অপেক্ষার বসন্ত পর্ব-০৭

0
233

#অপেক্ষার_বসন্ত
ফাহমিদা তানিশা
পর্ব ০৭

যদি জুঁইয়ের সাথে পারভেজের সম্পর্ক ঠিক থাকে তাহলে জুঁই অর্নি -আরাফের মাঝে জড়াতে চাইছে কেনো?তার লাভটা কি এতে?

পরেরদিন সকালে আরাফের মা মিসেস আরমিনকে হাসপাতাল থেকে বাসায় আনা হয়েছে।সবাই অনেকটা খুশি মনে আছে। আরাফের এখনো দেখা হয়নি তার মায়ের সাথে।তবু সে খুশি। তার মা সুস্থ হয়েছে এটাই সবকিছু।আজকে অর্নির বাবা-মা আসবেন আরাফদের বাসায়।তাই অর্নি একটু বেশি খুশি।তাই সে দ্রুত অফিসে ছুটে গেলো।হাতে কয়েকটা কাজ আছে।সব সেরে তাড়াতাড়ি চলে আসবে বাসায়।এই ভেবে তার দ্রুত অফিসে যাওয়া।

অফিসে পৌঁছে ইন্সপেক্টর রুমানার সাথে দেখা হলো।রুমানা পারভেজের সম্পূর্ণ ইনফরমেশন দিয়ে একটা ফাইল রেডি করেছে অর্নির জন্য। অর্নিকে পেয়ে ফাইলটা জমা দিলো সে।অর্নি ফাইলটা তার ডেস্কে রেখে অন্য কাজে মন দিলো। আগে অফিসের কাজগুলো তো শেষ করতে হবে। নিজের কাজটা সে পরে বাসায় গিয়েও করে নিতে পারবে। কিন্তু অফিসের কাজ তো দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।তাই হেঁয়ালি করলে তো হয় না।

প্রায় দুই থেকে তিন ঘণ্টা হলো। এতো দিন নিয়মিত অফিসে না আসায় অনেক কাজ জমা হয়ে আছে।তাই এখনো কাজ শেষ হয়নি।হঠাৎ অর্নির ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে বাবার নামটা স্পষ্ট হয়ে আছে। হয়তো তারা আরাফদের বাসায় এসে পৌঁছেছেন তাই খুশি মনে ফোনটা রিসিভ করলো সে। কিন্তু তার বাবার গলার স্বরটা একটু অন্যরকম লাগছে আজ। শুধু চিন্তার ছাপ নয়, একটা রাগ স্পষ্ট আবিষ্কার করতে পারছে অর্নি। গম্ভীর গলায় বললেন: কোথায় তুমি?
_আমি অফিসে।
_আমরা এসেছি তোমার খালামনির বাসায়। তুমি এসো।
_আচ্ছা আসছি।

অর্নি আর অফিসে দাঁড়ালো না। নিশ্চয় কোনো ঝামেলা হয়েছে তাই তার বাবা এভাবে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন।এই ভেবে সে বসকে বলে র‌ওনা দিলো বাসার উদ্দেশ্যে। অফিস থেকে আসার আগে ডেস্কে গিয়ে রুমানার দেওয়া ফাইলটা ব্যাগে নিলো সে।

