#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_ছয়
গলায় দড়ি লাগিয়ে শেষ ভরসা পায়ের নিচের চেয়ারটা যখন নিহা ফেলে দিলো, তখনি ও মৃত্যু যন্ত্রণা কতটা কঠিন তা টের পেলো। চিৎকার করতে গিয়েও পারলো না। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। এবার আর মরার চেষ্টা করলো না। বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু পারছে না। কোনোমতেই পারছেনা। কানে ভেসে আসলো তখন দরজার ওপাশ থেকে সোরগোল। তারিন, তামজিদ, নেওয়াজের গলাই বেশি শোনা যাচ্ছে। ওরা এখানে কি করে আসলো? বুঝতে পারছে না কিছু। নেওয়াজের মুখটা বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ছেলেটা বাবা-মা সব হারিয়ে নিহাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলো। আর সেই নিহাই নাকি ছেড়ে যাচ্ছে? নিহা বুঝে গেছে ওর আর বাঁচার চান্স নেই। তবুও মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে। বলছে, ‘শেষ বারের জন্য ওকে এ জীবন ভিক্ষা দিয়ে যেতে’। নিহা সেদিকে আর তাকাতে পারলো না। দু-চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কিছুতেই খুলে রাখতে পারছে না৷ জীভ বেরিয়ে আসছে। গলা কি দড়ির টানে কে’টে গেছে? হয়তো গেছে! নিহা বুঝে গেছে ও এ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে। শেষ বারের মতো নেওয়াজের মুখটা দেখার তীব্র ইচ্ছাটা পূরণ হলো না। নিয়তির অশেষ রহমতে সেই মুহূর্তেই তামজিদ, নেওয়াজ দরজা ভেঙে ভেতরে হুড়মুড়িয়ে ঢুকলো। নিহাকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে নেওয়াজ প্রথমে দৌড়ে গিয়ে নিহার পা দুটো জড়িয়ে ধরলো। তারিন আর চিৎকার করার শক্তি পেলো না। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিলেই তামজিদ সামলে নিলো। নিহার বাবা-মাও চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিলো। তামজিদ তারিনকে খাটের উপর বসিয়ে দিলো। তারপর নেওয়াজ, আর তামজিদ মিলে নিহাকে নামিয়ে আনলো। তামজিদ পার্লস চেক করতেই দেখলো পার্লস পাচ্ছে না। নেওয়ার নিহাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলো। কান্না করার সুযোগ পেলো না। কিছু বলছেও না ভয়ে। তামজিদ এবার নিহার নাকের কাছে হাত নিলো। নাহ! নিঃশ্বাস বুঝা যাচ্ছে না। তামজিদ ভয়ে ভয়ে নেওয়াজের দিকে তাকালো। নিহার বাবা একাধারে প্রশ্ন করে যাচ্ছে,
“বাবা, আমার মেয়েটা কি বেঁচে আছে? বলো, বেঁচে আছে?”
তামজিদ উত্তর দেওয়ার সাহস পাচ্ছে না। তারিনের দিকে একবার তাকালো। তারিন ভেঙে পড়া চোখে তাকিয়ে আছে। তামজিদ কোনোরকমে ভাঙা গলায় বললো,
“ও বেঁচে নে…।”
তামজিদ পুরো কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই নেওয়াজ চিৎকার করে বলে উঠল,
“বেঁচে আছে। ও বেঁচে আছে। ওর নিঃশ্বাস পড়ছে। তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। চলো।”
বলেই নিহাকে কোলে তুলে হাঁটা শুরু করলো। নিহার মা কান্না করতে করতে গাড়িতে উঠতে নিলেই নেওয়াজ থামিয়ে দেয়। রাগান্বিত স্বরে চিৎকার করে তামজিদের উদ্দেশ্যে বললো,
“উনাকে আসতে বারন করো। আমি যেনো উনাকে নিহার আশেপাশে না দেখি। উনার এইসব ন্যাকা কান্না অন্য কোথাও দেখাতে বলো। আমার সামনে এসব অভিনয় করে লাভ নেই।”
নিহার মা থেমে গেলো। কিছু বলতে গিয়েও পারলেন না। নিহার বাবা আর তামজিদ মিলে থামিয়ে দিলো। নেওয়াজ, আর নিহার বাবা নিহাকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আর তামজিদ তারিনকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। তারিন কাঁদছে না। অতিরিক্ত শকে চুপ হয়ে গেছে। বার বার চোখের সামনে নিহার ঝুলন্ত চেহারাটা ভেসে উঠছে। তামজিদ তারিনকে এক হাতে বুকে চেপে ধরে আর হাতে সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছে। তামজিদ আস্তে ধীরে সাবধনতা অবলম্বন করে বলা শুরু করল,
“এভাবে চুপ করে থেকো না। কাঁদতে মন চাইলে কাঁদো। তোমার কাঁদার জন্য আমার বুক আছে তো। কান্নাকাটি করে আমার বুক ভাসিয়ে দাও। আমি মেনে নিবো। কিন্তু এমন চুপ করে থেকো না। চুপ থাকা তোমাকে মানায় না। কষ্ট বুকে চেপে রাখলে কষ্ট বাড়ে, কমে না। এই অবস্থায় প্রেশার নিও না। ভুলে যেও না। তোমার ভেতর বসবাস করছে একটি প্রাণ। সে আমাদের সম্বল। তার জন্য হলেও নিজেকে ঠিক করো।”
