এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-২৮+২৯+৩০

0
338

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৮.

আরো ছয়টা দিন পেরিয়ে গিয়েছে। এই নিরাপত্তার বেড়াজালে আবদ্ধ বাড়িটায় বাণীর প্রায়ই দমবন্ধ অনুভব হয়। নিজের মেয়েকে ছাড়া প্রতিটা মুহুর্ত তার ছটফট করে পাড় হয়। তার খুব ইচ্ছে নিজের মেয়েকে নিয়ে এই শহরটা ছেড়ে দূরে চলে যাওয়ার। কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না একটা মানুষের জন্য কেবল। শাহরিয়ার দূর্জয়।

দূর্জয় সেদিন রাতে এই বাড়ি থেকে প্রস্থান করার পর আর এই বাড়ির মুখো হয় নি। প্রথমে বাণীর এ নিয়ে খুব অস্বস্তি কাজ করছিলো। কিন্তু ইলিয়াস কাঞ্চন নামক লোকটার মাধ্যমে দূর্জয় একদিন কলে তার সঙ্গে কথা বলেছিলো। সেই কথোপকথনে দূর্জয় জানায় যে, সে খুব জরুরী একটা কাজে আটকে আছে। ব্যস্ততাটা কিছুটা কমলেই সে আসবে। বাণী যেনো ধৈর্য্য ধরে কেবল অপেক্ষা করে। নিজে যেনো ভুল করেও দূর্জয়ের কথার বাইরে গিয়ে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বহ্নিকে উদ্ধারের চেষ্টা না করে। দূর্জয়ের উপরে আস্থা রেখে যেনো একটু স্থির থাকে।

বাণী দূর্জয়ের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা পায় না। সে নিজেও ভালো করে জানে, কোনো ধরনের সাহায্য ব্যতীত বহ্নিকে ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার করা একপ্রকার অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু মায়ের মন এতো যুক্তি মানতে চায় না। ইচ্ছে হয় ছুটে নিজের মেয়ের কাছে চলে যেতে।

এই কয়েক দিনে আরেকটা ব্যাপারে বাণী না চাইতেও খুব আগ্রহ অনুভব করে। তা হলো এই বাড়ির লক করা বেডরুমটা। কেনো যেনো তার মনে হয় ওই বেডরুমের ভিতরে দূর্জয় খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু লুকিয়ে রেখেছে। অবশ্য তা অবাক করার মতো বিষয় নয়। দূর্জয়ের পেশা অনুযায়ী এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। তবুও কেনো জানি ঘুরে ফিরে বাণীর ওই রুমটা একদফা ঘুরে দেখার খুব ইচ্ছে জাগে। কিন্তু পরমুহূর্তেই সে নিজেকে এ বলে শাসায় যে, দূর্জয় তাকে সাহায্য করে কেবল এখানে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। অনেকটা শরনার্থীর ন্যায়। এই সামান্য সাহায্যের মানে এই নয় যে দূর্জয় তাকে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি আগ্রহ দেখানোর এক্সেসও দিয়েছে।

ইউটিউবে বিবিসি নিউজের একটা ইংরেজি প্রতিবেদন দেখতে দেখতে এসব আকাশ কুসুম ভাবনায় মশগুল ছিলো বাণী। আচমকা গুলি বর্ষণের তীক্ষ্ণ শব্দে তার ভাবনার জগতে ভাটা পড়ে। ভীত দৃষ্টি মেলে সে টিভির স্ক্রিনের পানে তাকায়। রঙিন পর্দায় দেখাচ্ছে চট্টগ্রামের সেই ভয়ংকর টেরোরিস্ট অ্যাটাকের ঝলক। কলেজ ভবনের থেকে দূরে রাস্তায় সাংবাদিকদের উপচে পড়া ভীড়। দূর হতে কলেজ ভবনের ভিতর থেকে ভেসে আসছে গুলি বর্ষণের শব্দ।

বাণী ভীত দৃষ্টি মেলে দেখে ভয়ংকর সেই দৃশ্য। দূর্জয় কিছুদিন পূর্বে এই বাড়ির টিভিটায় ওয়াই-ফাই সংযোগের ব্যবস্থা করতে একজন লোককে পাঠিয়েছিলো। হয়তো বাণীর একাকিত্ব ঘোচানোর জন্য নতুবা বাণীর সময় কাটানোর জন্য। ওয়াই-ফাই সংযোগ দিয়ে যাওয়ার পর থেকে বাণী বহি বিশ্বের বিভিন্ন ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে ডকুমেন্টারি দেখে যাচ্ছে একের পর এক। আজ কতগুলো বছর ধরে সে বাহিরের পৃথিবী সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। সে তো ভেবেছিলো হিরণের ওই চার দেয়ালে ঘেরা প্রাসাদের ভেতরটাই কেবল ভয়ংকর। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছে বাহিরের দুনিয়াটাও ভালো নেই। কেমন একটা অসুস্থ পরিবেশ চারপাশ ঘিরে। মানুষ রূপী একদল জানোয়ার পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। যারা কিনা নিরপরাধ মানুষদের উপর অমানবিক ভাবে গণ হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। আর এই জানোয়ার গুলো এতোটা শক্তিশালী রূপ ধারণ করেছে যে এখন কেউই এদের দমাতে পারছি না। বাণী জানে না এই পরিস্থিতির শেষ কোথায়। কিন্তু সে মনে মনে দোয়া করে যেনো পৃথিবীটা সুস্থ হয়। এই গোলাগুলি যেনো শেষ হয়, নিরপরাধ মানুষ এবং নিষ্পাপ শিশুরা যেনো মুক্তি পায়।

__________

ব্যক্তিগত একটা ফোন পেতেই প্রত্যয় যতদ্রুত সম্ভব চট্টগ্রামের নামি-দামি একটা কফিশপে এসে উপস্থিত হয়। মুখভঙ্গি তার এজ ইউজুয়াল তেতো রকমের। টেবিলের অপরপ্রান্তে বসে থাকা মধ্য বয়সের দুই ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা সতর্ক দৃষ্টি মেলে দেখে প্রত্যয়কে। বোঝার চেষ্টা করছে ছেলে রেগে আছে নাকি না। প্রত্যয় সেই দৃষ্টি উপেক্ষা ভদ্রমহিলার উদ্দেশ্যে সরাসরি বলে,

“ তোমরা উইদাউট এনি নোটিশ হঠাৎ চট্টগ্রাম এসেছো কি আমার চেহারা খুটিয়ে দেখতে? “

ভদ্রমহিলা নরম গলায় প্রতুত্তর করে,

“ তিনমাস ধরে তুমি বাড়ি আসো না। আমাদের কি ইচ্ছে করে না তোমাকে একটু দেখার? “

প্রত্যয় টেবিলের উপর থাকা গরম কফি কাপটার পাশে হাত ছুঁইয়ে উত্তর দেয়,

“ ভিডিও কলে তো দেখোই। “

এবার ভদ্রলোক সামান্য কেশে বলে উঠে,

“ শুনলাম তুমি নাকি আগামীকাল দেশের বাহিরে যাচ্ছো। “

প্রত্যয়ের ভ্রু এবার কুচকে আসে। সে বলে,

“ তুমি আমার পিছনে কি গোয়েন্দা লাগিয়েছো? “

ভদ্রলোক প্রত্যয়ের মতোই মুখ কালো করে জবাব দেয়,

“ তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো তোমার পেশার উপরের পদের বেশ কিছু জনের সঙ্গে আমার ভালোই সখ্যতা রয়েছে। তুমি আমাকে নিজের জীবনের ব্যাপারে কিছু জানাবে না দেখে যে, আমি কিছু জানতে পারবো না সেটা তোমার ভুল ধারণা। “

প্রত্যয় এবার গরম কফির মগে একটা চুমুক দিয়ে বলে,

“ চট্টগ্রাম যেহেতু এসেছোই, আম্মুকে নিয়ে তাহলে কক্সবাজার ঘুরে যেও কিছুদিন। যান্ত্রিক কোলাহলমুক্ত সমুদ্রের বিশুদ্ধ হাওয়ায় প্রশান্তি খুঁজে পাবে। “

ছেলের এমন আউট অফ টপিক জবাবে মতিউর আরাফাত খুব বিরক্ত হয়। তিনি রাগ সংবরণ করে ফিসফিসিয়ে শুধায়,

“ তুমি ফিলিস্তিন যাচ্ছো ত্রাণ বিতরণ করতে। মাথা ঠিক আছে তোমার? “

প্রত্যয় সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশে তাকায় সতর্ক দৃষ্টিতে। পরখ করে কেউ তাদের কথা শুনলো কিনা। নিশ্চিত হয়ে নিচু গলায় জবাব দেয়,

“ এই বিষয়ে এখানে আমি কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না। আর আমি যাবো এটা ফাইনাল। “

