একগুচ্ছ শুকতারা পর্ব-৩৮+৩৯

0
185

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৩৮.
‘ হামিম কোথায়, আম্মা?’
হাসিনা মাহাথিরের প্রশ্নে উত্তর দিল,
‘ বিভার ঘরে। এক ঘরে থাকতে ওর ভালো লাগতেসিল না, তাই ওই ঘরে দিয়া আসছি।’
‘ আব্বার কী অবস্থা? শরীর ঠিক আছে?’
‘ হঁ, বাবা। আছে।’
‘ আচ্ছা, আমি ফ্রেশ হয়ে দেখা করে আসবনি।’

মাহাথির ঘরে ঢুকে দেখল দু’ভাই-বোন বসে আছে খাটের সাথে হেলান দিয়ে। মাহাথির এগিয়ে গেল। হাতে তার ফোমের পুতুল। হামিম বসে থাকতে চায়না। নড়চড় করে উঠে পড়তে চায়। অথচ তাকে বসে বসে, শুয়ে শুয়ে খেলতে হবে যা খেলার। তাই মাহাথির নিত্যনতুন খেলনা এনে হামিমকে মজা দেওয়ার চেষ্টা করে। এতে যদি বাচ্চাটা বসে থাকে। সেদিন পার্থিবও কতোগুলো নিয়ে এলো। তাও বাচ্চাটার নড়চড় থামেনা। মাহাথির নিজের হাতের খেলনা বাড়িয়ে দিল হামিমের দিকে।
হামিম লক্ষ্য করেই চোখ বড় বড় করে ফেলল, ‘ এলিফ্যান্টের বাচ্চা! ওয়াও! অনেক সুন্দর!’
ছোঁ মেরে খেলনাটা নিয়ে নিল হামিম। মাহাথির ঠোঁটে হাসি ফুটালো সরুভাবে। বিভার দিকে চোখ নিতেই নজড়ে এলো মলিন মুখ। তা দেখে বিভার মুখের মতোই মলিন হয়ে গেলো মাহাথিরের দৃষ্টি।

বিভা এতোক্ষণ যাবত দেখছিল হামিমের হাসিমুখ। কী উচ্ছ্বাস মুখে! নিজের অসুস্থ শরীরে কাছের মানুষের হাসিখুশি মুখ দেখতেও ভালো লাগে। তার শরীরটা বেশ ভালো নেই। দিন-দুনিয়া কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার লাগে। প্রেশারের সমস্যা কিনা কে জানে! আজকে সকাল থেকেই শরীরটা বেশ দুর্বল।
বিভার চোখ পড়ল খেলনার ওপরে। ছোটখাটো একটা হাতির বাচ্চা। মুখটা সুন্দর। কিউট বলা যায়। বিভা মনে মনে বলল, ‘ নিজে একটা হাতি। এনেছেও হাতি। হাতির পছন্দ হাতি।’
বিভা মনে মনে অনেক হাসল। তবে তার ছিঁটেফোঁটাও প্রকাশ করল না। অন্য চিন্তা মাথায় আসতেই উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘ এতোদিন আমি ছিলাম। এখন আমার ভাই এসে জুটেছে। আপনার অনেক টাকা গেল। আমি তার জন্য দুঃখিত। আমি এমনিতেও হামিমের অপারেশনের জন্য টাকা জমাচ্ছিলামই। সেগুলো আপনি নিলে খুশি হব।’
মাহাথিরের মনে হলো তার মাথার নরম অংশে কেউ সজোড়ে আঘাত করল। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সংযত করল মাহাথির। রাগকে আয়ত্তে এনে বলল, ‘ বাজে বকোনো বিভা। তোমরা আমার পরিবার। পরিবারের জন্য আমি খরচ করব না করবনা সেটা তোমার থেকে শুনব না আমি। টাকা বেশি হলে উড়িয়ে দাও। আমাকে টাকা দেখিওনা।’

বিভা উত্তর দিল না। হামিমের দিকে ফিরলে হাতের কবজিতে টান পড়ল।
মাহাথির রাগ, যন্ত্রণা সামলাতে না পেরে বলল, ‘ সমস্যা কী তোমার? আমাকে ইগনোর করো কেন এইভাবে? কথা বললে উত্তর দেওনা। আমি কিছু বললে করোনা। কী হয়েছে?’
‘ আমার ভালো লাগেনা, মাহাব।’
‘ কী ভালো লাগেনা? আর কী মাহাব? আমি মাহাথির। মাহাথির বলো?’
বিভা যেন মাহাথিরের পুরো কথা শুনলোই না। সে নিজের মতো উত্তর দিল,
‘ আপনার সাথে কথা বলতে ভালো লাগেনা। মন টানেনা। তাই বলিনা। এতে তো আপনার খুশি হওয়ার কথা। তাইনা? এমন রাগ করছেন কেন?’
মাহাথির ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগল। তার শ্বাসের শব্দ শুনে মনে হচ্ছে এক্ষুনি কাউকে ছো/বল মারবে। মাহাথির এগিয়ে বিভার দুই বাহু ধরল। টেনে আনল নিজের কাছে, ‘ প্রতিশোধ নিচ্ছো তাইনা? আমি খারাপ ব্যবহার করেছি এতোদিন যাবত তার প্রতিশোধ নিচ্ছো?’

‘ না। প্রতিশোধ আমার স্বভাবে নেই। তা আপনি খুব ভালো করেই জানেন।’

‘ কেন করছো এমন বিভা? শাস্তিই তো দিচ্ছো। আমি গত আটমাস ধরে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। তুমিও বুঝি আটমাস ধরে আমাকে শাস্তি দিবে? কথা বলবেনা, রাগ দেখাবে?’ মাহাথিরের কণ্ঠটা করুণ শোনাল।
বিভা অবাক হয়ে দেখল তার স্বামীকে। এইটা সত্যিই তার গম্ভীর স্বামী? ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল বিভা, ‘ আপনি এখনো মানসিকভাবে ভীষণ ছোট মাহ্ থির। আপনি আমাকে আটমাস কষ্ট দিয়েছেন বলে আমিও দিব – এটা নিতান্তই হাস্যকর কথা। আচ্ছা আপনি না কোচিং এ ম্যাথের টিচার? তাই বুঝি সম্পর্কে ম্যাথ ঢুকাতে চাইছেন? আটমাস আটমাস যোগ-বিয়োগ করে হিসাব মিলাতে চাচ্ছেন? অংক দিয়ে সম্পর্ক হয়না। সম্পর্কে লাগে মায়া, যত্ন, ভালোবাসা। যার একটিও আমাদের মধ্যে নেই।’
মাহাথির বিভার এমন কথায়, এমন ব্যবহারে আশ্চর্যের সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠে গেল। বিভার এমন ব্যবহার তার হজম হলোনা। তার আশাগুলো যেন ভেঙে গুড়িয়ে গেল। সে নিজ থেকে কথা বলে এমন ব্যবহার পেল? হাতে ফোন ছিল তার। রাগ নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে নিজের ফোন ছুঁড়ে মারল দেওয়ালে। এরপর হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

হঠাৎ এমন আওয়াজে ছিটকে উঠল হামিম। তাকিতুকি করতে লাগল বুঝতে যে কীসের শব্দ। বিভা এগিয়ে গিয়ে বলল,
‘ কিছু হয়নি ভাই। তুমি খেলো। এই দেখ কী সুন্দর হাতি!’

