এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩১.
আচমকা আননোন এক নাম্বার হতে কল পেয়ে ভ্রু কুচকে রয় জামিল। তবুও কলটা রিসিভ করে ফোন কানে চেপে ধরতেই অপর পাশ হতে গম্ভীর তবে অশান্ত গলা বলে উঠে,
“ মেজর শাহরিয়ার দূর্জয় বলছি। এক্স্যাক্ট এক মিনিটের মধ্যে আমি গাড়ি নিয়ে বেরোবো। পথে কোনো চেকিং অথবা কোনো ধরনের বাঁধা চাইছি না। আই হ্যাভ টু বি সামহোয়্যার এজ ফাস্ট এজ পসিবল। সেই অনুযায়ী বেরোনোর পথে যেনো কোনো ব্যারিকেডের সম্মুখীন আমায় না হতে হয়। দায়িত্বটা আপনাকে সঁপে দিলাম। ক্লিয়ার মাই ওয়ে ইন দিজ ওয়ান মিনিট। “
কথাটুকু বলেই ফোনটা রেখে দেয় অপর পাশের ব্যক্তি। জামিল বিস্ফোরিত দৃষ্টি মেলে চেয়ে রয় ফোনের পানে? মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়? যেই লোকটাকে প্রতিদিন জামিল বড়ো বড়ো চোখ মেলে এই হেডকোয়ার্টারে প্রবেশ করতে দেখে? রেড রুমে এই লোক বন্দীদের কাছে কিরূপ আতংক তা সম্পর্কে জামিল টুকটাক শুনেছে। আর তাতেই সে এই লোকটাকে জমের মতন ভয় পায়।
আচমকা ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে নিজের হাতের ঘড়ির কাঁটার পানে তাকায় জামিল। দূর্জয়ের বেঁধে দেওয়া এক মিনিট সময়ের মধ্যে কেবল চল্লিশ সেকেন্ড অবশিষ্ট রয়েছে। তৎক্ষণাৎ সে চেঁচিয়ে উঠে,
“ মেজর গাড়ি নিয়ে বের হবেন। ব্যারিকেড সরানোর অর্ডার এসেছে। গেট ক্লিয়ার করো ফাস্ট! ত্রিশ সেকেন্ড হাতে সময় আছে। “
__________
শাঁ শাঁ শব্দ তুলে কালো রঙা জিপ গাড়িটা হেডকোয়ার্টার ছেড়ে বেরিয়ে আসে। যত এগোচ্ছে গাড়ির গতিও ততই ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। আবহাওয়ার অবস্থা নেহাৎই বাজে। অসময়ে ঝড় নামবে বুঝি। স্টিয়ারিংয়ে বলিষ্ঠ ডান হাতটা স্থির রেখে অপর হাতে তিনটা নাম্বার পরপর ডায়াল করে চলেছে দূর্জয়। কল হচ্ছে, তবে কেউ রিসিভ করছে না।
মনটা এতো কু গাইছে কেনো? ওই মেয়েটা ঠিক আছে তো? প্রশ্নটা মনে উঁকি দিতেই দূর্জয়ের চিন্তিত মুখশ্রী মলিন বর্ণ ধারণ করে। অবচেতন মন নীরব প্রার্থনা চেয়ে বসে,
“ ও যেনো সেফ থাকে। “
__________
মেঝেতে পড়ে রয়েছে একটি রক্তে মাংসে গড়া দেহ। সময়ের ব্যবধানে যা এখন লাশ হিসেবে বিবেচিত। জুলফিকার মুজতবা মুখ কালো করে চেয়ে রয়েছেন সেই লাশের পানে। সেল নং এ থ্রি তে কেমন ভুতুড়ে একটা পরিবেশ বিরাজ করছে। আজ সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু যে মোটেও স্বাভাবিক নয় তা এই সেলে উপস্থিত সকলেরই জানা। সাদাত থমথমে গলায় বলে উঠে,
“ কেউ একজন চায় না আমরা সফল হই। সেই কেউ টা আমাদের মধ্যেরই কেউ। “
জুলফিকার মুজতবা সাদাতের কথার সঙ্গে একমত। আজ সন্ধ্যার এই ঘটনা তাকে সম্পূর্ণ এলোমেলো করে দিয়েছে। মিটিং শেষ হতেই সাদাত আচমকা কল করে জানায় যে বন্দী টেরোরিস্টদের মধ্যে একজন এই টেরোরিস্ট অ্যাটাক জড়িত সকল তথ্য জানাতে রাজি হয়েছে। তবে শর্ত হলো সে কেবল জুলফিকারকেই এই ব্যাপারে জানাবে। জুলফিকার সঙ্গে সঙ্গে মিটিং ছেড়ে রওনা হয় সেল এ থ্রি য়ের উদ্দেশ্যে। তবে সেলে পৌঁছাতেই তিনি দেখে আঘাতে জর্জরিত আতঙ্কবাদীর দেহটা কেমন নিথর হয়ে মাটিতে পড়ে রয়েছে।
সাদাতের কাছে তিনি এর ব্যাখ্যা চাইলে সাদাত জানায় আননোন একটা নাম্বার থেকে কল আসায় সে কথা বলতে শুধু কিছু মুহুর্তের জন্য বাহিরে গিয়েছিলো। কিন্তু যখন কেউ রেসপন্স করছিলো না ফোনের অপরপাশ থেকে তখন সে ফোন কেটে ভেতরে চলে আসে। আর সঙ্গে সঙ্গে দেখে ছেলেটা আর নেই। এই ব্যাপারে সে দায়িত্বরত সবাইকে জিজ্ঞেস করার পর সবাই একই উত্তর দিয়েছে। কেউ কিছুই জানে না। একজন আশংকা করে বলেছিলো যে থেরাপির ডোজটা খুব সম্ভবত বেশি হয়ে গিয়েছিলো, তাই ছেলেটা পটল তুলেছে।
জুলফিকার চোখ তুলে সাইফ এবং সাদাতের পানে তাকায়। সত্যের এতো কাছে পৌঁছে তা না জানতে পারার আক্ষেপ দু’জনের মুখেই ফুটে আছে। জুলফিকার কেবল থমথমে গলায় বলে,
“ এই ব্যাপারে এখন কোনো রিয়েক্ট করার দরকার নেই। এমন ভাব ধরো যেনো সত্যিই ছেলেটা হাই ডোজ টর্চার সইতে না পেরেই মারা গিয়েছে। দূর্জয় আসুক। মিটিং হবে এই ব্যাপারে। এন্ড ওয়ান মোর থিং। ডোন্ট ট্রাস্ট এনিওয়ান এনিমোর। প্রতারক আমাদের মধ্যেই আছে। “
__________
দীর্ঘ পথটা গাড়ির তুমুল গতির দরুন অতী স্বল্প সময়েই পাড় করে এসেছে দূর্জয়। বাড়ির সীমানার কাছে আসতেই সে গাড়িটা ব্রেক কষে দ্রুত পায়ে শূন্য উঠোন পেরিয়ে দরজার কাছে পৌঁছায়। শক্ত কাঠের তৈরী দরজাটার উপর কেমন ঝড় গিয়েছে তা ভাঙা লকটা দেখেই স্পষ্ট আন্দাজ করা যাচ্ছে। দূর্জয়ের শরীর অজানা আশঙ্কায় ছমছমে অনুভব করে। বিদঘুটে আবহাওয়াকে পিছনে ফেলে সে ঘড়ের ভেতর পা রাখে। পুরো ঘরটা অন্ধকারে নিমজ্জিত। দূর্জয় হাত বাড়িয়ে লিভিং রুম এবং ডাইনিং রুমের লাইটটা জ্বালায়। সতর্ক দৃষ্টি মেলে চারিদিকটা পরখ করে। উঁহু। সব ঠিকঠাক আছে। ধুকপুক করতে থাকা বুক নিয়ে এবার দূর্জয় ধীর পায়ে বাণীর থাকার রুমটার দিকে পা বাড়ায়।
রুমের দরজার কাছে পা রাখতেই আকাশটা তীব্র গর্জন করে ঝিলিক দিয়ে দিনের আলোর মতো চারিদিকটা ফর্সা করে তুলে। সেই আলোটা রুমের জানালা ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করে রুমটা আলোকিত করে তুলে ক্ষনিকের জন্য। মুহুর্তেই রুমটা ফের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। সেই ক্ষনিক বজ্রপাতের মুহুর্তে রুমের যেই দশা দূর্জয়ের সামনে ভেসে উঠে তা দেখে তার রক্ত হিম হয়ে আসার কথা। কিন্তু সেরকম কিছু হয় না। বরং দূর্জয় রুমের লাইটটাও জ্বেলে দিয়ে ফের দেখে রুমটাকে। এলোমেলো বিছানার চাদর, ভাঙা আসবাবপত্র, মেঝেতে পড়ে থাকা ফল কাটার ছুরি এবং কয়েক বিন্দু তাজা রক্ত। যেনো কোনো ধ্বংসলীলা চলেছে এই রুমে।
পরিস্থিতি আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না দূর্জয়ের। তার দৃষ্টি স্থির মেঝেতে পড়ে থাকা ছুরি এবং রক্তের পানে। বাণী যে প্রতিরক্ষার চেষ্টা করেছিলো তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ এই ছুরিটা। কিন্তু ছুরিতে লেপ্টে থাকা এবং মেঝেতে পড়ে থাকা সেই বিন্দু বিন্দু রক্ত গুলো কার তা ঠিক জানা নেই দূর্জয়ের। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে মেঝেতে এক হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে দূর্জয়। এক বিন্দু রক্ত নিজের তর্জনী আঙুলের ডগায় তুলে সে-ই পানে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