মতিউর আরাফাত স্ত্রী ফিজার উদ্দেশ্যে বলে,

“ তোমার ছেলের মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছে ফিজা। ওকে বুঝাও। “

স্বামীর কথা শুনতেই ফিজা উঠে এসে ছেলের পাশের চেয়ারটায় বসে। ছেলের দুইহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে উঠে,

“ বাবা সময় আছে। তুমি মানা করে দাও। তোমার বাবা ব্যবস্থা করে নিবে একটা। তোমার জায়গায় যেনো অন্য কাউকে পাঠানো হয় সেই ব্যাপারে কথা বলবে। “

প্রত্যয় নিজের মায়ের সেন্টিমেন্ট উপলব্ধি করে। তবুও সে নরম হয় না। বরং কাটকাট গলায় জবাব দেয়,

“ সরি আম্মু। তোমার এই আবদারটা রাখতে পারলাম না। “

মতিউর আরাফাত এবার রেগে বলে উঠে,

“ তুমি জানো কোথায় যাচ্ছো তুমি? একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে। ওইখানে লাইফের কি গ্যারান্টি আছে? নিজের ভাইয়ের পথে হাঁটা বন্ধ করো। এসব দেশপ্রেম ওকে কি দিয়েছিলো মনে আছে? যুদ্ধের ময়দানে মরেছে। আর যাদের নিজের ভাই ভেবেছিলো তারা কি করেছে তোমার ভাইয়ের সাথে? তারা নিজেদের বাঁচাতে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছে। তোমার ভাইয়ের লাশটাও শত্রুর ঘাটি থেকে নিয়ে ফিরে নি। তুমিও একই পরিণতি চাও? “

প্রত্যয় শুনে সবটা। পাশে বসা নিজের মায়ের নীরব অশ্রু সে টের পায়। কিন্তু মা’য়ের চোখের জল না মুছে সে নিজের আব্বুর দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বলে,

“ যুদ্ধের ময়দানে কেউ মরে না আব্বু। শহীদ হয়। ভাইয়া ইজ এ মার্টার। “

কথাটুকু বলেই প্রত্যয় উঠে দাঁড়ায় প্রস্থানের উদ্দেশ্যে। যাওয়ার আগে ফের বলে,

“ আর ছোটবেলায় তোমরাই সবসময় বলতে বড় ভাইয়ার থেকে যেনো ভালো কিছু শিখে সেই অনুসারে লাইফ লিড করি। এখন যখন ভাইয়ার পথ অনুসরণ করে ভালো কিছু করছি তখন তোমাদের এতো সমস্যা হচ্ছে কেনো? “

উত্তরের অপেক্ষায় আর দাঁড়ায় না প্রত্যয়। সেখান থেকে প্রস্থান করে। মতিউর আরাফাত স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে,

“ এক ছেলের জানাজা পড়েছি ফিজা। নিজের জীবন দশায় আরেক ছেলের জানাজা পড়ার মতো সাহস আমার নেই। ওকে এই পথ থেকে ফেরানোর জন্য যা যা প্রয়োজন হয় আমি করবো। ওকে বুঝতে হবে ওর কিছু হলে এই দেশের কিছু যায় আসবে না। কিন্তু ওর পরিবার শেষ হয়ে যাবে। “

“ কি করবেন আপনি? “

“ পুরুষ মানুষকে ঘর মুখো করার ক্ষমতা আল্লাহ শুধু নারীদের দিয়েছে। “

ক্ষীণ ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে ফিজা চুপ হয়ে যান। উনি আর এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামান না। উনি শুধু নিজের ছেলের জীবিত ফিরে আসাটুকুই কামনা করেন।

__________

পড়ন্ত সন্ধ্যায় দরজার কলিংবেল চেপে দাঁড়িয়ে আছে দূর্জয়। মিনিট গড়ানোর আগেই ভেতর থেকে দরজা খুলে দেয় শাড়ি পরিহিতা এক রুগ্ন নারী। দূর্জয় একপলক তাকে দেখে চোখ নামিয়ে ফেলে। বহুবছর পূর্বে দেখা এক টমবয়কে এতো বছর পর এই বাঙালী নারী রূপে দেখে সে প্রায়ই অজানা কারণে অস্বস্তি অনুভব করে। বাণীও দূর্জয়কে দেখে চোখ নামিয়ে নেয়। সেদিন রাতের পর আজ তাদের প্রথম দেখা। অস্বস্তি বাণীও অনুভব করছে। তার ব্যাপারে আর কোনো কিছুই এই মানুষটার অজানা নয় ভেবেই সেই অস্বস্তি কাজ করছে।

নীরবতার পালা ভেঙে দূর্জয় বলে,

“ সারাদিন বাড়ির ভেতরই থাকো? উঠোনে বের হও না? “

বাণী কেবল মাথা নেড়ে না জানায়। দূর্জয় গলা ঝাড়ি দিয়ে বলে,

“ ভেতরে আসবো না। বাহিরে বের হও। উঠোনে হাঁটতে হাঁটতে কথা হবে। “

বাণী আর কথা বাড়ায় না। শাড়ির আঁচলটা টেনে অপর পাশের কাধে চেপে দূর্জয়ের পিছু পিছু বের হয়। উঠোনের একপাশে ইলিয়াস কাঞ্চন সহ আরেকজন টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের এদিকে কোনো ধ্যানই নেই। দূর্জয় হাঁটতে হাঁটতে বলে উঠে,

“ তোমার বাবা আই মিন আনিসুজ্জামান তালুকদার বর্তমানে কি অবস্থায় আছে সেই সম্পর্কে কোনো আইডিয়া আছে? “

“ উনার ব্যাপারে কিছু জানতে আমি আগ্রহী নই। “

দৃঢ় গলায় কথাটুকু বলে বাণী। দূর্জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ আনিসুজ্জামান তালুকদার ছয় বছর আগে মারা গিয়েছে বাণী। হি ইজ নো মোর। “

বাণী চকিতে দূর্জয়ের পানে তাকায়। অবাক সে। তবে দুঃখ অনুভব করছে না বিন্দু পরিমাণ। সে মাথা নত করে বলে,

“ ওহ। “

“ জানতে চাইবে না কিভাবে মারা গেলো? “

“ উনি কখনো জানতে চেয়েছিলেন একটা আগুন্তকঃ লোকের বাড়িতে আমি কিভাবে বেঁচে আছি? “

বাণীর চাপা ক্ষোভ তার কণ্ঠে স্পষ্ট ফুটে উঠে। দূর্জয় নিজেই বলে উঠে,

“ তোমাদের বাড়িতে ডাকাত হামলা হয়েছিলো। ডাকাতেরা কয়েক কোপে উনাকে খুন করেছেন। “

বাণী আগ্রহ পায় না এই ব্যাপারে কিছু না শোনার। লোকটাকে সে চরম ঘৃণা করে। সেই ঘৃণার মাঝে মায়ার কোনো স্থান নেই। এরকম নিকৃষ্ট একটা লোক পৃথিবী থেকে চলে গেলে পৃথিবীর নিশ্চয়ই খুব বড়ো কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে না?

দূর্জয় এবার হাঁটা থামিয়ে বাণীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,

“ আমার মনে হয় খুনটার সাথে হিরণ জড়িত। যেনো আর কেউ তোমার ভাইয়ের মতো আনিসুজ্জামানকে ফলো করে তোমার পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারে। “

বাণী এতে অবাক হয় না। হিরণের জন্য এটা অসম্ভব বিষয় নয়। সে এসব কথা বাদ দিয়ে সরাসরি বলে,

“ আই ডোন্ট কেয়ার এবাউট দেম দূর্জয়। আই অনলি কেয়ার এবাউট মাই ডটার। আজকে এক সপ্তাহ পেরিয়ে গিয়েছে ও আমাকে ছাড়া থাকছে। ও এখনো অনেক ছোট। শি নিডস মি। “

দূর্জয় বুঝতে পারে বাণী আনিসুজ্জামান তালুকদার কিংবা হিরণ কারো ব্যাপারেই কথা বলতে আগ্রহী নয়। তাই সে বলে,

“ ট্রাস্ট মি। খুব দ্রুতই বহ্নি তোমার কাছে থাকবে। “

তাদের অগোচরে উঠোন সীমানার বাহিরে ঝোপঝাড়ের আড়াল হতে একজোড়া চোখ তাদের ভালো করে দেখে নেয়। খুবই সাবধানে নিজের ফোনে নিঃশব্দে ধারণ করে তাদের ছবি। মুখে লেপ্টে থাকা ক্রুর হাসিটা দীর্ঘায়িত করে সে ফের তাকায় দূর্জয় ও বাণীর পানে।

