একগুচ্ছ শুকতারা পর্ব-৩৪+৩৫

0
152

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৩৪.
পরের সময়গুলো কাটল উল্কার গতিতে। শ্রুতিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক মাস পার হয়ে গেল ইতোমধ্যে। মাঝে ঘটে গেল বিশাল বড় বড় ঘটনা।

শ্রুতি তার শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যাওয়ায় যারা খুশি কিংবা চিন্তামুক্ত হয়েছিল তাদের মধ্যে বিভা অন্যতম। বোনের চিন্তায় ছিল পাগলপ্রায়। ঠিক করেই ফেলেছিল নিজে গিয়ে শ্রুতিকে নিয়ে আসবে। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়ে তাকে যেতে হয়নি। তার আগেই পার্থিব এবং আসাদুজ্জামান নিয়ে গেল শ্রুতিকে। শান্তি পেল বিভা।

এর দুই-তিন পরেই হামিম অসুস্থ হলো। বিভা হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার জানাল, অপারেশন যতো দ্রুত হওয়া যায় ততোই ভালো। বাসায় এসে সব বলার পরপরই মাহাথির সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল অপারেশন হবে এক সপ্তাহ পরেই। সে নিয়ে পরদিন মাহাথির সন্ধ্যার পর নিজেই গেল ডাক্তারের সাথে কথা বলতে। ডাক্তার জানাল সমস্যা হবেনা। যতোদ্রুত কথা যায় ততো ভালো। হামিমের অভিভাবক বলতে দুই বোন এবং দুই বোনের স্বামীই। তাই মাহাথির ভাবল পার্থিবকে জানানো দরকার। পার্থিব এতোদিন খোঁজখবর নিলেও তাকে এবং শ্রুতিকে অসুস্থতার ব্যাপারে জানানো হয়নি বিভার বারণে। তবে এখন জানা তার অধিকার।
সব শুনে পার্থিবও সম্মতি দিল।

পরের সপ্তাহেই হামিমের অপারেশন হয়ে গেল। বলা বাহুল্য টাকা দিল পার্থিব এবং মাহাথির। মাহাথির তার ব্যাংক থেকে জমানো টাকা তুলে ফেলল। পার্থিবের টাকা নিতে না চাইলে পার্থিবের অনুরোধে নিতে বাধ্য হলো। মাঝে অবশ্য টাকা দেওয়া নিয়ে বিভার সাথে হলো এক শান্ত যুদ্ধ । বিভা এক লাখ সত্তর হাজার টাকা এনে দিল মাহাথিরের কাছে। মাহাথির তা দেখে শান্ত মুখে বিভাকে বলল, ‘ তোমার টাকা বেশি হলে প্লেন বানিয়ে উড়িয়ে দিতে পারো, নৌকা বানিয়ে পানিতে ভাসাতে পারো কিংবা জানালা দিয়ে ফেলে দিতে পারো, আমাকে দেওয়ার প্রয়োজন নেই।’ বলেই উঠে চলে গেল। বিভার উত্তরের সুযোগ রাখল না। বিভা মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইল নিজের স্বামীর এমন উত্তরে।

অপারেশনে লাগল প্রায় ছয় লাখের মতো টাকা। হামিমের বেশ কিছু সমস্যা ছিল। হার্টে ছিদ্র, রক্তনালি অচল, বুকের বাল্ব নষ্ট, পায়ে সমস্যা। সব মিলিয়ে টাকা গেল পাঁচ/ছয়ের মতো। সবচেয়ে স্বস্তি এবং শান্তি ব্যাপার হলো – হামিমের অপারেশন সম্পূর্ণ হলো ভালোভাবে। এরপর আইসি.ইউ তে রইল এক সপ্তাহের মতো। ডাক্তারের কথা অনুযায়ী, বাসায় ফিরে ভালোভাবে পায়ের ব্যায়াম করলে সে স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারবে। এছাড়া বুকের সমস্যার কারণে সকল প্রকার খেলাধুলা থেকে বিরত থাকতে হবে। নয়তো বুকের কৃত্রিম বাল্ব যেকোনো সময় আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। আইসিইউ থেকে হামিমকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার পরই যেন কেটে গেল বিভীষিকাময় মূহুর্ত। সবার বুক থেকে নেমে গেল এক বিশাল বড় পাথর। বিশেষ করে বিভা আর শ্রুতি।
হামিম এখন বিভার বাড়িতে আছে। সম্পূর্ণ বেডরেস্টে। নড়চড় করা তার স্বভাব। তবুও সবার অনুরোধে চুপচাপ শুয়ে থাকতে হয়।

