আমার নিঠুর মনোহর পর্ব-১৩+১৪

0
197

#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখিনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_তেরো

রাস্তার মাঝে নিজের স্বামীকে তার প্রাক্তন দুই হাতে জড়িয়ে ধরেছে। এমন দৃশ্য দেখে তারিন কয়েকপা পিছিয়ে গেলো। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে বারবার। বুকের ভেতরটায় ও কেমন ধুকপুক করছে। কান্নাগুলো ঝট পাঁকিয়ে আসছে। এ কি! এমন লাগছে কেন? তারিন আর সহ্য করতে পারলো না। চিৎকার করে বলে উঠল,
“মাস্টার মশাই! দিশা আপুকে এক্ষুনি আপনার কাছের থেকে সরে আসতে বলেন। নয়তো আমি ভদ্রতা ভুলে যাবো।”
তারিনের চিৎকারে তামজিদ হকচকিয়ে তাকায় তারিনের দিকে। এর মাঝে কেটে গেছে দু’দিন। তারিনের রেজাল্ট প্রকাশ হয়েছে৷ জিপিএ ফাইভ পেয়েছে শুনে পুরো পরিবারে খুশির ঢল নামলেও, কলেজের ভর্তির ব্যাপারে কিছুতেই বর্ষা বেগমকে রাজি করানো যায় নি। দিশাকে নিয়ে সেদিনের পর তারিন তামজিদকে এড়িয়ে চলে। কথাও বলেনা। অতিরিক্ত দরকার ছাড়া। আজ দিশা নিজেই তারিনকে ফোন করেছিলো সকালে। অনেক অনুরোধ করে বলেছিলো, শেষবারের মতো তামজিদকে নিয়ে দেখা করতে আসতে। তামজিদ অবশ্য বারন করেছিলো। কিন্তু তারিন এই সম্পর্কের শেষটা দেখার জন্যই রাজি হয়ে এসেছে। দিশার দেওয়া ঠিকানাতে আসতেই দিশা কয়েক সেকেন্ডের মাথায় তামজিদকে রাস্তার মধ্যেই জড়িয়ে ধরে। সেটাই তারিনের সহ্য হয় নি। আর তামজিদও ভাবতে পারেনি রাস্তার মাঝে হঠাৎ করে এমন বিবস্ত্র পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। তারিনের মুখপানে তাকিয়ে দিশা নিজেই তামজিদকে ছেড়ে দিলো। অসহায় ভঙ্গিতে তামজিদের দিকে একবার তাকালো। সে মুখমণ্ডলে কালো মেঘে ঢেকে আছে। দৃষ্টি তারিনের দিকে। দিশা আর দেরি করলো না। সশব্দে তামজিদের থেকে দূরে সরে আসলো। অপরাধী ভঙ্গিতে বলল,
“স্যরি! স্যরি! আসলে অনেকদিন পর তামজিদকে দেখে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি নি।”
তারিন অশ্রুসিক্ত নয়নে তামজিদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দিশার উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। শক্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“আমাকে এমন দৃশ্য দেখানোর জন্য বুঝি এখানে ডেকেছেন?”
দিশা আমতা আমতা করতে লাগলো। ও তো এজন্য ডাকে নি। ডেকেছিলো সব পিছুটান শেষ করার জন্য। তামজিদ ও অপরাধীর ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। তারিন উত্তরের আশায় ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। দিশা কিছু সময় চুপ থেকে বলল,
“স্যরি, তারিন। আমার তোমাদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে তাই ডেকেছি।”
তারিন আর কিছু বলল না। তামজিদ শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
“কি কথা আছে?”
দিশা প্রস্তাব দিলো সামনের রেস্টুরেন্টে যেয়ে বসার।তারপর তিনজনে মিলে সামনের রেস্টুরেন্টের ভেতরে গিয়ে বসলো। তামজিদ তারিনের পাশেই বসলো। আর দিশা অন্য পাশে৷ দিশা ওয়েটার বয়কে ডেকে তিন কাপ কফি অর্ডার দিলো। কিছু মুহূর্তের নিরবতা কাটিয়ে তারিন প্রশ্ন করল,
“আপনার কি কথা আছে, দিশা আপু?”