“ কার রক্ত তুমি? বাণী তালুকদারের নাকি অজ্ঞাত কোনো জানোয়ারের? “
উপরে উপরে দূর্জয় যথেষ্ট ঠান্ডা স্বরে প্রশ্নটুকু উচ্চারণ করলেও ভেতর ভেতর তার হৃদযন্ত্র উন্মাদ আচরণ করছে। হিরণ নামক ওই কালটাকে কখনো দেখে নি দূর্জয়। তবুও লোকটার প্রতি এক বুক ঘৃণা মনে পুষে রেখেছে সে। কাপুরুষটা আবার বাণীর সঙ্গে কি করতে পারে সেই আশংকা ক্ষণে ক্ষণেই দূর্জয়কে নিস্তেজ করে তুলছে। সেই নিস্তেজ ভাবটা কিছু মুহুর্তের জন্য তার মস্তিষ্কেও হানা দেয়। তাইতো সে ভুলে বসে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা পয়েন্ট। কিন্তু হঠাৎ তা মনে পড়তেই সে দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। ত্রস্ত পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে তাকায় বাড়ির পূর্ব পাশের দেয়ালাটার দিকে। সাদা দেয়ালটা আড়াল হয়ে আছে সাদা এবং গোলাপি বাগানবিলাসের বিস্তৃত ডাল পালার ফলে। সেই ডাল পালার মধ্যেই অতি সাবধানে এবং আড়ালে লুকায়িত আছে একটা সিসিটিভি ক্যামেরা যা এক সপ্তাহ পূর্বেই দূর্জয়ের আদেশে ইন্সটল করা হয়েছে। এই সিসিটিভি ক্যামেরাই এখন শেষ ভরসা। এর সাহায্যে হিরণ পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হলেই কেবল বাণী মিলবে।
ভাবনাটুকু মস্তিষ্কে উঁকি দিতেই আচমকা বাড়ির পেছন হতে কিছু শুকনো পাতার মড়মড়ে শব্দ ভেসে আসে। দূর্জয় সতর্ক হয়। কালো রঙের পিস্তলটা হাতে নিয়ে সাবধানের সহিত সে বাড়ির পিছন দিকে পৌঁছায়। কিন্তু মাটির উপর মাথা চেপে ইলিয়াসকে উঠে বসতে দেখেই সে ডাকে,
“ ইলিয়াস! “
আচমকা দূর্জয়ের কণ্ঠ শুনে ইলিয়াস বহু কষ্টে ভারী মাথা নিয়ে চোখ তুলে তাকায়। অত:পর অপরাধী গলায় বলে,
“ স্যার, আ’ম সরি। কিছু বুঝে উঠার আগেই কেউ পিছন থেকে জোরে মাথায় আঘাত করে। আর কিছু মনে নেই আমার। ম্যাম ঠিক আছেন? “
“ ও নেই। “
__________
ঝপঝপিয়ে বৃষ্টি নেমেছে ধারাপটে। গাড়ির ফ্রন্ট সিটে নীরবে বসে থাকা বাণীর মাথা নত। বুকটা শঙ্কায় দুরুদুরু করছে। হিরণ তাকে বাড়িতে না নিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছে এই চিন্তাটা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। এই অন্য কোথাওটা কোথায় তা বাণীর জানা নেই। তবে সে নিশ্চিত হিরণ এতো কিছুর পর বাণীকে আস্ত রাখবে না। এই মুহুর্তে বাসায় গেলে যে বহ্নি বাণীর বুকে লেপ্টে রবে তা হিরণ ভালো করেই জানে। তাই হয়তো নিজের খায়েশ মেটানোর জন্যই এই অন্য কোথাও এর আবির্ভাব। বহ্নি যেনো হিরণের আক্রোশের মাঝে বাধা না হতে পারে সেজন্য এই অভিনব পদ্ধতি।
দীর্ঘ হাইওয়ে এবং জঙ্গলের ন্যায় জায়গা পেরিয়ে একটা দো তলা বাসার সামনে এসে গাড়ি থামায় হিরণ। মূল শহর থেকে দূরে শুনসান নীরবতায় আচ্ছন্ন জায়গার মধ্যে এই বাড়িটি হিরণের ব্যক্তিগত প্রোপার্টির অংশ। বৃষ্টি হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য গাড়ির সামনে স্টোর বক্সের ভেতর একটা ছাতা সবসময় মজুদ থাকে। সেখান থেকে কালো রঙা ছাতাটা হাতে নিয়ে তা মেলে গাড়ি ছেড়ে নামে হিরণ। অপর পাশে গিয়ে নীরবে গাড়ির দরজা খুলে ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে রয়। অপেক্ষা করে বাণীর বেরিয়ে আসার।
বাণী সময় নেয়। মনকে বুঝ দেয় কেউ তাকে বাঁচাতে আসবে না। কোনো পথ খোলা নেই তার কাছে। আরো একবার হিরণের কাছে বন্দী সে। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বাণী ঝিম ধরা শরীরটাকে টেনে গাড়ি ছেড়ে নামে। হিরণের ধরে রাখা মাথার উপরের ছাতাটাকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে সে এলোমেলো পায়ে বাড়ির পথে হাঁটা ধরে। লম্বা শাড়ির আঁচলটা মাটিতে লুটিয়ে রয়েছে। বাণীর এমন বেখাপ্পা হাঁটার ধরণ দেখে হিরণ দ্রুত গাড়ির দরজা আটকে পায়ের গতি বাড়ায়। এগিয়ে গিয়ে শাড়ির আঁচলটা পিছন হতে নিজের হাতে তুলে নেয়। হাত বাড়িয়ে ছাতাটা আরেকটু মেলে বাণীর মাথার উপর ধরে। বাণী একটুও টু শব্দ করে না। নির্দিষ্ট ব্যসের ছাতাটা বাণীর উপর ধরার ফলস্বরূপ হিরণ বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পায় না। কাকভেজা হয়ে ঘরে প্রবেশ করে।
ঘরে পা রাখতেই বাণী অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে,
“ শাস্তির পালা তাই-না? শাস্তি হিসেবে আমাকে চাই তাই তো? কি করবো? উপরে যাবো নাকি এখানেই? বলুন। কৃতদাসীর জন্য আজ কি অপেক্ষা করছে জানতে আগ্রহী আমি। “
মলিন মুখের ঠান্ডা স্বরটা হিরণ নীরবে শুনে। অত:পর দরজা লক করে হাতের ভেজা ছাতাটা ফ্লোরের উপর রেখে বাণীর দিকে এগিয়ে যায়। বাণী নিশ্চল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়। হিরণ এসে কোনো কথা না বলে বাণীকে পাজাকোলে তুলে উপরের দিকে হাঁটা ধরে। বাণী বাধা দেয় না। ইঞ্জিন চালিত রোবটের ন্যায় নীরব রয়। উপরতলার তিনটি বেড রুমের কেবল একটাতেই প্রয়োজনীয় ফার্নিচার রয়েছে। সেই রুমটাতেই বাণীকে নিয়ে প্রবেশ করে হিরণ। বাণীকে বিছানায় নামিয়ে দরজাটা লক করে দেয়। অত:পর ভেজা কাপড়েই লেদারের সিঙ্গেল সোফাটায় গিয়ে বসে। দৃষ্টি তার বাণীর দিকে নিবদ্ধ।
বিছানার উপর পা তুলে হাঁটু মুড়ে বসে রয়েছে দৃষ্টি নত করে রাখা দেহের মালিক। মলিন মুখটা তুলে এক মুহুর্তের জন্য তাকাচ্ছে না হিরণের পানে। হিরণ সেই আশা রাখেও না। নিজের উপর হিরণের স্থির দৃষ্টি না তাকিয়েও অনুভব করতে পারছে বাণী। আর যতবার এই ব্যাপারটা উপলব্ধি করছে ততবারই সে শরীরটা আরো গুটিয়ে নিচ্ছে। সময় গড়ায়। বাণীও মাথা তুলে তাকায় না আর হিরণও নিজের দৃষ্টি ফেরায় না৷ এতক্ষণ ধরে বাণী পাথর বনে থাকলেও ধীরে ধীরে তার স্বত্বা নরম রূপ ধারণ করে। নিজের প্রতি আফসোসে তার বুক ফেটে কান্না পায়। সেই কান্না দমানোর চেষ্টায় সে নিজের ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রাখে। কিন্তু তাতেও লাভ হয় না। উল্টো তাতে ঠোঁট জোড়া তার টলমল চোখের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মৃদু কেঁপে কেঁপে ওঠে। বিষন্ন অনুভূতি যখন সহ্য সীমার বাহিরে চলে যায় তখন দুঃখগুলো নোনাপানি হয়ে টপটপ করে চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসে। অশ্রুসিক্ত দৃষ্টি নত রেখেই বাণী অস্ফুটে বলে উঠে,