হামিমের অপারেশনের পর প্রায় প্রতিদিনই শ্রুতি-পার্থিব বিভার বাড়িতে এসেছে। দেখে গেছে। পার্থিব না পারলেও শ্রুতি একাই চলে আসতো, রাতে পার্থিব এসে হামিমকে দেখে শ্রুতিকে নিয়ে যেত।
আজও তাই হলো। সারাদিন হামিমের সাথে কাটিয়ে শ্রুতিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল পার্থিব। গাড়িতে আছে তারা। শ্রুতি বাহিরে তাকিয়ে দেখছে রাতের শহর। একবার চোখ ফিরিয়ে চাইল পার্থিবের দিকে। শান্ত মুখে বসে আছে পার্থিব বাহিরের দিকে মুখ করে। আজ সে ড্রাইভ করছে না। ড্রাইভার আছে। অগত্যা দু’জনে পেছনে বসে আছে। শ্রুতি চোখ ফিরিয়ে নিল। গত একমাস এতো তাড়াহুড়োয় পার হলো যে নিজেদের সম্পর্কের দিকে তাকানোর সময় পাওয়া গেল না। তবে শ্রুতি পার্থিবকে অনেক সূক্ষ্মভাবে অবজার্ভ করছে। আর করে যা পেল তা হলো — পার্থিব আগের মতো তার সাথে কথা বলেনা। কেন বলেনা? রাগ থেকে? নাকি কষ্ট থেকে? শ্রুতি উত্তর খুঁজেও পেল না। এই এক মাসে কথা বলার মতো বলেছিল শুধু হামিমের অপারেশনের দিনে। কতো খারাপ লোক! খারাপ সময়ে স্ত্রীকে একা ছাড়ে না, অথচ অন্যসময় ঠিকই ভাব দেখায়। অসভ্য লোক! শ্রুতির ভীষণ অসহ্য এবং অস্থির লাগল। পার্থিবের দিকে তাকিয়ে নিজে থেকেই ডাক দিল,
‘ শুনুন?’
পার্থিব চোখ ফিরিয়ে বলল, ‘ হুম, বলুন।’
‘ আপনি কী আমার উপর রাগ? অনেক রাগ?’
‘ একটুও রাগ নই। কেন?’ পার্থিবের হেসেই উত্তর দিল।
শ্রুতি নাক ফুলিয়ে উত্তর দিল, ‘ না, কিছুনা। এমনিতেই।’
বলেই ঘুরে আবারো বাহিরে চোখ নিল। শ্রুতি ঠিক জানে পার্থিব তার উপর রাগ। অনেক রাগ। কতো ধুরন্ধর লোক! রাগ করেও হাসে যাতে শ্রুতি ধরতে না পারে। শ্রুতি কী এতোই বোকা?
রাগের মাঝে শ্রুতির মন খারাপ হয়ে গেল। পার্থিব কেন রাগ করেছে? সে যখন পার্থিবের দিকে আগাতে চাইল তখনই পার্থিব মুখ ফিরিয়ে নিল। কেন? কেন? কেন? আর ভালোবাসে না বুঝি? শ্রুতিকে অসুন্দর লাগে তাই? আর ভালোবাসবে না কখনো?

.
মাহাথির অফিসে বসে পার করছে অলস সময়। আনাস আসছেনা কিছুদিন যাবত। হয়তো ছুটি নিয়েছে বউ এর প্রেগন্যান্সি উপলক্ষে।
বিগত দিনগুলো চলে গেল চোখের নিমিষে। তবে হালকা লাগছে। বাচ্চাটাকে ওইভাবে অসুস্থ হয়ে কতোদিন আর পরে থাকত? শেষমেশ অপারেশন হলো — এই শান্তি।
তবে এখন বিভার কথা ভাবতে গেলেই চোখে ভাসে কেবল বিভার করুণ, অসহায় মুখ। ভাইয়ের অপারেশনে কী অসহায়ত্ব তার! মুখের দিকে তাকানোই যাচ্ছিল। দু’টো দিন বিভা ঠিকমতো খেল না। অবশ্য তাদের কারোরই সেভাবে খাওয়া-দাওয়া হয়নি ভালোভাবে। দৌড়ঝাঁপে অবস্থা খারাপ। তবুও পার্থিব ছিল, দু’জন মিলে শামলে নিয়েছিল পরিস্থিতি।
মাহাথির এতোদিনে খুব ভালোভাবেই বুঝে ফেলেছে সে বিভার প্রতি দুর্বল, মারাত্মক পরিমাণ দুর্বল। তবে এই দুর্বলতাকে সে ভালোবাসার নাম দিতে নারাজ।
জেদ দুইপ্রকার হয়। ভালো জেদ আর খারাপ জেদ। মাহাথিরের মধ্যে দুই জেদের মিশ্রণই দেখা যায়। তবে বর্তমানে তার খারাপ জেদ থেকে সে নিজেকে মানাতে চেষ্টা করল – সে কাউকে ভালোবাসতে পারে না। সে বিভাকে ভালো বাসেনা। এখন থেকে যথাসম্ভব সে বিভার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলবে। এতে যদি সমস্যার সমাধান হয়, এতে যদি মাথার মধ্যে পোকার মতো ঝিঁ ঝিঁ করতে থাকা বিভার চিন্তা দূর হয়। ভালোবাসলেও ঠিক ছিল যদি চিন্তা না হতো। এই চিন্তাটাকেই মেনে নেওয়া যাচ্ছেনা। এতো চিন্তা, ভাবনা কেন হবে? হোয়াই?

