একগুচ্ছ শুকতারা পর্ব-১৮+১৯

0
148

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

১৮. (অর্ধাংশ)
মাহাথিরের অফিসের একটা ভালো নিয়ম আছে। যে আগে কাজ শেষ করবে চাইলেই সে ম্যানেজারকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় চলে যেতে পারে। তবে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত থাকা আবশ্যক। মাহাথির, আনাস প্রায়ই আগে কাজ শেষ করে চলে যায়। তবে মাহাথির এখন ইচ্ছে করেই অতিরিক্ত সময় ধরে কাজ করে, আর আনাস করে কিছু কাজ জমা থাকার কারণে। অফিস বলতে গেলে প্রায় ফাঁকা’ই।

মাহাথির শ্রুতির ফোন কেটে দেওয়ার পরেই দেখতে পেল আনাস নিজের টেবিল ছেড়ে উঠে আসছে। চেহারায় বিরক্তি বেশ ভালো ভাবেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

‘কি সমস্যা?’ মাহাথির আনাসের প্রতিক্রিয়া দেখে প্রশ্ন করল।

‘ফোনটা কার ছিল?’

‘বিভার ছোটবোনের।’

‘সিরিয়াসলি মাহাতির! তুই বিভার বোনকে এইসব বললি?’

‘হ্যাঁ, তো?’

‘আমার জাস্ট তোকে কিছু বলার নেই। ভেবেছি খালাআম্মাকে হয়তো বলেছিস। তাই আসিনি। ভেবেছি জানার দরকার, উনার গুণধর ছেলের কাহিনী। কিন্তু তুই…….তুই খুবই নিচু মানসিকতার একটা কাজ করে ফেললি। তুই তো এমন না; তুই বদ/রাগী, মেজাজী, জেদি কিন্তু খারাপ নস। তাহলে এইসবের মানে কী?’ আনাসের কণ্ঠে হতাশায় ঠাই পাচ্ছেনা।

‘তোর এতো খারাপ লাগার কী হলো?’

‘খারাপ লাগছে। কারণ তুই একটা জ/ঘন্য কাজ করেছিস।’

‘কোনো জ ঘন্য কাজ করিনি। বিভার বোন আমার ফোন দিল কেন?’

‘জাস্ট এতোটুকুই? ফোন দিবেনা কেন তুই বল? তুই ওর বড় বোনের স্বামী। ফোন দিবেনা? আর ফোন দিয়েছে বলে তুই নিজেদের ব্যাপার ওকে জানিয়ে দিবি? এতোটা অবুঝ তুই? মিনিমাস সেন্স নেই? কা পুরুষের মতো কাজ করলি তুই একটা।’

‘আনাস, ভালো লাগছে না। আর তোর এতো কী যায় আসে আমার কাজকর্মে?’

মাহাথিরের কথায় আনাস নিভে গেল। এতোক্ষণ জোড়ে জোড়ে কথার কারণে ঘেমে গেছে, হাঁপাচ্ছে। নিজেকে থামিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘আমার কিছু যায় আসেনা, মাহাথির। কিন্তু তোর যাবে আসবে। যখন নিজের ভুলগুলো বুঝতে পারবি সেদিন তোরই সবচেয়ে বেশি যাবে আসবে। আর আমার যায় আসে বলতে আমার জীবনে কোনো বন্ধু কোনোকালেই ছিলনা। তুই প্রথম এবং শেষ। তাই শুধু চেয়েছিলাম নিজের বন্ধুটা যাতে ভালো থাকে; নিজেকে নিয়ে যাতে আর ছন্নছাড়া না থাকে। কারণ আমি জানি, সে যতোই উপরে উপরে রাগ ঝাড়ুক, তার মন অনেক ভালো। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তোর মনটাও জ ঘন্য। নয়তো এমন নিচু কাজ করতে পারতিনা।’

আনাস নিজের টেবিলে ফিরে নিমিষেই কাগজপত্র গুছিয়ে ফেলল। ব্যাগ নিয়ে বের হতে নিবে, তখনি মাহাথির ডাকল,
‘কোথায় যাচ্ছিস?’
‘জাহান্নামে…….আমার তো ১টা বউ আছে। সে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তার অপেক্ষা দীর্ঘ করাতে চাইছিনা তাই বাসায় যাচ্ছি। কোনো জ ঘন্য, খারাপ মানুষের সাথে আপাতত সময় কাটানোর ইচ্ছা নেই।’

মাহাথির ভ্রু কুঁচকে আনাসের কথা শুনল। আনাসের থেকে চোখ সরিয়ে নিজের ফোনের দিকে তাকাল। যেখানে উঠে আছে তার অতি পরিচিত এক নাম্বার। নিচেই একটা সবুজ আর লাল চিহ্ন। মাহাথির ফোন কানে তুলল।

.
মাহাথির বাইক চালাচ্ছে। তার মন ভীষণ খারাপ। সে নিজের উপর ভীষণ বিরক্ত অনুভব করছে। সে এমন কেন? তার কেন এতো রাগ? কেন অন্যের পরিস্থিতি বুঝে সে রিয়্যাক্ট করেনা? কেন নিজের দিকটাই শুধু বিবেচনা করে সে? কেনইবা এতো রাগ হয় তার; যেখানে অপরপক্ষকে দোষী মনে হয়; মনে হয় সে কেন আমি যা চাই তা সে করছে না? নাহ….আর রাগ করা যাবেনা। রাগ কমাতে হবে। সে আর কারোর উপর রাগ করবে না। না মানে না।
এই প্রতিজ্ঞা সে আগেও করেছে, কিন্তু পূরণ করতে পারেনি। এইবার পূরণ করেই ছাড়বে।