“ মেরে ফেলুন তবুও আমাকে আর ছুঁবেন না প্লিজ। “
হিরণ এতক্ষণ বাণীকে পরখ করতে করতে ঘোরে ডুব দিয়েছিলো। বাণীর কণ্ঠস্বর তার কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই সে বলে উঠে,
“ হু? “
বাণী একইভাবে দৃষ্টি নত রেখেই শব্দহীন কান্নার দমকে কম্পিত স্বরে বলে,
“ আই হেট মাইসেল্ফ বিকজ অফ ইউ। নিজেকে আপনার থেকে বাঁচাতে না পারার যন্ত্রণায় আমার নিঃশ্বাস আটকে আসছে। দয়া করুন। ডোন্ট টাচ মি এগেইন। “
শেষের কথাটুকু বলার সময় বাণী ফুপিয়ে উঠে। হিরণ কিছু বলে না। নীরবে উঠে যায়। নিচ থেকে একটা কাঁচের গ্লাসভর্তি পানি এনে তা বাণীর দিকে এগিয়ে ধরতেই বাণী ক্ষুব্ধ হয়। তীব্র ঘৃণা ভরা ক্রোধে সে সেই গ্লাসটা হাতে নিয়ে সজোরে ছুড়ে মারে হিরণের দিকে। আক্রোশ মিশ্রিত স্বরে বলে,
“ দূরে থাকতে বলেছি না? “
আচমকা আক্রমণ সামলে উঠার জন্য হিরণ পাশ ফিরতে নিলেও শেষ রক্ষা হয় না। কাঁচের গ্লাসটা দ্বারা তীব্র বেগে চোখের একপাশে আঘাত লাগে। মুহুর্তেই হিরণের মস্তিষ্ক এক মুহুর্তের জন্য ব্ল্যাক আউট হয়। চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসে। একহাতে চোখের পাশটা চেপে ধরতেই উপলব্ধি করে সেখান থেকে গলগলিয়ে তরল রক্ত বের হচ্ছে। এতদূর টের পেতে না পেতেই পরপর দু তিনটে তীব্র আঘাত ফের অনুভব করে সে পিঠে। বাণী এখনো থামে নি। আঘাত চালিয়ে যাচ্ছে। বিছানার সাইড কেবিনেটের উপর হতে কাঁচের তৈরী যে ক’টা শোপিজ পেয়েছে সবগুলো হিরণের দিকে ছুঁড়ে মেরে চিৎকার করে,
“ আই হেট ইউ। “
এতদূর বলেই সে ত্রস্ত পায়ে বিছানা ছেড়ে নেমে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই হিরণ ঝাপসা চোখ ছেড়ে বাণীকে দরজার সঙ্গে চেপে ধরে। হিসহিসিয়ে বলে,
“ মারো, কাটো যা ইচ্ছা করো। তবে বাহিরে পা দেওয়ার অনুমতি নেই তোমার। “
বাণী দু হাতে হিরণের বুকে ধাক্কা মারে। ক্ষুব্ধ স্বরে শুধায়,
“ মরতে পারেন না আপনি? মরে আমাকে আর আমার মেয়েকে শান্তি দিতে পারেন না? উপরওয়ালা কি আপনাকে দেখে না? “
হিরণ বাণীর চোখের পানে তাকিয়ে রয়। কোনটার যন্ত্রণা বেশি বুঝতে পারছে না? চোখের পাশের ক্ষতটার নাকি বুকের ক্ষতটার? যন্ত্রণাটুকু মনে লুকিয়ে রেখে সে শীতল গলায় প্রশ্ন করে,
“ আমি মরলে খুশি হবে তুমি? “
“ কোনো সন্দেহ আছে তাতে? “
হিরণ সামান্য ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলে,
“ সরি। তোমার এই ইচ্ছেটা পূরণ করা সম্ভব নয়। তোমার জন্য আমি মারতে রাজি আছি, তবে মরতে নয়। বহু কিছু পেরিয়ে তোমাকে পেয়েছি। মরে গেলে আফসোস বুকে রয়ে যাবে। “
বাণী ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন ছুড়ে,
“ আপনি আমায় আদৌ পেয়েছেন? “
চলবে…
এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩২.
ইলিয়াসের কথা মতন বাড়ির সীমানার বাহিরে রাস্তার অপরপাশের ঝোপঝাড়ের আড়ালে কিছুটা খুঁজতেই আহসানকেও চেতনাহীন অবস্থায় খুঁজে পায় দূর্জয়। তাকেও কেউ মাথায় আঘাত করেছিলো। আহত দু’জনকে একটা উবার ডেকে হসপিটালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে সে। অত:পর কাউকে কল করে বলে দরজা জানালার লক ফিক্স করার জন্য লোক সঙ্গে নিয়ে যেনো তার দেওয়া এড্রেসে এসে পৌঁছায়।
মেরামত করার লোক এসে পৌঁছাতেই তাকে কাজে লাগিয়ে নিজের গোপন রুমটায় গিয়ে একটা ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বসে দূর্জয়। দ্রুত ভঙ্গিতে দু হাত চালিয়ে সিসিটিভি ফুটেজের রেকর্ডিংটা ওপেন করে। রেকর্ডিংটা টেনে টেনে দেখতে থাকে সে। আচমকা একটি জায়গায় এসে ভিডিওর প্লে ব্যাক স্পিডটা স্লো করে।
গভীর মনযোগ পূর্ণ দৃষ্টিটা দিয়ে মুখবাধা একজনকে ভালো করে পরখ করে। মুখবাধা লোকটা পিছন থেকে এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা ইলিয়াসের মাথায় প্রথমে আঘাত করে। ইলিয়াস মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই সে কাউকে কল করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির সামনে একটি মাইক্রো গাড়ি এসে থামে সাদা রঙের। গাড়ি হতে নেমে আসে আরো সাত আটজন লোক। প্রত্যেকেই মাস্ক পরিহিত। তারা মিলে ধাক্কিয়ে দরজা ভেঙে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে।
তারপর। তারপর ঠিক নয় মিনিটের মাথায় তিনজন বের হয়ে মাইক্রো তে উঠে বসে। এর পরপরই আরো দুই জন লোক বাণীকে টেনে ঘর থেকে বের করে। দুই বাহু চেপে ধরে তাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যেতে থাকে মাইক্রোর দিকে।
দূর্জয় নীরব দৃষ্টি মেলে দেখে বাণীর যথাসম্ভব প্রতিরোধের চেষ্টা। বাণীর চোখে মুখে ফুটে উঠা ভয় আতংক কোনো কিছুই তার দৃষ্টি এড়ায় না। বাণী আশেপাশে কোনোকিছু না পেয়ে নগ্ন পায়ে উঠোনের মাটি খাবলে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই টানা হেঁচড়ার মাঝে বাণীর শাড়ির আঁচলটা অসাবধানবসত কাধ থেকে পড়ে যায়। অসংলগ্ন দৃশ্যটুকু দেখতেই দূর্জয় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ভিডিও টেনে সামনের দিকে যায় সে। বাণীকে মাইক্রোতে তুলে ফেলার পর তিনটে লোক ফের উঠোনে ফিরে আসে। তাদের মধ্যে একজনের আদেশ মতো বাকি দু’জন ইলিয়াসকে টেনে বাড়ির পিছন দিকে নিয়ে যায়। অতি দ্রুত কাজটা শেষ করেই তারাও সেই মাইক্রোতে চেপে বসে।
দূর্জয় এই পর্যায়ে ভিডিও পজ করে জুম করে মাইক্রোর নাম্বার প্লেটটা দেখার ট্রাই করে। কিন্তু গাড়িটা উঠোনের বাহিরে হওয়ায় নাম্বার প্লেটটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। দূর্জয় ফোন বের করে কারো নাম্বারে কল করে। কলটা রিসিভ হতেই সে স্পষ্ট গলায় আদেশ করে,
“ একটা গাড়ির ছবি পাঠাচ্ছি। নাম্বার প্লেট স্পষ্ট নয়। বিকেল ৫ টা ৩৭ মিনিটের ঘটনা। ইচ্ছানগরের কোন রুট হয়ে গাড়িটা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে সম্পূর্ণ ডিটেইলস আমি জানতে চাই। শহরের সকল রোডের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করো। এজ ফাস্ট এজ পসিবল। আর কেসটা কনফিডেন্সিয়াল। সেই অনুযায়ী কাজ করো। “