দিশা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। শান্ত বানীতে বলতে শুরু করল,
“আমি জানি, আমি তোমাদের মাঝে কাটা হয়ে গেছি। তাজের জীবনে অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছি। তাজকে আমি সত্যিই খুব ভালোবাসতাম আর এখনো বাসি। এত ভালোবেসেও আমি তাকে পাইনি। না! না! আমি বলছি না এটা তোমার বা তাজের দোষ। আমাদের মাঝে তোমার কোনো দোষ নেই, তারিন। তুমি বয়সে আমার থেকে খুব ছোট। আমার ছোট বোনের সমান। এতকিছুর মাঝে তোমার কোনো হাত নেই তাই তোমাকে দোষারোপ আমি করতে পারি না। সেই অধিকার আমার নেই। সেদিন রাগের বশে তোমার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি আমাকে ক্ষমা করো পারলে।”
বলেই থামলো দিশা। তারিনের মন এতক্ষণে গলে পানি হয়ে গেছে৷ তাই দিশা থামতেই অপরাধীর ন্যায় বলে উঠল,
“ক্ষমা তো আমার চাওয়া উচিত। আমি আপনার সাথে সেদিন প্রচন্ড বাজে ব্যবহার করেছি। বেয়া’দবি করেছি। কিন্তু আমি কি করতাম বলেন? কোনো মেয়ে কি তার স্বামীর ভাগ অন্য কাউকে দিতে চায়? যতই আপনাদের আগের একটা সম্পর্ক থাকুক। বিয়ে তো আমার সাথে হয়েছে, তাইনা বলেন? আমি বলছি না আমি ভুল ছিলাম। আমার জায়গায় আমি ঠিক ছিলাম। হ্যাঁ, আমার ভুল ছিলো আপনাকে বুঝতে পারি নি সেটা। তার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন, দিশা আপু।”
তামজিদ চুপ করে আছে। একবার তারিন আর একবার দিশার দিকে তাকাচ্ছে। সাপ, নেউল একসাথে হয়েও পরিবেশ এত শান্ত আছে কি করে ভাবছে? সূর্য কি তবে অন্য দিকে উঠল? বিস্ময়ে ওর মুখ হা হয়ে আছে। দুজনের কথা শুনছে চুপচাপ। আসল ঘটনা কি বোঝার চেষ্টা আছে। তারিনের কথা শুনে দিশা অল্পস্বল্প হাসল। পুনরায় বলতে শুরু করল,
“তুমি মেয়েটা অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী! এত গুছিয়ে কথা বলে নিজের সুন্দর ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিলে আবার। শোনো মেয়ে, পুরানো কথা থাক। আমার সাথে যেটা হয়েছে তার জন্য সম্পূর্ণ দোষী আমি। তাজ আমাকে বুঝানোর যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু আমি বুঝি নি৷ নিজের জেদ থেকে সরে আসি নি। নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করি নি। আন্টির উপর রাগ থেকে তাজের একটা কথাও বুঝার চেষ্টা করি নি। আমার পরিবার ইন্ডিয়া থাকে। ছোট বেলা থেকে বাবা-মায়ের অশান্তি দেখতে দেখতে পরিবারের উপর বিরক্তি এসে পড়েছিলো। তাই বুঝমান হতেই মামার সাথে বাংলাদেশে চলে আসি। এখন অব্দি তাদের কাছে ফিরে যাই নি। এই যে এতগুলো বছর আমি পরিবার থেকে দূরে থেকে পরিবারের আসল মানে টাই ভুলে গেছি। তাই আমিও চেয়েছিলাম তাজ নিজের পরিবার ছেড়ে আমার কাছে চলে আসুক। আমরা আলাদা সংসার গড়বো। তাজকে নিজের পরিবার থেকে সরানোর জন্যই নিজের সিদ্ধান্তে অটুট ছিলাম।ভেবেছিলাম, তাজ আমার কাছেই ফিরে আসবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। নিজের রাগ, জেদ টিকিয়ে রাখতে গিয়ে ভুলে গিয়েছিলাম আমি পরিবারের মর্ম না বুঝলেও, বাকি সবাই বুঝে। আমার মতো সবার একাকিত্বের জীবন না।”