নিজেকে অনেক কিছু বুঝাচ্ছে মাহাথির। সাথে এটাও বুঝাচ্ছে যে, বিভার ওপরও রাগ দেখাবে না, ওকে ইগনোর করবে। তাহলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

মাহাথির বেশ অনুতপ্ত। মাঝেমধ্যে আমরা এমন সব খারাপ কাজ করে ফেলি। যা করার পর শুধরে নেওয়ার কোনো সুযোগ থাকেনা। মাহাথিরের মনে হলো সেও এই ধরনের কাজ করেছে। আনাস যাওয়ার পর ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল আনাসের কথা ভেবে। তখন মনে হলো, সত্যিই সে খুব নি চু ১ টা কাজ করেছে। এটা না করলেও হতো। কিন্তু এখন শুধরাবে কীভাবে? সাথে বন্ধুকেও কষ্ট দিল। তবে আনাসকে চেনে সে, কালই এসে বকবক শুরু করবে। তাদের তো কতোই এমন ঝগড়া হয়।

বাজারে এসে থামল মাহাথির। বিভা তখন ফোনে বলেছে যে বাসায় কিছুই নেই, শাকসবজি,মাছ নিয়ে যেতে। মাহাথির বাজারে ঢুকল।
শাকসবজি দরদাম করে মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিতে গিয়েও দিল না। শ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আজ সবজি নিব না। রেখে দেন।’
বলেই হাঁটা ধরে চলে গেল মাংসের দোকানে। শ্রুতি বলছিল ওরা পরশু আসবে, আসলে বিভাই বা কী রান্না করে দিবে — সেই ভাবনা থেকেই কিছু ভালোমন্দ বাজার করল।
সে আরেকবার নিজেকে ধিক্কার জানাল। সে বিয়ে করে না’ই খুশি থাকতে পারে, কিন্তু বিয়ে তো হয়েছে। সে খারাপ আছে বলে শ্রুতি ওর বোনের বাড়িতে আসবে না? তার নিজের ভাইবোন থাকলেও তো আসত। আসত না?
মাহাথির বাইকে উঠতে উঠতে নিজেকে বুঝাল, এতো বাজার সদাই হলো কেবল তার শ্রুতির প্রতি করা খারাপ ব্যবহার এর সরি স্বরুপ। এরপর আর এই ব্যাপার নিয়ে ভাববে না সে। অতিরিক্ত ভেবে ফেলছে এই বিভা-শ্রুতিকে নিয়ে। এছাড়া আরোও ভাবল, কাল ২ তারিখে শ্রুতিকে ফোন করবে। বলবে যাতে নিজের বোনের বাড়িতে আসে।
নিজেকে এও বুঝাল, সে শুধুমাত্র নিজের দায়িত্ব পালন করছে। বিভার প্রতি ভালোলাগা কিংবা ভালোবাসা কোনোটাই নেই, ইহজনমে হবেওনা। শুধুমাত্র সংসার করবে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে এই যা….সমাজ ওদের বেঁধে তো দিয়েছে কিন্তু মন বাঁধতে পারেনি। দুটো মন নিজেদের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশজুড়ে।

______
চলবে~
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

১৮. (বাকি অংশ)
ইংরেজিতে জুলাই মাস চলছে। বাংলাতে কী মাস চলছে বিভা জানেনা। হিসাব করলে বের হবে, করতে ইচ্ছে করছেনা। বাহিরের জানালা দিয়ে কী সুন্দর ঠান্ডা বাতাস! অথচ দুপুরেই কতো গরম ছিল; চামড়া পুরে যাওয়ার মতো গরম।
আজ অনেকদিন পর ভার্সিটি গিয়েছিল বিভা। অর্নাস এর চার বছরকে সে পাঁচ বছরে নিয়ে এসেছে। এরপর কতো বছরে গিয়ে থামবে তা তার জানা নেই।

আজ অনেকদিন পর দাদিআম্মার সাথে কথা হয়েছে। ব্যস্ততায় প্রায় ভুলেই বসেছিল।
মানুষটার হাঁটুর ব্যথা বেড়েছে, আগের মতো চলাচল করতে পারেনা। রুমেই নাকি থাকে সারাদিন। সময় নিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে একদিন। তার ছেলে তো ফিরেও তাকাবে না মায়ের দিকে। তাকাবে না — ব্যাপারটা এমন নয়। আসলে সে ব্যস্ততায় সময়ই বের করতে পারেনা; তার স্ত্রীও যে নিজের শ্বাশুড়ির অসুস্থতা সম্পর্কে তাকে অবগত করবে এতো ভালো বউভাগ্য আমিনার জুটেনি। আচ্ছা একটা লোক এতো খারাপ কেমন করে হতে পারে? না সে স্বামী হিসেবে ভালো, না সে বাবা হিসেবে ভালো, আর না ছেলে হিসেবে। তবে মানুষটা অনেক পরিশ্রমী। পরিশ্রমের একমাত্র লক্ষ্য — টাকা ইনকাম। এতো টাকা ইনকাম করে কী হবে? সে যখন অসহায় বোধ করবে তখন কী টাকা তাকে ভরসা দিতে পারবে? সে যখন একাকিত্ব অনুভব করবে তখন কী টাকা তাকে সঙ্গ দিতে পারবে? জীবনে সবকিছুরই প্রয়োজন আছে, তবে তা নির্দিষ্ট পরিমাণে।

