অপেক্ষার বসন্ত পর্ব-২২ এবং শেষ পর্ব

0
288

#অপেক্ষার_বসন্ত
ফাহমিদা তানিশা
অন্তিম পর্ব

[কপি করা নিষিদ্ধ]

আরাফ তাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছে।

_বেশ তো ঘোরাঘুরি করলে। এবার তো একটু জামাইয়ের কাছে এসে খোঁজ খবর নাও।

আরাফের কথায় অর্নি সিউর হলো যে সামনে থাকা মানুষটা আরাফ।এটা তার হ্যালুসিনেশন নয়। আরাফের আজকের কথাটা তাকে বেশ অবাক করলো। আগে সে তুই করে কথা বলতো কিন্তু আজ হুট করে তুমি করে বলছে।ভ্রু কুঁচকে বললো: এখানে এসেছেন কেন?
_আমার ব‌উ তো আমার খবর নিচ্ছে না।তাই আমি নিজ থেকে খবর জানাতে চলে আসলাম।
আরাফের কথায় অর্নি মনে মনে হাসলো। সব দারুন লাগছে তার।সে কখনো ভাবেনি আরাফ এভাবে চলে আসবে।তার চেয়েও বেশি খুশি লাগছে আরাফের তুমি সম্বোধনটা।সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।তা দেখে আরাফ বললো: এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?আমি একজন অসুস্থ মানুষ হয়ে সবকিছু উপেক্ষা করে এতদূর পাড়ি দিয়ে তোমাকে দেখতে আসলাম আর তুমি তিন মাইল দূরে দাঁড়িয়ে আছো।তা কি হয়?
_আমি কি বলেছি আমাকে দেখতে আসুন?এতো আদিখ্যেতা দেখানোর কিছু নেই। আপনাকে আমি ভালো করে চিনি। আপনার ইচ্ছা হলো তো কথা বললেন আবার ইচ্ছে হলো তো ভাব দেখালেন।তাই আমিও সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনার সাথে আমার আর হবে না। আমার জন্য পারভেজ পারফেক্ট আছে। আপনি আপনার ভাব আর তেজ নিয়ে থাকুন। আমি গেলাম।

অর্নি কথাগুলো বলে এক মূহুর্তের জন্য‌ও রুমে দাঁড়ালো না। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসলো।কারণ শুধু একটায়। পারভেজ শব্দটা শোনার পর আরাফ যে তাকে চিবিয়ে খাবে তাতে তার কোনো সন্দেহ নেই। এখন আরাফ একাই জ্বলেপুড়ে মরুক অর্নির কিছুই আসে যায় না। অর্নি ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসতেই দেখলো তার খালাও এসেছেন।তার মা আর খালা সেখানে গল্প করছেন। অর্নি খালাকে সালাম দিয়ে তাদের মাঝখানে গিয়ে বসতেই তার মা জোর গলায় বললেন:এই বড়দের মধ্যে তোর কি কাজ? তুই তোর রুমে যা।আরাফ রুমে একা আছে।ওর কিছু লাগলে তখন কাকে বলবে?
_আমি তো মাত্র এসে বসলাম।এর মধ্যে উনার কিছু লাগবে না।
_এতো কথা তো বলতে বলিনি। সোজা রুমে যা। শুধু বড়দের মুখে মুখে তর্ক করা ছাড়া আর কিছু জানে না।

অর্নি বুঝলো তার মা থাকতে তার কপালে শান্তি নেই। এখানে যতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে ততোক্ষণ লেকচার দিবেন তিনি।তার চেয়ে বরং আরাফের পাশে গিয়ে বসে থাকুক। কিন্তু আরাফের ওখানে গেলেও এখন সমস্যা আছে।আরাফকে যা বলে এসেছে সব সে সুদে-আসলে নিবে। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো এখন বাঁচতে হলে অরিনের রুমে গিয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় নাই। ধীর পায়ে অরিনের রুমে গেলো। অরিন ল্যাপটপে কি যেন করছে। অর্নি পাশে বসতেই অরিন সেদিকে তাকালো। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো:এই আপু, তুই এখানে কি করছিস? ভাইয়া তো রুমে একা।একা একা বসে থাকতে থাকতে বোর হয়ে যাবে তো।
_পারবো না। আমি এখানেই থাকবো।
_কেন?সকালেও ফোন দিলো তখন‌ও কথা বললি না।এখন এখানে এসে বসে আছিস। আম্মু জানলে খুব বকবে।
_চুপচাপ তোর কাজ তুই কর। আমি আমার মতো বসে থাকি।

