#রোদরঞ্জন
#পর্ব_২২
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
[প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য]
[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.
জ্ঞান ফিরে ইনানের। মাথা প্রচণ্ড ভারী হয়ে আছে। দু হাতে মাথা চেপে ধরে উঠার চেষ্টা করে, ব্যর্থ হয়। শরীর গরম হয়ে আছে। মাথার ভেতরটা ফাঁকা, ঠাণ্ডা। চাদর গায়ে আরো টেনে দিতেই অনুভব করে সিল্ক চাদরটা মসৃণভাবে তার গায়ে পিছলে যাচ্ছে। আধবোজা চোখ ঝট করে বড় বড় হয়ে যায়। নিজের ভাবনা সঠিক কিনা তা প্রমাণ করতে চাদর উল্টিয়ে নিজ চোখে দেখে আসলেই সে নগ্ন। এক সুতোও তার শরীরে নেই।
জেহফিল তখন রুমে প্রবেশ খাবারের ট্রে হাতে।
‘গুড মর্নিং প্রিন্সেস।’ আদুরে গলা জেহফিলের।
জেহফিলকে দেখা মাত্রই ইনানের মনে পড়ে যায় ভোরের কথা। আতঙ্ক ঘিরে ধরে তাকে। উষ্ণ শরীর মুহুর্তেই হিম হয়ে যায়। চাদরের নিচেই ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে। জেহফিলের চুল ভেজা, কপালে খুব সুন্দরভাবে একই শেপে পড়ে আছে। তার ঠোঁটে মৃদু হাসি। হাসিটা মিথ্যে। ইনান জানে।
বেড সাইড টেবিলে আওয়াজ করে ট্রেটা রাখে সে। সেই আওয়াজে কেঁপে উঠে ইনান, জেহফিল লক্ষ্য করেছে ইনানের কাঁপুনি। হাসি চওড়া করে ইনানের মাথার কাছে বসল। ইনানের কাঁধ আর কোমর উঠে বসালো। ইনান চাদর শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরল। জেহফিলের হাত এত ঠাণ্ডা যেন মরা মানুষের হাত! ইনান এক হাতে জেহফিলের বরফ শীতল হাত সরিয়ে দেয়। জেহফিলের হাসি থেমে যায়। চেহারায় ভর করে গম্ভীরতা। সেই গাম্ভীর্যও প্রতিস্থাপিত হয় ফের মৃদু হাসিতে ইনানের ভয়াতুর মুখ দেখে। ইনানের নরম গাল টেনে চিমটি কাটে,
‘ইউ আর সো কিউট।’
ইনান ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকে। অন্য সময় হলে সে লজ্জা পেত, হাসত, জেহফিলের বুকে গড়িয়ে পড়ত। কিন্তু এখন সময়টা ভিন্ন। ভিন্ন তার সামনের মানুষটা।
‘আমার ছোঁয়া ভালো লাগে না?’
খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল জেহফিল। কিন্তু ইনান ঠিকই ধরতে পারল জেহফিলের কথার আড়ালে থাকা অদৃশ্য আক্রোশ। শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে নিজেকে নরমাল রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করল ইনান। জেহফিলের সাথে খোলাখুলি কথা বলতে হবে। তার আগে জেহফিলের মুড ভালো রাখতে হবে। ইনান চাদর ভালো করে জড়িয়ে বলল,
‘আপনার হাত অনেক ঠাণ্ডা, শীত লাগছিল অনেক।’
জেহফিল ইনানের চোখে চোখ রেখে প্রায় অনেকক্ষণ চেয়ে ছিল। তারপর খাবার নিয়ে ইনানকে খাইয়ে দিতে লাগল,
‘ভোরে জ্বর এসেছিল, আই থিংক এখন কমে গেছে।’
এরপর নিরবতা। খাওয়ানোর পুরোটা সময় জেহফিল একটা কথাও বলল না। কেমন ভাবলেশহীন মুখে ইনানকে খাইয়ে দিলো। বাতাসে অস্বস্তি টের পেয়ে ইনানও চুপচাপ খেতে লাগল।
খাইয়ে দিয়ে জেহফিল রুমের বাইরে চলে গেল। এই ফাঁকে জামা কাপড় পরে নিলো ইনান। শরীরে জ্বর ভাবটা নেই এখন আর, শুধু মাথাটা ব্যথা করছে।
টেবিলের উপরই তার মোবাইল দেখতে পায়। জেহফিল তাহলে তাকে মোবাইল দিয়ে দিয়েছে! ফোন হাতে নিলো বাবার সাথে কথা বলার জন্য। সাথে সাথেই জেহফিলের আগমন। ভ্রু বিকৃত করে শাসনের সুরে বলল,
‘জামা পরেছ কেন?’
ইনান হতভম্ব। এ কেমন কথা? সে জামা পরবে না তো কি সারাদিন চাদর জড়িয়ে থাকবে?
‘জবাব দাও!’ জেহফিলের গলার আওয়াজ বাড়ল।
ইনান বুঝল না আসলে কী বলা উচিত! জেহফিলের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে জামা পরে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছে ইনান।
‘স্ট্রিপ!’ জেহফিলের কড়া আদেশ।
ইনান চমকিত হয়। এমন না যে সে তার স্বামীর সামনে উন্মুক্ত হতে লজ্জা পাচ্ছে, তার শরীরে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে জেহফিল স্পর্শ করেনি। কিন্তু ইনান চিন্তিত জেহফিলের মনে কী চলছে তা নিয়ে।
‘বাটারফ্লাই!! তোমাকে এক কথা কেন দ্বিতীয়বার বলা লাগে?’ জেহফিল রক্তিম চোখে তাকায়। রক্ত টগবগ করে ফুটছে তার শরীরের প্রতিটা অঙ্গে।
ইনান দুর্বলচিত্তে জেহফিলের দিকে তাকায়। এমনিতেই মাথা ঘুরছে তার উপর জেহফিলের চেঁচামেচি!
‘প্লিজ স্টপ!’ ইনান ফ্যাকাশে কণ্ঠে বলল।
‘তুমি খুলবে না তাই তো?’ জেহফিলের অস্বাভাবিক শান্ত গলা।
ইনান দুইপাশে মাথা নাড়ায়। তার আসলেই শরীর ভালো লাগছে না। জেহফিল কি তার উপর অধিকার খাটানোর জন্য এমন করছে?
‘জেহফিল, প্লিজ, আজকে না।’
ইনানের কথার মনে বুঝতে জেহফিলের সময় লাগল না। দ্রুত পায়ে ইনানের কাছে আসে।
‘ওয়েট, তুমি ‘আজকে না’ দিয়ে কী বুঝালে? তুমি ভেবেছ আমি তোমাকে আদর করব?’
ইনানের কান গরম হয়ে যায় জেহফিলের লাগামহীন কথায়। সেই সাথে বিভ্রান্তি নিয়ে জেহফিলের দিকে তাকায়। কাছে না আসলে তাকে জামা কাপড় খুলতে বলেছে কেন?
জেহফিল কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় ইনানের দিকে। যেন ইনানের এই নিচু ভাবনা সে মেনে নিতে পারছে না। তখন নজর যায় ইনানের হাতে। ফোন দেখে বলে,
‘কাকে কল করছিলে?’
‘বাবাকে।’ সরল স্বীকারোক্তি ইনানের।
এক টানে মোবাইল নিয়ে যায় জেহফিল। ইনান আশাহত গলায় বলল,
‘আপনি বলেছিলেন মোবাইল দিয়ে দিবেন আমাকে।’
‘দিবো, তার আগে আমি যা বলেছি তা করো। স্ট্রিপ, রাইট নাও!’ থেমে থেমে বলল জেহফিল।
‘আপনি…’ এটুকু বলতে গিয়েই কণ্ঠ জড়িয়ে এলো ইনানের।
জেহফিলের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। লেডিস শার্টের বোতামে হাত দিতেই জেহফিল থামায়। ইনানকে কোলে তুলে নেয় আচমকা। তারপর নিয়ে যায় তার আর্ট রুমে। চেয়ারের উপর বসিয়ে দিয়ে ইনানকে শুরু করতে বলল।
জামা কাপড় খুলে ফেলল। আলোকিত রুমে এভাবে উন্মুক্ত হওয়ায় ইনান লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলল। ভেবেছিল জেহফিলের সামনে লজ্জা পাবে না, অথচ তার দ্বিগুণ লজ্জা পেয়ে উষ্ণ ধোয়া কান থেকে বেরোতে লাগল। যেখানে জেহফিল পোশাকে আচ্ছাদিত সেখানে তার সামনে এভাবে নগ্ন হয়ে বসাটা সবচেয়ে লজ্জাজনক ইনানের কাছে। সে জড়সড়ো হয়ে বসে রইল চেয়ারের উপর।
‘সো ড্যাম পারফেক্ট বেবিগার্ল।’ জেহফিলের আবেশিত কণ্ঠ শুনে ইনান চোখ খুলে।
দেখে জেহফিল ক্যানভাস সামনে নিয়ে তার চারহাত দূরত্বে বসে আছে। জেহফিল এখন ছবি আঁকবে তার? ভাবনা মাথায় আসতেই হাত আড়াআড়ি ভাবে বুকের কাছে নিয়ে গেল।
‘হাত সরাও।’ জেহফিল রং প্যালেটে নিয়ে বলল, ‘দ্বিতীয়বার এক কথা বলব না।’
ইনান কাঁপতে কাঁপতে হাত সরিয়ে ফেলে। জেহফিল উঠে গিয়ে সবগুলো পর্দা টেনে দেয়। ঘোর অন্ধকার রুম। ইনানের কাছে এসে তিনটে মোম জ্বালিয়ে সোজা করে ইনানের পাশের টেবিলে রাখে। ইনানের চুল গুলো গলার কাছে সুন্দরভাবে ভাঁজ করে রাখল। হলদেটে আলোয় ইনানের ধনুকের মতো বাঁকানো নিখুঁত নিখাদ দেহের দিকে মোহাবিষ্টের ন্যায় চেয়ে থাকে সে। তার বাটারফ্লাই যেন সদ্য প্রস্ফুটিত হওয়া স্নিগ্ধ গোলাপ, না না গোলাপের চেয়েও স্নিগ্ধ!