.
বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাতের শহর দেখছে শ্রুতি। দেখার মতো তেমন কিছুই নেই। নিচে বাগান, বড় বড় গাছ। এছাড়া তেমন কিছু নেই। ছাদে গেলে অবশ্য দেখা যায় দূরের রাস্তাঘাট; তবে ইচ্ছে করছে না। এখন ছাদে যাওয়ার মানে হয়না।
তরতর করে ঘামতে লাগল শ্রুতি। আজ সে একটা ভয়ংকর কাজ করবে বলে ঠিক করেছে। কাজটার কথা ভাবতেই ভয় হচ্ছে। তবে কাজটা তার করতেই হবে। ভয় পেলে চলবেনা। তাকে স্বাভাবিক হতে হবে। সেদিনের পর থেকে পার্থিব আর তার সম্পর্ক স্বাভাবিক, সহজ, সুন্দর হয়ে গেছে। সে ভার্সিটি যায়। পার্থিব নামিয়ে দিয়ে আসে। আসার সময় বাড়ি থেকে পাঠানো গাড়িতে চলে আসে। কখনো কখনো পার্থিব তাকে চমকে দিতেই হাজির হয় ভার্সিটি। শ্রুতির মাঝেমধ্যে মনে হয় অন্যরা যে প্রেম বিয়ের আগে করতো, সে সেই প্রেম বিয়ের পর করছে। তবে ব্যাপারটা মন্দ নয়।

‘ না ঘুমিয়ে ওখানে কী করছেন? ঘুমোতে আসুন। সামনে না আপনার এক্সাম? এমনিতেই তো কতো পিছিয়ে গেছেন! আসুন আসুন।’
পার্থিবের গলা শুনতেই বুকের হৃৎপিণ্ড যেন গলায় এসে ঠেকল। এতো দ্রুত ঘরে এলো কেন লোকটা? নিচেই থাকতো। শ্রুতি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে দেখল ঘড়িতে ১১ টা ৪৭ বাজে। যথেষ্ট রাত। আর কতো নিচে থাকবে! শ্রুতি ঘরে ঢুকে উশখুশ করতে লাগল। পার্থিব ওয়াশরুমে গেছে। ঘুমের আগে হাত-মুখ ধোঁয়া এই লোকের অভ্যাস।

পার্থিব বেরিয়ে গামছা দিয়ে হাত-মুখ মুছতে লাগল। আড় নজরে শ্রুতির ভাবভঙ্গি পরখ করে বলল, ‘ এমন স্ট্যাচু হয়ে আছেন কেন? কোনো সমস্যা? ’
‘ হ্যাঁ। আপনার চোখে সমস্যা।’
‘ ফালতু কথা না বলে ঘুমান। সকালে ক্লাস আছে ভুলে গেছেন?’
শ্রুতি কিছু বলল না। পার্থিব নিজে থেকেই বলল, ‘ আপনি কী পড়বেন শ্রুতি? লাইট অফ করে দিব না অন থাকবে? আমার ভীষণ টায়ার্ড লাগছে। শুয়ে পড়ব।’

শ্রুতি নিজের ভয় লুকিয়ে বলল, ‘ অফ করুন লাইট।’
পার্থিব শ্রুতির পাশ দিয়ে গিয়ে লাইট করে দিল। এগিয়ে এসে তার জন্য বরাদ্দকৃত বিছানায় উঠতে যাবে ওমনি শ্রুতি তার দু হাত দিয়ে সামনের মানুষটির কবজি আকড়ে ধরল। অন্ধকারে পার্থিবের প্রতিক্রিয়া বোঝা গেল না। শ্রুতি পার্থিবের সামনে গিয়ে নিজের মাথাটা বুকে ঠেকিয়ে দিল। পার্থিব ভীষণ অবাক হলো। রাত-বিরেতে হলো কী মেয়েটার? শ্রুতি দু হাত দিয়ে পিঠের গেঞ্জি আঁকড়ে ধরল। পার্থিব ঢোক গিলে আদরস্বরে বলল,
‘ ভয় পাচ্ছেন, শ্রুতি?’
শ্রুতি বুকে ঠেকানো মাথা দিয়ে উপর-নিচ করে ‘হ্যাঁ’ বোধক জবাব দিল।

‘ আমি তো এখানেই আছি। ভয় কীসের? শ্রুতি, কিছু কী হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেন? শরীর অসুস্থ লাগছে? দে..’

‘ আমি আপনার মেহমান বউ হয়ে থাকতে চাইনা। আপন বউ হতে চাই, পার্থিব।’

কথা শেষ করতে না দিয়েই শ্রুতি বলে উঠল। শ্রুতির কথাটা শুনে পার্থিবের মনে হলো সে কী ভুল শুনলো? শ্রুতির থেকে এতো দ্রুত এমন কিছু আশা করেনি সে। মুখটা স্বভাবতই আপনা-আপনি প্রসারিত হয়ে গেল।
‘ আপনি তো কবেই মেহমান থেকে আপন বউ হয়ে গেছেন।’
‘ না এখনো হইনি। হলে আমি আপনি আলাদা বিছানায় ঘুমাতাম না। আপনি নিচে শোন কেন?’
হঠাৎ করে ধমকের স্বর শুনে পার্থিবের আরোও হাসি পেল। সে শ্রুতির প্রশ্নের ইঙ্গিত বুঝেও উত্তর দিল, ‘ তাহলে কোথায় শোব?’
বুকে কপাল দিয়ে ঠেকানো মাথা তখনো উঠায়নি শ্রুতি। ওভাবে থেকেই নিজের হাতের এক আঙুল দিয়ে বিছানা দেখাল। জোড় গলায় বলল,
‘ ওখানে।’
পার্থিবের ভীষণ মজা লাগছে। তাই সে প্রশ্ন করতেই থাকল, ‘ আমার নিচের বিছানায় কী হবে?’
এবার ভ্রু কুঁচকে মুখ তুলল শ্রুতি। ভীষণ বিজ্ঞ কণ্ঠে বলল, ‘ একদিন দু’জন বিছানায় শোব। একদিন দু’জন ওই তোষকে শোব। বুঝেছেন?’

