#দো_দিলে_জাহান
#পর্বঃ১৫
#বর্ষা
৪৯.
জীবনের ধাপগুলো বেশ সহজ লাগলেও প্রতিটি পদক্ষেপ কখনো কখনো হয়ে দাঁড়ায় একটি রুবিকস কিউবের মতো।যে পারে সে কয়েক মুহূর্তেই মিলিয়ে নিতে পারে।আর যে পারে না সে একাংশ ছাড়া বাকি পাঁচ অংশ কখনো মিলাতে পারেনা।আজ মেহেরের মনে হচ্ছে সেও তেমনি জীবনের একাংশই উদ্ঘাটন করতে পেরেছে।বাকি পাঁচ অংশের খোঁজ অব্দি এতদিন সে পায়নি।
হসপিটালের করিডোরে নিস্তব্ধ ভাবে বসে আছে সে। রেদওয়ান আর তালুকদার বাড়ির প্রায় মানুষই উপস্থিত এখানে।তীব্রকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে দুই গুলি।বুকের অনেকটা উপরে লাগায় এই যাত্রায় তার সুস্থতা খুব শীঘ্রই হয়তো নিশ্চিত।
মেহেরের চোখ টলটল করছে।হয়তো কেউ একটু সহানুভূতি দেখাতে আসলেই কেঁদে ভাসাবে।পুরো বারো ঘন্টা এখনো জ্ঞান ফেরেনি তীব্রর। আরে বাড়ির মানুষেরা তো খবরই পেলো এখন।সবদিক তো মেহেরই সামলাচ্ছিলো।তার সামনেই তো সব হলো।
বারো ঘন্টা আগে,
গাড়িতে করে মেহেররা বেড়িয়েছে রেদওয়ান বাড়ির উদ্দেশ্যে। দু’জনেই বেশ চুপচাপ।বিকেলের সেই বিষয়টা নিয়েই হয়তো দুইজনের মাঝে এখনো ঝড় চলছে।গাড়িতে আর কেউ নেই। এতো রাত করে যাওয়ার দরকারও ছিলো না।তবে নূরিয়া মেয়েটা ওকে টিচ করে বলেছে শশুর বাড়ি থাকতেও জামাই নিয়ে বাপের বাড়ি কেন পড়ে আছে। মোবারক তালুকদার এই কথা শুনেও শুনেননি।তবে মেহেরের কথা শুনেছেন।মেহের বলেছিলো,
-“আমি তো আমার বাপের বাড়ি পড়ে আছি।আর তুমি তো তোমার বাপের বাড়ি কিংবা শশুরবাড়ি কোথাও নেই।পড়ে আছো আত্মীয়ের বাড়িতে”
তাইতো মোবারক তালুকদার মেহেরকে বেড়িয়ে যেতে বললেন।কথা শোনালেন।মহাসিন তালুকদার কিংবা রাবেয়া বেগম কেউ কিছু বলেননি। জুনায়েদ তালুকদার বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন না।আর তান্মি সে তো রুমে বসে এখনো কাঁদছে মেয়ের জন্য।মাহিন-মোয়াজ-জায়িন ওরা তখনও আত্মীয়দের বিদায় জানাতে ব্যস্ত।
লাগেজ গোছাতে যেতে নিলে মহাসিন তালুকদার পথ রোধ করে দাঁড়ান।মেহের বাবাকে জড়িয়ে কেঁদে দেয়।সে জানে তার বাবা কেন তার দাদাকে কিছু বলতে পারেননা।তার বাবা যখন কঠিন রোগে আক্রান্ত তখন তার দাদী মৃত। মোবারক তালুকদার প্রায় একটা বছর নাওয়া খাওয়া ভুলে ওনার সেবা করে ওনাকে সুস্থ করেছেন।কত মানুষ বলতো আরেক বিয়ে কর,আরেক বিয়ে কর।তিনি এসবে পাত্তা দিতেন না।নিজ হাতে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন।তাইতো চাইলেও বাবাকে কিছু বলতে পারেননা তিনি।
-“মেহের মা বাবাকে ভুল বুঝিস না।তুই তো জানিস আমি আব্বার মুখের ওপর কখনো কথা বলতে পারবো না।তোর আব্বুকে মাফ করিস মা”(মহাসিন তালুকদার)
-“আব্বু এটা কেমন কথা বলো? তুমি মাফ চাচ্ছো কেন?একদিন তো আমায় শশুরবাড়ি যেতেই হতো।আজ যাবো কিংবা কাল।যাবো তো নাকি।চিন্তা করো না।আম্মুর কাছে যাও। দেখো হয়তো আড়ালে কাঁদছে “(মেহের)
