আনমনে সন্ধ্যায় পর্ব-১১

0
261

#আনমনে_সন্ধ্যায়
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১১

অনেক কষ্টে রিমি কম্বলের ভেতর থেকে মাথা বের করলো। আজ জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। যাকে এক কথায় বলে হাড়ে কাঁপুনি টাইপ।

তার শীত এমনিতেই বেশি, আর এই হাড়ে কাঁপুনি শীতে কম্বলের নীচ থেকে মাথা বের করা যুদ্ধজয় করা সমান। আর এই যুদ্ধজয় করতে হলো মোবাইলের কারণে। সেটা বেজে চলছে। এতো সকালে কার এতো দরকার পড়লো রিমিকে।

সে কোন রকম হাত বাড়িয়ে মোবাইল টেনে কাছে আনলো। ওলীদ আশফাক! সে অবাক হলো! ফোন! তাও আবার এতো সকালে। বাজে কয়টা? সে মোবাইল স্কিনের উপর সময় দেখলো। সাতটার একটু বেশি। না ওতো সকালও না।

মেসেজে আজকাল টুকটাক হাই, হ্যালো টাইপ কথা হয়। তবে ফোনে আর হয় নি। হঠাৎ এই সময়, ব্যাপার কি?

সে ফোন রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে এক মহিলা কোকিলের মতো মিষ্টি সুরে বললো,
— হ্যালো কে বলছেন?

রিমির ভ্রু কুঁচকে গেলো! বললো,
— আপনি কে?

— আমি তো কেউ না। এই ফোনের লোকের এক্সিডেন্ট হয়েছে। জ্ঞান নেই। আমরা ধরাধরি করে পাশের এক হসপিটালে এনেছি। কতোক্ষণ বসে থাকবো, কাউকে তো জানানো দরকার। তাই সামনে যেই নাম্বারটা পেলাম সেটাতেই ফোন দিলাম।

— আমারটা সামনে ছিলো নাকি?

— না! দুই নাম্বারে। প্রথম জন ফোন ধরে নি।

— ও! পুলিশকে বলেছেন?

— ওমা! পুলিশ পাবো কোথায়? এটা কি বিদেশ, এক্সিডেন্ড হওয়ার সাথে সাথে পুলিশ এসে হাজির হবে।

— তাও ঠিক।

— আপনার ঠিক আপনার কাছে রাখেন আর পারলে তাড়াতাড়ি আসেন, আমি বাসায় বাচ্চা রেখে আসছি।

— বাচ্চা রেখে আসছেন কেন?

— আল্লাহ! আপনি তো খুব ফাউল পেচাল পারেন। আপনার আত্মীয় অজ্ঞান হয়ে হসপিটালে, আপনার তো কোন গরজই দেখছি না। তাড়াতাড়ি আসেন তো। এড্রেস আমি পাঠাচ্ছি।

রিমির মধ্যে তাড়াতাড়ি কোন রেশ দেখা গেলো না। সে ধীরে ধীরেই উঠলো। কাকের বাসা চুল হাত দিয়ে টেনেটুনে চান্দি বরাবর একটা খোঁপা করলো, ফ্রেশ হলো। সেই খোঁপার উপরে টেনেটুনে টুপি চাপালো। হাতে, পায়ে মোজা, সোয়েটার। তার উপরে আবার চাদর জরিয়ে ধীরে ধীরে বেড়িয়ে এলো।

কিচেন রুমে টুকটাক শব্দ হচ্ছে। তাছাড়া পুরো বাড়ি নীরব। এখনও সবাই ঘুম থেকে উঠেনি। সে বের হয়ে এলো নিঃশব্দে। বাইরের গেইটের সামনে এসে পকেট গেইট খুলতে যাবে, তখনি তার ফোন বাজলো। আবার আননোন নাম্বার! ধুর, আবার কে? সে বিরক্তি নিয়েই রিসিভ করলো। আর রিসিভ করতেই কোন ভণিতা ছাড়া ওপাশ থেকে দু- টো শব্দ ভেসে আসলো।

— কোথায় যাচ্ছো?

