একগুচ্ছ শুকতারা পর্ব-২৮+২৯

0
150

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

২৮.
বিভা, শ্রুতি, হামিম। তিন ভাই-বোন।
বলা যায় তিনজনই পরিস্থিতির চাপে শান্ত প্রকৃতির। বিশেষ করে বিভা, শ্রুতি।
তাদের দুইবোনের আচার-আচরণে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। দু’জনেই প্রিয় মানুষদের সামনে চঞ্চল, আবার দু’জনেই শান্ত। অমিল নেই ব্যাপারটা তেমনও নয়। বিভা-শ্রুতির মধ্যে সবচেয়ে বড় অমিল শ্রুতি ছোট থেকে যতো ঝা মেলা পাকিয়েছে, বিভা তার একভাগও পাকায়নি। উলটো সমাধান করেছে।
শ্রুতির ঝামেলা পাকানো যেন রক্তে মিশে গেছে। তাইতো এখনো একটা ঝামেলা পাকিয়ে ফেলেছে। নিজে নিজেই হামিমকে বিভা-মাহাথিরের কাছে দিয়ে এসেছে। এই কাজের পেছনের কারণ হলো পার্থিবের ওপর রাগ। পার্থিব লোকটার ভাব বহু বেড়েছে। তার সাথে কথা বলেনা। প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া মুখ দিয়ে কথা বেরই হয়না। তাকে এড়িয়ে চলে। শুধু হামিমের সাথে গল্প করে। মেনে নেওয়া যায় এইসব ভাব? তারওপর গতকাল নাকি আবার কোন কাজে চলে গেছে। তাই শ্রুতিও ভাইকে আপার কাছে দিয়ে এসেছে, পার্থিবকে না বলেই। এমনিতে পরিবারের সবার কাছেই বলেছে যে বিভা হামিমকে নিজের কাছে রাখতে চায়। বিভা কিছুদিন রাখার পর আবার সে নিয়ে আসবে। কেউ আর কিছুই বলেনি। আসাদ সাহেবও কেবল হামিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে আর শান্তকণ্ঠে বলেছে, সাবধানে যেও, দ্রুত ফিরে এসো বোনের কাছে।
তানহা বেগম অবশ্য জিগ্যেস করেছিল পার্থিব জানে কিনা এই ব্যাপারে। শ্রুতি বানোয়াট কাহিনী বলে বুঝিয়েছে।
এখন সে গাড়িতে বসে আছে। বাড়ির গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিল।
পার্থিব বাসায় ফিরবে পরশু। এই দু’দিনে নিশ্চয়ই জানবে হামিমের কথা। আর না জানলে আরোও ভালো। এসে হামিমকে না দেখে নিশ্চয়ই শ্রুতিকে জিগ্যেস করবে, রাগ করবে, তখন শ্রুতি সামনে থেকে দেখবে আর মজা নিবে। একদম ঠিক হবে। অস/ভ্য, বেয়া/দব, ফা/লতু লোকদের সাথে এমনই হওয়া উচিত।
শ্রুতি ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল। এতো ভালো কাজ সে করে কীভাবে?

শ্রুতির হঠাৎ মনে পড়ল দাদীর কথা। ঠিক করল কিছু ফলমূল নিয়ে দেখতে যাবে দাদীকে। মানুষটাকে শ্রুতি ভীষণ ভালোবাসে। আগে তো এই মানুষটাই তাদের আগলে রেখেছে। অথচ এখন তেমন করে কথাও হয়না। দেখা হয়েছে তাও দেড় মাস হয়। আগে যেখানে সারাদিন দাদীর সাথে কাটতো, এখন সেখানে পাঁচ/দশ মিনিট ফোনে কথা বলে রেখে দিতে হয়। সামনে থাকা আর ফোনে কথা বলা এক হয় বুঝি?