বাসায় ফিরে মাহাথির ভালোভাবে শরীর ধুয়ে নিল। হামিমের ঘরে যেতে হবে। শরীরে জীবাণু থাকা যাবেনা। এতে করে তাজা ক্ষততে ইনফেকশন হওয়ার চান্স থাকে। মাহাথির ঘরে গেল হামিমের। তাদের মধ্যে বেশ ভালো ভাব হয়েছে। ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেল হামিম শুয়ে আছে, তাকে দেখেই মুখ যতোটুকু প্রসারিত করা যায়, করে ফেলল। বুকে বালিশ চাপ দেওয়া। এটা ডাক্তারের নির্দেশ ছিল। মাহাথির পাশে বসে হামিমের চুলে হাত বুলিয়ে দিল,
‘ কেমন আছেন, লিটল ব্রাদার?’
‘ ভালো নেই।’
‘ সেকি! কেন?’
‘ আমাকে ভালো খাবার দেওয়া হয় না। আমার স্যুপ, সবজি ভালো লাগেনা।’
‘ তুমি কী খেতে চাও আমাকে বলো, ভাইয়া নিয়ে আসব।’
‘ আমি মরতুজ খাব।’
মাহাথির তাকিয়ে রইল হামিমের দিকে। ছেলেটার কথা আটকে আটকে পড়ে সবসময়। অনেক কষ্টে সে প্রতিটা বাক্য শেষ করে। প্রথমে অসুবিধা হলেও এখন সে বুঝতে পারে। তবে এখন বুঝতে পারল না। মরতুজ কী জিনিস? মরতুজ…..মরতুজ….তরমুজ? মাহাথির বিভ্রান্তিকর দৃষ্টি নিয়ে শুধালো,
‘ তুমি কী তরমুজের কথা বললে?’
‘ না। আমি মরতুজ খাব।’
মাহাথির কিছুক্ষণ নিজের কপাল চুলকালো। এরপর হেসে বলল,
‘ আর কোনো সমস্যা আছে?’
‘ আছে আরেকটা বড় সমস্যা। আমি আপোর ফোন খুঁজেছি। কিন্তু আপোর ফোন থেকে কয়েন খেতে পারিনা। ওই বাচ্চাটাকে খুঁজে পাইনা কয়েন খাওয়ার জন্য।’
মাহাথির হেসে ফেলল হামিমের কথায়। বুঝল হামিম গেমস খেলতে চাইছে। আগে যেমন খেলতো। মাহাথির নিজের ফোন বের করে হামিমকে দিল। বলল, ‘ এই নাও। কয়েন খাও। তবে বেশিক্ষণ কিন্তু খেলা যাবেনা। বেশি খেললে মাথা ব্যথা করবে।’
হামিম মাহাথিরের কথাকে গুরুত্ব দিল না অগ্রাহ্য করল বুঝা গেল না। সে নিজের মতো খেলতেই থাকল।

রাতে শুনা গেল আরেক কথা। বিভা আজ রান্না করতে গিয়ে দা চালিয়ে দিয়েছে নিজের হাতের ওপর। তাই বিভার হাত সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। কথাটা মাহাথির শুনলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল বিভার দিকে। মনে চাইল সামনে দাঁড়ানো বিভাকে এক আছাড় মেরে গিলে ফেলতে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। তাই নিজের ইচ্ছেকে চাপা দিয়ে মাহাথির চুপচাপ বসে রইল। মনে পড়ল সে পণ করেছে বিভার থেকে দূরে থাকার। এটা নিজের উপর একটা পরীক্ষা করা হয়ে যাবে। অতএব, মাহাথির নাতো বিভাকে কিছু বলল না বিভা সম্পর্কিত কোনো কথায় উত্তর দিল। তবে দেখে শান্তি পেল যে বিভা খাচ্ছে। তার আম্মা বিভাকে খাইয়ে দিচ্ছে। মাহাথিরের চোখ বিভার হাতের দিকে যেতেই ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল!
.

সারা ঘর কাগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে মাহাথির। দেখতেও বিরক্ত লাগছে, আবার গুছিয়ে রাখতেও মন চাইল না।
নিজের সাথে যুদ্ধ করে একটা একটা কাগজ ভীষণ অযত্নের সাথে তুলে নিল। টেবিলের ওপর ধাপ করে রেখে দিয়ে তৈরি করে ফেলল কাগজের স্তূপ। এসে অন করল নিজের ল্যাপটপ। এমন ফালতু কাজ সে করে কীভাবে? ভেবেই বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে গেল।
আজ সে অফিসে স্যারের বকা খেয়েছে। ভয়ানক বকা। অফিসে থাকে সকাল আটটা থেকে বিকেল ছয়টা। দশ ঘন্টা। দশ ঘন্টায় কোনো ভুল হতে পারেনা? দশ ঘন্টা বসে বসে টাইপিং করা সম্ভব? আবার বলে কিনা – তুমি কিন্তু এখন অনেক অমনোযোগী থাকো!
তার মনোযোগ সে কই রাখবে না রাখবে সেটা কী ওই লোক ঠিক করবে? সিসিটিভি দেখে কখনো বোঝা যায় কার মনোযোগ কোথায় থাকে? আশ্চর্য রকমের গাধা একটা লোক!

‘ মাহাথির, আপনার জন্য নাস্তা এনেছি।’
মাহাথির ঘুরে তাকাল। বিভাকে দেখে তার আরোও রাগ হলো; রাগের থেকেও যে বিভার মুখটা দেখে তার অন্তর শান্তি পেল তা সে বুঝল না, মানল না। তার খেয়ালে কেবল এলো মেয়েটার থেকে যতো দূরে যেতে চাচ্ছে, ততো যেন কাছে চলে আসছে। মাহাথির নিজের কাজে মন দিল। ওদিকে তাকানো যাবেনা।