-“হুম মা”(মহাসিন তালুকদার)
মেয়ের মাথায় চুপু খেয়ে মহাসিন তালুকদার চলে যান।মেয়েরা হচ্ছে বাপের চোখের দুলালি।ছেলেকে যতটা শাসন করে শক্ত করা যায়,তার চেয়ে মেয়েকে ততটা কোমলতা দেখিয়ে কোমল হয়তো বাবারই বানায়।আর মেয়েদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শাসন করে তাদের মায়েরা।বাবা-মেয়ের সম্পর্কের বাঁধন অন্যরকম।
মেহেরকে রুমে আসতে দেখে তীব্র মুচকি হেসে বলে ওঠে,
-“ও বউ আসছো যখন দরজা বন্ধ করেই আসো।ঘুমাবো তো”
-“কোনো ঘুম না।জামা-কাপড় গোছাও।আজই শশুরবাড়ি যাবো।”(মেহের)
-“এতো রাতে?আচ্ছা ঠিক আছে”(তীব্র)
-“তাড়াতাড়ি”(মেহের)
মেহের নিজের কাপড়গুলো কোনমতে লাগেজে ভরে একটা জামা নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে যায়।বড্ড ক্লান্ত সে।তবে তার আত্মসম্মান সবার আগে।ফ্রেশ হয়ে ঘুম দেওয়ার প্রয়োজন ছিলো তবে এখন আগে যেতে হবে শশুর বাড়িতে।
বাবা-মাকে বলে বেড়িয়ে যেতে পথিমধ্যে ভাইদের সাথে দেখা হয় ওর।পাশেই তৃষ্ণা ছিলো।সেও অবাক এই রাত দুপুরে ব্যাগ হাতে মেহের-তীব্রকে বের হতে দেখে। দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরে তাদের।মাহিন-মোয়াজ দু’জনই এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে অনেক প্রশ্ন।উত্তর হিসেবে মেহের বলে সবাইকে সারপ্রাইজ দিতেই রাত-বিরতে যাওয়া।যদিও সন্দেহ করেছিলো তবে বেশি প্রশ্ন আর করেনি। দু’জন এখন বড় রাস্তায়।তীব্র ড্রাইভ করছে।
-“মেহের কাউকে তো আর সত্য বললে না। অন্ততপক্ষে আমায় তো বলো কি কারণে রাত-বিরতে বাড়ি ছাড়লে?”(তীব্র)
-“তোমার কি মনে হয় আমি কেন ছেড়েছি?”(মেহের)
-“আমার সাথে তো সময়ই ব্যয় করতে পারতে না।তাই হয়তো তাড়াতাড়ি বাড়ি ছাড়লে।যাতে আমার…”(তীব্র)
তীব্র কথা সম্পন্ন করতে পারেনা তার আগেই পেছন থেকে ট্রাক ধাক্কা মারে।গাড়ি গিয়ে বাড়ি খায় রাস্তার পিলারের সাথে।তাও যেন ট্রাকের লোকটার শান্তি হয়না।পেছন দিকে ফিরে আরো দুইটা ধাক্কা মারে।তীব্রর মাথা দিয়ে প্রচন্ড রক্ত ঝড়তে থাকে।আর মেহের তার হাত ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে গাড়ির গ্লাস ভেঙ্গে।মাথায় আঘাত পায়নি হাত সামনে রাখায়।
ট্রাক চালক চলে যেতেই মেহের বহু কষ্টে বের হয় গাড়ি থেকে।একার পক্ষে তীব্রকে বের করা হয়তো কষ্টসাধ্য ছিলো তার পক্ষে। তবুও বের করে তাকে খুব দ্রুত। কেননা গাড়ি থেকে ডিজেল লিক হচ্ছিলো।যখন তখন আগুন লাগতে পারে।আর তারপর এম্বুলেন্সের সাহায্যে মিনিট দশেকের মাঝে এই হসপিটালে। আল্লাহর রহমত ছিলো তাইতো তীব্রর পান্টের পকেটে ফোন ছিলো।নয়তো কি যে হতো।
বর্তমান,,