.
মাহাথির, হামিম, হাসিনা, সিদ্দীক সাহেব বসে আছে একসাথে। বিভা রান্নায় ব্যস্ত তার ভাইয়ের জন্য। আজ হামিম যা পছন্দ করে বিভা তাই রান্না করবে। হাসিনাও এতোক্ষণ যাবত রান্নাঘরেই ছিল। মাত্র এসে বসল ফ্যানের নিচে।
হামিমের সাথে হাসিনা, সিদ্দীকের যাবতীয় পরিচয় পর্ব শেষ। বর্তমানে হামিম আর মাহাথির মিলে Subway Surfers গেমস খেলছে একসাথে। শুধু শুধু বসে থাকার চেয়ে গেমস খেলে সময় পার করা অনেক ভালো। হামিম প্রথমে খেলতে চায়নি, মাহাথির নিজে নিজে খেলার পর সে ফোন টান দিয়ে বলল, আমি খেলব। এরপর দুজন মিলেই খেলা শুরু করল।
মাহাথির তাকিয়ে আছে হামিমের দিকে। হামিমের মুখটা স্বাভাবিক। খুব মনোযোগ দিয়ে গেমস খেলছে। দেখতে ভালো লাগছে মাহাথিরের কাছে। এরইমাঝে মায়ের ডাকে চোখ তুলে তাকাল মাহাথির,
‘ কিছু বলবেন আম্মা?’
‘ তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে।’ হাসিনার কণ্ঠটা বেশ দৃঢ় শোনাল।
‘ বলেন আম্মা। শুনছি তো।’
হাসিনা একবার রান্নাঘরের দিকে তাকাল। এরপর মাহাথিরের দিকে দৃষ্টি নিয়ে বলল,
‘ তুমি এখনো সম্পর্কটা স্বাভাবিক করো নাই?’
মাহাথির তাকিয়ে রইল। সে বুঝেছে তার আম্মার প্রশ্ন। তবে এই ব্যাপারে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবুও বলল, ‘ আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক আছে আম্মা।’

‘ মিথ্যা বলবানা মাহাথির। তোমার আচার আচরণে প্রকাশ পায় তুমি এখনো স্বাভাবিক হও নাই। মানো নাই বিয়াটা।’

মাহাথির কিছু বলল না। হাসিনা আবারো বলল নিষ্প্রভ কণ্ঠে, ‘ বিভা মাইয়াটা ভালো। অযথা কষ্ট দিও না। পরে পস্তাইবা।’

মাহাথির নিজের ঠাঁট বজায় রাখল, ‘ আমি তো বিভাকে কষ্ট দেই না আম্মা। ওকে কী আমি নির্যা/তন করি? জিগ্যেস কইরেন তো ওকে।’
ছেলের এমন কথায় আশাহত হলেন হাসিনা, ‘ শারীরিক নির্যা তনের থেকেও বড় মানসিক নির্যা তন। তুমি ওরে মানসিক ভাবে নি র্যাতন করতেসো।’
হাসিনার ভীষণ খারাপ লাগল। তার ছেলে এমন করছে কেন? সে কী বুঝতে পারছেনা যে এইভাবে সে নিজের জীবনটাকে নষ্ট করছে? হাসিনা দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘ সময় থাকতে মূল্য দেও। মন থেকে উইঠা গেলে কাঁইদাও কুল পাইবানা।’

মাহাথির হতাশ শ্বাস ফেলল। সবাই তাকে পেয়েছেটা কী? জোড় করে ভালোবাসবে কীভাবে? কথাটা ভেবেই মাহাথির নিজেই আবার ভাবল সে কী কখনো বিভাকে মন থেকে কখনো মানার চেষ্টা করেছে? সে তো জেদ ধরেই বসে আছে।

নিজের জেদের মধ্যে দিয়ে মাহাথির বুঝতেও পারল না যে সে মনে মনে বিভাকে মেনে নিয়েছে, শুধু উপরেই নাকচ করে। ইতোমধ্যে বিভা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে।

