#রোদরঞ্জন
#পর্ব_১৬
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
[প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য]
[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.
টেবিলে ব্ল্যাক কফি দেখে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল ইনান। টয়া চোখ বন্ধ করে কফির মগে চুমু দিচ্ছে যেন সে অমৃত খাচ্ছে। ইনান ব্যস্ত ক্যাফেতে চোখ বুলায়। কেউই এখানে সিঙ্গেল নেই। হয় ফ্রেন্ডদের সাথে নয়তো পার্টনারের সাথে আড্ডায় মশগুল সবাই।
ক্লাস শেষে ইনান এসেছে টয়ার সাথে দেখা করতে। আশার কথা ছিল না তার। টয়া হঠাৎ ফোন দিয়ে বলে ক্যাফেতে দেখা করতে। জেহফিল একটু পরেই গাড়ি নিয়ে চলে আসবে ভার্সিটির সামনে। কিন্তু এই মুহুর্তে টয়ার সাথে কথা বলাটাও জরুরী।
‘তো কী খবর?’ টয়া কফির মগে হাত ঘুরাতে ঘুরাতে বলে।
ইনান দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাস্তায় দৃষ্টিপাত করে। সে কিছু বলার আগেই টয়া তাকে থামিয়ে বলে,
‘খবরাখবর ভালোই চলবে তোর। টেনশনমুক্ত আছিস কিনা।’
‘শরৎকে দেখতে যাইনি বলে এই কথাটা বললি?’
টয়া জবাব দিল না। তার চিকন ঠোঁটে অবহেলার হাসি ফুটে উঠল।
‘শুন টয়া। তোদের সবার একটা স্বভাব আছে ঘটনা পুরোটা না জেনেই জাজ করা। এতে বিপরীত দিকের মানুষটা হার্ট হবে কিনা তা ভাববার প্রয়োজনবোধ করিস না।’
‘তোর একটা বন্ধু হাসপাতালে ভর্তি। এই চব্বিশ ঘন্টার একটা ঘন্টা হাতে ছিল না তোর ছেলেটার খোঁজ নেয়ার?’
‘উফ টয়া। আমার কথা না শুনে তোরা কেন আমাকে ব্লেইম দিচ্ছিস বলতো?’ বিষণ্নতা ঘিরে ধরল ইনানকে, ‘এমন বিহেভ করছিস যেন আমি তোদের বন্ধু না! শরৎ অসুস্থ বলেই সবার চিন্তা এখন ওকে নিয়ে। দোষ যখন দিবি জেনেশুনে তারপর দিবি।’
‘আচ্ছা আচ্ছা বল তো। কী হয়েছে তোর শুনি।’ টয়া অবজ্ঞার ভঙ্গিতে বলল। হতাশ হলো ইনান। সে শরৎকে দেখতে যায়নি বলে মনে হয় কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গিয়েছে!
‘বলছিস না কেন? তোর ভাঙ্গা ক্যাসেট চালু কর। আমার হাতে সময় নেই। যেতে হবে।’
‘শরৎ যে ড্রাগ অ্যাডিক্টেড জানিস?’
টয়া ভ্রুকুটি করে তাকাল। ইনান শরৎএর মার খাওয়া ছবিটা দেখাল। টয়া চোখ ছোট ছোট করে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আবার ভ্রু মসৃণ করে তাকাল। তাচ্ছিল্য সহকারে বলে,
‘তো?’
‘তো?’ ইনান অবাক গলায় বলল, ‘তো মানে কী? বুঝতে পারছিস ও একজন ড্রাগ অ্যাডিক্টেড তাও আবার এই বয়সে!’
‘এই শুন, এসব এই বয়সে একটু আকটু হয়ই, বয়সের দোষ এগুলো। কারো ক্ষতি তো আর করছে না সে?’
টয়ার কথা শুনে ইনান সাত আসমান থেকে পড়ে। টয়া শরৎকে সাপোর্ট করছে?
‘তুইও কি এসব করিস নাকি?’
টয়া প্রশ্ন এড়িয়ে বলল, ‘তুই আসলেই একটা পাগল। শরৎ সামান্য নেশা করেছে বলে ওর বিপদে পাশে থাকবি না?’
ইনান মাথায় হাত দিয়ে বসে, টয়া আবারও পুরোটা না জেনে মন্তব্য করা শুরু করেছে।
‘ভাই লিসেন। ও শুধু ড্রাগ অ্যাডিক্টেডই না। ও আমাকে মা’রার চেষ্টা করেছে।’
টয়া হঠাৎ ধাক্কা খায় যেন, ‘মানে?’
‘মানে, ঐদিন আমরা সাইক্লিং করতে গিয়েছিলাম না? সেদিন ও আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল। হি ট্রাইড টু মার্ডা’র মি!’
‘তুই নিজ চোখে দেখেছিস ও তোকে ধাক্কা দিয়েছে?’
ইনান থমকায়, ‘না।’
টয়া চোখ উল্টায়, ‘তাহলে কোন ভিত্তিতে এসব বলছিস? আবার তুই আমাকে সেটা বিশ্বাসও করতে বলছিস?’
বিস্ময়ে ইনানের মুখ হা হয়ে গেল, ‘তুই বলছিস আমি মিথ্যা বলছি?’
টয়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলল, ‘ইনান, তুই বোধহয় জানিস না, বাট শরৎ লাইকস ইউ। ও তোকে প্রথম থেকেই পছন্দ করত আর আমরা সবাই তা আঁচ করতে পেরেছি শুধু তুই গাঁধী বাদে। ও হয়তো নেশা করতে পারে, বাট মার্ডা’র? পছন্দ করা মানুষকে হার্ট করে কোন পাগলে? তুই হয়তো কারণ দেখাতে পারিস যে তোর বাবা ও’কে মে’রেছে বলে তার শোধ তুলতে চেয়েছে তোর উপর, কিন্তু শরৎ এমন ছেলে না। এসব ওর সাথে যায় না। যদি তুই এই কারণেই শরৎএর সাথে দেখা করতে চাইছিস না তাহলে বলব তুই যা ভাবছিস তার সবটাই ভিত্তিহীন এবং মিথ্যা।’
ইনান উঠে দাঁড়ায়, ‘আমি গেলাম, ভাল্লাগছে না আমার।’
টয়া বাঁধা দিলো না, শুধু বলল, ‘হসপিটালের বেডে শুয়েও কিন্তু ও তোকে দেখতে চেয়েছে। স্বার্থপর হোস না। ও এখন ওর বাড়িতে, সময় পেলে দেখা করে আসিস।’
ইনান পার্স হাতে তড়িৎ গতিতে বেরিয়ে গেল। কেউ তার কথা বিশ্বাস করছে না! শরৎ তাকে লাইক করে এটা সবার চোখে পড়েছে আর মার খাওয়ার পর থেকে শরৎ যে ও’কে তীব্র ঘৃণার চোখে দেখত সেটা কারো চোখে পড়েনি? ও যে ঝারি মেরে কথা বলত ইনানের সাথে সেটা ওরা দেখেনি? আশ্চর্য বন্ধু বান্ধব! শরৎএর সাইড কেন নিচ্ছে? শরৎএর ফ্যামিলি সম্ভ্রান্ত বলে? শরৎ ইনানের থেকেও বড়লোক বাপের ছেলে বলে? প্রতিবার ট্রিট আর দামী দামী গিফ্ট দিচ্ছে বলে?