পার্থিব হাত উঠিয়ে শ্রুতির চুল কানের পিঠে গুঁজে দিল। মোহনীয় কণ্ঠে বলল,
‘ বুঝেছি। এইবার আপনি বুঝেন।’
‘ আমি কী বুঝব?’ না বুঝে বলল শ্রুতি।
‘ এই যে আমার পৌষমাস, আর আপনার সর্বনাশ।’
শ্রুতি হয়তো বুঝল পার্থিবের কথা। ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চোখ সরিয়ে নিল তার থেকে। রুমের চারদিকে নিজের চোখ ঘুরাতে লাগল। যেন এর থেকে প্রয়োজনীয় কাজ আর দ্বিতীয়টি নেই। শ্রুতি নিজের চোখের মাধ্যমে রাগ দেখাতে চাইলেও, পার্থিব সেই চোখে দেখল একরাশ লজ্জা।

.
‘ আমি আপনাকে খুঁজে হয়রান, আপনি এখানে কী করেন?’

মাহাথির মুখ ফিরিয়ে দেখল বিভাকে। কমলা রঙের একটা সাধারণ কাপড় পরেছে বিভা। ক্যাটক্যাটে কমলা নয়, গম্ভীর, শান্ত কমলা রঙ। মাহাথির কমলা রঙ পছন্দ করেনা। বিয়ের পরপরেও হয়তো একবার বিভা এই রঙ পরেছিল। সেদিন বিভাকে কী জঘন্যই না লেগেছিল তার কাছে। তবে আজকে অন্যরকম লাগছে কেন? কী সুন্দর মানিয়েছে বিভাকে! কমলা শাড়ি, দু’হাতে কেনা দু’টো চিকন চুড়ি, গায়ের শ্যামবর্ণ, সাধারণ তেলতেলে মুখ, কানে স্বর্ণের ছোট দুল, খোপা করা চুল থেকে কিছু বের হয়ে আছে কপাল, মুখ জুড়ে। মাহাথিরের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। পলক ফেলে ভাবল এখন যদি সে এই মূহুর্তে বিভাকে জড়িয়ে ধরতে পারে তবে এই পৃথিবীতে তার থেকে সুখী মানুষ একটিও থাকবে না।
কী আশ্চর্য! এমন ভাবনা উদয় কেন হলো? সময়ের সাথে সাথে কী সে এতোটাই জড়িয়ে গেছে বিভার সাথে? এতো অনুভূতি কখন জন্ম হলো?

অন্যদিকে মাহাথিরের এমন আনমনে থাকা ভাব বিভার বোধগম্য হলোনা। এগিয়ে এসে বলল, ‘ কী হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেন? নিচে আসুন। আম্মা কেন জানি আপনাকে ডাকছে।’

‘ আমি তোমার এই ব্যবহার মানতে পারছিনা বিভা।’
এমন কথায় থেমে গেল বিভা। শান্তকণ্ঠে বলল, ‘ কেমন ব্যবহার করছি আমি?’
মাহাথির শান্ত, অসহায় কণ্ঠে বলল নিজের মনের কথা, ‘ এই যে আমাকে এড়িয়ে চলো। নিজের হাতে টিফিন দাওনা। সূরা পড়ে ফুঁ দিয়েও দাওনা। কেন দাওনা? এখন কী আমার বাঁচা-ম/রা, সুস্থ থাকা কিছুই ইফেক্ট করেনা তোমাকে? আমি কথা বললেও ভালোভাবে কথা বলোনা। কোনো কথা শুনোনা আমার। কেন? আগে তো এমন ছিলেনা তুমি। ছিলে বলো? তাহলে এখন যখন আমি নিজেকে বুঝতে পারলাম, তুমি এইভাবে অবুঝ কেন হচ্ছো বিভা? আগে বলেছিলাম মাহাথির বলে না ডাকতে। তাই এখন তুমি আমাকে মাহাব বলে ডাকো। আমি তো এইসবে অভ্যস্ত নই বিভা। নিজেকে অনেক এলোমেলো লাগে আমার। আমি শান্তি পাচ্ছিনা।’

বিভা মাহাথিরের কথা মনোযোগ ঢেলে শুনল। এবং এবারো মাহাথিরকে এড়াতে চাইল। সবথেকে চুচ্ছ প্রশ্নটাই নিল উত্তর দেওয়ার জন্য। বলল, ‘ মজা করে আপনাকে মাহাব ডেকেছিলাম। আপনি বাচ্চামি করেছিলেন নাম নিয়ে। এরমানে এইনা আমিও করব। আমি আপনাকে মাহ্ থির বলেই ডাকব। সমস্যা নেই। এবার নিচে আসুন।’

মাহাথির এগিয়ে এসে বিভার হাত ধরল,
‘ এমন করোনা বিভা।’
বিভা গভীর চোখে দেখল মাহাথিরকে। মাহাথির তাকে সত্যিই কী অনুভব করে? ভালোবাসে? মাহাথিরের দৃষ্টি পড়ে মন মানতে চাইলেও কোথাও যেন বাঁধা সৃষ্টি হলো। মনে পড়ল মাহাথিরের বলা কথা। সে একদিন বলেছিল,
‘ আমি তোমাকে কখনো ভালোবাসবো না বিভা। তবে দু’জনে একসাথে থাকতে থাকতে আমি তোমার ওপর অভ্যস্ত হয়ে যাব এই যা। জাস্ট সংসার করার জন্য করব।’
মাহাথিরের পূর্বের বয়ানের ভিত্তিতেই বর্তমানের বয়ান হেরে গেল। মনে হলো অতীতের সবকিছু আবারো ফিরে আসছে। বিভা মাহাথিরের হাত ছাড়িয়ে ছাদের রেলিং এর দিকে গেল। দুই হাতে রেলিং আঁকড়ে ধরে নিচে তাকাল। দোকান-পাট সব এখনো খোলা। মানুষের চলাচল, রিকশার আওয়াজ সব মিলিয়ে ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত রাস্তাঘাট। বিভা তার শান্ত স্বরে গল্প বলা মতো বলতে শুরু করল,