.
শ্রুতি বারান্দায় বসে আছে ভ্রু কুঁচকে। সে বর্তমানে তার মনের ইচ্ছেকে খু/ন করতে ব্যস্ত। তার মনের ইচ্ছা হলো পার্থিবকে খু/ন করা। অথচ সে এখন তা করতে পারছেনা। সকালে পার্থিব তাকে ফোন দিল। ফোন দিয়ে শুধু জিগ্যেস করল,
‘ শ্রুতি, আমি শুনলাম আপনি নাকি হামিমকে রেখে এসেছেন। কথাটা কী সত্যি?’
পার্থিব জানে, তবুও জিগ্যেস করা। শ্রুতিও গম্ভীরকণ্ঠে বলল, ‘ হ্যাঁ, সত্যি।’
‘ কাজটা কী ঠিক হয়েছে শ্রুতি? একবারো কী আমাকে বলা প্রয়োজন ছিলনা? মাহাথির ভাইকে বলেছিলাম আমি গিয়ে দিয়ে আসব। আমি আসা পর্যন্ত কী অপেক্ষা করা যেতনা?’

পার্থিবের প্রশ্নে শ্রুতির মনে হলো সে আসলেই ভুল করেছে। কিছুই বলল না সে। সত্যি বলতে আসলেই অনুতপ্ত বোধ হচ্ছে এখন।
অবশ্য এখন বোধ হয়েই বা কী হবে, যা করার তা তো সে করে ফেলেছে। শ্রুতি ভাবল সে সরি বলবে পার্থিবকে। শ্রুতির বলার আগেই পার্থিবের শান্ত কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘ ভালো থাকবেন শ্রুতি। রাখছি।’
শ্রুতি অবাক এবং মন খারাপ করে নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল।

কিছুদিন ধরে শ্রুতি একটা কাজ করছে। কাজটা ভীষণ ভয়ং/কর। আর তা হলো — নিজের শ্বশুর অর্থাৎ আসাদ সাহেবের সাথে সময় কাটানো। লোকটা গম্ভীর হলেও নরম তা শ্রুতি বুঝেছে। সেই থেকেই উনার ঘরে এসে চুপচাপ বসে বসে কথা বলে। অন্যান্য দিন সাধারণত রাতে কিংবা সন্ধ্যায় আসত। আজ হামিম নেই, সময় কাটছে না, সেই সাথে তার শ্বশুরও বাসায়। তাই আজ শ্রুতি বিকেলবেলাতেই এলো। সাথে নিয়ে এলো দু কাপ কফি, বিস্কিট।
ঘরে ঢুকতেই শ্রুতি দেখল তার শ্বশুর পাঞ্জাবি পড়ে চোখে চশমা দিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে কাজ করছে। এখনো শ্রুতিকে খেয়াল করেনি। শ্রুতি কী চলে যাবে? শ্রুতি ঘুরতে নিলেই তার গম্ভীর শ্বশুর সরল গলায় ডেকে উঠল,
‘ চলে যাচ্ছো কেন? আসো।’
শ্রুতি ঘুরে নিজের হাতের ট্রে সহ বসল ছোট টেবিলে।
আসাদ সাহেব শ্রুতির আনা কফি দেখে নিজের অপরপাশ থেকে চায়ের খালি কাপ নিচে নামিয়ে রাখল। কাজ করতে করতে সে চা খায়। চা তার ইতোমধ্যে খাওয়া শেষ। তবুও সে শ্রুতিকে কিছু বলল না। মেয়েটা শখ করে তার জন্য এনেছে, বাবা হিসেবে তার খাওয়া উচিত।
শ্রুতি ধীরে ধীরে কফির কাপ বাড়িয়ে দিল। আসাদ সাহেব তা দেখে হেসে ফেলল। মেয়েটা বাচ্চাদের মতো কাজ করে। আসাদ সাহেব ট্রে থেকে আরেক কাপ উঠিয়ে শ্রুতির দিকে দিয়ে বলল, ‘ বাবাও খাক, মেয়েও খাক।’
কথাটা শুনে শ্রুতি চমৎকার করে হেসে ফেলল। কী সুন্দর কথা!
কাগজপত্রের পাশে কিছু একটা লক্ষ্য করতেই আসাদ সাহেব ভ্রু কুঁচকে লাইন কেটে ফেলল।