ইনান রাস্তার কাছে আসতেই দেখল জেহফিলের গাড়ি। এগিয়ে গেল। হয়তো পনেরো মিনিট ধরে জেহফিল অপেক্ষা করছে! গাড়িতে কাউকেই দেখতে পেল না। ইনান ফোন বের করল জেহফিলকে কল দেয়ার জন্য। কানের কাছে মোবাইল ধরা মাত্রই কেউ হেঁচকা টানে ইনানকে নিজের দিকে ঘুরায়। মোবাইল সশব্দে পিচ ঢালা রাস্তায় পড়ে যায়। শক্ত হাতে বাহু আঁকড়ে ধরা মানুষটার দিকে তাকায় ইনান। জেহফিল! কেমন উন্মাদের মতো লাগছে জেহফিলকে!
‘কোথায় ছিলে এতক্ষণ? কোথায় গিয়েছিলে?’ দাঁতে দাঁত চেপে বলল জেহফিল।
‘এত রেগে আছেন কেন?’ ইনান হাত ছাড়াতে লাগল।
জেহফিল দুইহাতে ইনানের দুই বাহু চেপে ধরল, ‘আগে বলো কোথায় গিয়েছিলে?’
‘ঐ পাশের ক্যাফেতে গিয়েছিলাম।’
‘কার সাথে?’
‘ফ্রেন্ড।’
‘ছেলে না মেয়ে?’ অধৈর্য হয়ে বলে জেহফিল।
বিরক্তির শ্বাস ফেলে ইনান, ‘টয়া ছিলো।’
‘কেন গিয়েছিলে? কী কথা হয়েছে?’
‘আরেহ, দেখা হয়নি এতদিন তাই দেখা করতে গিয়েছিলাম, বাকি সবার খোঁজ নিতে। এবার বলুন আপনি এতো রেগে আছেন কেন?’
জেহফিল চোখ বন্ধ করে ঘাড় পেছনে নিয়ে শ্বাস ফেলে। গাড়ির দরজা খুলে ইনানকে বসিয়ে নিজেও ড্রাইভিং সিটে এসে বসে।
ইনান অপেক্ষা করছে জেহফিল নিজ থেকে কিছু বলবে এই আশায়। জেহফিলের ঘাড়, কপালের রগ ফুলে গেছে, শরীর শক্ত রেখে শ্বাস ফেলছে সে। জেহফিল বসামাত্র ইনান তার হাতের উপর হাত রাখল। জেহফিল মাথা হেলিয়ে তাকায়। ইনান কিছুটা ভড়কায়। জেহফিলের চোখ লাল।
জেহফিলের হাতে রাখা ইনানের হাত শক্ত হয়। জেহফিলের গালে হাত রেখে বলে,
‘রিল্যাক্স, এত টেন্সড কেন?’
ইনানের হাতের ছোঁয়া পেয়ে জেহফিল চোখ বন্ধ করে, শান্ত হওয়ার চেষ্টা করে বলে, ‘কাজের চাপ বেশি।’
এই বলে জেহফিল ইনানের কোমর ধরে তাকে নিজের কোলে বসায়। গাড়ি অটোমোশনে দিয়ে বলল,
‘একটু জড়িয়ে ধরো আমাকে, টেনশন কমবে।’
ইনানের লজ্জা লাগল প্রথমে এভাবে বসেছে দেখে। তবে লজ্জা কমে গেল জেহফিলের চিন্তিত মুখে তাকানোর পর। জেহফিলের কাঁধে হাত রেখে হালকা ভাবে জড়িয়ে ধরল, জেহফিলের তাতে মন ভরল না। দুইহাতে ইনানকে হঠাৎ করে নিজের সাথে চেপে ধরল যে ইনানের মুখ থেকে মৃদু চিৎকার বেরিয়ে আসল।
‘আর কোনোদিন আমাকে না বলে কোথাও যাবে না। এমনিতেই কাজের চাপে থাকি তার উপর তুমি হুটহাট কোথাও চলে গেলে কোথায় যাবো বলো তো?’
ইনান জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল, ‘জ..জেহফিল, আলগা করে ধরুন।’
জেহফিল হিতে বিপরীত করল। ইনানকে আরো জোরে চেপে ধরল। যেন সে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলবে ইনানকে। ইনানের হাতের নখ দেবে গেল জেহফিলের পিঠে, এবার তার সত্যি দম বন্ধ হয়ে আসছে। মোচড়ানো শুরু করল সে, তাকে এমন করতে দেখে জেহফিল অগ্নিঝরা কণ্ঠে বলল,
‘তুমি আমার থেকে ছুটতে চাইছো কেন বাটারফ্লাই? এই কয়দিনেই আমার প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে? আমাকে একা করে দেয়ার প্ল্যান করছো…’
জেহফিল আরো বকবক করতে শুরু করল, ইনানের কানে কিছু ঢুকছে না, তার এখন অক্সিজেন প্রয়োজন। সেই মুহুর্তেই জেহফিল ইনানকে সামনে আনল, ইনান হাঁপাতে লাগল, বুক ভরে শ্বাস নিতে লাগল। স্বাভাবিক হওয়া মাত্রই জেহফিলের হাত ঝট করে সরিয়ে দিলো, রাগী চোখে তাকাল,
‘এখনই তো আমাকে মে’রে ফেলছিলেন, বুদ্ধিসুদ্ধি আছে নাকি গেছে? এভাবে কেউ জড়িয়ে ধরে? আপনি আমাকে মে’রে ফেলার প্ল্যান করেছেন নাকি আগে সেটা বলুন।’
জেহফিলের কণ্ঠ নরম হয়, ‘তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরোনি ঠিকমতো, তাইতো..’
‘তাই বলে জড়িয়ে ধরে ভর্তা করতে হবে?’
জেহফিল মৃদু গলায় বলে, ‘ বেশি ব্যথা দিয়েছি? সরি সোনা, আর এমন হবে না। ভেবেছি তুমিও আমাকে আবার একা করে চলে যাবে।’
জেহফিল আকুতি ভরা কথা দেখে ইনান শান্ত হয়,
‘আপনি আমার হাজব্যান্ড জেহফিল, আপনাকে কেন একা রেখে যাব আমি?’
‘সরি।’
‘আর সরি বলা লাগবে না, ভবিষ্যতে এমন দম বন্ধ করে ধরবেন না।’
‘আচ্ছা।’
.
রাতের বেলা কারেন্ট চলে যায়। ইনান মোম জ্বালিয়ে জেহফিলের আর্ট রুমের দরজায় নক করে। জেহফিল দরজা খুললে ইনান ভেতরে ঢুকে। ইনান কখনো জেহফিলের পেইন্টিং রুমে আসেনি। মোমের আলোতে রুমটা ভালো করে ফুটেনি, তবে ইনান আন্দাজ করল এই রুমটা সবচেয়ে বড় রুম।
‘কিছু বলবে বাটারফ্লাই?’
ইনান জেহফিলের দিকে তাকায়। ডেকেছিল ডিনারের জন্য। জেহফিলের হাতে চিকন একটা তুলি।
‘ছবি আঁকছিলেন?’
