এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0
285

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৪.

আজ ঠিক কতটা দিন পর মেয়েকে এভাবে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছে সেই হিসেব ভুলে বসেছে বাণী। শুধু একটু পর পরই মেয়ের মুখে চুমু খেয়ে আওড়াচ্ছে,

“ আ’ম সরি মা। মাম্মা তোমাকে একা রেখে গিয়েছিলো। “

বহ্নি কোনো জবাব দেয় না। সে এতটুকুতেই খুশি যে তার মাম্মা সুস্থ হয়ে গিয়েছে। মনে মনে ঠিক করে আর কখনো মাম্মাকে রেইনে ভিজতে দিবে না সে। সে চায় না তার মাম্মা আবার অসুস্থ হয়ে হসপিটালে থাকুক এতদিন।

খাবার টেবিলে বহ্নিকে কোলে বসিয়ে তাকে নিজের হাতে ভাত মেখে খাওয়াতে ব্যস্ত বাণী। হিরণ তখন সবে উপর থেকে গোসল সেরে রেডি হয়ে নেমেছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে এই প্রশান্তিদায়ক দৃশ্যটুকু দেখে তার ঠোঁটের কোণে অস্ফুটে হাসি ফুটে উঠে। নিজের ঘরকে আবার পরিপূর্ণ অনুভব হচ্ছে তার। বাণী অবহেলায় সিঁড়ির পানে তাকাতেই হিরণকে লক্ষ্য করে। হিরণের ঠোঁটের হাসি দেখে সে ঘৃণায় চোখ নত করে ফেলে। হিরণের হাসিও মিইয়ে যায়।

সে নিচে নামতেই রান্নাঘর হতে একজন হেল্পিং হ্যান্ড বেরিয়ে এসে বাণীকে প্রশ্ন করে,

“ ম্যাডাম, স্যারের জন্য খাবার সার্ভ করবো? “

প্রশ্নটা শুনে বাণীর রাগ হয়। এসব আলগা আধিক্যেতা জাতীয় প্রশ্ন শুনলেই রাগে তার গা জ্বলে। সে কাটকাট গলায় জবাব দেয়,

“ এসব তো আমার দেখার বিষয় না। যার যখন খেতে ইচ্ছে হবে সে তখন খেয়ে নিবে। “

হেল্পিং হ্যান্ডের মুখ কালো হয়ে আসে। হিরণ নিজেই আগ বাড়ি বলে,

“ খাবার সার্ভ করতে হবে না। আমার খিদে নেই। “

বহ্নি ঘাড় ঘুরিয়ে পাপার দিকে তাকায়। দাঁত বের করে হেসে বলে,

“ পাপা! “

হিরণ মেয়ের পানে তাকিয়ে মৃদু হেসে হাত ঘড়িতে সময়টা দেখে নেয়। বের হবে সে এখন। যাওয়ার আগে টেবিলে বসে থাকা বাণীর দিকে এগিয়ে যায়। মাথা সামান্য নুইয়ে বহ্নির কপালে চুমু খায়। তবে তার দৃষ্টি স্থির বাণীর মুখপানে। বাণী কঠিন হয়ে চুপচাপ বসে রয়। হিরণ বেরিয়ে যাওয়া আগে শুধু মেয়ের কানে কানে বলে যায়,

“ মাম্মাকে বেশি বিরক্ত করো না। সব দুষ্টুমি জমিয়ে রেখো। পাপা আসলে পাপাকে ইচ্ছেমতো জ্বালিও। “

হিরণ ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা গাড়িতে উঠে বসে। ড্রাইভিং সিটে আগে থেকেই ইবাত বসেছিলো। হিরণ এসে পাশে বসতেই সে গাড়ি স্টার্ট দেয়। ড্রাইভিং এর ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে সে স্যারের ক্ষত বিক্ষত মুখটা দেখে নেয়। মনে মনে খুব মায়া হয় তার। স্যারকে এই ক্ষত কে উপহার দিয়েছে তা তার ভালো করেই জানা আছে। বাণী ম্যাডাম ছাড়া আর কারো সাহস নেই এমনটা করার। রাগে ইবাত অস্ফুটে বলে উঠে,

“ পাষণ্ড। “

হিরণের মনযোগ ফোনে স্থির ছিলো। কিন্তু ইবাতের অস্ফুটে বলা কথাটা তার কর্ণগোচর হয়। সে চোখ তুলে প্রশ্ন করে,

“ কাকে পাষাণ বলছো? “

ইবাত নিজের রাগটুকু চেপে রাখতে পারে না। অতি সাহস জুগিয়ে বলে উঠে,

“ স্যার বেয়াদবি ক্ষমা করবেন। কিন্তু বাণী ম্যাডাম কাজটা মোটেও ভালো করে নি। নিশানা আরেকটু এপাশ ওপাশ হলেই আপনার চোখের খুব বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যেতো। “

হিরণ ভ্রু কুচকে বলে,

“ কিন্তু সেরকম কিছু তো হয় নি। আর তুমি কি বাণীকে উদ্দেশ্য করে ওই শব্দ ব্যবহার করেছো? “

“ উনি পাষাণ না হলে কি আপনার সাথে এমনটা করতে পারতো? নারী জাতির অন্যতম গুণ নাকি হলো মায়া। কিন্তু উনার মধ্যে কেনো আপনার প্রতি মায়া কাজ করে না? এতটা নির্দয় কেনো উনি? “

ইবাতের চাপা ক্ষোভ হিরণকে মৃদু হাসতে বাধ্য করে। সে শীতল গলায় বলে,

“ কে বলেছে ওর মধ্যে মায়া নেই? ওর সকল মায়া একজনকে ঘিরেই। বহ্নি ওর মায়ার কেন্দ্রবিন্দু। “

ইবাত তাচ্ছিল্যপূর্ণ হেসে শুধায়,

“ স্যার আপনি কি ভুলে গিয়েছেন বহ্নির জন্মের ঘটনা? “

হিরণ নীরব বনে যায়। তার চোখের সামনে ভেসে উঠে অতীত। প্রেগন্যান্সির সম্পূর্ণ জার্নিতে বাণী উন্মাদ আচরণ করেছিলো। সুযোগ পেলেই আত্মহত্যা করার চেষ্টা করতো। নিজের প্রতি যত ধরনের অবহেলা সম্ভব সব করেছিলো। হিরণের উপর দিয়ে তখন অন্যরকম এক ঝড় বয়ে যাচ্ছিলো।

২০১৮ সালের মে মাসের ঘটনা। যখন বহ্নি এই পৃথিবীতে এসেছিলো। কি ভয়ংকর কালবৈশাখীর সম্মুখীন হয়েছিলো চট্টগ্রাম শহরটা! নিরাপত্তার খাতিরে হিরণ বাণীকে হসপিটালে নিয়ে যায় নি। বাড়িতেই ডক্টর নার্স সব জোরো করে ফেলেছিলো। কাল বৈশাখীর সেই রাতে বাচ্চা মেয়েটা দুনিয়ায় এসেছিলো। কিন্তু ডক্টর হুমায়রা জানায় বাচ্চাটা খুব দূর্বল। ক্ষীণ তার নিঃশ্বাসের গতি। চব্বিশ ঘণ্টাও যদি টিকতে পারে তবে তা মিরাক্কেল হবে।

বাণী তখন প্রসব বেদনা কাটিয়ে অচেতন অবস্থায় ছিলো। হিরণ ছিলো দিশেহারা। কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলো না কোনো। অদ্ভুৎ এক অসহায়ত্বের মধ্যে দিয়ে সেই রাতটা পাড় করে সে। খুব সকালে যখন বাণীর জ্ঞান ফিরে তখন ডক্টর হুমায়রা বাণীকে বাচ্চার অবস্থার কথা জানায়। বাণীর মধ্যে কোনো উৎকণ্ঠা ছিলো না। ছিলো না কোনো চিন্তার ছাপ। সে নির্লিপ্ত রয়। বাচ্চাকে তার কাছে এনে দেয়ার পর সে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কোলে তুলে নেয় না। হিরণ এবং বাচ্চাটার প্রতি তার মনে পুষে ছিলো তীব্র ঘৃণা। হিরণ অবাক হয় না। ওই পরিস্থিতিতে বাণীর এরকম আচরণই স্বাভাবিক ছিলো।

কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে হিরণ সাহস করে নিজেই মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। দীর্ঘ জীবনে সেই প্রথম হিরণ কোনো বাচ্চার সান্নিধ্যে এসেছিলো। তাও নিজের বাচ্চা। ডক্টরকে বাণীর খেয়াল রাখতে বলে, বহ্নিকে নিয়ে সে নিজের রুমের সিঙ্গেল সোফাটায় নীরবে সারাদিন বসে রয়। নিজের বলিষ্ঠ হাতের বন্ধনে দূর্বল বাচ্চাটাকে একটা কবুতরের ছানা মনে হচ্ছিলো হিরণের। খুব নরম, হালকা, তুলতুলে। মুসলিম রীতি অনুযায়ী বাচ্চা জন্মের সঙ্গে সঙ্গে সর্ব প্রথম তাকে কোলে তুলে তার কানের কাছে আজান দিতে হয়। কিন্তু হিরণ সেসব রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে মেয়ের কানের কাছে সর্বপ্রথম উচ্চারণ করে,

“ তুমি কি আমার ভুল? “

দূর্বল বহ্নি চোখ মেলে তাকায় না। হিরণ ফের স্থির দৃষ্টিতে মেয়ের পানে তাকায়। তার মন জবাব দেয় এই বাচ্চাটা তার ভুল হতে পারে না। হিরণের কীর্তিকালাপ ভুল হলেও এই বাচ্চাটা কোনো ভুল নয়। এতো স্নিগ্ধ একটা প্রাণ বড়জোড় হিরণের জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি হতে পারে। হিরণ কিছু একটা ভেবে ফের ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ তুমি আমার বহ্নি। “

ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিলো বলেই হয়তো বহ্নি বেঁচে গিয়েছিলো। তবে শরীর তখনো অত্যাধিক দূর্বল। স্বাভাবিক বাচ্চাদের তুলনায় ওজনটাও যথেষ্ট কম। পেটে থাকাকালীন মায়ের শারীরিক অযত্নের ফলে পুষ্টিহীনতা দেখা দিয়েছিলো তার। দিন পেরিয়ে সপ্তাহ আসে। দেখতে দেখতে একুশটা দিন পাড় হয়। বাণী বহ্নির মুখ দেখতেও নারাজ রয়। কেউ ভুল করেও বহ্নিকে তার রুমে নিয়ে আসলে সে চিৎকার চেঁচামেচি করে তাকে তাড়িয়ে দিতো। হিরণ তখন বহ্নিকে নিয়ে দিশেহারা। ডক্টর সাজেস্ট করেছিলো পুষ্টির ঘাটতি পূরণের জন্য ব্রেস্টফিডের বিকল্প নেই। কিন্তু বাণীর ক্ষোভের কারণে হিরণ বাধ্য হয়ে বহ্নিকে ইনফ্যান্ট ফরমুলা মিল্ক তৈরী করে খাওয়াতো।

একুশতম দিনে হিরণ সাহস সঞ্চয় করে বহ্নিকে নিয়ে বাণীর রুমে প্রবেশ করে। বেশ রাত হওয়ায় বাণী তখন ঘুমে বিভোর। হিরণ নিঃশব্দে বহ্নিকে বিছানায় বাণীর একপাশে শুইয়ে দেয়। অত:পর দু’পাশে বালিশ দিয়ে বর্ডার টেনে দেয় যেনো ভুল করেও বাণী ঘুমের ঘোরে বহ্নির উপর না এসে পড়ে কিংবা বহ্নি নিচে না পড়ে যায়। সন্তর্পণে কাজটুকু শেষ করেই হিরণ রুম থেকে বেরিয়ে যায়। দরজার অপর পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে অপেক্ষা করতে থাকে।

বিশ পঁচিশ মিনিটের মাথায়ই বহ্নির ঘুম ভেঙে যায় খিদের চোটে। সে গলা ফাটিয়ে কান্না শুরু করে। বাণীর গভীর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। সে তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠে বসে। প্রথমে ভয় পেলেও বিছানায় নিজের পাশে বহ্নিকে দেখে তার ভ্রু কুচকে আসে। সেও বহ্নির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে,

“ কেউ আছে? এই বাচ্চাকে নিয়ে যাও এখান থেকে। “

বাণীর চিৎকার শুনে নিচ থেকে একজন হেল্পিং হ্যান্ড দৌঁড়ে আসে। কিন্তু দরজার বাহিরে হিরণকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে থেমে যায়। হিরণ চোখের ইশারায় চলে যেতে বললেই সেই মহিলা সুরসুর করে নিচে চলে যায়।

সময় গড়ায়। কিন্তু কেউ আসে না। বাণী বিরক্তিতে দুই হাতে নিজের কান চেপে ধরে। বহ্নির কান্না থামে না বরং ক্রমান্বয়ে আরো বাড়তে থাকে। বাণী দুই হাতে নিজের মাথার চুল মুঠো করে ধরে চেঁচিয়ে উঠে,

“ চুপ করবে তুমি? কেনো যন্ত্রণা দিচ্ছো? “

ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না থামে না। বাণী অসহায় অনুভব করে। সবে কুঁড়ি পেড়িয়ে আসা এই জীবনে সে কখনো কোনো বাচ্চা কোলে তুলে নি। তার জানা নেই একটা নবজাতক শিশুর সঙ্গে কিভাবে ডিল করতে হয়। সে ফ্যালফ্যাল করে বহ্নির দিকে তাকিয়ে থাকে। ধীরে ধীরে তার চোখের কোণে অশ্রু এসে ভীড় করে। অস্ফুটে সে প্রশ্ন করে,

“ তুমি বেশি অসহায় নাকি আমি? “

প্রশ্ন করে বাণী নিজেই অনভিজ্ঞ হাতে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেয়। বহ্নির মাথার কাছেই একটা ছোট্ট ফিডারে সে ফর্মুলা মিল্ক দেখতে পায়। সেই ফিডারটা খুলে বহ্নির মুখে দিতেই তার কান্না ধীরে ধীরে কমে আসে। পুরোপুরি শান্ত হয়ে যায়। বাণী অশ্রু সিক্ত দৃষ্টি মেলে বাচ্চাটাকে দেখতে থাকে। খাওয়ানো শেষ হতেই কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বহ্নি ঘুমায় না। ফ্যালফ্যাল করে নিজের মা’কে দেখতে থাকে। ছোট ছোট আঙুল দ্বারা ছুঁয়ে দেখারও চেষ্টা করে। বাণী মেয়ের চোখে চোখ রেখে ধরা গলায় বলে আসে,

“ আমি তোমার বাবাকে খুব ঘৃণা করি। সেই ঘৃণা এতটাই তীব্র যে আমি তোমাকেও মেনে নিতে পারছি না। তোমার অস্তিত্বই তোমার বাবাকে ঘৃণা করার অন্যতম কারণ। “

এই পর্যায়ে বাণীর চোখ দিয়ে টুপটুপ করে পানি পড়তে শুরু হয়।

“ আমার কি দোষ বলো? আমি তোমার থেকেও বেশি অসহায়। “

বহ্নি মনযোগ শ্রোতার মতো মায়ের সকল অভিযোগ শুনতে ব্যস্ত। বাণী রুগ্ন মেয়ের পানে তাকিয়ে বলতে থাকে,

“ আ’ম সরি। আ’ম রিয়েলি সরি। তুমি আমাকে খুঁজেছো খুব তাইনা? আমি আমার অনুভূতি বুঝে উঠতে পারি নি। এখনো পারছি না। তোমার এই অবস্থা আমার জন্য হয়েছে তাই না? আমার অবহেলার কারণে তুমি এতো দূর্বল। আমি এসবের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না বিশ্বাস করো। তুমি অনাকাঙ্ক্ষিত আমার জন্য। আমি খুব খারাপ মা। আমাকে মাফ করে দাও বাচ্চা। প্লিজ মাফ করে দাও… “

কথাগুলো বলতে বলতে বাণী ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। দরজার অপর পাশ হতে সবটাই হিরণের কর্ণগোচর হয়। সে নীরবে দরজায় মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়। সবটাই তার ভুল। তার ভুলের শাস্তি এতদিন তার মেয়ে পেয়েছে। তার ভুলের শাস্তি এতদিন বাণী পেয়েছে। আর নিজের ভুলের শাস্তি হিসেবে সে মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছে। সেই রাতের পর থেকে গত ন’টা মাস ধরে সে বিবেকের দংশন দ্বারা তাড়িত হচ্ছে। প্রেগন্যান্সির সময় বাণী যতবার সুইসাইড এটেম্পটের ট্রাই করেছে প্রত্যেকবার হিরণের নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসতো। রাতের ঘুম উবে গিয়েছিলো। চোখ বুজলেই মনে হতো এই বুঝি বাণী আবার কিছু একটা করে বসলো। বাণীর মানসিক অবস্থা এতটাই বিপর্যস্ত হয়েছিলো যে বাধ্য হয়ে একবার বিছানার সঙ্গে তার দু হাত বেধে রাখতে হয়েছিলো। যেনো নিজের কোনো ক্ষতি করতে না পারে। সেই দৃশ্য মনে পড়লে এখনো হিরণের বুকে কাঁপন ধরে।

অতীত যাত্রা সেড়ে হিরণ চোখ মেলে তাকায়। জন্মের পর বাণী একুশ দিন নিজের মেয়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলো এইটা সবার চোখে পড়েছে। কিন্তু বাণী ঠিক কি কারণে এরকম আচরণ করেছিলো তা সকলের অজানা। হিরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইবাতের উদ্দেশ্যে বলে,

“ বাণীকে কখনো ভুল বুঝবে না ইবাত। ও বহ্নিকে খুব ভালোবাসে। তুমি শুধু আমার পক্ষের ঘটনার সাক্ষী তাই এমনটা বলছো। বাণীকে বোঝার সাধ্যি তোমার নেই। “

হিরণের এহেন কথা শুনে ইবাত বিরক্ত হয়। লোকটা কিসের তৈরী? এখনো তিনি বাণী ম্যাডামের হয়েই সাফাই গাইছেন!

__________

ফিলিস্তিনে সময় তখন বিকেল ৭ টা বেজে ৩৫ মিনিট। ত্রাণ বিলানোর কাজ শেষ করে সৈন্যরা যে যার তাবুতে অবস্থান করছে তখন। রাতের খাবার কিছুক্ষণ আগে সেড়েই যে যার তাবুতে প্রবেশ করেছে। সারাদিনের ক্লান্তির ফলে সবাই এখন বিশ্রাম নেওয়ার প্রতি অধিক মনযোগী। আগামীকাল সকালের আগে কেউই আর কাউকে বিরক্ত করবে না। ঠিক এই সুযোগে প্রত্যয়, রাফি এবং রিদওয়ান নীরবে নিজেদের তাবু ছেড়ে বেরিয়ে আসে। আর মাত্র তিনদিন এই দেশে আছে তারা। এই তিনদিনের মধ্যেই তাদের সত্যিটা উদঘাটন করতে হবে যেকোনো মূল্যে।

রহস্য উদঘাটনের প্রথম ধাপ হিসেবে ট্রেস করা লোকেশনটা গুগল ম্যাপে বসিয়ে জায়গাটা এখান থেকে ঠিক কতটা দূরে তা মেপে নেয় তিনজন। পায়ে হেঁটে গেলে প্রায় একঘন্টার দূরত্ব। তিন সৈন্যের জন্য একঘন্টা পায়ে হেঁটে যাওয়া খুব বড়ো কোনো বিষয় নয়। কিন্তু সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে বিপদহীন ভাবে উক্ত স্থানে পৌঁছানোটাই আসল বিষয়।

কারো দৃষ্টি যেনো আকর্ষণ না হয় সেজন্য প্রত্যয়, রাফি, রিদওয়ান ইউনিফর্ম ছেড়ে সিভিল গেটাপে রেডি হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে করে নিয়েছে সম্পূর্ণ লোডেড পিস্তল।

প্রত্যয়, রাফি, রিদওয়ান তখন কেবল আব্দুল্লাহ আজাম মসজিদ পেরিয়ে সরু পথ ধরে সাবধানে এগিয়ে যাচ্ছে। আচমকা রাফি পায়ের গতি থামিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। হিসহিসিয়ে বলে,

“ আমার কেনো মনে হচ্ছে কেউ আমাদের ফলো করছে? “

রাফির কথা শুনতেই প্রত্যয় ও রিদওয়ান সতর্ক হয়ে চারিদিকে তাকায়। কিন্তু নিজেদের ত্রী সীমানায় কোনো মানুষের অস্তিত্ব না দেখে তারা আবার সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া শুরু করে। হঠাৎ আবার পিছনে শুকনো পাতা মাড়ানোর শব্দ হতেই তিনজন সতর্ক হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন ভাবে চারিদিকে কারো অস্তিত্ব খুঁজতে শুরু করে। রিদওয়ান হাতের টর্চের আলোর সাহায্যে এগিয়ে যায় সরু পথের ধারে একটা ছোট টিলার কাছে। টিলার চারিদিকে ঘুরে ঘুরে আলোর সাহায্যে কাউকে খুঁজতে গিয়েই আচমকা সে ভয়ে চাপা চিৎকার করে উঠে। প্রত্যয় আর রাফি বেশি দূরে ছিলো না। তারা রিদওয়ানের ভীত চিৎকার শুনতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে সেই টিলার কাছে এগিয়ে যায়। এরকম অন্ধকার জায়গায় লম্বা বোরখার ন্যায় সাদা আলখেল্লা পরিহিত রমণীকে দেখে যে কেউ ভয় পেতে বাধ্য। মাথার অর্ধেক ভাগ তার সবুজ রঙা একটা শাল দিয়ে ঢাকা। তার হালকা নীলাভ চোখ পানে তাকিয়ে রিদওয়ান অবাক গলায় বলে,

“ জারিয়াহ? “

জারিয়াহ দৃষ্টি নত করে কাচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিলো। প্রত্যয় আর রাফি মেয়েটাকে এক দেখায়ই চিনতে পারে। কিন্তু তারা এই ভেবে অবাক যে এই মেয়ে তাদের ফলো করছে কেন? প্রত্যয় গলার স্বর মৃদু গম্ভীর করে ইংরেজিতে জানতে চায়,

“ আমাদের ফলো করছিলে কেনো? “

জারিয়াহ ইংরেজি বুঝতে পারে। কিন্তু বলার অভ্যাস নেই বলে সে এতটা গুছিয়ে বলতে পারে না। তবুও অগোছালো শব্দে ইংরেজিতে সে জানায়,

“ আমি জানি আপনারা কোনো গোপন উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছেন। “

জারিয়াহর কথা শুনে তিনজনই বেশ অবাক হয়। রিদওয়ান প্রশ্ন করে,

“ তোমার এমনটা কেনো মনে হলো? “

“ আমি আপনাদের উপর নজর রাখছিলাম। আপনাদের দৃষ্টি সন্দেহজনক ছিলো। “

জারিয়াহর কথা শুনে রাফি বাংলায় বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ এই মেয়ে গোয়েন্দা সংস্থার অধিদপ্তরে কাজ করে নাকি? “

রিদওয়ান সেদিকে পাত্তা না দিয়ে কিশোরী মেয়েটাকে আগাগোড়া পরখ করে নেয়। বয়স ১৮ ছুঁয়েছে কিনা সন্দেহ! তবুও এতো বড়দের মতো কথাগুলো কেন যেনো মেয়েটার সাথে মানানসই লাগছে। রিদওয়ান ধীমি গলায় প্রশ্ন করে,

“ তোমার উদ্দেশ্য কি জারিয়াহ? “

“ আমি আপনাদের সাহায্য করতে চাই। “

প্রত্যয় ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ আর ইউ সিরিয়াস? “

“ হ্যাঁ। “

রিদওয়ান এবার শীতল গলায় প্রশ্ন করে,

“ বিনিময়ে তোমার কি চাই জারিয়াহ? “

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৫.

নির্জন রুমে হাত পা বাধা অবস্থায় বসে আছে এক আহত পুরুষ। তরতাজা শরীরটা রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। গায়ের পাঞ্জাবিটায় লেগে থাকা রক্ত শুকিয়ে বিশ্রী গন্ধ বেড়িয়েছে। সেই পাঞ্জাবির চারিপাশে ভীড় জমিয়েছে নোংরা মাছির দল। আচমকা কারো আগমনের আভাস পেতেই শমসের মজুমদার চোখ তুলে তাকায়। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটাকে দেখে হাসে। অত:পর মুখ বিকৃত করে বলে,

“ তুই হচ্ছিস সেই কুকুর যার লেজ আজীবন বাকাই থাকবে। কখনো সোজা হবে না। সুযোগ পেতেই কামড়ে দিয়েছিস, শালা অকৃতজ্ঞ। “

হিরণ নীরবে কথাটুকু শুনে হেসে শমসেরের বরাবর একটা চেয়ারে বসে। করুণার সুরে বলে,

“ আ’ম শিওর আমার থেকে বড় হারামজাদা তুই এই জগতে দ্বিতীয়টা খুঁজে পাবি না। “

“ আমাকে বেশিদিন আটকে রাখতে পারবি না হিরণ। শীঘ্রই আমার খোঁজ পড়বে। আমি এই মিশনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। আমাকে ছাড়া কোনো ডিল হওয়া অসম্ভব। “

হিরণ শমসেরের কথা শুনতে শুনতে হাতে থাকা ব্র্যান্ডের নিষিদ্ধ পানীয় বোতলটার ছিপি খুলে। অত:পর ডগডগ করে কিছুটা সাবাড় করে সে হেসে বলে,

“ আমার জন্য অসম্ভব বলে কোনো বিষয় নেই। তাই মিশনের চিন্তা তুই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। তোকে ছাড়া এই মিশন পরিচালনা করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হবে না আমার। আফটার অল তোর পোষ্য কুকুর গুলোকে টাকা দিয়ে পোষ মানিয়েছি। সারাদিন এখন এরা আমার পা চাটবে। “

শমসের ক্ষোভ মিশ্রিত স্বরে বলে,

“ নিজেকে খুব বড় কিছু মনে করিস, তাই না? “

“ মনে করার কিন্তু নেই। আমি খুব বড় কিছুই। “

শমসের একদলা থুথু মেঝেতে ফেলে বলে উঠে,

“ এতো বড় মানুষ হয়ে লাভ কি যদি নিজের বউকে নিজের করে না রাখতে পারিস? “

হিরণ চোখ মুখ শক্ত করে বলে,

“ বাণীকে কোথা থেকে উদ্ধার করেছিস তা জানিয়ে দে। দয়া দেখাবো তোর প্রতি কিছুটা। “

“ মিথ্যা আশ্বাস দিবি না হিরণ। তুই আর দয়া শব্দ এক বাক্যে ব্যবহারের উপযুক্ত নয়। “

“ ইউ হ্যাভ নো আদার অপশন। “

“ আমি কখনোই বলবো না। তোর কি মনে হয় তুই সত্যটা জেনে আমাকে শেষ করে দিবি আর পরে নিজে শান্তিতে জীবন পাড় করবি? আমি কখনোই তোকে শান্তিতে থাকতে দিবো না। ঠিক এই কারণে আমি ওই সাহায্যকারীর পরিচয় গোপন রাখবো। যাতে আমি না থাকলেও কেউ একজন গর্ত খুড়ে তোকে খুঁজে বের করে। তোর তিলে তিলে গড়ে তোলা সবকিছু ধূলিসাৎ করে দেয়। “

কথাটুকু বলেই শমসের বিশ্রী হাসি দেয়। হিরণ হাত ঘড়িতে সময়টা দেখে নেয়। তার কিছু কাজ আছে। এই হায়েনার সাথে কথা বলে আপাতত সময় নষ্ট করতে আগ্রহী না সে। এর পেট থেকে কথা বের করার ব্যবস্থা সে পরে করবে। এই ভেবেই হিরণ উঠে দাঁড়ায়। প্রস্থানের জন্য পা বাড়াতেই শমসের পিছন থেকে গা জ্বালানে হাসি দিয়ে বলে উঠে,

“ তবে একটা বিষয় তোকে জানাতে পারি। তোর বউ এতদিন এক ব্যাচেলর ছেলের সঙ্গে একা এক বাসায় ছিলো। সারারাতও কাটিয়েছে ওই ছেলের সাথে। সাহায্য করার বিনিময়ে নিশ্চয়ই ওই ছেলে তোর বউকে এভাবেই ঘরে সাজিয়ে রাখে নি? যা আর কেউ পারে নি তা তোর বউ পেরেছে। তোর একদম জায়গামতো আঘাত করেছে। তোর পুরুষত্বে চুনকালি মেখে দিয়েছে। “

হিরণের কপালের পাশের রগটা রাগে তখন দপদপ করছে। সে সাপের ন্যায় ফোসফাস করতে করতে এলোমেলো দৃষ্টি মেলে চারিদিকে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে সে রুমের এক কোণে মেঝের উপর একটা হাতুড়ি দেখতে পায়। হিরণ এক দন্ড অপেক্ষা না করে সেই হাতুড়িটা হাতে তুলে উল্টো ফিরে ক্ষিপ্র গতিতে সেটার সাহায্যে শমসেরের মাথায় আঘাত করে। কেবল একটি আঘাত দ্বারাই সে শমসের নামক অধ্যায়ের ইতি ঘটায়।
__________

একটা সিকুয়েন্স মেইনটেইন করে হাঁটছে চারজন মানুষ। সবার সামনে টর্চ হাতে যেই রমণী হেঁটে চলেছে তার কদম অনুসরণ করছে বলিষ্ঠ তিনজন যুবক। রাতের আঁধার চিড়ে সবথেকে নিরাপদ রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে তারা কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। রিদওয়ান ক্ষানিকের জন্য জারিয়াহর পানে তাকায়। মেয়েটার বয়স কম। তবে বিচক্ষণ খুব। নাহয় এখন পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারতো না। তার মনে পড়ে যায় কিছুক্ষণ পূর্বে জারিয়াহর অকপটে বলা কিছু সত্য বুলি।

“ আমি স্বার্থহীন ভাবে আপনাদের সাহায্য করতে চাইছি না। আবার অনৈতিক কাজেও আপনাদের সাহায্য করবো না আমি। আমি জানি আপনারা আমাদের মিত্র। নাহয় কখনো আমার ভূখন্ডের অভুক্ত মানুষদের ক্ষুধা মিটাতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন না। আমার একটা ছোট বোন আছে। ওকে নিয়ে যেনো কিছুদিন খাবারের অভাবে আমার দিন কাটাতে না হয় সেজন্য আমি আপনাদের সাহায্য করবো। বিনিময়ে আপনারা শুধু আমাকে খাবারের ব্যবস্থা করে দিবেন। “

জারিয়াহর ভাঙা ইংরেজিতে বলা কথার সারমর্ম বুঝতে পেরে তিনজন সৈন্যই নীরব বনে যায়। রিদওয়ান নীরবতা ভেঙে বলে উঠে,

“ তোমার খাবার নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমরা সেই ব্যবস্থা করে দিবো। এখন ফিরে যাও। আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন নেই। “

জারিয়াহ দৃঢ় গলায় বলে,

“ না। আমি এভাবেই আপনাদের সাহায্য নিয়ে ঋণী হতে পারবো না। আমার বাবা বলতেন কেউ আমাকে সাহায্য করলে, আমিও যেনো সুযোগ বুঝে সেই সাহায্য ফিরিয়ে দেই। “

প্রত্যয় শুধায়,

“ তোমার বাবা ভালো কথা বলতেন জারিয়াহ। কিন্তু সত্যি আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন নেই। “

“ প্রয়োজন আছে। আপনারা যেই রাস্তা ধরে এগোচ্ছেন তা নিরাপদ নয়। “

জারিয়াহর মুখে এতটুকু শুনেই তিনজন সৈন্যের মুখে মৃদু চিন্তার ছাপ ফুটে উঠে। জারিয়াহ তাদের আশ্বস্ত করে বলে,

“ চিন্তা করবেন না। এই শহরের প্রতিটা অলিগলি চিনি আমি। আপনাদের নিরাপদ রাস্তা ধরে গন্তব্যে পৌঁছে দিবো। বিশ্বাস রাখুন। “

প্রত্যয়, রিদওয়ান এবং রাফি কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে এক সিদ্ধান্তে উপনীত হতেই জারিয়াহ প্রশ্ন ছুড়ে,

“ এখন বলুন আপনাদের গন্তব্য কোথায়? “

আচমকা প্রত্যয়ের ডাকে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা চক্রের স্মৃতিচারণ হতে বেরিয়ে আসে রিদওয়ান। সামনে লক্ষ্য করে দেখে জারিয়াহ হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। রিদওয়ান কিছু বলতে নিবে তার আগেই জারিয়াহ ঠোঁটে আঙুল চেপে সবাইকে চুপ থাকার ইশারা করে। সবাই সঙ্গে সঙ্গে পিনপতন নীরবতার ইশারাটুকু মেনে নেয়। জারিয়াহ যথেষ্ট সাবধানে হাতের টর্চটা নিভিয়ে একটা বাড়ির পিছনে আড়াল হয়ে দাঁড়ায়। তাকে অনুসরণ করে বাকি তিনজনও আড়াল হয়ে দাঁড়ায়। প্রত্যয় হাতের গুগল ম্যাপে চেক করে দেখে তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সে নিজের পিস্তলটা বের করে হাতে চেপে ধরে। রাফি আর রিদওয়ানও একই কাজ করে। জারিয়াহ আড়াল হতে উঁকি দিয়ে সামনের বাড়ির দিকে দৃষ্টি স্থির করে। কিছুক্ষণ সময় গড়াতেই বাড়ির ভেতর হতে দু’জন লোক বেরিয়ে আসে। তাদের দেখতেই জারিয়াহ চাপাস্বরে বলে,

“ আমাদের এখুনি এখান থেকে যেতে হবে। “

__________

ফ্লাক্সে করে গরম পানি ভরে রান্নাঘর থেকে বের হয় বাণী। পরিবেশটা কেমন শীতল শীতল। এই আবহাওয়ায় বহ্নির না আবার ঠান্ডা লেগে যায় সেই চিন্তা করেই বাণী ফ্লাক্সে করে মেয়ের জন্য আলাদা করে গরম পানি নিতে নিচে এসেছিলো। রাতও খুব হয়েছে। রুমে ফিরেই বহ্নিকে ঘুম পাড়াতে হবে তার।

সিঁড়ির কাছাকাছি যেতেই বাহির থেকে গাড়ির হর্ণের শব্দ ভেসে আসে। বাণী একবার ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ির পানে তাকায়। রাত ১১ টা বেজে ৪৫ মিনিট। হিরণ ফিরেছে নিশ্চয়ই? বাণী আর সেদিকে তেমন একটা পাত্তা না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়।

হিরণ ঘরে প্রবেশ করতেই একজন হেল্পিং হ্যান্ড দৌড়ে এসে প্রশ্ন করে,

“ স্যার খাবার সার্ভ করবো? “

হিরণ শীতল গলায় বললো,

“ কিছুর প্রয়োজন নেই। বেরিয়ে যাও সবাই। “

মহিলাটা সাহস করে বলে,

“ স্যার কিছুর প্রয়োজন হলে… “

হিরণের হুংকারে তার বাকি কথা অসম্পূর্ণই রয়ে যায়,

“ বললাম না কিছুর প্রয়োজন নেই? সবাই বেরিয়ে যাও। নাহয় খুব খারাপ হয়ে যাবে। “

হিরণের হুংকারে উক্ত মহিলা ভয়ে কেঁপে উঠে। মুহুর্তেই তিনি সহ বাকি হেল্পিং হ্যান্ডরা ঘর থেকে বেরিয়ে যায় যত দ্রুত সম্ভব। সম্পূর্ণ বাড়ি বাহিরের মানুষ শূন্য হতেই হিরণ দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে। সঙ্গে সঙ্গেই বহ্নির রুমের দরজার বাহিরে সে বাণীকে ফ্লাক্স হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।

হিরণের চেঁচামেচি শুনে বাণী কৌতূহল বশত এখানে দাঁড়িয়ে ছিলো। কিন্তু এই মুহুর্তে হিরণের এই ভয়ংকর রূপ দেখে তার মনে হচ্ছে সে খুব বড়ো ভুল করে ফেলেছে। তার উচিত ছিলো হিরণের হুংকার শুনতেই রুমের ভেতর গিয়ে দরজা লক করে ফেলা। নিজের ভুলের জন্য যখন বাণী আফসোস করতে ব্যস্ত সেই সময়টুকুতে হিরণ ত্রস্ত পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসে। শক্ত হাতের থাবায় বাণীর বাহু চেপে ধরে তাকে বহ্নির রুম হতে কিছুটা দূরে নিয়ে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরে। ছোট করে সাপের ন্যায় হিসহিসিয়ে প্রশ্ন করে,

“ কোন পুরুষের বাসায় উঠেছিলে তুমি? “

হিরণের চোখের দৃষ্টি আর তার গলার স্বর শুনে বাণীকে আবার ভয় জেকে ধরে। সে মৃদু গলায় বলে,

“ বহ্নি পানি চেয়েছিলো। ওকে পানি খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে, রুমে এসে পরে কথা বলছি। “

বাণীর উত্তর হিরণের মনপুত হয় না। সে একহাতে বাণীর হাতের ফ্লাক্সটা কেড়ে নিয়ে অন্য হাতে বাণীর গলা চেপে ধরে বলে,

“ পরে না এখনই কথা হবে। কার বাসায় ছিলে তুমি? কোন ব্যাচেলর তোমার প্রতি এতো মেহেরবান হয়েছে? “

বাণী ঢোক গিলে গলা সামান্য ভিজিয়ে বলে,

“ কোনো ব্যাচেলরের বাসায় ছিলাম না। ওই লোক শমসের মিথ্যা বলেছে। “

হিরণের ধৈর্য্য বাঁধ ভাঙে। তার বিধ্বংসী রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। সে বাণীর গলা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে অপর হাতের ফ্লাক্সটা দ্বারা দেয়ালে সজোরে আঘাত করতে করতে চেঁচিয়ে উঠে,

“ মিথ্যা বললে খুন করে ফেলবো। একদম মিথ্যা বলবে না। আমাকে দেখলে খুব ঘৃণা লাগে? অন্য পুরুষকে দেখলে ঘৃণা কাজ করে না?… “

বাণীর নিঃশ্বাস আটকে আসার উপক্রম পায়। তার উপর মাথার কাছে দেয়ালে ফ্লাক্সের এই আঘাতের শব্দ তার মস্তিষ্কে গিয়ে খুব তীক্ষ্ণ ঠেকছে। এরকম একটা পরিস্থিতেও বাণীর নিজেকে ছেড়ে বহ্নিকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। বাচ্চাটা ঘুমায় নি এখনো। ও যদি এখন এখানে চলে আসে? কি বিভৎসকর এক মানসিক আঘাত পাবে তার মেয়েটা!

বাণীর ভাবনার মাঝেই হিরণ ফ্লাক্সটা ছুড়ে ফেলে বাণীর গলা আরো জোরে চেপে ধরে তার মাথা দেয়ালের সঙ্গে আঘাত করতে করতে চেঁচিয়ে উঠে,

“ কার জন্য? কার জন্য শাড়ি পড়েছিলে? কোন শু*রের বাচ্চার সাথে এতোগুলো দিন কাটিয়ে এসেছো নাম বলো। “

হিরণের লাগাতার আঘাতের ফলে বাণীর মাথার পিছনের দিকটা বারবার দেয়ালের সঙ্গে বারি খাচ্ছে। অপরদিকে নিঃশ্বাস স্বল্পতায় মনে হচ্ছে এই বুঝি চোখ উল্টে দমটা ফুরিয়ে যাবে। নিজের হয়ে সাফাই গাওয়ার পরিস্থিতেও নেই সে। হিরণের হিংস্র চেঁচামেচি থেমে যায় একটা দৃঢ় কোমল স্বরের পিঠে।

“ মাম্মা ব্যথা পাচ্ছে। “

হিরণের হাতের বাধন আলগা হয়ে আসে। ঘাড় ঘুরিয়ে সে নিজের ভয়ংকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রুমের দরজার বাহিরে দাঁড়ানো ছোট বাচ্চা মেয়েটার পানে। বহ্নির চোখে তখন কিছুটা ভয়, কিছুটা বিস্ময় এবং এক আকাশ সমান ঘৃণা। মেয়ের চোখে সেই অবিশ্বাস্যকর ঘৃণার সাক্ষী হতেই হিরণের দৃষ্টি হতে হিংস্রতা উবে যায়। নরম ও কোমল হয়ে আসে তার দৃষ্টি। বাণী তখন দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে পড়েছে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টায় মত্ত সে। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে রেখেছে। মাথা মনে হচ্ছে এখনই ফেটে যাচ্ছে। মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ দপদপ করছে। মস্তিষ্ক ব্ল্যাংক এবং চোখের সামনে সবটা ঝাপসা হয়ে আছে তার।

হিরণ একপল বহ্নির ঘৃণা ভরা দৃষ্টি দেখে নিয়ে ফের বাণীর দিকে তাকায়। বাণীর অবস্থা দেখে সঙ্গে সঙ্গে তার ব্রেইনের বিবেক সিস্টেম টার্ন অন হয়। সে হাঁটু গেড়ে বাণীর সামনে বসে তার গাল ছুঁয়ে প্রশ্ন করে,

“ বাণী? আ’ম সরি। আমি তোমাকে হার্ট করতে চাই নি। “

বাণী তীব্র যন্ত্রণার মধ্যেই হিরণের হাত নিজের গাল থেকে সরিয়ে দেয়। হিরণ অসহায় অনুভব করে। কাকে আগে সামলাবে? বাণীকে নাকি বহ্নিকে? এরই মাঝে সে লক্ষ্য করে বাণীর নাক দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে। হিরণ ভীত হয়ে যায়। রক্ত আসছে কেন? মাথায় আঘাত পাওয়ার ফলে? সে দ্রুত নিজের পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে বাণীর দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই ছোট ছোট দুটো হাতের ধাক্কায় পিছিয়ে যায়। বহ্নি কণ্ঠে সবটুকু ঘৃণা ঢেলে দিয়ে বলে,

“ মাম্মার কাছে আসবে না তুমি। তুমি মাম্মাকে হার্ট করেছো। আই হেইট ইউ। “

হিরণ হতবুদ্ধির ন্যায় তাকিয়ে রয় মেয়ের পানে। বহ্নির চোখে তখন পানি টলমল করছে। সে কিছু বুঝতে পারছে না। নিজের সামনের এই হিংস্র লোকটা তার পাপা এই সহজ সত্যিটা তার ছোট্ট মস্তিষ্ক মানতে চাইছে না। কিন্তু নিজের মাম্মার অবস্থা দেখে এই সত্যিটা মানতে বাধ্য হয় সে। আরো একবার জোর গলায় উচ্চারণ করে,

“ আই হেইট ইউ। তুমি আমার পাপা না। “

কথাটুকু বলেই বহ্নি দ্রুত বাণীকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। এতক্ষণ শক্ত থাকলেও রক্ত দেখে সে ঘাবড়ে গিয়েছে বেশ। বাণীকে আঁকড়ে ধরে থরথর করে কাঁপতে থাকে সে। বাণী মেয়ের অবস্থা দেখে সাময়িক সময়ের জন্য নিজের যন্ত্রণাটুকু ভুলে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করে। একহাতের পিঠে নাকের রক্তটুকু মুছে মেয়েকে বুকে মিশিয়ে নিয়ে শান্ত করার সুরে বলে,

“ মা ঠিক আছি। ভয় পেও না। কিচ্ছু হয় নি মায়ের। “

বহ্নি শান্ত হয় না। বাণী মেয়ের অবস্থা দেখে ঝাপসা চোখ মেলে হিরণের দিকে তাকায় একবার। হিরণ তখন নিশ্চল ভঙ্গিতে তাদের পানেই তাকিয়ে ছিলো। সে বুঝতে পারছে না নিয়তি তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! বাণী ওই অবস্থায়ই আর কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে মেয়েকে তুলে দ্রুত বহ্নির রুমের ভেতর গিয়ে দরজা লক করে দেয়। শুধু লোক করেই ক্ষান্ত হয় না বরং ছিটকিনিটাও তুলে দেয়। অত:পর মেয়েকে বুকে মিশিয়ে সে দরজার সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে। অবশেষে সেই দিন এসেই পড়লো! বহ্নি তার পাপার হিংস্র রূপটা দেখেই ফেললো। বহ্নির উপর দিয়ে কি ঝড় বইছে তা আন্দাজ করতে পেরেই বাণীর কান্না পায়। সে মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে বলে,

“ চুপ থেকো না মা। কেমন লাগছে মাম্মাকে বলো। চেপে রেখে যন্ত্রণা বাড়িও না। “

বহ্নি অস্ফুটে কেবল আওড়ায়,

“ আই হেইট হিম। আই হেইট হিম। আই… “

দরজার অপর পাশে পিঠ ঠেকিয়ে বসে থাকা হিরণের কানে পৌঁছায় প্রতিটা শব্দ। শরীর থেকে রুহ বেরিয়ে যাওয়ার কষ্ট কতটা তীব্র হয় সেই সম্পর্কে হিরণের ধারণা নেই। কিন্তু এখন সে যেই ধরনের কষ্ট অনুভব করছে তা কোনোভাবেই রুহ বেরিয়ে যাওয়ার কষ্টের তুলনায় কম নয়। তার নিয়তি এমন কেন!

দরজার নিচে সামান্য ফাঁক দিয়ে বাণীর গায়ের ওড়নার কিছুটা অংশ বেরিয়ে আছে। হিরণ অসহায়ের ন্যায় সেই ওড়নার অংশটুকু দুই হাতের মুঠোয় পুড়ে নেয়। দূর্বল গলায় বলে,

“ মাফ করে দাও বাণী। “

ওড়নায় মৃদু টান পড়তেই এবং হিরণের কণ্ঠস্বর কানে ভেসে আসতেই বাণী তড়িৎ গতিতে বহ্নিকে কোল থেকে নামিয়ে দেয়। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে একটানে ওড়নার অংশটুকু হিরণের আওতা থেকে ছাড়িয়ে নেয়। এতক্ষণে দমিয়ে রাখা কান্নাটা এবার চোখ ছাপিয়ে জল হয়ে বেরিয়ে আসে। আচমকা ফের তার মাথায় কিছুক্ষণ আগের আঘাতের ফলে তীক্ষ্ণ ব্যথাটুকু জাগ্রত হয়। বাণী দুইহাতে মাথার চুল টেনে ধরে আর্তনাদ করে উঠে। তার আর্তনাদ দেখে বহ্নি ভীত হয়ে পড়ে। সে বিছানার সঙ্গে গুটিসুটি মেরে সাক্ষী হতে থাকে নিজের মাম্মার এই করুণ অবস্থার।

দরজার অপর পাশে বসে থাকা হিরণের কানেও পৌঁছায় বাণীর আর্তনাদ। বাণীর সেই আর্তনাদ তার অন্তরের স্বত্তা কাঁপিয়ে তুলে। দিকদিশা শূন্যের ন্যায় সে হাসফাস করতে থাকে। এলোমেলো হাতে শার্টের গলার কাছের দুটো বোতাম খুলে ফেলে সে। হুট করে নিজের প্রতি তীব্র ঘৃণা থেকে সে নিজের মৃত্যুকামনা করে বসে। রুমের ভেতরে উপস্থিত এই দু’জন মানুষের কষ্টের কারণ হওয়ার থেকে মৃত্যু শ্রেয়।

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৬.

সরু গলিপথ ধরে হেঁটে চলেছে দুজন ব্যক্তি। এই ভীনদেশের মাটিতেও নিজের পুরুষালি কর্তব্যটুকু পালন করতেই রিদওয়ান জারিয়াহকে তার ঠিকানা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছে। প্রত্যয় ও রাফি ইতিমধ্যে নিজেদের ক্যাম্পিং এরিয়ায় ফিরে গিয়েছে। আজকে কেবল আড়াল হতে তারা ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা লোক দুটোর গতিবিধি মেপে চলে এসেছে। রিদওয়ানদের অনুমান মতে ওই জায়গায় আরো লোক আছে। আর লোকগুলো খুব একটা সাধারণ নয়। সিভিল ড্রেসের আড়ালে এবং কাপড় দিয়ে ঢাকা মুখের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে নিজেদের আসল কোনো পরিচয়।

ভাবনা চিড়ে নীরবতার ইতি ঘটিয়ে রিদওয়ানই প্রথম বলে,

“ তোমার পরিবারে শুধু তোমার বোন আছে? “

জারিয়াহ একপল রিদওয়ানের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নত করে ফেলে। হাঁটার গতি স্থিতিশীল রেখেই সে বলে উঠে,

“ মা – বাবাও ছিলো। অন্য শহরে থাকতাম আমরা। আমার বোন জুবেদা একদিন পাড়ার বাচ্চাদের সাথে খেলতে বেরিয়েছিলো। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসায় আমি ওকে আনতে যাই। খেলার মাঠ থেকে ওকে নিয়ে ফেরার পথে আচমকা মনে হলো পায়ের তলের মাটিটা সম্পূর্ণ কেঁপে উঠলো। কানের কাছে এক বিধ্বংসী ধ্বসে পড়ার শব্দ হয়। আমি আর আমার বোন দৌড়ে বাসার কাছাকাছি যেতেই দেখি আমাদের বাসাসহ আশেপাশের আরো কিছু বাসা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। বুঝতে পারি এই ধ্বংসযজ্ঞ কারা চালিয়েছে। সঙ্গে এ-ও বুঝতে পারি ওই বর্বরা শুধু আমার মাথার উপরের ছাদ নয় বরং বাবা মা’র ছায়াও কেড়ে নিয়েছে। এতিম হয়ে গিয়েছি। “

এতদূর শুনতেই রিদওয়ান অস্থির অনুভব করে। প্রশ্ন করে,

“ তারপর কি করলে? “

“ ওই শহরে তখন একের পর এক হামলা চলছিলো। জীবনের নিশ্চয়তা ছিলো না। বাঁচার তাগিদে বোনকে নিয়ে ওই শহর ছেড়ে যত সম্ভব দূরে চলে আসি। এখানেও যে খুব জীবনের নিশ্চয়তা আছে তা নয়। কিন্তু এখানে হামলার পরিমাণ এখনো কম। “

বেশ সরল ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে জারিয়াহ। রিদওয়ান বলে,

“ এখানে তোমার পরিচিত কেউ আছে? “

“ উহু। “

“ তাহলে কার ভরসায় আছো এখানে? জীবিকা কিভাবে চলছে? “

জারিয়াহ মৃদু হেসে বলে,

“ আল্লাহর ভরসায়। উনি রিজিক রেখেছেন বলেই জীবিকা চলছে। রিজিক ফুরিয়ে গেলেই, দমটাও ফুরিয়ে যাবে। “

রিদওয়ানের পা আচানক থেমে গেলো। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সরল মুখশ্রীর মেয়েটার দিকে। অত:পর বলে উঠে,

“ তুমি বেশ সাহসী জারিয়াহ। “

জারিয়াহ হেসে প্রশ্ন করে,

“ একজন সৈন্যের মতো? “

“ যুদ্ধ যেহেতু লড়ছো সেহেতু সৈন্যের মতোই৷ “

রাস্তার পাশে একটা ছোট একরুমের ধ্বংস স্তুপের সামনে এসেই জারিয়াহর পা থেমে যায়। সে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলে,

“ ধন্যবাদ। সাবধানে যাবেন। “

রিদওয়ান শীতল চোখ মেলে দেখে জারিয়াহর ছোট্ট বাসা নামক ধ্বংস স্তুপটাকে। বাড়ির একপাশের দেওয়ালের অর্ধেকটাই বলতে গেলে নেই। সেইটুকু একটা বড় চাদর দিয়ে কোনো মতে ঢাকা। রিদওয়ান কিছু একটা ভেবে আচমকা নিজের গায়ের উষ্ণ জ্যাকেটটা খুলে জারিয়াহর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,

“ তুমিও সাবধানে থেকো। আসি। “

জারিয়াহ অবাক হয়ে কিছুক্ষণ নিজের হাতের জ্যাকেটের দিকে তাকিয়ে রয়। রিদওয়ান ততক্ষণে বেশ ক্ষানিকটা দূরে চলে গিয়েছে। জারিয়াহ হঠাৎ পিছু ডাকতেই সে ফিরে তাকায়। জারিয়াহ সরল গলায় বলে উঠে,

“ আমার অপেক্ষা করবেন। আমাকে ছাড়া কাল রাতে ওদিকটায় যাবেন না দয়া করে। “

__________

বাণী তখন তীব্র মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ব্যথায় থেকে থেকেই মৃদু গোঙাচ্ছে সে। বহ্নি এতক্ষণ ভীত হয়ে দূর হতে মাম্মার এই তড়পানো দেখলেও এবার সে সাহস করে উঠে দাঁড়ায়। সবার আগে দৌড়ে গিয়ে সে টিস্যুবক্স হতে দু তিনটে টিস্যু হাতে নিয়ে বাণীর কাছে এগিয়ে যায়। অত:পর বাণীর সামনে বসে নিজের ছোট ছোট হাত দ্বারা অতি সাহসের সঙ্গে তার নাক হতে বের হওয়া রক্তটুকু মুছে দেয়। বাণী ঝাপসা চোখ মেলে তা দেখে। ফের চোখ বন্ধ করে মেয়ের এই যত্নটুকু অনুভব করে।

বহ্নি সন্তর্পণে কাজটুকু সেড়ে মাম্মার হাত আলতো টেনে ধরে বলে,

“ আমার কোলে শুয়ে পড়ো মাম্মা। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। ব্যথা চলে যাবে। “

বাণী মেয়ের কথা শুনে ফের চোখ মেলে তাকায়। তীব্র যন্ত্রণার মধ্যেও সামান্য স্বস্তি খুঁজে পায়। উপরওয়ালা তার এইটুকু মেয়েকে এতো বুঝ কেনো দিয়েছে? যাতে মায়ের কষ্টটুকু বুঝতে পারে? বাণী আর কোনো টু শব্দ না করে নীরবে মেয়ের কোলে মাথা রেখে ফ্লোরে শুয়ে পড়ে। বহ্নি ভদ্র বাচ্চা। একটুও জ্বালাতন করে না মা’কে। বরং নিজের ছোট হাত জোড়া দ্বারা বাণীর চুলের মাঝে বিলি কাটতে থাকে। এই কাজটা সে তার মাম্মার কাছ থেকেই শিখেছে। বহ্নি যখন অসুস্থ হয় তখন তার মাম্মাও এভাবেই তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সঙ্গে অবশ্য ওষুধও দেয়। কিন্তু বহ্নি তো আর ওষুধ চিনেনা। সে কিভাবে মাম্মাকে ওষুধ দিবে? বড়ো হয়ে ডাক্তার হলে কেমন হয়? তখন সে ঠিকই ওষুধ চিনবে। মাম্মার ব্যথা কমানোর জন্য সে ওষুধ খুঁজে এনে দিতে পারবে।

বহ্নির ছোট্ট মস্তিষ্কের হাবিজাবি ভাবনার মাঝেই বাণী ধীরে ধীরে ঘুমে তলিয়ে যায়। বহ্নি তবুও নড়ে না। একইভাবে বসে রয়। নড়লে যদি মাম্মা উঠে যায়?

__________

রিদওয়ান সবে মাত্র ক্যাম্পিং এরিয়ায় ফিরে এসেছে। নিজের তাবুতে প্রবেশের পূর্বেই রাফি তাকে টেনে নিজের তাবুতে নিয়ে যায়। প্রত্যয় সেখানে আগে থেকে উপস্থিত ছিলো। রিদওয়ান অবাক সুরে প্রশ্ন করে,

“ তোরা এখনো ঘুমাস নি? “

রাফি ভ্রু দ্বয়ের মাঝে ভাজ তুলে প্রশ্ন করে,

“ আগে বল তোর চক্কর কি? “

রিদওয়ান অবাক হয়।

“ আমার আবার কিসের চক্কর! “

প্রত্যয় জানতে চায়,

“ কি নিয়ে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে বুঝতে পারছিস না? “

“ না। “

রাফি রিদওয়ানের পিঠে চাপড় মেরে বলে,

“ শালা সারা রাস্তায় আমরা নোটিশ করেছি। তোর চোখ সরছিলোই না জারিয়াহর থেকে। কেস কি এখন সেটা বল। হৃদয় ঘটিত ব্যাপার? “

রিদওয়ান বিরক্তি মিশ্রিত গলায় বলে,

“ কিসের সাথে কি পান্তা ভাতের ঘি! “

প্রত্যয় বলে,

“ অস্বীকার করবি না রিদওয়ান। প্রথম দিনও তুই ওর দিকে কিভাবে তাকিয়েছিলি তা কিন্তু আমরা ভুলে যাই নি। “

রিদওয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করে,

“ আসলে এখানে আসার পর থেকে এখানে স্থানীয় সবার জন্যই মায়া লাগছে আমার। জারিয়াহও এর ব্যতিক্রম নয়। হয়তো ওকে একটু কাছ থেকে দেখেছি বলে মায়াটা একটু বেশি লাগছে। এই আরকি! “

রাফি জানতে চায়,

“ তাহলে ভ্যাবলার মতো ওর দিকে তাকিয়ে ছিলি কেন? “

“ আরে ভাই ওর চোখের রঙ একটু ব্যতিক্রমী। নিজে স্বচক্ষে কখনো নীল চোখের মানুষ দেখিনি। তাই আগ্রহবশত একটু দেখছিলাম। এই সামান্য ব্যাপারটাকে টেনে তোরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস! “

রিদওয়ানের কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলা কথাটুকু শুনে রাফি প্রসঙ্গ বদলে বলে,

“ আচ্ছা যা বাদদে। কিন্তু দোস্ত তোর জ্যাকেট কোথায়? “

রিদওয়ান অকপটে বলে ফেলে,

“ জারিয়াহকে দিয়ে এসেছি। “

কথাটা বলেই সে জিভ কাটে। অত:পর বন্ধুদের দিকে তাকাতেই দেখে তারা কেমন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রত্যয় খানিকটা মশকরা করে বলে,

“ মন দিস নি কিন্তু জ্যাকেট দিয়ে চলে এলি? “

রাফি এবার ঠোঁট টিপে হাসতে শুরু করে। প্রত্যয়ও সামান্য হাসছে। রিদওয়ান বিরক্ত হয়ে বলে,

“ ধ্যাৎ। “

__________

বিশাল আলিশান বাড়ির বাহিরে কঠোর নিরাপত্তার বেড়াজাল। এক দল লোক বর্ডার পাহারা দেওয়ার মতো করেই টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে বাড়ির চারিদিকে। বাড়ির সামনে পাকা রাস্তার অপরপাশটা কেমন গভীর জঙ্গুলে। সেই জঙ্গলের ভেতর হতেই আপন আপন স্থান হতে সেই টহলকারীদের উপর নজর রাখছে চার জোড়া চোখ। টহলকারীদের প্রতিটি গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত তারা।

আচমকা সাইফ ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ বালামার। মশা কামড়ায়া মাইরা ফেলতাসে। “

সাদাত সাইফের দিকে সামান্য চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে চুপ থাকার ইশারা করে। সাইফ চুপ হয়ে গেলেও তার মুখ থেকে বিরক্তি ভাবটা সম্পূর্ণ কাটে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই জুনায়েদ ও ফারদিন চাপা স্বরে ফিসফিসিয়ে উঠে,

“ কেউ বের হচ্ছে সম্ভবত। “

সাদাত এবং সাইফ সঙ্গে সঙ্গে প্রধান ফটকের দিকে দৃষ্টি স্থির করে। বিশাল ফটকটা ধীরে ধীরে দু’দিকে খুলে যায়। একটা কালো রঙা গাড়ি বাড়ির ফ্রন্ট ইয়ার্ড হতে বেরিয়ে আসে। সাইফ দ্রুত নিজের হাতের ক্যামেরায় তা দৃশ্যবন্দী করে। জুম করেও বেশ কিছু ছবি তুলে। সম্পূর্ণ কাজটা সে করে অতি নীরবে। সাদাত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে গাড়ির ভেতরে বসা মানুষটাকে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু গাড়ির জানালার কাঁচ ভেদ করে ভেতরে অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা মানুষটাকে স্পষ্ট দেখা যায় না।

সাদাত সেই গাড়িটাকে অনুসরণের উদ্দেশ্যে উঠতে নিলেই আচমকা তার কানে ক্যামেরায় ছবি ধারণের শব্দ ভেসে আসে। সাদাত অবাক সুরে সাইফকে প্রশ্ন করে,

“ সাউন্ডটা কি তোর ক্যামেরা থেকে এসেছে? “

সাইফ, জুনায়েদ এবং ফারদিনের কানেও সেই শব্দ ভেসে এসেছিলো। সাইফ বিষ্ময় নিয়ে বলে,

“ আমার ক্যামেরার সাউন্ড না এটা। “

সাদাত সহ সকলেই সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি মেলে পরখ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আচমকা সাদাত লক্ষ্য করে জঙ্গলের একপাশ দিয়ে একটা ছায়া ক্যামেরা হাতে দ্রুত দৌড়ে পালাচ্ছে। সাদাত আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে না। বড়ো বড়ো পা ফেলে সেই ছায়াকে অনুসরণ করে দৌড়ে যায়। দৌড়ানোর সময় ধুপধাপ পায়ের শব্দে টহলকারীদের মধ্যে একজনের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। সাইফ তা লক্ষ্য করতেই দ্রুত জুনায়েদ আর ফারদিনকে তাড়া দেয়,

“ তোরা শর্টকাট ধরে তাড়াতাড়ি এখান থেকে ফুট হ। আমি সাদাতের পিছনে যাচ্ছি। “

বলেই সাইফ আর অপেক্ষা করে না। দ্রুত সাদাতের পিছু পিছু দৌড়ে যায়। টহলকারীরা এদিকে এগিয়ে আসার পূর্বে জুনায়েদ আর ফারদিনও ভাগ মিলকা ভাগের মতো শর্টকাট ধরে উল্টো পথে ছুট লাগায়। আচমকা মাঝপথে জুনায়েদ পায়ের গতি থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তাকে থেমে যেতে দেখে ফারদিনও থেমে যায়। বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নিতে নিতে প্রশ্ন করে,

“ থামলি কেনো? “

জুনায়েদ বুক টান টান করে দাঁড়িয়ে বলে,

“ আমরা কেনো পালাচ্ছি? আমরা সৈন্য। এভাবে শত্রু দেখে পালিয়ে যাওয়া আমাদের মানায় না। “

এরকম একটা সিচুয়েশনে জুনায়েদের এই ডায়লগ শুনে ফারদিনের রাগ উঠে। সে জুনায়েদের ঘাড়ের কাছের কলার হাতের মুঠোয় পুড়ে নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বলে,

“ শালা নিজেও মরবি একদিন আমাকেও মারবি। “

__________

পিছনে কেউ দৌড়ে তাকে অনুসরণ করছে টের পেতেই ছায়াটা নিজের পায়ের গতি আরো বাড়ায়। গম্ভীর পুরুষালি একটা স্বর পিছন থেকে আদেশ দেওয়ার মতো করে বলে উঠে,

“ স্টপ! আদারওয়াইজ আই’ল শুট। “

ছায়াটা থামে না। উল্টো আরো জোরে দৌড়ায়। সাদাত দৌড়াতে দৌড়াতে নিজের প্যান্টের পিছন থেকে কায়দায় পিস্তলটা বের করে নেয়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকায় দূরন্ত ছায়ার পানে। শু, প্যান্ট, শার্ট, জ্যাকেট ও তার সঙ্গে মাথায় ক্যাপ পরিহিত হ্যাংলা যুবকটার মধ্যে থামাথামির কোনো লক্ষণ নেই৷ সাদাত বাধ্য হয়ে এবার পায়ের গতি সামান্য স্থিতিশীল করে পিস্তল তাক করে ছায়াটার বাম হাতের বাহু বরাবর নিশানা স্থির করে। সাইলেন্সার বসানো পিস্তলের ট্রিগারটা চাপতেই একটি বুলেট নীরব ঘাতকের ন্যায় গিয়ে সেই ছায়াটাকে আঘাত করে। ছায়া মানব মুহুর্তেই নিজের কাধ চেপে ধরে মাটিতে নুয়ে পড়ে।

সাদাত সঙ্গে সঙ্গে থামে। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠে। গুপ্তচোরকে ধরার জন্য ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। ঠিক পিছনে গিয়ে যখন সে দাঁড়ায় তখন আচমকাই ওই আহত ছায়াটা সোজা হয়ে নিজের ডান হাতের কনুইয়ের সাহায্যে সাদাতের বুক ও পিঠের মাঝামাঝি জায়গায় জোরে আঘাত করে। আচমকা আঘাতে সাদাত চাপা আর্তনাদ করে উঠে। হ্যাংলা দেখতে ছায়াটার কনুইয়ের হাড়কে কোনো রডের সাথে তুলনা করলে ভুল হবে না। আঘাত করেই ছায়াটা পালানোর জন্য ছুটতেই সাদাত পিছন থেকে হাত বাড়িয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করে। ফলস্বরূপ সেই ছায়া মানবের মাথার ক্যাপটা খুলে সাদাতের হাতে এসে পড়ে।

সঙ্গে সঙ্গে সে ভিমড়ি খায়। এতক্ষণ সে যাকে ছায়া মানব ভাবছিলো সে কোনো ছায়া মানব নয়, বরং ছায়া মানবী। মেয়েটার দৌড়ের গতির সঙ্গে পিঠময় জুড়ে দুলতে থাকা দীঘল রেড ওয়াইন কেশ তো তাই বলছে। সাদাত বিমূঢ় হয়ে মেয়েটার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। সাইফ ততক্ষণে দৌড়ে সাদাতের কাছে এসে এই অবস্থা দেখে প্রশ্ন করে,

“ কি রে? এইভাবে যেতে দিলি? “

সাদাত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

“ যেতে দিলাম। “

সাইফ অবাক হয়ে জানতে চায়,

“ কেনো? “

“ চোর পুলিশ খেলতে চাইছে। আমি নাহয় একটু খেলতে দিলাম। “

সাইফ সাদাতের কথার ভাবার্থ বুঝতে পারে না। উল্টো বেশ বিরক্ত হয়। মানব জাতির এই এক সমস্যা। সোজা সাপ্টা কথাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বললে এদের পেটের ভাত হজম হয় না।

__________

নির্জন এক সড়কের ধারে এসে কালো গাড়িটা থামে। গাড়ির ভেতর বসে থাকা মানুষটা শীতল চোখ মেলে একবার অন্ধকার রাস্তার পানে তাকায়। অত:পর গাড়ির জানালাটা নামিয়ে দেয়। রাতের এই বাতাসটা বড্ড স্নিগ্ধ ও শীতল। কেমন গা কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার দু ধারে উঁচু গাছের সারিই এই বাতাসের মূল উৎস।

এই শান্ত পরিবেশে গাড়ির ভেতর ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা মানুষটা আচমকা একহাতে শক্ত করে স্টিয়ারিংটা চেপে ধরে অপর হাতে স্টিয়ারিংয়ে আঘাত করতে শুরু করে। তার চোখ ছাপিয়ে নামে জল। ভয়ংকর চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে সে। কানের কাছটায় ভাসতে থাকে নিজের মেয়ের উচ্চারণ করা তিনটি শব্দ,

“ আই হেইট ইউ। “

রাতের আঁধারে এবং জনমানবহীন নির্জন রাস্তায় হিরণের কান্না মিশ্রিত চিৎকার গুলো মিলিয়ে যেতে থাকে। সব ছক এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। তার মেয়েকে আর সবকিছু নিয়ে সে বুঝ দিতে পারলেও এবার বুঝ দেওয়ার আর কোনো উপায় নেই। বহ্নি স্বচক্ষে ঘটনাটার সাক্ষী হয়েছে। সে দেখেছে কিভাবে তার পাপা তার মাম্মাকে আঘাত করছিলো। এই ঘটনার কি ব্যখ্যা দিবে হিরণ? তার মেয়ে আদৌ কোনো ব্যাখ্যা কানে তুলবে?

মুহুর্তেই হিরণের চোখের সামনে ভেসে উঠে বাণীর আহত মুখ। নিজের প্রতি তীব্র ঘৃণা অনুভব করে সে। কিভাবে পারলো সে বাণীকে আঘাত করতে? ওই শমসেরের কথায় সে কিভাবে নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো? আর কেউ না জানুক হিরণ তো জানে বাণী দুশ্চরিত্রা নয়। তাহলে সেই মুহুর্তে কেনো নিজের বিধ্বংসী রাগের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলো না সে? কি করবে সে? বাণী আর বহ্নির পায়ের কাছে গিয়ে লুটিয়ে পড়বে? মাফ চাইবে? মাফ করবে আদৌ?

হিরণ এলোমেলো হাতে নিজের পকেট থেকে ফোনটা বের করে। অত:পর গুগলে গিয়ে দ্রুত সার্চ করে ‘Is it dangerous to get injured in head?‘ গুগল সঙ্গে সঙ্গে নিজের উত্তর পেশ করে ‘Head injuries are one of the most common causes of disability and death in adults. The injury can be as mild as a bump, bruise or cut on the head. Head injuries cause internal bleeding and damage to the brain.’

লেখাটুকু পড়তেই হিরণ আতঙ্কিত হলো। তার স্পষ্ট মনে আছে সে কি পরিমাণ জোরে বাণীর মাথায় আঘাত করেছে। একবার নয় বরং অনেকবার। হিরণের কানে ফের ভেসে আসে রুমের ভেতর হতে বাণীর যন্ত্রণায় করা আর্তনাদ। সে আবার নিজের মাথা চেপে ধরে। নিজের করা পাপের কথা ভেবেই তার নিঃশ্বাস আটকে আসে। মনে হয় যেনো সমুদ্রের অতল ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। চারিদিকে কোনো কিনারা নেই৷ হিরণ আচমকা উপলব্ধি করে তার বহু বছরের তিলে তিলে গড়া এই সাম্রাজ্যের ছাদ ছিলো বহ্নির ভালোবাসা। যা সবসময় তাকে রোদ, তাপ, ঝড়, বৃষ্টি হতে রক্ষা করতো। কিন্তু আজকে মনে হচ্ছে যেনো সেই ছাদ ভেঙে পড়েছে। আর এতটা কঠিনভাবে ভেঙে পড়েছে যে আর কখনো তা হিরণকে এক রত্তি পরিমাণ ছায়া দিবে না।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]