রাত ১২ টার পর ৩ জুলাই হবে। বিভার জন্মদিন। বিভা জানে আজ তার জন্মদিন। সে অপেক্ষা করছে শ্রুতির ফোনের। তাকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য একমাত্র তার ছোটবোন’ই তো রয়েছে।
অনেকক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন ফোন এলো না বিভা মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল কয়টা বাজে। ১২ টা ১৭ বাজে। শ্রুতি ফোন করল না যে!
প্রতিবার শ্রুতি, হামিম, দাদিআম্মু ভীষণ যত্ন করে বিভাকে জন্মদিনের উইশ করে। বিভার ভালো লাগে। মনে হয় এই পৃথিবীতে কেউ তো আছে যাদের কাছে সে মূল্যবান। দাদিআম্মুর যে এতো বয়স হয়েছে, তবুও সে দুপুরেই বিভাকে অনেক দোয়া দিয়ে দিয়েছে। সে যে মনে রেখেছে এই কতো!
কিন্তু শ্রুতির ব্যাপারটায় একটু খারাপ লাগল। মূহুর্তেই ভাবল শ্রুতি হয়তো ভুলে গিয়েছে কিংবা কাল ফোন করবে। এর আগে তো দুইজন দুইবাড়িতে না, একবাড়িতে ছিল। তাই অন্যান্য বছরের সাথে এই বছরের তুলনা চলে না।

বিভা পাশে তাকাল। মাহাথির নিজের মতো কাগজপত্রে কী যেন লেখালেখি করছে। মাহাথিরকে একবার ভাবল ডেকে বলবে যে, আজ তার জন্মদিন। থাক…কী দরকার? কাজ করছে, করুক।

বিভা নিঃশব্দে উঠে গেল। ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করে চলে গেল অন্যরুমে।
মাহাথির রুমের দরজায় তাকাল। অন্য রুমের আলোর প্রতিফলন বুঝিয়ে দিল যে অন্য রুমের লাইট জ্বালানো হয়েছে। কিছু একটা ভেবে মাহাথির নিজের ফোনের পাওয়ার বাটন অন করল। ৩ জুলাই। মেয়েটার জন্মদিন। তার কী উইশ করা উচিত ডেকে?
ফোন অফ করে কাজে মনোযোগ দিল মাহাথির।

.
বিভা তার মা তাহিরার ডায়েরি খুলল। ডায়েরিতে মোটামুটি তাহিরার কৈশোর থেকে বেঁচে থাকার আগ পর্যন্ত প্রায় অনেক কিছুই লেখা আছে। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি। বেঁচে থাকতে এই ডায়েরি কেউ পড়েনি। শেষ মূহুর্তে বিভাকে ডায়েরিটা দিয়ে শুধুমাত্র বলেছিল, এই ডায়েরি যাতে কেউ না পড়ে, কারোর হাতেই যাতে না পড়ে।
বিভা কারোর হাতে পড়তে দেয়নি। তবে শ্রুতিকে একবার দিয়েছিল। শ্রুতি কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে আর পড়েনি, ফেরত দিয়েছে বিভাকে। শ্রুতির ভাষ্যমতে, ডায়েরি পড়লে তার মায়ের কথা বেশি মনে পড়ে, এতে তার দুঃখ আরোও বেশি হয়, কান্না পায় – তাই সে পড়ে না। পক্ষান্তরে, বিভার ডায়েরিটা পড়তে ভীষণ ভালো লাগে। মনে হয় সে তার মায়ের সাথে কথা বলছে। এই ডায়েরির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার পড়া। পৃষ্ঠা উল্টিয়ে উল্টিয়ে নিজের প্রিয় পৃষ্ঠা বের করল। বের করে পড়তে লাগল-

| আজ ৩ জুলাই। আমার জীবনের কিছু শ্রেষ্ঠ দিনের মধ্যে একটি। আজ আমি এক ফুটফুটে ফুলের মতো মেয়ের মা হলাম। মহান আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা আমার নেই। জীবনে তো তেমন কোনো ভালো কাজ আমি করিনি, তাহলে এমন ফুলের কলি আমার গর্ভে জন্ম নিলো কেমন করে?

আমার মেয়ের নাম রেখেছি বিভা। অনেক যত্ন করে এই নামটা আমি রেখেছি। বিভা নামের অর্থ দীপ্তি, সৌন্দর্য। আমার মেয়ের নাম সার্থক।

আজ আমার ভাইয়ের বউ আমার মেয়েকে দেখতে এলো। বলল মেয়ে নাকি কালো হয়েছে, আমার রঙ পায়নি। অথচ আমার মেয়ের দিকে তাকালে তার সৌন্দর্যে আমার কান্না চলে আসে। কী সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে আমার! মাশ-আল্লাহ!

আমার নাম তাহিরা ইবনাত। এতোদিন সবাই আমাকে তাহিরা বলে ডাকত। অথচ এখন আমাকে সবাই ডাকে ‘বিভার মা’ বলে। কথাটা শুনতে এতো শান্তি লাগে! মনে হয় এই পৃথিবীতে এরচেয়ে সুন্দর শব্দ আর হতে পারেনা। আমি তাহিরা নই, আমি বিভার মা। |

বিভা মুচকি হেসে সব পড়ল। পড়তে পড়তে কখন চোখে পানি চলে এলো বুঝল না। পুরো ডায়েরি জুড়ে তাকে নিয়ে তার মায়ের শত শত পাগলামি আছে। শ্রুতির বেলায়ও বাদ যায়নি। শ্রুতির বাচ্চামো, অবুঝপনা নিয়ে তাহিরার কতো আবেগ! তার এবং শ্রুতির প্রতু অনুভূতি তো ডায়েরিতে জায়গা পেল, শুধু পেল না হামিমের প্রতি অনুভূতি। তবে সেই ডায়েরিতে হামিমকে নিয়েও ১ টা লাইন আছে। লাইনটা কিছুটা এরকম – আজ আল্ট্রাতে ধরা পরেছে আমার ছেলে হবে। আমি দুই মেয়ে, এক ছেলের মা হবো। আমার ছেলে হলে তার নাম রাখব হামিম। বিভা, শ্রুতি, হামিম। আমার যত্নের তিন জীবন্ত পুতুল। আমি তাহিরা নই, আমি বিভা, শ্রুতি আর হামিমের মা।

বিভা নিঃশ্বাস ছাড়ল। কী হতো তার মা যদি হামিমকে দেখে যেত, কী হতো যদি আর কিছুদিন থেকে তার তিন জীবন্ত পুতুলকে আগলে রাখত?