পার্থিব এদিক থেকে অবাক হয়ে গেল। সে তার বাবার সাথে ভিডিও কলে ছিল। বাবার বয়স হয়েছে, অনেক কিছুই বুঝেনা। তখন পার্থিব তাকে সাহায্য করে। এতোবছর ধরে যে বাবা তাদের সাথে ব্যবসা সামলেছে এই কতোনা!
বাবার সাথে শ্রুতিকে নিয়ে পার্থিবে আগেও কথা হয়েছে। সে জানতে পেরেছে শ্রুতি তার বাবার সাথে গল্প করে। আজ চোখেও দেখে নিল। ভালোভাবে অবশ্য দেখেনি। ফোনের এংগেলটা ঠিক ছিলনা। শুধু শ্রুতির হাতের ট্রে দেখা যাচ্ছিল। আর টুকটাক কথা শুনতে পাচ্ছিল। পার্থিব কপালে ভাঁজ ফেলে ভাবল, তার বউ দেখি সে বাদে বাকি সবার সাথেই ভালো। তার মধ্যেই কী কোনো সমস্যা আছে নাকি?

আসাদ সাহেব কফি খেতে খেতে টুকটাক গল্প করতে লাগলেন। গল্পের মাঝেই আসাদ সাহেব বললেন,
‘ ভালো কথা মা। তোমার বাবা আসছে কয়েকদিনের মধ্যেই।’
শুনে শ্রুতির ভালো মনটা খারাপ হয়ে গেল। বুঝল না শ্বশুর এর কথা। ফট করে বলে দিল, ‘ তার আসার কী দরকার?’
উগ্র কণ্ঠে নয়, সাধারণ ভাবেই প্রশ্ন করল শ্রুতি। আসাদ সাহেব বলতে লাগলেন,
‘ বেয়াই আসবে আসলে বিজনেসের ব্যাপারে। অনেক বড় একটা প্রজেক্ট। এই প্রজেক্টের ব্যাপারেই তার সাথে আমার পরিচয় হয়। তবে এতোদিন শুরু করা হয়নি। কিছুদিন পর থেকে শুরু হবে। এই প্রজেক্টে ৭০% লাভ তোমার বাবার হবে। বাকি ২০% আমার সহ কিছু কম্পানির।’
শ্রুতি শুনে কিছু বলল না। মনে মনে আঁটতে লাগল কীভাবে তার বাবার বিরুদ্ধে নতুন ঝা মেলা পাকানো যায়।
____
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ১১৪৫
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

২৯.
সময় ভীষণ মূল্যবান। সময় কখনো কারোর জন্য থেমে থাকেনা। ধনী-গরিব সকলের ক্ষেত্রেই সময় ন্যায্য কাজ করে। পৃথিবীতে আপাতদৃষ্টিতে ধনীদের মূল্য বেশি। অথচ সময় ধনী-গরিব মানে না। পৃথিবীতে কখনো এমন শোনা যায়নি যে, কোনো বড়লোক অন্ততকাল বেঁচে আছে। এই পৃথিবীর বুকে যেমন গরিবের মৃত্যু হয়েছে, তেমনি ধনীদেরও।
সময় শুধু একা যায়না, নিয়ে যায় মানুষের সুখ, দুঃখের স্মৃতি; কখনো কখনোবা মানুষের জীবন। এই যেমন আজকের সময় নিয়ে গেছে আমিনা বেগমের জীবন।

বিভা, শ্রুতি বসে আছে আমিনা বেগমের মৃতদেহের সামনে। সকাল সকাল এমন খবরে দু’বোন চলে আসে। বিভার সাথে এসেছে মাহাথির। হাসিনা আসতে পারেনি, সিদ্দীক সাহেবের অসুস্থতা বেড়েছে। তাই তাকে হামিমকে দেখে রাখতে বলে এসেছে মাহাথির। শ্রুতির সাথে এসেছে তানহা বেগম, রুমা বেগম। বাকিরা কেউ বাড়িতে নেই। হিয়ার সাথে হিমেল গেছে তার শ্বশুরবাড়িতে। প্রভা-প্রত্যাশা নানুবাড়িতে। পার্থিবের বাবা, চাচা, পার্থিব সবাই একসাথে আছে চট্টগ্রামে। তাই খবর পাওয়া মাত্রই শ্রুতিকে নিয়ে তানহা আর রুমা বেগম চলে এসেছে।