নাম্বারটা অচেনা হলেও রিমি বুঝতে পারলো কে? সে পেছন ফেরে দু- তলায় তাকালো। এই বাড়ির সাব্বির ভাইয়ের রুমটাই একেবারে এই সাইডে। এই গেইট দিয়ে কে আসলো, কে গেলো পুরোটাই দেখা যায়।
সেও ডানে বামে গেলো না। স্বাভাবিক ভাবেই বললো, — অল কেয়ার হসপিটালটা কোন দিকে সাব্বির ভাই।

সাব্বির একটু থমকালো। ভাই শব্দটা কেমন জানি তার কানে লাগলো। অথচো লাগার কোন কারণ নেই।

সেও রিমির মতো স্বাভাবিক ভাবেই বললো, — দু-মিনিট ওয়েট করো। আমি আসছি।

রিমি ফোন কেটে অবাক হলো। এটা সে আশা করে নি। সে ফোন কেটে গেইট খুলে বাইরে আসলো। সে ভেবেছিলো রিকশা করে যাবে। রিকশাওলার কাছে ঠিকানা বললে, তারা অনায়াসেই সব জায়গায় নিয়ে যেতে পারে। এখন কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। রিকশা দাঁড় করাবে কি করাবে না?

অবশ্য দাঁড় না করালেও সমস্যা নেই। এই সময় কেজি স্কুলের বাচ্চাদের মায়েরা আসা যাওয়া করে। তাই রিকশার অভাব নেই। তাই যে নিয়ে যাবে সেই এসেই ব্যবস্থা করুক।

সাব্বির দু- মিনিটের মধ্যেই বের হলো। হাত দিয়ে রিকশা থামালো। থামিয়ে নিঃশব্দে উঠে এক সাইডে চেপে বসলো।

রিমি শুধু গোলগোল চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো। মনে মনে বললো, –এক রিকশায় যাবে নাকি?

রিমি ঢোক গিলে এগিয়ে গেলো! মনে মনে বললো,— আল্লাহ চোখ, হাত, পা, মুখ , নিয়ত সব কন্ট্রোলে রাখার তৌফিক দিয়ো।

সে এক প্রকার নিজেকে টেনেটুনে রিকশায় উঠালো। পায়ে তার চটি স্যান্ডেল তার মধ্যে আবার মোজা। উঠতে বেগ পেতে হলো। অথচো এই বান্দাকে দেখো টিশার্টের উপরে শুধু একটা পাতলা জ্যাকেট, তাও বুক খোলা। শীতে মরবে তাও ভাব ছাড়বে না।

সাব্বিরও রিমির কর্মকান্ড সব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো। তার মনে হলো, আজ তার জীবন সার্থক। এমন এক জোকার দেখার জন্যই এতোদিন সে নির্দ্বিধায় বেঁচে ছিলো।

রিমি উঠে চেপে চুপে বসার চেষ্টা করলো। অবশ্য তেমন লাভ হলো না। দু- জনেই উঁচা লম্বা মানুষ। তার মধ্যে সে পুরো প্যাকেট হয়ে এসেছে। আর ঢাকার রিকশা, সেটা আর নাই বললাম। না চাইতেও গায়ের সাথে গা লেগেই যাচ্ছে।

— এতো সকালে হসপিটালে কেন?

— আমিও বুঝতে পারছি না কেন?

সাব্বির ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মনে হয় উত্তর পছন্দ হয়নি।
— প্রফেশনাল ইয়া পার্সোনাল?

— সেটাও বুঝতে পারছি না।

— ইয়ার্কি বন্ধ করো রিমি।

— কেন?