ঝুঁকে এসে ইনানের কপালে চুমু খায়। ইনানের হাত দুটো নিয়ে নিজের শার্টের বোতামের উপর রাখে। ইশারা করে ইনানকে। ইনান মাথা নিচু করে জেহফিলের শার্টের বোতাম খুলতে নিলে জেহফিল তর্জনী দিয়ে ইনানের চিবুক ধরে উপরে তুলে। ডিপ ভয়েসে আদেশ দেয় ইনানকে,
‘আইজ অন মি বেবিগার্ল।’
জেহফিলের চোখে চোখ রেখে ইনান একটা একটা করে বোতাম খুলতে লাগে, তার হাত তিরতির করে কাঁপছে। জেহফিলের প্রতি ভালোবাসার যেই অনুভূতি এতদিন জেহফিলের আচরণের কারণে সুপ্তাবস্থায় ছিল, সেই অনুভূতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে আবার। জেহফিলের চোখে হারিয়ে যেতে মন চাইছে, ঐ নির্দয়, তমসাচ্ছন্ন, আবেগহীন ধূসর চোখে..
বোতাম খোলা শেষে জেহফিল শার্ট ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ইনানের কানের লতিতে কামড় দিয়ে ফিসফিস করে বলে,
‘আ’ম অলসো হাফ নেকেড। এবার আর লজ্জা পাবে না।’
ইনান ঘোর লাগা জেহফিলের সৌষ্ঠব দেহ উপর থেকে নিচ অবধি খুঁটে খুঁটে দেখে। জেহফিলের শ্যামবরণ শরীর, এ যেন নিখুঁত আর্ট। তার আঁকা আর্টের মতোই যেন জেহফিল নিজের দেহটাকেও আর্টে রূপান্তর করেছে, এত চমৎকার! মোমের আলোয় জেহফিলের পেটানো শরীর মাদকের মতো টানছে। তার হাত আপনাআপনি চলে যায় জেহফিলের বুকে। জেহফিল ইনানের দৃষ্টি পরখ করে এগিয়ে এসে ইনানের বক্ষ ভাঁজে গভীর চুমু দিয়ে সরে আসে, বসে পড়ে ক্যানভাসের সামনে।
শুরু করে তার প্রিয়তমাকে রঙ তুলির আঁচড়ে জীবন্ত করার কাজ। আঁকার নিমিত্তে জেহফিল যতবার ইনানের সুগঠিত উরোজে দৃষ্টিপাত করে ততবার ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে ইনানের তনু দেহ। রাঙা হয় তার গাল। চোখে আকাঙ্ক্ষা। ঠোঁটে ফুটে অদৃশ্য লাজুক হাসি, যেটা জেহফিল ছাড়া আর কেউই দেখে না, স্বয়ং ইনানও না।
ইনানের চোখের ভাষা দেখে জেহফিল বাঁকা হাসে। তার সেনোরিটা ঠিক তার স্কাল্পচার বানানোর মাটির মতো, সে যেমনটা চাইবে, যেই ছাঁচে ফেলবে, ঠিক সেই রূপ ধারণ করবে ইনান…করতে বাধ্য…
.
.
চলবে…
#রোদরঞ্জন
#পর্ব_২২ [অতিরিক্ত]
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.
________
আমি একজন এতিম। বুঝ হবার পর এই শব্দটার সাথেই বেশিরভাগ পরিচিত হয়েছি। শুধু আমি না, এই আশ্রমের নব্বই ভাগ ছেলেমেয়েই এতিম। তাদের বাবা-মা ছাড়াও অন্যান্য কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। বাকি দশভাগের কারো মা নেই, বাবা নতুন জীবনের আশায় সন্তানকে দিয়ে গেছে, কিংবা তাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় আছে, মাঝে মাঝে এসে দেখে যায়।
আমার নাম ছিল না। এতিমের স্যার-আঙ্কেলরা নাম দিয়েছিল, কী নাম দিয়েছিল আমার খেয়াল নেই। না থাকারই কথা। কেননা তারা যদি আমাকে ঐ নামে ডাকত আমি কোনোদিন সাড়া দেইনি। ‘এই ছেলে’ বলে ডাকলেই আমি সাড়া দিতাম। ফলস্বরূপ আমার ডাক নাম ছিল ‘এই ছেলে’
দীর্ঘশ্বাস….
আমার মা নেই বাবা নেই, তারা কোথায় আমি জানি না। কোনদিন জানতেও চাইনি। এই নিয়ে আশ্রমের হেড আঙ্কেল আমাকে একবার ডেকেছিল। তখন বয়সটা পনেরো বছর (নট শিওর)। আঙ্কেলের ভাষ্যমতে আমি একজন অদ্ভুত। তার মতে আর পাঁচটা ছেলের মতো নই। হওয়ার কথাও না। ম্যাচিওরিটি শব্দটা জানার আগেই এর গুণ আমার মধ্যে প্রবেশ করেছিল। নিজেকে অতিরঞ্জিত করছি না, যা সত্যি তাই বলছি, নিজ সম্পর্কে বাজনা বাজানো আমার ধাতে নেই।
আমি কখনো খেলাধুলা করিনি, আমার বয়সী ছেলে মেয়েরা কত খেলা খেলে, কিন্তু আমার ভাল্লাগতো না। কারণ এসব ছেলেমেয়েরা আমার সমান হলেও তাদেরকে হাঁটুর বয়সী মনে হতো। বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা, হাসি ঠাট্টা করা খুবই বিরক্তিকর এবং অসহ্যকর একটা কাজ। ওরা যে এসব খেলাধুলায় কী আনন্দ খুঁজে পায় আমি জানি না। জানতেও চাই না। ওদের জীবন, ওরা যা ইচ্ছে করুক।
আমার ভাল্লাগতো বই পড়া, না, ফিকশনাল না, নন- ফিকশনাল বই। যেসব বই পড়ে আমি কিছু জানতে পারব, শিখতে পারব সেসব বইয়ে আমার ঝোঁক ছিল বেশি। হিউম্যান সাইকোলজি নিয়ে বই ছিল আমার প্রিয় জনরা। যেখানে অন্যরা মাঠে হৈ হুল্লোড় করত সেখানে আমি লাইব্রেরীর এক কোণায় বই নিয়ে বসে পড়তাম।
ছেলেমেয়েরা আমাকে ভয় পেত। কারণটাও আমি জানি। আমি বড়দের মতো মুখ গম্ভীর করে রাখতাম। কথা বলতাম গুণে গুণে। প্রয়োজন ছাড়া কারো কথার উত্তর দিতাম না।
যা বলছিলাম, আঙ্কেল আমাকে ডেকে নিলো একদিন। তিনি অবাক হয়েছিলেন আমি এপর্যন্ত কেন আমার ফ্যামিলিকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন করিনি। তিনি আরও অবাক হলেন যখন আমি উত্তর দিলাম এসব জানার আগ্রহ আমার নেই। আরেকটা কথা বলে নেই, তিনি কিন্তু আমাকে ব্রিটিশ বলে ডাকতেন। কেন ডাকতেন পরে বলছি।
স্বভাবেও আমার আলাদা বৈশিষ্ট্য আমার ছেলেবেলা থেকেই তিনি খেয়ালে রেখেছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, আমাকে তিনি পেয়েছিলেনও আলাদা ভাবে। অন্য বাচ্চাদের পেয়েছিল রাস্তায়, নয়তো ডাস্টবিন। আমাকে পেয়েছিলেন জঙ্গলে। একদম গভীর জঙ্গলে। যেই জঙ্গলে মানুষের যাওয়া আসার সম্ভাবনা এক পার্সেন্ট। তিনি নাকি একদিন ধাওয়া খেয়েছিলেন কোনো এক কারণে। লোকের ধাওয়া খেয়ে গভীর জঙ্গলের মাঝে দৌড়াতে লাগলেন। ওনার মতে লোকের দৌড়ানি খাওয়াটা ওনার ভাগ্যে লিখা ছিল, তাইতো তিনি বট গাছের নিচে ময়লা তোয়ালে জড়ানো আমাকে পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি বলেন, আমাকে যখন দেখেন আমি নাকি কান্নাও করিনি, হাসিওনি। একদম চুপচাপ চেয়েছিলাম ওনার দিকে। আমার শ্যামলা গায়ের রঙও নাকি জঙ্গলের গাঢ় সবুজ পাতার থেকেও উজ্জ্বল লাগছিল বিধায় আমাকে তার নজরে পড়ে। আসলে কি তা বিশ্বাসযোগ্য?? উনি নিজেকেই প্রশ্ন করেন। আবার নিজেই উত্তর দেন, বিধাতার ইচ্ছে ছিল আমাকে বাঁচানোর। আমার ধূসর চোখ, শ্যামলা গায়ের রঙেও আমাকে নাকি বাঙালির মতো লাগছিল না। আমার শারীরিক পরিবর্তন নাকি হলিউড মুভিতে অ্যাক্টিং করা টিনেজ ছেলেদের মতো ছিল। তাই তিনি আমাকে ব্রিটিশ বলে ডাকতেন।
জেহফিল নামের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত করে বলি। বই পড়তে পড়তেই এই নামটা মাথায় গেঁথে যায়। নিজের নতুন নাম দেই জেহফিল এহসান। যদিও এই নামে কেউই আমাকে চিনত না, জানাই-ই তো না কাউকে, চিনবে কীভাবে? আমি শুধু হেড অফিসে গিয়ে বললাম আমি নাম চেঞ্জ করব। আঙ্কেল বিনা বাক্যে আমার কথা মেনে নেন।
আমার আর্টের প্রতি আগে কিন্তু ঝোঁক ছিল না। আমাদের সবাইকে প্যাস্টেল, পেন্সিল রং দিতো আঁকাআঁকি করার জন্য। সবাই আঁকত, ফুল, ফল পাখি কত কিছু। কিন্তু আমার খাতা সাদা থাকত। কী আঁকতাম? ফুল আমার পছন্দ না। প্রিয় ফুল বলে কিছুই নেই আমার। যেটা মনে ধরে না সেটা আঁকব কীভাবে? কোনোকিছুই আঁকার মনমানসিকতা থাকত না। তাও সাদা খাতাকে ভরাট করার জন্য রঙ নিয়ে সরলরেখা আঁকতাম। সবাই হাসাহাসি করত কীসব রেখা টেখা এঁকেছি বলে। আমি পাত্তা দিতাম না। দিয়ে লাভ আছে? তারা আমার জীবনে কোনো ভূমিকা রেখেছিল? রেখেছে? না রাখবে? যে তাদের পাত্তা দিব?