ফোনের শব্দে মেহের কেঁপে ওঠে।ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে।ঘন্টা ছয়েক আগেও এই নাম্বারে সে কল করেছিলো। ইনফরমেশন সঠিক আংকেল ক্যানিয়ন বাংলাদেশে এসেছেন।আর ঠিক তার পরদিনই তীব্রকে মারার চেষ্টা?কিছুতেই যেন কিছু মিলছে না।আংকেল ক্যানিয়ন তো আবার এসবের পেছনে জড়িয়ে নেই?মনের প্রশ্নে নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানায়।তীব্র তাকে ওনার কাহিনী বলেছে। টাইকুন সাম্রাজ্য গড়ে ওঠার আত্মকাহিনী মেহের জানে।
মেহেরের ইচ্ছে হয় সে যদি জিন হতো।তবে লুকিয়ে লুকিয়ে সবার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করে সব খবর দিনের মাঝেই বের করে ফেলতে পারতো।যা সম্ভব নয়।মেহেরের রাগ লাগে বড্ড।আবার টেক্সট এসেছে তীব্রর ফোনে।”ইউ হি ডেইড?”আংকেল ক্যানিয়নের ফোন থেকে এমন ম্যাসেজ মেহের আশা করেনি।কল দেয়।অপর পাশ থেকে রিসিভও হয়।
-“আংকেল ক্যানিয়ন এস.আর আহত। মৃত্যুর সাথে….”(মেহের)
-“হুশ আমি জানি।এটাও জানি তীব্র বাঁচবে না আর।আর ওর মৃত্যুর পেছনে তো আমিই আছি”(ক্যানিয়ন)
-“আংকেল?”(মেহের)
-“হা হা হা।ও বড্ড বোকা বুঝেছো তো।ওকি কানাডাকে তোমাদের সো কল্ড এই দেশ পেয়েছে যে ওখানে অন্যায় অবিচার হবে।আমি ওকে কাহিনী শোনালাম আর ও মেনেও নিলো।আর কি লাগে।ওর কারণে আমার অনেক কাজ হয়ে গেছে।তাইতো দূর্ঘটনায় মারলাম নয়তো মাথায় বুলেট ঢুকিয়ে মারতাম”(ক্যানিয়ন)
মেহের আর কিছুই বলে না।ঘরের শত্রু বিভীষণ।তীব্রর খুন আর কেউ নয় বরং ওরই সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষ করতে চেয়েছে।বাহ যার জন্য সে এতদিন এই কাজ করেছে সেই কিনা তাকে মারতে চাচ্ছে। তীব্র তো জানতেও পারলো না এখনো যে তার আংকেল কত বড় বাটপার।
৫০.
আংকেল ক্যানিয়ন আর কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে সুন্দর ক্যাসিনোর মতো জায়গাতে। বাংলাদেশেও এখন এমন জায়গা আছে বটে।আংকেল ক্যানিয়ন আশ্বস্ত করেন সামনের ব্যক্তিটিকে।তার অস্তিত্ব এখানে গোপন থাকবে।চাইলে সে মাস্ক,হুডি খুলতে পারে।এতো গরমে এভাবে থাকার মানে হয়না। আংকেল ক্যানিয়ন যেহেতু খোলামেলা দাঁড়িয়ে তো সামনের ব্যক্তিটাও খুলে ফেলে তার এই পরিচ্ছেদ।
তূর্যয়?হ্যা তূর্যয় ওনার সামনে দাঁড়িয়ে।ডিল করতে এসেছেন ওনারা। সবচেয়ে বড় ডিল। বাংলাদেশের ডিলারদের সাথে।ড্রাগ ডিলিং।এই দেশ থেকে কিনে অন্যদেশে পাচারের যেই ধান্দা সেইটার কাজেই আজ তার এখানে আসা।
-“টি.কে ডিলটা কনফার্ম করো”(ক্যানিয়ন)
-“ইয়েস বস।”(তূর্যয়)
ডিল কনফার্ম হতেই মদের নেশায় লুতপুত হয় ওনারা।এইসব জায়গায় তো শয়তানের বাস।রাতে মানুষের সংখ্যা থাকে অনেক অনেক বেশি।তাইতো দিন করে ডিল করা।সকাল সকাল এই ডিলিং এই সেফ মনে হয়েছে ওনাদের।তাইতো এই সকাল সকালই ডিল ফাইনাল হওয়ায় ওনাদের খুশি উৎযাপন!
