অপেক্ষার বসন্ত পর্ব-০১

0
406

#অপেক্ষার_বসন্ত
ফাহমিদা তানিশা
পর্ব ০১

হাতে ডিভোর্সের চিঠিটা নিয়ে উকিলের চেম্বারে প্রবেশ করতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো অর্নি। পেছনে ফিরে একপলক তার হাসবেন্ড আরাফের দিকে তাকালো। আরাফ শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। দুজনের চোখাচোখি হতেই একটা মুচকি হাসি দিয়ে অর্নি আবার ফিরলো সামনের দরজাটার দিকে। মুচকি হাসিটা একটু প্রশস্ত করে সে এডভোকেট শাহানার রুমে ঢুকে পড়লো। রুমে প্রবেশ করতেই মিসেস শাহানা উঠে দাঁড়িয়ে সবিনয়ে অর্নিকে বসতে অনুরোধ করলেন। মিসেস শাহানার এসিস্ট্যান্ট লিপি দ্রুত পায়ে এসে তাকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিলো।সেও ধন্যবাদ বলে চেয়ারটাতে বসতে বসতে মিসেস শাহানাকে বললো:”আপনার নিশ্চয় মনে আছে ডিভোর্সের জন্য দরখাস্ত করেছিলাম।তারা আমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন।”
এই বলে তার হাতে থাকা খামটা মিসেস শাহানার সামনে থাকা টেবিলে রাখলেন। মিসেস শাহানা চিঠিটা হাতে নিয়ে একবার পড়লেন। তারপর বিচলিত কন্ঠে বললেন:ম্যাম,আপনি কি এখনো আপনার সিদ্ধান্তে অটল? মানে আপনি সত্যি সত্যি ডিভোর্স চাইছেন?

মিসেস শাহানার কথায় অর্নি তার দিকে একবার তাকালো। মুচকি হাসির রেখাটা আবারো মুখে এনে বললো: আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল বলেই তো আপনার কাছে এসেছি। যদি সিদ্ধান্ত বদলে ফেলতাম তাহলে নিশ্চয় হানিমুনে যাওয়ার প্ল্যান করতাম।
অর্নির এমন ছেলেমানুষী কথায় মিসেস শাহানা অবাক হলেন।চিঠিটা আবার তিনি হাতে নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর আড়চোখে অর্নিকে পর্যবেক্ষণ করলেন।
অর্নি তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে এখনো মুচকি হাসির ছাপটা স্পষ্ট। শুধু এখন নয়। মিসেস শাহানার সাথে যতোবার অর্নির দেখা হয়েছে সবসময় তিনি অর্নির মুখে মুচকি হাসির একটা ঝলক দেখতে পান। কেমন জানি এক রহস্যময় হাসি!কখনো যেন সেই হাসিটা বন্ধ হ‌ওয়ার নয়।হাসিটা দেখে মিসেস শাহানা মনের মধ্যে সাহস জোগালেন। একটু ইতস্তত করে বললেন:যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলি?
_একটা কেন?হাজারটা কথা বলতে পারেন।আই ডোন্ট মাইন্ড।
তার কথায় মিসেস শাহানার সাহসটা আরেকটু বাড়লো। গোছানো ভাষায় বললেন: মানুষ হিসেবে আমরা সবাই সম্পর্কের বেড়াজালে আবদ্ধ।একঘরে যখন দুজন মানুষ নতুন করে জীবন শুরু করে তখন বিভিন্ন বিষয়ে মনোমালিন্য হতে পারে। সময়ের সাথে সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হলে ধীরে ধীরে মেলামেশা হয়ে যায়। তবে একটু অপেক্ষা করতে হয়। এখন আপনি যদি অপেক্ষা না করে বিয়ের ছয় মাসের মাথায় ডিভোর্স চান তাহলে কিভাবে হয়? আমার দৃষ্টিতে আপনি একজন ম্যাচিউর মানুষ। আপনার হাতে আমাদের জেলার পুরো বিচার বিভাগ ন্যস্ত। আপনার তো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দুবার ভাবা উচিত।
মিসেস শাহানার কথায় অর্নি শব্দ করে হাসলো। একটু পর হাসি থামিয়ে বললো: আমাদের বিয়ের এখনো চার মাস চলছে।ছ’মাস হতে আরো বিস্তর সময় বাকি আছে।
কথাটা শুনে মিসেস শাহানার রাগ হলো। তবু নিজেকে শান্ত করে বললো:ম্যাম আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন?
_আরে না না। আপনাকে সঠিক ইনফরমেশনটা দিচ্ছি।
_ম্যাম আপনাকে বারবার বলছি। সংসার জীবনটাকে গোছাতে একটু সিরিয়াস হোন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।
_আমি সব ঠিক করতে চাইছি বলেই ডিভোর্সটা চাই। আপনি দ্রুত ডিভোর্সটা কার্যকর করার চেষ্টা করুন। দরকার হলে ডাবল পেমেন্ট করবো আপনাকে। আমার হাতে আর সময় নেই। আজ উঠতে হবে।ভালো থাকবেন।