‘ আমার মা যখন মারা যায় আমার বয়স তখন ষোলো কী পনেরো। ততো বড় না হলেও ততো ছোট নই। অনেক কিছুই জানতাম, বুঝতাম। আপনি জানেন কিনা জানিনা আমিন শিকদার তার ২য় স্ত্রীকে সাধারণভাবে বিয়ে করেনি। আমার মা বেঁচে থাকাকালীনই তারা পরকীয়ায় লিপ্ত ছিল। হামিম যখন আমার মায়ের পেটে তখন মা জানতে পারে বাবার পরকীয়ার কথা। জানার পরেও আমার চঞ্চল মা আমিন শিকদারের সাথে অতো চেঁচামেচি করেনি। সাধারণ কিছু প্রশ্ন জিগ্যেস করেছিল। মি. শিকদার প্রথমে স্বীকার না করলেও পরে স্বীকার করে। এরপর মা উনাকে অফিসের জন্য বিদায় জানিয়ে দেয়। অন্যান্যদিনের মতো সাধারণভাবেই বিদায় দিয়ে আমার মা রুমে ঢুকে চিৎকার করে কাঁদে। মাথার চুল টেনে টেনে ধরে, গা খামছে খামছে, মুখে আঁচড় কেটে কেটে চিৎকার করে কাঁদে মাহাথির। তখন বাসায় কেউ ছিলনা। শ্রুতি স্কুলে, দাদী গ্রামে। শুধু আমি ছিলাম। আমি অবাক হয়ে দেখেছিলাম মায়ের চিৎকার, আর্তনাদ। আমার মায়ের এমন চিৎকারে আমার লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। অথচ আমি আমার মাকে সান্ত্বনা দেইনি। আমি জানতাম না কী বলে স্বান্তনা দিতে হয়। এরপর সেভাবেই চলছিল জীবন। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন আমার মা অসুন্দর ছিল তাই আমিন শিকদার পরকীয়া করতো। তেমন কিছুই নয়। আল্লাহ এই পৃথিবীতে অনেক সুন্দর করে মানুষদের সৃষ্টি করেছে। তাদের মধ্যে এমন কিছু মানুষ সৃষ্টি করেছে যাদের দেখলেই মুখ থেকে প্রশংসা বেরোয়। একদম ছবির মতো সুন্দর মুখ থাকে তাদের। আমার মাকেও সেই কাতারে ফেলা যায়। আমার মা এমনিতেই ছিল রুপ-লাবণ্য-গুণে অনন্য। তার উপর তার স্বভাবে সবাই তাকে ভালোবাসতে বাধ্য হতো। তাহলে ভাবুন, কেমন সুন্দর ছিল সে! আমি-শ্রুতি জন্মের পরেও তার সৌন্দর্যের কোনো কমতি হয়নি। তবে হামিম পেটে থাকাকালীন স্বাভাবিক যে পরিবর্তন আসে তা হয়েছিল। আমিন শিকদারের সত্য জানার পর আমিন শিকদার যেন আরোও আশকারা পেয়ে গেল। মায়ের সামনেই কথা বলত পরনারীর, প্রশংসা করতো। আমার মা চুপচাপ শুনত। আমি, শ্রুতি ঘুমিয়ে পড়লে আমার মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত। আমি বুঝতে পারতাম। কখনো কাঁদতে কাঁদতে শ্বাসকষ্ট উঠে যেত। এমনিতেই গর্ভকালীন সময়ে কতো কষ্ট থাকে, তার উপর আমিন শিকদারের কাজে আমার মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিল। আমি আমিন শিকদারকে কিছু বলতেও পারতাম না। এতোবছর যাবত আমিন শিকদারের খুব কাছে না থাকলেও, দূরে ছিলাম না। তাই সব মানতে ভীষণ কষ্ট হতো। শ্রুতি তো প্রায় এটাসেটা প্রশ্ন করত মাকে। মা কখনো উত্তর দিত, কখনো চুপ করে থাকতো। এমন মানসিক, শারীরিক যন্ত্রণা নিয়েই আমার আম্মু মরে গেছে। যাওয়ার আগে অবশ্য আমাদের তুলে দিয়ে গেছে দাদীর কাছে। তবুও মা তো মা-ই। একলা করে গেছে আমাদের। মা হারা হয়েছি আমি, আমার বোন, আমার ভাই।’

বিভা মাহাথিরের দিকে ফিরল। মাহাথির তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। বিভা আবারো বলতে লাগল, ‘ আমার মা মৃত্যুর আগে আমাকে একটা ডায়েরি দিয়েছিল। মায়ের মৃত্যুর পর সেই ডায়েরিটা আমি প্রায়ই পড়ি। গতরাতেও পড়েছি। কারণ সেখানে আমি আমার মায়ের অনুভূতি সম্পর্কে জানতে পারি। বেঁচে থাকাকালীন আমার মা চারটি আফসোস নিয়ে মারা গেছে। সেগুলোর কথা আমি হুবহু মায়ের লেখার মতো করেই বলছি আপনাকে । প্রথম টি হলো – সবাই বলে পুরুষেরা সৌন্দর্যের পাগল। সৌন্দর্য থাকলে পুরুষদের আটকানো যায়। অথচ কথাটা সবচেয় বড় মিথ্যা কথা। সৌন্দর্য দিয়ে কখনো পুরুষকে আটকানো যায়না। এই যে, আমি আটকাতে পারিনি। এতো সুন্দর হয়েও, এতো ভালোবেসেও তো আমি পারিনি আমার স্বামীকে আটকাতে। সে ঠিকই চলে গেছে অন্যের কাছে। যাদের চরিত্র ভালো তারা একজনের কাছেই আটকে যায়; একজনের মায়ায়, একজনের ভালোবাসায় পার করে দেয় এক জনম। আর যাদের চরিত্র খারাপ, উদ্দেশ্য খারাপ, তাদের সামনে বিশ্বসুন্দরী চলে এলেও তারা অন্যের খোঁজেই থাকে।

মায়ের দ্বিতীয় আফসোস হিসেবে লিখেছিলো – আমিনের সাথে আমার সম্পর্ক ২২ বছরের। বিয়ের ৬/৭ বছর পরে জন্ম হয়েছে বিভার। সে হিসেবে আমরা একসাথে পার করেছি অনেক বছর। এতোগুলো বছর ধরে আমিন আমাকে মিথ্যা কথা বলেছে। বলেছে সে আমাকে ভালোবাসে। ভালোবাসার কথা বলে এতোগুলো দিন সে আমাকে ঠকিয়েছে। অথচ সে আমাকে কখনো ভালোইবাসেনি, ভালোবাসার সংজ্ঞাই সে জানেনা। সে যদি আমাকে সত্যি কথাও বলতো তবুও এতো কষ্ট আমি পেতাম না যতোটা আজ লাগছে। মিথ্যা, প্রতারণা এতো যন্ত্রণাদায়ক কেন?

মায়ের লেখা তৃতীয় আফসোস – আমি আমার স্বামীর সাথে পার করে ফেললাম প্রায় দুই যুগ। অথচ দুই যুগ পার করেও তার মন বুঝলাম না, মনের খবর জানলাম না। একসাথে দুই যুগ পার করেও তার মনে বাস করতে পারলাম না। আমাদের মধ্যে যুগ যুগের দূরত্বই রয়ে গেল। ঘর বাঁধলেই আপন হওয়া যায়না। আমি পারলাম না আপন হতে।’

মায়ের লেখা চতুর্থ আফসোস – আমার মনে হয় আমি আর বাঁচব না। তাহলে আমার সন্তানদের কী হবে? পেটে যে আছে তার কী হবে? আমার জীবন্ত তিন পুতুলকে ছেড়ে দিয়ে গেলাম এই নিষ্ঠুর দুনিয়ায়। তাদের বেড়ে ওঠা দেখতে পারলাম না, তাদের সুখ-দুঃখের সাথি হতে পারলাম না। এই দুঃখ আমি কোথায় রাখব?