আমি নির্বিকার থাকতাম।
আমার অন্ধকার ভালো লাগে, শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ পছন্দ আমার। তাই এতিমখানায় শত শত বাচ্চাদের মাঝে থেকে আমি হাঁপিয়ে যাচ্ছিলাম। মন টিকতো না। আশেপাশে এত মানুষ থেকেও আমি সম্পূর্ণ একা ছিলাম। বোধহয় সেই সময়টাতে প্রিয় মানুষদের [বাবা-মা] সাহচর্যের তাগিদ অনুভব করতাম। শান্ত মন ছটফটে হতো। একটু আদর-যত্ন পাবার আশায়। কেয়ারটেকাররা সবাই-ই যত্ন করত। কিন্তু এসব তো মিথ্যে, তারা বেতনের জন্য যত্নের নাটক করত। আমি তো চাইতাম বিনিময় ছাড়া যত্ন। যেই যত্ন আসবে মন থেকে। এই যত্নের জন্য ছটফটে হলাম একটা ঘটনা দেখার পর।
আশ্রমের এক ছেলের বাবা এসেছিল একদিন। হাতে কত রকমের গিফট। সাথে আরেক মহিলাও এসেছিল। জানি না কে। তবে তারা দুইজন ছেলেটাকে কাছে পেয়ে কপালে, গালে চুমু দেয়, মাথায় হাত বুলায়, গাল টেনে দেয়।
আমি জানালায় দাঁড়িয়ে সবটা দেখেছি। ঐ বাবার চোখে কিন্তু মিথ্যে অভিনয় ছিল না। মহিলাটার আপাদমস্তক মিথ্যায় ঢাকা থাকলেও বাবার ভালোবাসাটা পবিত্র এবং সত্যি ছিল। আমি অনুভব করতে পেরেছি, ঠিক সেই সময়ই আমার কঠিন সত্ত্বা, গম্ভীর মন, খাঁচায় বন্দী পাখির মতো ছটফট করতে থাকে। আমি..জেহফিল, অস্থির হয়ে যাই কারো যত্ন পাওয়ার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, যার চোখেই তাকাই তার চোখেই করুণা, নয়তো ভাণ। যার ফলে প্রত্যেকটা মানুষের প্রতি ঘৃণা জন্মে যায়, মানবজাতির প্রতি।
একাকীত্বে ভুগতে থাকি সারাটা সময়। যত্নের অভাবে আমার কঠিন মনটা কুঁকড়ে যেত। তীব্র যন্ত্রণা হতো বুকের ভেতর। মানবজাতি এত অদ্ভুত কেন? আমি তো কারো থেকে টাকা পয়সা, সম্পদ কিছুই চাইছি না। চাইছি শুধু একটু যত্ন, মমতা। স্নিগ্ধ পরশে মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে, মিষ্টি হেসে বলবে, কেমন আছো জেহফিল? ব্যস, এইটুকুই তো চাওয়া। তাও দিতে এত কৃপণতা??
আমার মনে হতে থাকে এই দুনিয়ায় আমার জন্ম হয়েছেই একা থাকার জন্য। কোটি কোটি মানুষের মাঝে থেকেও আমি একা, নিঃস্ব। আমি… আমি যে এতিম..
মনে হলো, বেঁচে থাকার মানে কী? যেই জীবনে শান্তি নেই সেই অশান্তিময় জীবন বাঁচিয়ে রাখার কী দরকার। কাটার থেকে ধারালো ব্লেড খুলে প্রথমবারের মতো হাতে আঘাত করলাম। রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল, হাত বেয়ে ফ্লোরে। এবং আশ্চর্যজনকভাবে আমার কোনো অনুভূতি হলো না। আবার দিলাম, নাহ, কোনোকিছু ফিল হলো না। তাহলে আমি ম’রব কীভাবে?
মাথায় মৃ’ত্যুর চিন্তা ঘুরতে থাকত সবসময়। এর মাঝে একবার ঐ ছেলেটার সাথে দেখা হয়েছিল। আশ্রমের পেছনে দোল খাচ্ছিল। ছেলে হয়ে মেয়েদের মতো দোল খেতে দেখে আমার খুব রাগ হলো। এতে আনন্দের কী আছে যে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে দোল খেতে হবে?
আমি সেই প্রথমবার আশ্রমের ছেলেদের কারো সাথে নিজ থেকে কথা বললাম। আমি ওর সামনে দাঁড়াতেই ও দোল খাওয়া থামায়, চোখে স্পষ্ট ভয় ছিল। আমার ভালো লাগল ওর ভয় দেখে। জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার বাবা যখন তোমার কপালে চুমু দিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দিয়েছিল তখন অনুভুতি কী ছিল?”
ছেলেটা আমার কথার উত্তর না দিয়ে দোলনা থেকে নেমে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিল। আমার ভালো লাগে না যখন কেউ কথার উত্তর দেয় না। অভদ্র মনে হয়! এই ছেলেটা একটা অভদ্র! পড়ালেখা করে কী শিখল তাহলে? অভদ্রতামি?
আমি ছেলেটার গেঞ্জির কলার টেনে ধরলাম। ভয় পেল ও। ওর ভয় ভয় চোখের দিকে তাকিয়ে আমি পুনরায় একই প্রশ্ন করলাম। যখন সে উত্তর দিলো না, আমি শরীরে আগুনের আস্ফালন টের পেলাম। মুষ্টাঘাত করলাম ওর নাক বরাবর। ও চিৎকারের সুযোগ পেল না, তার আগেই ওর মাথার মধ্যে মারতে থাকলাম ক্রমাগত। ওকে মে’রে কেন যেন খুব শান্তি পাচ্ছিলাম। সেই শান্তির আশায় আরো মারতে লাগলাম..
