ঝলসে যাব জানি পর্ব-১৮

0
191

#ঝলসে_যাব_জানি
#Part_18
#ইয়াসমিন_খন্দকার

দূর্জয়কে ধাক্কা দিতে গিয়ে রূপকথার হাত থমকে যায়। সে পাহাড়ের উপরেই বসে পড়ে। আহাজারি করে কাঁদতে আরম্ভ করে দেয়। দূর্জয়ও রূপকথার পাশে বসে তার কাধে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দিতে চায়। কিন্তু রূপকথা দূর্জয়ের হাত ছিটকে ফেলে বলে,”স্পর্শ করবেন না আমায়। আমি ঘৃণা করি আপনাকে। আমার জীবনের সব ট্রাজেডির জন্য আপনি দায়ী।”

দূর্জয় নিজের হাত গুটিয়ে নিয়ে বলে,”আমাকে তুমি ঘৃণা করতেই পারো। কিন্তু এই মুহুর্তে তোমাকে আমার সাথেই যেতে হবে। রাত হয়ে আসছে। এই স্থানটা আর নিরাপদ নয়। এইসকল এলাকায় অনেক দুবৃত্তরা ঘুরে বেড়ায়। তারা জান কিংবা সম্মান কেড়ে নিতে ওত পেতে থাকে। তাই এখন তোমাকে আমার সাথেই ফিরতে হবে।”

রূপকথা কপট রাগ দেখিয়ে বলে,”আমি আপনার সাথে কোথাও যাবো না।”

দূর্জয়ের মাথাতেও জেদ চেপে যায়। তাই সে বলে,”তুমি যদি ভালোয় ভালোয় না যাও তাহলে আমি অন্য পন্থা অবলম্বন করব।”

“অন্য পন্থা মানে?!”

দূর্জয় বাঁকা হাসে। রূপকথা দূর্জয়ের প্রবৃত্তি অনুধাবন করতে পেরে বলে,”খবরদার আমাকে স্পর্শ করবে না। আমার থেকে দূরত্ব মেইনটেইন করে চলো। আমি যাচ্ছি।”

বলেই রূপকথা উঠে দাঁড়িয়ে হাটতে শুরু করে। দূর্জয় তার পিছু পিছু যেতে থাকে।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আজ শুভ্র ও আমিয়ার বৌভাত। স্বাভাবিক ভাবেই আমিয়ার মন এখনো বিক্ষিপ্ত। এই বিয়ে, এই সম্পর্কের প্রতি এখনো সে উদাসীন৷ সে মেনে নিতে পারছে না সম্পর্কের এই পরিণতি। তবুও মেনে নেয়ার চেষ্টায় রত। আমিয়া এই কথাতে বিশ্বাস করে, একবার যখন শুভ্রর সাথে তার বিয়ে হয়েছে তখন শুভ্রর সাথেই তার সংসার করতে হবে। আজ হোক বা কাল তাকে শুভ্রকে স্বামীর অধিকার দিতেই হবে। তাই আমিয়াও চেষ্টা করছে যাতে এই সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করতে পারে।

আমিয়ার এসব ভাবনার মাঝেই শুভ্রর বড় ভাবি অদিতি এসে তাকে দেখে হাসি মুখে বলে,”বৌভাতের আয়োজন কমপ্লিট। সব অতিথিরাও আসতে শুরু করে দিয়েছে। মা তোমাকে সাজিয়ে দিতে বলেছেন। চলো, আমি তোমাকে সাজিয়ে দেই।”

আমিয়া মেকি হেসে উঠে বসে অদিতির সাথে যেতে থাকে। অদিতি যেতে যেতে আমিয়ার সাথে অনেক আলাপ করে। যাতে করে আমিয়াও ধীরে ধীরে একটু করে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।

আমিয়াকে নিজের কক্ষে নিয়ে গিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয় অদিতি। সাজানো শেষ হতেই স্মিত হেসে বলে,”তোমাকে আজ যা সুন্দর লাগছে না, বলে বোঝাতে পারব না। শুভ্র তো আজ তোমার থেকে দৃষ্টিই সরাতে পারবে না।”

আমিয়া তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। এরমাঝে ঘরের দরজায় কেউ কড়া নাড়ে। অদিতি গিয়ে দরজা খুলতেই শুভ্রকে দেখতে পায়। শুভ্র বলে ওঠে,”আমিয়ার সাজ কি কমপ্লিট? মা আমাকে ওকে সাথে করে নিচে নিয়ে যেতে বলল।”