বিভা হাপ ছাড়ল। কিছুক্ষণ নিজেকে বিশ্রাম দিয়ে বলল, ‘ অনেক কথা বললাম মাহাথির। শুধু শুধু এমন অহেতুক কথা শোনার জন্য ধন্যবাদ। বিরক্ত হলে সরি। এতো কথা কেন বললাম জানেন? কারণ আমার মায়ের একটি আফসোস এখন আমার মধ্যেও চলে আসার চেষ্টা করছে। আমার মায়ের ২য় আফসোস ছিল আমিন শিকদারের বলা মিথ্যা ভালোবাসার কথা। মায়ের মনে হতো আমিন শিকদার তার সাথে প্রতারণা করেছে। আসলে সত্যিই তাই। প্রতারণাই করেছে। যদি সত্যিই ভালোবাসতো আমার মাকে, কখনো অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারতো না। জেনে খুব কষ্ট লাগছে আজ আপনিও আমার সাথে প্রতারণা করছেন।’

মাহাথিরের দৃষ্টিতে চোখের ভাষা প্রকাশ পেল। বিভা বুঝল মাহাথির তার কথার মানে বুঝেনি। তাই বিভা বলল, ‘ আপনি আমাকে বিয়ের পর অনেক কথা বলেছেন মাহাথির। খারাপ কথা বলেছেন, অপমান করেছেন আমি কিছু বলিনি। কারণ আমার সেগুলো ততোটা খারাপ লাগতোনা। উলটো আপনার প্রতি সম্মান আসতো। মনে হতো, আর যাই হোক আপনি মিথ্যা তো বলছেন না। নাটক তো করছেন না – এই অনেক। এইসব ভেবে খুশি ছিলাম। অথচ এখন! এখন আপনার কী হয়েছে মাহাথির? আপনি বুঝাতে চাচ্ছেন আপনি আমার প্রতি আগ্রহী, আমাকে পছন্দ করেন। কিন্তু এইসব আমার কাছে বানোয়াট মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আপনি জোড় করে সব করছেন। আপনি বলেছিলেন আপনি কখনো আমাকে ভালোবাসবেন না। যদি কিছু হয় তা জাস্ট হওয়ার জন্য হবে। তাহলে আজ কী আপনাকে বিশ্বাস করা সাজে আমার? আমরা দু’জন মানুষ সংসার করছি – এই অনেক। চলে যাবে এভাবেই। শুধু শুধু নিজের ওপর আবরণ সৃষ্টি করার প্রয়োজন নেই।’

বিভা এবার এগিয়ে এলো। মাহাথিরের দিকে তাকিয়ে নম্রকণ্ঠে বলল, ‘ আমাকে মিথ্যে বলবেন না, মাহাথির। তাহলে আমি একদম ম/রে যাব। সাথে আপনার প্রতি সম্মানটাও হারিয়ে যাবে। আমি কোনো প্রতা/রণার সংসার চাইনা। আপনি যেভাবে ছিলেন আমি ওতেই খুশি।’

মাহাথিরের গভীর, করুণ দৃষ্টি হয়তো বিভাকে নাড়াতে পারল না। মলিন হাসল বিভা। বলল,
‘ আর তাছাড়া আপনি আমাকে ভালোবাসবেনই বা কেন? কে আমি আপনার? কী হই?’
বিভা লক্ষ্য করল না মাহাথিরে কম্পিত ঠোঁটজোড়া। সে নিজের শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘ আমি আপনার কেউ হইনা, মাহাথির। আমি আপনার কেউ না। তাই ভালোবাসার কোনো কারণও নেই।’

বিভা চলে গেল নিজের নিষ্ঠুর কথা শেষ করে। মাহাথির আর বিভার দিকে ঘুরেও চাইল না। গম্ভীর মুখেই সামনে এগিয়ে গেল। পার হলো কিছু সেকেন্ড, কিছু মিনিট। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের টলমল দৃষ্টি তাঁক করে গানের সুর তুলল মাহাথির,
‘ তুমি আমার আঁধার রাতে একশো তারার মালা।’

______
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ২৭১৩
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান

একগুচ্ছ শুকতারা
শারমিন ইরান

৩৯.
মানুষের জীবন ধীরে ধীরে সহজ হয়, সুন্দর হয়। দুঃখ দূর হয়ে খুশিরা ডানা ঝাপটে আসে। অথচ মাহাথিরের মনে হলো তার জীবনে ঘটছে সব উলটো টা। তার জীবন সহজ ছিল, সুন্দর ছিল, নির্ঝঞ্ঝাট ছিল। এমন জীবনে হয়তো সে বোরিং ফিল করছিল। তাই তো নিজ দায়িত্বে জীবনটাকে এলোমেলো করেছে।

ছোটথেকেই তার দুনিয়া বেশ সংকীর্ণ। গুটি কয়েক মানুষকে নিয়ে তার দুনিয়া। ভালোই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই ‘বিভা’ নামক রমণী কোথায় থেকে যেন উড়ে উড়ে চলে এলো। তার সহজ, পানসে জীবনকে ডানা ঝাপটে করে দিলো আরোও সুন্দর। দূর করল সব একাকীত্ব। চারদিকে মেলে দিলো যত্ন, ভালোবাসার ঘ্রাণ।
নিজের এলোমেলো অনুভূতিতে মাহাথিরের মনে হলো যদি একটা ভালোবাসার যন্ত্র থাকতো তবে বেশ হতো। তাকে এতো দোটানায়, ঝামেলায় পড়তে হতো না। সে সেই যন্ত্রকে প্রশ্ন করতো ‘ মাহাথির কবে বিভার সাথে এতোটা জড়িয়ে গেল? মাহাথিরের মনে কবে বিভাকে ঘিরে এতো অনুভূতি তৈরি হলো?’
ভালো লাগেনা। কিচ্ছু ভালো লাগেনা। প্রথমে তার আম্মা বিয়ের কথা বলতো যা সে এড়িয়ে চলতো। যেন বিয়ে কোনো অপরাধমূলক কাজ। এরপর যখন নিজের দোনোমনা মন নিয়ে বিয়ে করে বসল তখন আবার ঠিক করল সংসার করবেনা। বিভাকে স্ত্রী হিসেবে মানবেই না। খুঁত হিসেবে বের করল গায়ের রঙ যা মাত্রই ছিল একটা বাহানা। কতো খারাপ ব্যবহার, কতো অপমান করল বিভাকে! এরপর ধীরে ধীরে নিল সংসার করার সিদ্ধান্ত। সবশেষে ভালোবেসে ফেলল বিভাকে। ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ল। অনুভূতিরা ঝাপটে ধরল তাকে।