ওর রক্তে আমার হাত রঞ্জিত হয়ে গেল। নিজের রক্ত ছাড়া প্রথম অন্য কারো রক্ত দেখেছি। সেই রক্ত দিয়ে মাটিতে ফুল আঁকলাম। আমার মন পুলকিত হলো ফুলটা দেখে। কী চমৎকার ফুল.. কী চমৎকার ফুলের রঙ.. রক্তিম রঙা। ছেলেটা পরে কমপ্লেইন দিলো আমার নামে। কেউই বিশ্বাস করল না, কারণ সবাই জানে আমি শান্ত, এসব মারামা’রির আশেপাশেও নেই।
সেই থেকেই আমার আর্টের প্রতি টান বাড়ল। সুই’সাইডের চিন্তা বাদ দিয়ে আর্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। দিন নেই রাত নেই খালি আঁকাআঁকি করতাম। ঠোঁটে হাসি ফোটার প্রথম কারণ হয়ে উঠে পেইন্টিং।
দ্বিতীয় কারণ আমার বাটারফ্লাই। আমি যখন আমার নিজ টাকায় কেনা বাড়িতে শিফ্ট হলাম তখন বয়স কতোই বা? খেয়াল নেই তবে টিনেজ ছিলাম। বাড়িটা পরিত্যক্ত। আমি এর চেয়েও লাক্সারিয়াস বাড়ি অ্যাফোর্ড করতে পারতাম, কিন্তু এই বাড়িটার পেছনে জঙ্গল আর নিরিবিলি হওয়ায় আমি কিনে নিলাম। নিচের তলায় পরিত্যক্ত গোডাউন। পুরো বাড়িটাকে ভূতের বাড়ি বললে ভুল হবে না। আর একটা কথা, পেছনের এই জঙ্গলটা অনেক বিস্তৃত। এর শেষ নেই আমার জানামতে। এই গভীর জঙ্গলের মাঝেই আমাকে পাওয়া গিয়েছিল, তাই এই বাড়িটা আর জঙ্গলের প্রতি টানটাও বেশি।
বছরের পর বছর যেতে থাকে, প্রাপ্তবয়স্ক হই, ছেলে থেকে পুরুষ হয়ে উঠি, আর্টিস্ট হিসেবে পরিচিত হই ন্যাশনালি প্লাস ইন্টারন্যাশনালি। মোটা অঙ্কের টাকা ইনকাম করতে থাকি প্রতিটা আর্টে। ব্যাংক ব্যালেন্স বেড়ে যায়। গাড়ি হয়, কিন্তু বাড়ি আর কেনার ইচ্ছে জাগেনি। ঘরের জন্য আসবাবপত্র বানাই, আর্ট করি। কিন্তু সাজাই না ঘর। অযত্নে ফেলে রাখি। আমার আর্ট রুমটাই সবচেয়ে সুন্দর করে সাজাই। সব সরঞ্জামের জন্য আলাদা শেল্ফ কিনে তাকে তাকে রাখি।
পড়ালেখার করি নামে মাত্র। যেটুকু জানা দরকার সেটুকু জানার পর পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ আসে না। হিসাববিজ্ঞানের রেওয়ামিল, আর্থিক অবস্থার বিবরণী, ফিন্যান্সের আদর্শ বিচ্যুতি- এসব জেনে আমার কোনো লাভ আছে?? আমি তো এসব কাজে লাগাব না।
দিন রাত আর্ট করি। এটা সেটা আঁকি। যা মনে আসে তাই আঁকি। কিন্তু ঐ যে একাকীত্ব, সাময়িক সময়ের জন্য আড়াল হলেও আমার পিছু ছাড়েনি। আঠার মতো লেগে ছিল। সম্মান, টাকা, ঐশ্বর্য সবই আছে আমার, কিন্তু ভালোবাসা? ঐ একটা জিনিসের জন্য আমি ভেঙে পড়ি। আঁকতে আঁকতে একসময় হতাশ হয়ে পড়তাম। আমার দরকার ছিল ভালোবাসার। দরকার ছিল একটু জড়িয়ে ধরার অনুভূতির। কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন মানুষদের জড়িয়ে ধরতে হয় প্রথম দেখায়, তবে সেই জড়িয়ে ধরাটা ছিল ফর্মাল, কেউ আমাকে মন থেকে জড়িয়ে ধরেনি, এগুলো ছিল সব ফর্মাল হাগ, যা খালি লোক দেখানো, যেখানে ভালোবাসাময় উষ্ণতা ছিল না..
প্রতি মুহূর্তে ভালোবাসার অভাব বোধ করতাম প্রচণ্ড। আমি যখন অসুস্থ হতাম নিজেই নিজের সেবা করতাম। জ্বরে গা কাঁপুনি দিয়ে উঠলে অসুস্থ শরীর নিয়ে নিজের কপালে নিজেই ভেজা কাপড় দিতাম, অসুস্থতা নিয়েও রান্না করতাম। জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ হয়ে ম’রে থাকলেও কেউ ছিল না আমাকে দেখার। আমি চাইতাম কেউ একজন থাকুক, আমার সাথে, বাবা মা না, নিজের একান্ত একজন মানুষ থাকুক। যে আমি ঘরে ফেরার সাথে সাথে হাসিমুখে ওয়েলকাম জানাবে, আমার ক্লান্ত মুখ দেখে জিজ্ঞেস করবে আজকের দিনটা কি বেশি খারাপ কেটেছে? খারাপ লাগার কারণ জানতে চাইবে। আমি যখন অসুস্থ থাকব, সেই মানুষটা আমার পাশে বসে যত্ন করবে। এইখানে যত্ন বলতে আমি কিন্তু রান্নাবান্নার কথা বলছি না। দরকার হলে জ্বর থাকা অবস্থাতেই আমি রান্না করব, সব কাজ করব, শুধু সেই মানুষটা পাশে বসে ভালোবাসার সাথে মাথায় হাত বুলিয়ে দিক। কপালে ছোট্ট করে চুমু দিক, শক্ত করে জড়িয়ে ধরুক। আমার নাম ধরে আদর করে ডাকুক। আর কিচ্ছু না।
এই ভালোবাসার মানুষ আমি খুঁজে পাইনি। যেখানে সমস্ত মনুষ্যজাতের প্রতি ঘৃণা জন্মেছে সেখানে কীভাবে আমি ভালোবাসার মানুষ খুঁজতে বেরোতাম? “আমার একান্ত মানুষ নেই” এই কথাটা আমার তৈরি, অথচ আমার তৈরি কথা-ই আমাকে মুষড়ে দিতে লাগল প্রতিনিয়ত। আবারও সুইসাই’ডের চিন্তা মাথায়া ভর করল। ব্লেড দিয়ে হাতে পোঁচ দিলাম। কিছুই অনুভুত হলো না। ভাবলাম ব্লেড হয়তো আমার শরীরের অনুভূতি জাগাতে অক্ষম। তাই স্কাল্পচার বানানোর ধারালো ছুরি দিয়েও হাত কাটলাম। দুই হাতে পর পর অনেকগুলো পোঁচ দিলাম। অনুভূতি যেন কঠিন শিকলে আবদ্ধ ছিল, কোনো কিছুই ফিল হতো না। বুঝলাম না, আমার ভেতরে কি কোনো অনুভূতি নেই? বিরক্ত হলাম নিজের প্রতি। ম’রে যাওয়ার সহজ উপায় খুঁজতে লাগলাম।
তারপর আমার অগোছালো, ভালোবাসাহীন, উদ্দেশ্যহীন জীবনের একদিন রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখি এক রমণীকে। জীবনে এই প্রথমবারের মতো কোনো রূপসী কন্যা আমার স্বপ্নে এসেছিল। তার হাতে রোদরঞ্জন ফুল, লম্বা হালকা গোলাপি গাউন পরনে, ঘন পল্লববিশিষ্ট চোখে আবেদন, ঠোঁটে দুষ্টু হাসি, পেছনের ব্যাকগ্রাউন্ড ড্রিমি… স্বপ্নটা স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর ছিল। আমার মনে হয়েছিল এক টুকরো হ্যাভেন আমার স্বপ্নে উঁকি দিয়ে গেল।
ঘুম ভাঙার পর আমি অস্থির হয়ে যাই। আমার ভুতুড়ে ঘরের মাঝেই মেয়েটাকে খুঁজতে থাকি। কী পাগল আমি তাই না? আসলেই পাগল। মেয়েটাকে স্বপ্নে যেমন দেখেছিলাম ঠিক সেভাবেই তুলে ধরি ক্যানভাসে।
আমার মনে হতো আমার স্বপ্নে দেখা মেয়েটির কোন অস্তিত্ব ছিল না, কেননা এরকম কোনো মেয়েকে আমি বাস্তবে দেখেনি, আমার ব্রেইন শার্প। পরপর তিনদিন আমি একই রমণীকে বিভিন্ন আঙ্গিকে স্বপ্নে দেখি। প্রত্যেকটা স্বপ্নকে আমি তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে আঁকি। এত চমৎকার দেখতে এই মেয়েটা, যে আমি নিজের আঁকা ছবি থেকে নিজেই চোখ সরাতে পারি না। মেয়েটাকে দেখার পর আমার চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠে, পাগল হয়ে যাই মেয়েটাকে পাওয়ার জন্য। আমার মনে হতে থাকে, এই মেয়েটাই আমার ভালো থাকার ঔষধ, আমার একাকীত্ব ঘুঁচানোর জন্য এই মেয়েটাকেই লাগবে। আমার একান্ত মানুষ এই মেয়েটাই। কতবার চুমু খেয়েছি ক্যানভাসে হিসাব নেই। ছবি আঁকার সাথে সাথে চুমু দিতাম, রঙে ঠোঁট ভরে যেত, আমি কেয়ার করতাম না, মন না ভরা অবধি ছবিতে চুমু দিয়েই যেতাম..এতটাই পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি।
কিন্তু এই বৃহৎ পৃথিবীতে কোথায় খুঁজব আমার স্বপ্নের হৃদয়হরণীকে?