বিভা হাপ ছাড়ল। সে এতোসুন্দর করে শাড়ি পরেছে মানুষটা খেয়াল পর্যন্ত করল না? বিভা এগিয়ে গিয়ে নাস্তা রাখল টেবিলে। ঘুরে আয়নার নিজেকে একবার দেখল ভালো লাগছে কিনা। মাহাথির বিভাকে দেখা দূর, খাবারের দিকেও তাকাল না। বিভা অন্যদিক দিয়ে খাটে উঠে মাহাথিরের পাশে এলো। কাঁধে মাথা রেখে বসল। মাহাথির ভীষণ অবাক হয়ে বিভাকে দেখল। আশ্চর্যের সাথে সাথে নিজের জেদ থেকে বিভাকে দূরে সরানোর তীব্র ইচ্ছে হলো। বিভা মাহাথিরের বাহুতে দুইহাত রেখে ডাকল, ‘ মাহাথির, দেখুন। কেমন লাগছে আমাকে?’
মাহাথির বিভাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালালো, ‘ ভালো লাগছে।’

‘ আপনি না তাকিয়েই কীভাবে বুঝলেন ভালো লাগছে? একটু দেখুন। বেশি না একটু।’

ল্যাপটপ থেকে নজর সরল না মাহাথিরের। বলল, ‘ তোমার মুখ কী চেঞ্জ হয়ে গেছে? আমি তোমাকে গত সাত মাস ধরেই দেখছি বিভা।’
বিভা মাহাথিরের বাহুতে ধরে টানতে লাগল। উদ্দেশ্য ল্যাপটপ থেকে হাত সরানো। মাহাথির নিজের হাতের চলন থামিয়ে দিল। বিভার দিকে চোখ তুলে চেয়ে বলল, ‘ রাগ তুলো না, বিভা। সামনে থেকে যাও।’

‘ কীসের রাগ? রাগ আপনার মাথায় উঠেই থাকে তাই না? অনেক হয়েছে আর না। আপনার রাগের ধার ধারিনা আমি। চলুন। আমরা বাহিরে ঘুরতে যাই।’

‘ বেশি বকছো বিভা। যাও।’

‘ না যাব না। দেখেন, আম্মা আমাকে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। আমি নিজেও পরতে পারি তবে সেই পরিয়ে দিল। ভালো লাগছেনা?’

‘ এমন ন্যাকামো তোমার সাথে যাচ্ছে না।’

‘ ভালো হয়েছে। আচ্ছা চলুন বাহিরে যেতে হবেনা। একটু গল্প করি দু’জন?’

মাহাথির নিরব রইল। বিভা অভিমানে গাল ফুলাল, ‘ মাহাথির, আপনি আমাকে ভালো কবে বাসবেন? আপনার উচিত না আমাকে ভালোবাসা? বলুন?’

‘ উচিত।’

‘ আপনি আমার সাথে এমন কেন করছেন, এইভাবে এড়িয়ে কেন যাচ্ছেন? আমাকে কী আপনার মানুষ মনে হয়না?’ ভীষণ কষ্ট, জেদ, অভিমান থেকে হালকা উচ্চআওয়াজে বলল বিভা। মাহাথির বিভার দিকে তাকাল। সে কম কীসে!
সেও দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘ তোমাকে এড়িয়ে যাচ্ছি বুঝেও কেন বসে আছো? চলে যেতে পারছো না? আর কী শুনতে চাও তুমি? ভালোবাসি কিনা? ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি। হ্যাপী? এইটাই শুনতে চাচ্ছিলা তো সাতমাস ধরে? বলে দিলাম। হ্যাপী? এবার যাও?’ কথা থামিয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলল মাহাথির।

মাহাথিরের এমন আচরণে বিভা ধপ করে নিভে গেল। বলার মতো কিছু পেল না। মাহাথিরের এমন কথা যেন বিভাকে নিভিয়ে দিল একেবারের মতো। বিভা মলিন হাসল, ‘ থ্যাংকিউ মাহাথির। মিথ্যা হলেও বলার জন্য।’
মাহাথির তাকিয়ে রইল। বিভা বলল,
‘ আপনার তো অফিস থেকে এলেই ক্ষুধা লাগে তাই বানিয়েছি। ক্ষুধা পেলে খেয়ে নিবেন।’
মাহাথির তাকিয়ে দেখল মেরুন রঙের জামদানি পরিহিতা মেয়ে নিশ্চুপে তার ঘর ত্যাগ করল।

উফ! মাহাথির মাথা ধরে শুয়ে পড়ল। কী হচ্ছে এইসব জীবনে? বিভার থেকে দূরে গিয়েও তো ভালো লাগেনা। বিভা চলে গেল তাও ভালো লাগেনা। নিজের কাছে নিজের হারতেও ইচ্ছে হয়না। পৃথিবী এমন এলোমেলো কেন? সম্পর্ক এতো কঠিন কেন? সম্পর্কে ঠিক কীভাবে করে? মানুষের জীবন সুন্দর কীভাবে হয়? সব জায়গায় অশান্তি হলে শান্তি কোথায়? মাহাথির থম ধরে শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। পার হলো কিছুমিনিট। কত মিনিট? পনেরো/ বিশ মিনিট তো ভালোভাবেই হবে।

মাহাথির উঠে বসল। ভালো লাগছেনা। উঠে চলে গেলো বাহিরে। বাহিরে গিয়েই দেখতে পেল বিভা বসা। মাহাথির অবাক হয়ে দেখল কিছুক্ষণ আগের শাড়ি পরে থাকা মিষ্টি, মায়ামুখ মুখের বিভা বসে নেই। মুখ তো মায়াময়, মিষ্টি আছেই। তবে পরনে সালোয়ার-কামিজ পরে থাকা বিভা বসে আছে। সাধারণ মুখে কিছু কাজ করছে।