জেহফিল মাথা উপর নিচ করে। রুমের একসাইডে দেয়ালের বদলে ফ্লোর থেকে সিলিং পর্যন্ত কাঁচ। তার ওপাশে খোলা বারান্দা। কতগুলো লম্বা লম্বা টেবিল খুব সুন্দর করে রুমে রাখা। প্রত্যেকটা টেবিলে আলাদা আলাদা জিনিসপত্র। একটায় মাটির ব্যাগ আর স্কাল্পচারের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি রাখা। আরেকটায় আর্ট করার রং তুলি। রুমের দেয়ালে জুড়ে তাক, আর সেগুলোতে বিভিন্ন ধরনের রং আলাদা করে সাজিয়ে রাখা। মোমবাতির আলোয় ইনান যতটুকু দেখছে তাতেই মুগ্ধ হচ্ছে। কী সুন্দর গুছিয়ে রাখা।
কাঁচের দেয়ালের সামনে একটা বড় ইজেল রাখা। ইনান সেদিকে এগিয়ে গেল। তাতে বড় একটা ক্যানভাস আটকানো। ক্যানভাসে আঁকা ছবিটা দেখে ইনানের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। ছবিটা তার! ছবিতে ইনান দুই হাতের উপর মাথা রেখে আবেদনময়ী নেত্রে চেয়ে আছে, তার লম্বা মসৃণ চুলগুলো পিঠময় ছড়িয়ে। পরনের জামাটা মনোমুগ্ধকর বেশি। বুক অবধি কতগুলো প্রজাপতি একত্রিত হয়ে ইনানের জামা হিসেবে তার শরীরে বসেছে, গলা এবং বুকের উপরিভাগ খালি। তার চুলেও কতগুলো প্রজাপতি, ঠোঁটের কোণে ছোট্ট একটা ডেইজি ফুল, আর সবগুলো প্রজাপতির রং পার্পল, পিংক আর রেড ভেলভেট কালারের। আশেপাশে উড়ছে অসংখ্য প্রজাপতি। কী নিখুঁত কাজ! চোখ জুড়ানো! এমনি এমনি তো আর জেহফিল ইন্টারন্যাশনালি পরিচিতি পায়নি!!
চিত্রের জামার নিচের অংশ এখনো কমপ্লিট হয়নি। সেটাই বোধহয় এতক্ষণ আঁকছিল জেহফিল, কারেন্ট চলে যাওয়ায় স্থগিত রেখেছে।
জেহফিল কখন ইনানের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে তা মুগ্ধ ইনান খেয়াল করেনি।
‘বাটারফ্লাই।’
ইনান ঘোর লাগা গলায় বলল, ‘আসলেই বাটারফ্লাই।’
জেহফিল হাসল, ইনানের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘পছন্দ হয়েছে?’
‘ভীষণ।’
আলতো করে ইনানের কানে ঠোঁট ছোঁয়াল জেহফিল, ‘কারেন্ট আসুক, সারপ্রাইজের পর্ব তো এখন মাত্র শুরু।’
ইনান জেহফিলের দিকে ফিরল, মোমের আলোয় তার চোখের তারা চিকচিক করছে, ‘আপনি আমার আরও ছবি এঁকেছেন?’
ইনানের হাতের উল্টো পিঠে চুমু দিলো জেহফিল, ‘কারেন্ট আসলেই দেখবে।’
জেহফিল টুলের উপর বসে ইনানকে নিজের কোলে বসাল। মোমবাতিটা ক্যানভাসের পাশে রাখল। রঙে তুলি ডুবিয়ে ইনানের হাতে দিলে ইনান দ্বিধাগ্রস্ত চোখে তাকায়।
জেহফিল চোখের ইশারায় ক্যানভাসে আঁকতে বলল।
ইনান মাথা নাড়ায়, ‘না না, আমি আঁকতে পারব না। এত সুন্দর চিত্রে আঁকলে এটা নষ্ট হয়ে যাবে।’
জেহফিল ইনানের মেদহীন পেটে হাত রাখে। হালকা চাপ দিয়ে ইনানকে নিজের দিকে টেনে আনে। মৃদু হাসল সে, ‘কিছুই হবে না, আমি শিখিয়ে দিচ্ছি।’
জেহফিল ইনানের হাত ধরে তুলিটা চিত্রের উপর রাখে। চিত্রে ইনানের বুকের উপর সবচেয়ে বড় প্রজাপতি আঁকার ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে। ইনান কাঁপা কাঁপা হাতে তুলি চেপে ধরেছে। তার ধারণা তার হাতের ছোঁয়া পেয়ে ছবিটা নষ্ট হয়ে যাবে।
জেহফিল ইনানের কানের কাছে এসে হালকা গলায় বলল,
‘কাঁপছো কেন? এখনো তো কিছুই করলাম না।’
‘হুম?’ জেহফিলের কথাটা বোঝার জন্য ইনান মাথা ঘুরিয়ে তাকায়।
জেহফিল ইনানের গালের সাথেই মিশে ছিল, যেই না ইনান মাথা ঘুরিয়ে তাকালো অমনি জেহফিলের ঠোঁটের সাথে তার ঠোঁটের মিলন ঘটল। সেই মুহুর্তে বারান্দা থেকে ধেয়ে আসা শীতল বাতাসে মোমবাতি নিভে গেল। সাদা পর্দা উড়তে লাগল নিরবচ্ছিন্নভাবে।
ইনান কেঁপে উঠল, হিমশীতল বাতাস নাকি জেহফিলের স্পর্শের কারণে বুঝতে পারল না।
ঝড়ো বাতাসে পর্দার সাথে লেগে মোমদানি পড়ে গেল। ইনান আবারও কেঁপে উঠল, জেহফিলের শুষ্ক নরম ঠোঁট থেকে আচমকা নিজেকে সরিয়ে নিলো। দ্রুততার সাথে মুখ সামনে ফিরিয়ে আনল। কান দিয়ে তার উষ্ণ ধোঁয়া বেরোচ্ছে। বুক এত জোরে ধুকপুক আওয়াজ করছে যে মনে হয় জেহফিলও শুনতে পাবে। ইনান দুই ঠোঁট চেপে চোখ বন্ধ করে নেয়।
জেহফিল ইনানের শরীরের উষ্ণতা টের পায়। আবারো ইনানের কানে কানে বলল, ‘সরি বাটারফ্লাই, আমারই ভু..’
জেহফিলের কথা কেটে যায় ইনানের আচমকা আক্রমণে। ইনান আবারও ঘুরে জেহফিলের ওষ্ঠাধর নিজ দখলে নিয়ে ন্যায়। ঘটনা এত দ্রুত ঘটেছে যে নিজের কাণ্ডে নিজেই প্রায় পড়েই যেতে নিচ্ছিল জেহফিলের কোল থেকে, জেহফিল ইনানের পেট ধরে নিজের সাথে ঠেকায়। ওষ্ঠাধরের লড়াইয়ে নেমে পড়ে ইনানের সাথেই। ততক্ষণে ইনানের হাত বিচরণ করছে জেহফিলের সৌষ্ঠব দেহে। ইনানের এত উন্মাদনা দেখে জেহফিল ওর দুইহাত ধরে থামায়। ইনানকে ছাড়িয়ে নিয়ে মুখের সামনে নিয়ে আসে। এক হাতে ইনানের থুতনি চেপে মাথা উঁচু করে। ইনানের ঠোঁট লাল হয়ে ফুলে কাঁপছে।
ইনান তখন দিশেহারা। দেহে আগুনের ঝড়। ইনানের চোখের আবেদন জেহফিলের নজর এড়ায় না। সে নিজেকে যে কত কষ্টে ইনানের থেকে দূরে থাকছে সেটা সেই জানে।
ইনান জেহফিলের শার্টের বোতামে হাত লাগায়। জেহফিল হাত ধরে ফেললে ইনান মরিয়া হয়ে তাকায়। জেহফিল ইনানের ফোলা ঠোঁটে এক আঙুল রেখে বলে,
‘তুমি শিওর বাটারফ্লাই?’