__________

ফোনে একটা ম্যাসেজ পেতেই অন্যা দ্রুত ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে নিঃশব্দে পা টিপে টিপে রুম ছেড়ে বের হয়। রাত সাড়ে বারোটার এসময় তার বাড়ির প্রত্যেকেই গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। তবুও সবাই ঘুমিয়েছে কিনা নিশ্চিত হয়ে সে বিড়ালের মতো কদম ফেলে ঘর ছেড়ে বের হয়। অত:পর দ্রুত বাড়ির বাহিরে রাস্তায় বের হতেই দেখে একটা বাইক নিয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে আছে রাফি। কেবল রাফি একা হলে অন্যা এই মুহুর্তেই ছুটে গিয়ে তার বুকে আছড়ে পড়তো। কিন্তু রাফির সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা সাইফ এবং প্রত্যয়কে দেখে সে নিজের সেই ইচ্ছায় বালিচাপা দিয়ে শান্ত পায়ে হেঁটে এগিয়ে যায়। সাইফ অন্যাকে দেখেই একগাল হেসে বলে,

“ আসসালামু আলাইকুম ভাবী৷ “

অন্যাও সামান্য হেসে সালামের জবাব দেয়। প্রত্যয় অবশ্য এতো ফর্মালিটিস না করে হেসে বলে,

“ হাই অন্যা। “

সাইফ সঙ্গে সঙ্গে বাগড়া দিয়ে বলে,

“ শালা ভাইয়ের বউকে ভাবী বলে। এতটুকু কমন সেন্স নাই? “

প্রত্যয় ভ্রু কুচকে বলে,

“ এখনো রাফির বউ তো হয় নি। “

“ এনগেজমেন্ট তো হইসে। মানে ফিফটি পার্সেন্ট বউ অলরেডি হয়ে গেসে। বাকি ফিফটি পার্সেন্ট কবুল বললেই হয়ে যাবে। “

সাইফের যুক্তির পিঠে প্রত্যয় আর কিছু বলে না। এই ছেলেকে একটা কিছু বললে সে এটার পিঠে দশটা যুক্তি হাজির করে দিবে। রাফি বন্ধুদের দিকে আহত দৃষ্টি মেলে কিছু একটা ইশারা করে। সাইফ এবং প্রত্যয় সেই ইশারা দেখে বেশ মজা পায়। বেচারাকে কি অসহায় দেখাচ্ছে! সাইফ শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে বলে,

“ আজকে প্রত্যয় গার্ড দিবি। অন্যার হিটলার বাপকে দেখলেই সাথে সাথে সিগনাল দিবি। “

নিজের আব্বুকে এরকম হিটলার ডাকায় অন্যা সামান্য মুখ লটকে বলে,

“ ভাইয়া পৃথিবীর সব প্রেমিকার বাপই হিটলার হয়। বিশ্বাস না হলে একটা প্রেম করে দেখুন। প্রেমিকার সঙ্গে হিটলার শশুর বাই ওয়ান গেট ওয়ান অফারের মতো পেয়ে যাবেন। “

__________

সাইফ আর প্রত্যয় দু’জন দু’দিকে পাহারা দেওয়ার জন্য প্রস্থান করতেই অন্যা মুখ কালো করে প্রশ্ন করে,

“ কবে নাগাদ ফিরবে তুমি? “

“ জলদিই ফিরবো। “

অন্যা আর কোনো কথা বলে না। মুখ কালো করে রাফির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার রাফির এই ফিলিস্তিনে যাওয়ার বিষয়টা মোটেও ভালো লাগছে না। কিন্তু কিছু করার নেই তার। রাফির পেশাকে সে সম্মান করে। সে এই বিষয়টা মাথায় রেখেই সম্পর্কে জড়িয়েছিলো যে, রাফির কাছে সবসময় তার চাকরিই ফার্স্ট প্রায়োরিটি থাকবে। রাফির কাছে যেমন তার জব ফার্স্ট প্রায়োরিটি, তেমনই অন্যার কাছে রাফি তার ফার্স্ট প্রায়োরিটি।

রাফি এক মুহুর্ত অন্যার মলিন মুখ দেখে হেসে বলে,

“ মলিন মুখে বিদায় জানাবে? “

অন্যা আর অপেক্ষা না করে এবার ধীরে সুস্থে রাফিকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“ দ্রুত ফিরবে। অপেক্ষায় থাকবো। “

__________

“ ভাইয়া, আজ এখনও জেগে? “

ম্যাসেজটা পেতেই সাইফের আচমকা মেজাজ একই সঙ্গে ফুরফুরে এবং গরম হয়ে যায়। দিন দিন এই মেয়ের ভাইয়া ডাকটা বেড়েই চলেছে। আর অপরদিকে এই গা জ্বলানো ডাক শুনে সাইফের মেজাজ থার্মোমিটারের পারদের মতো বেড়ে যায়। তবুও সে ভদ্র ভঙ্গিতে টাইপ করে জবাব দেয়,

“ জ্বি মিস ইয়াসমিন। একটা কাজে এলাম। “

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিশা জবাব দেয়,

“ আপনারা এডাল্টরা বেশ অদ্ভুৎ। রাত বিরাতেও আপনাদের কাজ থাকে। অথচ এটা ঘুমানোর সময়। “

ম্যাসেজটা পড়ে সাইফের ভ্রু কুচকে আসে। সে অন্যাদের বাসার গলির মশার কামড় খেতে খেতে লিখে পাঠায়,

“ আপনার বয়স কতো? “

“ ব্যাড ম্যানার্স ভাইয়া। মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করা উচিত না। ডোন্ট ইউ নো দ্যাট? “

সাইফ চোখ সরু করে ম্যাসেজটা কয়েকবার পড়ে। এখন এই ভীতু মেয়ে তাকে ম্যানার্স শিখাবে? সাইফ ম্যানার্স শিখতে মোটেও ইচ্ছুক নয়। তাই সে লিখে,

“ ঘুমান মিস ইয়াসমিন। গুড নাইট। “

নিশা ম্যাসেজটা পড়ে অবাক হয়। হুট করে কথার মধ্যপথে বিদায় নেওয়া কি এই লোকের স্বভাব? এই স্বভাবটা মোটেও পছন্দ নয় নিশার। সে বিড়বিড়িয়ে বলে,

“ এগেইন ব্যাড ম্যানার্স। “

নিশা ফোন রেখে মন খারাপ করে শুয়ে রয়। অদ্ভুত বদভ্যাস হয়েছে তার। এই অতি ব্যস্ত ম্যানারলেস লোকটার সঙ্গে কথা বলতে কেনো যেনো তার ভালো লাগছে তার হঠাৎ করে। হয়তো একাকিত্বের জন্য। আম্মু নেই। আব্বুও প্রায় সারাদিন বাহিরেই কাটায়। রুহী নেই। এমন অবস্থায় তার অবচেতন মন কথা বলার জন্য একজন সঙ্গী খুঁজলেই সে এই সাপ বিচ্ছু প্রেমী লোকটাকে ম্যাসেজ দেয়। লোকটা দু চারটা অদ্ভুৎ কথা বলে কথার মাঝখানেই সবসময় উধাও হয়ে যায়।

__________

এক রুমের আলিশান হোটেল রুমটা অন্ধকারে ছেয়ে আছে। সেই অন্ধকারের মাঝেই ল্যাপটপের স্ক্রিনটা রুমটাকে মৃদু আলোকিত করার প্রচেষ্টায় মত্ত। বিছানার হেডসাইডে হেলান দিয়ে বসে কি বোর্ডে দ্রুত ভঙ্গিতে হাত চালাচ্ছে এক রমণী। গভীর মনযোগ তার ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে নিবদ্ধ। আচমকা ফোনের রিংটোনের শব্দে তার মনযোগ ভঙ্গ হয়। ফোনটা হাতে নিতেই দেখে একটা ফরেন নাম্বার থেকে ইনকামিং কল। রমণী অপেক্ষা না করে কল রিসিভ করে এরাবিক ভাষায় বলে উঠে,

“ হ্যালো স্যার। “

ফোনের অপর পাশ থেকে একটা পুরুষালী স্বর একই ভাষায় বলে উঠে,

“ মিস দৃশান নামরা। নতুন কোনো আপডেট? “

“ আ’ম স্টিল ওয়ার্কিং অন ইট স্যার। “

“ এতো সময় আপনাকে দেওয়া সম্ভব নয় দৃশান। বিষয়টা মাথায় রাখবেন। যত দ্রুত সম্ভব ওই র‍্যাস্কেলকে খুঁজে বের করে সঙ্গে নিয়ে নিজের মাতৃভূমিতে ফিরুন। “

“ স্যার আই’ল বি ব্যাক সুন। “

ফোনটা রাখতেই সেই নারী জ্বলজ্বল দৃষ্টি মেলে ল্যাপটপের স্ক্রিনের পানে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে একটা আর্টিকেল তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। ইয়েমেনে আরো একটা টেরোরিস্ট অ্যাটাক। দৃশান চোখ বুজে নেয় সঙ্গে সঙ্গে। হচ্ছে টা কি? তার মাতৃভূমির বর্তমান অবস্থা এভাবেই খুব করুণ। তার উপর পরপর কয়েকমাসের ব্যবধানে তিনবার এই টেরোরিস্ট অ্যাটাক। এর শেষ কোথায়?