দিশার গলা ধরে আসছে। আবার থামলো। তামজিদের দৃষ্টি টেবিলের দিকে। তারিন টলমল চোখে দিশার দিকে তাকিয়ে আছে। দিশা আবার বলা শুরু করল,
“জানো, আমিও খুব ভালোবাসতাম আমার পরিবারকে। কিন্তু চোখের সামনে নিজের মাকে কতদিন অত্যাচারিত হতে দেখা যায়। মাকে অনেক বুঝিয়েছিলাম বাবাকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু মা নিজের সংসার ছেড়ে আসতে কখনোই রাজি হয় নি। তাইতো আমারো সংসারের প্রতি এত অনীহা। আন্টি এইজন্যই আমাকে পছন্দ করতেন না। অবশ্য না করাটাই স্বাভাবিক।”
বলে অল্প বিস্তর হাসার চেষ্টা করলো। তারিন দিশার কষ্টের সীমা বুঝতে পারলো। একবার তামজিদের দিকে তাকিয়ে নিলো আড় চোখে। ছেলেটার দৃষ্টিতে অপরাধবোধ আর অনুতাপের ছোয়া স্পষ্ট। দিশার চোখের কোনেও জল জমেছে। কী আশ্চর্য! তিনজন মানুষের কষ্টের কারণ একই। অথচ তিনজন মানুষ কয়েক দিন আগে অব্দি কেউ কাউকে চিনতো না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ তিনজন একই সূত্রে গেথে গেছে৷ কষ্টটাও বুঝি সে
জন্যই হচ্ছে! তারিনের বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। ভেতরাঙ্গে হাহাকারের শব্দ বাজছে। তবুও শান্ত থাকলো। চোখের জমে থাকা অশ্রু বিন্দু খুব সর্তকে মুছে নিলো। অতঃপর খুব শান্ত, মোলায়েম স্বরে বলে উঠল,
“আপনি একবার যদি মায়ের সব শর্তে রাজি হয়ে যেতেন তাহলে আজকে আমাদের তিনজনের জীবন তিন রকম হতে পারতো। আমরা তিনজন দহনের যন্ত্রণায় প্রতি রাতে ছটফট করতাম না। অবিশ্বাসের বীজ আমার মনে ফুটতো না। প্রতিনিয়ত সংসার ভাঙার ভয় আমাকে কাবু করতে পারতো না। আপনারা দুজন একসাথে থাকতেন। সুখে থাকতেন। অন্যরকম কিছু হতে পারতো। আপনাদের তিনজনের রাগ, অভিমান, জেদ এর জন্য আমার জীবনের বলি দান আমি কেনো করবো, দিশা আপু?”
তামজিদ দৃষ্টি তুলে তাকালো। এই মেয়েটা এত শক্ত কেন? কোনো কিছুতেই তাকে দূর্বল করা যায় না৷ সত্যিই মেয়েটার ব্যক্তিত্ব অসাধারণ! তামজিদ না চাইতেও বারবার তারিনের ব্যক্তিত্বের প্রসংশা করে ফেলছে। এত এত ঝামেলা, অশান্তি কত সুন্দর করে সামলাতে জানে। প্রসংশানীয়! যখন তিনজন তিনরকম ভাবনা চিন্তায় ব্যস্ত। তখনি দিশা হুট করে প্রশ্ন করে,
“আমি তোমার কাছে কিছু চাইলে আমাকে দিবে?”
তারিন অকপটে জবাব দিলো,
“দেওয়ার সামর্থ্য থাকলে অবশ্যই দিবো। বলে দেখুন।”
“তাহলে আমার আর তাজের জীবন থেকে সরে যাও। চলো, আমরা তিনজনে আবার নতুন করে সবটা শুরু করি।”
কথাটা শোনামাত্র তারিন আর তামজিদ যেনো আকাশ থেকে পড়লো। কী বলছে ও? তারিন বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে আছে দিশার দিকে। আর দিশার মুখে লেগে আছে রহস্যময় হাসি। সে হাসির মানে কি? নতুন কোনো ঝড় নাকি সব ঝড়ের সমাপ্তি?

#চলবে

#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখিনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_চৌদ্দ

“কোন সাহসে আপনি আমাকে আমার স্বামীর জীবন থেকে সরে যেতে বলেন? আপনি ভুলে গেছেন আপনি কে? আর আমি কে? আপনি আমার স্বামীর প্রাক্তন। আর আমি তার সহধর্মিণী। দুনিয়া ও আখিরাতের জীবন সঙ্গী। তার বক্ষস্থলে আমার স্থান। আর সেই আমাকেই বলছেন আমার স্বামীকে ছেড়ে দিতে? এমন দুঃসাহস কী করে দেখাতে পারলেন আপনি?”