বিভা ডায়েরিটা আবার খুলল। পরের পৃষ্ঠা গুলো পড়তে নিল কিন্তু আর পড়ল না। কারণ এই পৃষ্ঠা গুলোয় তার বাবাকে নিয়ে লেখা। বন্ধ করতে গিয়েও একবার চোখ বুলিয়ে নিল –

| মেয়ে হওয়াতে আমিন খুশি হয়নি তা আমি বুঝতে পারি। মেয়ে হয়েছে তার উপর গায়ের রঙ চাপা এইটাই আমিনের সমস্যা। এতোদিন শুধু ধারণা করেছিলাম, তবে আজ বুঝতে পারছি আমিন কখনো আমাকে ভালোবাসেনি, ভালোবেসেছে আমার সাদা রঙকে। তাই তো নিজের মেয়ের প্রতি এতো অবহেলা।
আচ্ছা, এমন একটা মানুষকে আমি ভালোবাসলাম কেমন করে? সে তো আমাকে ভালোবাসেনি, আমি কেন বাসলাম?|

ঠাসস করে বন্ধ করে দিল ডায়েরিটা। এইসব পড়ে মন খারাপের মানে হয়না….

.
শুক্রবার, দুপুর ১২ টা ৪০ মিনিট।
গাড়িতে বসে আছে শ্রুতি। তার পাশেই হামিম বসা। গন্তব্য – বিভার বাড়ি।
পার্থিব সকালে উঠেই চলে গেছে অফিসে। বলে গেছে, কাজ আছে। নামাজের পর পৌঁছে যাবে ঠিক সময়ে। শ্রুতি আর তেমন কিছু বলেনি।

গত পরশুর ঘটনার পর শ্রুতির কোনো ইচ্ছা ছিল না বিভার বাড়িতে যাওয়ার। পার্থিবের বুঝানো, সাথে গতকাল মাহাথির ভাইয়ার ফোনের কারণে যাচ্ছে। মাহাথির বেশ বিনীতভাবেই বলেছে আসার জন্য, সাথে আগেরদিনের কথা ভুলে যেতে বলেছে। কিন্তু শ্রুতি মোটেও ভুলবেনা।

শ্রুতি ঠিক করল বিভাকে গিয়ে আজ সব সত্যি জিগ্যেস করবে। এরপর মিস্টার মাহাথিরের চৌদ্দটা বাজাবে। যদিও পার্থিব তাকে বুঝিয়েছে স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারে অতিরিক্ত নাক গলানো দৃষ্টিকটু হবে। কিন্তু শ্রুতি তো নাক, কান, হাত, পা সব গলাবে।

.
কলিংবেল বাজছে। এই সময়ে কে? বিভা ভাতের চাল ধুতে নিচ্ছিল। পাতিল টা রান্নাঘরে রেখে কিছুটা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল। যাকে দেখল, তাকে দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলনা। আমিন শিকদার! কিন্তু এখানে কেন? এইভাবে না বলে কয়ে আসার মানে বিভা খুঁজে পেল না। পাশেই তার এসিস্টেন্টকে দেখে বিভা আরোও বিব্রতবোধ করল।

_____
চলবে~

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

১৯.
এই বাসায় এই সময়ে আমিন সাহেবকে আশা করেনি বিভা। সাথে আবার তার এসিস্ট্যান্ট ও আছে। বিভা সরে গেল দরজা থেকে। শান্ত, নিষ্প্রাণ কণ্ঠের বাক্য,
‘ভেতরে আসুন।’

আমিন সাহেব হাসি হাসি মুখে ভেতরে ঢুকল। সাথে ঢুকল তার সহকারী।
ভেতরে ঢুকে কাউকে না দেখে আমিন সাহেব একটু অবাক হলো। কেউ নেই কেন? হয়তো পৌঁছায়নি।
এবার চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল ফ্ল্যাট টা। তিন বেড, ডাইনিং, ড্রইং, বড় এক বারান্দা মিলে ছিমছাম ফ্ল্যাট। ডাইনিং রুমে নিতান্তই ছোট্ট ১টা খাবার টেবিল। সব দেখে হালকা কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করল,
‘এই বাসায় থাকতে অসুবিধা হয় না?’
তার প্রশ্নের পিছনে লুকায়িত বাক্য – এতোকাল এতো দামি দামি আসবাবপত্র ব্যবহার করে এখন বিভার অসুবিধা হওয়া উচিত।

‘না অসুবিধা হয়না। নিজের বাসায় অসুবিধা হওয়ার কথাও না। পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তির, নিরাপত্তার জায়গা হলো নিজের বাসা। আর এইটা আমার বাসা, যেখানে আমি নিজের ইচ্ছেমতো থাকতে পারি, যা খুশি করতে পারি। তাই এখানে আমার অসুবিধা হয়না।’
আমিন সাহেব যেমন নিজের করা প্রশ্নে নিজের আভিজাত্য বোঝাতে চেয়েছিল, বিভাও তেমন তার দেওয়া উত্তরে অপ্রকাশিতভাবে বুঝিয়ে দিল – আমিন সাহেবের বাসায় সে নিজের ইচ্ছেমতো থাকতে পারতো না, এখানে পারে এবং সে এখানে অনেক শান্তিতে আছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমিন সাহেব আর দ্বিতীয় প্রশ্ন করল না।