সামনে পা খেয়াল করে বিভা মুখ তুলে তাকাল। মাহাথির দাঁড়িয়ে। মোটা, রুক্ষ চুলগুলো এলোমেলো। বিভা হাসার চেষ্টা করল, মুখে হাসি ফুটিয়ে স্বাভাবিক স্বরে জানতে চাইল, ‘ কিছু বলবেন? লাগবে কিছু?’
মাহাথির হতবাক হয়ে চেয়ে রইল। কিছু বলতে পারল না। মাহাথির উত্তর দিল,
‘ না, লাগবে না কিছু।’

বিভা কাজে মন দিল। মাহাথির ধীরে ধীরে বলল, ‘ আমার হয়তো তোমাকে লাগবে বিভা। অথচ এই ‘তোমাকে’ লাগাটা আমি মানতে পারছিনা।’
_______
চলবে~

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৩৫.
স্বাভাবিক জীবন আসলে কী — তার সংজ্ঞা মাহাথির জানে না। জানতেও চায়না। স্বাভাবিক জীবন দিয়ে তার কী কাজ? সে ব্যস্ত নিজের জীবন নিয়ে। এখন তার জীবন স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক সেটা আল্লাহ জানে। মাহাথির নিজের জীবন নিয়ে ভাবতে লাগল। নিজের জীবন বলতে সে বুঝে, বাড়ি থেকে অফিস আর অফিস থেকে বাড়ি। এর বেশি কিছুই নয়। আগে তার দুনিয়া ছিল আম্মা, আব্বা, তার ভাই, বন্ধু আনাস কে নিয়ে। এখন তার দুনিয়াতে তার ভাই নেই। নেই? আছে। আছে হয়তো কোথাও। তার কথা সে ভাবে না। যে ভালো আছে তাকে নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। তবে তার দুনিয়ায় মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন তার দুনিয়া বলতে সে বুঝে – আম্মা, আব্বা, বিভা, শ্রুতি, পার্থিব, হামিম, আনাসকে।

মাঝে পেরিয়ে গেছে ১০/১২ দিন। বর্তমানে সে বসে আছে অফিসে। তার আরেক বাড়িতে। কাজ করতে একটুও ইচ্ছে, শক্তি কোনোটাই নেই। বিরক্তিগুলো স্যালাইনের মতো করে প্রবাহিত হচ্ছে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মাহাথির আনাসের দিকে চাইল। আনাস অফিসে আসছে কিছুদিন হলো। ৭ দিনের ছুটি নিয়েছিল। আবারো সামনে নিবে তার বউয়ের ডেলিভারির সময়ে। তবে এখন সে হাসতে হাসতে ফোনে কথা বলছে। মাহাথির চোখ ঘুরিয়ে নিল। নিশ্চয়ই ভাবির সাথে কথা বলছে। মাহাথির ফের ঘুরে চাইল আনাসের দিকে। সুখী দম্পতি। মাহাথির ভ্রু কুঁচকে আবারো চোখ ফিরিয়ে নিল। এমন একটা মূহুর্ত কী তার আর বিভার মাঝে আসতে পারেনা? মস্তিষ্ক থেকে উত্তর এলো, ‘ না। পারেনা। কারণ তুই আসতে দিসনা।’ মাহাথিরের মন মস্তিষ্কের বিরুদ্ধ নিল। মন উত্তর দিল, ‘ আমি কই আসতে দিইনা? বিভা আসতে দেয়না। ও আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলেনা তাই এমন মূহুর্ত আসেনা। ও কথা বললে আমি কী না করি?’

মাহাথির হাপ ছাড়ল। তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছেনা। গত দিনগুলোতে সে নিজের বিষয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপলব্ধি করে ফেলেছে। আর তা হলো — বিভাকে ছাড়া তার চলেনা। একদমই চলেনা। বিভা কাছে থাকলে তার ভালো লাগে, কথা বললে ভালো লাগে, ওর দিকে তাকিয়ে হাসলে ভালো লাগে — এই যা। ওসব ভালোবাসা টালোবাসা কিচ্ছু নয়। নয়? আসলেই নয়?

মাহাথির গতকালের কথা ভাবল। গতকাল সে আনাসকে নিজের অনুভূতি বলেছে। নিজের অস্বস্তি বলেছে। অফিস থেকে বেরিয়েই মাহাথির অনুরোধ করেছে কোনো নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে বসতে। আনাস-মাহাথির নিরব কোনো জায়গায় বসতেই মাহাথির গম্ভীর মুখে বলে উঠে,
‘ আমি ভীষণ সিরিয়াস, আনাস। আশাকরি তুই আমার কথার মজা নিবিনা।’
‘ এই নিয়ে এক কথা চারবার বলে দিলি। কিন্তু সিরিয়াস কথাটা আর বললি না। কী হয়েছে বলবি, প্লিজ?’
‘ আমি মানসিক রোগী হয়ে গেছি আনাস। আমার কিছু ভালো লাগেনা।’
‘ মানে? কী ভালো লাগেনা তোর? তুই দেখি আমার বউয়ের মতো কথা বলছিস! কিছু ভালো না লাগা মেয়েদের স্বভাব। তোর মধ্যে এলো কীভাবে?’