বিভা নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে দাদীর ফ্যাকাসে চেহারায়। বার বার মনে পড়ছে তিনদিন আগের বলা কথাগুলো। কথাগুলো যেন কানে বেজে চলেছে,
‘ বু, তোর চেহারাটা তো দেখলাম। এইবার শুতি আর হামিম রে নিয়া একবার ঘুইরা যাইস তো। ওদের কতোদিন হইয়া যায় দেখিনা। ওদের দেখতে ইচ্ছা করতাসে। একবার দেখাইয়া নিয়া যাইস। নয়তো আমারে নিয়া চল।’
দাদী অসুস্থ। বিভা চাইলেও দাদীকে নিয়ে যেতে পারতো না। তাই ভেবেছিল শ্রুতি, হামিমকে নিয়ে খুব দ্রুতই আসবে। কিন্তু দাদীতো তাকে সময়ই দিলোনা। বিভা শ্রুতির দিকে তাকাল। শ্রুতি দাদীর বুকে মাথা দিয়ে চুপ করে আছে। বিভার বুকটা কেঁপে উঠল যেন। বিভা দাদীর মাথার কাছে বসা ছিল। দাদীর কানে কাছে গিয়ে ধীরকণ্ঠে বলল, ‘ দাদীআম্মু, দেখো, তোমার শুতি বুকে মাথা রেখে বসে আছে। চোখ খুলো।’

দাদী চোখ খুলল না। বিভা জানে আর কখনো খুলবেও না। তবুও তার মন কেন চাইছে আর একবার মানুষটা চোখ খুলে তাকাক। বিভা নিজের চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়তে লাগল উত্তপ্ত অশ্রুকণা। বিভা দাদীর কপালে ভীষণ যত্ন নিয়ে চুমু খেল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। যেন বিভা হাত না বুলালে মানুষটার ঘুম ভালো হবেনা। বিভা মুখ দিয়ে গোল করে নিঃশ্বাস নিয়ে কান্না গেলার চেষ্টা করল। মানুষ তো মরবেই, তাতে এতো কাঁদলে চলবে? মানুষের ধর্মই তো ছেড়ে যাওয়া। বিভা নিজের চোখ মুছতে লাগল দুই হাত দিয়ে। মাহাথির হাত বেঁধে গম্ভীর মুখে বিভার কার্যকলাপ দেখল।

দাফনের সময় হয়ে গেছে। সবাই শ্রুতিকে সড়তে বলল। শ্রুতি সড়ছেনা। তানহা, রুমা বুঝাতে লাগল। শ্রুতি যেন কারোর কথা শুনতেই পাচ্ছেনা। বিভা এসে শ্রুতির পাশে বসল। শান্তকণ্ঠে বলল, ‘ এমন করেনা বোন।’
বিভার একটা কথা যেন একশোজনের বলার সমান মনে হলো শ্রুতির কাছে। শ্রুতি উঠে দূরে চলে গেল। দূরে বসে শাহিনা কাঁদছে, তার পাশে তার চারছেলে। শ্রুতি শুনেছিল মেয়ের আশায় নাকি আগের ঘরে তার সৎ মায়ের চার ছেলে হয়েছিল। তারাও চুপ করে বসে আছে মায়ের পাশে। শ্রুতির দেখতে ভীষণ বি শ্রী লাগল। সবচেয়ে বেশি বি শ্রী লাগল আমিন সাহেবের চেহারা। হঠাৎ করেই শ্রুতি উঠে গেল আমিন সাহেবের কাছে। গিয়ে শান্তকণ্ঠে বলল, ‘ আপনি জানাযায় অংশ নিয়েন না, আমিন শিকদার। প্লিজ।’

আমিন শিকদার ভরা মজলিসে এমন কথা আশা করেনি। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
‘ আজকের দিনে অন্তত তামাশা করোনা।’
শ্রুতি তাচ্ছিল্য হাসল, ‘ যেই মায়ের চিকিৎসা করাননি, সেই মায়ের দাফনে অংশ নিতে লজ্জা করবেনা?’