এতোকিছুর মাঝে কখন বিভার প্রতি অনুভূতি তৈরি হলো কে জানে!
অনুভূতির জন্ম বোধয় হয় বিভার করা যত্ন থেকে। প্রথম প্রথম বিভার দেওয়া যত্ন তার বেশ ভালো লাগতো। বিভা তার প্রতি যত্ন করছে তা সে অনুভব করতো। নিজের অজান্তেই ভালোলাগা তৈরি হতো। এরপর তার মনে চাপল কীভাবে বিভাকে খুশি করা যায়। কীভাবে মেয়েটার কষ্ট একটু দূর করা যায় তার প্রচেষ্টা। তাই তো প্রায় এটাসেটা কিনে নিয়ে যেত বিভার জন্য। উদ্দেশ্য বিভার মুখের একটু হাসি দেখা। তাও হতোনা। তাতে অবশ্য মাহাথিরের দোষই থাকতো। কারণ বিভা যখন প্রশ্ন করতো কার জন্য, তখন সে বলতে পারতো না ‘ তোমার জন্য’, মুখ থেকে স্বভাববশত গম্ভীর গলা বের হতো অথবা উলটোপালটা কথা বলে বসতো। কেন? কী হতো যদি সে দু’টি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করতো? সে যদি উচ্চারণ করতো — ‘ তোমার জন্য’। তাহলেই তো বিভা হাসতো। সুন্দর করে হাসতো। সে বলেনি কেন? যেই অপরমানুষ টাকে খুশি করতে সে দু’টো শব্দ উচ্চারণ করতে পারেনি, তার থেকে সে এতোকিছু আশা কীভাবে করছে? লজ্জা হওয়া উচিত তার।

মাহাথির ভীষণ অবহেলার সাথে দৃষ্টি মেঝেতে দিয়ে আছে। মেঝেতে তাকিয়ে ভাবছে নিজের জীবনের কথা। সেই মূহুর্তে আনাস এসে বসল সামনে। মুখে উৎফুল্লতা। নিশ্চয়ই ছুটি মঞ্জুর করেছে। মাহাথির আনাসের দিকে তাকালে আনাস উৎফুল্লতার সাথে বলল, ‘ কীরে! আগে গম্ভীর হয়ে থাকতি, এখন দেবদাসের মতো মুখ করে থাকিস। জীবনে মুখটা স্বাভাবিক করবি না?’
মাহাথির কিছু বলল না। আনাসের মনে হলো পরিস্থিতি বেশ গম্ভীর, সিরিয়াস। তাই সে কৌতূহলী কণ্ঠে জানার আশায় বলল, ‘ সব ঠিক হয়নি দোস্ত?’
মাহাথির হালকা দুপাশে মাথা নেড়ে জানালো, না! হয়নি।
‘ ভাবী কী বেশি রাগ?’
‘ আমাকে বিশ্বাস করেনা ও।’
‘ বুঝলাম না।’
‘ ওর ধারণা আমি মিথ্যা বলছি।’
‘ সবকথা বুঝিয়ে বল।’
‘ ও বলছে ও আমাকে ভালোবাসতো আমার স্বচ্ছতার কারণে। আমি আমার মনের কথা ওকে বলে দিতাম হোক সেটা খারাপ কথা – এই জন্য আমার প্রতি ওর সম্মান আসতো। কিন্তু এখনের কথা ওর কাছে মিথ্যা, বানোয়াট লাগে। তাই আমি এইসব বললে নাকি আমার সম্মানও ওর নজড়ে কমে যাবে। কী করব আমি বল? নিজের অনুভূতি বলতে গিয়েও আটকে যাচ্ছি।’ হতাশ গলায় নিজের দ্বিধাযুক্ত কথা শেষ করল মাহাথির।

‘ এখন এইসব কিছু মনে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এতোদিন এতোকিছুর পর হঠাৎ করে….’
‘ হঠাৎ করে?’ আনাসের কথা সম্পূর্ণ হতে না দিয়েই মাহাথির গর্জে উঠল। যার অর্থ – আনাস ভুল বলছে। তাই তাকে উল্টো প্রশ্ন করে বুঝানো হলো যে সে ভুল।

আনাস নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল,
‘ সরি। সরি। ভুল হয়েছে। হঠাৎ করে না। তবে হঠাৎ করে যে অনুভূতি হয়নি সেটা তুই জানিস, আমিও জানি। কারণ আমি তোর অস্থিরতা দেখেছি। কিন্তু বিভা তো জানেনা রে। ওকে জানা।’
মাহাথিরের জেদ চাপল। বলল,
‘ কেন জানবে না? ও কি অন্ধ? ও জানে। তাও আমাকে কষ্ট দিচ্ছে।’

‘ ব্যাপারটা এমন নয় মাহাথির। দেখ, বিয়ের পর থেকে তুই বিভার সাথে খারাপ ব্যবহার করছিস। ধীরে ধীরে ওর ওপর তোর ভালোলাগা কাজ করতে শুরু করল। এরপর তুই বুঝলি ওকে ছাড়া তোর চলবেনা। কিন্তু এতোকিছু তো বিভা জানেনা। তুই জানতে দিসনি। তুই কী মনে করছিস ওর কষ্ট, অভিমান এতো সহজে গলে যাবে? তুই হঠাৎ করে ওকে গিয়ে বলছিস ওর আগের করা কাজ তুই মিস করছিস। এটাকে ও কী ভাববে বল? ভাববে তুই জাস্ট ওর ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছিস। আর কিছুনা।’

‘ তোরও কী মনে হয় আমি শুধু নিজের প্রয়োজনে এমন করছি?’ মাহাথিরের কণ্ঠে অসহায়ত্ব, যেন সে এইবার নিজেই নিজের ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে।

‘ না বন্ধু। তুই ভাবির ওপর নির্ভরশীল হয়ে আছিস এইটা সত্যি, ওর প্রতি অভ্যস্ত হয়ে গেছিস এইটাও সত্যি। সাথে তোর মধ্যে সত্যিই বিভার জন্য ভালোবাসা আছে সেটা আমি জানি। ভালোবাসা আছে বলেই বিভার জন্য চিন্তা করতি, যত্ন করতি নিজের অজান্তেই, খুশি করতে চাইতি। এরপর বিভা যখন ওর কাজগুলো বন্ধ করে দিল তখন তুই কষ্ট পেতে শুরু করলি, একাকীত্ব বোধ করতে লাগলি। তোর এই ভেবেই খারাপ লাগল যে বিভা তোকে যত্ন করছেনা, তোর খেয়াল রাখছেনা। তোকে ভালোবাসছেনা। কারণ আমরা আমাদের প্রিয় মানুষের অবহেলা মানতে পারিনা। ঠিক বললাম?’
মাহাথির বাচ্চাদের মতো উপর-নিচ মাথা নাড়ল। বাচ্চাদের মতো স্বীকারোক্তি দিতে চেষ্টা করল, ‘ আমার, আমার এই ভেবে ভয় হয়েছে যে বিভা যদি সত্যি সত্যি ওর মন থেকে আমাকে উঠিয়ে দেয়?’