‘তুমি এখানে কী করছো?’
আমিন সাহেব সোফায় বসে ছিলেন। চোখ তুলে দরজায় তাকালেন। শ্রুতি দাঁড়িয়ে। হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমিন সাহেব বুঝতে পারলেন তাকে এখানে একদমই আশা করেনি বিভা, শ্রুতি।
শ্রুতি মুখ কুঁচকে পাশে থাকা হামিমের হুইল চেয়ার ধরে ভেতরে ঢুকল। বিভা এগিয়ে এলো ভাই-বোনের কাছে। শ্রুতির দিকে তাকাল। শ্রুতির মুখের প্রতিক্রিয়ার অর্থ – তার দিনটাই খারাপ হয়ে গেলো। বিভা কিছু বলল না। আমিন সাহেবের সামনে তার অস্বস্তি হয়, মুখ দিয়ে কথা বের হয়না।

শ্রুতি মুখ কুঁচকে আবার জিগ্যেস করল,
‘আপনাকে এখানে কে আসতে বলেছে আমিন শিকদার? আসছেন কেন?’
আমিন সাহেব বিরক্তবোধ করল। একটু আগেই তুমি করে ডাকল এখন আবার নাম ধরে ডাকছে; তাও তার সহকারীর সামনে। বিরক্ত হয়ে শাসন করতে চাইল, ‘এইসব কেমন আচরণ শিখেছো তুমি? আগের থেকেও দেখি বে য়া দব হয়েছো।’

‘হ্যাঁ, আমি বে য়া দব। আপনাকে অনুরোধ করছি এই বে য়াদ বের সামনে থেকে চলে যান প্লিজ। কী কারণে আসছেন বলেন তো? কী সমস্যা?’ শ্রুতি অধৈর্য হয়ে পড়ল। কী করবে ভেবে পেল না। এই মানুষটাকে সে সহ্যই করতে পারেনা।

‘অ স ভ্যের মতো ব্যবহার থামাও। তোমাদের সাথে দেখা করতে আসিনি। শুনেছিলাম পার্থিব এখানে আসবে, তাই ওর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। ওর সাথে দেখা হলেই চলে যাব। আর এখানে থাকেই বা কে! যা অবস্থা বাড়ির…..’

বিভা বুঝতে পারল তার ঘরকে অবজ্ঞা করা হলো। মুখ শক্ত হয়ে ভ্রু কুঁচকে গেল। সে কিছু বলার আগেই শ্রুতির ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে বলল,
‘ঠিক বলেছেন। আসলেই যা অবস্থা…এই সুন্দর বাড়িতে তিন তিনটা ফুলের মাঝে আপনি ১ টা নোং রা কীট। বড্ড বেমানান!’

‘শ্রুতি, আর ১ টা বাজে কথা বললে আমার হাতের থা প্প ড় খাবে তুমি।’ সহকারীর সামনে শ্রুতির ব্যবহারে রাগে ফেটে পড়ল আমিন সাহেব।
বিভা গম্ভীর কণ্ঠে শুধুমাত্র বলল, ‘আমার বোনকে বকার অধিকার কিংবা আমার বাড়ি নিয়ে কিছু বলার অধিকার, কোনোটাই আপনার নেই। সেই দুঃ সা হস দেখাবেনও না। অতিথি হয়ে এসেছেন, অতিথির মতো থাকুন।’
আমিন সাহেবও আর কথা বাড়ালেন না।

অনেকদিন পর আজ আবার পার্থিবকে মনে মনে বকল শ্রুতি। ফা লতু লোক ১টা! উনার জন্য আমিন শিকদার এখানে এলো। এখন সুন্দরভাবে দিনটা কাটানোই হবেনা।

.
দুপুর ২ টা বাজে।
শ্রুতি, হামিম বসে আছে দূরে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে। আমিন, তার সহকারী বসে আছে সোফায়। সামনে জুসের গ্লাস। সিংগেল সোফায় বসে আছে মাহাথির। নামাজ পড়ে কিছু ফল, জুস, কেক নিয়ে বাসায় ঢুকেছে সে। এরপর আমিনকে দেখে সাধারণ কুশলাদি বিনিময় করেছে।

আমিন সাহেবের যে খুব পার্থিবের সাথে দেখা করার ইচ্ছে — ব্যাপারটা তেমনও নয়। আজ আসাদ সাহেবকে ফোন দিয়েছিলেন পারিবারিক খোঁজখবর নিতে। তখন তার থেকে জানলেন আজ শ্রুতি, পার্থিব বিভার জন্মদিন উপলক্ষে এখানে আসবে। কথার এক পর্যায়ে আসাদ সাহেব প্রশ্ন করে বসল, আপনি বিভার বাড়িতে যাবেন না?
উত্তরে সরাসরি না বলা যায়না। বিভা তার বড় মেয়ে। মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে সে যাবেনা শুনতে বাজে লাগে। ঝোঁকের বসে বলে দেয়, জ্বি যাব। পার্থিবের সাথে দেখা হবে, ভালোই হবে।
তাই সে বাধ্য হয়ে এসেছে। কারণ সে যদি না আসে, পার্থিবকে যদি এই ব্যাপারে আসাদ সাহেব জিগ্যেস করেন, তখন সত্যিটা জেনে তো তাকে মিথ্যাবাদী ভাববে; যা সে চায়না। তার সাথে মিলে ব্যবসায় অনেক লাভ হচ্ছে, কিছুতেই তার চোখে নিজ বিষয়ক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে দেওয়া যাবেনা।