তারিন কথাগুলো শুনলো। কিন্তু কাঁদতে চেয়েও পারলো না। কেনো যেনো কান্না আসছে না। হঠাৎ কোনো শক খেলে কি মানুষ এভাবেই চুপ হয়ে যায়? হয়তো যায়। তখন নিহা ফোন রেখে দেওয়ার পর তারিন এক মুহূর্তের জন্য যেনো আকাশ থেকে পড়ে। পরক্ষণেই যখন নিহার ফোন পুনরায় ফোন দিলো তখন ওপাশ থেকে ফোনটা বন্ধ ঘোষণা করলো। ভয়ে যখন মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো তখন তারিন এক মুহূর্তের জন্য কাঁদতেও ভুলে গেলো। মাথায় তৎক্ষনাৎ তামজিদের কথা আসতেই আগে তামজিদকে ফোন করে সবটা বললো। তারিন সেই অবস্থায় কিছু না ভেবে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। সোজা তামজিদের কলেজে গিয়ে তামজিদকে সাথে নিয়ে রওনা হলো নিহাদের বাসায়। তামজিদ ততক্ষণে নেওয়াজকেও নিহাদের বাসায় আসতে বলে দিয়েছে। কি এক ভয়ানক সময় ছিলো সেইসময়টা! ভেবেই তারিন একবার কেঁপে উঠলো। তারিনের থেকে কোনো রকম উত্তর না পেয়ে তামজিদ পুনরায় বলে উঠল,
“তোমার এভাবে তাড়াহুড়ো করে, নিজের কথা না ভেবে ছুটে যাওয়া একদম উচিত হয় নি। আমার উপর ভরসা ছিলো তো। আমি নিহার কিচ্ছু হতে দিতাম না। সবথেকে বড় কথা নিহার হায়াত থাকলে নিহার কিছু হতো না। আর হায়াত শেষ হলে আমরা কেউ বাঁচাতে পারতাম না। কিন্তু তুমিএভাবে টেনশন, ছুটোছুটি কতটা বিষাদময় পরিস্থিতি দিয়ে গেলে বলো তো? তোমার কোনো ক্ষতি হলে আমার কি হবে?”
তামজিদের গলা কাঁপলো। তারিন বুঝতে পেরে একটু স্বস্তি পেলো। শক্ত করে ধরলো তামজিদকে। বললো,
“আমার কিছু হবে না। আপনি পাশে থাকলে সব পরিস্থিতিতেই আমি সুখী, মাস্টার মশাই।”
তামজিদ উত্তর দিলো না। মনে মনে স্বস্তির নিঃস্বাস ফেললো। যাক মেয়েটাকে একটু স্বাভাবিক করা গেলো। তারিন পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
“নিহা ঠিক হয়ে যাবে তো?”
তামজিদ অভয়বানী দিয়ে বললো,
“ইন শা আল্লাহ, সুস্থ হয়ে যাবে। চিন্তা করো না।”
তারিন শান্ত হলো। মনে মনে দোয়া করলো বেশকিছুক্ষন। হাসিখুশি মেয়েটা কতটা চাপে পড়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা তারিন ভীষণ ভাবে বুঝতে পারছে। তামজিদ তারিনকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে জাহেলাকে বলো, তারিনের খেয়াল রাখতে। আর তারিনকে বললো, ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিতে। তারপর নিজে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
–
–
–
মাঝে কেটে গেছে প্রায় ৪ ঘণ্টা। নিহা এখন ভালো আছে। তবে জ্ঞান ফিরেনি। ডাক্তার ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছে। তাই গভীর ঘুমে আছে। নেওয়াজ নিহার কাছের থেকে একবারের জন্যও নড়েনি। তামজিদ একবার নেওয়াজকে সামলে নিয়ে, খাইয়ে দাইয়ে আবার বাসায় গেছিলো। এবার তারিনকে নিয়ে আবার হসপিটালে আসতেই দেখলো নিহার মাও হসপিটালে। মুখে আঁচল গুঁজে নিশ্চুপে কাঁদছে। নিহার বাবা দরজার পাশেই চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। উনার চোখেও পানি। তারিন নিহার বাবা-মাকে উপেক্ষা করে কেবিনের ভেতরে ঢুকে গেলো। নেওয়াজকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে বসলো নিহার পাশে। মেয়েটার চোখ মুখের কি ভয়ংকর অবস্থা! নেওয়াজ বাইরে আসতেই নিহার মাকে দেখে রেগে গেলো। চিৎকার করে বললো,
“উনি এখানে কেন? উনাকে এখানে আসতে কে বলেছে? তামজিদ উনাকে এক্ষুনি এখান থেকে চলে যেতে বলো নয়তো আমি পুলিশ ডাকবো। উনি মা নামে কলঙ্ক। যে মায়ের কাছে নিজের মেয়ের চাইতেও সমাজের মানুষের কথা বেশি গুরুত্বপূর্ণ সে কেমন মা? চলে যান আপনি। এক্ষুনি চলে যান। আউট।”
তামজিদ কোনোরকমে নেওয়াজকে থামালো। তারিন চিৎকার শুনে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। এবার তামজিদ মুখ খুললো। নিহার মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো,
“আন্টি, কিছু প্রশ্ন করি। চুপ করে থাকবেন না প্লিজ। সঠিক উত্তর দিবেন।”
নিহার মা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াতেই, তামজিদ প্রশ্ন করলো,
“নিহাকে জন্ম দিয়েছে কে?”