আনাস মলিন হাসল। যে বন্ধু আগে প্রয়োজনেও কথা বলতো না, কেবল শুনতো। তার সেই বন্ধুই আজ কতোটা উদ্বিগ্ন! কতোটা ভয় তার চোখে-মুখে! ভালোবাসা কী সুন্দর! কতোটা বদলে দেয় একটা মানুষকে! ভেবেই অবাক লাগে।

বেল বেজে উঠল। অর্থাৎ কাজের সময় শুরু। আনাস উঠতে উঠতে বলল, ‘ চিন্তা বাদ দিয়ে কাজ তাড়াতাড়ি শেষ কর। এরপর দ্রুত বাড়ি চলে যা। ভাবিকে অনুভব করা তোর অবস্থা। এইভাবে দেবদাস হয়ে কিছুই হবেনা।’

মাহাথির স্ক্রিনে তাকাল। তার বাকি কাজ দেখে মাথা ঘুরতে লাগল। এতো কাজ সে করবে কখন ভেবেই ইচ্ছে করল সামনের ল্যাপটপটা ভেঙে গুড়িয়ে দিতে।

.
বাড়িতে ঢুকেই দেখতে পেল আব্বা-আম্মা একসাথে বসে আছে। দৃশ্যটা কী সুন্দর! আব্বার শরীরটা আগের তুলনায় অনেক ভালো — ভেবেই এতো এতো যন্ত্রণার মাঝেও বুকের কোথাও একটু শান্তি পেল।
সিদ্দীক সাহেবও ছেলেকে দেখতে পেয়ে চোখে হাসলেন। বলল,
‘ যাও আব্বা হাত-মুখ ধুঁইয়া আসো। একসাথে পিঠা খাই। আমার আম্মা বানাইছে পিঠা।’
বিভাকে কী সুন্দর করে আম্মা ডাকছে তার আব্বা! শুনে ভালো লাগল মাহাথিরের। ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নাড়তে যাবে তখনি হাসিনা বলে উঠল, ‘ কীসের পিঠা খাওয়া! দুপুরে খাবার নেয়নাই তোমার পোলা। যাও, তুমি হাত-মুখ ধুঁইয়া টেবিলে বসো আব্বা। আর শুনো ঘরে ঢুইকা বউরে ডাক দিও। বউ দুপুরে খায় নাই। খাবার নাকি ভালো লাগেনা। তাই পিঠা বানাইয়া, গোসল দিয়া সেই যে ঘুম দিসে এখনো উঠে নাই। যাও গিয়া দেখো।’

মায়ের কথায় চিন্তার ভাঁজ পড়ল কপালে। দুপুরে খায়নি কেন বিভা? মূহুর্তেই অন্য চিন্তা মাথায় আসতেই ভেতর থেকে খুশিরা হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠল। বিভা খায়নি। কেন খায়নি? সে দুপুরে খাবার নেয়নি বলে?
মাহাথির না চাইতেও হেসে ফেলল। নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে মুখটা হয়ে উঠল উজ্জ্বল। যেখানে নিজের স্ত্রীর জন্য দুশ্চিন্তা করার কথা, সেখানে সে এই ভেবে খুশি হলো যে তার স্ত্রী এখনো তাকে ভালোবাসে। তার জন্য চিন্তা করে। মাহাথির নিজের উপচে পড়া খুশি থামাতে পারল না। আবার প্রকাশ করাও সম্ভব নয়। তাই সে যতোদ্রুত সম্ভব ঘরে চলে গেল। হাত-মুখ ধুঁয়ে খাবার খেতে বসতে হবে। সে আর বিভা একসাথে খাবে ভেবেই মাহাথিরের হাত-পা দ্রুত চলতে লাগল।

.
চোখ খুলে মুখের ওপর মাহাথিরের মুখ দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল বিভা। ঘুম থেকে উঠেই সে এমনকিছু আশা করেনি। মস্তিষ্ক সচল হতে সময় নিল।
মাহাথিরের মুখ চিন্তিত। বিভাকে সুস্থ লাগছেনা। কেমন মলিন চোখ-মুখ। সত্যি সত্যি অসুস্থ নাকি না খাওয়ার কারণে এমন লাগছে। শান্তকণ্ঠে শুধাল, ‘ ঠিক আছো?’

বিভা কিছুই বলল না। বিভার ঘাড়ে ব্যথা করছে। শরীর অবশ লাগছে। হাত উঠিয়ে ঘাড়ে রাখতেই মাহাথির হয়তো বুঝল। কপালে ভাঁজ ফেলেই নিজের হাত বিভার ঘাড়ে দিয়ে মালিশ করতে লাগল। অবাকে সর্বোচ্চ উচ্চতায় থাকা বিভা নির্নিমেষ চেয়ে রইল তার সামনে থাকা কয়েক ইঞ্চি দূরত্বের পুরুষের দিকে।
নিজের কাজ শেষেই বলল, ‘ দুপুরে খাওনি কেন? চলো খেয়ে নিবে। খাবার টেবিলে খাবে নাকি এখানে আনব?’
‘ খাবনা আমি।’
‘ বেশি কথা বললে ঘাড় ভেঙে দিব।’ গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল মাহাথির।
বিভা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। অনেকদিন পর ধমক খেল সে। মাহাথির প্রশ্ন করল,
‘ খাওনি কেন তুমি?’
বিভা ঠোঁট চেপে ধরল। সে খায়নি দু’টো কারণে। প্রধান কারণ হলো মাহাথির খাবার নেয়নি কেন? তাই সেও খায়নি। খেতে ইচ্ছে করেনি। দ্বিতীয় কারণ হলো যখনি ভেবেছিল খাবে তখনি খাবারের গন্ধে অসহ্যবোধ হচ্ছিল। তাই ঘরে এসে ঘুম দিয়েছে। তবে এর কিছুই বিভা বলল না। বলল, ‘ এমনি।’
‘ এরপর থেকে এমন অনিয়ম করোনা।’
‘ কেন? করলে কী করবেন?’
‘ করবে কেন তুমি?’
পুরোনো চিন্তা মাথায় চেপে বসল বিভার। বলল, ‘ এতোকিছু করার কী দরকার বলুন তো? আমি তো আপনার সাথে আছি। আপনার ঘরে আছি, কাছে আছি। তবুও হঠাৎ এইসব কেন শুরু করেছেন আপনি?’
‘ মানে?’
‘ মানে এই যে নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাকে মানার চেষ্টা করার দরকার নেই আপনার, ভালোবাসার অভিনয়েরও দরকার নেই। শুধু শুধু চিন্তিত দেখানোরও প্রয়োজন নেই। আগে যেমন ছিলেন তেমনি থাকুন।’