‘ বেশি কথা বলছিস কিন্তু তুই।’ আমিন সাহেব হালকা গ র্জে উঠল।

‘ মিথ্যা কী বলেছি? আপনি জানতেন না, আপনার মা অসুস্থ? একবারো প্রয়োজন মনে হয়নি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার? ছেলে হয়ে যখন দায়িত্ব পালন করেননি, তাহলে এখন দাফনও করতে হবেনা।’

‘ শাহিনা, ওকে ঘরে নিয়ে যাও।’ আমিন সাহেব চেষ্টা করলেন বিষয়টা সামলানোর। শ্রুতি তা হতে দিলনা। চিৎকার করে উঠল,
‘ কোথাও যাবনা আমি। কেন চিকিৎসা করাননি বলুন? উত্তর দিন সবাইকে। সবাই জানুক।’
আমিন সাহেবও আর নিজেকে সামলাতে পারল না, ‘ চিকিৎসা কেন করাব আমি? উনার একার ছেলে আমি? আর ছেলে নেই? সে না করালে আমার কী ঠ্যাকা পড়েছে একা চিকিৎসা করানোর? আমার টাকা কী এতোই সস্তা মনে হয়?’

শ্রুতি ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল, ‘ গ্রামে থাকা চাষী ভাইয়ের সাথে নিজের তুলনা করছেন? যেই ভাই কিনা নিজের পরিবারই ঠিকভাবে চালাতে পারেনা তার সাথে? এতো ছোট মন আমিন শিকদারের? ছিহ!’
বলেই থুথু ফেলল আমিন শিকদারের সামনে। আমিন শিকদার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। রাগে তার শরীর কাঁপতে লাগল। অন্যদিকে সবাই চুপ করে বাবা- মেয়ের কাহিনী দেখতে ব্যস্ত।

বিভাও চুপ করে আছে। সে জানে সবই। তার দাদী অনেক বছর ধরেই অসুস্থ ছিল। নানা রোগে আক্রান্ত থাকতো। সে অনলাইন বিজনেস করে বছর তিনেক ধরে। টাকা পাওয়ার পর অনেকবারই দাদীকে ডাক্তার দেখিয়েছে, ঔষধ এনে দিয়েছে। সাথে আমিন সাহেবও টাকা দিত কিন্তু তার ভাই গ্রাম থেকে যতো টাকা পাঠাতো ঠিক সেই পরিমাণেই আমিন সাহেবও দিত। না কম, না বেশি। দাদীকে নিয়ে প্রথম প্রথম ডাক্তার দেখাতে গেলেও পরে দাদীকে রাজি করাতে পারতো না বিভা। ডাক্তারের নাম করলেই রাগারাগি শুরু করতো। চিৎকার, চেঁচামেচি করে প্রেশার বেড়ে নতুন কান্ড। তবুও শেষ কয়েকদিন বিভা চেষ্টা করেছিল, তবে বিশেষ লাভ হয়নি। আমিন শিকদারকে প্রথম প্রথম বলতো, এরপর আর বলেনি।
নোং/রা মানুষটার সাথে কথা বলতে তার রুচিতে বাঁধে। তাই কথা বলা তো দূর, বিভা পারলে তাকায়ওনা নিজের বাবার দিকে।
সবার মধ্যে থাকা আমিন শিকদারের ভাইও মাথা নিচু করে ফেলল। মায়ের খবর শুনে সকাল সকালই স্ত্রীকে নিয়ে এসে পড়েছে সে। সন্তানদের আনেনি। এখন এসে ভাইয়ের এই ব্যবহারে তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। তার সাথে তার বড় ভাইয়ের তুলনা চলে?