__________
সময় রাত ৯ টা ১৩। প্রকৃতিতে তখন চলছে প্রলয়কারী তান্ডব। বাতাসের প্রকোপে ওয়াশরুমের এককোনার ছোট্ট জানালার থাই গ্লাসটা কেমন কেঁপে উঠছে একটু পরপর। নিশী ঝড়ের ডাক এবং জানালার এরকম কেঁপে উঠার শব্দ শুনে মনে হচ্ছে বুঝি কোনো অশরীরী ডাকছে বাহিরে। প্রকৃতি যখন তান্ডবে মত্ত তখন এক ছাট পানি মুখে ছিটিয়ে চোখ তুলে আয়নার পানে তাকায় হিরণ। চোখের পাশে ক্ষত স্থান হতে এখনো তরল রক্ত ঝরছে। সেই রক্ত হিরণের গাল বেয়ে টুপটুপ করে সিংকের উপর পড়ছে। অত:পর পানির কল হতে বহমান পানির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।
হিরণ নীরবে এই দৃশ্যটুকু পরখ করে। এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ফার্স্ট এইড বক্স হতে একটা কাঁচির মাথায় কিছুটা তুলা ছিড়ে তা আটকে সেটা তরল স্যানিটাইজারে ডুবিয়ে আংশিক ভিজিয়ে নেয়। অত:পর কাঁচির সাহায্যে তুলোটা কাঁটা জায়গায় ছোঁয়ায় পরিষ্কারের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে সঙ্গেই কাঁটা জায়গাটা এক প্রকার কামড়ে জ্বলে উঠে। কিন্তু হিরণ সেই যন্ত্রণাটুকু অবলীলায় সহ্য করে নেয়৷ টু শব্দও করে না। এসব সামান্য কাঁটা ছেড়া তাকে যন্ত্রণা দিতে সক্ষম নয়। উল্টো বাণীর থেকে পাওয়া প্রতিটি আঘাতকেও হিরণ স্বযত্নে লালন করে। সেগুলোর দাগ শরীরে বয়ে বেড়ানোর মাঝেও সে শান্তি পায়।
চোখের পাশের ক্ষতটা পরিষ্কার করে সেখানে আপাততর জন্য ব্যান্ডেজ করে নেয় হিরণ। এই কাজটুকু শেষ করে হাত ধোয়ার জন্য সিংকের সামনে সামান্য ঝুকতে নিলেই পিঠে কিছুটা জ্বালা অনুভব করে সে। সঙ্গে সঙ্গে সে একপাশে ফিরে আয়নার পানে তাকিয়ে দেখে হালকা আকাশি রঙা শার্টের পিছনের দিকটা ভেদ করে লাল রক্ত দেখা যাচ্ছে। হিরণের মনে পড়ে যায় যে বাণী রাগের বশে যখন কাঁচের শোপিজ গুলো ছুড়ছিলো সেগুলো এসে তার পিঠে লেগেছিলো। এতক্ষণ পিঠের দিকে হিরণের মনযোগ ছিলো না বিধায় খেয়াল করে নি সে। কিন্তু এখন খেয়াল হতেই সঙ্গে সঙ্গে সে গায়ের শার্টটা খুলে ফেলে। যতদূর সম্ভব পিঠের ক্ষতটাও পরিষ্কার করে নেয় সে।
ফ্রেশ হয়ে অর্ধ উদোম দেহ নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই হিরণ আগে একপল বিছানায় বসে থাকা শাড়ি পরিহিতা নারীকে দেখে নেয়। দেখে নিজের চোখ দুটো জুড়ায়। কলা পাতার ন্যায় সরু দেহতে হালকা জারুল ও সাদা রঙের মিশেলের শাড়িটা খুব মানিয়েছে। হিরণের মনের কোণে এক সুপ্ত ইচ্ছে ছিলো জীবনে একবার অন্তত বাণীকে শাড়িতে দেখার। কিন্তু মুখ ফুটে সেই ইচ্ছের কথা কখনো প্রকাশ করা হয় নি তার। আর আজ যখন সেই ইচ্ছে পূরণ হয়েছে তখন চোখ ফেরানো দায়। হুট করে হিরণের খুব জানতে মনে চায়, কে সেই ব্যক্তি যার কথায় বাণী শাড়ি পড়েছে?
বাণী ঘাড় ঘুরিয়ে হিরণকে দেখে। দৃষ্টি স্থির হয় হিরণের চোখের পাশে কাটা জায়গাটায়। সঙ্গে সঙ্গে তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠে। পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করে সে। বাণীর হাসি দেখে হিরণ নীরবে সোফায় গিয়ে বসে। এই হাসিটুকু দেখার জন্য আরো হাজারটা ঘাত সহ্য করতে রাজি আছে সে। প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে সে একজনকে কল করে। কাটকাট গলায় প্রশ্ন করে,
“ কোথায়? “
“ বহ্নি ঘুমিয়েছে? “
এতদূর শুনতেই বাণী নিশ্চিত হয় ফোনের অপরপাশের ব্যক্তিটা ইবাত। হিরণ আবারও প্রশ্ন করে,
“ শমসের মজুমদারের ব্যবস্থা করা হয়েছে? “
“ তোমার ম্যাডামের সাহায্যকারীর নাম পরিচয় বের করো ওর পেট থেকে। “
এতটুকু শুনতেই বাণী বিস্ফোরিত দৃষ্টি মেলে তাকায়। হিরণও বাণীর দিকে তাকিয়ে ছিলো। বাণীকে এমনভাবে তাকাতে দেখে ও সামান্য হাসে। সেই হাসি দেখে বাণীর গা জ্বলে যায়। হিরণ ফোন রাখতেই বাণী বলে উঠে,
“ কেউ সাহায্য করে নি আমাকে। “
হিরণ ফোন চালাতে চালাতে জবাব দেয়,
“ আচ্ছা। “
হিরণ যে বাণীর কথা বিশ্বাস করে নি তা বাণী ভালো করেই জানে। সে আবার চেঁচিয়ে উঠে,
“ বললাম তো আমাকে কেউ সাহায্য করে নি। “
হিরণ একই ভঙ্গিতে বলে,
“ আচ্ছা। “
বাণী এবার ক্ষুব্ধ স্বরে বলে,
“ বিশ্বাস করছেন না কেনো আমাকে? “
হিরণ ফোনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই জবাব দেয়,
“ ঘুমাও বাণী। “
বাণী হিরণের কথার তোয়াক্কা করে না। সে ক্ষোভ মিশ্রিত দৃষ্টি নিয়ে হিরণের পানে তাকিয়ে রয়। হিরণ এবার ফোন রেখে চোখ তুলে তাকায়। স্বাভাবিক গলায় বলে,
“ পালানোর আগে এবং কারো সাহায্য নেওয়ার আগে ভাবা উচিত ছিলো তোমার। এর দায়ভার আমার না। “
বাণী ক্রুদ্ধ স্বরে বলে,
“ ঘৃণা করি আপনাকে। “
হিরণ হাসে। হেসে বলে,
“ এক এক করে আমাকে ঘৃণা করার কারণ গুলো বলো তো। গুণে দেখি তোমার কাছে আমাকে ঘৃণা করার কয়টা কারণ রয়েছে। “
বাণী সঙ্গে সঙ্গে বলতে শুরু করে,
“ আমার ভাইয়ের খুনি হিসেবে আপনাকে ঘৃণা করি। “
হিরণ হাতের আঙুলের সাহায্যে কারণ গণনা শুরু করে।
“ আমাকে জোর করে বন্দী করে রাখার জন্য আপনাকে ঘৃণা করি। “
“ আনিসুজ্জামান তালুকদারের থেকে আমাকে পণ্যের মতো কিনে নেওয়ার কারণে আপনাকে ঘৃণা করি আমি। “
“ আপনার লাইফস্টাইলের জন্য আপনাকে ঘৃণা করি আমি। “
“ ঘরের বাহিরে আপনার অনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য আপনাকে ঘৃণা করি আমি। “
“ কাফের আপনি। রবের অস্তিত্বে বিশ্বাস নেই আপনার। তাই ঘৃণা করি। “
“ আর… আর আমাকে যেই দুইবার রেপ করেছেন সেজন্য ঘৃণা করি। “
এতদূর বলে বাণী আর বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে থাকে সে। হিরণ অবাক হয়ে বলে,
“ মাত্র সাতটা কারণ? আমি ভেবেছি হাজারটা কারণের লিস্ট ধরিয়ে দিবে তুমি। “
বাণীর কাছে হিরণকে ঘৃণা করার অগণিত কারণ রয়েছে। কিন্তু আপাতত এই কয়েকটা কারণ বলেই সে নীরব হয়ে গিয়েছে। আর কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না তার। হিরণ এবার হেসে বলে,
“ তোমার কাছে আমাকে ঘৃণা করার জন্য সাতটা কারণ রয়েছে। অথচ আমার তোমাকে ভালোবাসার পিছনে কোনো কারণ নেই। কি অদ্ভুৎ! “
বাণীর এসব কথা শোনার আর ধৈর্য্য নেই। সে একটা কাথা টেনে মাথা পর্যন্ত ঢেকে শুয়ে পড়ে। মনে নতুন ভয় হানা দিয়েছে তার। ওই শমসের নামক লোকটা যদি মুখ খুলে? দুঃশ্চিন্তা বাণীর বুক কামড়ে ধরে। আরো একবার সে কারো বিপদের কারণ হতে রাজি না। আরো একবার সে কারো মৃত্যুর কারণ হতে রাজি না।
__________
হেডকোয়ার্টারে পৌঁছাতেই দূর্জয়কে জুলফিকারের কেবিনে ডাকা হয়। দূর্জয় কেবিনে প্রবেশ করতেই দেখে সেখানে আগে থেকেই সাইফ,সাদাত, ফারদিন, জুনায়েদ উপস্থিত রয়েছে। দূর্জয়কে দেখতেই জুলফিকার থমথমে গলায় বলে,