বাসা থেকে অফিসের খুব একটা বেশি দূরত্ব নয়। তাছাড়া জ্যাম না থাকায় মিনিট দশেকের মধ্যে সে আরাফদের বাসায় পৌঁছালো। বাসায় ঢুকতে সে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলো।কারণ বাড়ির ছোট-বড় সবাই ড্রয়িং রুমে বসা।তার বাবা-মা,বড় আপু,আরাফের বাবা-মা,আরাফের বড় আম্মু, অবনি, আরাবি,আরাফ,রকি। এমনকি বাসার কাজের লোকেরাও উঁকি দিচ্ছে এক পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।নিশ্চয় কোনো আলাপ চলছে।অযথা কোনো কারণ ছাড়া তো সবাই এক জায়গায় এসে জড়ো হবে না।তাই সে পা টিপে টিপে সে দিকটায় গেলো। অর্নিকে দেখে তার বাবা রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। গম্ভীর গলায় বললেন: ব্যাগপত্র গুছিয়ে নাও তাড়াতাড়ি।আমরা অপেক্ষা করছি।
বাবার কথার আগামাথা অর্নির মস্তিষ্কে ঢুকছে না।হুট করে সে ব্যাগ গোছাবে কেন?আর ব্যাগ গুছিয়ে যাবে কোথায়?তাই বাবাকে প্রশ্ন করলো:ব্যাগ গোছাবো কেনো?
অর্নির কথায় তার মা রেগে গিয়ে বললেন: তোকে বলেছে ব্যাগ গোছাতে আর তুই রুমে গিয়ে গুছিয়ে আসবি।এতো প্রশ্ন করিস কেন?
_কিন্তু আমি এখন কোথায় যাবো?অযথা ব্যাগ গুছিয়ে কি হবে?
কথাটা শুনে তার বাবা বললো: তুই বাড়ি যাবি। এখানে আর তোর থাকতে হবে না।
_মানে?
_মানে হলো একটাই।তোর সাথে যেহেতু আরাফের ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে তাহলে তুই এখানে কেনো থাকবি?তোর বাবা এখনো বেঁচে আছে। এখানে যাযাবরের মতো পড়ে থাকার প্রশ্নই আসে না।চল বাড়ি যাবি। ওখানেই থাকবি।

অর্নি তার বাবার কথায় বেশ অবাক হলো।তার মানে সবাই জেনে গেছে ডিভোর্সের ব্যাপারটা। কিন্তু সে চলে গেলে আরাফের কি হবে? সেই বা আরাফকে ছেড়ে কিভাবে থাকবে?রোজ দেখা না হলেও একবার তো শিউর আরাফের সাথে দেখা হয়। সামনে পড়লে একটু তো কথা হয়। এখন তো সব বন্ধ হয়ে যাবে।দেখা তো দূরের কথা কথাও হবে না আর।সে বাবার কথাগুলো শুনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে।তাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার মা মিসেস অরিন রেগে গিয়ে বললো:এই তুই এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?
_দেখো আম্মু। বোঝার চেষ্টা করো বিষয়টা।হুট করে এভাবে আমি আমাদের বাসায় চলে গেলে সবাই কি বলবে?
অর্নির বড়ো আপু এতোক্ষণ চুপ ছিলো। এখন আর চুপ থাকতে পারলো না সে। শান্ত কন্ঠে বললো: ডিভোর্স হয়ে গেলে সবাই কি বলবে এখনো তাই বলবে।এসব লোকের কথায় ভাবতে হবে না।এমনে দুদিন পর ডিভোর্স হলে তুই এই বাড়িতে কি পরিচয়ে থাকবি? না হয় দুদিন আগে চলে গেলি।তাই বাড়াবাড়ি না করে ব্যাগ গুছিয়ে আয়। আমাদের তাড়া আছে।

অর্নি তার আপুর কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো। আসলেই তার কথায় যৌক্তিকতা আছে।এমনেও দুদিন পর সে এই বাড়ির কেউ নয়। তাহলে এখন আর মায়া বাড়িয়ে লাভটা কি হবে? উল্টো নিজেই কষ্ট পাবে। তবু একপলক বাড়ির সবার দিকে তাকালো অর্নি।যদি আরাফ বা আরাফের বাবা-মা কেউ একবার থেকে যেতে বলে তাহলে তার থাকাটা কেউ ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু তাদের কারো কোনো প্রতিক্রিয়া নেই এই বিষয়ে।সবাই বোবা প্রাণীর মতো চুপ করে বসে আছে। এমনকি আরাফের বাবাও একবার বললো না মেয়েটা আপাতত এই বাড়িতেই থাক।পরেরটা পরে দেখা যাবে। তাহলে কি আর থাকা যায়?চলে তো যেতেই হবে।