যেদিন বুঝেছিলাম আমি আমার প্রাণপ্রিয়াকে খুঁজে পাব না সেদিনই এই অর্থহীন প্রাণটাকে নাশ করার সিন্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি জানি না এটা আসলে অলৌকিক কিনা, তবে সেদিনই আমার জীবনের মোড় ঘুরে গেল। কী মনে করে সেদিন ভার্সিটি যাই। এবং আমার হৃদয় থমকে দিয়ে আমি আমার হৃদয়হরণীর দেখা পাই। ভার্সিটির গেটের সামনে, কতগুলো কেকের ব্যাগ হাতে, ঠোঁটে সেই দুষ্টু হাসি। আমার পা থমকে যায়, শরীর অসাড় হয়ে যায়। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি যে আমার ভালোবাসা আমার কাছে এসে ধরা দিয়েছে, তাও আবার সেদিন যেদিন আমি দুনিয়াকে চিরতরে বিদায় জানানোর প্ল্যান করেছিলাম। নিজের উপর রাগ হতে লাগল, কেন এর আগে ভার্সিটি এলাম না।
ও যেই ক্লাসরুমে ঢুকল সেই ক্লাসরুমের পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে একটা সিটে বসে পড়লাম। সারাক্ষণ ওর চঞ্চলতা মুগ্ধচোখে দেখতে লাগলাম। ও যখন আমার কাছে আসল, আমার বুকের মধ্যে চলা দ্রিম দ্রিম আওয়াজ বেড়ে যেতে লাগল, মনে হলো এই বুঝি পুরো ক্লাস আমার হৃদয়ের শব্দ শুনে ফেলল! ও কাছে আসল, আমার সামনে জার কেক সামনে রাখল। আমি আঁকার ভান করে আঁকিবুঁকি করতে লাগলাম, কিন্তু আমার মন ছিল সামনে দাঁড়ানোর আমার ভালোবাসার কাছে। ও নিজ থেকে পরিচিত হতে চাইল, আমিও হতে চাইলাম, কিন্তু যখন দেখলাম ওর সাথে আরও একটা ছেলে আছে তখন আমার প্রজাপতি উড়তে থাকা হৃদয়ে ক্রোধের আগুন জ্বলতে থাকল, যেই আগুনে সব প্রজাপতি পুড়ে ছাই হতে লাগল…
আমি গম্ভীর মুখে নিজের নাম বললাম, ওর নাম জানলাম, আমার পছন্দ হয়নি। ওকে দেখা মাত্রই আমার মনে যেই নামটা এসেছিল তা ছিল ‘বাটারফ্লাই’। যে কিনা আমার মৃ’ত হৃদয়ে হুট করে উড়ে এসে জীবিত করে তুলেছে।
আমি পুরোটা ক্লাস ও’কে দেখে যেতে লাগলাম। ছুটির শেষেও ওকে ফলো করলাম। শুধু ভার্সিটি না, সব জায়গাতেই ওকে ফলো করতে লাগলাম। যেই আমি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরৈ থাকতাম সেই আমি ওর জন্য ইন্সটা, টুইটার ডাউনলোড করে ওকে ফলো করতে লাগলাম, ওর প্রতিটা ছবি সেভ করে রুমে টানিয়ে রাখলাম। ও কোথায় যায় কী করে না করে সব স্টক করতে লাগলাম। আমি অবসেসড হয়ে গিয়েছিলাম ওর প্রতি। প্রত্যেকটা মুহুর্ত বাটারফ্লাইয়ের চিন্তায় বিভোর থাকতাম। নানা কূটকৌশলে ওর বাবার সাথে সম্পর্ক ভালো করি, ওকে নিজের কাছে রাখার চেষ্টা করি।
বিয়ের চিন্তা এত দ্রুত ছিল না, কিন্তু ও’কে ওর ফ্রেন্ডদের সাথে মেলামেশা সহ্য হলো না আমার। আমি চাই সব মানুষের থেকে ওকে আলাদা রাখতে। সবার থেকে দূরে সরাতে, ওর শেষ এবং একমাত্র মানুষটা আমি হবো, শুধুই আমি। তাই ছক কষে ওকে বিয়ে করি। তাও ওর ফ্রেন্ডদের সাথে মেলামেশা কমল না। ওর সাথে ওর বন্ধু বান্ধবদের সখ্যতা দেখে আমার এত রাগ উঠল…পৃথিবী ধ্বংস করার মতো রাগ। যদি ও আমাকে কম গুরুত্ব দেয়! যদি আমাকে ছেড়ে চলে যায়! যদি আবার একাকীত্বের মাঝে ফেলে দেয়!! আমি ও’কে ওদের থেকে আলাদা করার সব ধরনের চেষ্টা করি। আমার বাটারফ্লাইয়ের গলায় সুতো বেঁধে নিজের করার জন্য যা করার লাগে সব করব, সব।
আমার বাটারফ্লাই শুধুই আমার। আমার বাটারফ্লাইয়ের উড়ার ক্ষমতা থাকবে একটি নির্দিষ্ট জায়গায়, একটি নির্দিষ্ট ফুলের কাছে..রোদরঞ্জন ফুল..বিষাক্ত মধু যার। আমি হবো আমার বাটারফ্লাইয়ের রোদরঞ্জন। যেই বিষাক্ত মধুর একমাত্র ভাগীদার সেই কোমল ডানার প্রজাপতি। যা পান করে অন্যান্য ফুলের কাছে যাওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলবে সে… দুর্বল ও নত হয়ে পড়ে থাকবে জেহফিল নামক বিষাক্ত রোদরঞ্জনের কাছে…
.
.
চলবে…
#রোদরঞ্জন
#পর্ব_২৩
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.
আধবোজা চোখে ইনান দেখল জেহফিল টেবিলে বসে কিছু একটা করছে, ঘোলা চোখে ভালো করে দেখতে পারল না, শুধু টেবিল ল্যাম্পের আলোর সামনে খালি শরীরে বসে থাকা জেহফিলের থেকে কাগজে খসখসানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বারান্দা থেকে আসা ঠান্ডা বাতাসে ঘুম আরও জেঁকে বসলে গায়ে থাকা জেহফিলের শার্ট শরীরে জড়িয়ে ঘুমে ডুব দিলো আবার।
.
গলায় আর বুকে ঠাণ্ডা পানির ফোঁটা পড়তেই ইনানের ঘুম ভেঙে গেল। আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরতেই দেখল শুধু তোয়ালে জড়ানো জেহফিল ইনানের উপর ঝুঁকে বসে আছে। তার ভেজা চুল থেকে টুপটুপ করে পানির ফোঁটা ইনানের উষ্ণ শরীরকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। ইনানকে চোখ খুলতে দেখে জেহফিল স্মিত হাসে। ইনান মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চেয়ে থাকে জেহফিলের নজর কাড়া হাসিতে। জেহফিল ইনানের নাকা নাক ঘষে আলতো গলায় বলে,
‘বেবি, এগারোটা বাজে, ঘুম থেকে উঠবে না?’
এত সময় ইনান ঘুমিয়েছে ভাবতেই হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসে। আজ আর ভার্সিটি যাওয়া হলো না।
জেহফিল ইনানকে কোলে তুলে নিলো। লজ্জায় ইনানের মরি মরি অবস্থা। তার পরনে শুধু জেহফিলের শার্ট। সেটাও কোলে তোলার কারণে বার বার উরু থেকে পিছলে পড়ে যাচ্ছে। ইনানকে ওয়াশরুমে দাঁড় করিয়ে কোমর চেপে ঘাড়ে চুমু খেল জেহফিল। শীতল ঠোঁটের পরশ ঘাড় ছুঁতেই মৃদু কেঁপে উঠল ইনান। কপালে চুমু দিয়ে বলল,
‘যাও, গোসল সেরে আসো। তোমার প্রিয় ব্রেকফাস্ট রেডি করছি।’
.
চুল মুছতে মুছতে ইনান কিচেনে আসলো। দেখল জেহফিল তোয়ালে জড়িয়েই প্যানকেক বানাচ্ছে। শুধু পরনে অ্যাপ্রোন। অ্যাপ্রোনটা জেহফিলের শরীরকে পুরোপুরি আয়ত্ব করতে পারছে না। জেহফিলের পেশিবহুল বাহু, শক্ত কাঁধ, অ্যাডামস অ্যাপল ইনানকে চুম্বকের ন্যায় টানছে। জেহফিল নিজেও জানে না খালি গায়ে অ্যাপ্রোন পরনে জেহফিলকে কতটা আবেদনময় লাগছে।
‘হ্যালো বেবিগার্ল!’
ইনানের ধ্যান ছুটে জেহফিলের গাঢ় কণ্ঠে। ডাইনিংএ গিয়ে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল,
‘এমন উদোম হয়ে রান্না করছেন কেন? কেমন দেখায়?’
‘হট লাগছে তাই না?’ মিটিমিটি হেসে উত্তর দেয়।
পানি খেতে গিয়ে বিষম খায় ইনান, তোতলিয়ে বলে,
‘কীসব আজেবাজে কথা!’
‘আজেবাজে কাজ করতে ভালো লাগে অথচ কথা বললেই দোষ?’ নিষ্পাপ গলা জেহফিলের।
ইনানের কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হতে থাকে। জেহফিলের মুখ এত লাগামহীন কেন? জেহফিল ইনানের লাজুক, অস্বস্তিকর চেহারা দেখে কাছে এসে বাঁকা হেসে বলল,
‘তুমি কাল রাতে এত ওয়াইল্ড…’
জেহফিলের কথা শেষ হওয়ার আগেই ইনান জেহফিলের মুখে প্যানকেক ঢুকিয়ে দিলো, শাসানোর স্বরে বলল,
‘আরেকটা কথা যদি মুখ দিয়ে বের করেছেন তো.. তো আপনার একদিন আর আমার দশদিন।’
জেহফিল আরামে প্যানকেক খেতে খেতে ভাবুক গলায় বলল,
‘হুমম, তোমার দশদিনই লাগবে আমাকে ক্লান্ত করতে, আর আমার মাত্র একদি..আউচ বাটারফ্লাই!’
ইনান জেহফিলের নাক বরাবর ঘুষি দিলো, জোরেই, রাগত স্বরে বলল,
‘বেশরমা, অসভ্য, মুখে বন্ধ হয় না কেন আপনার?’
জেহফিল নাক ডলতে ডলতে বলল, ‘এভাবে বন্ধ না করে কিস দিয়ে তো বন্ধ করতে পারতে, এত আনরোমান্টিক কেন তুমি? যত রোমান্টিকতা সব খালি আমিই করি।’
সকালটা কেটে গেল দুজনের খুনসুটিতে। জেহফিলকে আগের মতো দুষ্টুমি করতে দেখে ইনান সম্পূর্ণ ভুলে গেল গতকাল ভোরের জেহফিলের ভয়ানক রূপের কথা।
.