মাহাথির গম্ভীর মুখে তাকিয়ে রইল। তার দৃষ্টির অর্থ – সে বলেছিল সে সিরিয়াস, তাহলে আনাস মজা করছে কেন?
আনাস হাসল। বলল, ‘ বল। বল। আমি শুনছি। কন্টিনিউ প্লিজ?’
মাহাথির উশখুশ করে বলল, ‘ আমি মানসিক রোগী হয়ে গেছি। সারাটাদিন বিভার কথা মাথায় ঘোরে। ওকে নিয়ে চিন্তা করি। এইসব কী স্বাভাবিক বল? তুই আমাকে কোনো ডাক্তারের নাম্বার দিতে পারবি?’
আনাস নিজের মুখ স্বাভাবিক করে বলল,
‘ আর?’
‘ কী আর? সমস্যা বললাম তো। আমার রোগের নাম বিভা। সারাদিন বিভা সম্পর্কিত কথা ঘোরে মাথায়। বিভা কিছু করে না দিলে সেই জিনিস করিনা। বিভা আমাকে শার্ট আজকে আয়রন করে দেয়নি। বলেছিল আমাকে করে নিতে। করিনি আমি। আমি কেমন যেন হয়ে গেছি আনাস। আমি দিনে দিনে বিভা কেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি। এমনটা কী উচিত হচ্ছে বল? মাথা আমার, অথচ ঘোরে বিভার কথা। কী হচ্ছে এইসব?’

আনাস সুন্দর হেসে তাকিয়ে রইল মাহাথিরের দিকে। মাহাথিরকে তার কাছে ভীষণ অসহায় আর বাচ্চা মনে হলো। রাস্তা খুঁজে না পাওয়া বাচ্চা যেভাবে অস্থির হয়ে কাঁদে, আনাসের মনে হলো তার সামনেও একটা বাচ্চা দাঁড়িয়ে যে নিজের জীবনের রাস্তা খুঁজে পাচ্ছেনা। একা একা থাকা মাহাথির সম্পর্কে জড়িয়ে কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। যে মাহাথির নিজের বউকে কষ্ট দিত, এখন সে সেই বউয়ের জন্যই কষ্ট পাচ্ছে। আনাস মাহাথিরের কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘ তুই মানসিক রোগী না, প্রেমের রোগী হয়ে গেছিস। তোর রোগের ঔষধ ডাক্তার নয়। বিভা।’
‘ বিভা?’
‘ জ্বী, ওর কাছে যা। ওর কাছে গিয়ে নিজের সমস্যা বললেই সমাধান পেয়ে যাবি।’
‘ আমি ওকে এইসব বলতে পারব না আনাস।’
‘ কেন পারবি না?’
‘ আমি জানিনা।’
‘ আমাকে যে বলে দিলি?’
‘ এতো সহজে বলিনি। গত ১ সপ্তাহ ধরে তোকে ফোনে বলার ট্রাই করেছি। শেষে আজ বললাম।’
‘ তুই এমন কেন দোস্ত? নিজের অনুভূতি এক্সপ্রেস করতে তোর কীসের এতো সংকোচ? তুই কী বুঝতে পারছিস না তুই ভালোবাসিস ওকে?’
‘ ভালোবাসা এমন?’
‘ জী, এর থেকেও ভয়ংকর। সবে মাত্র অনুভূতি শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে বুঝবেন ভালোবাসা হলো চোরাবালির মতো। উঠতে গিয়েও পারবেন না। আটকে যাবেন শুধু।’

মাহাথির অস্থির হয়ে উঠে গেল। মাথার চুল টেনে তাকিয়ে রইল পঁচা ডোবার দিকে। আনাস বলল, ‘ বিভাকে বল, শান্তি পাবি।’
‘ বিভা হাসবে আমাকে নিয়ে।’ করুণ গলায় বলল মাহাথির।
আনাস অবাক হলো বন্ধুর এমন কথায়। কতোটা অসহায় দেখাচ্ছে তার রগচটা, দাম্ভিক বন্ধুকে! আনাস মাহাথিরকে বুঝালো। মাহাথির বুঝলো কিনা কে জানে শুধু মাথা নাড়ল হ্যাঁ বোধক। এরপর দু’জন চলে গেল নিজেদের গন্তব্যে।

মাহাথির নিজের চিন্তা থেকে বের হলো। আনাস তাকে জানিয়েছে সে বিভাকে ভালোবাসে, সে যতো তাড়াতাড়ি বিভার সাথে কথা বলবে ততোই ভালো। মাহাথির ভেবেছিল সে অতি দ্রুতই বিভার সাথে কথা বলবে। তবে পারেনি। হেরে গেছে। কথা সাজিয়েও সে বিভাকে কিছু বলে উঠতে পারেনি। এখানে অবশ্য বিভারও কৃতিত্ব আছে। মেয়েটা তাকে এড়িয়ে চলছে। এড়িয়ে চলছে কিনা জানেনা, তবে অনেককিছুই আগের মতো নেই। বিভা এখন তার সামনে আসেনা বললেই চলে। শুধুমাত্র দেখা যায় রাতে। তাও মাঝেমধ্যে দেখা পাওয়া যায়না। আবার গতো ৩/৪ দিন যাবত তার হাতে দুপুরের খাবার দিচ্ছে তার আম্মা। সে তার আম্মাকে কিছু বলতে পারেনি। তাকে তো আর জিগ্যেস করা যায়না যে, বিভা কেন দিলোনা? এরপর আরোও ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে। বিভা তাকে সূরা পড়ে ফুঁ দিতেও আসেনি। এইতো সে গতকাল, আজ কতোক্ষণ টিফিন হাতে বসে রইল। অথচ মেয়েটা এলোনা। শেষে অফিসের টাইম হয়ে যাওয়ার বাধ্য হয়ে তাকে বের হতে হলো। কিন্তু কেন এলোনা? মাহাথির মুখ ফুলালো। স্বামীর সাথে বেয়াদবি? জানে না যে স্বামীর সুরক্ষার জন্য সূরা পড়তে হয়? নাকি মাহাথিরের সুরক্ষা তার উপর কোনো প্রভাব ফেলে না? সত্যিই ফেলে না? তবে কী বিভা তার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে? বদলে যাচ্ছে? নাকি সব স্বাভাবিক? মাহাথির মাথা হেলিয়ে দিল। মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে দলা ধরে আছে সব। সে কিছুরই সমাধান করতে পারছেনা। মাথা ব্যথা করছে। বিভা চুল টেনে দিলে ভালো লাগত। মাহাথির ভাবল — বিভা একবার তার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বললেই সে বিভাকে অফিসেও নিয়ে আসবে। সামনে বসিয়ে রাখবে। মাহাথিরের মাথা ব্যথা করলে চুল টেনে দিবে। আর কী চাই জীবনে? জীবন তো এতেই সুন্দর। মাহাথির নিজের অজান্তেই হেসে ফেলল।