বিভা খাট থেকে নেমে পড়ল। মাহাথির তখনো বসা। সে আটকে ধরল বিভার হাত। বিভা ঘুরলে দেখল মাহাথির তাকিয়ে আছে তার দিকে। মলিন, শান্ত মুখে। চোখের দৃষ্টিতে সামনের মানুষের কাছে নিজেকে বুঝাতে না পারার অসহায়ত্ব। মাহাথির বলল,
‘ আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে বুঝবে বিভা। আমার চলাফেরায়, কাজকর্মে, চোখের ভাষায় তুমি আমাকে বুঝতে পারবে। কিন্তু তুমি আমাকে বুঝলে না। বুঝলে না নাকি বুঝেও না বুঝার চেষ্টা করছো আমি জানিনা।’

বিভা অবহেলার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাহাথির উঠে গেল। নিজের দুই বাহুতে বিভাকে আড়াল করে ফেলল। এক হাতে বিভার মাথা বুকে মিশিয়ে দিয়ে সে নিজের মাথা নামিয়ে আনল বিভার কাঁধে। নিজেকে বুঝানোর চেষ্টায়, নিজের ভুলগুলো শুধরানোর চেষ্টায় কাতর কণ্ঠে বলল,

‘ তোমাকে আমার কষ্ট দেওয়া উচিত হয়নি। তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করা উচিত হয়নি। তোমার অনুভূতিকে অবমূল্যায়ন করা উচিত হয়নি। বিয়ের পর থেকে যা যা করেছি তার কিছুই করা উচিত হয়নি। আই এম সরি। আই এম সরি ফর এভ্রিথিং। আমাকে ক্ষমা করো তুমি। তবে এতো এতো অনুচিতের মাঝে তোমাকে ভালোবাসাটা উচিত হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করো বিভা। আমাকে বিশ্বাস করো।’

কাঁধে মাহাথিরের ঠোঁটের ছোঁয়ায় শক্ত হয়ে গেল বিভা। চুপচাপ শুনল মাহাথিরের কথা। চোখের কোলে জমতে থাকল বিন্দু বিন্দু অশ্রু। বুকের ভেতরে থাকা অবিশ্বাসদের ডানা গজালো। তবে উড়ে গেলনা। সাথে শক্ত পাথরের মতো অভিমান গুলোর মাঝে মাহাথিরের কথাগুলো ভীষণ ভারী হয়ে পড়ল। অভিমান গুলো ফেঁটে গেল। তবে ফাঁটলেই তো শুধু হবেনা। অভিমান গলে তরল হতে হবে। এরপর সেই অভিমান গুলো ভালোবাসার সাথে দ্রবীভূত হয়ে নিঃশ্বাস হতে হবে। এতোকিছু কী সত্যিই হবে?
বিভা মাহাথিরের পিঠে এক হাত রাখল। নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলল, ‘ খাবেন চলুন। সেই সকালে খেয়েছেন। শরীর খারাপ করবে।’

.
মাহাথির ঘরে বসে নিজের কাজ শেষ করছে। অফিসে এখন তেমন কাজ করা হয়না বললেই চলে। সারাক্ষণ নানান চিন্তায় বিভোর থাকে সে। তার চিন্তার যে নিরানব্বই শতাংশ বিভাকে নিয়ে তা আর বলার প্রয়োজন রাখেনা। এখন তার বেশি বেশি কাজ করতে হবে। প্রমোশোন টা হয়ে গেলে বেতন বাড়বে। তখন জীবনটাকে আরোও গুছিয়ে নেওয়া যাবে। আরেকটু স্বচ্ছলতা বাড়বে। মাহাথির নিজের কাজ মনোযোগ দিয়ে করতে লাগল। কাজ প্রায় শেষের দিকে। আরেকটু আছে।

মিনিট বিশেক পর নিজের কাজের সমাপ্তি ঘটালো মাহাথির। উঠে পড়ল জায়গা ছেড়ে। হাত-পা দিয়ে কিছু শারীরিক ব্যায়াম করে শরীরের একঘেয়েমি ছুটালো। এখন উদ্দেশ্য হামিমের ঘরে যাওয়া। আজ একবারো দেখা হয়নি। খবর নেওয়া দরকার। নিজের ফোন উঠানোর ক্ষেত্রে হাত বাড়াতেই চোখে পড়ল দূরে ওয়াবড্রবের ওপর কিছু উলটো করে রাখা। পিছন দিক থেকে ছবি মনে হচ্ছে। অজ্ঞাত কারণবশত মাহাথির ভীষণ কৌতূহল বোধ করল। ফোন উঠিয়ে এগিয়ে গেল। হাত দিয়ে ছবিটা উল্টো করতেই চোখে পড়ল একটা শান্ত হাসিমাখা মুখ।
লাল জমিনের সাধারণ শাড়ি। সরু গোল্ডেন রঙের পাড়। চোখে-মুখে প্রসাধনীর ছোঁয়া নেই। মুখে নির্মল, স্বচ্ছ হাসি। মাহাথির ছবিটার মুখটার প্রতি ভীষণ মায়া অনুভব করল। বুঝাই যাচ্ছে যুবতী কালের কিংবা বিয়ের পর পরই তোলা ছবি। মাহাথির নিজমনে বলল,
‘ আপনি অনেক কষ্ট করে গিয়েছেন জীবনে। তবে চিন্তা করবেন না। আমি এতোটা খারাপ নই। আপনার মেয়েকে এতোটা কষ্ট আমি দিবনা। তাকে আগে ভালো না রাখতে পারলেও এখন ভালো রাখব। ওকে স্বামী হয়ে আগলে রাখব। বাকি দু’জনকে ভাই হয়ে। বিশ্বাস করেছেন? নাকি আপনার মেয়ের মতো আপনিও আমাকে বিশ্বাস করেন না?’

মাহাথির ভীষণ যত্ন করে ছবিটা রেখে ঘুরল। ঘুরে মনে হলো তার সবকথা শেষ হয়নি। ফিরে তাকাল। আবারো ছবিটা উঠিয়ে বলল, ‘ আপনার বদ মেয়েকে বলবেন ভালো হতে। নয়তো ওর ঘাড় ভেঙে ফেলব আমি।’
_____
চলবে~
শব্দসংখ্যা – ১৮৬৩
#একগুচ্ছ_শুকতারা
#শারমিন_ইরান