মানুষ কত খারাপ হয় তাইনা?নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য কত ধরনের মিথ্যা কথাই না বলে মানুষ।তীব্র যাকে ভালো মানুষ ভেবে জনগণের হিতে আইনের বিরুদ্ধে কাজ করছিলো সেখানে সে নিজেই হয়েছে প্রতারিত।তার সাথেই তার আংকেল প্রতারণা করেছে। তীব্র কি সইতে পারবে এই প্রতারণা?আদৌতে কি সে বিশ্বাস করতে পারবো সব!নাকি এইসব বিশ্বাস করার চেয়ে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণে সে বেশি আগ্রহী হবে।
মেহের কি আবারো ডিআইজির সাথে যোগাযোগ করে কেসটা হাতে নিবে?সে কি আংকেল ক্যানিয়নকে তার যোগ্য শাস্তি পাইয়ে দিতে পারবে!পারবে কি তীব্রর ভুল ভাঙাতে।আচ্ছা তীব্র কি পারবে কখনো আর কাউকে বিশ্বাস করতে? নাকি এখানেই ওর বিশ্বাসের সমাপ্তি ঘটবে!আর তূর্যয়ই বা কিভাবে আংকেল ক্যানিয়নের সাথে জড়িত হলো।সে যে ওকে কখনো ধোঁকা দিবে না তার কি মানে আছে!
চলবে কি?
#দো_দিলে_জাহান
#পর্বঃ১৬
#বর্ষা
৫১.
-“ম্যাম আপনি তো শুধু ট্রাক দুর্ঘটনার কথা বললেন।তবে স্যারের যে গুলি লেগেছে তার বিষয়ে?”
জুনিয়র অফিসার নোমানের কথায় মেহের অতীতে ফিরে যায়।তীব্র একদিন যাবৎ কোমায় আছে।তার ভিতরটা মনে হয় ছিঁড়ে যাচ্ছে তবুও মেহের নিজেকে সামলে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে।
সেদিন রাতে এম্বুলেন্স আসার আগে গোলাগুলি শুরু হয়েছিলো।আদৌ আদৌ জ্ঞান থাকা অবস্থাতেও তীব্র নিজের সর্বস্ব দিয়ে মেহেরকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। এম্বুলেন্সের শব্দে যদিও ওরা পালিয়ে গেছে তবে মেহের ওদের গাড়ির নাম্বার নোট করে রেখেছে তার মস্তিষ্কে।মেহেরের রাগ লাগছে নিজের ওপর।কেন সে ওই মাঝরাত্তিরে বের হয়ে এসেছিলো।যদি এমন না করতো তাহলে তার তীব্র আজ সুস্থ থাকতো।তার সাথে খুনসুটি করতো!
নোমানকে আর কিছু না বলে ওই কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে মেহের। রেদওয়ান বাড়ির আরো কয়েকজনকে ডাকা হয় ইন্টারোগেশনের জন্য।সারিমকে কোথাও দেখছে না মেহের।আজ সে সারিমকে দেখেনি।ফোন লাগালে কল যায় না।মেহেরের চিন্তা হয়। দুইভাই তো জনগণের হিতে কাজ করতো। অজান্তেই টাইকুন সাম্রাজ্যে জড়িয়ে ছিলো।তীব্রর পর যদি সারিমকে….?
মেহের দ্রুত ছুটে যায় নোমানের কাছে।তখন সে কিছু ভাবছিলো।রুমটা ফাঁকা ছিলো।হয়তো পরবর্তী জন এখনো আসেনি।মেহের আদেশের স্বরে বলে ওঠে,
-“নোমান দ্রুত সারিমের ফোনের লোকেশন ট্রেস করো।”
৫২.