অ্যাকাডেমীর দোতলার ভবনটা মাঠের একদম কোণায়। গাছ পালা ঘিরে আছে ভবনটাকে। এইখানের সিঁড়িঘরটা কেউ ব্যবহার করে না। অন্ধকার সিঁড়ির মধ্যে তাজবীর বসে আছে। কয়েক সেকেন্ড পরপর তার দু ঠোঁটের ফাঁক থেকে ঘোলাটে ধোঁয়ার কুণ্ডলী বের হচ্ছে। তাজবীর চোখ ছোটো ছোটো করে সামনের ভবনের নিচ তলায় তাকিয়ে আছে। তার টিমের সদস্যরা প্রজেক্টের স্ট্যাচু ঠিক করছে। আর তাদের দিক নির্দেশনা দিচ্ছে জেহফিল। জেহফিল থাকার কারণেই তাজবীর আর জয়েন করেনি ওদের সাথে।
জেহফিলের প্রতি মনে মনে রাগ পুষে রেখেছে তাজবীর। তার এই রাগকে ফ্রেন্ডরা বলে হিংসা। আসলেই কি হিংসা নাকি?
জেহফিলকে দেখতে না পারার কারণ ছিল একটি। তাকে ক্লাসের মধ্যে কঠিন অপমান করাটা। তবে পরবর্তীতে আরও কারণ খুঁজে বের করেছে, যদিও জেহফিল তাজবীরকে ততটা পাত্তাও দিত না। ক্লাসের অপমানটা ধীরে ধীরে রূপ নেয় ভয়ঙ্কর আকারে। জেহফিলের সব কাজ তার বিরক্ত লাগত এরপর থেকে, ইভেন জেহফিলকেই বিরক্ত লাগত। জেহফিলের সাকসেস, বিভিন্ন এক্সিবিশনে জেহফিলের আর্টওয়ার্ক প্রেজেন্টেশন, দেশে বিদেশে ওর সুনাম, এগুলো তাজবীরকে ভেতরে ভেতরে দাবানলে জ্বালায়। জেহফিল তাজবীরের প্রায় সমবয়সীই, সে যতটুকু জানে জেহফিল মাস্টার্সে বর্তমানে পড়ত যদি না পড়ালেখা ছাড়ত। আর তাজবীর মাস্টার্স ফাইনাল দিয়েছে। সেই হিসেবে জেহফিল তাজবীরের কিছুটা ছোটো হবে বোধহয়।
তাই তার ছোটো কেউ তাকে ক্লাসের মাঝে অপমান করে, তাও আবার রাগ দেখিয়ে, ধমক দিয়ে, কঠিন গলায়- এই ব্যাপারটা খুব ইগোতে লেগেছে তাজবীরের। তার উপর জেহফিলের সাফল্য তাজবীরের জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছে। এসব ভাবতে ভাবতে কপালের রগ ফুলে উঠেছে তার। আধ খাওয়া সিগারেটটা পায়ে পিষে উঠে দাঁড়ায়।
কোমরে এক হাত আর মাথায় এক হাত দিয়ে চুল চেপে ধরে। তাজবীরের সারা জীবনেও তাকে কেউ ফুলের টোকাও পর্যন্ত দেয়নি, ধমক দিয়ে কথা বলা তো দূরে থাক। এমনকি তার বাবা মাও কখনো তার সাথে উঁচু গলায় কথা বলেনি। সব সময় আদরের মাঝে বড় হওয়া তাজবীরের সবার সামনে অপমানিত হওয়াটা; তাও আবার ছোটো কারো কাছে; ব্যাপারটা সহজে হজমযোগ্য নয়। জেহফিলকে কোনো শাস্তি দিতে পারলে তার মন শান্ত হতো। কিন্তু জেহফিলকে শাস্তি দেয়ার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না সে।
ভাবনায় মশগুল থাকা তাজবীর এলোমেলো পায়ের করিডোরে হাঁটছিল। তখন ইনান সিঁড়ি থেকে দৌঁড়ে উপরে উঠে মোড় ঘুরতেই কাউকে সামনে দেখে। আচমকা কেউ সামনে আসায় তাজবীর দুইহাত সামনে বাড়ায় মানুষটি যাতে পড়ে না যায়। কিন্তু ইনান নিজেকে রক্ষার জন্য ফাস্ট ছিল, তাজবীর ধরার আগেই সে নিজের গতির ব্রেক কষে। তাজবীরের আর তার মাঝের ব্যবধান পাঁচ ইঞ্চি মাত্র।
‘পাগলের মতো ঘুরাঘুরি করে রাস্তা আটকে রেখেছেন কেন? এক্ষুনি তো পড়ে যেতাম।’
ত্যক্ত বিরক্ত ইনান তাজবীরকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত পায়ে চলে যায় আবার। তাজবীর হতভম্ব চোখে ইনানের চলে যাওয়া দেখে। আজব মেয়ে একটা।
ইনান নিচে জেহফিলের কাছে যায়। তার ক্লাস শেষ। বসে থাকতে ভালো লাগছিল না বিধায় জেহফিলের কাজ দেখার চলে এসেছে।
জেহফিল গম্ভীর গলায় সবাইকে ডিরেকশন দিচ্ছে। আর ইনান জেহফিলের পেছনে এসে তার কাজ পর্যবেক্ষণ করছে। জেহফিল খেয়াল করেনি যে ইনান তার পেছনে দাঁড়িয়ে। স্ট্যাচুটা দেখতে এত সুন্দর লাগছিল যে ইনানের ঠোঁট দুটো বিস্ময়ে ফাঁকা হয়ে গেছে। এক রমণীর শরীর দুই টুকরো কাপড় দিয়ে ঢাকা, পা শিকল দিয়ে বাঁধা, তার চোখে অশ্রু, ঠোঁট দুটো যেন এখনি সাহায্যের জন্য চিৎকার করে উঠবে। এতটা করুণ দৃশ্য!
ইনান বেখেয়ালি পায়ে হেঁটে গেল মূর্তির কাছে। মূর্তির শিকল বাঁধা পায়ে হাত দেয়া মাত্রই কারো কর্কশ কণ্ঠের চিৎকার শুনে চমকে উঠে সে।
সবার নজর যায় ইনানের দিকে। ইনান তাকায় তার উপর চিৎকার করা মেয়েলী কণ্ঠের মালকিনের দিকে। টিয়া ধমকে বলল,
‘এই মেয়ে, এটা ধরলে কেন? চোখ কি আকাশে রেখে হাঁটো নাকি? দেখোনা মাটি এখনো শুকা…’
‘জাস্ট শাট ইউর মাউথ মিস টিয়া।’
টিয়া চুপসে যায় জেহফিলের ধমকে, চুপসানো গলায় বলল,
‘স্যার মেয়েটা স্ট্যাচুর পায়ের দিকটা টাচ করেছে, এতে শেপ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।’
‘হয়েছে?’
টিয়া বুঝলো না। বিভ্রান্ত নিয়ে চাইল জেহফিলের দিকে, ‘সরি স্যার?’
‘শেপ কি নষ্ট হয়েছে?’ গাম্ভীর্য নিয়ে বলল।
টিয়া মূর্তিটার যেদিক ইনান ছুঁয়েছে, সেখানে দৃষ্টিপাত করল। ইনান হালকা করে ছুঁয়েছে যার কারণে কোনো দাগই পড়েনি, টিয়া মাথা দুদিক নেড়ে নিচু গলায় বলল,
‘না স্যার। বাট হতো যদি..’
জেহফিল হাত উঠিয়ে থামিয়ে দেয়, ‘হতো এবং হয়েছে- এর মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। সিক্সের বই দেখে পার্থক্যটা পড়ে নিবেন।’
টিয়াকে অপমান করার ধরণটা দেখে না চাইতেও বাকিদের হাসি চলে আসে। মুখ টিপে তারা হাসতে থাকে।
জেহফিল কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ইনানের পানে চাইল। তার বাটারফ্লাইয়ের উপর টিয়ার গলা চড়িয়ে কথা বলার সাহস দেখে জেহফিলের রক্ত টগবগ করে উঠে। ইনানের সন্নিকটে গিয়ে তার হাত ধরে মূর্তির পা ছুঁয়িয়ে দেয়।
‘যেখানেই টাচ করতে মন চাইবে, ধরবে, কারো পারমিশনের প্রয়োজন নেই।’
ছোঁয়ার পর ইনানের হাত ধরে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। তার আগে পেছনে ফিরে টিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘আগামীকাল আপনার হোমওয়ার্ক হচ্ছে ক্লাস সিক্সের বই জোগাড় করে টেন্সের স্ট্রাকচার মুখস্থ করবেন, সবার সামনে দাঁড়িয়ে টেন্সের ডেফিনেশন বলবেন, যদি না পারেন তাহলে পুরো স্ট্যাচুর দায়িত্ব আপনার নিতে হবে।’
অপমানে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে টিয়া। তার ফ্রেন্ডরা মুখ চেপে হাসলে আকাশ যে কিনা নতুন জয়েন করেছে সে হো হো করে হেসে উঠল। দামড়া একটা মেয়েকে এই ধরনের শাস্তি দেয়ার চেয়ে অপমানজনক আর কিছু হয় না।
জেহফিল ইনানের হাত ধরে চলে গেল। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় ইনান বলল,
‘এই ধরনের শাস্তি না দিলেও পারতেন জেহফিল। মেয়েটা কত লজ্জা পেয়েছে।’
জেহফিল ইনানের ঠোঁট চেপে বলল,
‘তোমার উপর কেউ ঝারি মেরে কথা বলবে আর আমি চুপ করে থাকব?’