.
মাহাথির ঘরে ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিল। আজ হামিমের সাথে দেখা হবেনা। বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ বুকের সুতো কেটে এনেছে বিভা। সাথে পার্থিব, শ্রুতি ছিল। মাহাথির থাকতে পারেনি। তার জ/ল্লাদ ম্যানেজার ছুটি দেয়নি কিছুদিন আগে নেওয়ার কারণে। হামিমের ব্যথায় জ্বর এসেছে শুনে মাহাথিরও ব্যথিত হলো। হামিমের সাথে তার রক্তের সম্পর্ক নেই। তবুও… তবুও কেন জানি বাচ্চাটার প্রতি তার অসীম মায়া, অগাধ স্নেহ বুকের ভেতর। কিন্তু কেন? যাই হোক, বাচ্চাটা সুস্থ থাকুক তাই চাওয়া। ভীষণ সুন্দর ছবি আঁকে বাচ্চাটা। সে দেখেছে। একদিন তো মাহাথিরকে বলল, ‘ একটা ছবি লিখেছি। দেখবে?’
মাহাথির হ্যাঁ বোধক জবাব দিতেই হামিম তার ক্যানভাস ঘুরিয়ে দিল মাহাথিরের দিকে। মাহাথির দেখল একটা বড় ছেলে আর একটা ছোট ছেলে দৌড়াচ্ছে। ছোট ছেলেটা বড় ছেলের হাত ধরা। সামনে বড় বড় কয়েন। মাহাথির হেসে ফেলল। হামিম বলল, ‘ ফোনে তো তুমি আর আমি নেই। তাই এখানে আছি। এটা তুমি, আর এটা আমি। আমার তো পা নেই। আমি গাড়িতে চলি। তাই তোমার হাত ধরে দৌড়াচ্ছি। যাতে পড়ে না যাই। আর এইগুলা হলো কয়েন। তুমি আর আমি খাব। খেয়ে ভুট্টু হয়ে উড়ে যাব।’
মাহাথির আশ্চর্য হয়ে সেই সুন্দর ছবিটা দেখেছিল। এতো নিঁখুত ছবি! ছেলেটাকে পেছন থেকে দেখেও মাহাথিরের মতোই মনে হচ্ছে। মাহাথিরের সেই এ্যাশ কালারের শার্ট, আবার ডিটেইলসে শার্টের ওপর ঘর ঘর করা। ছোট ছেলেটার ঝাপড়ি ধরা চুল। সব কী সুন্দর! ভালো লাগার সাথে হামিমের কথায় ভীষণ মায়া হয়েছিল। মায়া থেকে হামিমকে উত্তর দিয়েছিল, ‘ কে বলেছে তোমার পা নেই? এই যে তোমার পা। তোমার পা আছে ব্রাদার। জাস্ট কয়েকটা দিন, এরপর থেকেই তুমি হাঁটতে পারবে। বুঝেছো?’ হামিম বুঝেছিল কিনা কে জানে। ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিল। মাহাথির অবাক হয়ে দেখল বাচ্চাটার কান্না। শেষে তার কান্না থামল মাহাথিরের কোলে উঠে।
ঘটনা মনে হতেই মাহাথির হেসে ফেলল। ভাই-বোন দুটো আসলেই পাগল।

হামিমকে থেকে চিন্তা গিয়ে ঠেকল বিভার দিকে। ঘরে ঢুকার সময় বিভাকে বলে এসেছে, ‘ শরবত দিও বিভা। গরম লাগছে।’
অথচ বিভা এখনো আসেনি। আসবে না নাকি? হঠাৎ বাহিরের ঠান্ডা বাতাসে মাহাথিরের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। এতো ঠান্ডা বাতাস! কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে নাকি? আজ মোটেও গরম ছিল না আবহাওয়া। তবুও সে শরবত চেয়ে এসেছে, অথচ তার চাওয়া উচিত ছিল চা। ঠান্ডা আবহাওয়ায় চা খেতে পারলে শান্তি লাগতো। কী আশ্চর্য! সে এমন গাঁ জাখোরের মতো ব্যবহার কেন করছে? সে কী গাঁ জা খায় নাকি? বিভাকে জিগ্যেস করতে হবে বিভা রান্নায় কিছু মেশায় নাকি। সারাদিন একজন মানুষকে ঘিরে চিন্তা, চায়ের বদলে শরবত চাওয়া – এইগুলো অবশ্যই গাঁ জাখোরের লক্ষণ। মাহাথির ফোন বের করে সার্চ করতে নিল – ‘ গাঁ জা খোরের লক্ষণ কী….’