নিহার মা কান্নারত স্বরে জবাব দিলো,
“আমি।”
তামজিদ পুনরায় প্রশ্ন করলো,
“নিহাকে ছোট থেকে লালন পালন করেছে কে?”
“আমি আর নিহার বাবা।”
“নিহার এই অব্দি সব দায়িত্বে, আবদার পূরণ করেছে?”
“নিহার বাবা।”
“আচ্ছা আন্টি, সবথেকে বড় কথা নিহার খাওয়ানো, পড়ানোর দায়িত্ব কি সমাজ, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী নিয়েছিলো?”
নিহার মা চুপ করে গেলেন এবার। উত্তর দিতে পারলেন না। তামজিদ এবার আগের ন্যায় শক্ত কণ্ঠে বলতে লাগলো,
“যেখানে মেয়ে আপনাদের, খাওয়ানো, পড়ানো, বড় করার দায়িত্ব আপনাদের। সেখানে পাড়া-পড়শীর, আত্মীয়-স্বজন, সমাজের কথা আপনারা কেন শুনবেন? কেন তাদের জন্য নিজের সন্তানকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিবেন? সন্তানের জীবনের থেকে কি পড়ালেখাটা বেশি দামী? আপনাদের মতো কিছু বাবা-মায়ের জন্য কত ছেলে-মেয়ের জীবন অকালে ঝড়ে যায় জানেন? আপনারা সন্তান জন্ম দেন ঠিকই। কিন্তু সন্তানের মন বোঝার ক্ষমতা আল্লাহ আপনাদের দেয়নি। সন্তানের কদর করতে জানেন না। আপনাদের মতো মায়েদের না মা হওয়ার কোনো যোগ্যতাই নেই। আল্লাহ আপনাদের সন্তান না দিলেই বোধহয় ভালো করতেন। কারণ, আপনারা ভেবে নেন সন্তান যা করে সেটাই ভুল। প্রেম করলে সেই ব্যক্তি ভুল। মোটকথা, সন্তান যা করবে সেটাই ভুল। আর আপনারা যা করবেন সেটা ঠিক? মনে রাখবেন, কোনো মানুষই ভুলের উর্ধে না। আপনারা বাবা-মা বলে যে আপনাদের ভুল হয়না এটা ভাবা বোকামি। আপনারা নিজেরাও জানেন না, আপনারা সন্তানের ভালো চাইতে গিয়ে মাঝে মাঝে তাদের খারাপ করে ফেলেন। শাসন করা অবশ্যই উচিত। ভুল হলে বাবা-মা শাসন করবে এটাই স্বাভাবিক৷ এই অধিকার আপনাদের একশোবার আছে। কিন্তু অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। যখন দেখলেন নিহা নিজেই হতাশায় ভুগছিলো, তখন আপনার মা হিসেবে উচিত ছিলো ওকে সাপোর্ট করা। ভরসা দেওয়া। সাহস যোগানো। তা না করে আপনি ওকে আরো ভেঙে দিছেন। একটু একটু করে ভাঙতে ভাঙতে মেয়েটা পুরো ভেঙে গেছে৷ তাইতো এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ আপনাদের এই মুহূর্তে আর কি বলা উচিত আমার জানা নেই? শুধু বলবো সমাজ, পাড়া-পড়শীর, আত্মীয়-স্বজনের কথায় কান দিবেন না। আপনারা এক বেলা না খেয়ে থাকলে তারা খাওয়াতে আসবেনা৷ আপনাকে কোনো কাজে সাহস যোগাবে না। শুধু ভুল করলে সেই ভুল ধরিয়ে দিতেই আসবে৷ নিজের মনকে প্রশ্ন করুন আপনি কি ঠিক করেছেন নাকি ভুল?”
#চলবে