শ্রুতি হাতে ফোন নিয়ে বসে আছে। পার্থিব কোথায় গেছে কে জানে! আসছে না কেন? এতো দেড়ি হওয়ার কারণ কী? বলল নামাজের পড়ে চলে আসবে। অথচ এক নামাজের ওয়াক্ত গিয়ে আরেক নামাজের ওয়াক্ত চলে এলো তার খবর নেই।

টেবিলে গরু মাংস, ভাত, তরকারি রাখল বিভা। আজ সকালে মাহাথির বলেছিল গরু রান্না করতে। তাই করেছিল সে। বিভা বুঝতে পেরেছে তার জন্মদিন উপলক্ষেই শ্রুতি, হামিম এসেছে। তার চেয়েও অবাক করা বিষয় – মাহাথির ঘরে ঢুকে রান্নাঘরে এসে কেকসহ সবকিছু বিভার হাতে দিয়ে সাধারণভাবে তাকে উইশ করেছে। জাস্ট তিনটা শব্দ — শুভ জন্মদিন বিভা। না কণ্ঠে কোনো উচ্ছ্বাস, না কোনো আবেগ। তাও এই তিনটা শব্দ বিভার কানে এতো মধুর শুনাল যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। তার উপর, ফিরোজা রঙের পাঞ্জাবিটা তার স্বামীকে একটু বেশিই মানিয়েছে।

কলিংবেল বাজল। শ্রুতি এমন ভঙ্গিতে উঠে গেল যেন দরজাটা খুলেই মাথার মাঝখানে এক বারি বসাবে। ভাবল পার্থিবকে অনেক কঠিন কথা শোনাবে সে।
যা ভাবল তার কিছুই শ্রুতিকে দিয়ে হলোনা। দরজার ওপাশে পার্থিব দাঁড়িয়ে আছে, পরনে ঘামে ভেজা নীল পাঞ্জাবি, মুখে অমায়িক হাসি।
পার্থিবের হাসি দেখে নিভে গেল শ্রুতি। কিছুই বলল না। পার্থিবই বলল,
‘এতো দেড়ি হয়ে যাবে সত্যিই বুঝতে পারিনি। সরি। রাগ করবেন না প্লিজ। রাগ করেছেন?’

‘না, করিনি। ভেতরে আসুন।’’

‘রাগ করেও বলছেন রাগ করেননি। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আপনার চোখে রাগ, ভ্রুও কুঁচকে আছে। বেশি রাগ করেছেন?’

শ্রুতি বুঝতে পারল পার্থিব তাকে জ্বালাচ্ছে, ‘বাহিরেই থাকবেন নাকি ভেতরে আসবেন? দরজা বন্ধ করব?’

পার্থিব হেসে দিয়ে ভেতরে ঢুকল। শ্রুতি খেয়াল করল পার্থিবের হাতে অনেক ব্যাগ।

পার্থিব ড্রইংরুমে ঢুকল। বিভার কাছে গিয়ে সুন্দর হাসি উপহার দিয়ে বলল, ‘শুভ জন্মদিন আপা।’
বিভাও মিষ্টি হাসল। কী সুন্দর শুনালো পার্থিবের মুখে আপা ডাকটা। উত্তর দিল, ‘থ্যাংকিউ।’

‘এই নিন, এখানে বিরিয়ানি, মোরগ পোলাও আছে। আপনাকে কিছু রান্না করতে হবেনা। সব নিয়ে এসেছি। আজ দুপুর-রাত সবাই একসাথে মজা করে খেয়ে এরপরই যাব।’
বিভা অবাক হয়ে সবকিছু হাতে নিল। একা পারছিল না বলে শ্রুতি সাহায্য করল। ব্যাগ নিয়ে ওরা রান্নাঘরে চলে গেল।

পার্থিব এগিয়ে গিয়ে মাহাথিরের সাথে হ্যান্ডশেক করে নিল।
আমিন সাহেব নিজে থেকে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন পার্থিবকে। পার্থিব তার শ্বশুরকে এখানে আশা করেনি। তবুও তা মুখে কিছুই প্রকাশ না করে কথা বলতে লাগল সবাই মিলে।

মাহাথির ফোন আনতে ঘরে যাবে এমন সময় চোখ পড়ল হামিমের ওপর। টেবিলে মাথা দিয়ে শুয়ে আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করার চেষ্টা করছে। হামিমকে দেখে ভীষণ মায়া হলো মাহাথিরের। ওকে আগে সেভাবে খেয়াল করেনি, আজ বেশ ভালোভাবেই খেয়াল করেছে। হামিমের সাথে তার কোনো মিল নেই, তবুও নিজের সাথে হামিমের মিল খুঁজার চেষ্টা করল। নেই, দুজনের জীবনে কোনো মিল নেই।

.
সবাই টেবিলে বসে খাওয়া-দাওয়া করছে। বিরিয়ানির সাথে বিভার গরুর মাংসও নিচ্ছে। কেবলমাত্র বিভা, শ্রুতি বসেনি। তারা সবাইকে বেরে দিচ্ছে। শ্রুতি বেরে দিতে গিয়ে আমিন সাহেবের সহকারীর সাদা পাঞ্জাবিতে ঝোল ফেলে দিয়েছে। ফেলার পর শুধু গম্ভীরমুখে বলেছে,
‘ইচ্ছে করে ফেলিনি। সরি।’
আমিন সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে যখন দেখল শ্রুতির দিকে সে গম্ভীরমুখে তাকিয়ে আছে, তখন শ্রুতির ইচ্ছে করল সহকারীর মাথায় পুরো মাংস ঢেলে দিতে। সে তো ইচ্ছে করে ফেলেনি, তাহলে এইভাবে তাকানোর মানে কী? এখন ইচ্ছে করে ফেলুক, এরপর না হয় এইভাবে তাকানো সহ্য করবে। শ্রুতি চলে গেল হামিমকে খাওয়াতে।