ইনান তখন নিজের মধ্যে নেই যেন। নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। যেন সে এইমাত্র নেশা করে এসেছে। তার মন কুঠুরীতে আবদ্ধ বস্তুটি ইনানকে তাড়া দিতে লাগল জেহফিলকে গভীর করে ছোঁয়ার।
ইনান মাথা উপর নিচ করে।
‘মুখে বলো।’ জেহফিল আদেশ করল।
ইনান ঢোক গিলে ধীরে ধীরে বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘জোরে বলো।’
ইনান চোখ শক্ত করে বন্ধ করল, ‘হ্যাঁ।’
জেহফিল ইনানকে কোলে তুলল। ইনানের দুই পা জেহফিলের কোমর জড়িয়ে ধরল। আর দুই হাতে জেহফিলের গলা। জেহফিল টেবিলের উপরে রাখা সমস্ত আর্টের সরঞ্জামগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে নিচে ফেলে পুরো টেবিলটা খালি করল। বাহিরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ভুবন কাঁপিয়ে বারিধারা ধরণীতে আছড়ে পড়ছে। ইনানকে টেবিলে বসিয়ে ইনানের পায়ের ফাঁকে দাঁড়ালো জেহফিল।
ইনানের ঠোঁটে স্লাইড করতে করতে বলল,
‘ভেবেচিন্তে বলো বাটারফ্লাই। তুমি কি আমাকে চাও?’
ইনান হ্যাঁ-বোধক মাথা নাড়ায়।
ইনানের ঠোঁট দুই আঙ্গুলে চেপে ধরে জেহফিল, ইনান হালকা ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে।
‘মুখে বলতে বলেছি না?’
‘হ্যাঁ, আ..আমি চাই।’
জেহফিল ইনানের সাদা জামাটা ঘাড় থেকে কিছুটা নামিয়ে গলা থেকে পিঠে ও পেটে আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে টিজ করে। ইনান প্রায় অতিষ্ঠ হয়ে প্রায় ভিক্ষা চাওয়ার মতো করে বলল,
‘প্লিজ জেহফিল।’
জেহফিলের অধরে হাসি ফুটে, বিড়বিড় করে বলল,
‘ইউ লুক সো হট হয়েন ইউ বেগ। অ্যান্ড দ্যাটস হোয়াট আই ওয়ান্টেড অল দিস ফাকিং টাইম।’
তারপর ইনানের চুল কানের পেছনে নিয়ে শেষবারের মতো বলল,
‘ভেবেচিন্তে বলছো?’
‘হ..হ্যাঁ।’ ইনান প্রায় ফিসফিস করে বলল।
ইনানের বলা শেষ হতে না হতেই জেহফিল ইনানের উপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, জেহফিলের ভারে ইনান টেবিলে ঝুঁকে পড়ে। জেহফিলের ঠোঁট অবাধ্যভাবে ইনানের গাল, গলা, ঘাড়ে বিচরণ করছে। একটু থেমে ইনানের চোখে চোখ রাখে সে। এক হাতে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ইনানকে নিজের করে নেওয়ার আগে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
‘আমার থেকে আর নিস্তার নেই তোমার বাটারফ্লাই। তুমি নিজেই এই পথ বেছে নিয়েছো।’
তারপর ইনানের গলায় ঠোঁট ছুঁইয়ে কামড় দিলো জেহফিল,
‘তোমাকে আর ছাড়ছি না। প্রতি রাতে আমাকে হ্যান্ডেল করার জন্য প্রস্তুত হও বেবিগার্ল।’
.
.
চলবে…
#রোদরঞ্জন
#পর্ব_১৭
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
[প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য]
[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.
গলায় শীতল কিছুর পরশে ইনানের কাঁচা ঘুম ভাঙে। চোখ পিটপিট করে দেখে তার একদম কাছে একজোড়া বুদ্ধিদীপ্ত চোখ জ্বলজ্বল করছে। চোখের মালিককে চিনতে সময় লাগে না ইনানের। ঘুম ছুটে তার মধ্যে এসে ধরা দেয় এক রাশ মুগ্ধতা। আয়াতাকৃতির নিখাদ নয়নের মাঝে ধূসর মণিজোড়া আবৃত বড় বড় পাপড়ি দ্বারা। বিচক্ষণ অথচ শান্ত চাহনিতে সেখ চোখজোড়া পরখ করছে ইনানকে। আনমনে ইনানের হাত চলে গেল জেহফিলের চোখের পাপড়িতে। মনে মনে বলল,
‘ছেলেদের কেন এত সুন্দর পাপড়ি হতে হয়?’
জেহফিল ইনানের নাকের ডগায় চুমু দিয়ে বলে,
‘শুভ সকাল আমার হৃদয়হরণী।’
জেহফিলকে খাঁটি বাংলায় শুভেচ্ছা জানাতে দেখে ইনানের হাসি পেল অনেক। পাওয়ার কথা অবশ্য, জেহফিলের দশটা কথার নয়টা-ই ইংরেজি। তাও হাসি পেটে রেখে মুচকি হেসে বলল,
‘শুভ সকাল সুদর্শন।’
‘উঠবে না? এভাবে শুয়ে থাকলে তো ঘাড় ব্যথা করবে।’
ইনানের নগ্ন পায়ে শীতল বাতাস লাগতেই তার হুশ ফিরে। ইনান এখন জেহফিলের আর্ট রুমের দুই সিটের কাউচে শুয়ে আছে, তার মাথা কাউচের হ্যান্ডেলে। মনে পড়ে যায় গত রাতের জেহফিলের পাগলামির কথা। যেই পাগলামি থেকে ইনান ছাড়া পায় মধ্য রাতে। তা মনে পড়তেই আরক্ত হয় তার গাল। দ্রিম দ্রিম শব্দে বাজতে থাকে হৃদয়।
ইনানের রক্তিম মুখপানে নিষ্পলক চেয়ে তাকে হঠাৎ কোলে উঠিয়ে ন্যায় জেহফিল। আচমকা কোলে উঠানোতে টাল সামলাতে জেহফিলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ইনান। তার পরনে জেহফিলের শার্ট ছাড়া আর কিছুই নেই, আর জেহফিলের উদোম গায়ে শুধু জগার প্যান্ট পরা। ইনানকে কোলে নিয়ে জেহফিল চলে আসে বারান্দায়। এই রুমের বারান্দাটা বড়। এক সাইডে ছাউনির নিচে সিঙ্গেল খাটের সমান ফোমের গদি বিছানো। জেহফিল সেখানে বসে ইনানকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিজের দুই পায়ের উপরে বসায়।
ইনানের ফর্সা উরু উন্মুক্ত। দুই পা শক্ত করে চেপে শার্টটাকে হাটুর নিচে নামানোর বৃথা চেষ্টা দেখে মিটিমিটি হাসছে জেহফিল। ইনানের লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে থাকা মুখে চেয়ে ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
‘এখনো এত লজ্জা কেন সোনা? লজ্জা ভাঙেনি?’