ধীর পায়ে অর্নি তার মানে আরাফের রুমে গেলো।এই ক’দিনে রুমের অর্ধেক মালিকানা তার হয়ে গেছে।বলা চলে অর্ধেকের বেশি।কারণ আরাফ হাসপাতালের চাপে খুব একটা সময় পায় না বাড়িতে থাকার। সারাদিন অর্নি একা এই রুমে থাকে,ঘুরে-ফিরে।সে আসার পর বেলকনিতে ফুলের গাছ লাগিয়েছিল কয়েকটা। বেশ যত্নে গাছগুলো বড় করেছিল।কয়েকটাতে ফুল ফুটেছে আর কতগুলো এখনো ফুলে পরিপূর্ণ হয়নি। হয়তো গাছগুলোর পূর্ণতা আর দেখা হবে না তার।অনেক স্মৃতি জমে আছে এই রুমটায়।আরাফের সাথে খুব একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক না হলেও চার মাসে অনেকটা সখ্যতা হয়েছে।সব স্মৃতি এই এক রুমে।হয়তো আজকে শেষবারের মতো এই রুমে প্রবেশ।আর কি কখনো সে এই বাড়িতে আসবে বা এই বাড়িতে আসলেও আরাফের রুমে আসতে পারবে? নিজের রুম বলে অধিকার ফলাতে পারবে? তা অর্নির জানা নেই।

বেলকনিতে গিয়ে একবার ফুলের গাছগুলো দেখলো সে। একটা কাঠ-গোলাপ ফুটে আছে। বেশ দারুন লাগছে।কি মনে করে ফুলটি ছিঁড়তে হাত বাড়ালো অর্নি। আবার থেমে গেলো।গাছটায় ফুলটা দারুন মানিয়েছে। ফুল গাছে মানায়,হাতে নয়।এভাবে ছিঁড়ে ফেললে আর লাভটা কি হবে?এই ভেবেই মূলত হাতটা সরিয়ে এনেছিল। কিন্তু পরক্ষণেই মাথায় আসলো ফুলটা এমনেও একসময় ব্যর্থ হয়ে ঝরে যাবে তার মতো।কেউ দেখার থাকবে না।তার চেয়ে বরং সে ফুলটা ছিঁড়ে নিয়ে যাক তার সাথে।আরাফের রুমের শেষ স্মৃতি হয়ে ফুলটি যত্নে থাকুক তার মাঝে।সেটা আরো বেশি ভালো অর্নির ধারণায়।অবহেলায় আস্তে আস্তে ঝরে পড়ার চেয়ে একেবারে শেষ হয়ে যাওয়া ভালো।এসব ভেবে চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। হাতের তালু দিয়ে চোখ দুটো মুছে আবারো সে ফিরলো রুমে। দ্রুত ব্যাগ গোছাতে হবে তাই দাঁড়িয়ে থাকলে তো হবে না। কিন্তু চোখের জল বারবার বিরক্ত করছে তাকে। থামছেই না কিছুতে। এখনো গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অনবরত।

একে একে সব ব্যাগে নেওয়া শেষ।পুরো রুমটা শেষ বারের মতো একপলক পর্যবেক্ষণ করে নিতেই অর্নির চোখ আটকালো দরজার দিকে।আরাফ দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার দিকে কিন্তু মুখে কোনো আওয়াজ নেই।তাই অর্নি জানেই না আরাফ কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে। অর্নি আরাফকে দেখে দ্রুত অন্যদিকে ফিরে গেলো।হাতের তালু দিয়ে আবারো চোখের জল মুছলো। মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে আরাফের দিকে ফিরলো। কিন্তু আরাফের এতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।সে দিব্বি তাকিয়ে আছে অর্নির দিকে।অর্নি হাসির রেখাটা প্রশস্ত করে বললো: আপনার কিছু চুরি করে নিয়ে যাবো ভেবে দেখতে আসলেন?

আরাফ একটু থেমে বললো: আমার সব তো নিয়েই যাচ্ছিস।
_মানে?
_তুই ছোট মানুষ। বুঝবি না।বাই দ্যা ওয়ে,এই হাসিটা আমাকে দেখিয়ে লাভ নেই।আমি চোখ দেখে মন পড়তে পারি।তাই অযথা মুখে হাসি ফুটিয়ে সুখী মানুষ সাজতে আসবি না।