কথাটা বলেই সে উঠে হনহন করে বেরিয়ে গেলো। মিসেস শাহানাকে কোনো কথা বলার সুযোগ পর্যন্ত দিলো না। শাহানা বোকার মতো অর্নির যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে এখনো।

অর্নি শাহানার চেম্বার থেকে বের হয়ে দাঁড়ালো।তার স্বামী আরাফ‌ও কোর্টে এসেছে আজ।তার পক্ষের উকিলের সাথে কথা বলতে। অর্নি নিজে আরাফকে তার পক্ষের জন্য উকিল ঠিক করে দিয়েছে।আজ দুজনে বাসা থেকেও একসাথে এসেছে কোর্টে। কিন্তু অর্নি মিসেস শাহানার চেম্বারে ঢুকে গেলেও আরাফ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল কোনো এক মেয়ের জন্য। মেয়েটা কে তা অবশ্য অর্নি জানে।আরাফের এক্স গার্লফ্রেন্ড এবং হবু স্ত্রী “জুঁই”। জুঁই আসতে দেরি করায় আরাফের উকিলের রুমে যেতে একটু দেরি হয়েছে।অর্নি সিদ্ধান্ত নিলো আরাফের জন্য অপেক্ষা করবে। তারপর দুজনেই আবার একসাথে বাড়ি ফিরবে যেহেতু আসার সময় তারা একসাথে এসেছে। তাছাড়া জুঁইয়ের সাথেও আলাপ করা হয়ে যাবে। জুঁইকে আগে থেকেই সে চিনতো আরাফের গার্লফ্রেন্ড হিসেবে কিন্তু কখনো কথা হয়নি।আজ দুজনের আলাপ করাও হয়ে যাবে।

রাস্তার একপাশে আরাফের গাড়িটা দাঁড় করানো আছে।অর্নি একপলক সেদিকে তাকাতেই টুপ করে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো। সেই ছোট্ট বেলা থেকেই আরাফ তার জীবনের একটা অংশ হয়ে আছে। তার জীবনের প্রথম পুরুষ যাকে একপলক দেখার জন্য অর্নি কতো বাহানা করতো,কতো পাগলামি করতো, মায়ের কাছ থেকে কতো বকা শুনতো।আজ‌ও সে এক‌ইভাবে অনেক বাহানা, পাগলামি করছে কিন্তু সেটা আরাফকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য।তার জীবন থেকে উপড়ে ফেলার জন্য।চাইলেই তাকে জীবন থেকে উপড়ে ফেলা যাবে না। তাছাড়া সে আরাফকে উপড়ে ফেলতে চায়ও না।আরাফ আজীবন থাকুক তার হৃদয়ে কিন্তু অপূর্ণতার চিহ্ন হয়ে।