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৯.

[ এই উপন্যাসটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। এটাতে দৃশ্যমান কোনো ঘটনার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। তবে হ্যাঁ গল্পের প্রয়োজনে বর্তমান পৃথিবীর করুণ অবস্থা আমি কিছু জায়গায় তুলে ধরেছি। আর আজকের পর্বে কিছু স্ল্যাং ওয়ার্ডস ইউজ করেছি। সেটা মাথায় রেখে পড়বেন। ]

নিজের ম্যানেজারের সঙ্গে ব্যবসার হিসেব নিয়ে আলাপনে ব্যস্ত ছিলো শমসের মজুমদার। সেখানে সকাল সকাল মানিকের আগমন হওয়ায় তিনি আলাপ থামায়। ম্যানেজারকে বিদায় করে দিয়ে মানিকের উজ্জ্বল মুখপানে চেয়ে হেসে প্রশ্ন করে,

“ কোনো গুড নিউজ মানিক? “

মানিক হেসে মাথা নাড়ে। পকেট থেকে নিজের ফোন বের করে। অত:পর ফোনটা শমসের মজুমদারের দিকে বাড়িয়ে দেয়। শমসের মজুমদার আগ্রহ নিয়ে ফোনটা নিজের হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখেও হাসি ফুটে উঠে। কৌতুক মিশ্রিত গলায় প্রশ্ন করে,

“ সাথের মালটা কে? “

“ মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার মুজতবার অতি নিকটবর্তী লোক। জুলফিকারকে ফলো করতে করতে আমি মেজর পর্যন্ত পৌঁছেছি। “

শমসের মজুমদার এবার কিছুটা সিরিয়াস মুখ করে বলে,

“ খালি হাতে ফিরে এলে কেনো তবে? “

“ স্যার জায়গাটা খুব সিকিউরড। গতকাল সারারাত আমি ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে মশার কামড় খেয়ে ওখানকার গতিবিধি বুঝার চেষ্টা করেছি। “

“ তা গতিবিধি বুঝতে পেরেছো? “

“ জি স্যার। “

“ তাহলে আর দেরি কেনো? “

শমসেরের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরেই মানিক হাসে।

__________

আজ সকালের নাস্তাটা ঘরে মেয়ের সঙ্গে সেড়েই বেরিয়েছেন জুলফিকার মুজতবা। তিনি নিজেও খুব করে উপলব্ধি করছেন যে নিশাকে তিনি ঠিকঠাক সময় দিতে পারছেন না। মেয়েটা কেমন মনমরা হয়ে থাকে সারাদিন। প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ছাড়া সেধে তেমন একটা কথা বলে না। জুলফিকার খুব ভালো করেই বুঝতে পারে নিশার তার সঙ্গে কথা বলতে জড়তা কাজ করে। কিন্তু এই জড়তা ভাঙার উপায় জুলফিকারের জানা নেই। নিজের মেয়েকে জুলফিকার খুব ভালোবাসে। কিন্তু তা প্রকাশ করতে জানে না সে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরে তাকায় জুলফিকার। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় নাঈমাকে বাসায় আসতে বলবে। নিশা হয়তো মা’কে পেলে খুশি হবে। আর তাছাড়াও জুলফিকারের উদ্দেশ্য মা মেয়েকে আলাদা করা ছিলো না কখনো।

ফোনের রিংটোনের আওয়াজে জুলফিকার ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে। স্ক্রিনে ভেসে উঠা নামটা দেখতেই সে দ্রুত কলটা রিসিভ করে। সালাম দিয়ে শুধায়,

“ কেমন আছেন ভাবী? “

“ আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন ভাইয়া? নিশার এখন কি অবস্থা? “

“ আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি। নিশার ফিজিওথেরাপি চলছে। ধীরে ধীরে হাঁটার চেষ্টা করছে। “

“ যাক আলহামদুলিল্লাহ। ইনশাআল্লাহ নিশা দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে। “

ফোনের এপাশ থেকে জুলফিকার কেবল মৃদু হাসে। নীরবতা ভেঙে সেই নারী বলে উঠে,

“ ভাইয়া আসলে আমি দূর্জয়কে কল করছিলাম। কিন্তু ওকে ফোনে পাচ্ছি না। ও কোথায়? ভালো আছে তো? “

প্রশ্নটা শুনতেই জুলফিকার বুঝতে পারে দূর্জয় ইচ্ছে করেই সুহালা বেগমের কল রিসিভ করছে না। দীপ্তর মৃত্যুর পর থেকে ছেলেটা আরো গিল্টে ভুগছে। নিজের মা’র কাছ থেকে ভাইয়ের সত্যিটা লুকানোর গিল্ট ফিলিংস ছেলেটাকে খুব পোড়াচ্ছে। জুলফিকার সত্যটা ঢাকা দেওয়ার জন্য অযুহাত দেখিয়ে বলে,

“ ভালো আছে ভাবী। কাজের চাপে একটু ব্যস্ততায় দিন কাটছে ওর। “

ফোনের অপরপাশ হতে দূর্জয়ের মা সুহালা বেগম এবার সামান্য ইতস্তত করে বলে,

“ ভাইয়া, দূর্জয় আজ প্রায় সাত মাস ধরে বাড়ি ফিরছে না। ওকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিলো। আমি ভাবছিলাম চট্টগ্রাম এসে ক’টা দিন থেকে যাবো। “

জুলফিকার মুজতবা সঙ্গে সঙ্গে বিষম খায়। তার মনে পড়ে যায় গতকাল মাত্র দূর্জয় তাকে জানিয়েছে যে তার পরিচিত এক ক্লাসমেট খুব বড় এক বিপদে পড়েছে। তাকে আপাতত সে নিজের বাবার চট্টগ্রামের বাড়িটাতে রেখেছে। তাকে সেই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্যই সে সেদিন জুলফিকারকে বলেছিলো হসপিটালের সিসিটিভি ফুটেজ ডিলিট করার ব্যবস্থা করতে। এমন অবস্থায় যদি সুহালা বেগম চট্টগ্রামে আসেন তবে সিচুয়েশন আরো কম্পলিকেটেড হয়ে দাঁড়াবে। জুলফিকার সুহালা বেগমকে একটা বুঝ দিয়ে বলেন,

“ ভাবী এখানে আপনার নিজস্ব বাড়ি আছে। আপনি চাইলে যখন খুশি তখন আসতে পারেন। কিন্তু সত্যি বলতে এই মুহুর্তে আসলে দূর্জয় আপনাকে একদমই সময় দিতে পারবে না। খুব ব্যস্ততায় সময় কাটছে ওর। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই ও কিছুটা ফ্রি হবে। তখন না-হয় আপনি এসে ওর কাছে থেকে গেলেন অনেকদিন। দূর্জয়ও তখন আপনাকে সময় দিতে পারবে। “

জুলফিকার মুজতবার বুঝ পেয়ে সুহালা বেগম তা মেনে নেন। তিনি হেসে বলেন,

“ আচ্ছা তা-ই নাহয় হবে। “

“ আপনি দূর্জয়কে নিয়ে একদমই দুঃশ্চিন্তা করবেন না ভাবী। “

“ আপনি ওকে আগলে রেখেছেন দেখেই আমি কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকতে পারি ভাইয়া। ও ছাড়া আর আমার আছে কে বলুন? “

__________

চট্টগ্রামের সুনামধন্য এক গার্লস কলেজে ঘটিত টেরোরিস্ট অ্যাটাকে আটকৃত টেরোরিস্ট গুলো আজ এক সপ্তাহর বেশি সময় ধরে সেনাদের সেলে আটক অবস্থায় রয়েছে। এই দিনগুলোয় সৈন্যরা কম টর্চার চালায় নি জানোয়ারগুলোর উপর। কিন্তু এরা লোহার তৈরী। মরবে তবুও মুখ খুলবে না। প্রত্যেকের চেহারার নকশা বদলে গিয়েছে মার খেতে খেতে। তবুও এদের মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। কোনো ধরনের ইমোশনাল ব্লেকমেইলিং পর্যন্ত এদের ছুঁতে পারে না। জানোয়ার গুলো পৃথিবীর সকল কিছুর প্রতি মায়া ত্যাগ করেছে।

সাদাত নিষ্প্রভ দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে আছে একটা সেলের বাহিরে। তার দৃষ্টি স্থির সেলের দরজার মধ্যে ছোট্ট ফাঁক গলে ভিতরের অন্ধকার কুটিরে। এই সেলটার ভিতরে সেই টেরোরিস্ট গুলোকে রাখা হয়েছে। আজ ক’দিন ধরে এদের খাবার দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। যেনো ক্ষুধার তাড়নায় হলেও এরা মুখ খুলে। কিন্তু এরা মাটি কামড়ে পড়ে আছে। তবুও মুখ খুলছে না। আজ এদেরকে এক নতুন ধরনের থেরাপি দেওয়া হবে। শালারা যতক্ষণ না মুখ খুলবে ততক্ষণ এদের ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে আদর আপ্যায়ন অব্যাহত থাকবে।