“ সেল নং এ থ্রি তে থাকা টেরোরিস্টদের একজনের ডেথ হয়েছে। “
দূর্জয় কপাল কুচকে তাকায়। এটাই সেই ইমারজেন্সি কেস? হুট করে একজন বন্দী টেরোরিস্টের মৃত্যু? বিষয়টা শুনতে যতটা স্বাভাবিক লাগছে বাস্তবিকভাবে ততটা স্বাভাবিক নয় তা দূর্জয় নিশ্চিত। সে আগ্রহী দৃষ্টি নিয়ে তাকাতেই জুলফিকার ফের বলে উঠে,
“ ওই টেরোরিস্ট মুখ খুলতে রাজি হয়েছিলো। তবে ওর শর্ত ছিলো শুধু আমাকেই ও সবটা জানাবে। কিন্তু আমি সেলে পৌঁছে ওকে মৃত অবস্থায় পাই। ক্যান ইউ গেস দ্যা সিচুয়েশন দূর্জয়? “
দূর্জয় অকপটে বলে উঠে,
“ কেউ একজন চায় না আমরা কিছু জানতে পারি। “
এতটুকু বলেই দূর্জয় ভাবুক স্বরে বলে,
“ আর সেই কেউ একজনটা আমাদের মধ্যেই কেউ। “
সাইফ ভনিতা ছাড়া বলে উঠে,
“ স্যার আ’ম সরি। কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনো একজন প্রতারক হলে আমি সন্দেহের তালিকায় সর্বপ্রথমে কর্নেল জুবায়ের শিকদার স্যারকে রাখবো। উনার আচরণ এবং এই কেস রিলেটেড বিভিন্ন ডিসিশন অত্যন্ত সন্দেহজনক। “
জুলফিকার এবং দূর্জয় নীরবে সাইফের কথা শুনে। তারা এই ব্যাপারে কোনো প্রতিবাদ করে না কারণ তাদের মাথায়ও সন্দেহের তালিকায় প্রথম এই নামটাই এসেছে। সাদাত বলে,
“ আমি লেফটেন্যান্ট সাইফের সঙ্গে একমত। “
জুলফিকার গলা ঝেড়ে বলে উঠে,
“ মোদ্দা কথা হলো এখন কাউকেই সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা যাবে না। এই অপারেশন রিলেটেড প্রতিটা ইনফরমেশন এখন নিজেদের মধ্যেও কনফিডেন্সিয়াল রাখতে হবে আমাদের। গুরুত্বপূর্ণ সকল ইনফরমেশন সবার আগে আমি অথবা মেজর দূর্জয় ছাড়া অন্য কাউকে জানাবে না। “
সাইফ প্রশ্ন করে,
“ স্যার প্রতারক কে সেটা আগে জানা কি বেশি গুরুত্বপূর্ণ না? “
দূর্জয় স্থির গলায় বলে,
“ একটা উপায় আছে। “
জুলফিকার প্রশ্ন করে,
“ কি? “
দূর্জয় শুধু শান্ত গলায় বলে,
“ সময়মতো প্ল্যান জানিয়ে দিবো সবাইকে। “
এক এক করে সবাই জুলফিকারের কেবিন থেকে প্রস্থান করলে দূর্জয়ও বেরোনোর জন্য পা বাড়ায়। জুলফিকার সেই মুহুর্তে তাকে পিছু ডাকে,
“ আই নিড টু টক টু ইউ দূর্জয়। “
__________
ফিনফিনে বাতাস বইছে চারিদিকে। তেরো তলা উঁচু দালানের ছাদ হতে রাতের টিমটিমে আলোর শহরটা দেখছে একজোড়া চোখ। এইতো আর কিছুক্ষণ। তারপরই এই দালানের নীরবতা ভেঙে যাবে। সবাই মিলে হন্যি হয়ে খুঁজে বেড়াবে এক পাগলকে। পাগলই তো। একা একা কথা বলা, হুটহাট তীব্র ভয়ে মিইয়ে যাওয়া, বিষন্ন মনে সারাদিন চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী থাকাটা হয়তো পাগলেরই লক্ষ্মণ। নাহয় কি সবাই মিলে তাকে বারবার ধরে বেধে ওই সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিতো?
পাতলা টপের উপর কালো জ্যাকেট আর একটা প্লাজো পরিহিত নারী কায়া নির্ভীক ভঙ্গিতে ছাদের রেলিঙে বসে এসবই ভাবছিলো। হুট করে এক দমকা হাওয়া এসে তাকে ছুঁয়ে যায়। খুলে রাখা চোখ জোড়া সঙ্গে সঙ্গে বুজে আসে। চোখের সামনে ভেসে উঠে অতীত। যেইবার সে প্রথম ও শেষবারের মতো সিনেমা দেখতে হলে গিয়েছিলো। সঙ্গে ছিলো ওই প্রেমিক রূপী প্রতারক।
সিনেপ্লেক্সে তখন ২০১৩ সালে রিলিজ প্রাপ্ত সিনেমা আশিকী ২ এর জন্য উপচে পড়া ভীড়। ১০ বছর আগে রিলিজ প্রাপ্ত একটা রোম্যান্টিক সিনেমার এতো হাইপ দেখে সাইন্স ফিকশন জনরা প্রেমী রুহী খুব কৌতূহলী ছিলো। এতো ভীড়ের মধ্যে আব্রাহাম তার হাত চেপে কোল-ড্রিংকস সহ হাবিজাবি কিনে সিনেমা হলে প্রবেশ করেছিলো। মুভি চলমান অবস্থায় আব্রাহাম কেবল একবার বলেছিলো এই মুভির জিউকবক্স তার খুব প্রিয়। সেদিন রাতেই রুহী নিজের ফোনে আশিকী ২ এর সম্পূর্ণ জিউকবক্স ডাউনলোড করে ফেলে। সেই জিউকবক্স প্রেমী রুহীর জীবনে আর না থাকলেও জিউকবক্সটা এখনো তার ফোনে রয়ে গিয়েছে।
অতীতের ভাবনা ছেড়ে রুহী বর্তমানে ফিরে। চোখ খুলে ফোনটা হাতে নিয়ে ডাউনলোড লিস্ট হতে আব্রাহামের প্রিয় জিউকবক্স প্লে করে নীরবে বসে রয়। আচমকা নিজের পাশে কারো অস্তিত্ব টের পেতেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। তার থেকে একহাত দূরেই রেলিঙের উপর কালো টি শার্ট পরিহিত এক যুবক বসে রয়েছে। যুবকের দৃষ্টি রুহীর পানেই নিবদ্ধ। মুখভঙ্গি নির্লিপ্ত। রুহী সেই নির্লিপ্ত মুখপানে চেয়ে রয় অনেকটাক্ষণ। দু’জনের মধ্যে এক অসীম শূন্যতা সম দূরত্ব। যেই দূরত্বটা কেবল এক বিষন্নতার সুতোয় দু’জনকে বেঁধে রেখেছে। রুহী মলিন গলায় প্রশ্ন করে,
“ আমি কি পাগল হয়ে গিয়েছি? “
নিষ্ঠুর যুবক নিরুত্তর রয়। রুহী উত্তরের অপেক্ষা করে না। সে আপনমনে বলতে থাকে,
“ আম্মু আব্বু শুধু বলে আমি অসুস্থ। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গেলেই নাকি সুস্থ হয়ে যাবো। কিন্তু আমি তো জানি আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। “
এবারও সেই যুবক নিরুত্তর রয়। রুহী এবার কণ্ঠে গোপন দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে,
“ প্রতারণা করাটা কি খুব জরুরী ছিলো? “
নিষ্প্রভ কণ্ঠে শেষ প্রশ্নটা করে রুহী,
“ সত্যিই কখনো ভালোবাসো নি? “
প্রশ্নটা করার সময় এক করুণ যন্ত্রণা রুহীর হৃদয়ে উথাল-পাতাল ঢেউ তুলে। অস্তিত্বহীন এই যুবকের অস্তিত্ব তাকে ক্ষণে ক্ষণে মনে করিয়ে দেয় সে খুব ঠকেছে। আর এই ঠকানোর দায় বুকে নিয়ে যুবকটা পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেলো। রুহীর শেষ প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই যুবকটা ফের হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। রুহী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরবে রেলিঙের উপর উঠে দাঁড়ায়। তার একটা গোপন ক্ষত রয়েছে। ঠকে যাওয়ার ক্ষত। এই ক্ষত কখনো সেরে উঠবে না তা রুহী ভালো করেই জানে। কিন্তু এই ক্ষত বয়ে বেড়ানোও আর তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তাইতো জীবনের সঙ্গে সন্ধির ব্যবচ্ছেদ ঘটাতে সে কেবল এক কদম বাড়ায়। পিছনে ফেলে যায় ফোনে প্লে করা গানের বিষন্ন সুর।
“ খিলেঙ্গি যাহা, বাহারে সাভি
মুঝে তু ওয়াহা, পায়েগা
রাহেগি যাহা, হামারি ওয়াফা
মুঝে তু ওয়াহা, পায়েগা।
মিলুঙ্গা মে ইস তারাহ, ভাদা রাহা
রাহুঙ্গা সাঙ্গ মে সাদা, ভাদা রাহা
তুঝে জিনা হে মেরে বিনা। “
চলবে…
এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৩.