‘ঝারি মারল কোথায়? মেয়েটা চিন্তিত ছিল তাই এমন করে বলেছে, এটা স্বাভাবিক। আমিও হলে এভাবেই ডাক দিতাম।’
জেহফিল ইনানের গাল চেপে ধরে, হালকা করে,
‘সোনা, তোমার কাছে স্বাভাবিক হলেও এসব মেনে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। তোমার উপর চিৎকার করে কথা বলা হোক কিংবা আদর করে কথা বলা হোক, সবকিছুর অধিকার শুধু আমার।’
‘জেহফিল..’
‘শশশহ, কোনো কথা না। মাথা গরম আছে, কিস করো তো।’
ইনানের চোখ বড় বড় হয়ে যায়, ‘পারবো না।’
জেহফিল ইনানকে সেই অন্ধকার সিঁড়ি ঘরে টেনে ধরে, ‘বাটারফ্লাই, তোমাকে যখন যা করতে বলব সেটাই করবে, বিপরীতে একটা কথাও যেন তোমার এই সুন্দর মুখ দিয়ে না বের হয়।’
‘যদি না করি?’
‘ফল খারাপ হবে।’
ইনান জেহফিলের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে,
‘ছাড়ুন এখন, পাবলিক প্লেসে এসব কী?’
‘এখানে কেউ আসবে না, চুপ থাকো।’
এই বলে জেহফিল ইনানের ওষ্ঠাধর আয়ত্বে নিয়ে নেয়।
সিঁড়ি ঘরের উপরে থাকা তাজবীর সবটাই লক্ষ্য করল, দেয়ালে হেলান দিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে আপনমনে স্বগোতক্তি করল,
‘ইন্টারেস্টিং।’
.
.
চলবে…
#রোদরঞ্জন
#পর্ব_২৩ [অতিরিক্ত]
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.
সুন্দর একটা দিন কাটানোর পর ইনান একাডেমি থেকে বাসায় ফিরছিল। জেহফিলের সাথে নরমাল কনভারসেশন করছিল সে। সেই টাইমে ইনানের বাবার কল আসে। ইনান ফুরফুরে মনে বাবার সাথে কথা বলায় খেয়াল করল না জেহফিলের অগ্নি চোখের লাভা।
‘কল ধরছিলে না কেন আম্মু?’
‘চার্জ ছিলো না বাবা। এখন অন হয়েছে।’
‘জেহফিলের ফোনে কল ঢুকছে না কেন? সকাল থেকে কল করছিলাম।’
‘কিজানি, বলতে পারছি না। আচ্ছা আমি দেখব।’
বাবার সাথে কথা বলা শেষ করে। জেহফিলের মোবাইল ইনানের সামনেই ছিল। সে মোবাইলটা নিয়ে কন্টাক্ট লিস্ট চেক করে। জেহফিলের মোবাইলে নাম্বারের সংখ্যা নিতান্তই কম। তাও সেগুলো কাজের ক্ষেত্রের।
ইনান তার বাবার নাম্বার খুঁজে পেল না। তাই স্বাভাবিকভাবেই বলল,
‘বাবার নাম্বার আপনি সেভ করেননি?’
এই বলে জেহফিলের দিকে তাকায়। দেখল এতক্ষণ হাসিখুশি থাকা জেহফিলের চোয়াল শক্ত। তীক্ষ্ণ চোখে আগুনের হলকা।
‘জে..’
‘সেভ করার কোনো প্রয়োজন আছে?’
জেহফিলের কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ মাত্র হঠাৎ করেই জেহফিলের সেইদিন মোবাইল ছিনিয়ে নেয়ার কথাটা মনে পড়ে, মনে পড়ে তার বাবাকে নিয়ে ভৎর্সনা করাটা, সিরিয়ালি তার মনে পড়ে যায় ভোরের কথা। কপালে হাত চলে যায় ইনানের। সে এতো মনভুলো কেন? ধাতস্থ করে নিজেকে। গভীর শ্বাস ফেলে জেহফিলের দিকে চায়।
‘এক্সপ্লেইন।’
‘এক্সপ্লেইন হোয়াট?’
‘ফুল গাছ কেটে ফেলার কথা।’
জেহফিল ইনানের কথা শুনে বাঁকা হাসে। কটাক্ষ করে বলে,
‘এতক্ষণ পর মনে পড়ল?’
‘কথা প্যাঁচাবেন না।’ তীক্ষ্ম গলা ইনানের।
ইনানের জোরে জোরে কথা বলা শুনে জেহফিল বলল,
‘লাভ, আমি তোমাকে এখনো ম্যানারস শিখাতে পারিনি। এটা কি আমার ব্যর্থতা নাকি তোমার অমনোযোগিতা?’ অসন্তোষ প্রকাশ পেল জেহফিলের কথায়।
‘একদম কথা ঘুরাবেন না।’
ততক্ষণে তারা বাসায় এসে পড়েছে। জেহফিল গাড়ির দরজা খুলে ইনানকে কোলে তুলতে নিলে ইনান জেহফিলের বুকে ধাক্কা মারে।
‘বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বাটারফ্লাই।’ হীম শীতল গলা জেহফিলের।
‘আপনি বেশি করছেন, কথার জবাবা দেন না কেন? গাছগুলো কেন কেটেছিলেন? বিহেভিয়ার চেঞ্জ কেন আপনার? আপনিই না আমার পছন্দে গাছ লাগিয়েছেন তাহলে কেন আপনি আবার সেগুলো তুলে ফেলেছিলেন? তাও এত কষ্ট দিয়ে?’
‘গাছের কষ্ট নিয়েও ভাবো, আমার কষ্ট চোখে পড়ে না?’
‘আপনার কীসের কষ্ট?’ ভ্রু কুঁচকে আসে ইনানের।
‘ভেতরে যাই?’
‘এখানেই বলবেন।’ হুকুমের সুরে বলল ইনান।
জেহফিলের ভালো লাগল না তার উপর ইনানের হুকুম জারি করা। সিরিয়াস কথাবার্তায় তার উপর কেউ রুড হয়ে কথা বলবে, চিৎকার করবে, আদেশ দিবে- এসব জেহফিলের সবচেয়ে অপছন্দ। তাও আবার তার বাটারফ্লাই সুরেলা গলায় তাকে অর্ডার করবে কেন? বাটারফ্লাইয়ের মিহি কণ্ঠস্বর শুধুমাত্র ভালোবাসাময় কথা বলার জন্য তৈরি হয়েছে, রিনরিনে হাসির জন্য, সুখে…
‘চুপ করে থাকবেন না, আপনিই না বলেন প্রশ্নের জবাব না দেয়া অভদ্রতা? তাহলে এখন আপনি নিজেই তো অভদ্র হয়ে গেলেন।’
জেহফিলের হাত মুষ্টিবদ্ধ হলো। রাগ হলে তার মাথা ঠিক থাকে না। কিন্তু বাটারফ্লাইয়ের সামনে লাগ দেখানো যাবে না। বাটারফ্লাই যদি কষ্ট পায়?
ইনান আবারও কিছু বলতে নেয়, তখন জেহফিল ইনানের হাত ধরে হেঁচকা টান মারল, কথা গলায় আটকে কাশি উঠে যায় তার। গিয়ে পড়ল জেহফিলের কাঁধে। হুট করে টান মারায় গাড়ির সাথে কপালে হালকা ব্যথাও পায়।
ইনানকে কাঁধে তুলে জেহফিল সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে। ইনান ছোটার জন্য মোচড়ামুচড়ি শুরু করতে লাগল।
ইনানকে এনে খাটের উপর ফেলল জেহফিল। ইনানের উপর উঠে এসে দুই হাতের মাঝে বন্দী করল। ইনানের নাকের কাছে চুমু দিতে চাইলে ইনান সরে যায়। জেহফিলের অন্তঃকরণে আগুন জ্বলে উঠতে লাগল ধীরে ধীরে। রাগ কমানোর জন্য ইনানকে কাছে টানতে চাইছে আর ইনান কিনা উল্টো দূরে সরে গিয়ে তার রাগ বাড়িয়ে দিচ্ছে!!
‘বেবি, আমার দিকে ফিরো.. ফিরো না সোনা.. কপালে গভীর চুমু দাও।’ অস্থির গলায় বলল। যেন এখন ইনানের সান্নিধ্য পাওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ।
ইনান মুখ সরিয়ে নিলো,
‘এসবের মুডে নেই এখন, যা বলছি তার উত্তর দেন।’
‘নাহলে যে আমার রাগ কমবে না বাটারফ্লাই।’
ইনান তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল,
‘রাগ যেখানে আমার হওয়ার কথা সেখানে আপনি রেগে আছেন? অদ্ভুত!’
জেহফিলের কানে কোনো কথা গেল না। সে ইনানকে কাছে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল।
ইনানের মাথায় কোনো একটা ভাবনা খেলে গেল। জেহফিলের মোবাইল তার হাতেই ছিল। সে ব্লকলিস্টে গেল। এবং যা ভেবেছিল ঠিক তাই। তার বাবার নাম্বার ব্লকে রাখা।
এদিকে জেহফিলের নিজের শার্ট খুলে ইনানের কটি খোলা শুরু করেছে। ইনান জেহফিলের হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল।
‘বাবাকে ব্লক করে রেখেছেন কেন?’