সারিম রাগান্বিত হয়ে বন্দুক হাতে বাগান বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। আংকেল ক্যানিয়নের অবস্থান এখানেই।সারিম বন্দুকের গুলি শেষ করে ফেলেছে গেটের আশেপাশে থাকা গার্ডদের মারতে গিয়ে।নিচে মরে পড়ে থাকা গার্ডের বন্দুক উঠিয়ে নেয় সে।
-“আংকেল ক্যানিয়ন দরজা খুলুন।কেন করেছেন আপনি এরকম? সবকিছুর উত্তর চাই আমার। আংকেল ক্যানিয়ন”
কেউ আওয়াজ দেয় না।দরজায় জোরে এক লাথি দিতেই দরজা খুলে যায়। পঁচা গন্ধ ভেসে আসতে থাকে।কেমন বিদঘুটে গন্ধ।হয়তো কোনো লাশের গন্ধ।তখনই পুলিশের গাড়ির আওয়াজ হয়।সারিম বুঝে যায় ওকে ফোন দিয়ে সব বলা ছিলো আংকেল ক্যানিয়নের বিশাল ফাঁদ।তবে এখন কি করবে কিছুই বুঝতে পারেনা সে।
-“সারিম কিছু স্পর্শ না করে এখান দিয়ে আসো।দ্রুত”
মেহেরকে দেখে কোনো কিছুর বাছবিচার না করেই সারিম ছুটে যায় সেদিকে। ইতিমধ্যে সিসিটিভির রেকর্ডিং বক্স সে তার সাথে নিয়ে নিয়েছে।আর আগুন লাগিয়ে একটা কাপড় ভেতরে ছুড়ে মারতেই ফায়ার এর্লাম বেজে পানি ঝড়তে শুরু করেছে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট থাকলেও তা মিশে যাবে।
৫৩.
সারিম অবাক হয়ে মেহেরের কথা শুনছে।তার ঘৃণা হচ্ছে নিজের প্রতি, নিজের কাজের প্রতি। পৃথিবীতে সত্যিই প্রকৃত মানুষ চেনা দায়। আংকেল ক্যানিয়ন যাকে ওরা মনপ্রাণ উজার করে বিশ্বাস করেছিলো।সেই নাকি চোরাচালান,ড্রাগস ডিলিং, হিউম্যান ট্রাফিকিংয়ের সাথে জড়িত।
-“মেহের তুই জানলি কি করে আমি এখানে?”(সারিম)
-“আমি এখানে এর আগেও দুইবার এসেছিলাম কেস তদন্তে।তবে অনেক আগে। কিন্তু যখন তোমার নাম্বারের লাস্ট লোকেশন এখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে দেখলাম। তখনই বুঝে গিয়েছিলাম তুমি এখানেই থাকবে।”(মেহের)
-“মেহের আংকেল ক্যানিয়ন কেন এরকম করছে?”(সারিম)
-“আংকেল ক্যানিয়ন? এখনো তাকে সম্মান দিচ্ছো।আমি থাকলে খুন করতাম।তবে আমার হাত বাঁধা।তাইতো তোমাদের বাচাচ্ছি।আগে আসল অপরাধী ধরা পড়বে তারপর তোমাদের শাস্তি হবে”(মেহের)
-“আমাদের শাস্তি?”(সারিম)
-“হুম তোমাদের শাস্তি।যেমনেই হোক হিউম্যান কিলিং এর সাথে তোমরাও জড়িত।তবে আমি এই কেস সলভের ক্রেডিট তোমাদের দুই ভাইয়ের ওপর দিবো যাতে তোমাদের অল্প দিনের শাস্তি হয়”(মেহের)
-“ঠিকই বলেছিস আমাদেরও শাস্তি পেতে হবে।শাস্তি না পেলে বুঝবো কি করে যে মানুষ বিশ্বাসের অযোগ্য “(সারিম)
-“সারিম মানুষ বিশ্বাসের অযোগ্য নয়। বরং তোমরা অযোগ্য কাউকে বিশ্বাস করেছো”(মেহের)
সারিম,মেহের চুপ থাকে। হাঁটা পায়েই এখান থেকে বের হতে হবে ওদের। জঙ্গলের পিছন সাইড দিয়েই একটা রাস্তা গিয়ে বড় রাস্তায় উঠেছে।মিনিট ত্রিশের মতো হাঁটা পথে হাঁটছে ওরা। আকাশে এতো রোদ তবে জঙ্গলের মাঝে যেন অন্ধকার।দুইজনই নিস্তব্ধ। হঠাৎ সারিমের মস্তিষ্কে প্রশ্নরা খেলতে শুরু করে।
-“তীব্র ভাইকে বিয়ে করার কারণ কি ক্যানিয়ন?”(সারিম)