ভরা রেস্টুরেন্টের মাঝে তারিন উচ্চবাক্যে উপরোক্ত বাক্য গুলো বলে উঠল। রাগে ওর শরীর কাঁপছে। দিশার চোখ এখনো শান্ত,শীতল। মুখে লেগে আছে আগের ন্যায় হাসি। উপস্থিত সবাই ওদের দিকে চেয়ে আছে অবাক দৃষ্টিতে। তামজিদ চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে নিলো। নিচু স্বরে দিশার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“এসব কি বলছিস তুই? মাথা ঠিক আছে? কেনো বার বার অতীত নিয়ে পড়ে আছিস? আমি আর মানতে পারছি না বিশ্বাস কর। ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমি কি বাকি জীবনে আর শান্তি পাবো না?”
এবার তারিন আগের ন্যায় শক্ত স্বরে বলে উঠল,
“অবশ্যই! আপনি বাকি জীবন অনেক শান্তিতে থাকবেন। আমি রাখবো। আপনার মানসিক শান্তির কারণ আমি হয়ে উঠবো, মাস্টার মশাই। আপনি কেনো শুধু শুধু এই মেয়েটার জন্য কষ্ট পাবেন? কেনো বিয়ের মতো হালাল সম্পর্কে থেকেও হারাম সম্পর্কের মায়া কাটাতে পারছেন না? মানুষ চেষ্টা করলে সব পারে_কথাটা জানেন না আপনি? তবে কেনো চেষ্টা করছেন না? কেনো আমাকে ভালোবেসে আগলে নিচ্ছেন না? কেনো অতীত ভুলে যাচ্ছেন না? কেনো, কেনো?”
দিশা আর তামজিদ দুজনেই চুপ হয়ে আছে। তারিন কথাগুলো চেঁচিয়ে বলছে। আজকে আর কাউকে পরোয়া করছে না। মনের সবটুকু রাগ, ক্ষোভ উত্তলে দিচ্ছে। তারিন পুনরায় শক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি কি দিশা আপুর কাছে ফিরে যেতে চান, মাস্টার মশাই?”
কথাটা বলতে তারিনের গলা কেঁপে উঠেছে কয়েকবার। তবুও বলেছে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নের উত্তর জানাটা খুব দরকার। তামজিদ সাথে সাথে উত্তর দিলো,
“যে অতীত থেকে একবার আমি ফিরে এসেছি, সে অতীতে আমি আর ফিরে যেতে চাই না। তাতে যদি মানুষ আমাকে কাপুরুষ, স্বার্থপর, প্রতারক উপাধি দেয় আমি তা মাথা পেতে মেনে নিবো।”
তামজিদের উত্তরটা কানে যেতেই তারিনের চোখে মুখে খুশির ছোঁয়া স্পষ্ট হয়ে ফুটল। তারিন যেনো এবার আরো সাহস ফিরে পেলো। দিশার দিকে অগ্নী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আপনাকে আমার এই মুহূর্তে ঠাটিয়ে থা”প্পড় মা’রার শখ হচ্ছে জানেন? কিন্তু ওই যে বয়সে বড় বলে নিজের সীমা অতিক্রম করার মতো বে”য়াদবি আমি করবো না। আপনি না কিছুক্ষণ আগে আমাকে বললেন ‘আমি আপনার বোনের মতো’? তাহলে বোনের স্বামীকে কী করে চাচ্ছেন? লজ্জা করলো না আপনার?”
তামজিদ এবার মুখ খুলল। শক্ত বাক্যে জিজ্ঞেস করলো,
“তুই আসলে কি চাস আমাকে একটু পরিষ্কার করে বলবি, প্লিজ?”
“তোদের সুখী দেখতে চাই।”
কথাটা তামজিদ আর তারিনের কানে যেতেই ওরা দুজন অবাকের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেলো। দুজনের মুখভঙ্গি দেখে দিশা ফিক করে হেসে ফেলল। উচ্চ স্বরে হাসতে লাগলো কিছুসময়। ওদিকে তামজিদ, তারিন দুজনেই অবাক হয়ে দিশার দিকে তাকিয়ে আছে। তারিন কিছু একটা ভেবে তামজিদের কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
“দিশা আপু কি আপনার শোকে পাগল হয়ে গেলো, মাস্টার মশাই?”