জেহফিলের ঠাট্টায় ইনানের লজ্জা শতগুণ বেড়ে যায়। ইচ্ছে করছে মাটি ফুঁড়ে গর্তে ঢুকে যেতে, তাতে যদি লজ্জা কমে। জেহফিলের বুকের সাথে মিশে ইনান নিজেকে লুকোনোর চেষ্টা করে।
তখনও সূর্য পুরোপুরিভাবে ধরণীতে ধরা দেয়নি। সুনশান নীরবতা বিরাজ করছে এই জঙ্গলে। যেখানে চোখ যায় সেখানেই সবুজ। চোখ শীতল হয়ে আসে। ঝনঝন আওয়াজে ইনান তার হাতের দিকে চায়। জেহফিল ইনানের হাতে কয়েকটা চুড়ি পরিয়ে দিয়েছে। চুড়ি গুলো ক্লে দিয়ে বানানো। মোটা চুড়িতে সবুজ লতার চারপাশে নীল রঙের ছোটো ছোটো প্রজাপতি উড়ছে আর চিকন চুড়ি গুলোতে ইংরেজি কার্সিভ লেটারের ‘বাটারফ্লাই’ লেখা। ইনানের চোখ ঝলমল করে উঠল খুশিতে।
‘চমৎকার।’ আপনাআপনি বের হয়ে আসল ইনানের মুখ থেকে।
ইনানের শার্টের নিচের কয়েকটা বোতাম উল্টোপাল্টা করে লাগানো থাকায় ইনানের সরু পা দুটো আরো অনাবৃত হয়ে গেল। জেহফিল নিজের সাথে যুদ্ধ করে ইনানের বোতামগুলো ঠিকভাবে লাগিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘যখন বানিয়েছিলাম তখন এগুলো দেখতে খুবই কুৎসিত লাগছিল। এখন তোমার হাতে প্রাণ পেয়েছে এরা।’
ইনান চোখে বিস্ময় খেলে গেল,
‘এগুলো আপনার বানানো?’
জেহফিল মাথা হালকা নাড়ায়।
‘আমি তো ভুলেই গেছি আপনি যে স্কাল্পচার আর্টিস্ট। এগুলো বানানো তো আপনার বা হাতের খেল।’
জেহফিল হাসে। পাশে থাকা ছোট্ট কুশন নিয়ে ইনানের পা ঢেকে দেয়। মাথা প্রায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল ইনানের লোভাতুর পা দেখে।
‘ইয়ারিংসগুলো আরো বেশি মানিয়েছে।’
ইনান এবার কানে হাত দিয়ে দেখে তার কানেও দুল পরা। দুলগুলো দেখার জন্য জেহফিলের কোল থেকে উঠে বারান্দার কাঁচের সামনে দাঁড়ায়। দুটো প্রজাপতি সারিবদ্ধভাবে উড়ছে, তাদের উপর নিচে মুক্তা পাথর। ইনান হা করে তাকিয়ে ছিল। প্রজাপতি দুটোও ক্লে দিয়ে বানানো। জেহফিলের এত গুণ কেন থাকতে হবে??
ইনানের শরীরে থাকা জেহফিলের সাদা শার্ট ভেদ করে ইনানের ধনুকের মতো বাঁকানো দেহের খাঁজ বুঝা যাচ্ছিল। জেহফিল শুষ্ক ঢোক গিলে চোখ ফিরানোর চেষ্টা করতেই তার চোখদুটো ফের ইনানের মেদহীন উদরে এসে পড়ে। তারপর মাতোয়ারা চোখ চলে যায় পেটের উপরে.. সুগঠিত উরোজে। জেহফিল আর না পেরে উঠে ইনানের পেছনে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ ডুবায়।
জেহফিল ইনানের সংবেদনশীল অঙ্গগুলোয় নিজের অস্তিত্ব বোঝাতে প্রগাঢ় স্পর্শে ছুঁয়ে দেয়। তার ঘনিষ্ঠ ডাক উপেক্ষা করতে পারেনি ইনান। তার শরীরে জেহফিলের অবাধ্য হাতের গভীর বিচরণ ইনানকে ভেতরের চিত্তকে অসাড় করে দিচ্ছে…অচল করে দিচ্ছে তার দেহের অস্থিমজ্জা।
দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে জেহফিলের বুকে সমস্ত ভার ছেড়ে দেয় সে। জেহফিল যেন এই আশাতেই ছিল। প্রগাঢ় বন্ধনে জড়িয়ে ইনানকে আলগোছে কোলে তুলে বারান্দার কোমল গদিতে ছুঁড়ে মারে। বারান্দায় সাদা নেটের পর্দা নামিয়ে জেহফিল চলে আসে তার প্রাণপ্রিয়ার দেহে ওঠা অশান্ত, অবাধ্য, তোলপাড় করা ঝড়কে থামাতে।
.
.
‘কী চাই?’ রুক্ষ কণ্ঠে বলে উঠে রুহি।
ফোনের ওপাশে পলক চোখ বুজে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলে, ‘তোমার ভাইকে দাও।’
‘কী দরকার?’ একই টোনে বলল রুহি। তার রক্ত টগবগ করছে। ব্রেকাপের পর নিজের প্রাক্তনের সাথে প্রথমবার কথা হলে মেয়েদের স্বর কঠিন নয়তো কোমল থাকে। কিন্তু এই মেয়ের কঠিনের থেকেও এক ধাপ উপরে। রিলেশন থাকতে যেমন কর্কশ গলা ছিল তার একটুও বদলায়নি এখনো।
পলক বিরক্তিকর শব্দ উচ্চারণ করল,
‘ইম্পর্টেন্ট কথা আছে, দাও আগে।’
‘যা বলার আমাকে বলো।’
পলক নিজেকে চেঁচিয়ে ওঠা থেকে থামাল। থেমে থেমে বলল, ‘ইনানের ফ্রেন্ড হিসেবে ওর থেকে একটা খবর নেবার আছে।’
রুহি ভ্রু কুঁচকায়, ‘ইনানের ফ্রেন্ড হিসেবে কী খবর নিবে?’
অধৈর্য হয়ে পলক হাতে থাকা বোতলটা আছড়ে মারল। কিছুর আওয়াজ শুনে রুহি বুঝল পলক রেগে আছে। কিন্তু রুহি থোরাই না কেয়ার করে! এখন আর সে পলকের প্রেমিকা নেই যে তার রাগের ধার ধারবে।
পলক চুলে হাত বুলাতে বুলাতে নিজেকে স্থির রেখে বলল, ‘ইনানের খোঁজ নেওয়ার জন্যই শরৎকে চাইছি।’
চোখ উল্টায় রুহি। অপরপ্রান্তে থাকা পলক রুহির অভিব্যক্তি বুঝেনি।
‘ইনানের খোঁজ শরৎ কীভাবে জানবে? আমার ভাই নিজেই ঠিকমতো উঠে বসতে পারছে না আবার সে রাখবে ইনানের খোঁজ?’