অদিতি হেসে বলে,”হ্যাঁ, কমপ্লিট। তুমি নিজেই নিজের বউকে একবার দেখো। দেখবে আর চোখই ফেরাতে পারবে না।”

বলেই অদিতি আমিয়াকে নিয়ে এসে শুভ্রর সামনে দাড় করায়। শুভ্র আমিয়াকে দেখে বিমোহিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। শাড়ি এবং গহনায় সজ্জিত আমিয়ার রূপ যেন আজ আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। শুভ্রর ইচ্ছে করছে জীবনভর এভাবে আমিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে। এদিকে আমিয়া দৃষ্টি নত করে আছে। অদিতি অনেকক্ষণ শুভ্রকে আমিয়ার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হালকা কেশে বলে,”এভাবে তাকিয়ে থাকার অনেক সময় পাবে দেবরজি। এখন আপাতত তোমার স্ত্রীকে নিয়ে নিচে যাও।”

অদিতির কথায় শুভ্রর হুশ ফেরে। নিজের কাজে নিজেই লজ্জায় পড়ে যায়। আমিয়ার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে সেও বেশ লজ্জায় পড়ে গেছে। তাই সে আর এই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে বেশিক্ষণ থাকতে চাইল না। আমিয়ার উদ্দ্যেশ্যে বলল,”এসো আমার সাথে।”

আমিয়া শুভ্রর সাথে যেতে লাগল। সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই শুভ্র আমিয়ার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,”তোমাকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে।”

আমিয়া হালকা হাসলো। শুভ্র আবারো ব্যকুল কন্ঠে বলল,”আমি যদি আজ তোমার কাছে একটা অনুমতি চাই তো দিবে আমায়?”

“কিসের অনুমতি?”

“তোমার কপালে প্রেমের পরশ একে দেওয়ার?!”

আমিয়ার পুরো শরীরে যেন তড়িৎ খেলে গেল। সে কোন প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করতে পারল না। শুভ্র বলল,”তোমার এই নীরবতাকেই তাহলে সম্মতি ধরে নিলাম।”

কথাটা বলেই আমিয়ার কপালে প্রেমের পরশ একে দিলো। আমিয়া পুরো সময়টা চোখ বন্ধ করে রাখলো। তার চোখের সামনে দূর্জয়ের মুখশ্রী ভেসে উঠলো। অদ্ভুত ভাবে ধীরে ধীরে সেই প্রতিচ্ছবি মিশে যেতে লাগল এবং একসময় শুভ্রর প্রতিচ্ছবি ধরা দিলো। আমিয়া চোখ খুলেই শুভ্রকে দেখতে পেল। অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,”আমার ভবিতব্য এখন এটাই!”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
রূপকথা ও দূর্জয় এখন যেই এলাকা দিয়ে হেটে চলেছে সেটা সম্পূর্ণ জঙ্গলে ঘেরা। দূর্জয় রূপকথাকে সাবধানে পা ফেলতে বলছে কারণ এই জঙ্গলে প্রতি পদে পদে বিপদ লুকিয়ে থাকতে পারে। রূপকথা অবশ্য দূর্জয়ের কথাকে এতটা গ্রাহ্য করছে না। সে নিজের মতোই হেটে চলেছে। এই স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের খেসারত দিতে হলো তাকে। পায়ে কিছু একটার সাথে আঘাত খেয়ে পড়ে যেতে নিলো৷ তখনই দূর্জয় তাকে আগলে নিয়ে বলল,”বললাম না, সাবধানে চলতে।”

এরইমধ্যে তারা দুজনেই কারো পায়ের শব্দ শুনতে পেল। দুজনেই অবাক হয়ে গেলো। কারা আসছে এখানে!