এই মুহূর্তে তারিনের এহেন কথায় তামজিদ ভ্যাবাচেকা খেয়ে উঠল। দিশার দিকে অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে মা*রল,
“এভাবে পাগলের মতো হাসছিস কেনো?”
দিশার হাস্যজ্বর মুখপানে তাকিয়ে তারিনের বড্ড রাগ হচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজে নিজেই নিচু স্বরে বলে উঠল,
“শা’কচু’ন্নিটার মাথা মনে হয় একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। যাক! ভালোই হলো। এবার এটাকে ধরে নিয়ে পাগলাগারদে রেখে আসবো। আর আমি আর মাস্টার মশাই এই খুশিতে হানিমুনটা সেরে আসবো। ইশ! লজ্জা পাচ্ছে!”
ভেবেই নিজে নিজেই লজ্জায় দুই হাতে মুখ ঢাকলো। তামজিদ একবার দিশার দিকে আর একবার তারিনের দিকে তাকাচ্ছে। হচ্ছে টা কি? সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে বেচারার। নিজেকেই পাগল পাগল লাগছে এই মুহূর্তে। ওইদিকে দিশা হাসছে। আর এদিকে তারিন লজ্জা লজ্জা মুখ করে হাসছে। মানে এখানে লজ্জা পাওয়ার কি হলো_ সেটাই খুঁজছে তামজিদ। নাহ! এই দুজন মিলে ওর জীবনটা একেবারে তেজপাত করে ফেলবে মনে হচ্ছে। তামজিদের নিজের মাথায় বাড়ি মা’রতে ইচ্ছে হচ্ছে। কী উদ্ভট পরিস্থিতিতে পড়েছে ভাবা যায়! দিশার হাসি থামলো এতক্ষণে। হাসতে হাসতে বলে উঠল,
“স্যরি! স্যরি! বিশ্বাস কর, তোদের দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কিছুতেই নিজের হাসি কন্ট্রোল করতে পারি নি।”
বলেই আরেকদফা হেসে নিলো। টেবিলের উপরে থাকা এক গ্লাস পানি নিয়ে ঢকঢক করে গিলে ফেলল। তারিন আর সহ্য করতে পারছে না৷ তাই তামজিদের হাত ধরে জোর গলায় বলল,
“চলুন, আমরা বাসায় যাবো।”
বলেই উঠে দাঁড়ালো। দিশা বাঁধা দিয়ে বলে উঠল,
“আরে! যাচ্ছো কই? আমার সম্পূর্ণ কথাটা শুনে যাও, পাগলী।”
“আপনার এমন রং তামাশা দেখার সময় নেই আমাদের। নতুন নতুন বিয়ে করেছি স্বামী স্ত্রী একসাথে সময় কাটাবো। গল্প করবো। ঘুরবো। আপনি নামক ‘কাটার’ সাথে বসে থেকে সময় নষ্ট করার একটুও ইচ্ছে নেই।”
তামজিদ খালি তারিনের মুখের দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। নিজে নিজেই মিনমিনিয়ে বলে উঠল,
“ইয়া আল্লাহ! এটা তুমি কাকে আমার জীবনে পাঠিয়েছো? এটা মেয়ে নাকি কথা বলার মেশিন? সারাদিন মুখ থেকে নতুন নতুন শব্দ ফুটতেই থাকে? উফফ! হাঁপিয়ে গেলাম।”
তামজিদ মিনমিনিয়ে বললেও তারিনের কানে শেষ কথাটা ঠিকই পৌঁছালো৷ তারিন কঠিন স্বরে বলে উঠল,
“মাত্র তো হাঁপানো শুরু, মাস্টার মশাই। এখনো সারাজীবন বাকি।”
তারিনের কথাটা শেষ হতেই দিশা হা হা করে হেসে দিলো। আর তামজিদের মুখটা চুপসে গেলো৷ দি্ার অনুরোধে তারিন বসলো পুনরায়। এর মাঝে ওয়েটার এসে কফি দিয়ে গেছে। তামজিদ কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বলল,
“যা বলার তাড়াতাড়ি বলে শেষ কর। তবে হ্যাঁ, আবোল-তাবোল কিছু বললে এবার আর আমি বাঁচাতে পারবো না।”
দিশা ঠিক বুঝলো তামজিদ কি মিন করেছে। তবুও কথা বাড়ালো। সোজা কথায় চলে গেলো। শান্ত বাক্যে বলতে লাগল,
“তোমার কাছে এমন অন্যায় আবদার করার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, বোন। তোমাকে এইটুকু সময়ে আমার খুব ভালো করে চেনা হয়ে গেছে। তুমি যে তাজকে কখনো ছাড়বে না এটা পরিষ্কার ভাবে বুঝে গেছি। শুধু মাত্র এইটুকু বুঝার জন্যই অন্যায় আবদারটা করেছিলাম। আমি আজকে তোমাদের এখানে ডেকেছি আমাদের তিনজনের জীবনের সব অশান্তি দূর করার জন্য। আমি কাল ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছি। আর কবে ফিরবো জানা নেই। তবে একদিন আসবো হুট করেই। তোমাদের সুখের সংসার নিজের চোখে দেখে যেতে।”
তারিন আর তামজিদ দুজনেই আরেক দফা অবাক হলো। তামজিদ কিছু একটা ভেবে প্রশ্ন করল,
“তাহলে জবটা ছেড়ে দিচ্ছিস?”