অর্নি আরাফের কথাগুলো শুধু শুনলো। কোনো জবাব দিলো না।এতোই যদি মনের কথাগুলো পড়তে পারে তাহলে এতোদিন বুঝলো না কেন তাকে?আজ তো অন্তত “থেকে যা” বলতে পারতো‌।তাও করলো না সে।আর মন পড়ে লাভটা কোথায়?অর্নি চুপচাপ ব্যাগটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ পেছন থেকে আরাফ ডাক দিলো।ডাক শুনে সাথে সাথে অর্নি দাঁড়িয়ে গেলো। মনে মনে খুশি হলো এই ভেবে হয়তো তাকে থেকে যেতে বলবে। কিন্তু তার স্বপ্ন তো আর সত্যি হয় না কখনো। তাকে বোকা বানিয়ে দিয়ে আরাফ বললো:চলে যাচ্ছিস ফাইনালি?

অর্নি এই প্রশ্নে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ।এই মানুষটা কি দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছে?এতো কিছুর পর চলে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করছে চলে যাচ্ছে কিনা। তাই কিছু না বলে সে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। তারপর আবার হাঁটা দিলো।তার চলে যাওয়া দেখে আরাফ পেছন থেকে জোর গলায় বললো: সাবধানে থাকিস।

কথাটা শুনে অর্নির চোখ দিয়ে আবারো এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। কিন্তু এবারো মুছে নিয়ে সে সবার সামনে গেলো। ড্রয়িং রুমে এসে দেখে তার বাবা বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে বসে আছেন। ‌তার জন্য অপেক্ষা করছে তারা। তা দেখে সবাইকে বিদায় দিয়ে সেও বেরিয়ে পড়লো।

গাড়িতে উঠতে যাবে তখনি আবারো থামলো অর্নি। এখন আর পারছে না। জোরে জোরে কান্না আসছে তার। কিছুতেই যেতে মন চাইছে না। বারবার মাথায় আসছে,কেউ যদি একবার থেকে যেতে বলতো তাহলে কতোই না ভালো হতো। তাকে দেখে তার বাবা গাড়িতে উঠতে বললো। সেও বাবার কথায় উঠে বসলো। গাড়ি ছেড়ে দিতেই তার চোখ গেলো তার রুমের বেলকনিতে।আরাফ রেলিংয়ে হাত দিয়ে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। গাড়ি ছেড়ে দেওয়ায় অর্নি তার চেহারাটা স্পষ্ট দেখতে না পেলেও এতটুকু আবিস্কার করতে পেরেছে যে অর্নির চলে যাওয়াটা আরাফের মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।

আরাফ খুব চাপা স্বভাবের। মনের কথাগুলো যেন সে মনেই জমা রাখে। খুব দামী গহনার মতো তার মনের লকাপে শুধু এসব কথার জায়গা হয়। অন্যের মাঝে এতো দামী কথা কিছুতেই সে ছাড়তে রাজি নয়।এই কারণেই তো আজ এই দশা তার।

অর্নিদের বাড়িতে পৌঁছাতে প্রায় এক ঘণ্টার মতো লেগেছে।সারা পথ ধরে তার চোখ দুটি থামেনি। বারবার জল গড়িয়ে পড়েছে।কোনো নির্জন স্থানে গিয়ে কিছুক্ষণ জোরে জোরে কান্না করতে পারলে হয়তো কষ্টটা একটু কমতো। কিন্তু শহরের বুকে নির্জনতার পাহাড় খোঁজা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।

রাত একটার কাছাকাছি।বাসার আসার পর থেকে অর্নি রুমে বসে আছে একা একা।ঘুম আসছে না আজ।বেশ উদাসীন লাগছে আজ নিজেকে। বারবার আরাফদের বাড়ি থেকে আনা কাঠগোলাপটা দেখছে সে। এই গোলাপের কাঁটা দিয়ে যদি তার ব্যথাগুলো উপড়ে ফেলতে পারতো তাহলে হয়তো একটু নিস্তেজ লাগতো।তা আর হলো কোথায়? হঠাৎ পাশে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো।কেউ ফোন করেছে। কিন্তু এতো রাতে কে ফোন করবে? ধীর পায়ে উঠে গিয়ে ফোনটা হাতে নিলো। স্ক্রিনে “আরাফ ভাই ” নামটা ভাসছে।আরাফ কেনো তাকে এতো রাতে ফোন দিবে?কোনো সমস্যা নয় তো?

চলবে…