অরিন সোজা উঠে চলে গেলো। অর্নি মনে মনে ভাবছে ভালোই হলো।অরিন রুমে থাকলে অযথা জ্ঞান দিতো।তার চেয়ে বরং এখন একটু প্রশান্তি। সেই প্রশান্তিকে আরেকটু গভীর করতে ফোনটা আর হেডফোনটা হাতে নিলো সে।রুমের লাইটটা অফ করে কানে হেডফোন গুঁজে আরামসে গান শুনছে সে। মনের মতো একটা সময় এখন।প্যারা নাই কোনো।

একটু পর হেডফোনে টান পড়তেই অর্নি চোখ তুলে তাকালো সেদিকে।তার মা জমদূতের মতো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ভীষণ রেগে আছেন তিনি। অর্নি চেহারাটা কাঁচুমাচু করে মায়ের দিকে তাকালো।তার মা রাগী গলায় বললেন:এই তুই আমাকে কি অপমান করতে চাইছিস? দেখছিস আরাফ আর তোর খালামনি এসেছে। তুই মহারানীর মতো এখানে এসে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছিস।ছেলেটি অসুস্থ তার মধ্যে তোর মনে রঙ লেগেছে। সোজা রুমে যা।
_পারবো না। এখানেই থাকবো।
_পা থেকে জুতা খোলার আগে আরাফের কাছে যা। এক্ষুনি যাবি।

অর্নি এবার উঠে দাঁড়ালো।তার মা তো তার পেছনে আঠার মতো লেগে আছে। বোনের সাথে আড্ডা দিচ্ছে তখন তো ভালো ছিল। শুধু শুধু এখানে আসার কি দরকার ছিল?এখন আর আরাফের কাছে না গিয়ে উপায় নেই।তা না হলে তার মা জীবন্ত চিবিয়ে খাবে ‌। রুম থেকে বের হতেই দেখলো অরিন তার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।তার মানে সবকিছুর মূলে আছে এই অরিন।মাকে গিয়ে সব বলে দিয়েছে সে।তাই এভাবে চোরের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে। আজকে অরিনকে কাছে পেলে দেখে নিতো সে। দূরে থাকায় বেঁচে গেছে।

মুখটাকে কাঁচুমাচু করে অর্নি নিজের রুমে গেলো।তার শান্তিটা হারাম করে আরাফ বিছানায় শুয়ে শুয়ে আরাম করছে। একদম সহ্য হচ্ছে না।আরাফ তাকে দেখে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। অর্নি এসব কর্ণপাত না করে বিছানার পাশে থাকা টেবিলের চেয়ারটায় গিয়ে বসলো। ফোনটা হাতে নিয়ে অযথা ফেসবুকে ক্রল করছে।আরাফ কিছু বলছে না তাকে। তার মানে ঝড়ের পূর্বাভাস। অর্নি বুঝেও চুপচাপ বসে আছে। কিছুই তো করার নেই এখন। কেন যে কথাটা বলতে গেলো! এখন নিজের মাথাটা নিজের ফাটাতে ইচ্ছে করছে।

হঠাৎ আরাফ তার হাতটা ধরে টান দিলো।তাল সামলাতে না পেরে সে আরাফের গায়ে গিয়ে পড়লো। যেহেতু পাশেই বিছানা ছিল তাই আরাফের রোগা শরীর তাকে এক টানে জব্দ করতে পারলো। অর্নি পড়তেই মাথা তুলে তাকালো।আরাফ অর্নির হাতগুলো ধরে তার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বিয়ে প্রায় ছয় মাসের মতো হলেও এতোটা কাছাকাছি তারা আগে কখনো আসেনি।আরাফ শান্ত কন্ঠে বললো: পারভেজের প্রতি ভালোবাসা একটু বেশি বেড়ে গেছে বুঝি? আমাকে উপেক্ষা করে পারভেজের হয়ে সাফাই গাওয়া হচ্ছে এখন।আর আমি বসে বসে তামাশা দেখবো ভেবেছিলে?নেক্সট টাইম পারভেজ নামটা মুখে উচ্চারণ করলেও দেখাবো আমি কে।
অর্নি মুখে ভেংচি কেটে বললো:একশো দশ বার নিবো পারভেজের নাম। আপনি কি করবেন আমার?
_সেটা সময় হলেই দেখাবো‌।
_এখন আমার হাত ছাড়ুন।
_ছাড়বো না। আগে বলো পারভেজের নাম জীবনেও মুখে নিবে না। প্রমিজ করতে হবে।
_পারভেজের নাম প্রতিদিন মুখে নিবো। উল্টো আপনার নামটা মুখে নিবো না।
আরাফ এবার রেগে গিয়ে বললো:এমনেও তোর মতো গাঁধীর সাথে ওকে মানায়। আমাকে মানায় না।আব্বু আম্মু ভুল করে তোকে আমার ব‌উ বানিয়ে ফেলাই আমার জন্মের শিক্ষা পেতে হচ্ছে।
কথাটা শুনে অর্নি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো।বড় গলায় বললো:কি বললেন আপনি? আমার জন্য আপনার শিক্ষা পেতে হচ্ছে? আপনার জন্য আমার এসব কষ্ট পেতে হচ্ছে। আমি আগে ভালোই ছিলাম। ছোটবেলায় যে কোন ভূত আমার উপর ভর করেছিল যার জন্য আমি আপনার মতো একটা ছেলেকে ভালোবাসতে গেলাম। সেই ভালোবাসার মাশুল আমাকে এখনো দিতে হচ্ছে। আমাকে বিয়ে না করলে আমিও একটু শান্তি পেতাম।আর আপনি জুঁই আর রকির পাল্লায় পড়ে পৃথিবী থেকে বিদায় হতেন। তখন একদম পারফেক্ট হতো। এখন আমি সব ঠিক করার পর আমার উপর মাষ্টারি করছেন। কোথায় আমার প্রশংসা করবেন, আমাকে ভালোবাসবেন তা না। আমাকে কষ্ট দেন সবসময়। আমার লাগবে না আর আপনাকে। সেই সাথে আপনার ভালোবাসাকেও বয়কট করলাম।আমি একা থাকবো। এতেই আমার শান্তি।
অর্নি এক নাগাড়ে সব বলে থামলো। কথাগুলো শুনে আরাফ মুচকি হাসলো। অর্নিকে আরেকটু কাছে টেনে এনে বললো:আমি তো ভালবাসতেই চাই। তুমি নিজেই তো আমাকে ইগনোর করে পারভেজের পেছনে পড়তে গেলে।
_আমি কখনো পারভেজের পেছনে পড়িনি। আমার ভালোবাসা আপনার মতো দু’নম্বর নয়। এমন হলে অনেক আগে আপনাকে ছেড়ে চলে যেতাম।