‘শরৎএর কাছে ইনানের অন্যান্য ফ্রেন্ডদের নাম্বার নিশ্চয়ই থাকবে? তাদের নাম্বার দিতে বলো।’
পলকের আদেশ শুনে রুহি দাঁত কটমট করে বলল, ‘পারব না। ইনান কি কোথাও হারিয়ে গেছে নাকি যে ওর খোঁজ জানা লাগবে? নিজের দরকার হলে নিজেই খুঁজে নাও।’
এই বলেই মুখের উপর ফোন কেটে দিলো রুহি। পলকের সাথে কথা বলে তার আজকের শুটিংয়ের মুডটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
.
.
ইনান প্ল্যান করেছে সে মাটির কাজ শিখবে। সিরামিকের প্লেট, কাপ, ফুলদানি, মগ ইত্যাদি বানিয়ে বিক্রি করবে। শহরে ইনানের নামে একটা শপ দিবে। যেখানে এসবের পাশাপাশি জুয়েলারির দোকানও দিবে। জেহফিল যেভাবে সুন্দর করে ক্লে দিয়ে তাকে জুয়েলারি বানিয়ে দিয়েছে সেভাবেই সে বানিয়ে বিক্রি করবে অনলাইনেও অফলাইনেও। এই ব্যবসার আইডিয়াটা তার মাথায় এসেছিল যখন দেখেছে জেহফিলের বাড়ির অধিকাংশ আসবাবপত্র তার নিজের হাতে বানানো। এমনকি তারা এতদিন যে কাপে, মগে, প্লেটে করে খেত ওগুলাও জেহফিল বানিয়েছে। রুমের প্রতিটি কোণায় কোণায় জেহফিলের হাতে তৈরি বড় বড় ফুলদানি। রুমের দেয়ালজুড়ে স্কাল্পচার আর্ট, পেইন্টিং। জেহফিলের ঘরের দেয়াল আর আসবাবপত্র ছাড়া যা যা আছে সবই জেহফিলের হাতে তৈরি। এসব দেখেই ইনান উৎসাহিত হয়ে চিন্তা করে সেও জেহফিলের থেকে এসব শিখবে।
জেহফিলকে এই ব্যবসায়ের আইডিয়া বলা মাত্রই সে নাকচ করেছে,
‘এসব ছোটখাটো ব্যবসা কেন করতে হবে তোমাকে? তুমি বরং সময় নিয়ে আমার মতো আর্ট, ভাস্কর্য এগুলো বানানো শিখো, দুজনের একই প্রফেশন থাকলে দু’জনেরই সুবিধা হবে।’
কিন্তু নাহ, ইনান জেহফিলের মতো বড় বড় কাজে হাত দিতে চায় না। জেহফিলের মতো কাজ আয়ত্ব করা তার পক্ষে সম্ভব না। করতে পারলেও এসব নিজ আয়ত্বে আনতে কয়েক বছর চলে যাবে। ইনান এসব করবে না। তারচেয়ে ভালো হবে ছোটোখাটো জিনিসপত্র বানাবে আর বিক্রি করবে। ইনান জেহফিলের কাছে বায়না ধরল তাকেও মাটির কাজ শিখিয়ে দিতে। জেহফিলও শর্ত দিলো, সে শিখাতে পারবে তবে এসব দোকান দিয়ে ব্যবসার চিন্তা বাদ দিতে হবে তাকে। ইনান রাজি হলো, আগে কাজ শিখুক তারপর ব্যবসা।
ইনান জেহফিলের আর্ট রুমে টুলের উপর বসে ঘুরে ঘুরে রুমটাকে দেখছে। দিনের আলোয় এই রুমটাকে কোনো ভিন্টেজ অ্যাস্থেটিক রুমের চেয়ে কম লাগছে না। দেয়ালে দেয়ালে পেইন্টিং টানানো, গ্রিক পুরাণের ফিনিক্স পাখির চার ফুটের একটা আর্ট দেয়ালের অর্ধেক জুড়ে। রুমের কোণায় একটা ড্রাগনের ভাস্কর্য। লম্বা একটা বুকশেল্ফ জুড়ে কতগুলো বই। ইনান বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখল সব আর্ট ও ভাস্কর্যের মোটা মোটা বই। বোঝা গেল জেহফিল তার পেইন্টিংয়ের পেছনে কত শ্রম ঢেলেছে। ইনান এসব কিছুতেই আয়ত্বে আনতে পারবে না। তার ঐ সাহস নেই।
রুমের আরেক দেয়ালে ভিনসেন্ট ভ্যান গগের বিখ্যাত স্ট্যারি নাইটের আর্ট করা। ইনান যত দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে। জেহফিলের প্রশংসা না করে পারছে না। রুমের মাঝের আর্ট টেবিলে একটা স্কাল্পচার আর্ট সযত্নে সাজানো। যেখানে একটা ভিন্টেজ ক্যানভাসে নারীমূর্তির থ্রিডি আর্ট। দেখে মনে হয় ক্যানভাস হতে নারীটা বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। এই আর্টটা মূলত জেহফিলের রাশিয়ার এক্সিবিশনের জন্য। ইনান বিমোহিত হয়ে চেয়ে রইলো।
জেহফিল ইনানকে গত বিশ মিনিট ধরে পর্যবেক্ষণ করছে। স্লিভলেস টপ আর ব্যাগি জিন্স পরনের ইনানকে প্রেমোচ্ছন্ন চাহনিতে একগ্রতার সাথে দেখছে। ইনান রুমের চিত্রশিল্পগুলো দেখার সময় তার ঠোঁট দিয়ে কিছু বিড়বিড় করছিল, যা দেখে জেহফিলের ইচ্ছে করছে এক্ষুনি ইনানকে টেনে তার ওষ্ঠাধরকে শাস্তি দিয়ে শাসন করতে- কেন জেহফিলকে এত টানছে!
ইনান অবশেষে আসল জেহফিলের নির্ধারিত জায়গায় যেখানে বসেই জেহফিল ছবি আঁকে। রুমের সেই কোণার দেয়ালটায় সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। কৌতুহল জাগলো ইনানের। জেহফিলের অনুমতি না নিয়েই কাপড়টা সরিয়ে দিলো, যা দেখল তাতে ইনানের চক্ষু ছানাবড়া। ইনানের পোর্ট্রেট আঁকা কতগুলো ক্যানভাস দেয়ালে ঝোলানো। কোনোটাতে সে হাসছে, কোনোটাতে পুকুরে ডুব দিয়ে উঠছে, আবার ফুলের মাঝে শুয়ে আছে, এরকম নানা ধরনের নান্দনিক, চোখ জুড়ানো ছবি আঁকা। এই ছবিগুলো জেহফিলের টেবিলের সামনেই অর্থাৎ জেহফিল যখনই আর্ট করতে বসে তার চোখ উপরে তুললেই ইনানের এসব ছবি দেখতে পাওয়া যায়।
‘সারপ্রাইজ কেমন লাগল?’
ইনান মুগ্ধতায় এতটাই ডুবে গেছে যে কোনো কথাই বলতে পারল না। তার কান্না চলে এলো প্রায়। প্রতিটা চিত্র নিখুঁত, যেন কেউ ক্যামেরায় ছবি তুলেছে। জেহফিল কতটা ভালোবেসে এই ছবিগুলো এঁকেছে! কতটা সময় নিয়ে ইনানকে এঁকেছে!