সাদাত হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নেয় সময়টা। সকাল সাতটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট। রাফি, প্রত্যয়, রিদওয়ানদের যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে প্রায়। সাদাত আর দাঁড়িয়ে না থেকে সেখান থেকে প্রস্থান করে। এই মুহুর্তে বন্ধুদের বিদায় জানানো তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

___________

সামরিক বাহিনীর ইউনিফর্ম পরিহিত রাফি, প্রত্যয় এবং রিদওয়ান সম্পূর্ণ তৈরী যাওয়ার জন্য। সাইফ, সাদাত, জুনায়েদ, ফারদিনের থেকে বিদায় নেয় তারা হাস্যজ্বল মুখে। অত:পর মুখোমুখি হয় মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়ের। তারা যখন মেজরকে স্যালুট করতে প্রস্তুত তখন তাদের অবাক করে দিয়ে দূর্জয় নিজের দু-হাত মেলে দেয় আলিঙ্গনের জন্য। উপস্থিত সকলেই বেশ অবাক হয় তাতে। তবে প্রত্যয় দ্রুত বিস্ময় কাটিয়ে দূর্জয়ের আলিঙ্গন গ্রহণ করে। জুনিয়রকে বুকে জড়িয়ে ধরে দূর্জয় তার কানে ফিসফিসিয়ে বলে,

“ ভুলে যেও না, যেই প্রমাণই পাও না কেনো, তা সবার আগে জুলফিকার স্যার অথবা আমাকে জানাবে। “

এক এক করে বাকি দু’জনকে আলিঙ্গন করেও দূর্জয় একই কথা বলে। প্রত্যয়, রাফি এবং রিদওয়ান ভালো করেই জানে মেজর এরকম একটা কথা কেনো বলেছে। তাদের কাছে অর্ডার আছে যেনো সকল আপডেট সবার আগে কর্নেল জুবায়ের শিকদারের কাছে পৌঁছানো হয়। কিন্তু এই লোকটা খুব একটা পছন্দের না তাদের। ঠিক পছন্দ না বললে ভুল হবে, তাদের কাছে লোকটার ব্যবহার অবিশ্বাসযোগ্য ঠেকে। একজন সৈন্যের কাছে তার ফার্স্ট প্রায়োরিটি নিজের দেশের সুরক্ষা। সেই সুরক্ষার খাতিরে এমন দু একটা অর্ডারের থোড়াই কেয়ার করলে কোনো ক্ষতি নেই তারা মনে করে।

বিদায়ের পালা শেষ হতেই সৈন্যরা প্রাথমিক ভাবে সামরিক হেলিকপ্টারে চড়ে বসে। তারা আগে এখান থেকে ঢাকায় যাবে। সেখান থেকে বাকিদের সঙ্গে একসাথে ফিলিস্তিনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে তারা। হেলিকপ্টার ধীরে ধীরে ভূমি ছেড়ে আকাশপথে ঊর্ধ্বগমণ শুরু করতেই তিনজন আরো একবার জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকায়। দেখে নেয় পরিচিত মুখগুলো। কে জানে এটাই যদি কারো শেষ যাত্রা হয়?

__________

বিকেলের এই সময়টা মূলত শিফট চেঞ্চিং এর সময়। সারাদিন অন্য দু’জন দূর্জয়ের বাড়ির বাহিরে নিরাপত্তা দিলেও বিকেলের এই সময়টায় শিফট চেঞ্জ করে ইলিয়াস কাঞ্চন এবং তার সঙ্গী ডিউটিতে আসে। ঠিক বিকেল থেকে সারারাত পর্যন্ত তারা বাণীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। ইলিয়াস এবং তার সঙ্গী সবে ডিউটিতে এসেছে।

তারা যখন উঠোন জুড়ে টহল দিতে ব্যস্ত তখন আচমকা ইলিয়াসের সঙ্গী আহসান বলে উঠে তার প্রকৃতির ডাক এসেছে। সে এখনই রাস্তার ওপাশের ঝোপ থেকে এক নাম্বার কাজ সেড়েই এসে পড়বে। ইলিয়াস বিরক্ত হলেও বলে দ্রুত আসতে। আহসান প্রস্থান করতেই ইলিয়াস একা একা চারিদিকে টহল দিতে থাকে। সময় পেরোয়। দশ মিনিট, বিশ মিনিট পেরিয়ে প্রায় ত্রিশ মিনিট হতেই ইলিয়াস বিরক্ত হয়। আহসানের একটা বদভ্যাস আছে। এটা সেটার উছিলায় দূরে গিয়ে সিগারেটে দু চারটে টান মারার। তাই এই ব্যাপারে খুব একটা মাথা ঘামায় না ইলিয়াস।

কিন্তু আচমকা উঠোন পেরিয়ে রাস্তার অপরপাশের ঝোপঝাড় হতে অদ্ভুৎ কিছু শব্দ ভেসে আসতেই ইলিয়াস সতর্ক হয়ে যায়। দ্রুত নিজের সিভিল পোশাকের পিছন হতে একটা পিস্তল বের করে হাতে নেয়। বাড়ির দরজার কাছে গিয়ে কলিংবেল চাপে দ্রুত। মিনিট পেরোতেই ভিতর থেকে বাণী অভ্যাসগত স্বরে প্রশ্ন করে,

“ কে? “

“ ম্যাডাম আমি। ইলিয়াস কাঞ্চন। আপনি দরজা ভালো করে লক করে বসুন। ভুলেও দরজা খুলবেন না। সম্ভব হলে দ্রুত দূর্জয় স্যারকে কল করুন। আই থিংক সামথিং ইজ ফিশি হেয়ার। “

অনর্গল বলা কথা গুলো কানে পৌঁছাতেই বাণী ভীত হয়ে পড়ে। সামথিং ইজ ফিশি মানে? কি হয়েছে বাহিরে? হিরণ? ওর লোকেরা কি বাণীর সন্ধান পেয়ে গিয়েছে? ভাবনাটা বাণীর মাথায় উঁকি দিতেই সে তিরতির করে ঘামতে শুরু করে। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ইলিয়াস কাঞ্চনের কথা মতন দরজার দুটো ছিটকানিই ভালো করে আটকে দেয়। ডাইনিং টেবিলের কাছ থেকে একটা চেয়ার টেনে এনে তা দিয়ে দরজায় ঠেক দেয়।

অত:পর দ্রুত গতকাল দূর্জয়ের দেওয়া ফোনটা থেকে দূর্জয়ের সেভ করা নাম্বারটা ডায়াল করে। একবার, দুবার, তিনবার করে পরপর ছয়বার কল দেয়। কিন্তু কলটা রিসিভ হয় না। বাণী ভীত হয়ে রয়। তার গলা শুকিয়ে চৌচির হয়ে আছে। আচমকা দরজায় জোরে করাঘাতের শব্দে তার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠে। এই করাঘাতের শব্দ বেশ হিংস্র ধরনের। বাণীর অন্তর আত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠে এক একটা দানবীয় হাতের করাঘাতের শব্দে। সে দ্রুত রান্নাঘরের দিকে দৌড়ে যায়। কেবিনেট হাতড়ে একটা ধাঁরালো ছুরি হাতে নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দেয়। রুমের এককোণে মেঝেতে বসে রয় সে শক্ত করে ছুরি হাতে। অসহায় লাগছে তার খুব। হিরণ তাকে পেলে আস্ত রাখবে না। ম্যানিয়াকটার মাথা বিগড়ে আছে নিশ্চয়ই। বাণীকে ছিড়ে খাবে।

অশ্রুসিক্ত দৃষ্টি মেলে বাণী হাতের ফোনের পানে চায়। কিছু একটা ভেবে দ্রুত দূর্জয়ের নাম্বারে একটা ম্যাসেজ সেন্ড করে। অত:পর ফোনটা দ্রুত সাইলেন্ট করে বিছানার নিচে লুকিয়ে ফেলে। সে খুব ভালো করেই টের পায় বাড়ির মেইন দরজাটা ভেঙে কিছু মানুষ বাড়ির ভেতর প্রবেশ করেছে। কয়েক জোড়া পায়ের এগিয়ে আসার শব্দ বাণীর রক্ত হীম করে তুলে। তবুও সে হাতের ছুরিটা শক্ত করে ধরে রয়। সে চেষ্টা করবে। যতদূর সম্ভব বাঁচার চেষ্টা করবে।

__________

হিরণের পক্ষে বহ্নিকে সামলানো খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথম প্রথম এটা সেটা বলে মেয়েটাকে বুঝ দেওয়া যেতো। কিন্তু এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। এতোদিন হয়ে গিয়েছে অথচ বাণী এখনো কেনো ফিরছে না সেই প্রশ্ন করতে করতে বহ্নি হাপিয়ে উঠেছে। মেয়ের প্রশ্নের তাড়ায় হিরণের অন্তর্নিহিত ক্ষোভ মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। সেই ক্ষোভ মেটাতে সে প্রায় প্রতিদিনই একটা না একটা খুন করে চলেছে। তবে এসব ব্যাপারে সে এখন খুব সতর্ক হয়েছে। ভুল করেও ঘরের ত্রী সীমানায় ভায়োলেন্স জাতীয় কিছু করে না। পাছে না আবার তার মেয়ে কিছু জেনে যায়!