আরাফ সম্পর্কে অর্নির স্বামী হলেও তার আরেকটা পরিচয় আছে।অর্নি আর আরাফ সম্পর্কে খালাতো ভাই-বোন।তার চেয়েও বড়ো পরিচয় অর্নির জীবনের প্রথম ও একমাত্র প্রেমিক পুরুষ আরাফ। কিশোর বয়সে যখন থেকে অর্নি প্রেম-ভালোবাসা বুঝতে শিখেছে তখন থেকে সে আরাফকে চায়।আর কাউকে কখনো তার ভাবনার জগতে ঠাঁই দেইনি।আরাফ অর্নির চেয়ে বছর ছয়েকের বড় হবে। বয়সের বিশাল ব্যবধান হ‌ওয়ায় আরাফ তাকে ছোট বাচ্চাদের মতো শাসন করে এখনো।কথায় কথায় বকার সাথে আরাফের কাছ থেকে রোজ চড়-থাপ্পড়‌ও খেতে হয় তাকে। এসবে সে অভ্যস্ত। ছোট বেলা থেকে রোজ মার খেতে খেতে এখন সে আরাফের মাইর আর বকাবকিকে সবচেয়ে বেশি মিস করে। তবু এই দীর্ঘ চোদ্দ বছরে অর্নি আরাফকে তার ভালোবাসা বোঝাতে ব্যর্থ। একজন ব্রিলিয়ান্ট মানুষ হলেও সে অর্নিকে বুঝতে পারে না। বুঝতে পারার চেয়েও বড়ো কথা সে বুঝতে চায় না অর্নিকে।কারণ শুধু একটাই।অর্নি যেমন মনেপ্রাণে আরাফকে চায়,আরাফ‌ও তেমন মনেপ্রাণে জুঁইকে চায়। জুঁই ছাড়া সে কিছু বোঝে না।এমনকি নিজেকেও না।

চোখের নোনা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে এখনো।হাতে থাকা টিস্যু দিয়ে বারবার চোখ মুছতে আছে সে।একা একা দাঁড়িয়ে থাকলে আরাফের কথা আরো বেশি মনে পড়বে। কষ্টটা আরো বেড়ে যাবে।তাই চোখ দুটো ভালোভাবে মুছে সামনের দিকে হাঁটা দিলো অর্নি। পেশায় একজন সিআইডি অফিসার হ‌ওয়ায় চাকরির সুবাদে কোর্টে সে রোজ আসে।তাই চারপাশের সবকিছু তার মুখস্থ। শুধু সে নয়,কোর্টের লোকজন‌ও তাকে খুব ভালো করে চেনে। সামনে একটু হাঁটলেই একটা চায়ের টঙ্গী আছে। একজন বয়স্ক মানুষ সেখানে চা বিক্রি করে।অর্নিকে বেশ ভক্তি করেন তিনি। দেখলেই “ম্যাডাম এসেছেন”বলে একটা বিস্তর হাসি দেন তিনি।আজ‌ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অর্নিকে দেখে একটা হাসি দিলেন তিনি। তারপর বললেন: ম্যাডাম চা দিবো?
_জি একটা চা দিন চাচা।
তিনি দ্রুত তাকে একটা চা দিলেন।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সে আরাফকে নিয়ে ভাবছে।চার মাস আগে আরাফের বাবা আরহাম সাহেব এক প্রকার জোর করে দুজনের বিয়ে দিলেন।আরাফ রাজি না থাকায় অনেকটা ছোট পরিসরে আয়োজন হয়েছিল। কিন্তু অর্নি অনেক খুশি ছিল। মনে করেছিল বিয়েটা হয়ে গেলে আরাফ জুঁইকে ভুলে যাবে আর তাকে ভালোবাসতে শুরু করবে। কিন্তু হয়ে গেলো উল্টো।আরাফের বিয়ের দুই মাস পর জুঁই আবারো ফিরে আসলো তাদের জীবনে।প্রায় ছয় বছর আগে তাদের ব্রেকাপ হয়েছিল।তাই অর্নি এবং আরাফের পরিবারের কাছে মনে হয়েছিল বিয়েটা হয়ে গেলে আরাফ জুঁইকে নিয়ে আর ভাববে না।অর্নিকে নিয়ে নতুন করে সংসার করবে। কিন্তু কে জানতো বিয়ের চার মাসের মাথায় আরাফ ডিভোর্স চেয়ে বসবে অর্নির কাছে। নিজের স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে ছয় বছরের পুরনো প্রেমিকাকে বিয়ে করতে যাবে এমন সিদ্ধান্ত আরাফের মতো কোনো পুরুষ নিতে পারে সেটা অর্নির জানা ছিল না।