জেহফিল উন্মাদ হয়ে আছে ইনানেতে ডুব দেয়ার জন্য। তাই তার উন্মাদনার মাঝে ঐ বুড়োর কথা বলাতে তার মুড চলে গেল। সাথে রাগ হলো প্রচুর। ইনানের হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে কাউচে ছুঁড়ে মারল।
‘কারণ ঐ বুড়োটা সারাদিন কল দিতো।’ ক্ষোভের সাথে বলল জেহফিল।
বাবাকে এমন বেয়াদবি সম্বোধনে ডাকায় ইনান ফুঁসে উঠে।
‘যে বয়সে বড় কাউকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে জানে না সে আবার আমাকে ম্যানারস শিখাবে? আগে নিজে বেয়াদবি বাদ দেন।’
‘হয়েছে? শেষ জ্ঞান দেয়া?’
‘আজাইরা, আপনাকে জ্ঞান দেয়া মানে কলা গাছের সাথে কথা বলা। বাবা কল দিতো বলেই আপনাকে ব্লক দিতে হবে কেন?’
‘কারণ তিনি তোমার মতোই জ্ঞান দিতো। তোমার কী কী পছন্দ, তরকারিতে ঝাল কেমন খাও, কীভাবে চালালে তুমি কম্ফোর্টেবল হবে এসব আলতু ফালতু কথা বলে কান পঁচিয়ে ফেলত। একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দেয়ায় বাবার চিন্তা থাকবেই। তাই বলে সারাক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করবে কেন এসব নিয়ে?’
‘আমার বাবা ঘ্যানঘ্যান করে? এগুলা বলা কি পাপ নাকি? বাবা শুধুমাত্র আপনাকে আমার ভালো খারাপ লাগা সম্পর্কে অবগত করছে।’
‘তোমার পছন্দ অপছন্দ তোমার বাবার চেয়েও ভালো জানি আমি। কোন রেস্টুরেন্টের কোন আইটেম পছন্দ, রাস্তার কোন স্টলের ফুচকা পছন্দ, কী টাইপের ড্রেস ইভেন তোমার কোন ডিজাইনের ইনার পছন্দ সবই জানি আমি।’
‘এগুলো সব বিয়ের পরই জেনেছেন।’
তীর্যক হাসে জেহফিল, ‘বিয়ের আগে থেকেই সব জানি।’
থম মেরে যায় ইনান, সন্দেহী গলায় বলল,
‘কীভাবে?’
‘ফলো করলে সবই জানা যায়।’
‘মানেহ!!’
‘তুমি কি বোকা? বাংলা কথা বুঝো না?’
‘তারমানে আপনি আমাকে স্টক করতেন?’
‘সব জায়গাতেই। শুধু রিয়েলেই না, সোশ্যাল মিডিয়াতেও।’
‘আপনি না বলেছিলেন আপনি এসব ইউজ করেন না?’
জেহফিল হাসে। তার হাসিতেই ইনান বুঝে যায় জেহফিলের মিথ্যে বলা।
‘কেন করেছেন আপনি এসব?’
‘তোমাকে পাওয়ার জন্য।’ গাঢ় স্বরে বলল জেহফিল।
‘পেয়ে তো গিয়েছেনই। তাও কেন থামছেন না?’
‘তোমাকে পুরোপুরি পাওয়া বাকি।’
‘মানে?’
জেহফিল ইনানের দুই পাশে দুই হাঁটুতে ভর করে বসেছিল। ইনানের মুখের কাছে মুখ এনে বলল,
‘তোমার প্রায়োরিটির লিস্টে প্রথম হওয়া বাকি এখনো।’
ইনান জেহফিলের কথা বুঝল না। জেহফিল তো অলরেডি ইনানের প্রায়োরিটিতে আছেই, এখানে প্রথম হওয়ার কথা আসছে কেন?
জেহফিল বলেই চলছে, ‘তুমি আমার থেকে ফুল গাছগুলোকে বেশি ভালোবাসতে, সকাল- বিকাল ফুল গুলোকে মুগ্ধ চোখে দেখতে, বারান্দায় গেলেই ফুল নিয়ে কথা বলতে, এসব আমার ভালো লাগত না। তোমার মুগ্ধ চোখের চাহনি শুধুমাত্র আমার জন্য বরাদ্দ থাকবে বাটারফ্লাই। এমনকি তোমার মিষ্টি কণ্ঠ শুধুমাত্র আমারই গুণগান গাইবে, আর কারো না। তাই..’
ইনান জেহফিলের কথা শেষ করল,
‘তাই আপনি গাছগুলো কেটে ফেলেছেন?’
জেহফিল মাথা নাড়ায়।
ইনানের মুখ তেঁতো হয়ে গেল ঘৃণায়। নিষ্পাপ গাছগুলোকে পাষাণের মতো পায়ে পিষেছিল জেহফিল, কতটা হিংস্র ছিল সে!
‘ইউ আর সিক জেহফিল।’
‘ইউ মেড মি সিক বাটারফ্লাই।’
জেহফিল বদলায়নি… ইনান আসলেই পাগল যে কিনা জেহফিলের গত কালকের মুখোশ পরা ভালো রূপে মুগ্ধ হয়ে মুখোশের আড়ালের জেহফিলকে ভুলেই গিয়েছিল। সারাদিনেও জেহফিলের ধ্বংসাত্মক রূপের কথা মনে পড়েনি তার। অথচ কয়েক ঘণ্টা পেরোতেই জেহফিলের আগের রূপ ফিরে এসেছে।
জেহফিল ইনানের কাছে আসার চেষ্টা করে। ইনান জেহফিলের হাত সরিয়ে জোরে ধাক্কা দেয়। হঠাৎ ধাক্কায় জেহফিল বিছানায় পড়ে যায়। ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে ইনানের প্রত্যাখ্যানে রাগ এবার আকাশচুম্বী হলো তার। খুব কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছিল, পারেনি, তার বাটারফ্লাই তাকে শান্ত থাকতে দেয়নি। এর শাস্তি তো পেতেই হবে তার।
ইনানকে শাস্তি দেয়ার ইচ্ছা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সে শান্তি দিবে তার বাটারফ্লাইকে, তবে কষ্ট দিয়ে না..
ইনান উঠে যেতে নিলে জেহফিল হাত ধরে বিছানায় উল্টো করে ফেলে। ইনানের পিঠের উপর উঠে এসে ইনানের মাথার নিচে বালিশ দুটো রাখে। তারপর ইনানের চুলের মুঠি চেপে ধরে একের পর এক আছাড় মারতে থাকে বালিশের উপর। তার বাটারফ্লাই ব্যথাও পাবে না, আবার তার শাস্তিও দেয়া হবে।
আকস্মিক আক্রমণে ইনান নিজেকে বাঁচানোর সুযোগ পায় না। জেহফিল ইনানের চুল চেপে ধরেছে। ইনান হাত দিয়ে জেহফিলের হাত ধরল, ছাড়ানোর আশায়। তার আগেই জেহফিল বালিশের উপর ধড়াম করে আঘাত করতে লাগল। নরম বালিশের কারণে যদিও ইনান ব্যথা পায়নি তবে বালিশের উপর কিছুক্ষণ বাদে বাদে মুখ চেপে ধরায় শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তার। মাথা দুদিক নাড়িয়ে ইনান জেহফিলের হাতের শক্ত বাঁধন থেকে চুল ছাড়াতে চায়। হিতে বিপরীত হয়ে যায়। ক্রোধান্বিত জেহফিল গর্জন করে ইনানের চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে, এক হাতে ইনানের দুই হাত পিঠের কাছে এনে চেপে ধরে।
ব্যথায় ডুকরে কেঁদে উঠল ইনান। খুব কষ্টে শ্বাস নিয়ে বলল,
‘ছেড়ে দিন জ..জেহফিল।’
জেহফিল ইনানের কথা শুনে থামে। ইনানের চুলের মুঠি ধরে নিজের দিকে ঘুরায়। চোখের জল পুরো মুখে লেপ্টে আছে। ব্যথায় চোখমুখ খিঁচে রেখেছে ইনান। জেহফিল ইনানের গাল চেপে ধরে, বাধ্য করে ইনানকে চোখ খুলতে। তার অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,
‘ছাড়ব? মাই লিটল বেবিগার্ল… এত প্ল্যান করে বিয়ে করেছি কি ছাড়ার জন্য? ছাড়ার কথা তোমার এই ছোট্ট মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো সারাজীবের জন্য।’
তারপর ইনানের আরো কাছে এসে প্রমত্ত গলায় বলল,
‘এটা আমাদের ভাগ্য ছিল বাটারফ্লাই। তাইতো তুমি স্বপ্নে রোদরঞ্জন হাতে ধরা দিয়েছিলে আমার কাছে। নিজেকে বন্দীর শিকল নিজ হাতে করেই নিয়ে এসেছিলে… এই ভাগ্য খণ্ডাবে কীভাবে? আমি…জেহফিল… বেঁচে থাকতে এই ভাগ্য খণ্ডানোর উপায় কোনোদিন খুঁজে পাবে না..খোঁজার সময়টুকুই যে আমি তোমাকে দিবো না সোনা… আমার মৃ’ত্যুর পরেও না.. ‘This is called FATE. OUR FATE’
.
.
চলবে..