ইনানের এমন নিষ্পাপ বিমোহিত চাহনি আর বেশিক্ষণ দেখতে থাকলে জেহফিল আবার কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলবে। তাই ইনানকে নিজের দিকে ফিরাল।
‘দেখা শেষ হলে আমরা শুরু করি?’
জেহফিল ইনানকে পাশে নিয়ে বসল। ইনানের সামনে পটারি হুইল রেখে দুইহাতে ইনানের হাত ধরে মাটি বসিয়ে কাজ শুরু করল। প্রায় চারঘন্টা শেষে ইনান মাটি ঠিকভাবে দাঁড় করানো ছাড়া আর কিছুই শিখতে পারল না। এতে জেহফিল ইনানকে হতাশ না হতে বলল। প্রথম প্রথম এমন হবেই। ভুল হতে হতেই একসময় শিখে যাবে। যেহেতু এসব কাজ প্রতিদিন চর্চায় থাকতে হয় আর জেহফিলেরও সময় থাকবে না হাতে তাই ইনান নিজ থেকেই বলল জেহফিল যেই আর্ট অ্যান্ড স্কাল্পচার ইনস্টিটিউশনে ইন্সট্রাক্টর হিসেবে আছে সেখানে ইনানকে ভর্তি করিয়ে দিতে।
জেহফিল প্রথমে চুপ করে রইল। মাথায় বিভিন্ন জিনিস ঘুরপাক খেতে লাগল। তার ইচ্ছা নেই ইনানকে তার একাডেমিতে ভর্তি করানোর। জেহফিল সেখানে হাই ক্লাসের টিচার। অর্থাৎ যেসব স্টুডেন্টরা আর্ট আর নরমাল ভাস্কর্য বানানো ছাড়া প্রো লেভেলে আছে তাদের ইন্সট্রাকশন দেয় জেহফিল। অন্যান্য টিচার যারা প্রাইমারী লেভেলে আছে তারা নিউ স্টুডেন্টদের শেখায়, ইনানকেও সেসব টিচারদের কাছে শিখতে হবে, অর্থাৎ একই প্রতিষ্ঠানে ইনান জেহফিলের কাছে থেকেও দূরে থাকবে ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছে না সে।
কিন্তু ইনান এত জোরাজুরি শুরু করল, না খেয়ে ঘুমানো, জেহফিলের কাছে না আসার থ্রেট দেওয়া শুরু করলে বাধ্য হয়ে জেহফিল পরদিন বিকেলে ইনানকে নিয়ে যায় তার একাডেমিতে।
.
একাডেমিটা বিশাল, নরমাল কলেজের থেকেও বড় এবং গোলক ধাঁধানো। ইনান এর আগে কখনোই এখানে আসেনি। এই একাডেমিটাও শহরের শেষ মাথায়। আশেপাশে জঙ্গল, ভবনের ভেতরেও বড় বড় গাছপালা। তিনতলায় জেহফিলের অফিস, সেখানে গিয়ে ইনানকে এডমিট করে দিল সে। ইনান কী খুশি!! লেখাপড়া ছাড়াও হাতে কলমে এবার কিছু শিখবে যেটা সত্যিই তার কাজে লাগবে।
জেহফিল ইনানকে রুমে বসিয়ে চলে যায় ক্লাসে। ইনানকে কড়া করে বলে দিয়েছে আগামী পঁয়তাল্লিশ মিনিটে রুম থেকে কোথাও না বেরোতে। ইনানের সামনে কতগুলো বই আর খাবার রেখে গেছে যাতে ইনানের সময় কাটে।
ইনানের ভালো লাগছিল না এতক্ষণ ধরে বসে থাকতে। তাই জেহফিলের বারণ সত্ত্বেও সে চলে যায় ভবন ঘুরতে। এই একাডেমিতে বাতাস প্রচুর থাকলেও উপরে গাছপালার জন্য আলো নিতান্তই কম। একটা গাছ বিল্ডিংয়ের ভেতর দিয়ে উপরে উঠে গেছে, যেটা কাটা হয়নি। ইনান এসব মানুষের বিচক্ষণতা দেখে সন্তুষ্ট হয়। ছোটো ছোটো গাছগুলোও কী যত্নে বেষ্টনী দিয়ে রাখা হয়েছে। যেখানেই গাছ থাকুক তা না কেটে সেটার চারপাশে বসার জায়গা করে দেয়া হয়েছে। সেই বসার জায়গায় কেউ কেউ আঁকছে কেউ মাটি দিয়ে কাজ করছে। ইনান প্রসন্ন চোখে পুরো ভবন ঘুরল।
ইনান যখন বিভিন্ন ভবনের পাশ দিয়ে হাঁটছিল তখন একটা ভবনের সামনে এসে থামল। কতগুলো বড় বড় ছেলেমেয়ে মিলে আটফুটের মূর্তি বানাচ্ছে। মূর্তিতে কোনো এক গ্রিক দেবতা, যার পিঠের দুপাশ থেকে পাখির মতো বড় বড় ডানা সগর্বে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।
ইনান সেদিকে এগোতেই কিছুর সাথে জোরে ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে যায়। সামনে থাকা ব্যাক্তিটিও ইনানের সাথেই ইনানের উপর পড়ে যায়। ভারী কিছু ইনানের শরীরের উপর পড়ায় ইনানের মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে চাপা চিৎকার।
‘আ’ম সো সরি মিস।’ ইনানের উপরে থাকা ব্যক্তিটি বলে উঠে। ইনানের উপর থেকে উঠতে নিলে তার হাতে থাকা কাঁদামাটিতে পিছলে আবারও পড়ে যায় ইনানের উপর।
ইনান এক চোখ খুলে দেখে তার একদম মুখের কাছে একজোড়া কালো মনির চোখ। অস্বস্তি নিয়ে ইনানের দিকে চেয়ে আছে।
ছেলেটা তাড়াতাড়ি উঠে ইনানের দিকে হাত বাড়াল। হাত না ধরেই ইনান উঠে বসে। এতে ছেলেটি অপমানিত হবে কিনা ভাবে না সে। তার এখন চিন্তা তার জামায়, গালে, গলায় লেগে থাকা কাঁদা নিয়ে। ছেলেটা হাত ধীরে ফিরিয়ে নেয়। সে এইমাত্র মাটির বস্তা কোলে নিয়ে আসছিল। আর এই সময়ই সামনে কারো সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে সবগুলো মাটি তাদের উপর পড়ে যায়।
ইনান উঠে নিজের দিকে তাকাতেই চোখে জল জমে যায়। দেখে মনে হচ্ছে সে কাঁদায় গোসল করে এসেছে। এই অবস্থায় এভাবে থাকা কতটা লজ্জার!