এসব ভাবতে ভাবতে আরাফ আর জুঁই উকিলের চেম্বার থেকে বের হলো‌। তাদের দেখে অর্নি চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে দ্রুত তাদের সামনে গেলো।আরাফ তাকে দেখে বললো: বাসায় চলে যাসনি এখনো?
_না। একসাথে যাবো বলে যায়নি।
তখনি জুঁই আরাফকে প্রশ্ন করলো:এই মেয়েটা কে?
আরাফ জুঁইয়ের প্রশ্নে একটু থামলো। তারপর বললো:ও আমার কাজিন।
আরাফের মুখ থেকে “কাজিন” শব্দটা শুনে অর্নি ছলছল চোখে তার দিকে তাকালো। কিন্তু আরাফের দৃষ্টি অন্যদিকে।তা দেখে সে নিজেকে কন্ট্রোল করে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো:হাই ভাবি, কেমন আছেন?
জুঁই তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আরাফকে উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো।”তোমার কাজিন মানে? তোমার ব‌উ নাকি?”
কথাটা শুনে আরাফ এবং অর্নি দুজনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।আরাফ অর্নির দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো একবার। তারপর বললো: হ্যাঁ।
জুঁই একবার অর্নিকে উপর থেকে নিচে পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলো। গলার স্বর শক্ত করে বললো: কেমন আছি তা তো তুমি বেশ ভালো করেই জানো। তাহলে আবার জিজ্ঞেস করার কি দরকার?
অর্নি আবারো জুঁইয়ের কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। মানুষের সাথে দেখা হলে কেমন আছে জিজ্ঞেস করাটা তো দোষের কিছু নয়। তাছাড়া বিয়েটাতে ওর দোষ কি?সে তো জানতো জুঁই আরাফকে ছয় বছর আগে ছেড়ে চলে গেছে। তাহলে বিয়ে করতে আপত্তি কোথায় আর?যদি আরাফকে বিয়ে করা অবস্থায় জুঁই আর আরাফের রিলেশন থাকলে তখন তার দোষ হতো। জুঁইয়ের কথার অনেক জবাব অর্নির কাছে থাকলেও সে চুপ করে থাকলো। একটু হেসে বললো:ভাবি আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।আমি কখনো আপনাদের মাঝে থাকবো না।
_তাই? আমাদের মাঝে থাকবে না তুমি?বেশ তাহলে ডিভোর্সটা তাড়াতাড়ি করে ফেলো।আর তোমার তো নিজের বাড়ি আছে।যেই সম্পর্কের কোনো অস্তিত্ব নেই সেই সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য আরাফদের বাসায় থাকার কোনো দরকার নেই। তুমি এখন থেকে তোমাদের বাসায় থাকবে। ঠিক আছে?
অর্নি আর কিছু বললো না। শুধু “ঠিক আছে” বলে মাথা নাড়লো। আসলেই তো জুঁই ঠিক কথা বলেছে। শুধু শুধু সে কোন কারণ ছাড়াই সে আরাফদের বাসায় থাকে।আরাফ তো তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিবে দূরের কথা একটু ভালো করে কথাও বলে না। সেখানে সম্পর্কের কথা ভাবা আর পরিচয় দেওয়া বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।

আরাফ অর্নির দিকে না তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো: তুই বাসায় চলে যা। আমরা একটু ঘুরতে যাবো।একা তো যেতে পারবি যেহেতু রোজ আসিস। না হয় তোর ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে গাড়ি নিয়ে আসতে বল।
অর্নি ছোট গলায় বললো: হুম পারবো। ড্রাইভারকে আসতে হবে না।
আরাফ আর অর্নিকে কিছু বললো না।”চলো জুঁই ” বলে তারা দুজনে হাঁটা দিলো। অর্নি একপলক সেদিকে তাকিয়ে থাকলো। কতো সুন্দর দুজনকে মানিয়েছে কিন্তু সে মাঝে কাঁটা হয়ে আছে। হয়তো তার সাথে আরাফকে আরো ভালো মানাতো কিন্তু আরাফ তা বুঝতে পারছে না বা বুঝতে চাইছে না। আসলেই তার ওদের মাঝখান থেকে সরে যাওয়া উচিত।এসব ভাবতেই তার গাল বেয়ে দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। কিন্তু সে কান্না করতে চাই না। সবাইকে দেখাতে চায় সে খুব ভালো আছে এবং হাসিমুখে আরাফকে মুক্তি দিচ্ছে।তাই তো সবসময় মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখে।আরাফদের গাড়ি চলে গেলো আর অর্নি সেদিকে তাকিয়ে আছে এখনো।

চলবে….