তিন ঘন্টা ধরে চলমান তুফানি বৃষ্টির ফলে প্রকৃতির ভ্যাপসা গরমটা হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। বাতাসে বয়ে বেড়াচ্ছে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ। থমথমে, নীরব রুমটায় সবেমাত্র ফিরলো সাইফ। সারাদিনের ক্লান্তির লেশমাত্র তার চেহারায় লক্ষ্যনীয় নয়। ফ্রেশ না হয়েই সে বিছানায় গিয়ে হেলান দিয়ে বসলো। সাদাত এই মুহুর্তে রুমে উপস্থিত থাকলে এই নিয়ে একশোটা কথা শোনাতো তাকে। কিন্তু সাদাত মেসের বাহিরে থাকায় এই মুহুর্তে তাকে জ্ঞান বিলিয়ে বিরক্ত করার মতো কেউই নেই।
বালিশে পিঠ এলিয়ে দিয়ে সাইফ ফোনের ডাটা অন করে। সঙ্গে সঙ্গে তার নোটিফিকেশন বার টুংটুং শব্দ করে জানান দেয় ইয়াসমিন মুজতবা হতে পাঠানো খুদেবার্তার। সাইফ নিশার পাঠানো ম্যাসেজ ওপেন করে। সকাল ১১ টার দিকে একটা ছবি পাঠিয়েছে। মা মেয়ের হাস্যজ্বল ছবি। ছবির সঙ্গে একটা ছোট্ট ম্যাসেজও লিখতে ভুলে নি,
“ গেস হোয়াট! আম্মু এসেছে। আ’ম সো হ্যাপি রাইট নাও। “
ম্যাসেজের সঙ্গে দাঁত বের করে হাসার এক ইমোজি। সাইফ ম্যাসেজটা দেখে মৃদু হাসে। স্ক্রল করে নিচে যেতেই দেখে আরেকটা ছবি। কাসুন্দি দিয়ে কাঁচা আম মাখার। এটা দুপুর ১২ টার দিকে পাঠিয়েছে। সঙ্গে লিখেছে,
“ আপনি কাসুন্দি দিয়ে কাঁচা আম মাখা খেয়েছেন কখনো? দুর্দান্ত হয়। আমি বারান্দায় বসে মেঘলা আবহাওয়া দেখছি আর আম্মুর হাতে বানানো আম মাখা খাচ্ছি। আপনি খাবেন? “
সাইফ আরো একদফা হাসে। এবার আরেকটু স্ক্রল করতেই সে দেখে শেষ ম্যাসেজটা। যেটা বিকেল ৪ টা বেজে ৩৫ মিনিটে পাঠানো হয়েছে। যেখানে নিশা লিখেছে,
“ আম্মু চলে গিয়েছে। আবার একা হয়ে গিয়েছি। “
সাইফ এবার ম্যাসেজের রিপ্লাই দেয়,
“ আপনার মন খারাপ মিস ইয়াসমিন? “
নিশা অনলাইনেই ছিলো। সে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ম্যাসেজটা সিন করে রিপ্লাই করলো,
“ আপনি ফ্রি আছেন? একটু ভিডিও কলে আসবেন? এক্ষুনি! “
সাইফ ম্যাসেজটা পড়ে সামান্য অবাক হয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেলের ভীতু মেয়ে এমন জরুরি তলবে তাকে কেন ভিডিও কলে আসতে বলছে? সাইফ আচ্ছা লিখে রিপ্লাই দিয়ে সামান্য সোজা হয়ে বসে। পরপর নিজেই ভিডিও কল দেয়। নিশা তৎক্ষণাৎ কলটা রিসিভ করতেই সাইফ ফোনের স্ক্রিনে দেখতে পায় একটা হাস্যজ্বল রমণীর মুখশ্রী। মাথার অর্ধেক চুলগুলো পিছনের দিকে নিয়ে খুব সম্ভবত ক্লাচার দিয়ে আটকানো। উজ্জ্বল মুখখানি একগাল হেসে বলে উঠে,
“ আপনাকে একটা জিনিস দেখাবো। “
কথাটুকু বলেই নিশা ব্যাক ক্যামেরা অন করে। লম্বাকৃতির আয়নায় দেখা যায় ফতুয়া এবং স্কার্ট পরিহিত এক নারী কায়া। যে ধীর গতিতে হেঁটে সামনের দিকে আগাচ্ছে। সাইফ দৃশ্যটুকু মনযোগ দিয়ে দেখে। পরপরই সে চাপা স্বরে চেঁচিয়ে উঠে,
“ ইয়াসমিন। ফাইনালি! “
নিশাও খুশিতে চেঁচিয়ে বলে,
“ ইয়েস। আমার খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে। “
সাইফ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠে,
“ ডোন্ট! এতো দ্রুত লাফঝাপ করার পারমিশন কি ফিজিওথেরাপিস্ট আপনাকে দিয়েছে? “
“ উঁহু। কথার কথা বললাম আরকি। আম্মু যাওয়ার পর একা বাসায় বোর হচ্ছিলাম। কি মনে করে একা একা চেষ্টা করতে গিয়ে দেখি নিজে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছি। দেয়ালের সাপোর্ট নিয়ে হাঁটতেও পারছি ধীরে ধীরে। দ্যা ফিজিওথেরাপি ওয়ার্কড ফাইনালি। এই অত্যাধিক খুশির খবরটা কাউকে জানাতে না পেরে পেট ব্যথা করছিলো। আপনাকেই প্রথম জানালাম। উফ! এক্সাইটমেন্ট চেপে রাখা এতো কষ্টকর কাজ! “
নিশা একনাগাড়ে কথা গুলো বলে থামে। সাইফের আচমকা বুক কেঁপে উঠে। চব্বিশ বছরের এই জীবনে এই ধরনের অভিজ্ঞতা তার প্রথম। কারো খুশির খবরের প্রথম ভাগিদার সে। খুব ছোট্ট এবং সাধারণ একটা বিষয়। কিন্তু সাইফের মতো শিকড়হীন মানুষের কাছে বিষয়টার গভীরতা অসীম। মুখে কিছু না বললেও তার চোখের কোণে ফুটে উঠলো হাসির রেখা। নিশা ক্যামেরা নিজের দিকে ফিরিয়ে বিছানায় বসে আপনমনে বলে উঠে,
“ আব্বু বাসায় আসুক। আব্বুর সামনে হেঁটে আব্বুকে চমকে দিবো। খুব খুশি হবে। আর আম্মুকেও আগামীকাল যে কোনো মূল্যে এখানে আসার জন্য রাজি করাবো। আম্মুকেও সামনাসামনি হেঁটে দেখাবো। উফ! রুহীটা যে কবে ঠিক হবে। ও দেখলেও খুব হ্যাপি হতো। “
সাইফ নিশার হাস্যজ্বল মুখ দেখে নীরবে। ক্ষনিকের জন্য ভুলে বসে যে ফোনের অপর পাশের এই রমণী তার লেফটেন্যান্ট কর্নেলের একমাত্র মেয়ে। কিন্তু পরপরই তার মনে পড়ে যায় বাস্তবতা। মনে পড়ে যায় নিজেদের মধ্যের বিস্তর ফারাক। সাইফের আকাশ কুসুম ভাবনার মাঝেই নিশা ফোনের স্ক্রিনের পানে তাকায়। মুহুর্তেই নোটিফিকেশন বারে ভেসে উঠা একটা ম্যাসেজ দেখে তার দৃষ্টিতে অবিশ্বাস খেলে যায়। সেই দৃশ্য সাইফের দৃষ্টি এড়ায় না। সে কোনো প্রশ্ন করার পূর্বেই নিশা হাত থেকে ফোনটা ফেলে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠে। দ্রুত ছুটে যায় রুমের বাহিরে। সাইফ ব্যস্ত হয়। গলায় একরাশ চিন্তা ঢেলে দিয়ে চেঁচিয়ে প্রশ্ন করে,
“ ইয়াসমিন? ঠিক আছেন আপনি? ইয়াসমিন? শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো?… “
ফোনের অপর পাশ থেকে কোনো জবাব না আসায় সাইফের চিন্তার পরিমাণ গাঢ় হয়। সে হাত ঘড়িটা একবার দেখে নেয়। স্যার তো মেজরের সঙ্গে বেড়িয়েছেন তার জানামতে। বাসায় ফিরতে নিশ্চয়ই দেরি হবে! এমন অবস্থায় যদি ওই ভীতু মেয়েটার কোনো বিপদ হয়ে থাকে? সাইফ আর এক দন্ড অপেক্ষা করে না। ফোন কেটে পকেটে ভরে নিয়ে দ্রুত বের হয়। যাওয়ার পথে জুনায়েদের থেকে বাইকের চাবিটা নিতেও ভুলে না।