“হ্যাঁ! ”
দিশা উত্তর দিতেই তামজিদ অসহায় বাক্যে উচ্চারণ করল,
“তাহলে আমি কি দোষ করেছিলাম? আমার জন্য কেনো ছাড়তে পারলি না? কেনো আমার মায়ের শর্তটা মানতে পারলি না?”
তারিন বুকের ভেতরের যন্ত্রণা টের পেলো। তামজিদ এখনো দিশার উপর বেশ দূর্বল সেটা বুঝতে সময় লাগলো না ওর। দিশা হাসলো। বলল,
“বোকা! আমি এখানের জবটা ছেড়ে দিচ্ছি। কারণ, ইন্ডিয়াতে গিয়ে ভালো একটা জব খুঁজে নিবো। কয়েকটা জব অফার হাতে রেখেই যাচ্ছি সেখানে।”
তামজিদ চুপ করে গেলো। দিশা পুনরায় শান্ত বাক্যে বলে উঠল,
“আমি তোকে সত্যি ভালোবাসতে পারি নি। তুই অন্য কাউকে বিয়ে করেছি বিশ্বাস করো আমার একটুও কষ্ট হয় নি। তুই যেদিন বিয়ে করলি সেদিন থেকে মনে হতে লাগলো আমি আন্টির কাছে গেছি। নিজের হার কিছুতেই মানতে পারছিলাম না৷ এতদিন এইসব অশান্তি করেছি শুধুমাত্র নিজের রাগ আর জেদটাকে ধরে রাখার জন্য৷ কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারছি। এটা ঠিক না৷ আমার তো আত্মসম্মান আছে৷ আমি কেনো বে’হায়ার মতো তোকে বার বার ফোন করে, কান্না কাটি করে নিজের আত্মসম্মান বির্সজন দিবো? যখন বুঝতে পারলাম তখন সিদ্ধান্ত নিলাম আমি তোদের জীবনে আর কাটা হয়ে থাকবো না। নিজের জীবনটা সুন্দর করে গড়ে তুলবো। নিজের মনের মতো কাউকে খুঁজে নিয়ে তার সাথে ঘর বাঁধবো। আমাদের সবার অধিকার আছে সুন্দর করে বাঁচার। তাহলে আমি নিজের আর তোদের দুজনের ভালো থাকা কেনো নষ্ট করবো? আমরা তিনজনেই সুখে থাকবো। জীবনে ভালো কিছু পাওয়ার জন্য নিজেকে এক ধাপ পিছিয়ে নিতে হয়। আমি পিছিয়ে গেলেই সবার জন্য ভালো হবে। তাই পিছিয়ে গেলাম। তোমাদের জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা রইলো। তোমরা একসাথে খুব ভালো থাকবে। সুখী থাকবে। আসি আমি। আমার একটু কাজ আছে। আল্লাহ হাফেজ।”
বলেই দিশা হাসি মুখে উঠে চলে গেলো। বসে রইলো শুধু তামজিদ আর তারিন। তামজিদের মুখটা অন্ধকার হয়ে গেছে। হয়তো এখনো মানতে পারছে না সবটা। আর তারিনের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটেছে। মনে মনে ভাবছে,
“তাহলে সব ঝড়ের সমাপ্তি কি এখানেই হলো? এবার বোধহয় আমি স্বামীর ভালোবাসা পাবো। আমাদের নতুন সংসার শুরু হবে আজ থেকে।”

#চলবে