— তোমার সাথে আমার ইয়ার্কির সম্পর্ক না।

— ইয়ার্কির জন্যও আবার সম্পর্ক লাগে নাকি? সম্পর্ক লাগে বিয়ে করতে, প্রেম করতে, ডট ডট ডট করতে।

— আচ্ছা?

— হ্যাঁ!

— এইটুকু বয়সে এতো জ্ঞান?

— রাখতে হয়। কখন কোন জিনিসের প্রয়োজন হয় ঠিক আছে।

— তোমার মনে হয় না বয়সের তুলনায় বেশি পেকে গেছো?

— হুম হয়। তবে পেকেই যখন গেছি কি আর করার। কোন উপায় কি আছে আবার কাঁচা হওয়ার?

সাব্বির কঠিন চোখে রিমির দিকে তাকালো!
— আমি তোমার বয়সে বড়, সম্পর্কে ও বড়। তাই নেক্সট টাইম কথাবার্তা চিন্তাভাবনা করে বলবে।

রিমি সভ্য মেয়ের মতো মাথা দোলালো। হালকা হেসে বললো, — অবশ্যই ভাইয়া।

— ডোন্ট কল মি ভাইয়া।

রিমি ঠোঁট টিপে হাসলো! হেসে বললো, — তাহলে কি বলবো?

— কিছুই বলার দরকার নেই।

— এটা ভাইয়ার চেয়ে বড় হয়ে গেলো না। “কিছুই বলার দরকার নেই” তাছাড়া শুনতেও তো অকওর্ড লাগছে।

সাব্বির দাঁতে দাঁত চেপে অন্য দিকে তাকালো। তবে আর টু শব্দও করলো না। রিকশা হসপিটালের সামনে থামতেই রিমি আগে নামলো। নেমে যেতে যেতে বললো, —- ভাড়াটা দিয়ে দিন “কিছুই বলার দরকার নেই ” বড় “কিছুই বলার দরকার নেই”
থাকতে ছোট বোন ভাড়া দেবে দেখতে খারাপ দেখায়।

সাব্বির রিকশায় বসেই বড় বড় কয়েকটা শ্বাস ফেললো। রাগ কন্ট্রোল করা ব্যর্থ চেষ্টা । চাচি কেন এই মেয়েকে উঠতে বসতে শাসায় আজ বুঝলো। তার নিজেরি তো ইচ্ছে করছে ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দিতে।

রিমি হসপিটালের ভেতরে আসলো। রিসিপশনে জিজ্ঞেস করতেই সাইড থেকে একদল মহিলা আসলো। তাদের সবার গায়ে থ্রিপিস । ওড়না গলায় থেকে কোমরে এসে আড়াআড়ি করে গিট্টু দেওয়া, পায়ে কেডস।

রিমি এবার বুঝলো, বাচ্চা বাসায় রাখার কারণ। এখন এটা ফ্যাশনের মতো হয়ে গেছে। সকাল হলেই মহিলারা দল বেঁধে বের হয় জগিং করার জন্য। অবশ্য জগিং জন্য এরা বের হলেও, তাদের সময় কাটে যার যার বাড়ির গল্প করে।

— রিমি তাইনা?
রিমি তাকালো, সাথে মাথা নাড়লো।

— উপকারের কোন দাম নেই বুঝেছো। এতো কষ্ট করে হাসপাতালে আনলাম। ভর্তি করালাম। অথচো জ্ঞান ফিরতেই ধমকা ধমকি শুধু । কেন তোমাকে ফোন করলাম। আরে বাবা আমরা জানি নাকি? কে তোমার কি হয়।

— উনার জ্ঞান ফিরেছে নাকি?