‘ মাহ্ থির, আপনার শরবত।’
বুকটা ধ্বক করে উঠল। মাহাথির পিছন ফিরে চাইল। সাধারণ মুখে বিভা দাঁড়িয়ে। মাহাথির ফোন বিছানায় ছুঁড়ে দিল। বিভা এগিয়ে এলো গ্লাস নিয়ে। মাহাথির এর দিকে বাড়াতেই মাহাথিরের ইচ্ছে হলো বিভার হাত ধরতে। ধরল না। গ্লাস নিল। বিভা ঘুরতেই মাহাথির ডেকে ফেলল,
‘ বিভা?’
এমন ডাকে বিভাকে আবারো ঘুরতে হলো মাহাথিরের দিকে।
মাহাথির মনে মনে আওড়াল, ‘ আসো, দু’জনে একটু গল্প করি। তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।’ আওড়ানো শেষ। এখন সে এই কথাটাই বিভাকে বলবে। রেডি…ওয়ান…টু….থ্রি…,
‘ আসো….কথা…বলো?’
বিভা বুঝল না মাহাথিরের অস্পষ্ট সুর। বিভ্রান্তি নিয়ে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ?’
মাহাথির অন্যদিকে ফিরল। মাহাথির নিজের ওপর অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। সে বিভাকে কষ্ট দিত অনায়াসে, তাহলে ভালো কথা বলতে এতো দ্বিধা কীসের? মাহাথির বিভার দিকে ফিরল করুণ মুখে। বিভা তখনো হতবাক হয়ে দাঁড়ানো। বলল, ‘ কিছু বলতেন?’
করুণ মুখের ‘না’ বোধক মাথা নাড়ল মাহাথির। বিভা হাপ ছেড়ে চলে গেল। মাহাথির বিছানায় বসল ধপ করে। ভীষণ রাগ হলো বিভার ওপর। মাহাথিরের মন মস্তিষ্ককে ধমক দিল, ‘ খুব তো বড় বড় কথা। ভালোবাসি। ভালোবাসি। ভালোবাসি। তুমি আমাকে মোটেও ভালোবাসো না বিভা। ভালোবাসলে আমার চোখ দেখেই সব বুঝে যেতে। বুঝতে পারতে আমি কী চাই। তুমি একটা মিথ্যাবাদী, বিভা।’
মনের কথা শেষ হতেই মস্তিষ্ক মনকে চড় বসাল। বলল, ‘ বিভা কোনো কবিরাজ-জ্যোতিষী নয়। ওর কোনো আধ্যাত্মিক ক্ষমতাও নেই যে তোর মনের খবর ও জানবে। তুই মুখ ফুটে না বললে বুঝবে কীভাবে? আগে নিজে ঠিক হ।’
মাহাথির নিভে গেল। মন-মস্তিষ্কের যুদ্ধ আর হচ্ছেনা। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। কাল সে বিভাকে নিজের মনের কথা বলবে। বলবেইইই…..

.
রাত একটা তো বাজবেই। বিভা ঘুমায়নি। বসে বসে দেখছে নিজের মা ম/রা ভাইটাকে। ব্যথায় মুখটা একটুখানি হয়ে আছে। যখন সুতো কাটা হলো কী চিৎকার টাই না করল! হামিমের চিৎকার শুনে শ্রুতির চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ল। আর বিভা মনে মনে ছিটকে উঠল। আর কিছুই করার থাকল না।
শ্রুতির কথা ভেবেই মলিন হাসল। যতোই চিৎকার চেঁচামেচি করুক, বোনটা তার ভীষণ নরম মনের। সে বাদে শ্রুতিকে কেউ বুঝেনি। না ভুল হলো। পার্থিব শ্রুতিকে বুঝে। আগলে রাখে। ভাবতেই বিভার ভালো লাগল, শান্তি পেল। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা বাড়ল।

ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই বিভা ভাবল এখন ঘরে যাবে নাকি আরেকটু পরে যাবে? মাহাথির ঘুমিয়েছে? আরেকটু পড়ে যাক। মানুষটা ঘুমাক। তাকে দেখলে শুধু শুধু অশান্তি পাবে। কতো আর জ্বা লাবে। থাকুক না তার মতো। তার সাথে সংসার করছে — এই কতোনা! কী দরকার শুধু শুধু অ শান্তি দেওয়ার? সে থাকুক ভালোভাবে, সুখে, শান্তিতে। আর কিছু চাওয়ার নেই। জোড় করে কখনো ভালোবাসা হয়না। শুধু শুধু তি ক্ততা বাড়ে।

বিভা উঠে জানালার কাছে গেল। ঠান্ডা বাতাস! অথচ বিভার ভেতরটা কেমন যেন আগুনে পো/ড়ার মতো গরম।

বিভা ঘরে না গিয়ে ভাইয়ের ঘরে বসে রইল তার ভালোবাসার মানুষকে শান্তি দিতে। অথচ সে জানলোও না তার ভালোবাসার মানুষ তার জন্য অপেক্ষা করে সারাঘর হাঁটাহাটি করছে উদ্ভ্রান্তের মতো। অথচ তার চোখে রাজ্যের ঘুম!

_______
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ১৮২৪
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান