#ঝলসে_যাব_জানি
#Part_12
#ইয়াসমিন_খন্দকার
আহনাফের মৃত্যুর পর এক মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। সময় কখনো কারো জন্য অপেক্ষা করে না। এই এক মাসে অনেক কিছুই বদলে গেছে৷ রূপকথা শোক কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় রত৷ কতটা উঠতে পেরেছে জানে না তবে আগের মতো আর আহনাফকে মনে করে সে কাঁদে না। নিজেকে শক্ত খোলসে আবৃত করে রেখেছে। দূর্জয়ও হম্বিতম্বি ছেড়ে অনেকটা শান্ত হয়েছে। বাপ্পী বা তার গ্যাং এর কোন খোঁজ নেই এক মাস হলো। এই এক মাস দূর্জয় সব রকম খোঁজ লাগিয়েছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। তবে সে হাল ছাড়ার পাত্র নয়। শান্ত মস্তিষ্কে খোঁজ চালিয়ে যায়।
দূর্জয় এবং রূপকথা দুজনেই দুই প্রান্তের মানুষ তবে একটা বিষয়ে তাদের মিল সম্পূর্ণ আছে। দুজনের চোখেই জ্বলজ্বল করছে প্রতিশোধের আগুন। যা নিভবে শুধুমাত্র আহনাফের হ*ত্যাকারীদের চরম শাস্তি দেয়ার মাধ্যমে। রূপকথার বোঝাপড়াটা আরো অনেক বেশি। যারা তার সম্মানের দিকে হাত দিয়েছিল তাদের নিকৃষ্ট অবস্থা সে করবেই, সাথে নিজের ভালোবাসার হ**ত্যাকারীকেও দেখে নেবে, এই তার পণ।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আমিয়া আজ দুই দিন পর ভার্সিটিতে পা রাখলো। ইদানীং কোন কিছুই তার ভালো লাগে না। আহনাফের মৃত্যুর পর রূপকথা কেমন জানি বদলে গেছে। আর আগের মতো তার সাথে মেশে না। খুব একটা কথাও বলে না। সারাক্ষণ জানি কিসব ভাবনায় ডুবে থাকে। আমিয়া রূপকথার পরিবারের থেকে শুনেছে বাড়িতেও সে এমন চুপচাপ এবং একাকী থাকতে পছন্দ করে।
এসবের মধ্যে আমিয়া বড্ড একা হয়ে পড়েছে। দূর্জয় তো তার দিকে ফিরেও তাকায় না। কত বার সে দূর্জয়ের সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছে এই এক মাসে। বিনিময়ে শুধু জুটেছে অবহেলা আর অপমান। আমিয়া তবুও হাল ছাড়েনি। এত সহজে হাল ছাড়ার মেয়ে সে নয়।
আজ ভার্সিটিতে আমিয়া নিজের হাতে কাবাব বানিয়ে এনেছে। দূর্জয়ের এক বন্ধুর মাধ্যমে আমিয়া জানতে পেরেছিল সে কাবাব খেতে অনেক পছন্দ করে। এটা জানার পর তার ইচ্ছা জাগে দূর্জয়কে কাবাব বানিয়ে খাওয়ানোর। কিন্তু সে যে রান্না একদম পারে না। তারপরেও ফোনে দেখে দেখে অনেক কষ্টে বানিয়েছে। আসার সময় খেয়ে দেখেছে খুব একটা ভালো না হলেও খারাপও হয়নি, খাওয়া যায়। তাই মনে অনেক আশা নিয়ে দূর্জয়ের জন্য নিয়ে এসেছে এই খাবার।
ভার্সিটিতে এসে চারদিক তন্নতন্ন করে দূর্জয়কে খোঁজে আমিয়া। কিন্তু কোথাও তার খোঁজ পায়না। তবে দেখতে পেয়ে যায় দূর্জয় এর বন্ধু সাগরকে। তাকে দেখে এগিয়ে গিয়ে বলে,”ভাইয়া, দূর্জয় কোথায়? এসেছি থেকে ওকে দেখছি না?”
সাগর আমিয়ার দিকে তাকিয়ে বিরক্তির সহিত বলে,”দূর্জয়ের সাথে তোমার কি কাজ? তুমি কেন ওর পেছনে পড়ে আছ? বুঝতে পারো না, ও তোমার উপস্থিতিতে বিরক্ত হয়।”
আমিয়া স্লান হেসে বলে,”আপনি নিশ্চয়ই কখনো কাউকে ভালোবাসেন নি। তাই আপনি বুঝবেন না।”
“তোমার ভালোবাসাটা স্যালুট জানাতে হয়। দূর্জয়কে ভালোবাসার কথা বলে অন্য একটা ছেলের সাথে বিয়ের পিড়িতে বসতে যাচ্ছ আর এখানো সব নাটক করে চলেছ..তোমার মধ্যে কি এতটুকু লজ্জা অবশিষ্ট নেই?”
“না, নেই। ভালোবাসলে নির্লজ্জ হতে হয়।”
সাগরের আমিয়া নামক মেয়েটাকে একদম সহ্য হয়না। এতদিনে সে শতভাগ নিশ্চিত হয় দূর্জয় কেন আমিয়ার উপর এত বিরক্ত। এমন গায়ে পড়া মেয়েকে কোন ছেলেই পছন্দ করে না। সাগর স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়,”দূর্জয় এর থেকে দূরে থাকো এটাই তোমার জন্য ভালো হবে৷ ও যদি রেগে যায় তাহলে কিন্তু নারী জন্য তোমাকে তোয়াক্কা করবে না।”
বলেই সাগর গটগট পায়ে স্থান ত্যাগ করে। সাগর যাওয়ার পরই দূর্জয় একটা বাইকে চেপে ঠিক সেখানে চলে আসে যেখানে আমিয়া দাঁড়িয়ে ছিল৷ কারণ সাগরের সাথে এই স্থানে তার দেখা করার কথা। হেলমেট নামিয়ে সাগরকে না দেখে আমিয়াকে দেখে দূর্জয় যারপরনাই বিরক্ত হয়৷ পুনরায় হেলমেট পড়ে বাইক স্টার্ট দিবে তার আগেই আমিয়া দূর্জয়ের বাইকের সামনে এসে দাঁড়ায়। দূর্জয় বলে ওঠে,”সমস্যাটা কি?”
আমিয়া নিজের হাতে বানানো কাবাবটা দূর্জয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”আমি নিজের হাতে আপনার জন্য এটা বানিয়েছি। শুনেছি কাবাব আপনার অনেক প্রিয়৷ খেয়ে দেখুন তো কেমন হয়েছে।”
দূর্জয় খুবই শান্ত ভঙ্গিমায় বাইক থেকে নেমে দাঁড়ায়। অতঃপর হেলমেট খুলে বাইকে রেখে হাত বাড়িয়ে আমিয়ার হাত থেকে টিফিন বক্সটা নিয়ে নেয়। আমিয়ার চেহারায় খুশির ছটা দেখা যায়। তবে শীঘ্রই এই খুশি মিলিয়ে যায় কারণ দূর্জয় তার আনা টিফিন বক্সটা খুবই নির্দয়তার সাথে দূরে ছুড়ে ফেলে। আমিয়ার যত্নে বানানো খাবার মাটিতে গড়াগড়ি খায়।
আমিয়া এই ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই দূর্জয় চেচিয়ে বলে,”ইউ চিপ গার্ল…তুমি ভাবলে কি করে তোমার হাতের রান্না আমি খাবো? নিজেকে কি মনে করো তুমি? আমার কাছে তুমি কেবলমাত্র একটা বেহা*য়া, কানকাটা মেয়ে যে আমার পিছে চিপকে আছে। আর কত অপমান করলে তুমি আমাকে রেহাই দেবে ইয়ার? সেল্ফ রেসপেক্ট বলে তোমার মাঝে কিছু নেই? কই তোমার বান্ধবী রূপকথা তো এমন না। তার সাথে থেকেও কিছু শেখো নি? কি ভেবেছ এভাবে একটা ছেলের পেছনে পড়ে থাকলে..নিজের সম্মান বিসর্জন দিয়ে তার পেছনে বেহায়ার মতো পড়ে থাকলেই মন পাওয়া যায়? এমন ভাবলে তুমি ভুল ভাবছ। আমার তোমার উপর কেবল একটাই অনুভূতি আছে আর সেটা হলো বিরক্তি। তাই ভালো হবে, তুমি আমার আশা বাদ দিয়ে তোমার বাগদত্তার উপর ফোকাস করো।”
বলেই ত্রস্ত পায়ে বিদায় নেয়৷ পেছনে ফেলে রেখে যায় অশ্রুসিক্ত নয়নের এক নারীকে।
এদিকে এত চিৎকার চেচামেচি শুনে সেই স্থানে অনেক জটলা লেগে যায়। অনেক স্টুডেন্টই আমিয়ার এই অপমানের সাক্ষী হয়। এত ভীড়ের মাঝে একজনকে দেখে আমিয়া চমকে ওঠে। শুভ্র এগিয়ে আসে আমিয়ার কাছে। ভীষণ শান্ত গলায় প্রশ্ন করে,”কি হয়েছে এখানে?”