বিকেল হয়েছে। সবাই খাওয়া-দাওয়ার শেষে টুকটাক কথা বলছে। শ্রুতি-বিভার মুখজুড়ে অন্ধকার। তাদের মুখে কোনো কথা নেই। এর কারণ হয়তো আমিন সাহেব।
একটুপরেই আমিন সাহেব চলে যাবেন। তাই মাহাথির বলল কেক কে টে যেতে। তার কথায় আমিন সাহেবকে তেমন গুরুত্ব দিতে দেখা গেল না। একই কথা যখন পার্থিব বলল, আমিন সাহেব রাজি হয়ে গেল। বিভা উঠে চুপচাপ কেক নিয়ে এলো। তার এখন মনে হচ্ছে, আজ তার জন্মদিন না হলেও পারতো।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিভা একপাশে শ্রুতি, হামিমকে নিয়ে এবং অন্য পাশে আমিন সাহেবকে নিয়ে কেক কাটল। বিভা কেক এর পিস নিয়ে সর্বপ্রথম শ্রুতিকে খাইয়ে দিল। হামিমকে খাওয়াতে গিয়ে দেখল হামিম পানি খাওয়ার জন্য একাই দূরে চলে গিয়েছে। পিছন ঘুরতে গিয়েই দেখতে পেল আমিন সাহেব তার মুখে সামনে কেক ধরে আছে। ভীষণ অস্বস্তিকর মূহুর্ত!
আমিন সাহেবের কাজের পেছনের অর্থ যে তাদের বাবা-মেয়ের সম্পর্ক স্বাভাবিক আছে তা বোঝানো — এটা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে বিভা।
বিভা অযথা ঝামেলা কোনোকালেই চায়নি, আজও চায়না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আমিন সাহেবের হাত ধরে কেক তাকেই খাইয়ে দিল। এরপর হাত ধুয়ে এসে সবার জন্য কেক কাটতে লাগল।
সবাইকেই ছোট পিরিসে কেক দেওয়া হলো।

মাহাথির কেক খেতে নিয়েও খেলো না। ঘাড় ফিরিয়ে হামিমের দিকে তাকাল।
হামিম দূরে একুরিয়াম এর মাছের সাথে খেলা করছে। মাছের সাঁতার কাটা দেখছে। অন্যদিকে তার কোনো ধ্যান-জ্ঞান নেই। মাহাথির উঠে চলে গেল হামিমের কাছে। এরপর সুন্দর করে হামিমকে কেক খাইয়ে দিল।
বিভা ফল কেটে সবার সামনে দিলে, মাহাথির এসে ফল নিয়েও হামিমকে খাইয়ে দিল।

ইতঃমধ্যে এই দৃশ্য সকলের চোখে পরে গেল। বিভাও নির্নিমেষ চেয়ে আছে দুজনের দিকে। মাহাথির সকাল থেকেই স্বাভাবিক আচরণ করছিল, তাই বলে এতোটাও বিভা আশা করেনি।

আমিন সাহেব উঠে পড়েছেন। তার চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। সে উঠে নিজের ছেলের দিকে গেল। হাতে থাকা টিস্যু দিয়ে হামিমের মুখ মুছে দিতে দিতে হেয়ালি প্রশ্ন করল,
‘তুমি তো অপরিচিত কারোর হাতে খাবার খাওনা, তাহলে আজ খেলে যে?’

পার্থিব ভ্রু কুঁচকে ফেলল। মাহাথির ভাই অপরিচিত কেন হবে? বোনের স্বামী অপরিচিত হয়?

মাহাথির এতোক্ষণে বেশ ভালোই বুঝেছে যে — লোকটা তাকে পছন্দ করেনা। অবশ্য এতে তার কিছুই যায় আসেনা। তার গ ণ্ডা রের চামড়ায় সহজে কিছু গায়ে লাগলে তো।

হামিম সচরাচর আমিন শিকদারের সাথে তেমন কথা বলেনা। কোনোদিন কোনো প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়নি, চুপ থেকেছে। এনার প্রতি আলাদা এক ভয়, আ তংক সবসময়ই হামিমকে ঘিরে রাখে।
এছাড়া এমনিতে সাধারণ সময়ে হামিম কিছু না বুঝলে অতিরিক্ত প্রশ্ন করে অবুঝের মতো। অথচ আজ সবাইকে অবাক করে দিয়ে সামনের দিকে আঙুল তাক করে বিজ্ঞ শিশুসুলভ কণ্ঠে বলতে লাগল,
‘ও আমার একটা ফ্রেন্ড। আমার ভাইয়া হয়। সে বলেছে সে আমার আপোর হাসবেন্ড। আর আপোর হাসবেন্ডরা নাকি খুব ভালো হয়। তাই আমি তার সাথে কথা বলি, গল্প করি, ছবি আঁকি। সে তো ছোট আপোর হাসবেন্ড।
আজ বড় আপোর কাছে এলাম। বুঝলাম এও আমার আপোর হাসবেন্ড। তারমানে এও ভালো। এও আমার ফ্রেন্ড। তাই আমি তার হাতে খেয়েছি।’

হামিম প্রথম পার্থিব এবং পরে মাহাথিরকে তাক করে ঢিমেতালে বলে শেষ করল কথাগুলো। হামিমের কথা শুনে শ্রুতি পার্থিবের দিকে তাকাতেই দেখল পার্থিব সুন্দর এক হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে হামিমের দিকে। শ্রুতি তারাতাড়ি চোখ সরিয়ে নিল। এই লোকের হাসি কী সত্যিই সুন্দর? নাকি শ্রুতির চোখে ছানি পড়েছে? কেমন বুক ‘ধ্বক’ করে ওঠা হাসি হাসে। শ্রুতি ঠিক করল আর পার্থিবের দিকে তাকাবে না। কক্ষনো না…..