হিরণের মনে হয় সে একদল গরুকে ঘাস খাইয়ে পালে। এরা জাবরকাটা ছাড়া আর কোনো কাজ পারে না। একটা মেয়ে মানুষ কি হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে নাকি? তাকে খুঁজে পেতে এতো দেরি কেনো হবে নাহয়? হিরণের সব রাগ জমা হয়ে আছে বাণীকে সাহায্য করা সেই সাহায্যকারীর প্রতি। এই মানব সেবাকারীকে খুঁজে পেলে হিরণ সোজা তার গলায় নিজের সংগ্রহের সবথেকে ধাঁরালো চাপাতি চালাবে। অসভ্য কুকুরটার গলার সবগুলো রগ কেটে দিবে। গলাকাটা মুরগির মতো তড়পাতে তড়পাতে যখন তার আত্মা দেহ ত্যাগ করবে তখন হিরণ তৃপ্তির ঢেকুর তুলবে।

সবে মাত্র বাসায় ফেরা হিরণ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে এসব ভাবনায় মশগুল ছিলো। সময়টা এখন তিনে সন্ধ্যা। বাড়ির সীমানার বাহিরে পরিবেশটা দেখতে কেমন ভুতুড়ে লাগছে। বাহিরের দুটো ল্যাম্পপোস্ট আজকে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ফলস্বরূপ আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়ির সীমানার বাহিরটা। আচমকা ফোন শব্দ তুলে বেজে উঠতেই হিরণের ভাবনায় ভাটা পড়ে। সে ছাঁই রঙা প্যান্টের পকেট হতে ফোন বের করে। অসময়ে শমসের মজুমদারের কল পেয়ে বেশ বিরক্ত অনুভব করে। তবুও কলটা রিসিভ করে সে। ফোনের অপরপাশ হতে শমসের হেসে বলে উঠে,

“ হিরণ, শুনলাম তোমার খাঁচা থেকে নাকি পাখি উঁড়ে গিয়েছে? “

হিরণ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ তিনে সন্ধ্যা বেলা কি মদ্যপান করেছেন নাকি? কিসব আবোলতাবোল বকছেন? “

শমসের মজুমদার হিরণের কথায় খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। তিনি নিজের মতো বলে উঠে,

“ প্রথমে আমি ভেবেছিলাম পাখিটা খুব কুৎসিত দেখতে। কিন্তু এখন এই বাঙালি রূপে দেখে তো আমার মাথায় অন্য চিন্তা আসছে। এতো সুন্দর জিনিস তুমি আমার থেকে আড়াল করে রেখেছিলে? “

হিরণের আচমকা গলার স্বর পরিবর্তন হয়। সে সিরিয়াস গলায় প্রশ্ন করে,

“ যা বলার সরাসরি বলেন। “

“ তুমি নিজেই শুনে নাও। “

মুহুর্তেই ফোনের অপর পাশ থেকে ভেসে আসে এক নারী স্বরের চিৎকার। এই স্বর হিরণের খুব পরিচিত। সে সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে ফেলে। অদ্ভুৎ ভঙ্গিতে নিঃশ্বাস ছাড়ে। শমসের মজুমদার নিজেই আবার বলে উঠে,

“ শুধুমাত্র জোর করে একটু কোলে বসিয়েছি। এতেই চিৎকার করে আমার কানের পর্দা ফাটিয়ে দিচ্ছে। তুমি তো ভালো করেই জানো আমার অযথা চিৎকার চেঁচামেচি করা পছন্দ না। এই পাখির সঙ্গে কি করা যায় বলো তো? “

হিরণ রাগ সংবরণ করতে পারে না। তেঁতে উঠে বলে,

“ কুত্তার বাচ্চা তোর হাত কেটে দিবো। কই হাত দেস তুই? “

আবারও ফোনের ওইপাশ থেকে চিৎকার ভেসে আসে। শমসের মজুমদার বেশ রসালো গলায় বলে,

“ এই নরম তুলতুলে শরীর এতোদিন একা ভোগ করেছো তুমি? একবারও এই বাপটার কথা মনে পড়ে নি? বাপকে অভুক্ত রেখে কিভাবে হজম করলে তুমি? “

হিরণ আবারও চিৎকার করে উঠে।

“ খা*কির বাচ্চা তুই মরবি। আমার হাতে মরবি। “

হিরণের চিৎকার এতো জোরে ছিলো যে তার রুমের দরজার কাছে বহ্নি এসে উপস্থিত হলো। কিন্তু পাপার এই ভয়ংকর রূপ আর অজস্র গালিগালাজ শুনে সে ভীত হয়ে পড়ে। ছোট বাচ্চাটা ভয়ে গুটিসুটি মেরে দরজার সঙ্গে লেপ্টে রয়। নিচ থেকে ইবাত এবং একজন হেল্পিং হ্যান্ডও দৌড়ে উঠে আসে হিরণের দরজার কাছে। হিরণের এই রূপ দেখে এবং বহ্নিকে দরজার কাছে দেখে ইবাত দ্রুত সেই হেল্পিং হ্যান্ডকে ইশারা করে বহ্নিকে এখান থেকে নিয়ে যেতে। হেল্পিং হ্যান্ড মহিলাটা একটা ঢোক গিলে বহ্নির হাত ধরে টেনে দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করে। হিরণ তখনও গালিগালাজ করে শমসেরকে একের পর এক হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। ফোনের অপর পাশে থাকা শমসের তা শুনে হাসে। কুকুরের লেজে সে পা দিয়েছে। কুকুর তো ঘেউঘেউ করবেই। সে আর কোনো কথা না বলে ফট করে কলটা কেটে দেয়।

হিরণের মাথা বিগড়ে যায় মুহুর্তেই। রাগে সে লাথি মেরে সিঙ্গেল সোফাটা উল্টে ফেলে। অত:পর দ্রুত বেডসাইড কেবিনেট থেকে একটা রিভলবার বের করে প্যান্টের পিছন দিকে ভরে নেয়। গায়ের কোটটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে সে ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে যায়। ইবাত চিন্তিত গলায় জানতে চায় কি হয়েছে। হিরণ কেবল যাওয়ার আগে এইটুকু বলে,

“ শমসের খা*কির বাচ্চা বাণীকে খুঁজে পেয়েছে। আমি অর্ধেক গার্ড সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি বাসায় থাকো। বহ্নির দিকে খেয়াল রাখো। আমার মেয়েকে তোমার ভরসায় রেখে যাচ্ছি। “

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩০.

দুই হাত এবং পা বাঁধা অবস্থায় সোফার এককোণে বসে আছে বাণী। তার ঠিক পাশেই বসে আছে শমসের মজুমদার। যিনি একহাতে বাণীর কোমর চেপে ধরে বসে আছেন। অসভ্য বুড়ো লোকটার স্পর্শ ক্ষণে ক্ষণে বাণীকে আতংকিত করে তুলছে। কিন্তু সে ছটফট করা এবং চিৎকার করা ছাড়া প্রতিহত করার আর কোনো মাধ্যম খুঁজে পাচ্ছে না। বাণীর আতঙ্ক মিশ্রিত চিৎকারে বেশ তৃপ্তি খুঁজে পাচ্ছে শমসের মজুমদার। তিনি সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে খুব আয়েশ করে অপরহাতে চানাচুর মাখা খেতে ব্যস্ত। বাহিরে আকাশ তখন গর্জন তুলে ডাকছে। এমন বাদলা দিনে চানাচুর মাখা খাওয়ার মজাই অন্যরকম। তিনি একমুঠো চানাচুর বাণীকে দেখিয়ে সাধে,

“ খাবে নাকি বৌমা? খাইয়ে দিবো? ছেলে এসে তো পরে বলবে আমি তার বউয়ের ঠিকঠাক খাতির যত্ন করিনি। “

কথাটা বলেই শমসের অশ্লীল ভঙ্গিমা করে হাসিতে ফেটে উঠে। বাণীর গা গুলিয়ে আসে সেই হাসি দেখে। আক্রোশে সে নিজের দঁড়ি দিয়ে বাঁধা পা জোড়া তুলেই সোফার সামনে রাখা টি টেবিল বরাবর একটা লাথি মারে। মুহুর্তেই টি টেবিলের উপরের কাঁচ এবং চানাচুর মাখা কাঁচের বাটিটা টাইলস বসানো ফ্লোরে পড়ে ঝনঝন শব্দ তুলে ভেঙে গুড়িয়ে যায়। শমসের মজুমদার কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই তার মুখেও একদলা থুতু নিক্ষেপ করে বাণী।