‘আমি সত্যিই দুঃখিত মিস। খেয়াল করিনি আপনি যে সামনে।’
ইনান ছেলেটার দিকে তাকায়। ছেলেটার শার্ট প্যান্ট মাটিতে ভরে গেছে, সেটা নিয়ে সে চিন্তা না করে বরং ইনানকে সরি বলছে! ইনান তো কারো সামনে কাঁদতে পারবে না তাই হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘আমিও দুঃখিত। আমিই রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে ছিলাম।’
ছেলেটি মাথা নাড়িয়ে মাটি তুলতে লাগে বস্তাতে। ইনান ফিরে যেতে পা বাড়াতেই থমকে পড়ে। সে কোথা থেকে এসেছে ঠাহর করতে পারল না। সবগুলো রাস্তা আর ভবনগুলো একই রকম।
সে পাশে থাকা ছেলেটির দিকে তাকায়।
‘এক্সকিউজ মি।’
ছেলেটি মাথা তুলে চায়। তার উজ্জ্বল চেহারার অর্ধেক ঢেকে গেছে মাটিতে, কপালে পড়ে থাকা কালো সিল্কি চুলগুলোতে মাটি লেগে মিশে আছে। ইনান ছেলেটির বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করে। দেখে মনে হয় জেহফিলের সমানই হবে। তাই বলল,
‘ভাইয়া, হেড অফিসটা কোন ভবনে?’
ছেলেটা মাথা উপরে তুলে, ‘নিউ স্টুডেন্ট?’
ইনান মাথা নাড়ায়।
‘কোন গ্রেড?’
ইনান অপ্রস্তুত হয়। ছেলেটা কীসের গ্রেড বলছে বুঝতে পারছে না। তাই মিনমিন করে বলে,
‘আমি আজকেই নতুন ভর্তি হয়েছি। মাটির কাজ শেখার জন্য।’
ছেলেটা বুঝে যায়। সে মাটির বস্তা রেখে উঠে দাঁড়ায়।
‘চলুন দিয়ে আসি।’
‘না না, আপনি শুধু বলুন কোথায় হেড অফিস আমি যেতে পারব।’
ছেলেটি ইনানকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে,
‘এর আগে কখনো এখানে এসেছেন?’
ইনান দুদিকে মাথা নাড়ায়।
‘তাহলে আপনি অফিসও খুঁজে পাবেন না। আমি গত এক বছর এখানে পড়েও সবগুলো অফিস ঠিক মতো চিনে উঠতে পারিনি, আর আপনি তো নিউ! আপনাকে এখন হাত ধরে ধরে শিখালেও আপনি কোনো ক্লাসই চিনবেন না।’
ছেলেটির কণ্ঠে ইনানের প্রতি মশকরার আভাস পায় ইনান। তাই সে রেগেও যায় সহসা।
‘আপনি বললে বলবেন না বললে নেই। এত কথা বলতে বলেছে কে?’
‘ওকে, বললাম না।’ শ্রাগ করে নিজের কাজে মন দেয় ছেলেটি।
এতক্ষণ ধরে ভাস্কর্য বানানো ছেলেমেয়েদের থেকে ইনান সাহায্য চেয়ে নিবে ভাবে। কিন্তু একি! কারো টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। ইনান আশেপাশে তাকিয়ে অন্য কোনো মানুষকেও দেখতে পেল না। এদিকে জেহফিল এসে যদি দেখে সে নেই তখন আবার বকাঝকা শুরু করবে। বাধ্য হয়ে ইনান ছেলেটির কাছেই হেল্প চায়।
‘আচ্ছা, আসুন, আমাকে নিয়ে যান অফিসে।’
ইনান ভেবেছে ছেলেটি হয়তো আরো ঠাট্টা করবে ইনানকে নিয়ে অথবা কিছু বলবে, কিন্তু তা না করেই ছেলেটি কাজ ফেলে আগে আগে এগিয়ে চলে, ইনানও পিছু পিছু যায়।
যাওয়ার পথে একটা কথাও বলল না ছেলেটি কিংবা ইনান। এই পর্যন্ত যতগুলো ক্লাসের সামনে দিয়ে গিয়েছে সব স্টুডেন্টরা অবাক চোখে তাদের দিকে ঘুরে ঘুরে দেখছে যেন তারা এলিয়েন।
‘ওয়াশরুমটা কোন দিকে?’ ইতস্ততবোধ করে বলল ইনান।
ছেলেটি কোনো কথা না বলে লেডিস ওয়াশরুমে নিয়ে যায় তাকে। চুল, গলা আর গাল থেকে মাটি সরালেও জামা ঠিকমতো পরিষ্কার করতে পারেনি সে। ওয়াশরুম থেকে বেরোলে ছেলেটি হঠাৎ তার সামনে হাত বাড়িয়ে ধরে। দেখল রুমাল হাতে তার। সঙ্কোচ নিয়ে ইনান রুমালটা নিয়ে পানি মুছে নেয়।
‘থ্যাংকস।’
‘ওয়েলকাম।’ ইনানের দিকে না ফিরেই বলল সে।
হেড অফিস থেকে একটু দূরেই ছেলেটি থামে। হাত দিয়ে ইশারা দিয়ে বলল,
‘ঐ যে অফিস। এটুকু আর হাত ধরে এগিয়ে দেয়া লাগবে না নিশ্চয়ই?’
ইনান আড়চোখে চায়। ছেলেটির হাসছে সাথে চোখও হাসছে। ইনান ভেঙচি কেটে কিছু না বলেই অফিসের সামনে এগিয়ে যায়।
‘ধন্যবাদ?’ পিছন থেকে বলে উঠে ছেলেটি।
ইনান পিছু তাকায়। চোখে তার প্রশ্ন।
‘কী?’
‘ধন্যবাদ কোথায়?’
‘ধন্যবাদ।’
ছেলেটি কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে মাথা নোয়ায়। হেসে বলল,
‘স্বাগতম।’
এই বলে সে চলে যায়। ছেলেটিকে ইনানের ভালো না লাগলেও যে ব্যাপারটি ইনানের না চাইতেও ভালো লাগল তা হলো ছেলেটির হাসি। হাসলে চোখ হাসে এবং ডান গালে টোল পড়ে।
ইনান যেই না ফিরবে অমনি কেউ শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ইনানকে। ইনান অনুভব করছে তাকে জড়িয়ে ধরা মানুষটির বুকের হৃদস্পন্দনের অস্বাভাবিক দ্রুত গতি। ইনান কিছু বলবে তার আগেই জেহফিল ইনানের গালে চোখে ঠোঁটে মুখে চুমু দিয়ে আবারো জড়িয়ে ধরে,
অস্থির চিত্তে বলে,
‘কোথায় ছিলে? তোমাকে বলেছি না রুমে বসে থাকতে? বের হতে বারণ করেছিলাম না? তাও কেন আমার কথা শুনলে না? এত অবাধ্য কেন তুমি।’
জেহফিল একাধারে বলে যেতেই লাগল। ইনান জেহফিলকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বলল,
‘ভালো লাগছিল না তাই হাঁটতে বের হয়েছিলাম। এমন করছেন যেন আমি হারিয়ে গেছি।’
জেহফিল ইনানের মুখ দুহাতে ধরল, শক্ত করে। ক্রোধ এবং কষ্ট মিশ্রিত গলায় বলল,
‘আমার ভয় হয় তুমি যদি আমার থেকে হারিয়ে যাও! যদি হারিয়ে যেতে চাও! ইচ্ছে করে..ইচ্ছে করে তোমাকে বেঁধে রাখি যাতে আমার থেকে দূরে যেতে না পারো।’
.
.
চলবে…