মেহেরের হাঁটা থেমে যায়।পিছু ফিরে তাকায়। কাঁধের ব্যাগ কিছুটা ভারী।এই নিয়েই হাঁটছে। আর এই ছেলে ওকে প্রশ্ন করে এখন বিরক্ত করছে।মেহের উত্তর দেয়,
-“হুম..তবে তীব্র আমার ভালোবাসার মানুষ”
সারিম অবাক হয়।নির্ভীক হয়ে অকপটে কি করে নিজের ভালোবাসার কথা বলে দিলো এই মেয়ে!সারিমের ভয় হয় আদৌ তীব্র ভাইয়ের জ্ঞান ফিরবে তো! তীব্র কি আবার আগের মতো হতে পারবে।আর জারিন?জারিন সব জেনেও কি ওকে ভালোবাসবে!নাকি হারিয়ে যাবে অন্য কারো হয়ে।সারিমের হাত-পা কাঁপতে থাকে। হাঁটা শক্তির মনে হয় হ্রাস পেতে থাকে।
-“মেহের…”(সারিম)
সারিম বসে পড়ে।মেহের দ্রুত পিছিয়ে দেখে কি হয়েছে।ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে পানি খাওয়ায় ওকে।বসিয়ে রেখে পিঠে হাত বুলাতে থাকে। মিনিট পাঁচেক পর কিছুটা সুস্থ হয় সারিম। হেঁটে যেতে পারবে বলে জানায়।বাগান পেড়িয়ে বড় রাস্তার মোর থেকে বাসে উঠে পড়ে দু’জন।সারিমকে জানালার পাশে বসিয়ে সুইয়ে দেয় সে।
৫৪.
চারদিন অতিক্রান্ত।সব যেন স্বাভাবিক হয়েও স্বাভাবিক হয়নি।তীব্র?তার জ্ঞান ফিরেছে তবে একদম আলাদা মানুষ হয়ে।মধ্যকার দশ বছরের স্মৃতি তার মস্তিষ্কে নেই। অর্থাৎ সে ঊনিশ বছর বয়সী তরুণ মস্তিষ্কে আছে এখন।মেহেরের হাত ধরে ঘুরছে।বলছে ওকে স্কুলে দিয়ে আসবে।ওকে খাইয়ে দিবে।আর কখনো বিদেশ যাবে না।
মিসেস মিথিলা রেদওয়ান চোখের জল ফেলছেন ছেলের বাচ্চামো দেখে।ওনার বুকটা ফেটে যাচ্ছে।মাথায় আঘাতের কারণেই মূলত এমন হওয়া।আদৌতে কখনো ওর স্মৃতি ফিরবে কিনা ডক্টররা সিওর না।মেহের যেন কাঁদতে কাঁদতেও হেসেছে আজ সকালে।হাসবে নাই বা কেন?আজ চারদিন পর যে কোমা থেকে জেগে উঠেছে ওর ভালোবাসার মানুষ।না থাকুক স্মৃতি,না থাকুক কবুল বলে নেওয়া দায়িত্বের কথা স্মরণ তবুও তো ভালোবাসি,ভালোবাসি বলছে।জেগেই তো মেহেরকে খুঁজেছে।হাত জড়িয়ে থেকেছে।বলেছে মেহের তুমি কেন বড় হয়ে গেলে এই দুই বছরে।আমার তো আমার আগের মেহেরই চাই।সতেরোতে দেশ ছাড়া তরুণ এখন ঊনিশে পা দিয়ে এখানে এমনটাই তীব্রর ধারণা।
সারিমকে ভালো মতো বুঝিয়ে বলেছে যাতে তীব্রর সামনে কখনো আংকেল ক্যানিয়নের নাম না নেয় ও। কেননা যদি ওর সব মনে পড়ে তাহলে হয়তো ও পরিবারের সবাইকে চিনবে,ভালোবাসবে।তবে ভেতর থেকে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।একদম শেষ হয়ে যাবে।
-“পুতুল বউ তুই কতো বড় হয়ে গেছিস।আমায় এখন খাইয়ে দিচ্ছিস।আচ্ছা চলনা আমরা বিয়ে করে নেই।তারপর একসাথে থাকবো।তুই আমায় প্রতিদিন খাইয়ে দিবি,গল্প করবি।”
বিছানায় শুয়ে শুয়ে খাবার খাচ্ছে আর কথা বলছে তীব্র।তরুণ মস্তিষ্কের কথা শুনে যেমন ওর হাসি পাচ্ছে তেমনি প্রচন্ড কান্নাও পাচ্ছে। শুধু আফসোস হচ্ছে কেন যে সে সেদিন বেড়িয়ে আসলো!সে কখনোই ওই বাড়ি ফিরবে না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো।তারপর ভাবলো আমি না গেলে ওই নূরিয়া দাদার কান আরো ভাঙাবে।সে যাবে।
৫৫.