__________
ঘড়ির কাটা ছুটে চলেছে অলস ভঙ্গিতে। বিছানায় গুটিসুটি মেরে ঘুমে আচ্ছন্ন নারী হঠাৎ কেঁপে উঠে। স্বপ্নের রাজ্যে তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে তীব্র ভয়। অতীতে তাকে সাহায্যকারী সায়াহ্ন তালুকদারের পরিণতি চারিদিকে আতঙ্ক ভাব ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিষাক্ত, শ্বাসরুদ্ধকর স্বপ্নের ইতি ঘটতেই বাণী ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। ভাইয়ার লাশটা এখনো তার চোখে ভেসে আছে। আতঙ্কে বিভোর বাণীর ঘোর ভাঙে পিঠে কারো আলতো হাতের ছোঁয়ায়। সে চকিতে পাশ ফিরে তাকায়। হিরণের মুখদর্শন হতেই সে চটে উঠে। এক ঝটকায় নিজের পিঠ হতে হিরণের হাত সরিয়ে ফেলে। হিরণ তাতে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। শান্ত গলায় প্রশ্ন করে,
“ খারাপ স্বপ্ন দেখছিলে? “
“ না। বাস্তবতা দেখছিলাম। আপনার আমার ভাইকে খুন করার দৃশ্য স্বপ্ন হয়ে হানা করছিলো আমাকে। “
হিরণ নীরব রয়। কোনো প্রতুত্তর করে না। বাণী সময় নেয় স্থির হতে। অত:পর বলে উঠে,
“ ভাইয়ার মৃত্যুর জন্য কোনো না কোনো ভাবে আমি দায়ী। এই ভাবনাটা আমাকে প্রচন্ড মানসিক পীড়া দেয়। খুব না বড়ো বড়ো কথা বলেন? আমাকে ভালোবাসেন বলে দাবী করেন? তাহলে আমার মানসিক যন্ত্রণা বাড়াতে চাচ্ছেন কেনো? কেনো শুধু শুধু ওই সাহায্যকারীর পরিচয় জানতে চাইছেন? “
“ আমি ক্ষমা করি না বাণী। এসব অযথা সেন্টিমেন্টাল ডায়লগ ছেড়ে আমাকে দূর্বল করার বৃথা চেষ্টা করবে না। কোনো লাভ হবে না। “
বাণীর রাগে নিজেকে জুতোপেটা করতে মন চায়। দূর্জয়ের জীবন আশংকা তাকে এতটাই ভীত করে রেখেছে, যে সে কিনা কোনো দিশা না পেয়ে এই জানোয়ারের কাছে দয়া আশা করছিলো! আশাহত বাণী মনে মনে প্রার্থনা চায়,
“ এই জানোয়ার তো দয়া করবে না রব। তুমি নাহয় করো। আর কার কাছে চাইবো বলো? দূর্জয়কে হিরণের হাত থেকে রক্ষা করো। ওর পরিণতিও যেনো ভাইয়ার মতো না হয়। “
__________
যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটার আবহাওয়া তখন ২০° সেলসিয়াসে স্থির। সকাল সকাল ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ এপ্লাইড সায়েন্স গাজার সামনে সৈন্যরা ত্রাণ বিতরণের ক্যাম্পিং খুলে বসেছে। প্রত্যয়, রাফি, রিদওয়ানও বাকি সৈন্যদের সঙ্গে দায়িত্ব পালনে কর্মরত রয়েছে। লম্বা লাইনে ত্রাণ পাওয়ার আশায় চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করছে অসংখ্য মানুষ। ইতিমধ্যে যারা ত্রাণ পেয়েছে তাদের সবার মুখের অমূল্য হাসি এই বিষন্ন পরিবেশে সৈন্যদের মনে প্রশান্তি এনে দেয়। একজন বয়োবৃদ্ধ লোক তো ত্রাণ হাতে পেয়ে কেঁদেও ফেলেছিলেন। প্রত্যয়ের মতো কাঠখোট্টা মানুষও এমন পরিস্থিতিতে নিজের জড়তা কাটিয়ে লোকটাকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলো। লোকটা অশ্রুসিক্ত গলায় নিজস্ব মাতৃভাষায় প্রত্যয়কে কিছু একটা বলেন। সেই ভাষা প্রত্যয়ের বোধগম্য না হলেও লোকটার চামড়ায় ভাজ পড়া হাতটা যখন তার মাথায় ঠেকে বুলিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তখন তার মনটা ভালো লাগায় ভরে যায়। অনুধাবন করে নিজের মরহুম ভাইয়ের এই পেশার প্রতি এতো টান এবং শ্রদ্ধার কারণ। যা সে কখনোই নিজের মা বাবাকে বুঝাতে পারবেন না।
রিদওয়ান তখন ত্রাণ বিতরণে ব্যস্ত ছিলো। আচমকা একটা দূর্ঘটনায় লাইনচুত্য হয়ে মানুষের শোরগোল শুরু হতেই তার মনযোগ ভঙ্গ হয়। কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে সে সামনে তাকাতেই দেখে কেউ একজন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছুজন। এতদূর দৃশ্য দেখতেই রিদওয়ান ব্যস্ত পায়ে এক বোতল পানি হাতে নিয়ে সেদিকে ছুটে যায়। মানুষের ভীড় ঠেলে কাছে যেতেই সে দেখে ছাই রঙা বোরখা জাতীয় পোশাক পরিহিত এক নারী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রয়েছে। মাথা এবং মুখ তার ওড়নার আড়ালে ঢাকা। রিদওয়ান এক হাঁটু ভেঙে বসে। মেয়েটার মুখের ওপর থেকে ওড়না সড়িয়ে সে দ্রুত সামান্য পানি ছিটকে দেয় তার মুখে। প্রথমবারে কোনো লাভ না হওয়ায় সে আরো কিছুটা পানি হাতে নিয়ে সেই মেয়ের মুখে ছিটিয়ে দেয়। এবার মেয়েটা পিটপিটিয়ে চোখ মেলে তাকায়। চোখ মেলে অপরিচিত কাউকে দেখতেই সে খানিকটা ভীত হয়ে পড়ে। কণ্ঠে ভীত ভাব মিশিয়ে নিজ মাতৃভাষায় প্রশ্ন করে,
“ মান আনতা? “
প্রশ্নটা রিদওয়ানের কানে পৌঁছায় না। তার দৃষ্টি স্থির রমণীর গভীর হালকা নীলাভ চোখ পানে। এরকম রঙের চোখের মানুষ এই প্রথম সরাসরি দেখছে রিদওয়ান। কেমন ভ্যাবলাকান্তের মতো তাকিয়ে দেখছে সে। আশেপাশের স্থানীয়রা ভাবলো ছেলেটা হয়তো তাদের ভাষা না বুঝে এমন বেকুবের মতো তাকিয়ে রয়েছে। তাই তারা নিজ দায়িত্বে মেয়েটাকে বলে যে সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। ভীনদেশী এই সৈন্য তার মুখে পানি ছিটিয়ে তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছে। মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে দূর্বল শরীর টেনে উঠে বসে কৃতজ্ঞতার সহিত বলে উঠে ,
“ শুকরান জাজিলান। “
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার খেয়াল হয় লোকটা ভীনদেশী। তাদের ভাষা তার বোধগম্য হবে না। তাই মেয়েটা ফের বলে উঠে,
“ থ্যাংক ইউ। “
প্রত্যয়, রাফি ততক্ষণে সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। রিদওয়ানকে এমন বোকার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রত্যয় তার কাধে হাত রেখে সামান্য ঝাকিয়ে ডাকে। সঙ্গে সঙ্গে রিদওয়ান স্তম্ভিত ফিরে পায়। নিজের বিস্ময় সামলে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মেয়েটার দিকে সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দিয়ে ইংরেজিতে বলে,
“ উই হেভ আওয়ার মেডিক্যাল সার্ভিস করপস উইথ আস। কাম উইথ আস। “
মেয়েটাকে এই পর্যায়ে সামান্য দ্বিধায় মশগুল দেখা গেলো। কিছু একটা ভেবে সে নিজের ভাষায় বলে উঠে,
“ লা আহতাজ ইলা খিদমাত তিবিয়াতিন। আহতাজ লিবায়েদ আল তাইয়িয়াম ফাকাত। “
মেয়েটার কথা বোধগম্য না হওয়ায় তিন বাংলাদেশী সৈনিকই চোখ সরু করে তাকিয়ে রয়। ভীড়ের মধ্যে থেকে একটা ছেলে ইংরেজিতে ট্রান্সলেশন করে বলে উঠে,
“ ও বলেছে ওর মেডিক্যাল সার্ভিসের প্রয়োজন নেই। ওর শুধু একটু খাবারের প্রয়োজন। “
রিদওয়ান আগ্রহী গলায় প্রশ্ন করে,
“ ইউর নেম? “
এবার মেয়েটা এক শব্দে জবাব দেয়,
“ জারিয়াহ। “
__________
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মায়ের কোলে মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে আছে নিশা। নাঈমা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে ব্যস্ত। মেয়েকে কি বলে শান্তনা দিবেন সেই ভাষা তার জানা নেই। শান্তনার কোনো ভাষা না পেয়ে তিনি অসহায় দৃষ্টি মেলে জুলফিকারের পানে তাকায়। রুমের এককোণে নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলো জুলফিকার। মেয়ের দুঃখের গভীরতা সম্পর্কে তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম। অতীতে তিনিও নিজের ভাই সমতুল্য বন্ধুকে হারিয়েছেন। ঠিক চোখের সামনে। বন্ধু জীবন তৃষ্ণায় ছটফট করছিলো। জুলফিকার নিরুপায় ছিলেন তখন। যুদ্ধের ময়দানে বন্ধুকে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হয় নি।
আজ এতো বছর পর তার মেয়েও একই যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে দিচ্ছে। নিউজ চ্যানেলে রাজধানীর বহুতল ভবন থেকে এক রমণীর ঝাপিয়ে আত্মহত্যা করার খবর পাওয়ার পর থেকেই মেয়েটা এমন ফুপিয়ে কাঁদছে। বারবার আফসোসের সুরে বলছে,
“ সব দোষ আমার। আমি আমার বন্ধুর খারাপ সময়ে তার পাশে ছিলাম না। রুহী কতটা কষ্ট পাচ্ছিলো একা! “
নিশা বন্ধুকে শেষ বারের মতো একবার দেখার বায়নাও করছিলো খুব। নাঈমা এই ব্যাপারে বাঁধ সাধলেও জুলফিকার মেয়ের আবদার রাখেন। ইমারজেন্সি দুটো টিকেটের ব্যবস্থা করেন। চট্টগ্রাম টু ঢাকার ডিরেক্ট ফ্লাইট। নাঈমাও যাবেন নিশার সঙ্গে।
রেসিডেন্সিয়াল কটেজের সামনে গাড়ি এসে থামার শব্দ হতেই জুলফিকার উঠে দাঁড়ায়। প্রাক্তন স্ত্রী এবং একমাত্র মেয়েকে গাড়িতে তুলে দেয়। গাড়ি ছাড়ার পূর্বে মেয়েকে একপল দেখে নিয়ে নাঈমার উদ্দেশ্যে বলে,
“ সাবধানে যেও। নিশার খেয়াল রেখো। রিটার্ন টিকেট আগামীকালের করেছি। দ্রুত ফিরে এসো। “
নাঈমা কেবল মৃদু মাথা নেড়ে সম্মতি পোষণ করে।
__________
আকাশটা কালো মেঘে ছেয়ে আছে। চারিদিকে কেমন বিষন্ন আলো বিরাজ করছে। পুশআপ দিতে ব্যস্ত সাইফের মনটাও কেমন বিষন্ন। তার মনে প্রশ্ন জাগে। বিষন্নতা কি ছোঁয়াচে? নাহলে গতকাল ইয়াসমিনের নিজের বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে ওই কান্নার দৃশ্য দেখার পর থেকে সাইফের এতো বিষন্ন কেনো অনুভব হচ্ছে? যেই দৃশ্য দেখে সাইফ আর আগে পা বাড়ানোর সাহস পায় নি। যেমন আড়ালে ছুটে গিয়েছিলো, তেমন আড়ালেই ফিরে এসেছে।
তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুশআপ দিতে ব্যস্ত বন্ধু মহল বিভিন্ন আলোচনায় মত্ত। কিন্তু কোনো শব্দই সাইফের মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছায় না। তার চোখের সামনে ভাসছে ইয়াসমিন মুজতবার ওই করুণ কান্নার স্বর। দুনিয়া কত বিচিত্র! কিছু মানুষের কাছে কান্না করে মাথা গুজার জায়গা থাকা সত্ত্বেও তারা কাঁদে। আর কিছু মানুষের কাছে না আছে অশ্রু, আর না আছে মাথা গুজার জায়গা। হয়তো এই কারণেই উপরওয়ালা সাইফের মতন মানুষদের এতটা শক্ত বানায়। যাতে তারা সহজে না ভাঙে। কিন্তু দিন শেষে কেউ একজন আসে। ভূমিকম্পের ন্যায়। বিশাল ইমারতে কাঁপন ধরায়। শক্ত মানুষটার খোলস ভেঙে গুড়িয়ে দেয়।
___________
নিউজ চ্যানেলে রিপোর্ট কাভার করছেন এক পুরুষ। টিভির এককোণে তার নাম ভেসে উঠেছে। তূর্য রশীদ। স্পষ্ট গলায় আওড়াচ্ছেন গতকাল রাতে রাজধানীতে ঘটে যাওয়া এক সুইসাইড কেসের বর্ণনা। রুহী মেহরোজের মৃত্যুর খবরটা অতি নীরবেই শুনলো দূর্জয়। অত:পর টিভিটা রিমোট চেপে বন্ধ করে দিলো। মনে পড়ে গেলো মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে ভাইয়ের আবদারের কথা। রুহী মেহরোজ নামক মেয়েটার গায়ে যেনো আতঙ্কবাদীর প্রেমিকা হওয়ার কলঙ্ক না লাগে। দূর্জয় ভাইয়ের আবদার পূরণ করেছিলো। মেয়েটার গায়ে কলঙ্ক লাগতে দেয় নি। তার বাবা মা কে বুঝিয়ে এখান থেকে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু শেষ রক্ষা কি হলো? দীপ্ত কি একটাবারও ভাবে নি মেয়েটা এতো বড় প্রতারণার ভার বয়ে আদৌ বাঁচতে পারবে কি-না?
গুরুত্বপূর্ণ ফোন কলটা বেজে উঠতেই দূর্জয় ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসে। একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে কল রিসিভ করতেই ফোনের অপরপাশ হতে বলে উঠে,
“ স্যার, সিসিটিভি ফুটেজ হতে ওই গাড়ির লোকেশন ট্রেস করতে সক্ষম হয়েছি আমরা। “
এতক্ষণের বিষন্নতা একপাশে ঠেলে দিয়ে শীতল পুরুষালি স্বরটা বলে উঠে,
“ আ’ম কামিং। “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]