আমিয়া সেই প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে স্থান ত্যাগ করে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
রূপকথা আমিয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। কিছু ব্যাচমেটের মাধ্যমে সে তখনকার ঘটনাটা জানতে পেরেছে। যা তাকে ভীষণ রাগিয়ে দিয়েছে। আমিয়ার মুখোমুখি হয়ে সে আমিয়াকে শাসিয়ে বলে,”তুই কিভাবে এত শিট হলি আমিয়া? কিভাবে এমন একটা কাজ করলি। আমারই তো ঘটনাটা শুনে লজ্জা লাগছে। ভার্সিটির সবাই তোকে নিয়ে হাসছে!”
“আমি পরোয়া করি না।”
আমিয়ার স্পষ্ট জবাব।
রূপকথা বিরক্ত হয়ে বলে,”ঐ দূর্জয়ের মধ্যে এমন কি দেখলি যে ওর পেছনে এভাবে পড়ে আছিস?”
“তুই আহনাফ ভাইয়াকে কি দেখে ভালোবেসেছিলি রূপ? ভালোবাসা কোন কিছু দেখে হয়না,এমনিই হয়ে যায়।”
“এটাকে ভালোবাসা বলে না, আমিয়া। ভালোবাসার অর্থ শুধু আই লাভ ইউ এই শব্দে সীমাবদ্ধ নয়৷ ভালোবাসা অর্থ সম্মান ভালোবাসা অর্থ বিশ্বাস। ভালোবাসায় সম্মান এবং বিশ্বাস থাকা জরুরি। আর তুই সেই ভালোবাসা পাওয়ার জন্য নিজের সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছিস?”
“আমি ভালোবাসি দূর্জয়কে।”
“ভালোবাসার মানে এই নয় যে নিজের আত্মসম্মান ভুলে যাবি।”
“তো কি করব? তো মতো ইগো দেখিয়ে নিজের ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেলব?”
“আমিয়া!”
“আমাকে চোখ রাঙাস না রূপ। তুই মানিস বা না মানিস আহনাফ ভাইয়ের এই অবস্থার জন্য তোর ইগোই দায়ী। এই ইগোর জন্য তুই আহনাফ ভাইকে হারিয়ে ফেলে এখন তড়পাচ্ছিস। কিন্তু আমি ইগোর জন্য নিজের ভালোবাসা হারাব না।”
“আমাদের ব্যাপারটা আলাদা আমিয়া। আহনাফ আমায় ভালোবাসত কিন্তু দূর্জয় তোকে ভালোবাসে না।”
“ভালোবাসে না তো কি? বাসবে। আমি নিশ্চিত দূর্জয় একদিন আমায় ভালোবাসবে।”
“তুই অন্য কারো বাগদত্তা।”
“ভেঙে ফেলবো আমি বিয়ে। দূর্জয় ছাড়া আর কাউকে জীবনে গ্রহণ করবো না।”
বলেই গটগট পায়ে স্থান ত্যাগ করে। রূপকথা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”ভুল পথে পা বাড়াচ্ছিস তুই আমিয়া..এর ফল ভালো হবে না। দূর্জয়ের প্রতি এই ভালোবাসাই না তোর কাল হয়ে দাঁড়ায়…জ্বলে পুড়ে অঙ্গার করে দেয় তোকে!”
to be continue…..