— হ্যাঁ! কিছুক্ষণ আগে। ঐ কর্নারের রুমটায় আছে, যাও । তোমার জন্যই বসে আছে।

— আপনাদের ধন্যবাদ। আজকাল অবশ্য এতোটুকুও কেউ করে না।

— যাক কেউ তো উপকারের কদর করলো। আচ্ছা এবার আসি। তোমার জন্যই বসে ছিলাম। বলেই মহিলারা বেড়িয়ে গেলো।

রিমি কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলো।
ওলীদ বেডে বসে ছিলো। তার মাথায় ব্যান্ডেজ। তাকে দেখেই ফট করে দাঁড়িয়ে গেলো। অনুতপ্ত কন্ঠে বললো, — স্যরি রিমি! এক্সট্রেমেলি সরি। আমার জন্য আপনার এতো সকালে কষ্ট করতে হলো।

— সমস্যা নেই। আপনি ঠিক আছেন?

ওলীদ বড় একটা শ্বাস ফেললো। ফেলে হালকা হেসে বললো,
— এখন আমি সত্যিই ভালো আছি।

রিমিও হালকা হাসলো!
— এক্সিডেন্ড কিভাবে হলো?

— জগিং করতে বের হয়েছিলাম। কুয়াশা বেশি ছিলো তাই খেয়াল করিনি। রাস্তা পার হতে গেলাম, ব্যস গাড়ির সাথে ধাক্কা।

— ডিসচার্জ করবে আজ?

— হ্যাঁ ! দু- তিন ঘন্টা অবজারভেশনে রাখবে। তারপর ছেড়ে দেবে।

— আমি ছাড়াও আর কাউকে ইনফ্রম করা হয়েছে?

— হুম! এক ফ্রেন্ডস কে বলেছি । কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে।

— ফ্রেন্ডস! ফ্যামিলি মেম্বার কোথায় ?

ওলীদ হাসলো! হেসে আবার বেডে গিয়ে বসলো।
— জেরা করছেন?

— অবশ্যই।

— তাহলে বলছি না।

— কেন?

— বন্ধু হয়ে বন্ধুর মতো যেই দিন জিজ্ঞেস করবেন, সেই দিন বলবো।

রিমি হাসলো! কিছু বললো না। সেও এগিয়ে গিয়ে সোফায় বসলো।

ওলীদ রিমির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তাকিয়ে থাকার অবশ্য কিছু নেই। হাতের সামনে যতোগুলো শীতের কাপড় পেয়েছে, সবই মনে হয় পরে এসেছে। চোখ, মুখ, নাক ছাড়া সবই প্যাকিং। নিশ্বাস নেওয়াটা প্রয়োজন, তা না হলে এগুলো মনে হয় ঢেকে ফেলতো। কোন জড়তা নেই, সংকোচ নেই। তার সামনে যে দেখতে বিশ্রি চেহেরার একজন মানুষ দাড়িয়ে। কোন মাথা ব্যথাও নেই।

অথচো এই পর্যন্ত সে যেখানেই গেছে সবার আগে তার দিকে অন্য ভাবে তাকায়। পরে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে। মেয়েটা একটু অন্য রকম। এই অন্য রকমটাই সে ধরতে পরছে না। পরছে না বলেই অজানা অন্য কিছু একটা অনুভব করছে।

সে তাকিয়ে থেকেই শান্ত ভাবে বললো — আমার বন্ধু হবেন মিস রিমি?

রিমি চোখ তুলে তাকালো। তার চেহেরার কোন পরিবর্তন হলো না। যেন সে জানতো এমন কিছু হবে। সে কিছু বলবে তখনি দরজায় সাব্বির এসে দাঁড়ালো। নির্বিকার ভাবে বললো, — আমার দশটায় ক্লাস আছে। আমি ফিরবো। তুমি যাবে?

রিমি একটু চমকালো। সাব্বিরকে তো সে ভুলেই গিয়েছিলো।

ওলীদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তাদের দু- জনের মাঝে আসা এই সুদর্শন যুবক কে তার একদম পছন্দ হলো না। তবে এই যুবক কে তার চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছে। ও শপিংমলে! রিমির পরিচিত নাকি? কই সে দিন তো দেখে মনে হয় নি।

চলবে…….