ঝোপের আড়াল থেকে কয়েকজন উপজাতি মানুষ বেরিয়ে আসে। দূর্জয় ও রূপকথাকে এই অবস্থায় দেখে তারা অবাক হয়ে যায়। রূপকথা শরীরে বাপ্পীর করা আঁচড়ের দাগ তখনো স্পষ্ট। সাথে তার সালোয়ারের ছেড়া অংশও সবার দৃষ্টিগোচর হয়। সবাই নিজেদের মনের মতো কাহিনি বানিয়ে নেয়।

এদিকে দূর্জয় ও রূপকথা তাদের ভাবগতিক বোঝার চেষ্টা করে। উপজাতির লোকেরা নিজেদের মধ্যে নিজেদের ভাষায় কথা বলতে থাকে। অতঃপর তাদের মধ্যেই একজন লোক এগিয়ে আসে দূর্জয় ও রূপকথার দিকে। লোকটা আধো আধো বাংলায় বলল,”তোমরা আমাদের সাথে আমাদের সর্দায়ের ডেরায় চলো।”

দূর্জয় বলে,”আমরা কেন যাব ওখানে?!”

লোকটা বলে,”যদি নিজেদের ভালো চাও তো চলো। নাহলে এখানে যারা আসে তারা সবাই কিন্তু তোমাদের উপর ক্ষেপে আছে। তোমাদের অনৈতিক কাজের জন্য সবাই রুষ্ট। এই জঙ্গলের মাঝেই আমাদের কাবিলা। সবাই মিলে যদি তোমাদের উপর হামলা চালায় সেটা কিন্তু ভালো হবে না।”

“এসব কি ফালতু কথা বলছেন!”

রূপকথা ভয় পেয়ে যায় এসব শুনে। এসব লোকেরা না জানি তাদের ব্যাপারে কি ভাবছে। সে এটাও বুঝতে পারে দূর্জয় স্বভাবচারিত ভাবেই নিজের মারকুটে স্বভাব বজায় রাখবে যেটা তাদের জন্য ভালো হবে না৷ কারণ এতগুলো লোকের সাথে তারা একা পেড়ে উঠবে না। তাছাড়া এসব লোকের কাছে বর্শা ও তীর ধনুক জাতীয় অনেক অস্ত্র আছে। তাই এদের মোকাবিলা করাও সহজ হবে না। এজন্য সে দূর্জয়ের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”ওরা যা বলছে তাই করা উচিৎ আমাদের। নাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে।”

দূর্জয়ও ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পেরে সায় জানায়।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
উপজাতির কাবিলায় রূপকথা ও দূর্জয়ের বিচারসভা বসেছে তাদের সর্দারের মর্জিতে। সর্দার তাদের নিয়ে আসা ব্যক্তিদের বয়ান শুনে এবং রূপকথার দিকে ভালো ভাবে খেয়াল করে অনুধাবন করে তারা কোন অনৈতিক কাজ করতে এখানে এসেছিল। সর্দার বাংলায় কথা বলতে জানে। তাই সে রূপকথা ও দূর্জয়ের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আমরা সবাই শতভাগ নিশ্চিত তোমরা এখানে কোন অনৈতিক কাজ করতে এসেছিলে। এর আগেও আমাদের কাবিলার আশেপাশে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। এই তো কয়েক মাস আগেই একটা মেয়েকে কেউ ধ** করে এখানে মে**রে রেখে দিয়ে যায়। আর পুলিশ এসে আমাদের কাবিলার নিরীহ মানুষদের ধরে নিয়ে যায় সন্দেহের বশে। এখনো সেই কেস চলছে। তাই আমরা কেউ আর এসব ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নই।”

দূর্জয় বলে,”আপনারা ভুল বুঝছেন। এমন কিছুই না..আসল ব্যাপারটা হচ্ছে..”

সর্দার বলেন,”তোমাদের কোন অযুহাত আমি শুনতে চাই না। তোমাদের সামনে দুটো উপায় রাখছি..হয় তোমরা দুজনে নিজেদের ধর্মমতে এখানে বিয়ে করে নাও আর নাহলে তোমাদের দুজনকেই আমাদের কাবিলার নিয়ম অনুসারে অনৈতিক কার্যক্রম করার অপরাধে পু**য়ে মারা হবে।”

দূর্জয় ও রূপকথা দুজনেই হতবাক হয়ে যায়৷ রূপকথা বলে ওঠে,”বিশ্বাস করুন আমাদের। এত কঠিন শাস্তি দেবেন না।”

“সিদ্ধান্ত তোমাদের হাতে।”

রূপকথা বলে,”ঠিক আছে..যদি এমনই হয় তো আমায় পু*ড়িয়ে মারুন। তবুও আমি এই লোকটাকে বিয়ে করব না।”

to be continue…..