শ্রুতি আরোও কিছু বলতে গেলেও অন্যান্য মহিলারা তাকে আটকে ফেলল। শ্রুতি চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে কেবল বলল, ‘ আল্লাহ আপনাকে ছাড়বেনা আমিন শিকদার। আল্লাহ আপনাকে ছাড়বেনা। কক্ষনও না।’
তানহা বেগম এবং রুমা বেগম ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

এরপর মাহাথিরসহ বাড়ির সব ছেলেরা জানাযায় অংশ নিল।

দাফনের পর পরই বিভা, শ্রুতিসহ অন্যান্য আত্মীয়স্বজন বেরিয়ে গেল নিজেদের বাসার উদ্দেশ্যে। এই বাড়িতে থাকার অর্থ হয়না। বিভা যাওয়ার আগে তানহা বেগমকে বলতে ভুলল না, ‘ শ্রুতির একটু খেয়াল রাখবেন প্লিজ।’

.
বিভা রারান্দায় বসে আছে। একটু আগেই হামিমের সাথে কথা বলে এলো। হামিমকে যখন বলা হলো, দাদী নেই। মারা গেছে। তখন হামিম তেমন বিশেষ প্রতিক্রিয়া দিল না। বিভা আশাও করেনি। সে তো জানে যে তার ভাই স্বাভাবিক নয়, সব বুঝেনা। তাইতো দাদীকে চিনলেও তার মারা যাওয়ার খবর তার ভাইকে বিচলিত করতে পারলনা।

মাহাথির ঘরে ঢুকে অবাক হলো। ঘরে কোথাও বিভা নেই। বাহিরেও তো ছিলনা। মাহাথির ধীর পায়ে বারান্দায় এলো। তার ধারণা সত্যি। বিভা হাঁটু জড়িয়ে ধরে তাতে মাথা হেলিয়ে দিয়ে বসে আছে। মাথাটা অপরপাশ করা। চেহারা দেখা যাচ্ছেনা। মাহাথির এক হাঁটু ছড়িয়ে অন্য হাঁটুতে নিজের হাত রেখে বসল।
বিয়ের পর প্রথমবারের মতো নিজে থেকে ভালোবেসে বিভার মাথায় হাত রাখল। বিভা অবাক হয়ে মাথা তুলল। মাহাথিরকে দেখে তার বিস্ময় বাড়ল শতগুণ।
আদর পেলে আশকারা বেড়ে যায়। বিভার ক্ষেত্রেও তাই হলো। মাহাথিরের শান্ত, করুণ দৃষ্টিতে বিভা যেন আশকারা পেয়ে গেল। মনের সকল দুঃখ গুলো উপচে পড়তে চাইল। বিভার চোখ থেক বড় বড় অশ্রুকণা পড়তেই বিভা দুইহাত দিয়ে মুছতে লাগল। এরপর আবারো হাঁটুতে মুখ গুজে দিল।
মাহাথির শান্ত চোখে বিভাকে দেখে গেল। বিভার শরীরের কাঁপন বুঝিয়ে দিচ্ছে সে কতোটা কষ্ট থেকে কাঁদছে! মাহাথির শান্তভাবে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে চেয়ে রইল বিভার দিকে।

.
শ্রুতি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার দাদীআম্মু চলে গেল। তাও আকাশে দুইটা চাঁদ উঠল না কেন? উঠা তো উচিত ছিল তাইনা? একটা হতো তার মা, একটা হতো তার দাদী। নেই কেন? শ্রুতি বড় করে শ্বাস নিল। সে অনেক বড় হয়ে গেছে। তবুও এই চাঁদ-তারার খেলা থেকে বের হতে পারেনা। থাকুক না কিছু ছেলেমানুষী। ক্ষতি কী? শ্রুতি মাথা নিচু করে চোখের পানি মুছতে গেল। পারল না। তার আগেই শুনতে পেল,
‘ শ্রুতি?’