শমসের মজুমদারের হাসিমাখা মুখে মুহুর্তেই কালো আঁধার নামে। তিনি রাগে ফেটে পড়ে একহাতে বাণীর চুলের মুঠি চেপে ধরে অন্য হাতে তার গালে একটা কষে চড় বসিয়ে বলে,

“ মা*গী তোর এতো তেজ? তোর তেজ আমি ছুটামু দাঁড়া। তোর জামাইয়ের খুব পাংখা গজাইছে। আগে ওর পাংখা কাইট্টা নেই। পরে তোর তেজ ছুটামু। “

চড় খেয়েও বাণী দমে না। ফের থুতু ছুড়ে মারে শমসেরের মুখে। রাগে এবং বিতৃষ্ণায় শমসের মজুমদারের গা ঘিনঘিন করে উঠে। তিনি কিছু করবে তার পূর্বেই বাহির থেকে গাড়ির হর্ণের তীক্ষ্ণ শব্দ ভেসে আসে। শমসের একপল বাণীকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায়। গায়ের পাঞ্জাবিটা সামান্য ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে তাকাতেই দেখে মানিক সহ বেশ কিছু গার্ড দ্রুত লিভিং রুমে প্রবেশ করে সতর্ক অবস্থান জারি করে পিস্তল হাতে প্রস্তুত। তার ঠিক পরপরই গটগট পায়ে প্রবেশ করে হিরণ। তার পিছনে রয়েছে তার ব্যক্তিগত একদল গার্ড।

হিরণ সর্বপ্রথম সোফায় বসে থাকা শাড়ি পরিহিতা বাণীর দিকে দৃষ্টিপাত করে। আর সঙ্গে সঙ্গেই সে হাতের পিস্তলের স্লাইড পুল করে শমসের মজুমদারের দিকে তা তাক করে ধরে। শমসেরের লোকেরাও দেরি না করে চারিদিক থেকে হিরণের দিকে পিস্তল তাক করে ধরে। বাদ যায় না হিরণের লোকেরাও। ট্রিগার চাপার পূর্বে হিরণ একমুহূর্ত চিন্তা করতো না, যদি না এখানে বাণী উপস্থিত না থাকতো। কিন্তু এখন তাকে কিছু করতে হলেও আগে একশো বার ভাবতে হবে। সে ট্রিগার চেপে এখনই শমসেরের বুকে ফায়ার করতে পারে, কিন্তু এতে উভয়পক্ষ থেকেই ক্রসফায়ার হওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চিত। সেই ফায়ারিং এর মাঝে বাণী যে গুলিবিদ্ধ হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। হিরণ সেই রিস্ক নিতে রাজি না। তাই সে ক্রুদ্ধ গলায় কেবল বলে,

“ পথ আলাদা আজ থেকে আমাদের। কাজ সম্পর্কিত যত ডিল ছিলো আমাদের মধ্যে সেই সকল চুক্তিকে আমি আর তোয়াক্কা করবো না। বাণীকে আমার সাথে যেতে দে। বেঁচে থাকতে চাইলে আর কখনো বাণী কিংবা বহ্নির আশেপাশে যেনো আমি তোকে না দেখি। “

শমসের মজুমদার পাজামার পকেট হতে একটা রুমাল বের করে মুখটা মুছে নিয়ে হাসতে হাসতে বলে,

“ বৌমার মুখের থুতুতেও কি স্বাদ! “

হিরণের রাগে শরীর গিজগিজ করছে। সে গমগমে গম্ভীর স্বরে বাণীকে শুধায়,

“ গেট আপ বাণী। “

বাণীর ক্ষানিক পূর্বের তেজ হিরণকে দেখতেই মিইয়ে গেছে। সেই ভয়ঙ্কর দৃষ্টি তার কলিজায় কাঁপন ধরায়। কি হতে চলেছে ভেবে মনে মনে তটস্থ সে। কোনটা বেশি উত্তম? শমসের নাম এই অসভ্য বুড়ো লোকের কাছে হেনস্থা হওয়া? নাকি হিরণের সাহায্যে উদ্ধার হয়ে আবারও তার ভয়ংকর ক্ষোভের শিকার হওয়া? দুটোই বাণীর জন্য অসহনীয়। এর থেকে মরে যাওয়া কি উত্তম নয়? মরে যেতো বাণী। বহু পূর্বেই মরে যেতো। কিন্তু বহ্নির পিছুটান তাকে মরতেও দিচ্ছে না। নিজের মেয়েকে এমন অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে একা ছেড়ে দিয়ে মরে গিয়ে মুক্তি লাভের মতো স্বার্থপর বাণী হতে পারবে না।

হিরণের রাগের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পেতেই সে হাতের নিশানা ঘুরিয়ে শমসেরের এক লোকের পেটের বাম পাশ বরাবর গুলি ছুড়ে চেঁচিয়ে উঠে,

“ আই সেইড গেট আপ বাণী। “

বাণী কেঁপে উঠে। ভয়ে সে বলতেও পারে না যে সে উঠতে পারবে না। শাড়ির পাড়ের নিচে তার পা দুটো বাঁধা। আহত লোকটা পেট চেপে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। শমসের মজুমদার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না। তিনি এবার সিরিয়াস মুখভাব করে হিরণের চোখে চোখ রেখে বলে,

“ ভুলে যেও না কার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছো তুমি। বেশি সেয়ানা সাজলে মেরে আমার বাড়ির আঙিনায় বালি চাপা দিয়ে দিলেও কেউ টের পাবে না। আমার খেয়ে পড়ে এখন আমার দিকেই ঘেউঘেউ করবে, আর আমি তা মেনে নিবো? বউ সহ যদি এখান থেকে জীবিত বের হতে চাও তাহলে শুধুমাত্র একটা সিগনেচার করতে হবে। নিজের অস্ত্রের ব্যবসা আমার নামে করে দাও আমি তোমাদের যেতে দিবো। আর কখনো তোমাকে আমাদের প্রয়োজন পড়বে না। “

শমসেরের ধূর্ত প্ল্যান সম্পর্কে শুনে হিরণ অবাক হয় না। বহুদিন ধরে যে শমসের তার ব্যবসার দিকে নিজের নজর দিয়ে রেখেছে তা হিরণের ভালো করেই জানা আছে। সে এটাও জানে শমসের মজুমদারের বলা কথাটা মিথ্যা। একবার সিগনেচার পেয়ে গেলে সে কখনোই হিরণ এবং বাণীকে এখান থেকে জীবিত বের হতে দিবে না।

শমসের এবার আচমকাই দ্রুত গতিতে নিজের পাঞ্জাবির পকেট হতে একটা পিস্তল বের করে তা বাণীর মাথায় ঠেকায়। গম্ভীর গলায় শুধায়,

“ তোমার হাতে সময় কম হিরণ। দ্রুত সিদ্ধান্ত নাও কি চাও। “

হিরণ একপল বাণীর ভয়ার্ত মুখশ্রী দেখে নিয়ে লিভিং রুমের এককোণে থাকা ঘড়িতে সময়টা দেখে নেয়। ঘড়ির কাঁটা ছয়টা উনপঞ্চাশে রয়েছে এই মুহুর্তে। তা দেখে হিরণ মৃদু হাসে। ঠোঁটের কোণে হাসি বজায় রেখেই সে শমসের মজুমদারের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া বন্ধ কর। আমরা দুইজনই ভালো করে জানি যে আমাকে কিংবা বাণীকে এখান থেকে কখনোই জীবিত যেতে দিবি না তুই। “

শমসের মজুমদার হিরণের কথা শুনে সামান্য হাসে। ছেলেটা খুব বুদ্ধিমান। হিরণ আবারও বলে উঠে,

“ আমাদের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব নতুন না শমসের মজুমদার। তুই যেমন নিজ স্বার্থে আমার মতো অনাথকে পেলে সুযোগ বুঝে ব্যবহার করেছিস, আমিও ঠিক একইভাবে নিজ স্বার্থে তোর দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছি। তোর কি মনে হয় তুই আমাকে নিজের মতো গড়ে তুলেছিস? হাহ! আমি নিজেকে গড়েছি। আর এতটা শক্তভাবে গড়ে তুলেছি যে এখন আমি তোর থেকেও বেশি ক্ষমতার মালিক। একটা প্রবাদ আছে না? একই বনে কখনো দুই রাজা থাকতে পারে না? আমাদের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। এই বনে রাজা শুধু একজনই থাকবে। সে হলাম আমি। “