আংকেল ক্যানিয়ন চিন্তায় যদিও ছিলেন তবে এখন চিন্তামুক্ত। চিকিৎসকের সাথে কথা বলে জেনেছেন তীব্রর স্মৃতি ফেরার সম্ভাবনা ষাট শতাংশ।যতোই হোক বিপরীত পক্ষ।তবুও তো দশটা বছর যাবৎ ওনার হয়ে কাজ করেছে।ভালোবাসায় মুড়ে রেখেছে।তাই হয়তো আর মারার চেষ্টা করবেন না।হয়তো।
মানুষ মায়ায় আটকে যায়।একবার ছিন্নভিন্ন করতে না পারলে দ্বিতীয় চেষ্টা করে না।ক্যানিয়নও তেমনি।এই ছেলের ওপর নির্ভর করে নাম কামিয়েছেন তিনি।নয়তো কেউ কি আদৌতে তাকে চিনতো!হয়তো আবার হয়তো না।
-“তীব্র আই লাই ইউর এটিটিউড।বাট তুমি আমার জন্য রিস্ক।তাই তোমার স্মৃতি না ফেরাই মঙ্গল জনক।আর সারিম?ও কোথায়!”
আংকেল ক্যানিয়ন সারিমের কোনো খোঁজ পাননি।এই ছেলেকে ধরার জন্য ওইদিন নিজের কেনা পুলিশ অফিসারদের পাঠিয়েছিলেন তিনি।তবে সেখানে নাকি ফায়ার এর্লামের কারণে কোনো প্রমাণই মেলেনি।একটা বন্দুক পাওয়া গিয়েছিলো।যাও কেউ চুরি করে নিয়েছে।
ফোন বেজে ওঠায় রিসিভ করে সে।তূর্যয় ফোন করেছে।এই ছেলে বুদ্ধির দিকে কম হলেও কাজের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে।রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে এইটাই তো এই পেশার মানুষের প্রয়োজন।তূর্যয় বলে ওঠে,
-“আংকেল সারিম যেন লাপাত্তা হয়ে গেছে কোথাও।আমি আজ তীব্রকে দেখতে ও বাড়ি গিয়েছিলাম। কিন্তু সারিমের খোঁজ পাইনি।”
-“মিস হাইডের খোঁজ করো।আমি নিশ্চিত উনি কিছু হলেও জানবে।আর মেহের?মেহেরকে উড়িয়ে দেও।আমার বিষয়ে জেনে গেছে”(ক্যানিয়ন)
-“কিন্তু ও তো বাড়ি থেকে বেরই হয়না। তাহলে?”(তূর্যয়)
-“পুরো বাড়িই উড়িয়ে দেও”(ক্যানিয়ন)
তূর্যয়ের চোখ বড় বড় হয়ে যায়।যেমনই হোক বোন তো ওকে মারবে কি করে!আর কোনো বোম ব্লাস্ট করাও তো যাবে না। কেননা আতংকবাদী হামলা হলেও নিরিবিলি ভবনগুলোর এখানে হবে নাকি!আর চোর/ডাকাত ওরা এলে তো খুন করবে। কিন্তু এতোজনকে এক এক করে মারতে গেলেই তো ধরা পরে যেতে হবে!তাহলে কি করবে সে?
চলবে কি?