কারোর ব্যগ্র কণ্ঠে পিছনে ফিরে তাকাল শ্রুতি। পার্থিব দরজার নব ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারল রুমে ঢুকে দরজা খুলেই সে শ্রুতিকে ডেকেছে। শ্রুতি ধীর পায়ে বারান্দা থেকে বারান্দার দরজায় এলো। পার্থিবের দিকে লক্ষ্য করে দেখতে পেল সে ঘরের চারদিকে চোখ বুলাচ্ছে আর জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। হাঁপিয়ে গেছে ভীষণ। নেভি ব্লু ব্লেজার এর নিচের শার্ট ঘামে ভেজা। মুখও ঘেমে আছে।

পার্থিব শ্রুতিকে দেখেই বড় বড় পা ফেলে এসে শ্রুতিকে জড়িয়ে ধরল। হঠাৎ আক্রমণে পিছিয়ে গেল শ্রুতি। পার্থিব এক হাতে শ্রুতির মাথা বুকে চেপে ধরে আছে, অন্য হাত শ্রুতির পিঠে। শ্রুতির নিরব দুঃখরা যেন ডানা ঝাপটে বেরিয়ে এলো। চোখ দিয়ে পড়তে থাকল অশ্রু। ফুঁপিয়ে উঠল শ্রুতি।
অন্যদিকে পার্থিব শ্রুতিকে জড়িয়ে ধরে বলছে, ‘ আই এম সরি, শ্রুতি। আ’ম সরি। আমি জানতাম না এমন কিছু হবে। আ’ম সরি। আমাকে মাফ করে দিন প্লিজ।’
শ্রুতি কিছু বলল না। পার্থিব তার কাছে ক্ষমা চাইতেই থাকল। পার্থিব খবরটা পায় সকাল ১১ টায় যেখানে ১২ টায় জানাযা দেওয়া হয়েছে। তখন অনেকবেশি দেড়ি হয়ে যায়। ইমার্জেন্সি ভাবে আসার চেষ্টা করেছিল, সম্ভব হয়নি। আর এসেও সে জানাযায় অংশ নিতে পারতো না। তবুও, চেষ্টা করেছে যথাসম্ভব দ্রুত চলে আসতে।

পার্থিব শ্রুতিকে জড়িয়ে ধরে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে। শ্রুতির কাঁপনে বুঝতে পারল মেয়েটার কাঁদতে কাঁদতে হিঁচকি উঠে গেছে। পার্থিব শ্রুতির সারামুখে চুমু খেল। কপালে চুমু খেয়ে আবারো জড়িয়ে ধরল। পার্থিবের আদরে শ্রুতির কান্না থামার বদলে বাড়ল। শ্রুতি শান্ত হচ্ছেনা। পার্থিব শ্রুতিকে বসিয়ে পানি খাওয়ালো। হিঁচকি তখনো থামেনি। পার্থিবের কাছে শ্রুতির এই অবস্থা দেখতে ভালো লাগছেনা। সে বিছানায় বসে শ্রুতিকে আবারো নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে নিল।
কিছুসময় ওভাবেই অতিবাহিত হয়ে গেল। পার্থিবকে অবাক করে দিয়ে শ্রুতি পার্থিবের বুকেই ঘুমিয়ে পড়ল। পার্থিবও যত্নের সাথে আগলে রাখল। মনে মনে ভীষণ আফসোস হলো। সে কাজের জন্য দূরে না থাকলে, সে নিজেও জানাযায় অংশ নিতে পারতো। দাদীকে যতোটুকু দেখেছিল ভীষণ ভালোমানুষ ছিল তিনি। সাথে বেশ মজার। অল্প পরিচয়েই ভালো সাক্ষাৎ গড়ে উঠেছিল। এরপর চোখের পলকে কোথায় দিয়ে সাড়ে পাঁচ মাস পেরিয়ে গেল পার্থিব বুঝতে পারল না। মাঝে ফোনে কথা অবশ্য হয়েছে, তবুও দেখা তো হয়নি। তার উচিত ছিল দেখতে যাওয়া। ইশ! বড্ড আফসোস হচ্ছে।
আফসোস হয়েও উপায় নেই। মানুষটা চলে গেছে। আর ফিরবে না। একজন মানুষ চলে যাওয়ার পরে রেখে যায় শুধু আফসোস আর আফসোস।

_____
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ১৪৮০
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান