এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান পর্ব-৬৫+৬৬+৬৭

0
225

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৬৫.

সারিবদ্ধ এম্বুল্যান্স গুলোর ভীড় জমেছে ঢাকার পান্থপথের রাস্তা জুড়ে। রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানব দেহ গুলোকে পালাক্রমে স্ট্রেচারে তুলে ত্রস্ত পায়ে এম্বুল্যান্স গুলোর দিকে ছুটছে একদল হসপিটাল কর্মী। ভীড় জমেছে পুলিশ কর্মকর্তাদের, সেনাবাহিনীর এবং সাংবাদিকদের। হাজার মানুষের ভীড়ের মাঝে নীরব ভঙ্গিতে রাস্তার ধারে বসে আছে সবুজ এবং খাকি রঙের মিশেলের ইউনিফর্ম পরিহিত এক পুরুষ। কিছুক্ষণ আগেই ভাই তূল্য বন্ধুর লাশ নিজে বয়ে এম্বুল্যান্সে তুলে দিয়েছে সে। কি ভারী সেই লাশের ভার!

খুব কাছেই শোনা যাচ্ছে সাংবাদিকদের লাইভ বক্তব্য। সাইফের কানে ভেসে আসছে সেই কথাগুলো,

“ আরো একবার দেশের বুকে বয়ে গেলো একটা রক্তক্ষয়ী হামলা। প্রাণ হারিয়েছে প্রায় শতাধিক মানুষ। জনগণের প্রশ্ন কি করছে সামরিক বাহিনী? কি করছে পুলিশ সমাজ? তাদের উদাসীনতাই কি হামলাকারীদের সাহস বাড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে? হামলা… “

সাইফ নীরবে শুনে সবটা। মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। সত্যিই তো! সামরিক বাহিনী খুব উদাসীন! মুখে আঙুল দিয়ে চুষছে তারা। কোনো দায়িত্ববোধ নেই তাদের। দেশের মানুষ গুলোর তো এটাই ধারণা।

দেশটাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য কত-শত সৈন্য প্রতিনিয়ত সীমান্তে নিজেদের জীবন হারাচ্ছে সেই হিসেব কি এই দেশ বাসীর আছে? আজকের হামলায় এতো গুলো নিহত মানুষের ভীড়ে যে একজন সৈন্যও প্রাণ হারালো, সেই দিকে কি কারো হুশ আছে? উঁহু। নেই। সৈন্যরা মানুষ না। তাদের জীবনের মূল্য নেই। একটা কেনো, একশোটা সাদাত সরকার মরলেও এই দেশের মানুষ গুলোর কিছুই আসবে যাবে না।

যায় আসবে কেবল শহীদের পরিবারের। সেই মা’য়ের যে কিনা নিজের ছেলে হারালো, সেই বোনদের যারা নিজেদের মাথার উপরের ছায়া হারালো, সেই বন্ধুদের যারা ভাই তূল্য সহোদর হারালো, সেই প্রেয়সীর যে কিনা গোপন অনুভূতির কেন্দ্রবিন্দু হারালো। এই দেশের মানুষ গুলোর একটা লেফটেন্যান্ট সাদাত সরকার হারানোতে খুব বড়ো কোনো ফারাক পড়বে না।

একজন সৈন্য এগিয়ে এসে সাইফকে নিজের হাতের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ লেফটেন্যান্ট, জুলফিকার স্যার কথা বলবেন। “

সাইফ নীরবে ফোনটা কানে ধরে হ্যালো বলতেই জুলফিকার মুজতবা বলে,

“ গেট এ গ্রিপ ইয়াং ম্যান। তোমার কষ্টটা বুঝতে পারছি। কিন্তু নিজেকে সামলে নাও। শহীদকে আগামীকাল নিজের ঠিকানায় পৌঁছে দিতে হবে। আমি, মেজর দূর্জয় সহ বাকি লেফটেন্যান্টরা সকাল দশটার ভেতর খুলনায় পৌঁছে যাবো। শহীদকে নিজের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটা তোমার রইলো। “

সাইফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,

“ রজার দ্যাট স্যার। “

জুলফিকার মুজতবা শক্ত গলায় কথাগুলো বললেও উনি সাইফের অবস্থা কল্পনা করতে পারছেন। বহু বছর আগে তিনিও ভাই সমতুল্য কারো লাশ বহন করেছিলেন। সেই ভারটা বওয়া যে মোটেও সহজ নয় তা তিনি ভালো করেই জানেন। কিন্তু তাদের পেশায় সেই হারানোর আবেগটুকুকে দীর্ঘক্ষণ স্থান দেওয়ার সুযোগ নেই। এই একরোখা কর্মজীবনের বড্ড নিষ্ঠুর এক নিয়ম এটা। তবে সৈন্যদের অভিযোগ করার সুযোগ নেই সেসব নিয়ে। কারণ সৈন্যদের তো এরকম-ই হওয়া চাই। শক্ত পিলারের ন্যায়। যত বড় ভূমিকম্পই আঘাত হানুক না কেনো তাদের ভেঙে পড়া যাবে না। নাহয় ইমারতের ন্যায় এই দেশটাও যে দূর্বল হয়ে পড়বে।

ফোনটা রেখে আরো কিছুক্ষণ বসে রয় সাইফ। পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমাণ সৈন্য বলে উঠে,

“ লেফটেন্যান্ট, গাড়ি অপেক্ষা করছে। হসপিটাল যেতে হবে আমাদের। চলুন। “

সাইফ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ আপনি যান। আমি আসছি। দুই মিনিট সময় দিন। “

সৈন্যটা চলে যেতেই সাইফ এবার নিজের পকেট হতে ফোনটা বের করে। বুকের ব্যথার ভার যতই ভারী হোক না কেনো, নিজের প্রেমিক হওয়ার দায়িত্বটা ভুলে যায় না সে। তার চিন্তায় রাত জেগে বসে থাকা অভুক্ত প্রেয়সীকে কল করতেই ফোনটা রিসিভ হয়। সম্ভবত ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিলো। নিশা অস্থির গলায় বলে,

“ হ্যালো? ঠিক আছেন আপনি? সাদাত ভাইয়া… আমি শুনেছি। আপনার খুব খারাপ লাগছে তাই না? আল্লাহ ভাইয়াকে জান্নাত নসিব করবে। এই… আপনার কান্না পাচ্ছে? কাঁদতে ইচ্ছে করছে? কাঁদুন প্লিজ। মনে জমিয়ে রাখবেন না। আমার কাছে লজ্জা পাবেন না। আমি আপনার কান্নাটুকু না দেখলে কে দেখবে বলুন? “

সাইফ শান্ত ভঙ্গিতে শুনে সবটা। অত:পর শীতল গলায় বলে,

“ ঠিক আছি ইয়াসমিন। অস্থির হবেন না। ঘুমিয়ে পড়ুন আপনি। “

নিশা স্থির হয় না। তার বুকে অদ্ভুৎ যন্ত্রণা হচ্ছে। এই লোকটা পাথর নাকি? কখনো কাঁদে না কেনো? কোন কৃষ্ণ গহ্বরে লুকিয়ে রাখে এতো অপ্রাপ্তি আর হারানোর হিসাব? নিশার খুব কান্না পায়। কান্নাটা সে দমিয়ে রাখতে পারে না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। তার নাক টেনে কান্নার শব্দ ফোনের অপর পাশের মানুষটা শুনে। সাইফ ঠোঁট কামড়ে আকাশ পানে চায়। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে আসলেও স্বাভাবিক গলায় বলে,

“ কিভাবে কাঁদবো ইয়াসমিন? আমার হয়ে আমার দুঃখ গুলোর যন্ত্রণায় কাঁদার জন্য আপনি আছেন। আমি না দেখানো সত্ত্বেও আমার দুঃখ গুলো আপনি দেখতে পাচ্ছেন। কি অদ্ভুৎ! “

__________

দু হাতের বেশ কিছু আঙুলের নখ উপড়ে ফেলার যন্ত্রণা বিন্দু পরিমাণ অনুভব করছে না হিরণ। তার বুকে অদ্ভুৎ প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে। সেই প্রশান্তি এতটাই স্বস্তিদায়ক যে একটু পর পর হিরণ আপন মনে হেসে উঠছে। নির্মল সেই হাসির ভঙ্গি। বাণী আর বহ্নি বেঁচে আছে, এই ছোট সত্যিটাই তাকে মন খুলে হাসতে বাধ্য করছে। যদিও প্রথমে সে সত্যটা বিশ্বাস করতে চায় নি। ভেবেছিলো তার পেট থেকে তথ্য জানার জন্য জুলফিকার মুজতবার সাজানো কোনো ফাঁদ এটা। তবে যখন জুলফিকার মুজতবা একটা নাম্বার ডায়াল করে ফোনটা স্পিকারে দেয়, তখনই ফোনের অপরপাশ হতে বাণীর কণ্ঠ স্বর শুনতেই হিরণের বিশ্বাস হয় বাণী বেঁচে আছে। পেছন হতে বহ্নির গলাও শুনতে পেয়েছিলো হিরণ।

মানুষ দুটোকে বর্বরদের হেনস্থার শিকার হওয়া থেকে বাঁচাতে সে বাধ্য হয়ে ওই মুহুর্তে সত্যটা জুলফিকারকে জানায়। বাণী আর বহ্নির জীবনের থেকে বেশি ওই হামলাটা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। মনটা বেশ ফুরফুরে হওয়ায় হিরণের হঠাৎ করে মনে পড়ে অতীতের সামান্য এক ঝলক।

বাণীকে নিজের বাসায় আনার তিন মাস পরের ঘটনা। দিনের বেলা ইচ্ছাকৃতভাবেই বাণীর খুব একটা মুখোমুখি হতো না হিরণ। তাকে দেখলেই বাণী ক্ষেপে নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যেতো। সারাদিন অদ্ভুৎ এক আতংক নিয়ে জেগে থাকতো মেয়েটা। রাতেও আতংকের কারণে ঠিকঠাক ঘুমোতে পারতো না। ভয় পেতো এই বুঝি হিরণ তার কাছে এলো।

হিরণ এসব দেখতো, বুঝতো, তবে কিছু বলতো না। তবে মাত্রারিক্ত ঘুমের ঘাটতির ফলে বাণী অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে ভেবে সে গোপনে এক ডাক্তারের পরামর্শে বাণীর জন্য ঘুমের ওষুধের পথ বেছে নেয়। সরাসরি অফার করলে বাণী কখনোই ওষুধ খেতে রাজি হতো না বলে, সে ঘরের রাধুনিকে বলে রেখেছিলো যেনো প্রতি রাতে বাণীর খাবারের সাথে ওষুধ গুড়ো করে মিশিয়ে দেয়। এই পন্থাটা কার্যকরী ছিলো। স্লিপিং পিলের সুবাদে রাতের সময়টুকু বাণী একটু ঘুমের দেখা পেতো। এতে অবশ্য হিরণেরও সুবিধা হতো। ঘুমের ঘোরে বাণীর রুমে গেলেও কখনো বাণী তা টের পেতো না। হিরণ মাঝেমধ্যে যখন বাণীকে ছুঁয়ে দিতো তখনো বাণীর হদিস থাকতো না। বাণীকে কাছ থেকে দেখার অফুরন্ত সময় পেতো তখন সে। ঠিক প্রথমদিন হসপিটালে সেই মুখ দর্শনের ন্যায়।

এরকমই একদিন রাতে বাণী ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার পর হিরণ রুমে প্রবেশ করে। রুমের লাইট জ্বেলে দিয়ে সে ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে বাণীর পাশে বসে। বেশ অনেকক্ষণ নীরবে সেই মুখশ্রী পরখ করে উঠে যেতে নিয়েই হঠাৎ খেয়াল করে যে বাণীর ঘাড়টা বেকায়দায় বাকা হয়ে আছে। কি ভেবে যেনো হিরণ এগিয়ে গিয়েছিলো ঘাড়টা ধরে মাথাটা সামান্য সোজা করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু যে-ই মুহুর্তে সে বাণীর ঘাড় ছোঁয় সঙ্গে সঙ্গে বাণী চোখ মেলে তাকায়। আকস্মিক ঘটনায় হিরণ যতটা না হতবিহ্বল হয় তার থেকেও বেশি অবাক হয় যখন পেটের বাম পাশের খানিকটা উপর দিকে শার্ট চিরে শরীরের ভেতর ধারালো কিছুর প্রবেশ টের পায়।

হিরণ বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে বাণীর দিকে তাকায়। বাণী এবার নিজের হাতের চাকুটা আরেকটু মোচড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে হিরণ চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে ফেলে। বাণী এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে চাকুটা হিরণের পেট থেকে বের করে এক লাফে উঠে বসে। হিরণকে ধাক্কা মেরে বিছানা থেকে মেঝেতে ফেলে চাকু হাতে লাফিয়ে নিজেও বিছানা ছেড়ে নামে। দ্রুত পায়ে দৌড়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।

হিরণ একহাতে পেটের পাশটা চেপে ধরে উঠে দাঁড়ায়। পেট থেকে তার তখন গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। তবুও দম খিচে রুম থেকে বেরিয়ে হিংস্র এবং উচ্চ স্বরে ডাকে বাণীর নাম ধরে। বাণী তখন বাড়ি ছেড়ে কেবল বাহিরে পা রেখেছে। সঙ্গে সঙ্গে সে একঝাঁক গার্ডের সম্মুখীন হয়। বাণী আর এগোতে পারে না। পিছন হতে সেই হিংস্র স্বর শুনে টের পায় হিরণও আসছে। হিরণ যখন পোর্চের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক সেই মুহুর্তে বাণী ধারালো চাকুটা নিজের গলার কাছে চেপে ধরে। রাগ, ক্ষোভ এবং উত্তেজনায় সে দিকদিশা শূন্য হয়ে মৃদু কাঁপছিলো। চেঁচিয়ে বলে উঠে,

“ কাছে আসার চেষ্টা করবে না কেউ। আমি এই চাকু চালানোর আগে একবারও ভাববো না। দূরে থাকো। কেউ আমার কাছে আসবে না। “

মানসিক ভাবে সেই মুহুর্তে বাণী শক্ত থাকার চেষ্টা করলেও তা সম্ভব হচ্ছিলো না। বারবার এলোমেলো হয়ে পড়ছিলো। নিঃশ্বাসের গতিও ছিলো বেগতিক। সে নিজ চোখে সে রাতে রাধুনিকে তার খাবারে কিছু একটা ওষুধ গুড়ো করে মেশাতে দেখেছে। ওষুধটা কিসের তা বাণীর অজানা ছিলো। তবে সে নিজে হিসেব করে দেখে গত বেশ ক’দিন ধরে সে চাইতেও রাতে জেগে থাকতে পারছে না। কেমন চোরাবালির ন্যায় ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে। তার মানে ওষুধটা খুব সম্ভবত ঘুমের ছিলো। বাণীর মাথায় বারবার শুধু একটাই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিলো যে তাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়ার পিছনে কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে? ঘুমন্ত অবস্থায় কি ওই লোকটা তার কাছে আসতো? এসব ভাবতেই বাণীর কান্না পায়। সে আরেকটু জোরে নিজের গলার কাছে চাকুটা চেপে ধরে।

হিরণের শুভ্র রঙা শার্টটা তখন রক্তের কারণে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। সে সেই ব্যথা উপেক্ষা করে ধমকের সুরে বলে,

“ চাকুটা ফেলো বাণী। ধার আছে খুব। একটা অঘটন ঘটে যাবে। “

“ একশো বার অঘটন ঘটাবো। আপনি খুব ভালো সাজার নাটক করেন না আমার সামনে? বুঝাতে চান আমার অনুমতি ব্যতীত কাছেও ঘেঁষবেন না। অথচ ঠিকই প্রতিরাতে আমার খাবারে ঘুমের ওষুধ মেশান। তারপর কি করেন আপনি? আমি ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আপনি আমার কাছে আসেন তাই না? আপনি একটা… “

বাকি কথাগুলো এলোমেলো ভঙ্গিতে বলে বাণী। হাতের চাপটা একটু জোরে লাগতেই চাকুর ধারে তার গলার কাছে খানিকটা চামড়া কেটে যায়। সেখান থেকে টুপটুপ করে রক্ত পড়তে শুরু হয়। হিরণ অস্থির হয়ে উঠে। ঠিক সেই মুহুর্তে অতি সাবধানে পিছন থেকে একজন গার্ড এসে বাণীর হাত থেকে চাকুটা ছুড়ে ফেলে তার দুই হাত চেপে ধরে। বাণী তখন হাত পা ছোড়াছুড়ি করছিলো। সেই গার্ডদের উপর চড়াও হওয়ার চেষ্টা করছিলো। বেগতিক অবস্থা সামাল দিতে আরেকজন গার্ড কথা থেকে জেনো একটা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ হাতে এগিয়ে এসে তা বাণীর হাতের বাহুর কাছে পুশ করে। সঙ্গে সঙ্গে বাণী চিৎকার করে বলে,

“ চরিত্রহীন লম্পট আপনি। আমাকে অজ্ঞান করে, আমার সুযোগ নিতে চান। শেষ করে দিবো। সব শেষ করে দিবো। আপনাকে শেষ করতে না পারলে নিজেকে শেষ করে দিবো, তবুও কখনো এসব মেনে নিবো না। আমি… “

বাকি কথা আর শেষ করতে পারে না বাণী। তার আগেই অসাড় দেহ নিয়ে ঢুলে পড়ে। গার্ডরা বাণীকে সামলাতে নিলেও হিরণ সেই সুযোগ দেয় না। দৌড়ে এগিয়ে এসে নিজেই বাণীকে ধরে। চিল্লিয়ে বলে,

“ দাঁড়িয়ে মুখ না দেখে একটা ডাক্তার তুলে আনো এই মুহুর্তে। গলা থেকে রক্ত ঝরছে ওর। বি ফাস্ট। “

সবাই হিরণের আদেশ মানলেও একজন কিশোর কেবল এগিয়ে আসে হিরণের চিন্তায়। বলে,

“ স্যার, আপনার পেট থেকেও রক্ত ঝরছে। “

হিরণ কিশোর ইবাতের কথায় বেশি একটা গুরুত্ব না দিয়ে বাণীকে পাজাকোলে তুলে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে তার পেটের পাশটা আরো ব্যথা করে উঠে। সে দাঁত খিচে বলে,

“ ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে আসো ইবাত। “

অতীত থেকে ফিরে আসতেই হিরণের মন আচমকা খারাপ হয়ে যায়। বাণীর ঘৃণার তীব্রতা এতটাই বেশি যে এতগুলো বছর সে স্বেচ্ছায় মরতেও রাজি ছিলো, তবুও এক মুহুর্তের জন্য হিরণকে মেনে নিতে রাজি হয় নি। হিরণের মনে প্রশ্ন জাগে, সে কি মৃত্যুর থেকেও বেশি যন্ত্রণাদায়ক? কে জানে! আগে কখনো এসব নিয়ে তেমন একটা ভাবা হয় নি হিরণের। অবশ্য সেই ফুরসতও মিলতো না তার। কিন্তু এখন এই চার দেয়ালের ভেতর বন্দী অবস্থায় তার কাছে অফুরন্ত সময় আছে এসব ব্যাপার নিয়ে ভাবার।

হিরণ পেটের কাছ দিয়ে কাপড়টা সামান্য তুলে সাত বছর পুরনো ক্ষতে সেলাইয়ের দাগটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রয়। অত:পর আবার মলিন মুখ নিয়ে বসে রয়।

__________

রাজশাহী শহরে চলমান ডুমস ডে অপারেশন সফল হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বোম ডিফিউজ করার মাধ্যমে। সেকারণে সেখানে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ শূন্য বললেই চলে। চট্টগ্রাম শহরের অপারেশনটাও মেজর শাহরিয়ার দূর্জয়ের পরিচালনায় সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। যদিও বিস্ফোরণ চট্টগ্রামের বুকেও ঘটেছে। তবে সেই বিস্ফোরণের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য শাহরিয়ার দূর্জয় যথাসময়ে পুলিশের সহায়তায় কাদিরগঞ্জ মোড়ের সকল প্রবেশ পথ বন্ধ করানোর পদক্ষেপ নেয়। সেই সঙ্গে আশংকাজনক জায়গাটাও সম্পূর্ণ জনমানবশূন্য করে তুলে দ্রুততার সহিত। এতে করে বিস্ফোরণে কোনো মানুষের শারীরিক ভাবে সামান্যতম ক্ষতিটুকুও হয় নি।

রাত তখন ক’টা বাজে কে জানে! বাড়ির আঙিনায় এসে থামলো কালো রঙা জিপটা। দূর্জয় গাড়ি ছেড়ে নামতে নামতেই দেখলো বাড়ির দরজা খুলে পোর্চে এসে দাঁড়িয়েছেন সুহালা বেগম। মা ছেলে দু’জনের মুখভঙ্গিই স্বাভাবিক। দূর্জয় এগিয়ে এসে বলে,

“ আমি বাচ্চা নই মামণি। ঘুমিয়ে পড়লেই পারতে। সারাদিন কম ধকল যায় নি তোমার উপর দিয়ে। “

সুহালা বেগম কিছুক্ষণ ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আলতো করে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। মনে মনে আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া জানায় তার ছেলেকে আরো একবার অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। পরপর এই মুহুর্তে সাদাতের মা’র কি অবস্থা হতে পারে সেটা ভেবেই বিষণ্ণ মন নিয়ে নরম স্বরে বলে,

“ আল্লাহ জান্নাত নসিব করুক ছেলেটাকে। “

দূর্জয় স্বাভাবিক গলায় আমিন শব্দটা উচ্চারণ করে। চোখের সামনে তার এখনো ভাসছে সাদাতের মুখ। আজকে সন্ধ্যায়ই তো ছেলেটাকে জীবিত অবস্থায় দেখেছিলো দূর্জয়। এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের কর্মোঠ ছেলেটা আর নেই ভাবতেই সূক্ষ্ণ শূন্যতা তার মনকে ব্যথিত করে তুলছে।

সুহালা বেগম ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে ভেতরে আসার সুযোগ দেয়। দূর্জয় সোফায় এসে বসে জুতো খুলতে খুলতে প্রশ্ন করে,

“ বাণী বহ্নি ঘুমিয়েছে? “

“ হ্যাঁ। বাণী তোমার অপেক্ষা করে জেগেছিলো অনেকক্ষণ। ক্লান্ত শরীর কতক্ষণ আর সায় দেয়? ভাগ্যিস একটু ঘুমিয়েছে। “

“ খাওয়া দাওয়া করেছে? “

“ না। জোর করেছি। মুখে তুলে নি। “

দূর্জয় ভ্রু কুচকে তাকায়। এই ভয়ংকর লো প্রেশার নিয়ে না খেয়ে থাকার মানে কি? বাণী কি ভেবেছে স্বামীর অপেক্ষায় না খেয়ে থাকাটা স্ত্রী গত দায়িত্ব? দূর্জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার ওয়াইফকে গ্রুমিং করতে হবে। পাকাপোক্ত স্ত্রী হওয়ার ট্রেনিং দেওয়ার প্রয়োজন।

“ খাবার গরম বসাই? “

সুহালা বেগমের কথার পিঠে দূর্জয় বলে,

“ না। খেতে ইচ্ছে করছে না। সকাল সকাল রওনা দিতে হবে। খুলনা যাবো। সাদাতের বাড়িতে। “

সুহালা বেগম আর ছেলেকে জোর করেন না। দূর্জয় জুতো জোড়া খুলে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। নীরবে রুমে প্রবেশ করতেই দূর্জয়ের চোখ যায় সর্বপ্রথম বিছানার দিকে। বিছানার ডান পাশটায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে বাণী। গায়ে বিয়ের পোশাকটা বদলে তার পরিবর্তে এখন একটা সাদা রঙের সুতির কামিজ। তার ঠিক পাশেই বিছানার মাঝখানের জায়গাটা দখল করে ঘুমোচ্ছে বহ্নি। দূর্জয় দেয়ালের একপাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখে দৃশ্যটা। অত:পর আলমারির কাছে গিয়ে যতটা নিঃশব্দে সম্ভব নিজের ঘরে পরিধেয় পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। লম্বা একটা গোসল সেরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বিছানার বাম পাশটায় থাকা খালি জায়গায় গিয়ে নীরব বসে।

সম্পূর্ণ রুমটা তখন ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মৃদু আলোকিত। দূর্জয় বুঝে উঠতে পারে না তার কি আলোটা নিভিয়ে দেওয়া উচিত হবে? কিঞ্চিৎ পরিমাণ আলোর ভেতর দূর্জয়ের চোখে কখনো ঘুম নামে না। কিন্তু বাণী আর বহ্নি যদি ভয় পায়? এই ভেবে আর আলোটা নেভায় না সে। সামান্য এগিয়ে গিয়ে কম্বলটা আরেকটু টেনে মানুষ দুটোর গা ঢেকে দেয়। পরপর নিজের গায়েও কম্বলের একাংশ টেনে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে। বাণী বহ্নির দিকে ফিরে ঘুমোচ্ছিলো। তার এক হাত ছিলো কম্বলের উপর দিয়ে বহ্নির বুকে রাখা। দূর্জয়ও পাশ ফিরে বাণীর মুখোমুখি হয়। অত:পর নিজের একটা হাত বাড়িয়ে বাণীর হাতের উপর রাখে। মনে মনে ভাবে ভাগ্যের খেলা কি অদ্ভুৎ! তেরো বছর আগের দূর্জয় কস্মিনকালেও কখনো কল্পনা করে নি যে ভবিষ্যতে এসে এই নারীই একদিন তার স্ত্রী হবে।

__________

সকাল এগারোটার দিকে বাড়ির দরজায় কারো করাঘাতের শব্দ হতেই সাওদা সবার আগে দৌড়ে যায় দরজা খুলতে। চোখমুখের তার থমথমে অবস্থা। গত রাত থেকে মা আর সায়রাকে এই বলে বুঝ দিয়ে আসছে সে যে তার মারাত্মক মাথা ব্যথা। ওই দুটো মানুষের এখনো বিন্দুমাত্র ধারণা নেই যে কি হয়েছে।

দরজাটা খুলতেই দ্বারপ্রান্তে একজন সিনিয়র অফিসারকে দেখতে পেয়ে সাওদার পা জোড়া টলে উঠে। সে দাঁতে ঠোঁট চেপে পিছনে তাকায়। আরো বেশ কিছু সংখ্যক ইউনিফর্ম পরিহিত সৈন্যকে দেখতে পায় সে। ইতিমধ্যে তাদের উঠোনে এলাকার উৎসুক মানুষজন ভীড় জমাতে শুরু করে দিয়েছে। উঠোন পেরিয়ে বাহিরে চোখ পড়তেই সাওদা দেখতে পায় বেশ কিছু গাড়ির ভীড়ে লাশবাহী গাড়িটা।

ঠিক সেই মুহুর্তে শাহানা বেগম ভেতরের রুম থেকে বলতে বলতে বের হয়,

“ কে রে সাওদা? “

দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই শাহানা বেগম বিস্মিত হয়। অস্ফুটে বলে,

“ স্যার আপনি! “

জুলফিকার মুজতবা নিজের মাথার টুপিটা নামিয়ে শান্ত স্বরে বলে,

“ আল্লাহ আপনাদের ধৈর্য্য দিক। “

শাহানা বেগম অবাক হয়ে সবাইকে দেখে একবার। হঠাৎ তার চোখ পড়ে সেই লাশবাহী গাড়িটার দিকে। তার অবচেতন মন বুঝতে পারে সম্পূর্ণ ঘটনা। সঙ্গে সঙ্গে তিনি গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে সেই লাশবাহী গাড়িটার দিকে ছুটে যায়।

“ আমার বাপজান, আমার বাপজান। “

বলে বাতাসটা ভারী করে তুলে। সায়রা তখন নিজের রুমে ঘুমোচ্ছিলো। মায়ের চিৎকার চেঁচামেচিতে তার ঘুম ভেঙে যায়। সে চোখ ডলতে ডলতে বাসার দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই বিস্মিত হয়। হতভম্ব স্বরে দরজার ধারে মেঝেতে বসে থাকা বোনকে প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে আপু? মা কান্না করছে কেনো? “

সাওদা জবাব দেয় না। কেমন নিষ্প্রাণের মতো পড়ে রয়। সায়রা জবাবের অপেক্ষা না করে খালি পায়ে দৌড়ে উঠোন পেরিয়ে গিয়ে মা’কে জাপ্টে ধরে। উদ্ভ্রান্তের ন্যায় প্রশ্ন করে,

“ তুমি ভাইয়ার নাম ধরে ডাকছো কেন? আমার ভাইয়া এই গাড়ির ভেতর নেই। তুমি এই গাড়ির দরজা থেকে সরে আসো। “

এলাকার কিছু মহিলা ইতিমধ্যে এসে শাহানা বেগম এবং সায়রাকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মা মেয়ে যেনো প্রতিযোগিতায় নেমেছে, কে কত বেশি ক্ষত-বিক্ষত হতে পারে আজ। কেবল নীরব রয় সাওদা। কাঁদতে পারে না সে। গতরাত সবাইকে আড়াল করে এক সমুদ্র কেঁদেছে সে। এই মুহুর্তে ভাই হারানোর যন্ত্রণা অনুভব করতে পারলেও কান্নাটা আর আসছে না। চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে কেমন!

সকল লেফটেন্যান্টদের মাথা তখন নত। তাদের সাহস হয় না এই দৃশ্যটুকুর সাক্ষী হতে। বেশিক্ষণ সাওদা নিজেকে সামলাতে পারে না। এই ভারী পরিবেশে তার নিঃশ্বাস আটকে আসে। সে এলোমেলো ভঙ্গিতে উঠে সোজা বাড়ির পিছনের উঠোনের দিকটায় চলে যায়। এক জোড়া চোখ অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিতে দেখে সেই দৃশ্য। পর মুহুর্তেই চোখ মেলে সামনে তাকিয়ে বন্ধুর মা এবং ছোট বোনের বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে। মনে মনে ভাবে দেশটাকে দেখার জন্য তো সৈন্যের অভাব হবে না, কিন্তু যেই পরিবারটা নিজেদের একমাত্র ছেলেকে হারালো তাদের দেখভাল কে করবে?

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৬৬.

দৃশান যখন নিজের মাতৃভূমিতে পা রাখে তখন সময় সকাল ৮ টার উপর। প্রায় তেরো ঘন্টার ফ্লাইট জার্নিতে খুব ক্লান্ত অনুভব করছিলো সে। তার একটা বাজে সমস্যার অভ্যাস আছে। দীর্ঘ সময়ের ফ্লাইট জার্নিতে প্রায়ই তার কানে মারাত্মক ব্যথা করে। সেই ব্যথা ধীরে ধীরে কান হতে ঘাড় এবং মাথায় ছড়িয়ে পড়ে। আর তারপর দৃশানের হয় পাগল প্রায় অবস্থা। অবশ্য এক দু’দিন এরকম ব্যথা করে পরে নিজ থেকেই স্বাভাবিক হয়ে যায় সবকিছু।

আজও তার ব্যতিক্রম নয়। তীব্র ব্যথার চোটে দৃশান ফ্লাইট থেকে নেমে নিজের ফোনও সুইচ অন করতে ভুলে গিয়েছে। কেবল এয়ারপোর্ট থেকে একটা ক্যাব বুক করে সোজা রওনা হয় নিজের বাসার উদ্দেশ্যে। বাসায় ফিরে তার সর্বপ্রথম একটা লম্বা গোসল দিতে হবে। আর তারপর ঘোরদোর সব অন্ধকার করে সোজা ঘুমের জগতে ডুব দিতে হবে তার।

নিজের এপার্টমেন্টের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল বাজানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন মধ্যবয়স্ক নারী এসে দরজাটা খুলে দেয়। সম্পর্কে তিনি দৃশান নামরার মা। মেয়েকে দেখতেই তিনি চিন্তিত ভঙ্গিতে জড়িয়ে ধরে বলে,

“ আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া যে তুমি ঠিক আছো। কালকে থেকে এতবার কল করছিলাম তোমার নাম্বারে আমরা সবাই। তোমার নাম্বার বন্ধ পেয়ে আমাদের জান যায় অবস্থা। “

দৃশান ভ্রু কুচকে বলে,

“ আমি তো ভেবেছিলাম না জানিয়ে বাড়ি ফিরে তোমাদের চমকে দিবো। আর আমার নাম্বার তো প্রায় সময়ই বন্ধ থাকে। এতে এতো চিন্তার কি আছে? “

কথাটা বলতে বলতে দৃশান ঘরে প্রবেশ করে। দৃশানের মা মেয়ের পেছন পেছন আসতে আসতে সামান্য ধমকে বলে,

“ এতো ভয়ংকর একটা নিউজ দেখে চিন্তা না করে পারা যায়? তোমার ভাই আর বাবার পাগলপ্রায় অবস্থা। একটু আগে মাত্র তারা অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলো। তোমার দাদীমাও চিন্তায় প্রেশার বাড়িয়ে ফেলেছে। ওষুধ খেয়ে এখন একটু ঘুমোচ্ছে। “

দৃশানের কানে মারাত্মক ব্যথা করছিলো। মায়ের উচ্চস্বরে বলা কথাগুলো তার মাথায় তীক্ষ্ণ ঠেকছিলো। তবুও সে লাগেজটা নিজের রুমের দিকে টেনে নিতে নিতে বলে,

“ কোন ভয়ংকর নিউজের কথা বলছো? “

“ তুমি জানো না? গতরাতে বাংলাদেশের তিনটা বিভাগে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। কি ভয়ংকর অবস্থা! ঢাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমান বেশি। অনেক মানুষও মারা গিয়েছে। “

দৃশান নিজের রুমের দ্বার প্রান্তে গিয়েও থেমে যায়। পিছনে ঘুরে একপলক তার মা’কে দেখে নিয়ে অত:পর লাগেজ টেনে নিজের রুমে প্রবেশ করে দরজা আটকে দেয়। নিজের কাধের ব্যাগটা থেকে দ্রুত ফোনটা বের করে বিছানায় বসে। গতরাতের বাংলাদেশের সেই বিস্ফোরণের ঘটনা সম্পর্কিত নিউজ সার্চ করতেই তার কাছে লেটেস্ট সব আর্টিকেল শো করে। দৃশান মনযোগ দিয়ে দু একটা আর্টিকেল পড়ে ঘটনার বিবরণীটুকু জেনে নেয়। কিন্তু তার চোখ আটকায় তৃতীয় আর্টিকেলের শব্দের ভীড়ে।

“ This tragic explosion left more than 50 people dead. Including 2 police man respectively Md. Mizanur Ansari & Sayed Imran Hauqe also 1 army man named Lt. Sadat Sarkar. “

দৃশান দু চারবার লাইন গুলো মনে মনে পড়ে। বিশ্বাস হয় না তার। স্ক্রল করে সামান্য নিচে যেতেই দেখতে পায় আর্টিকেলের সঙ্গে সংযুক্ত তিনজন মানুষের পাসপোর্ট সাইজের ছবি। শেষ ছবিটা দেখে সে বাকরুদ্ধ বনে যায়। কানের ভেতর প্লেনে থাকা অবস্থায় যেরকম তীক্ষ্ণ শব্দ শোনা যায় ঠিক তেমনই একটা শব্দ সূক্ষ্ণ ভঙ্গিতে বেজে উঠে। বাকহারা দৃশান বার দু’য়েক চোখের পলক ফেলে। পরপর কানে এবং মাথায় অনুভব করে তীব্র ব্যথা।

দৃশান অস্থির ভঙ্গিতে চারিদিকে তাকায়। এই নিউজের মানে কি? এটা তো হওয়ার কথা ছিলো না। একটা সুন্দর, সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনের জন্যই তো দৃশান পিছুটান ফেলে চলে এসেছে। একবারও ফিরে তাকায় নি। তবে এসবের মানে কি? গতকাল দুপুরেও না এই ছেলেটা তার কল রিসিভ করেছিলো? এক রাতে ছেলেটা পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে গেলো? এমনটাও হয়? আদৌ সম্ভব?

দৃশান অস্থির ভঙ্গিতে চারিদিকে তাকায়। বুঝদার মেয়েটার হঠাৎই বাচ্চাদের মতো খুব কান্না পাচ্ছে। বুক ভাঙা কান্না। হাতের কাছের চতুর্ভুজাকৃতির কুশনটা তুলে নিয়ে মুখের কাছে চেপে ধরে দৃশান। পরপর গলায় আটকে থাকা চিৎকারটা বালিশের চাপে মিলিয়ে দেয়। এরকমটা তো দৃশান চায় নি। সে তো চেয়েছিলো ছেলেটা যেনো নিজের দেশে, নিজের জীবনে ভালো থাকুক। তাহলে তার চাওয়া পূরণ হলো না কেনো? ছাব্বিশ বছরের দৃশান নামরা শক্ত থাকতে পারে না। বালিশের ভাজে মিশে যায় তার এক একটা চিৎকার।

__________

বাদ যোহর জানাজার নামাজ শেষে মসজিদের বাহিরে এক কোণে বসে আছে পাঁচ জন লেফটেন্যান্ট। তাদের থমথমে মুখ এলাকাবাসীর নজর এড়াচ্ছে না। রক্তের সম্পর্কহীন মানুষ গুলোকে দেখে মনে হচ্ছে যেনো তারা শহীদ সাদাত সরকারের খুব কাছের কেউ। অথচ অপরদিকে সাদাতের চাচাতো ভাইয়েরা দাফন কাজ শেষ করে এসেই নিজেদের মধ্যে সম্পত্তির হিসেব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের পথের কাঁটা দূর হয়েছে। চাচার শেষ সম্বল হিসেবে যা যতটুকু আছে, তার উপর কিভাবে ভাগ বসানো যায় তা-ই আপাতত তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এবং মুখ্য বিষয়।

সাইফের চোখ জোড়া লাল হয়ে আছে। কি কারণে কে জানে! হঠাৎ তাদের সামনে দূর্জয় এসে দাঁড়াতেই প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। দূর্জয় কিছু না বলে এগিয়ে গিয়ে সাইফকে জড়িয়ে ধরে শান্তনার ভঙ্গিতে পিঠে সামান্য হাত বুলিয়ে দেয়। সিনিয়রের থেকে হয়তো এমন কিছু আশা করে নি সাইফ। তাই ক্ষানিকটা অবাক হলেও পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়।

দূর্জয় আলতো করে সাইফের পিঠ চাপড়ে দেয়। এছাড়া আর কিছু খুঁজে পায় না বলার মতো। অবশ্য কাছের কোনো মানুষকে হারানোর পিঠে শান্তনা সরূপ কিছু বলাও সমীচীন নয়। পৃথিবীর সকল বাক্যই সেই হারানোর দুঃখ কম করতে অক্ষম।

দূর্জয় এবার দু হাত বাড়িয়ে বাকিদেরও ইশারা করে। মুহুর্তেই জড়তা কাটিয়ে প্রত্যয়, রাফি, ফারদিন, জুনায়েদ এগিয়ে এসে সাইফ এবং দূর্জয়কে ঘিরে জড়িয়ে ধরে। রক্তহীন ভ্রাতৃত্বের এই নির্মল দৃশ্যটা দূর হতে দেখে জুলফিকার মুজতবা। গর্বে বুকটা ফুলে উঠে তার। এই ছেলেটার প্রতি তার বিশ্বাস অগাধ। প্রয়োজনে কড়া শাসনে জুনিয়রদের রাখতেও যেমন ভুলে না, একই ভাবে কঠিন সময়ে তাদের সঙ্গে নমনীয় আচরণ করতেও কার্পণ্য করে না।

__________

সেদিন দূর্জয় বাড়ি ফিরলো বেশ রাত করে। সাদাতের জানাজা পড়ে চট্টগ্রামে ফিরতে বেশ সময় লেগেছে তার। চট্টগ্রামে পৌঁছেও বাসায় ফেরার আগে কিছু কাজে হেডকোয়ার্টারে গিয়েছিলো সে। অবশেষে সব কাজ থেকে ফুরসত পেতেই যখন বাড়ি ফিরে কলিংবেল বাজালো তখন দরজা খুলতে এলো লাল রঙের কামিজ পরিহিত তার নব পরিণীতা। দরজা খুলে এক পলক দূর্জয়কে দেখেই চোখটা নামিয়ে নিলো।

মুখে আঁধার ছেয়ে আছে বাণীর। সেই সঙ্গে কিছুটা অপরাধবোধ। গত রাতে দূর্জয় যখন বাড়িতে ফিরেছে তখনো সে ঘুমিয়ে ছিলো, আজ সকালেও দূর্জয় যাওয়ার সময় সে ঘুমে নিমগ্ন ছিলো। ব্যাপারটা বাণীর কাছে বেশ লজ্জার। আন্টি, দূর্জয় উনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন কি দায়িত্ব জ্ঞানহীন মেয়েকে ঘরের বউ করে আনলো তারা!

দূর্জয় নীরবে ঘরে প্রবেশ করতে করতে প্রশ্ন করে,

“ এখনো ঘুমাও নি কেনো? “

“ তোমার অপেক্ষা করছিলাম। “

দূর্জয় মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে রেখেছিলো। বাণীর জবাবের পিঠে আড়ালে নীরব হেসে স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করে,

“ মামণি, বহ্নি কোথায়? “

“ ঘুমোচ্ছে। “

“ খেয়েছো তুমি? “

বাণী কেবল দু’দিকে মাথা নেড়ে বলে সে খায় নি৷ দূর্জয় আপাতত কথা বাড়ায় না। শান্ত গলায় বলে,

“ আমি গোসল করে আসি। খাবার বেড়ে নাও দুজনের জন্য। এসে একসঙ্গে খেতে বসবো। “

বাণী কেবল মাথা নেড়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়। দূর্জয়ও রুমে প্রবেশ করে এক মিনিটের মাথায় আবার ফিরে এসে বাণীকে প্রশ্ন করে,

“ বহ্নি কোথায়? “

বাণী খাবার গরম করছিলো। সে উত্তর দেয়,

“ আন্টির রুমে। “

“ নিজের ইচ্ছায় গিয়েছে নাকি মামণি-ই বলেছে উনার কাছে ঘুমাতে? “

বাণী স্বাভাবিক গলায় বলে,

“ নিজের ইচ্ছায়ই গিয়েছে। আন্টি বেশ সুন্দর ফেইরি টেল বলতে পারেন। বহ্নিও আন্টিকে আর আন্টির ফেইরি টেলকে খুব পছন্দ করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। “

দূর্জয় আর কথা বাড়ায় না। গোসল করতে চলে যায়। দশ মিনিটের ভেতর গোসল শেষ করে রুম থেকে বের হতেই দেখে বাণী খাবার টেবিলে দু’জনের জন্য খাবার সাজিয়ে বসে আছে। টেবিলের কাছে যেতেই দূর্জয় অবাক হয়। তার প্লেটে অত্যাধিক পরিমাণে ভাতের চারিদিকে একসঙ্গেই সব তরকারি বেড়ে দিয়েছে বাণী। দূর্জয় একটা ঢোক গিলে মনে মনে। এভাবে খাওয়ার অভ্যাস নেই তার। সে সবসময় এক তরকারি খেয়ে শেষ করে তারপরই আরেক তরকারি প্লেটে নেয়। আর ভাতও সবসময় সে চোখের আন্দাজে এক কাপের বেশি খায় না। দূর্জয় ব্যাপারটা নিয়ে আর টু শব্দ করে না। বাণী এসব ব্যাপার এখনো জানে না। আস্তে আস্তে জেনে যাবে। এতো তাড়া নেই দূর্জয়ের।

খেতে বসে দূর্জয় নিজেই নীরবতা ভেঙে বলে,

“ আমার প্রায় সময়ই বাসায় ফিরতে দেরি হতে পারে। অপেক্ষা করবে না। সময়মতো খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। “

বাণী চোখ তুলে এক পলক দূর্জয়কে দেখে ক্ষীণ স্বরে বলে,

“ আচ্ছা। “

দূর্জয় আবারও বলে,

“ মামণি ঢাকা ফিরে যাবে শীঘ্রই। মনে এরকম হেজিটেশন রাখবে না যে, বহ্নি আমাদের প্রাইভেসি নষ্ট করছে বা ওকে আলাদা রুমে দেওয়ার প্রয়োজন। শি ইজ স্টিল এ বেবি, যতদিন না বড়ো হচ্ছে আমাদের রুমেই থাকবে ও। “

বাণীর বুক থেকে যেনো একটা বিশাল পাথর সড়ে গেলো। সে এই ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছিলো, কিন্তু গুছিয়ে উঠতে পারছিলো না। ভাগ্যিস দূর্জয় নিজ থেকেই কথাটা বলেছে। সে ক্ষানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

“ আচ্ছা। “

দূর্জয় এবার আড়চোখে বাণীকে পরখ করে বলে,

“ খাবার নাড়াচাড়া করছো কেনো? খেতে ইচ্ছে করছে না? নাকি কোনো ব্যাপার নিয়ে ডিস্টার্বড তুমি? “

বাণী এবার খাবার ছেড়ে সরাসরি দূর্জয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ আই এম সরি। আমি রাতে টের পাই নি তুমি কখন এসেছো। সকালে যখন চলে গিয়েছো তখনও ঘুমিয়ে ছিলাম। আন্টির মুখে না শুনলে বুঝতামও না যে তুমি বাসায় ফিরেছিলে। অপেক্ষা করা উচিত ছিলো আমার। সামনে থেকে এই ব্যাপার গুলো খেয়াল রাখবো। “

দূর্জয় কিছুক্ষণ বাণীকে দেখে নিয়ে বলে,

“ খাওয়া শেষ করো। তারপর এই ব্যাপারে কথা বলছি। “

বাণী আর কিছু বলে না। নীরবে খাওয়া শেষ করে উঠে রান্নাঘরে চলে যায় প্লেট গুলো ধুয়ে রাখতে। দূর্জয়ও তখন রান্নাঘরে এসেছিলো। সে বাণীর কাছ থেকে প্লেট গুলো নিয়ে বলে,

“ তুমি রুমে যাও। আমি এগুলো ধুয়ে আসছি। “

বাণী বিস্মিত ভঙ্গিতে বলে,

“ তুমি কেন ধুবে? আমি পারি তো। আই প্রমিজ একটাও প্লেট ভাঙবে না। “

বাণীর শেষ কথাটা শুনে দূর্জয়ের হাসি পায়। সে নিজের হাসি সংবরণ করে বলে,

“ তুমি প্লেট ভেঙে ফেলবে সেই ভয়ে আমি বাঁধা দিচ্ছি না। প্লেট ভাঙতে মন চাইলে ভাঙবে। সেটা বড়ো বিষয় না। “

বাণী বুঝতে পারে দূর্জয় খুব শান্ত ভঙ্গিতে কথার ফাঁকে মজা করলো। সে সেই মজাটা এড়িয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে,

“ তাহলে বাঁধা দিচ্ছো কেন? “

“ হাতের মেহেদী ভালো হয়েছে তোমার। দেখতে সুন্দর লাগছে। পানিতে রঙ ফিকে হয়ে যাবে। “

দূর্জয়ের অদ্ভুৎ লজিকের পিঠে বাণী আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ রুমে চলে যায়। দূর্জয় সুন্দর করে প্লেট দুটো ধুয়ে ফেলে। এসবের অভ্যাস তার আগে থেকেই আছে। একা থাকার দরুণ রান্না থেকে শুরু করে নিজের কাপড় ধোয়াটাও তার আয়ত্তে আছে।

__________

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতের তীব্রতাটাও বেড়ে গিয়েছে। বাণী একটা শাল গায়ে পেচিয়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে ছিলো। দূর্জয়কে রুমে প্রবেশ করতে দেখেই সে কিছুটা গুটিয়ে যায়। দূর্জয় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রুমে প্রবেশ করে বাণীর সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দেয়। বাণী ভ্রু উঁচু করে জানতে চায় ‘কি’? দূর্জয় বলে,

“ আসো। “

বাণী নীরবে দূর্জয়ের হাত ধরে জানালার পাশটায় গিয়ে দাঁড়ায়। কুয়াশা গুলো শিশির বিন্দু হয়ে জমে জানালার থাই গ্লাসটা সম্পূর্ণ ভিজে আছে। যার ফলে বাহিরের কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। দূর্জয় সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সরাসরি বাণীর দিকে তাকিয়ে বলে,

“ তোমার কেনো মনে হচ্ছে আমার অপেক্ষায় জেগে থাকা বা না খেয়ে বসে থাকা এগুলো খুব গুরতর ব্যাপার? এগুলো না করলে তার জন্য সরি বলা প্রয়োজন এই ধারণাটা কোথা থেকে মাথায় আসলো? “

বাণী দৃষ্টি নত করে বলে,

“ জানি না। আমার ধারণা নেই। জাস্ট মনে হলো। “

“ এগুলো ম্যান্ডাটরি না বাণী। যখন ঘুম পাবে ঘুমিয়ে পড়বে, যখন খিদে পাবে সময়মতো খেয়ে নিবে। আমার অপেক্ষায় এসব ব্যাপারে অনিয়ম করে স্ত্রী গত দায়িত্ব পালনের পক্ষে নই আমি। বুঝতে পারছো কি বলছি? “

বাণী আচমকা প্রশ্ন করে,

“ তোমার কি আমার তরফ থেকে এই সম্পর্কের প্রতি কোনো এক্সপেকটেশন নেই? “

দূর্জয় অবাক হয়। পরমুহূর্তেই বুঝানোর স্বরে বলে,

“ ইউ আর গেটিং মি রং বাণী। আমি এরকম কিছু মিন করিনি। অবশ্যই আমার তোমার তরফ থেকে এক্সপেকটেশন আছে। কোনো সম্পর্ক একপাক্ষিক এফোর্টে কখনোই ওয়ার্ক আউট করে না। দুই পক্ষ থেকেই ফিফটি ফিফটি এফোর্ট প্রয়োজন। অল আই ওয়ান্ট টু সে ইজ, সেই এফোর্টটা নিজের প্রতি অযত্ন করে যেনো না হয়। হুট করে একটা সংসারে এসে কিছু না বুঝেই পুরোটার ভার তুলে নেওয়া ইজ নট লজিক্যাল। সময় নাও, নিজেকেও সময় দাও। ধীরে ধীরে সব বুঝার চেষ্টা করো, আমাকেও বুঝার চেষ্টা করো। বুঝতে না পারলে আমাকে বলবে, বুঝিয়ে দিবো। সংসার আর আমি দুটোই তোমার। বুঝে আগলে নেওয়ার আগেও এবং পরেও তোমারই থাকবে। “

বাণী চোখ তুলে তাকাতে পারে না। নিজের বোকা বোকা ধারণার প্রতি লজ্জিত সে। দূর্জয় নিজেই এবার দু পা এগিয়ে গিয়ে একহাত বাড়িয়ে বাণীর গাল ছুঁয়ে মুখটা উঁচু করে ধরে। পরপর আবার বলে উঠে,

“ তোমাকে কথাগুলো বলার পিছনে কারণ হলো আই কেয়ার এবাউট ইউ। এতদিন নিজের মর্জিতে যত ইচ্ছা অযত্ন করলেও, আমার সামনে এসবের অনুমতি নেই। সংসার, আমি আর বহ্নি তিনোটা সামলানোর জন্যই তোমার নিজে আগে স্ট্যাবল থাকা প্রয়োজন। মামণি দু’দিনের মাথায় ঢাকা চলে যাবে, আমিও সারাদিন বাসায় থাকবো না। আল্লাহ না করুক যদি প্রেশার লো হয়ে আবার সেন্সলেস হয়ে যাও? বহ্নি তোমাকে একা ঘরে সামলাতে পারবে? মেয়ে ভয় পাবে না? থিংক এবাউট ইট বাণী। একটা সুন্দর লাইফ শুরু করার জন্য সবার আগে ইউ নিড টু টেক কেয়ার অফ ইউর হেলথ। ইট ইজ দ্যা মোস্ট ইম্পোরট্যান্ট ট্রেজার। আর নিজের মনে প্লিজ কিছু জমিয়ে রাখবে না। যেকোনো ডাউট কিংবা প্রবলেম ফেস করলে আমাকে বলবে। ট্রাস্ট মি নিজের মনে কথা লুকানো কিংবা ল্যাক অফ কমিউনিকেশন, এগুলো ভুল বুঝাবুঝি ছাড়া আর কিছুই সৃষ্টি করে না। আর আমি চাই না আমাদের মাঝে কোনো ভুল বুঝাবুঝি কখনো হোক। বুঝতে পারছো? “

বাণী ক্ষীণ স্বরে বলে,

“ বুঝেছি। “

“ আর দৃষ্টি নত করে কথা বলো কেনো? আমার সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলবে। ডোন্ট হেজিটেট টু মেক আই টু আই কন্ট্যাক্ট। “

বাণী লজ্জা পেলো কিনা বুঝা গেলো না। কেবল দ্রুত মাথা নেড়ে বুঝালো আচ্ছা। দূর্জয় আর লজ্জা না দিয়ে বাণীর গাল থেকে হাত সরিয়ে বিছানার কাছে যেতে যেতে বলে,

“ কালকে সকাল থেকে যা-ই নাস্তা করো না কেন, সঙ্গে দুটো করে ডিম সিদ্ধ করে খাবে। বহ্নি বাচ্চা। ওর জন্য কিছুটা ছাড় দিয়ে একটা দেওয়া যায়। কিন্তু বহ্নির মা’র জন্য ছাড় নেই। মনে থাকে যেনো। “

মুহুর্তেই বাণীর মুখটা কালো হয়ে যায়। সে থমথমে গলায় বলে,

“ কখনো না। এসব সিদ্ধ ডিমের গন্ধও আমার সহ্য হয় না। এগুলো কখনো আমার হজম হবে না। “

দূর্জয় ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বিছানায় বসে গায়ে কম্বল টেনে নিতে নিতে বলে,

“ ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে। “

“ তুমি জোর করতে পারো না দূর্জয়। “

“ অবশ্যই পারি। “

“ আমাকে আমার অপছন্দের খাবার খাওয়ার জন্য জোর করার অধিকার আমি কাউকেই দেই নি। “

দূর্জয় এবার আরাম করে সোজা হয়ে বিছানায় শুয়ে একহাত কপাল থেকে খানিকটা নিচে চোখের উপর রেখে স্পষ্ট গলায় বলে,

“ তোমার দেওয়া না দেওয়ার তোয়াক্কা কে করছে? অধিকারনামা হিসেবে এখন মাঝ রাতে কাবিননামা খুঁজে বের করে তোমাকে দেখানোর এনার্জি নেই আমার। তবে এতটুকু বলতে পারি হাজব্যান্ড হিসেবে তোমার ভালোর জন্য যেকোনো ব্যাপারে জোর করার রাইট আমার আছে। “

বাণীর রাগ হয়। লেবার অফ পার্লামেন্ট নাকি? বাণী এসব অর্ডার মানতে রাজি নয়। সে এগিয়ে এসে দূর্জয়ের গায়ের কম্বল টেনে সরায় তার ঘুম ঘুম ভাবটআ দূর করার জন্য। পরপর বিক্ষিপ্ত গলায় জোর মিশিয়ে বলে,

“ ইউ আর নট বিয়িং হাজব্যান্ড, ইউ আর বিয়িং রুড। “

দূর্জয় পাত্তা না দিয়ে অন্য পাশে ঘুরে চোখ বুজে শুয়ে ঘুম জড়ানো স্বরে বলে,

“ বিয়ের পরের দিনই হাজব্যান্ডের সঙ্গে ঝগড়া করছো। দ্যাটস নট ডান। টিপিক্যাল ওয়াইফ টাইপ বিহেভিয়ার। “

বাণীর রাগ হয়। সে শুনবে না কারো কথা। দূর্জয় হয়তো ভুলে গিয়েছে বাণী ৫ বছরের বহ্নি নয় যে এসব কথা শুনবে চুপচাপ। এতো অধিকার খাটানোর শখ জাগলে বহ্নিকে জোর করে এসব খাওয়াক। বাণী কখনোই ওই বিদঘুটে গন্ধের খাবারটা মুখে তুলবে না। বাণী গটগট পায়ে বিছানায় নিজের পাশে গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসে। বিড়বিড়িয়ে বলতে থাকে,

“ এরকম জানলে আমি কখনোই বিয়ের জন্য রাজি হতাম না। “

দূর্জয়ের কানে পৌঁছায় কথাটা। সে চোখ বুজে রেখেই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়ে এবার। আড়ষ্টতা ছেড়ে মেয়েটা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হোক। দরকারে দূর্জয় নাহয় এই শীতের কালে কয়েক রাত কম্বল ছাড়া ঘুমালো। কি আর এমন হবে? ওর মতো মানুষকে সহজে জ্বর, ঠান্ডা ধরতে পারে না। তাই কোনো সমস্যা নেই।

বাণী নিজেই এবার লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। দূর্জয় তা টের পায়। তার মানে অন্ধকারে ঘুমোতে বাণীর অসুবিধা নেই? দূর্জয় আরো ভাবছিলো বাণী ভয় পায় কি-না! যাক ভালোই হলো। আলোর ভেতর দূর্জয়েরও ঘুম হয় না।

সময় পেরিয়ে কিছুক্ষণ যেতেই দূর্জয় অনুভব করে তার শীতল শরীরে কেউ অতি যত্নের সহিত উষ্ণ কম্বলটা টেনে দিচ্ছে। এতো সাবধানতার সহিত কাজটা করছে যেনো ভুলেও ধরা না পড়ে যায়। নীরবে কাজটুকু করেই বিছানার অর্ধেক অংশের মালিকানা দ্রুত মাঝে দূরত্ব রেখে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ে। দূর্জয় নিঃশব্দে হাসে। ম্যাডামের মনে দয়া মায়া আছে তবে!

চলবে…

এক ম্লান রক্তসন্ধ্যার গান
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৬৭.

ক্যালেন্ডারের বুক থেকে একটা সপ্তাহ যেনো চোখের পলকেই কেটে গেলো। এই একটা সপ্তাহে স্পেশাল ফোর্সের পরিচালিত অপারেশনে দেশের বুকে কালো অধ্যায়ের রচয়িতা হামলাকারীদের খুঁজে খুঁজে আটক করা হয়েছে। প্রত্যেক সৈন্যের মধ্যে হামলাকারীদের প্রতি পুষে রাখা অদম্য ক্ষোভই হয়তো তাদের ইচ্ছে শক্তি বাড়িয়ে দেওয়ার টনিক হিসেবে কাজ করেছে। যার ফলস্বরূপ এতো দ্রুত তারা অপরাধীদের আটক করতে সক্ষম হয়েছে।

এই একটা সপ্তাহ কোনো সৈন্যই ঠিক করে নিজেদের পরিবার, পরিজন কিংবা আপনজনদের সময় দিতে পারে নি। তার কারণ হলো একরোখা কর্ম জীবনের তীব্র ব্যস্ততা।

তবে আজ কারো কোনো ধরনের ব্যস্ততা নেই। আছে অফুরন্ত সময়। বিশেষ একটা দিন বলে কথা। তারিখটা ১৮ ই ডিসেম্বর। প্রত্যয় এবং জেসির বাগদানের অনুষ্ঠান। যদিও বন্ধুর মৃত্যু শোক এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারে নি প্রত্যয়। তবে অনুষ্ঠানের ডেটটাও পেছানো আর সম্ভব ছিলো না তার পক্ষে। ইতিমধ্যে দুই পক্ষ হতেই সব মেহমানদের দাওয়াত দেওয়ার কাজটা সম্পন্ন হয়েছিলো। শেষ মুহুর্তে এসে তাদের মানা করে দেওয়াটা বেমানান দেখাতো।

অনুষ্ঠানটা ঘরোয়া ভাবে করলেও প্রত্যয় পরিবারের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রের কাছের মানুষদের দাওয়াত দিতে ভুলে নি। বিশেষ দিনে সকল বিশেষ মানুষদের উপস্থিতিই তার কাম্য।

__________

ঘড়িতে তখন বিকেল চারটা বাজে। বহ্নি রেডি হয়ে লিভিং রুম জুড়ে ছোটাছুটি করছে। হাতে তার একটা রিমোট। সেই রিমোট দ্বারা চালিত গাড়িটাকে নিয়ে পুরো ঘর জুড়ে পায়চারি করাটাই এই মুহুর্তে তার কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ৷ লিভিং রুমের সোফায় বসে থাকা দূর্জয়ও সম্পূর্ণ রেডি। গায়ে জড়িয়েছে নিজের পছন্দের কালো রঙের একটা শার্ট। হাতে রয়েছে প্রিয় রয়্যাল রয়েন্সের সিলভার রঙের ঘড়িটাও। সোফায় বসে ঢাকা ফেরত সুহালা বেগমের সঙ্গে কলে কথা বলার পাশাপাশি সতর্ক দৃষ্টি মেলে বহ্নিকেও পরখ করছে।

সুহালা বেগম কথার মাঝে প্রশ্ন করে,

“ বহ্নি কোথায়? সামনে আছে? থাকলে ওকে ডেকে দাও। কথা বলবো। “

দূর্জয় বহ্নিকে ডেকে বলে,

“ বহ্নি। কাম হেয়ার। দীদা কথা বলবে আপনার সাথে। “

বহ্নি সঙ্গে সঙ্গে খেলা ছেড়ে দৌড়ে আসে। এই নতুন জীবনটা বেশ উপভোগ করছে সে। কত কত নতুন মানুষ চারিদিকে আছে তার! সবাই তাকে কত আদর করে! বাহিরে ঘোরাঘুরি নিয়েও কোনো বাধা নেই তার। যদিও মেজর জোর করে তাকে আর মাম্মাকে ঐ নট সো ইয়াম্মি খাবার গুলো খাওয়ায়, কিন্তু মেজরও এতটা খারাপ না। বরং দীদা যাওয়ার পর দু’দিন তাকে রাতে নাইট টাইম স্টোরি শুনিয়েছে।

বহ্নি কাছে এসে দাঁড়াতেই দূর্জয় তাকে টেনে কোলে নিয়ে হাঁটুর উপর বসায়। ফোনটা বহ্নির হাতে দিয়ে নিজেই আনাড়ি হাতে বহ্নির এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিতে থাকে। বাণী এসে যদি দেখে যে খেলার চক্করে বেঁধে দেওয়া চুলগুলোর এই অবস্থা করেছে তাহলে ঝাড়ি একটাও মাটিতে পড়বে না।

বহ্নি ফোন কানে চেপে ধরেই প্রফুল্ল গলায় বলে,

“ ইয়ো দীদা! “

দূর্জয় এবং ফোনের অপর পাশে থাকা সুহালা বেগম দুজনেই বহ্নির অদ্ভুৎ সম্বোধনে না চাইতেও হেসে দেয়। চট্টগ্রামে থাকা অবস্থায় সুহালা বেগম বহ্নিকে বলেছিলো যে তিনি এখন বহ্নির দাদী হয়। সেই দাদী শব্দটাকেই উল্টো করে এই মেয়ে নিজের মতো দীদা শব্দ আবিষ্কার করে সারাদিন এটাই ডাকা শুরু করে। সুহালা বেগম অবশ্য বাধা দেন নি। বাচ্চা মানুষ যা ডেকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তা-ই ডাকতে দেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।

বহ্নি কথা শেষ করে ফোনটা রাখতেই দূর্জয় বলে,

“ এবার চুপ করে বসে থাকুন। আপনার মাম্মা এসে যদি দেখে যে, খেলার চক্করে আপনি নিজের চুল এলোমেলো করে ফেলেছেন আবার, তাহলে জানেন তো কি হবে? থার্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার! “

বহ্নি চোখটা সরু করে বলে,

“ তুমি আছো কেনো? ইউ শুড সেভ মি। আমি আমার মাম্মা তোমার সাথে শেয়ার করছি না? “

দূর্জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বিড়বিড়িয়ে বলে,

“ মায়ের যোগ্য মেয়ে। “

বহ্নি ফের প্রশ্ন করে,

“ তুমি কি বললে? “

“ আপনি দিন দিন পাকনি বুড়ি হয়ে যাচ্ছেন বহ্নি। “

বহ্নি মুখ ফুলিয়ে বলে,

“ ওহ গড মেজর! তুমি এতো ডাম্ব? একটা ফাইভ ইয়ারের বাচ্চা বুড়ি কিভাবে হয়? “

বহ্নির কথার ভঙ্গি দেখে দূর্জয় হেসে দেয়। সেই মুহুর্তে রুম থেকে বেরিয়ে লিভিং রুমের সামনে এসে দাঁড়ায় বাণী। দূর্জয় আনমনে চোখ তুলে এক পলক দেখে নিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। পরমুহূর্তেই আবার চোখ তুলে তাকায়। এবার আর দৃষ্টি সরাতে পারে না।

মেরুন রঙের শাড়ি গায়ে জড়ানো নারীকে দেখে মনে মনে থমকায় দূর্জয়। তা প্রকাশ পায় তার চোখের অভিব্যক্তিতে। বাণী কিঞ্চিৎ লজ্জা পেয়ে তাড়া দেখিয়ে বলে,

“ যাবে না? “

দূর্জয় মাথা নেড়ে বহ্নিকে কোল থেকে নামিয়ে সোফায় বসিয়ে গিয়ে দু জোড়া জুতা নিয়ে আসে। প্রথম জোড়া জুতাটা বহ্নির। দূর্জয় বহ্নির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে জুতাটা পড়িয়ে দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নিজেও সোফায় বসে নিজের জুতা পড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাণী নীরবে দেখে সবটা। মনের সুপ্ত কোণে ভালো লাগা কাজ করে। দু’দিন আগেও সে ভাবতো সে ছাড়া বহ্নির আর কেউ নেই। কিন্তু ধীরে ধীরে তার সেই ধারণা পাল্টাচ্ছে। দূর্জয় নিজে আয়োজন করে সেই ধারণা বদলে দিচ্ছে। কথায় কথায় মুখে বহ্নিকে নিজের মেয়ে বলে কখনো দাবী না করলেও, কাজের মাধ্যমে নিঃসংকোচে বহ্নিকে নিজের মেয়ের মতোই ট্রিট করছে। আর কি চাই বাণীর?

__________

জেসি আর প্রত্যয়ের বাগদানে একপ্রকার হুলুস্থুল কান্ড বেধে গিয়েছে। ছেলে পক্ষের তরফ থেকে হাতেগোনা মেহমান হলেও, মেয়ে পক্ষের আত্মীয় স্বজন মিলিয়ে মেহমানের সংখ্যা পঞ্চাশ এর ঘর ছাড়িয়েছে। ভাগ্যিস আলাউদ্দিন সাহেব আয়োজনটা এপার্টমেন্টের ছাদে করেছেন। নাহয় হযবরল অবস্থা হয়ে যেতো এক প্রকার।

পুরুষেরা সব ছাদে অবস্থান করলেও মহিলা এবং বাচ্চারা মিলে দখল করেছে বাসার চারটা বেডরুম এবং লিভিং রুমটা। জেসির মা আর ভাবী সেদিকটা তদারকি করতে ব্যস্ত। এতো ভীড়ের মাঝে বাণী বেশ অস্বস্তি অনুভব করছিলো। এতো গুলো অপরিচিত মানুষের ভীড়ে কেমন জড়তা কাজ করছিলো তার ভেতর। জেসির সঙ্গে তার যা-ও পরিচিত কিন্তু জেসিও এই মুহুর্তে আত্মীয়দের দ্বারা ঘেরা। তার কাছে ঘেঁষার সুযোগ নেই।

উপস্থিত মহিলাদের অনেকেই বাণীর দিকে উৎসুক দৃষ্টি মেলে তাকাচ্ছে। শুনেছে প্রত্যয়ের সিনিয়র মেজরের স্ত্রী এই নারী। এতটুকু তথ্যই তাদের কৌতূহলের জন্য যথেষ্ট। একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা আগ্রহ দমাতে না পেরে প্রশ্ন করে বসে,

“ তোমার বিয়ের কতো বছর হলো? “

বাণী থতমত খেয়ে যায়। উত্তর দিতে পারে না কোনো। মহিলার আগ্রহ আরো বেশি হওয়ার কারণ হলো, তিনি দেখেছেন বাণীর একটা বাচ্চা আছে। খুব সম্ভবত বাচ্চাটার বয়স ৫ কিংবা ৬। সুতরাং বিয়ে নিশ্চয়ই অন্তত পক্ষে আরো ৭ বছর আগে হয়েছে? কিন্তু ৭ বছর আগে তো পদ অনুযায়ী মেজরের বিয়ের অনুমতি পাওয়ার কথা না! মূলকথা উনি হিসাব মিলাতে পারছে না।

উনি আরো কিছু প্রশ্ন করবে তার আগেই বহ্নি এসে বাণীর হাত ধরে টেনে আদুরে স্বরে বলে,

“ আমি মেজরের কাছে যাই মাম্মা? “

বাণী মেয়েকে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে বলে,

“ না মা। উপরে এখন সবাই ব্যস্ত। মাম্মার সাথে থাকো তুমি। “

বহ্নির কথাটা আশেপাশের আন্টিদের কান এড়ায় না। একজন আগ্রহী গলায় প্রশ্ন করে,

“ মেয়ে কি নিজের পাপাকে মেজর বলে ডাকে নাকি? “

বাণী কিছু বলার পূর্বেই বহ্নি অবাক গলায় বলে,

“ মেজর তো আমার পাপা না, মেজর তো শুধুই মেজর। তাই না মাম্মা? “

উপস্থিত মহিলারা অবাক হয়। বাণীর অস্বস্তি হচ্ছিলো। সে কোনো মতে বলে,

“ দূর্জয় আমার হাজব্যান্ড। আমাদের রিসেন্টলি বিয়ে হয়েছে। ও বহ্নির বায়োলজিক্যাল ফাদার না। “

একজন মহিলা সুর টেনে বলে,

“ ওওও। “

বাণীর খুব অস্বস্তি লাগছিলো। এতগুলো মহিলার তার এবং তার মেয়ের প্রতি মনযোগে সে দমবন্ধকর অনুভব করছিলো। বাণী যে-ই না উঠে যেতে নিবে সেই মুহুর্তে তার পাশের সোফায় বসা একজন মহিলা বহ্নিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ তোমার আসল ফাদার না হলেও তো সে এখন তোমার মাম্মার হাজব্যান্ড। মাম্মার হাজব্যান্ডকে তো পাপাই বলতে হয়। এভাবে মেজর ডাকলে খারাপ শোনায় তা। “

বাণী আর অপেক্ষা করে না। তাড়া দেখিয়ে বলে,

“ আমি একটু আসছি। “

বলেই বহ্নির হাত ধরে টেনে সে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। দরজার বাহিরে আসতেই বাণী নিশার মুখোমুখি হয়। নিশা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে,

“ কোথায় যাচ্ছো ভাবী? “

বাণী আরেক দফা ইতস্তত অনুভব করে। এরকম ভাবী ডাকে সে অভ্যস্ত নয়। কিন্তু নিশার ভাষ্যমতে তার ভাইয়াকে বিয়ে করার দরুন বাণী এখন আপু থেকে ভাবীর পজিশনে প্রমোশন পেয়েছে। বাণীকে নিরুত্তর দেখে নিশা আবার বলে,

“ ভাবী আর ইউ ওকে? “

বাণী মাথা নেড়ে বলে,

“ ভেতরে অনেক মানুষ। অস্থির লাগছিলো। ছাদে যাবে তুমি? “

নিশা ভেবে দেখে অপরিচিত এতো মানুষের ভীড়ে বসে থাকার তুলনায় ছাদে যাওয়াটা বেটার অপশন। সেখানে অন্তত পরিচিত মুখ তো পাবে! আব্বু, দূর্জয় ভাইয়া আর সাইফ। সাইফের কথা মনে পড়তেই নিশার মুখখানা লজ্জায় রাঙা হয়।

__________

ছাদে এসে এতো পুরুষের ভীড়ে কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দূরে এককোণে রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেদিকে এগিয়ে যায় বাণী। সঙ্গে রয়েছে বহ্নিও। দূর্জয় হট্টগোল ছেড়ে কিছুটা নীরবতার জন্যই এই দূরে এসে আশ্রয় নিয়েছে। প্রত্যয় এবং জেসির জন্য সে খুশি হলেও, এতো মানুষের ভীড়ে সে কিছুটা হাঁপিয়ে উঠেছিলো। সে নিষ্প্রভ পরিবেশ প্রেমী মানুষ।

পাশে কারো উপস্থিতি টের পেতেই দূর্জয় তাকিয়ে দেখে বাণী এবং বহ্নি এসে দাঁড়িয়েছে। মা মেয়ের মলিন মুখখানা দেখে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ মন খারাপ কেনো? “

বাণী কেবল বলে,

“ নিচে অস্বস্তি লাগছিলো এতো মানুষের ভীড়ে। “

দূর্জয় কিছুক্ষণ বাণীর দিকে তাকিয়ে রয়। তেরো বছর আগের বাণীর স্বভাব ছিলো হাজার ভীড়েও সাবলীল ভঙ্গিতে মেতে থাকা। অথচ আজকের বাণীর মাঝে কত সংকোচ! দূর্জয় বহ্নিকে প্রশ্ন করে,

“ খারাপ লাগছে বাচ্চা? “

বহ্নি মলিন মুখে মাথা নেড়ে বলে,

“ পা ব্যথা করছে। “

বহ্নি মিথ্যে বলে নি। অতিরিক্ত দৌড়াদৌড়ি করার ফলে তার আসলেই পা ব্যথা করছিলো। দূর্জয়কে খানিকটা চিন্তিত দেখায়। সে কিছু একটা ভেবে বহ্নিকে কোলে তুলে নেয়। বহ্নি দু’হাতে ঘাড় জড়িয়ে কাধে মাথা হেলে দেয়। দূর্জয় বাণীর দিকে তাকিয়ে বলে,

“ নিচে চলো। গাড়ির ভেতর নিরিবিলি কিছুক্ষণ বসে রেস্ট করো। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে জাস্ট উপরে চলে আসবো। “

বাণী গলা নিচু করে বলে,

“ খারাপ দেখাবে না? “

“ মেয়ের অসুবিধার কথা আমাদেরই ভাবতে হবে। অন্য কেউ সেই কাজটা করবে না। আর অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে উপরে এসে পড়বো তো। “

বাণী আর কথা বাড়ায় না। দূর্জয় কেবল নিচে যাওয়ার আগে ফারদিনকে বলে যায় যে, তারা নিচে পার্কিং এরিয়াতেই আছে। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে যেনো কেবল দূর্জয়কে একটা কল দেয়।

__________

সন্ধ্যা নেমে খোলা আকাশের নিচে ছাদের চারিদিকটা কৃত্রিম আলোয় জ্বলজ্বল করে উঠতেই মূল অনুষ্ঠান শুরু হলো। গোলাপি গাউন জাতীয় পোশাক গায়ে জড়ানো জেসি ছাদে পা রাখতেই তার চোখ পড়ে ছাদে তৈরী ছোট স্টেজ জাতীয় জায়গার উপর দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যয়ের দিকে। তার আব্বুর পছন্দের সুপাত্রকে সবসময়ের মতো দেখতে ক্লাসের সবথেকে ভদ্র বাচ্চার মতোই মনে হচ্ছে। নিজের অদ্ভুৎ ভাবনায় জেসি ঠোঁট টিপে হাসে। এগিয়ে যায় সামনের দিকে। নিজের অপেক্ষমাণ ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ায় অতি নিভৃতে।

আন্টি বদলের অনুষ্ঠান শেষে সবাই যখন করতালিতে চারিপাশটা মুখোর করে তুলেছে ঠিক সেই মুহুর্তে প্রত্যয়ের চোখ পড়ে স্টেজের নিচে এতো মানুষের ভীড়ে দাঁড়িয়ে থাকা চার বন্ধুর দিকে। স্বভাবত প্রত্যয় আবেগী নয়। কিন্তু আচমকা তার চোখ ছলছল করে উঠে। প্রিয় চার বন্ধুর পাশে চোখের সামনে ভেসে উঠে আরো দুটো মুখ। রিদওয়ান আর সাদাতের। আজকে তো ওদেরও এখানে উপস্থিত থাকার কথা ছিলো। তাই না? জীবন এতটা অনিশ্চিত যে কার কখন ডাক পড়ে যায় তা কেউই জানে না। কারণ মৃত্যুই হচ্ছে মানুষের জীবনের ধ্রুব সত্য। যেই সত্য কেউই বদলাতে পারবে না।

এই অনিশ্চিত জীবনে যেখানে এক সেকেন্ডের ভরসা নেই সেখানে ভবিষ্যতের আশায় বসে থাকাটা বোকামি। প্রত্যয় মুহুর্ত অপচয় না করে নিজের পাশে বসে থাকা জেসির পানে তাকায়। নিচু স্বরে বলে,

“ একটা কথা বলার ছিলো। “

জেসি প্রত্যয়ের পানে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চায় কি বলার আছে? প্রত্যয় দ্বিধাহীন গলায় বলে,

“ প্রেমে তুমি একা পড়ো নি জেসি। আমিও পড়েছি। তোমার প্রেমে পড়েছি। “

জেসি অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়। হঠাৎ এই মুহুর্তে এই কথাটা বলার পিছনে কি বিশেষ কোনো কারণ আছে? হয়তো আছে! জেসি কিছু না বলে চোখ ফিরিয়ে নেয়। সবার অগোচরে কেবল প্রত্যয়ের হাতের পিঠে হাত রেখে ফিসফিসিয়ে বলে,

“ ভয় খুব অদ্ভুৎ জিনিস তাই না? মনের কথা মুখে এনে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। “

__________

জুলফিকার মুজতবার সাথে সাথে থাকার দরুন নিশা এক মুহুর্তের জন্যও সাইফের কাছে ঘেঁষার সুযোগ পায় নি আজ। চোখে চোখে কিংবা ফোনের ম্যাসেজে লুকোচুরি করে কথা বললেও কাছ থেকে কথা না বলার আক্ষেপে মনটা তার মলিন হয়ে আছে। সবাই যখন খাওয়া দাওয়া নিয়ে ব্যস্ত ঠিক সেই মুহুর্তে নিশার ফোনে একটা ম্যাসেজ আসে।

“ ছাদের ডানপাশে আছি। এদিকে কেউ নেই। অপেক্ষায় আছি ইয়াসমিন। “

নিশা চারিদিকে তাকিয়ে জুলফিকার মুজতবাকে মিছে এক ছুতো দেখিয়ে দ্রুত খাওয়া শেষ করে সবার অগোচরে ছাদের ডানপাশটায় চলে যায়। এদিকটায় তেমন একটা আলো নেই। তবে চাঁদের আলোয় চারিপাশটা একদম অস্পষ্ট নয় এখনো। কিছুটা এগিয়ে সাইফের অবয়ব দেখতেই নিশা দ্রুত তার কাছে এগিয়ে যায়। সাইফ নিশাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলে,

“ উপরের ছাদে উঠতে পারবেন ইয়াসমিন? “

নিশা বড়ো বড়ো চোখ মেলে সাইফের পাশের দেয়ালে খাড়া মইয়ের মতো সিঁড়ির দিকে তাকায়। বিস্মিত গলায় বলে,

“ সিঁড়ির পাশেই রেলিং সাইফ। পা ফসকে গেলে সোজা উপরে চলে যাবো আমি। এতো ভীতি নিয়ে উপরে উঠা সম্ভব না। “

সাইফ আশ্বস্ত করে বলে,

“ ভয়ের কিছু নেই তো। আমি… “

নিশা পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে ফোঁড়ন কেটে অস্থির গলায় বলে,

“ আপনি বনে বাদরে ঘুরে বেড়ানো মানুষ। আপনার ভয় ডর কম হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার পক্ষে সম্ভব না। আপনি জানেন আমার পোকামাকড়, অন্ধকার, ভূত, উচ্চতা, আগুন এসবে ফোবিয়া আছে? এভাবেই আমি সারা বিকাল ধরে ভয়ে ছাদের কিনারে ঘেঁষছি না। ভয়ে পা কাঁপছে। তার উপর… “

সাইফ নিশার দু গালে হাত রেখে এবার নরম গলায় বলে,

“ শান্ত হোন। ভয় পাবেন এরকম কিছু করবো না। বিশ্বাস রাখুন ইয়াসমিন। “

নিশা কিছুটা ঠান্ডা হয়। সাইফ এবার নিজে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নিশার দুই হাত নিজের হাতে নিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে রসিক সুরে বলে,

“ আমাদের বাচ্চা কাচ্চা তাদের মা’য়ের মতো হলে খুব ঝামেলা হবে ইয়াসমিন। এক ভীতুকে নাহয় সামলে নিলাম। কিন্তু পরে এতগুলো ভীতুর ভয় দূর করতে হিমশিম খাবো না, বলুন? “

নিশা কথা গুলো শুনতেই লজ্জা এবং রাগে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করতে নেয়। সাইফ তড়িঘড়ি করে তার হাত ধরে টেনে নিজের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বলে,

“ আরে কোথায় যাচ্ছেন? আচ্ছা, সরি। আর ফাইজলামি করবো না। আই প্রমিজ। “

নিশা তখনো লজ্জায় মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে রেখেছে। সাইফ লজ্জা রাঙা মুখটা দেখে এগিয়ে এসে দুই হাতের সাহায্যে নিশার খোলাচুল গুলো দু কানের পিছনে নিয়ে গুজে দেয়। নিশা মুখ ফিরিয়ে সাইফের পানে তাকায়। সাইফের দৃষ্টি জোড়া মুহুর্তেই মুগ্ধতায় ছেয়ে যায়। তার মন বলে উঠে লেফটেন্যান্ট কর্নেলের এই ভীতু, বোকা মেয়েটার মতো নিষ্পাপ, নির্মল, মায়া মাখা মুখের মানুষটা শুধুই এবং একান্তই তার। এই পবিত্র মনের মানুষটাকে পাওয়ার বিনিময়ে জীবনের প্রায় পঁচিশটা বছরের একাকিত্ব ভুলে যাওয়া খুব কঠিন কোনো কাজ নয়।

নিশার অস্থির দৃষ্টি নিজের প্রতি স্থির করতেই বোধহয় সাইফ রাশভারী গলায় আবৃতি করে উঠে,

“ তুমি পোকামাকড় ভয় পাও বলে,
আমি কীটনাশক হতে রাজি।
তুমি অন্ধকার ভয় পাও বলে,
আমি আলো হতে রাজি।
তুমি ভূতে ভয় পাও বলে,
আমি রক্ষাকবচ হতে রাজি।
তুমি উচ্চতা ভয় পাও বলে,
আমি পায়ের নিচে জমিন হতে রাজি।
তুমি আগুন ভয় পাও বলে,
আমি পানি হতে রাজি।
শুনেছি প্রেমে লোভী হতে নেই।
কিন্তু শুনে রাখো মেয়ে,
তোমার প্রেমিক খুব লোভী।
এতকিছুর বিনিময়ে তুমি কেবল গাছ হয়ে পাশে থেকো।
উত্তপ্ত দুপুরে কিছুটা ছায়া দিও।
ঘোর বৃষ্টিতে কিছুটা আশ্রয় দিও।
তিক্ত গরমে শীতল হাওয়া দিও।
তবুও ভয় কিসের মেয়ে?
আমি তো আছি! “

নিশা ভরা চোখে সাইফের দিকে তাকিয়ে আছে। তার হঠাৎ করে খুব কান্না পায়। অসহ্যকর ভালো লাগায় দমবন্ধকর অনুভূতি হচ্ছে তার। এই তামাটে গায়ের চঞ্চল স্বভাবের মানুষটা লিখিত, অলিখিত সব ভাবেই তার ভাবতেই হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। অনুভূতির তাড়নায় নিশা নিজেই এগিয়ে গিয়ে সাইফকে জড়িয়ে ধরে। নিজের সরু হাতের আলিঙ্গনে জাপটে ধরে ধরা গলায় বলে,

“ আপনি আমার আশেপাশে থাকলে আমার কান্না পায় খুব। কখনো খুশিতে, কখনো কষ্টে। এরকম কেন হচ্ছে? “

সাইফ উত্তর দেয় না। কেবল হেসে প্রিয়তমাকে স্নিগ্ধ আবেশে জড়িয়ে নেয়। নিশা উত্তরের অপেক্ষাও করে না। কেবল চোখ বুজে বুকের বা পাশের ধুকপুক করতে থাকা হৃৎস্পন্দন গুলো শুনতে থাকে।

__________

রাত তখন প্রায় দশটার কাছাকাছি। জেসিদের বাসা থেকে বেরিয়ে বেশ অনেকক্ষণ বাহিরে ঘুরাঘুরি করে সবেমাত্র পরিবার সমেত বাড়ির সামনে এসে গাড়ি ব্রেক করলো দূর্জয়। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বাণীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ তুমি দরজা খুলে ভেতরে যাও। আমি গাড়ি পার্ক করে বহ্নিকে নিয়ে আসছি। “

বাণী এক মুহুর্ত পিছনে ফিরে মেয়ের মলিন মুখটা দেখে পার্স হাতে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। দূর্জয় দক্ষ হাতে গাড়িটা পার্ক করে নির্দিষ্ট জায়গায়। অত:পর নিজে গাড়ি থেকে নেমে পিছনের দরজা খুলে হাসি মুখে বহ্নিকে বলে,

“ কমন ম্যান এট ইউর সার্ভিস ইউর হাইনেস। আপনাকে কোলে করে নামাবো নাকি নিজে নিজে নামতে চান আপনি? প্রিন্সেস কি চায়? “

অন্যসময় হলে এতো আদুরে কথায় বহ্নি গলে সবগুলো দাঁত বের করে হাসতো। তবে আজ সেরকমটা হলো না। কেবল নিজের দু হাত এগিয়ে দিয়ে বুঝায় সে কোলে করে নামতে চায়। দূর্জয় এগিয়ে বহ্নিকে কোলে নিলেও আর নিচে নামায় না। বরং উঠোন ধরে হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে কিডডো? কেউ কিছু বলেছে? মাম্মা কি আপনাকে বকেছিলো? “

বহ্নি এবার দূর্জয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ মাম্মার হাজব্যান্ডকে কি পাপা ডাকতে হয় মেজর? কিন্তু তুমি তো আমার পাপা না। তাহলে ওই আন্টিটা কেনো বললো, তোমাকে পাপা ডাকতে? “

দূর্জয় থম মেরে কিছুক্ষণ বহ্নির ছোট্ট মুখের দিকে তাকিয়ে রয়। সারাদিন ধরে বাচ্চার মলিন মুখ দেখে সে আঁচ করতে পেরেছিলো কিছু একটা হয়েছে। এইবার পুরোপুরি ঘটনাটা বুঝতে পারে সে। দূর্জয় নীরবে হেঁটে বহ্নিকে নিয়ে গাড়ির সামনে যায়। বহ্নিকে গাড়ির ফ্রন্ট বোনাটে বসিয়ে নিজেও তার মুখোমুখি দাঁড়ায়। কিছুটা বুঝানোর মতো করে বলে,

“ আপনার মাম্মার হাজব্যান্ড অর্থাৎ আমি টেকন্যাকিলি আপনার ফাদার হই এটা সত্য। কিন্তু
আমাকে আপনি কি ডাকবেন ইট ইজ আপ টু ইউ। ইউ ক্যান কল মি হোয়াটএভার ইউ লাইক। “

বহ্নি ভাবুক হয়ে জানতে চায়,

“ কিন্তু কারো দুইটা ফাদার কি করে হয়? আমার তো অলরেডি পাপা আছে। “

দূর্জয় এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ আপনি এখনো ছোট বহ্নি। রিলেশনশিপ গুলো একটু কম্পলিকেটেড। আরেকটু বড়ো হোন, বুঝতে শিখুন। আমি আর মাম্মা আপনাকে সব বুঝিয়ে বলবো। আপাতত একটা কথা জেনে রাখুন, কারো কথায় বাধ্য হয়ে কখনো আমাকে পাপা, বাবা, আব্বু কিংবা কিছু ডাকতে হবে না আপনার। কখনো যদি আপনার নিজ থেকে ডাকতে ইচ্ছে হয় তখনই একমাত্র ডাকবেন। ওকে? “

বহ্নি হ্যাঁ বোধক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। অত:পর কিছুক্ষণ চুপ করে মলিন মুখে বলে,

“ তোমাকে একটা সিক্রেট বলি মেজর? “

দূর্জয় মাথা নেড়ে বলে,

“ শিওর। “

বহ্নি কিছুক্ষণ চুপ থেকে নরম গলায় বলে,

“ আই হেইট পাপা, বাট আই মিস হিম অলসো। ইজ ইট রং? “

দূর্জয় নির্বাক কিছুক্ষণ বহ্নিকে দেখে। বাস্তবিক জীবনের ভয়ংকর রূপ সম্পর্কে অজ্ঞাত শিশুটার মাথায় একটা চুমু দিয়ে বলে,

“ ইট ইজ নট রং। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]