হিরণ কথাটা শেষ করতে না করতেই লিভিং রুমে প্রবেশের প্রধান দরজা এবং দুই ধারের চারটে জানালার আড়াল হতে গুলি বর্ষণ শুরু হয়। শমসের মজুমদার কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই তার অধিকাংশ গার্ড রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। পরিস্থিতি বুঝে উঠতেই শমসের ট্রিগার চাপার জন্য উদ্যত হয়। কিন্তু তার পূর্বেই হিরণ তার হাতের বাহু বরাবর ফায়ার করে। ফলস্বরূপ তার হাত থেকে পিস্তল ছিটকে পড়ে। হিরণের লোকেরা যখন বাসার বাহির এবং ভেতর থেকে গুলি ছুঁড়তে ব্যস্ত হিরণ সেই সুযোগে দ্রুত বাণীর দিকে এগিয়ে যায়। শমসের মজুমদার রক্তাক্ত হাত চেপে ধরে পিস্তলের কাছে এগিয়ে যেতে নিলেই হিরণ ফের তার হাঁটু বরাবর গুলি ছুড়ে। শমসের হাঁটু ভেঙে মুহুর্তেই ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে। গুলিটা একদম পায়ের হাঁড়ে গিয়ে লেগেছে। উঠে দাঁড়ানোর কোনো শক্তি খুঁজে পাচ্ছে না সে।

হিরণ নিঃশব্দে এগিয়ে বাণীর দঁড়ি দিয়ে বাঁধা হাত জোড়াকে আগে বাঁধন মুক্ত করে। সঙ্গে সঙ্গে বাণীর হাত চেপে ধরতেই বাণী নিচু গলায় বলে,

“ পা বাঁধা। “

হিরণ তা শুনে ভ্রু কুচকে তাকায় বাণীর পায়ের দিকে। বাণী নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নিজেই শাড়ির পাড়টা সামান্য উঁচু করে দ্রুত হাতে পায়ের বাঁধন খুলে ফেলে। পা জোড়া মেঝেতে রাখতে নিলেই হিরণ তার পূর্বেই তাকে পাজাকোলে তুলে নেয়। ভয়ে বাণী চিৎকার করে উঠে,

“ হাঁটতে পারবো… নামান। “

হিরণ প্রতুত্তর করে না। বাণীকে নামায়ও না। কেবল শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। বাণী সঙ্গে সঙ্গেই ভয়ে চুপ হয়ে যায়। বুক ভেঙে কান্না আসছে তার। সব বৃথা গিয়েছে। সব! আবার সেই জাহান্নামে ফিরতে হবে তার। আবার সেই নরক যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে তার। এতো সব ভাবনার মাঝেই একটা নাম বাণীর মস্তিষ্কে উঁকি দেয়। শাহরিয়ার দূর্জয়। কোথায় সে? তার কাছে কি বাণীর ম্যাসেজ পৌঁছায় নি? নাকি সে দেশের প্রতি দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত? নিজের ভাবনার প্রতি বাণীর করুণা হয়। সে কেনো আশা করছে দূর্জয় তাকে সাহায্য করতে আসবে? দূর্জয় কেনো আসবে? দেশের প্রতি নাহয় দূর্জয়ের দায়িত্ব এবং ভালোবাসা দুটোই আছে। কিন্তু বাণী? তার প্রতি তো দূর্জয়ের দুটোর একটিও নেই।

হিরণ নীরবে ভাঙা কাঁচ মাড়িয়ে দরজার কাছে যেতেই ইবাতের মুখোমুখি হয়। ইবাত বাণীকে দেখতেই প্রাণখোলা হাসি দিয়ে হিরণকে বলে,

“ স্যার থ্যাংক গড লাস্ট মোমেন্টে আমরা প্ল্যান চেঞ্জ করেছি। ব্যাক আপ ছাড়া আপনি এখানে আসলে শমসের স্যার আপনাকে আর ম্যাডামকে জীবিত যেতে দিতো না কখনো। “

হিরণ শান্ত গলায় বলে,

“ শমসের মজুমদারের কি ব্যবস্থা করতে হবে তা তোমার জানা আছে। এখানের কাজ শেষ করে বাড়ি যাও। বহ্নিকে কিছু একটা বুঝ দিয়ে আজকের জন্য সামলে নাও। আমরা আগামীকাল ফিরবো। “

বাণী সঙ্গে সঙ্গে ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে হিরণের পানে তাকায়। আগামীকাল ফিরবে মানে? আজ তাহলে তারা কোথায় যাবে?

ইবাত প্রশ্ন করে,

“ স্যার সঙ্গে গার্ড নিবেন না? “

“ প্রয়োজন নেই। “

__________

“ Something is wrong Durjoy. Please come soon. “

মিটিং রুম থেকে বের হয়ে বাণীর নাম্বার থেকে আগত ছয়টা মিসড কল এবং এই দুই বাক্যের ম্যাসেজ দেখে দূর্জয়ের কপালে চিন্তার ছাপ ফুটে উঠে। সে দ্রুত বাণীর নাম্বার ডায়াল করে। কিন্তু কলটা রিসিভ না হতেই সে পরপর আহসান এবং ইলিয়াসের নাম্বারে কল করে। তারাও যখন কল রিসিভ করে না, তখন দূর্জয় দ্রুত প্রস্থানের জন্য পা বাড়াতেই তার ফোন বেজে উঠে। ফোনের স্ক্রিনে জুলফিকারের নামটা দেখে দূর্জয় তা রিসিভ করে। ফোনের অপর পাশ হতে জুলফিকার তাড়া দিয়ে বলে,

“ দ্রুত সেল নং এ থ্রিতে এসো। “

কথাটুকু বলেই জুলফিকার কল কেটে দেয়। দূর্জয় দুইপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। একটা রাস্তা বাণীর কাছে পৌঁছানোর এবং অন্য রাস্তা সেল নং এ থ্রিয়ে পৌঁছানোর। কোনদিকে পা বাড়াবে সে? অজানা কারণে বাণীকে নিয়ে অনুভূত ভয়, শঙ্কা দূর্জয়ের বুকের ভেতর বুঁদবুঁদ করছে। এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে দূর্জয় এক কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। জুলফিকারের নাম্বারটা ডায়াল করে ফোন কানে চেপে ধরে। কলটা রিসিভ হতেই সে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠে,

“ স্যার, সেল নং এ থ্রিতে যে খুব ইমারজেন্সি কোনো কারণে আপনি আমায় ডেকেছেন তা আমি জানি। এই মুহুর্তে সেই ইমারজেন্সি সিচুয়েশনটা সামলানোর জন্য এই হেডকোয়ার্টারে অসংখ্য সেনা উপস্থিত আছে। কিন্তু বাণী ইজ হেল্পলেস। শি ইজ ইন এ বিগ ট্রাবল। ওর ইমারজেন্সি কেসটা দেখার জন্য আমি ছাড়া আর কেউ নেই। এই অবস্থায় আমি কাকে চুজ করবো? আপনার পারমিশন ছাড়া আমি এক পা-ও বাড়াবো না। “

__________

সন্ধ্যা তখন ছয়টা নাগাদ বাজে। সূর্য ঢলে পড়লেও পশ্চিম আকাশে সূর্যের রক্তিম আভা তখনও ফুটে আছে। নিজের ভূখণ্ড ছেড়ে বহু দেশ ও সমুদ্র অতিক্রম করে সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারটা ভিন্ন এক ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে বেশ অনেকক্ষণ হলো। স্বচ্ছ কাঁচের জানালা ভেদ করে স্পেশাল ফোর্সের তিন লেফটেন্যান্টেরা যুদ্ধ বিধ্বস্ত এক ভূখণ্ডের পানে তাকায়। যে দেশের বাতাসে মিশে আছে বারুদের গন্ধ। যে দেশে মৃত্যুর মাত্রা অতুলনীয়। যে দেশের প্রায় ১.৭ মিলিয়ন মানুষ বাস্তচুত্য হয়েছে, সম্প্রদায়গুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে, বাড়িঘর ভেঙে ফেলা হয়েছে, পুরো পরিবার এবং গোটা একটা প্রজন্মকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে।

রাফি, প্রত্যয় এবং রিদওয়ান স্ব চোক্ষে দেখে এমন একটা ভূখণ্ডকে, যে ভূখণ্ডের জাতির উপর অনাহার নেমে এসেছে। বাস্তব পৃথিবীর এরূপ চিত্র দেখে তিনজনই বাকহারা হয়ে পড়েছে। সামনে থেকে পাইলট জানায় আর সাত মিনিট পড়েই তারা ফিলিস্তিনের মাটিতে ল্যান্ড করবে। প্রত্যয়, রাফি এবং রিদওয়ান মনে মনে প্রস্তুত ব্যতিক্রমী এক অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হতে। স্ব চোক্ষে এই ভূখণ্ডে চালিত ধ্বংস লীলার চাক্ষুষ সাক্ষী হতে।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]