আরাফ আবারো হাসলো অর্নির কথায়।সে খুব ভালো করে জানে অর্নি তাকে কতোটা ভালবাসে। অর্নিকে অবিশ্বাস করার ক্ষমতা আরাফের নেই। শান্ত কন্ঠে বললো: নতুন করে সব শুরু করবো। আমিও পারভেজের নাম নিবো না কখনো আর তুমিও জুঁইয়ের নাম নিবে না কখনো। শুধু আমি আর তুমি।
_আপনাকে আমি বিশ্বাস করি না। একটু পর আবারো ভাব দেখানো শুরু করবেন।এসব মানুষ আমার চাই না।
_আমি ভাব দেখালে তুমিও আমাকে ভাব দেখাবে।ব্যাস কাটাকাটি।দেখো আমরা এসব বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে কষ্ট হচ্ছে আব্বু আম্মুর। তাদের শুধু শুধু এক্সট্রা প্রেসার দিচ্ছি। আমাদের এবার ভুল পথ থেকে ফিরে আসা উচিত।
_এবার আমাকে ছাড়ুন।
_ডিল ফাইনাল? তবেই ছাড়বো।
_কিসের ডিল?
_ভালোবাসার।

অর্নি হাসলো মনে মনে। কিন্তু মুখে কিছু না বলে আরাফ থেকে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে সে।আরাফ কিছুতেই হাতটা ছাড়ছে না।
_এবার আমার হাতটা ছেড়ে দিন। আমার অস্বস্তি লাগছে।
_হাত ছাড়ার জন্য ধরিনি। অস্বস্তি লাগলেও আমার কিছুই করার নেই। আগে বলো ডিল ফাইনাল কিনা?
অর্নির আর কোনো উপায় নেই। রাগী গলায় বললো: আচ্ছা বাবা, ফাইনাল। এবার হাতটা ছাড়ুন।
_আমি বাবা নয় জামাই।বলবা, আচ্ছা জামাই হাতটা ছাড়ো।

এই বলে আরাফ অর্নির কপালে একটা চুমু দিয়ে হাতটা ছেড়ে দিলো। অর্নি সাথে সাথে উঠে বসলো।আরাফের শেষের কথাটা শুনে তার খুব হাসি পেয়েছে কিন্তু হাসার উপায় নেই। বিয়ের দিনটা স্পেশাল ছিল তার কাছে। কিন্তু বিয়ের পর থেকে প্রতিটা মুহূর্ত যেন আরাফের জন্য অপেক্ষা। অপেক্ষা করতে করতে প্রায় ছয়টা মাস কেটে গেলো।আজ যেনো সব ধরনের অপেক্ষার অবসান।আরাফ এখন শুধু তার।সে তো কিছুই চায়নি। শুধু আশরাফকে জীবনের একটা অংশ করতে চেয়েছিল।আজ সে সফল।এই মূহুর্তটা সে খোদায় করে রাখতে চায়।তার জীবনের ডায়েরিতে।আর সেই ডায়েরির একটাই নাম “অপেক্ষার বসন্ত “।

সমাপ্ত…