এদিকে হামিমের কথা শুনে মাহাথির হেসে দিয়ে হামিমের গোল গোল চুলগুলো হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিল। হামিম ভেবে পায়না সবাই তার চুল এলোমেলো কেন করে। সে এক আঙুল দিয়ে নিজের চুল কপাল থেকে সরিয়ে ফেলল।

.
আমিন সাহেব চলে গেছে অনেকক্ষণ হয়। সে থাকাকালীন তার ক্যামেরায় কিছু ছবি তোলা হয়েছিল। সে যাওয়ার আগে তার সহকারী নিচে থেকে ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো বের করে নিয়ে এসেছে একটা খামে করে। শ্রুতির হাতে দিয়ে গিয়েছিল সেই খাম।

আমিন সাহেব যাওয়ার পর থেকেই পার্থিব এক নতুন শ্রুতিকে আবিষ্কার করছে। কী সুন্দর হেসে খেলে কথা বলছে। শ্রুতি তার আপার সাথে, ভাইয়ের সাথে যথেষ্ঠ প্রাণোচ্ছল থাকে। এইভাবে অন্য কোনো সময় দেখেনি পার্থিব। তবে দেখতে ভালো লাগছে।

দুই সিটের সোফায় মাহাথির, পার্থিব বসে আছে। তাদের একদম বিপরীত পাশের সোফায় বিভা, শ্রুতি। বিভার পাশে হামিম। বিভা, শ্রুতি মিলে কথা বলছে। মাহাথির, পার্থিব নিরব দর্শকের ভূমিকায় আছে। তারা দুজন খামের ছবিগুলো দেখছে। পার্থিব বলল,
‘ছবিগুলো সুন্দর হয়েছে।’

শ্রুতি উৎফুল্ল হয়ে বলল,
‘আপা, চলো ছবিগুলো দেখি।’

বলেই ছবিগুলো পার্থিবের হাতে থেকে নিয়ে এসে দুজন মিলে দেখতে লাগল। বিভার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। দুই বোনের মুখেই অন্ধকার।
প্রতিটা ছবিতে আমিন শিকদার আছে। তারা পাঁচজনই ঠিক ছিল, আমিন শিকদারকে থাকতে কে বলেছে। বিভা একটার পর একটা ছবি দেখতে লাগল। নাহ! কোনো ছবিই আমিন শিকদার বিহীন নেই। তার মুখের অন্ধকার যেন গাঢ় হলো।

শ্রুতি উঠে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলো একটা কেচি নিয়ে। বিভা বুঝল না শ্রুতি কী করবে। শ্রুতি বসে বসে খুব মনোযোগ নিয়ে ছবিগুলো থেকে আমিন শিকদারকে আলাদা করল। চারটা ছবির সাইডে ছিল আমিন শিকদার আর একটা ছবির মাঝখানে। শ্রুতি সেই ছবিরও তোয়াক্কা করল না। মাঝখান থেকে আমিন শিকদারকে গোল করে কেটে উঠিয়ে নিল। এরপর খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
‘দেখো আপা, আমিন শিকদারকে সরিয়ে দিয়েছি। এখন দেখো ছবিগুলো কী সুন্দর লাগছে!’

শ্রুতির থেকে এমন বাচ্চামো বিভা আশা করেনি। হঠাৎ করে বিভা হেসে দিল। এমন করে হাসল যে ওর মাড়ি প্রকাশ পেয়ে গেল। একটু শব্দ করে গা দুলিয়ে হাসতে লাগল বিভা। হামিম, মাহাথির, পার্থিব দুইবোনের দিকে তাকিয়ে রইল। হামিম হাতে নিয়ে ছবিগুলো দেখে বলল,
‘আপো তোমার তো হাত নাই হয়ে গেছে।’

শ্রুতি ভাইয়ের কাছ থেকে ছবি নিয়ে দেখল আসলেই কিছু ছবিতে তার একপাশ নাই হয়ে গেছে কারণ তার সামনেই আমিন শিকদার ছিল। তাই তাকে উপরে ফেলতে গিয়ে নিজের অর্ধেক অংশ’ই নাই হয়ে গেছে।
শ্রুতি আমলে নিল না। নিজের মতো বলতে থাকল, ‘হোক! আমার এক হাত প্রয়োজনে না থাকবে, তাও আমিন শিকদার থাকা যাবেনা।’
বিভার দিকে তাকিয়ে দেখল বিভা তখনো হাসছে। মুখে উজ্জ্বলতা।

মাহাথির, পার্থিব বেশ ভালোভাবেই বুঝল দুইবোন তাদের মনে তাদের বাবার প্রতি কতোটা ঘৃ ণা জমিয়ে রেখেছে। দুইবোনের কয়েক ঘন্টা আগের আর এখনের মূহুর্তে আকাশ পাতাল তফাৎ। যেই মুখ কিছুক্ষণ আগেও ছিল অন্ধকারে ঘেরা, সেই মুখে এখন শুধু উজ্জ্বলতা।

____
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ২১০৪
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান