রোদরঞ্জন পর্ব-২৪+২৫

0
347

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_২৪
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.

‘আগামী মাসে ট্যুরের প্ল্যান করেছি। কেউ যাতে স্পাউজ নিয়ে না আসে, এটা ফ্রেন্ডসদের জার্নি কেবল।’

মুগ্ধ বলল কর্কশ গলায়। ইনান ফোন হাতে চুপ করে আছে। সে এবং তার ফ্রেন্ডরা মিলে গ্রুপ কলে কথা বলছে এখন।‌ সবাই এতক্ষণ তাকে ইচ্ছেমতো ধুয়ে দিয়েছিল তার বিয়ের খবর লুকানোতে। ইনান নিশ্চুপে সব হছম করে গিয়েছে।‌

ফারার বেল মাথায় আর্মি ছাঁটের চুল দেখা দিয়েছে। সে মাথায় ঘোমটা টেনে ফোনের সামনে বসে আছে, ভার মুখে বলে,

‘তুই খবরটা লুকিয়েছিলি আমাদের পঁচানির ভয়ে না, তুই লুকেয়েছিস মূলত হ্যান্ডসাম হাজব্যান্ড‌ পাওয়ায়, ভেবেছিলি আমরা যদি নজর দেই, এতে তোদের সংসার লাইফে আবার আগুন লাগবে কিনা।’

ইনান তাও চুপ করে রইল। তার কিছু ভাল্লাগছে না। ফ্রেন্ডদের জবাব দিতেও না।

‘আচ্ছা তোরা কথা বল, আমি যাই।’

‘কেন? জেহফিল, সরি, দুলাভাই কি বারণ করেছে নাকি আমাদের কথা বলতে?’

বিরক্ত হয় ইনান, ‘সেরকম কিছু না, পটারি ক্লাসের কিছু হোমওয়ার্ক বাকি আছে।’

‘আমাদের না বলে তুই আর্ট একাডেমিতে ভর্তি হলি? বাহ!’ ভর্ৎসনা করল ফারা।

‘জেহফিল সেখানে টিচার হিসেবে আছে, ও-ই আমাকে ভর্তি করিয়েছে।’

আকাশ তাদের কথার মাঝে বাঁধা দিলো, ‘এসব আজাইরা কথা বাদ দিয়ে বল, তুই কি ট্যুরে যাবি? তোর জামাইকে নিতে পারবি না কিন্তু।’

‘সময় আছে, এখনই তো আর যাচ্ছিস না। পরে জানাব, বায়।’

ইনান ফোন কেটে দিয়ে যেই পিছু ফিরতে নিবে অমনি শক্ত কিছুর সাথে ধাক্কা খায়। দেখল জেহফিল এতক্ষণ তার কানের কাছে আড়ি পেতে ছিল।

‘কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করছ নাকি বাটারফ্লাই?’ জেহফিল হেসে বলল।

ইনান ভয়াতুর চোখে জেহফিলের হাসির দিকে চেয়ে আছে। মিথ্যে হাসির আড়ালে থাকা রাগকে সে সহজে ধরতে পারল। মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘আমি যাব না, ওরা যাবে।’

‘কেন তুমি যাবে না? আমাকে যেতে বারণ করেছে বলে? আমাকে ছেড়ে তুমি যেতে চাও না তাই?’

ইনান উপর নিচ মাথা দুলায়। জেহফিল ইনানকে জড়িয়ে ধরে, ‘তুমি এত অ্যাডোরেবল কেন বলো তো? এত ভালোবাসো আমায়?’

ইনানের কানের পিঠে চুল গুঁজে দিলো জেহফিল।

‘আমার দিকে তাকাও।’

ইনান অস্বস্তি নিয়ে তাকায়। জেহফিল ইনানের গাল, গলা, ঠোঁটে অধর স্পর্শে ছুঁয়ে দিতে থাকে। ইনান হাত দুটো শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ করে আছে। গতকালের জেহফিলের আচরণে সে ভয় পেয়েছিল সে অনেক। সেই ভয় এখনো কাটেনি। গতকাল তাকে শাস্তি দেয়ার পর জেহফিল ইনানকে এমনভাবে কাছে টেনে নিলো, এত আদর করে কথা বলল যেন কিছুই হয়নি।

চুমুতে চুমুতে ইনানের গাল, গলা ভিজে গেল। তাও জেহফিল থামছে না, এদিকে ইনানের অস্বস্তির মাত্রা বেড়েই চলছে,

‘একটা কথা ছিল।’

নিজের কাজ না থামিয়ে বলল জেহফিল, ‘উম, বলো সোনা।’

‘আপনি..কালকে রাতে এত রিয়েক্ট করেছিলেন কেন?’

ইনানের গলায় শেষ চুমু দিয়ে মাথা তুলে জেহফিল, ‘কজ ইউ রিজেক্টেড মি।’

‘তাই বলে এই ধরনের আচরণ করবেন?’

‘আই ডিডন্ট হার্ট ইউ বাটারফ্লাই। এই জন্যই তো মাথার নিচে বালিশ দিয়েছি যাতে তুমি আঘাত না পাও।’

ইনান বিমূঢ় চেয়ে থাকে। শান্ত গলায় বলল,

‘আপনি কী চান জেহফিল?’

‘তোমাকে।’‌ ইনানের বিভ্রান্ত চোখে চেয়ে বলল জেহফিল।

‘ক্লিয়ার করে বলুন।’

জেহফিল মৃদু হাসে, ইনানের গলার ভাঁজে মুখ ডুবিয়ে বলল,

‘তোমার ভালোবাসা, তোমার সময়, তোমার অনুভূতি, তোমার সুখ -দুঃখ, হাসি- কান্না, তোমার ধ্যান-জ্ঞান, চিন্তা ভাবনা, এমনকি তোমার অস্তিত্ব সব… সব কিছুর মালিক হতে চাই আমি বাটারফ্লাই। ঘুম থেকে উঠে আমাকে নিয়ে ভাবা শুরু করে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমার চিন্তা তোমার মাথায় গেঁথে দিতে চাই। ইউ বিলং টু মি সেনোরিটা। ইউর এভ্রিথিং বিলংস টু মি…এভ্রিথিং।’

ইনানের গলায় কান্নার দলা পাকিয়ে গেল, চোখ দিয়ে নোনা জলের ফোয়ারা বইতে আরম্ভ করল,

‘আপনি জানেন তা অসম্ভব..’

‘শশহ, সম্ভব, তুমি চাইলে সব সম্ভব।’

‘আমি চাই না জেহফিল।’ কম্পিত কণ্ঠস্বর তার।

জেহফিলের চোখ জ্বলে উঠল। ইনানের বাহু শক্ত করে চেপে ধরে গলায় চুমুর বদলে কামড়ে দিলো।

‘তোমার আর কোনো অপশন নেই বাটারফ্লাই। ইউ আর অল অ্যালোন। কেউ নেই তোমার পাশে, শুধু আমি আছি, তোমার ভালোবাসার স্বামী। তুমি বাধ্য আমার হতে। না চাইলেও তোমাকে আমার হতে হবে। আর আমার হওয়ার জন্য যে তোমার অস্তিত্বকে আমার কাছে হস্তান্তর করতে হবে সোনা, তুমি চাও কিংবা না চাও। যদি দিতে না চাও, তাহলে আমি তা ছিনিয়ে নিবো।’

হিসহিসিয়ে বলে উঠল জেহফিল।

‘সোজা কথা বলুন, আপনি যে আমাকে হাতের পুতুল বানাতে চান।’ রোবোটিক গলায় বলল ইনান।

‘ওয়াও!! আমার বাটারফ্লাইটা কত ব্রিলিয়ান্ট!’ জেহফিল মেকি অবাক হওয়ার ভান করল।

‘চলো, তোমার বুদ্ধিমত্তার জন্য তোমাকে পুরস্কৃত করব।’

এই বলে জেহফিল ইনানকে কোলে তুলে রুমে নিয়ে গেল।

.

.

ভার্সিটির জন্য রেডি হচ্ছিল ইনান।‌ কোথা থেকে জেহফিল চলে এসে ইনানের হাত চেপে ধরে। ভ্রুকুটি করে ইনান তাকিয়ে থাকলে জেহফিল বলল,

‘আই গেস তোমার পড়াশোনার প্রয়োজন নেই।’

কথাটা বুঝতে ইনানের সময় লাগল, ‘কেন?’

‘তুমি তো চাকরি-বাকরি করবে না। তো পড়াশোনা করে তো লাভ নেই।’

জেহফিল ইনানের ব্যাগ নিয়ে বই খাতা বের করতে লাগল।

‘এবার কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে।’

‘কম কমই করছি।’

ইনান জেহফিলের হাত থেকে বইগুলো টেনে নিলো,

‘আপনার ইচ্ছে নেই পড়াশোনার, তাই বলে কি আমার থাকতে পারে না? চাকরি করি বা না করি, সার্টিফিকেট অর্জন করতে চাই আমি।’

জেহফিল কথা না বলে ইনানের হাত থেকে আবারও ছিনিয়ে নিলো বইখাতা। আগুন ঝরা চোখে ইনানের দিকে চেয়ে একটা খাতা নিয়ে দু টুকরো করে ফেলল। ইনান হতবাক চেয়ে থেকে চিৎকার করল। জেহফিল বইয়ে হাত দিতে নিলে ইনান জেহফিলের হাত চেপে ধরে। দুজনের মাঝে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায়। ইনান কাঁদতে কাঁদতে বলে,

‘প্লিজ জেহফিল, পায়ে ধরি আপনার, পড়ালেখাটা এভাবে মাঝ পথে বন্ধ করিয়েন না, আমার অনেক স্বপ্ন পড়ালেখা নিয়ে।’

জেহফিল ইনানের গাল চেপে ধরল, ‘ইউ নো বাটারফ্লাই, আমি কেন তোমাকে পড়ালেখা করাতে চাচ্ছি না? কারণ তুমি সকলের মধ্যমণি। সবাই তোমাকে ভালোবাসে, কেয়ার করে যা আমি চাই না। তোমাকে ভালোবাসার অধিকার আমার। তোমার ছেলে ক্লাসমেটদের সাথে মেলামেশা আমি পছন্দ করি না। ইভেন মেয়েদের সাথেও না। আর্ট একাডেমিতে তোমাকে চোখের সামনে রাখা যায় যা তোমার ভার্সিটিতে পারা যায় না। সবাই তোমাকে দেখবে, কথা বলবে, তোমার সাথে হাসাহাসি করবে, আমি সহ্য করব না এটা।’

এটা শুনে ইনান তড়িৎ গতিতে বলল, ‘তাহলে আমি ক্লাস করব না। শুধু পরীক্ষা দিবো। প্লিজ জেহফিল, হাম্বল রিকুয়েস্ট করছি..প্লিজ।’

বহু কষ্টে জেহফিলকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ইনান তার পড়ালেখা বাঁচালো। শর্ত একটাই, সে ক্লাস করবে না, শুধু পরীক্ষা দিবে। এই সুযোগে জেহফিল ইনানের মোবাইলও নিয়ে নিলো,

‘পরীক্ষার সব আপডেট আমি দিবো। মোবাইল লাগবে না।’

স্তিমিত কণ্ঠে বলে ইনান, ‘বাবার সাথে…’

‘রাতের বেলায় নির্দিষ্ট একটা টাইমের মধ্যে তোমার বাবার সাথে কথা বলতে পারবে।’

ইনান পরাস্ত যোদ্ধার ন্যায় হার মেনে নিলো, মেনে নিতে বাধ্য হলো। শুধুমাত্র পড়ালেখার জন্য।

‘আপনি খারাপ জেহফিল…অনেক খারাপ।’

‘আমি জঘন্য।’ ফিসফিস করে বলে ইনানের গালে হাত বুলিয়ে চুমু খেল জেহফিল ।

ইনান জেহফিলকে সরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। টিভি ছেড়ে সোফায় এসে বসে থাকে। শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে টিভির দিকে। কেন যেন মনটা কু গাইছে তার। মনে হচ্ছে তার আশা ভরসা ধীরে ধীরে ধূলিসাৎ হতে যাচ্ছে।

.

.

তাজবীরের বিরক্তির সীমা ছাড়িয়ে গেছে। গত একঘন্টা ধরে সে করিডোরে ঘুরপাক খাচ্ছে। আশায় আছে জেহফিলের গার্লফ্রেন্ড বা ওয়াইফ যেটাই হোক, ওর সাথে কথা বলার। কিন্তু শালার জেহফিল আঠার মতো চিপকে আছে মেয়েটার সাথে। সরেইনা। মেয়েটার এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় রেখে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে তাজবীরের মুখ বিকৃত হয়ে আসলো। ঢং।

ঘামে হাত চিটচিটে হয়ে আছে ইনানের। তাও জেহফিল তার হাত ছাড়ছে না। জেহফিল ইনানের পাশের চেয়ারে বসে ল্যাপটপে অফিশিয়াল কাজ করছে। ইনানের ক্লাস শেষ হওয়ায় জেহফিলের সামনে মূর্তির মতো বসে থাকতে হচ্ছে। জেহফিল থেকে ছাড়া পাবার আশায় বলল,

‘ক্ষিদে পেয়েছে প্রচুর।’

জেহফিল পাশ থেকে কেকের বক্স দিলো। ইনান তা সরিয়ে বলল,

‘এসব না, ভাত খেতে ইচ্ছে করছে, ছয় পদের ভর্তা দিয়ে, সাথে ডাল।’

‘এখন ভাত, ভর্তা কোথায় পাবো বাটারফ্লাই?’

‘কোনো রেস্টুরেন্টে চলুন।’

‘না।’

‘তাহলে বাড়ি চলুন।’

‘আর পাঁচ মিনিট।’

‘আমি আর পারছি না।’

ইনান পেট চেপে ধরে বলল। অগত্যা জেহফিলকে কাজ ফেলে উঠতে হয়। কয়েকটা ফাইল হাতে নিয়ে বলল,

‘তুমি ব্যাগ গুছাও। আমি যাবো আর আসবো।’

জেহফিল ইনানের হাত ছেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ইনান তাড়াতাড়ি হাত পানিতে ভেজাল। গরমে আর ঘামে হাতের অবস্থা বেহাল, তার উপর কী টাইট করে ধরে রেখেছিল জেহফিল।

‘হ্যালো বাটারফ্লাই।’

অপরিচিত কারো কণ্ঠে জেহফিলের দেয়া নিকনেমে ডাকায় চমকে উঠে ইনান। পেছন ফিরে দেখে তাজবীর প্যান্টের পকেটে হাত পুরে দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রথম জেহফিল ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের মুখে বাটারফ্লাই ডাক শোনায় ইনানের অদ্ভুত লাগল, সাথে বিরক্তিও।

‘কী চাই?’

‘তার মানে আপনার নাম বাটারফ্লাই?’ মিষ্টি হেসে বলল তাজবীর, হাসার কারণে টোল পড়ে ডান গাল দেবে গেল।

ইনান কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,

‘আমার নাম ইনান। বাটারফ্লাই আমার হাজব্যান্ডের দেয়া নিকনেম।’

‘ইনান থেকে বাটারফ্লাইটাই বেশি স্যুট করে আপনাকে। বাই দ্য ওয়ে, আমাকে চিনেছেন? ওই যে ঐদিন হেল্প করেছিলাম..’

‘কী বলবেন সেটা বলুন।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাজবীর, নিচের ঠোঁট কামড়ে বলল, ‘বলার তো আছে অনেক কিছুই। বাট আই ডোন্ট থিংক কথা বলার জন্য এই প্লেসটা উপযুক্ত।’

‘তাহলে আপনার সাথে আমার কোনো কথাই নেই। প্লিজ লিভ।’

‘হোয়াই সো রুড বাটারফ্লাই?’

‘ডোন্ট কল মি বাটারফ্লাই।’ কঠিন গলা ইনানের।

তাজবীর যেন মজা পেল, এক পা এগিয়ে বলল,

‘কেন বাটারফ্লাই? এই নামে ডাকা কি নিষিদ্ধ আমার জন্য বাটারফ্লাই?’

প্রতিটা লাইনে এই নামে ডাকায় ইনানের মাথা গরম হয়ে গেল। সে উদ্যত হলো কিছু বলার জন্য কিন্তু থেমে গেল দরজার নিকটা কারো ছায়াকে এগিয়ে আসতে দেখে। শিট! জেহফিল আসছে। এখন তাজবীরকে তার কাছাকাছি দেখলে আবার না জানি পড়ালেখা সত্যি সত্যি বন্ধ করে দেয়, সাথে আবার কোনো শর্ত আরোপ করে!!

ইনান তাজবীরকে দু হাতে জোরে ধাক্কা মেরে পাঁচ ফুট দূরত্বে চেয়ারে বসে পড়ল।

আচানক ধাক্কায় তাজবীর ‘আরে বাটারফ্লাই…’ বলে প্রায় পড়ে যেতে নিচ্ছিল।

মেঝেতে মাথা আঘাত করার আগেই বেঁচে গেল কারো কোলের মধ্যে পড়ায়। দেখল জেহফিল রাশভারী মুখে তাকে দুহাতে আগলে আছে। তবে সেই আগলিয়ে রাখাটা মাত্র এক সেকেন্ডের জন্য ছিল যখন জেহফিল তাজবীরের মুখে বাটারফ্লাই ডাকটা শুনল। সে হাত সরিয়ে নিলো তাজবীরের পিঠ থেকে, যার ফলে ধরাম করে ফ্লোরে বারি খেল তাজবীর।

জেহফিল কঠিন আকৃতির মুখাবয়ব ধারণ করে তাজবীরের নিকট চেয়ে ছিল। তার রাগের আগুন জ্বলে উঠল। সেই উত্তাপ টের পেল ইনান। ইনান আঁচ করল রাগ বাড়তে থাকলে জেহফিল ভয়াবহ কোনো কাণ্ড ঘটাতে পারে। জানে কেন তার এমন মনে হলো, তবে জেহফিলকে দেখে মনে হলো এক্ষুণি লঙ্কাকাণ্ড বাঁধাবে। যদি জেহফিল ভাবে তাজবীরের সাথে ইনানের ভালো সম্পর্ক আছে? কিংবা ইনান তাজবীরের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে, এসব ভাবনা জেহফিলের মাথায় আসলে ইনান শেষ হয়ে যাবে।

তাই ইনান উঠে জেহফিলের হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসল। তাজবীরকে তিরস্কার করতে আরম্ভ করল যাতে জেহফিল ভাবে ইনানের সাথে তাজবীরের আসলেই কোনো সম্পর্ক নেই।

তাজবীর মাথা ধরে ফ্লোর থেকে উঠতে নিলে হঠাৎ জেহফিল এসে তার কলার চেপে ধরে উঠিয় দেয়। ইনান চমকে গেল জেহফিলের হঠাৎ কাজে, সে দৌড়ে যায় জেহফিলের কাছে।

জেহফিল তাজবীরের কলার ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ও’কে বাটারফ্লাই ডাকার অধিকার একমাত্র আমার। তোর মতো লো স্ট্যাটাসের কোনো রাইট নেই আমার জিনিসকে আমার দেয়া নামে ডাকার।’

এই বলে সে তাজবীরের গলা চেপে ধরল শক্ত করে, ‘আর একবার ও’কে বাটারফ্লাই বলে ডাকলে এই গলা আর তোর শরীর, দুটোই থাকবে দুই জায়গায়।’

তাজবীরে গলা ধরে রুম থেকে ধাক্কা মেরে বের করে দিলো জেহফিল। জেহফিলের রাগ বেশিদূর গড়ানোর আগেই ইনান জেহফিলকে টেনে নিয়ে বের হয়ে আসলো।

তাজবীর ফ্লোর থেকে উঠে ওদের চলে যাওয়া দেখল। তবে জেহফিলের রূঢ় দৃষ্টি প্রতিটা মুহুর্ত তাজবীরকে হুমকি দিতে লাগল যতক্ষণ না তারা গাড়িতে উঠে চলে গেল। তাজবীর ঘাড় মটকে রেলিংয়ে হাত রাখল। এই প্রথম জেহফিলের অগ্নিমূর্তির সাথে পরিচিত হলো ও। তবে অপমানটা দ্বিতীয় ছিল‌। দ্বিতীয়বারের মতো তাকে আবার অপমান করল, তাও তুই তোকারি করে আর তার স্ট্যাটাসকে নীচু করে। তাজবীরের চোয়াল শক্ত হলো। একটা মেয়ের সামনে জেহফিলের করা বাজে অপমানটা মেনে নিতে পারল না সে।

তাজবীর ভাবল, জেহফিলের নিজস্ব জিনিস বলতে কিছু আছে তাহলে। যেটায় হাত বাড়ালে জেহফিল রেগে যায়। বোধহয় সেই জিনিসটাকে ব্যবহার করেই জেহফিলকে শাস্তি দেয়া যাবে! এতে তার রিভেঞ্জ নেওয়াও হবে। ভাবতেই তাজবীরের ঠোঁটে তীর্যক হাসির দেখা মিলল।

.

.

সন্ধ্যায় বাসায় আসার পর জেহফিলের মুড ভালো হলো কিছুটা। তার কারণ অবশ্য ইনান। ইনান জেহফিলকে সারা রাস্তা তাজবীরকে গালি দিতে দিতে এসেছে, যাতে জেহফিল আশ্বস্ত হয় ইনান তাজবীরের প্রতি ইন্ট্রেস্টেড না।

জেহফিল রান্নাঘরে কিছু একটা করছে, গায়ে অ্যাপ্রোন জড়িয়ে ছুরি দিয়ে কাটাকুটি করছে। ইনান রান্নাঘরে এসে সাবধানের সাথে কথা বলল,

‘মোবাইলটা দেয়া যাবে?’

‘কেন?’

‘বাবার সাথে কথা বলব..’

জেহফিল ঝট করে তাকাল ইনানের দেখে, তা দেখে ইনান দ্রুত হাত নাড়িয়ে বলল, ‘আপনি না বলেছিলেন নির্দিষ্ট টাইম দিবেন।’

জেহফিল বিনা বাক্যে মোবাইল দিলো ইনানকে। ইনান খুশি মনে বারান্দায় চলে আসলো। নাম্বারে ডায়াল করা মাত্র কারো গরম নিঃশ্বাস ইনানের ঘাড়ে পড়ল। ইনানের দুই পাশে দুটো হাতের দেখা মিলল। এক হাতে মসৃত বড় ছুরি। মাথা ঘুরিয়ে দেখে জেহফিল তার কাছে। হঠাৎ আসায় ইনান ভয় পেয়ে গেল, বুকে থুতু দিয়ে বলল,

‘কিছু বলবেন?’

এর মধ্যে ইনানের বাবা ফোন ধরেছে‌। জেহফিল ইশারা করল লাউড স্পিকার অন করতে। ইনান হেজিটেট হয়ে অন করে কথা বলল। বাবার সাথেই কথা বলার পুরোটা সময় জেহফিল ইনানের কাছ থেকে এক পাও নড়ল না। ইনান যদিও খুব ইতস্ততবোধ করে বাবার সাথে কথা বলেছিল। কথা শেষে জেহফিল মোবাইল নিয়ে নেয়।

‘এখন থেকে যা বলবে সব লাউড স্পিকার দিয়ে বলবে।’ গম্ভীর গলায় শুধায় জেহফিল।

বাড়াবাড়ি মনে হলো ইনানের। তবে কিছু বলতে পারল না জেহফিলের হাতের ছুরি দেখে।

রাতের বেলা ইনান পড়া শেষ করে ডাইনিং এ গেল ডিনারের জন্য। টেবিলে রাখা খাবার দেখে বিস্মিত হলো সে। জেহফিল ছয় পদের ভর্তা আর ডাল করেছে। তখন তো সে মিথ্যামিথ্যি বলেছিল। জেহফিল মনে রেখেছে?

জেহফিল কিচেন থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে আসলো। ইনানকে চেয়ারে বসিয়ে প্লেটে ভাত বেড়ে দিলো।

‘কোনটা দিয়ে শুরু করবে? মাছ ভর্তা, মরিচ ভর্তা, চিংড়ি…’

তারমানে সন্ধ্যা থেকে জেহফিল রান্নাঘরে তার জন্য, তার কথামতো খাবার তৈরিতে ব্যস্ত ছিল! শুধু ইনান একবার মুখ ফুটে বলেছিল তার কী খেতে ইচ্ছে করছে!! ইনান চোখ বন্ধ করল। এই ছোটো ছোটো কেয়ারগুলোর কারণেই জেহফিলের প্রেমে পড়েছে সে। জেহফিলের প্রতিদিনের অদ্ভুত আচরণের মাঝে এই যত্নগুলোই ইনানকে বেঁধে রেখেছে। যতবার জেহফিল ইনানের ছোটো ছোটো প্রতিটা ব্যাপারে খেয়াল রাখে, ততবারই ইনানের মনে হয় এটাই জেহফিলের আসল রূপ, অন্য যেই কঠিন, অ্যাগ্রেসিভ রূপ, সেটা ভ্রম। আর এই কেয়ারগুলোর কারণেই ইনান প্রতিবার ভুলে যায় জেহফিলের করা কাজ গুলো…ফের ভালোবাসা জন্মে তার প্রতি। মেয়েদের মন এত কোমল কেন?

.
.
চলবে…

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_২৫
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

[বিরক্তির এলার্ট🚩🚩]

[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.

জেহফিল বাথরুমের দরজায় জোরে জোরে ধাক্কাচ্ছে। যেন এক্ষুণি দরজা ভেঙে ফেলবে। সে এইপাশে থেকে ইনানকে হুমকি দিচ্ছে বেরিয়ে আসার জন্য। ইনান ঝরণার নিচে গত আধঘন্টা ধরে বসে আছে। ফুঁপিয়ে কান্নার দমকে তার শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠছে। জেহফিল বদলায়নি… ইনান আসলেই পাগল যে কিনা জেহফিলের গত কালকের মুখোশ পরা ভালো রূপে মুগ্ধ হয়ে মুখোশের আড়ালের জেহফিলকে ভুলেই গিয়েছে।‌ কাল রাতেও জেহফিলের ধ্বংসাত্মক রূপের কথা মনে পড়েনি তার। অথচ রাত পেরোতেই জেহফিলের আগের রূপ ফিরে এসেছে।

পাগল হয়ে যাচ্ছে ইনান। সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছে। জেহফিলের পূর্ণাঙ্গ পাগলামি সহ্য করার আজ এক সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহে ইনান যদি একটু শান্তি পেত… জেহফিল শ্বাস নেওয়াটাও হারাম করে দিয়েছে তার। এক মিনিট ভালো থাকলে দশ মিনিট হিংস্র থাকে জেহফিল। ইনান সহ্য করতে পারছে না। কতশত নিয়ম জারি করল তার উপর। কী কারণে?? কারণ ইনান জেহফিলকে লুকিয়ে ইনান ভার্সিটি গিয়েছিল, জেহফিল জানত না এই ব্যাপারে, জেনেছে ইন্সটায় এক ফ্রেন্ডের স্টোরিতে। এটা কি তার পাপ হয়েছে? সে কি খুব বড় অপরাধ করে ফেলেছে? ইনান ভেবে পায় না।

জেহফিল এখন আর একাডেমিতে যায় না। তার ক্লাস থাকে সপ্তাহে একটা। ফলস্বরূপ ইনানকেও প্রতিদিন ক্লাস থাকা স্বত্বে জেহফিলের সাথে সপ্তাহে একদিন ক্লাস করতে হয়। জেহফিল এখন সপ্তাহের ছয় দিনই বাসায় থাকে। আর যতক্ষণ বাসায় থাকে ততক্ষণ ইনানের নিঃশ্বাস নেওয়াটাও হারাম হয়ে যায়। জেহফিলের জন্য হৃদমাঝারে থাকা ভালোবাসা চাপা পড়ে গেছে জেহফিলের অত্যধিক আধিপত্যের কারণে‌। একশোটা কাজের মধ্যে নিরানব্বইটা কাজ জেহফিলের অনুমতি নিয়ে করতে হয়, তাও জেহফিলের পছন্দ মতো‌।

এইতো সেদিন, ইনান বই পড়ছিল। টান টান উত্তেজনাপূর্ণ থ্রিলার বই। প্রতিটি লাইনে লাইনে টুইস্ট। ইনান খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল। জেহফিল তার পাশে এসে তার কোলে মাথা রেখে শুয়েছিল। আর কী কী যেন বলছিল, ইনান পড়ায় মনোযোগ থাকায় ধ্যান দেয়নি। সেই জের ধরেই জেহফিল হঠাৎ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। তার থেকেও বেশি বইকে প্রায়োরিটি দেয়ায় জেহফিল ইনানের হাত থেকে বইটা টেনে দুইভাগ করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ইনান নিজেও রাগান্বিত হয়ে জেহফিলের ক্রোধান্বিত রূপের বিপরীতে তর্কে জড়িয়ে যায়। এটাই ছিল তার সবচেয়ে বড় ভুল।

এক কথা, দুই কথা বলতে বলতে ঝগড়া বেঁধে যায়। ঝগড়াটা মূলত একতরফা ছিল। জেহফিল ভস্মীভূত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা ছাড়া মুখ দিয়ে রা করেনি। ইনানের মেজাজ তখন চড়ে ছিল। ইচ্ছেমতো জেহফিলকে কথা শুনিয়েছে। জেহফিলের ব্যবহার নিয়েও কথা তুলেছে… শুধু তাই না, ইনান জেহফিলকে এও বলেছে যে বাবা মা না থাকার ফলে সন্তানের বখে যাওয়ার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে জেহফিল। আরো অনেক হার্ট করার মতো কথা বলেছে‌। সবচেয়ে বড় কথাটা ছিল জেহফিলের বিষাক্ত ভালোবাসার দিকে আঙুল তোলার… যেটা শোনার পর জেহফিল শান্ত থাকতে পারেনি, যা ইনানের জন্য কাল রাত্রির সমান ছিল।

অকল্পনীয় কাজ করেছিল জেহফিল, সেদিন‌ রাতে। ইনানকে কোলে তুলে বাড়ির ব্যাক ইয়ার্ডে এসে তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দেয়‌। ইনানের পছন্দের বইগুলো তাকে তাকে সাজিয়ে রাখা, যেগুলো ইনানের সবচেয়ে পছন্দ। সেই বইগুলো এনে জেহফিল একটা একটা করে পেজ ছিঁড়তে থাকে ইনানের সামনে। ইনান যখন জেহফিলকে বাঁধা দিতে যায় জেহফিল ইনানকে চেয়ারে বসিয়ে দুই হাত পেছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ দিয়ে আটকে রাখে। যা ইনানের চিন্তার বাইরে ছিল। তারপর জেহফিল প্রত্যেকটা বইয়ের পেজ ছিঁড়ে স্তূপ করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তা দেখে ইনানের মনে হলো তার হৃদয় কেউ মোচড় দিয়ে ধরেছে। এত যন্ত্রণা… তার প্রিয় বইগুলোর পেজ ধীরে ধীরে ছাই হয়ে যাওয়ায় ইনান প্রায় কেঁদে উঠল। এই বইগুলো ইনান বাচ্চাদের মতো আগলে রেখেছিল..

দাউদাউ করে জ্বলা আগুনের এক পাশে ক্রন্দনরত মানবী আরেক পাশে শান্ত চোখে চেয়ে ক্রুর হাসতে থাকা নিষ্ঠুর মানব..

সেই ঘটনা মনে পড়লে ইনান এখনো কেঁপে উঠে।

‘বাটারফ্লাই, যদি তুমি তিন সেকেন্ডের মাথায় দরজা না খুলো সিরিয়াসলি আ’ম গনা ব্রেক দিজ ডোর।’ জেহফিল কঠিন স্বরে হুমকি দিলো।

‘এক…’ শীতর গলা জেহফিলের।

ইনান হাটু মুড়ে তাতে মাথা দিয়ে আছে।

‘দুই…’

ইনান ক্লান্ত অথচ ভয়ার্ত চোখে দরজায় দৃষ্টিপাত করল। পায়ে শক্তি জোগাড় করে ধীরে ধীরে উঠল।

‘তিন…’

জেহফিল প্রস্তুতি নিলো দরজা ভাঙার। যেই না দরজায় আঘাত করবে অমনি দরজা খুলে ইনান বেরিয়ে আসে। ইনান যে আসতে বাধ্য.. দরজা বন্ধ করলেও জেহফিল থেকে বাঁচতে পারবে না.. না বন্ধ করলেও পারবে না.. তার চেয়ে ভালো নয় কি দরজা খুলে শিকারির কাছে নিজেকে তুলে দেওয়া? এতে যদি তার উপর ঝড় কম যায়…!

জেহফিলের হার্ট যেন এতক্ষন গলার কাছে এসে পড়েছিল, তার বাটারফ্লাইকে আধঘন্টা দেখতে না পারায়। কোনো সাড়া পাচ্ছিল না সে। খবরে কত কিছু দেখায়.. শ্যাম্পু, হারপিক, এসব খেয়ে যদি বাটারফ্লাই উল্টোপাল্টা অ্যাকশন নেয়?? তখন জেহফিলের কী হবে? সে কীভাবে বাঁচবে? এই দুনিয়াতে যে তার বাটারফ্লাই ছাড়া সে নিঃস্ব!

ইনানকে দেখা মাত্রই জেহফিল শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ইনানের ভেজা শরীরের ফলে জেহফিলও ভিজে যাচ্ছে। সেদিকে তার খেয়াল নেই। তার খেয়াল শুধু তার বাটারফ্লাই। বাটারফ্লাইয়ের নিঃশ্বাস…

এত শক্ত করে ধরেছে সে যে ইনানের মনে হচ্ছে তার হাড্ডি সব গুঁড়া গুঁড়া হয়ে গেছে। শ্বাস নিতে এত কষ্ট হচ্ছিল!! জেহফিল ইনানকে ছাড়লে ইনান শ্বাস নেওয়ার জন্য দম টানল, তার আগেই জেহফিল তার সারা মুখে চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগল। একটা নয়, দুটো নয়, তিনটে নয়.. অসংখ্য চুমু… এক মিনিট.. দুই মিনিট.. পাঁচ মিনিট গেল, গুণে গুণে আট মিনিট গেল তাও জেহফিল থামল না।

ইনান ছাড়ানোর জন্য কত হাত নাড়ল, জেহফিল হাত চেপে ধরল, পা নাড়ল, জেহফিল পায়ের উপর দুই পা দিয়ে আলগাভাবে চেপে ধরল, মাথা নাড়ল, জেহফিল ঘাড়ে হাত রেখে ঠোঁট চেপে ধরল…

পরিশ্রান্ত ইনান জেহফিলের পাগলামি সইতে না পেরে ঢলে পড়ল জেহফিলের বুকে। থামল জেহফিল। ভারী শ্বাস নিতে নিতে ইনানের ঘাড়ে চুমু খেয়ে কোলে তুলে নিলো। ইনানকে খাটে শুইয়ে ভেজা কাপড় খুলে নিজেও কাপড় ছাড়ল। ইনানের স্নিগ্ধ দেহ চাঁদের কোমল আলোয় এত মনোহর লাগল যে জেহফিলের ইচ্ছে করছে এক্ষুনি ইনানেতে ডুব দেয়। কিন্তু সেই ইচ্ছে ধূলিসাৎ হলো একটা কারণ… চাঁদ। জানালা ভেদ করে আসা চাঁদের নরম আলো ইনানের বক্ষ বিভাজন আর উদরে এসে খেলা করছিল। তা দেখে জেহফিলের আবেশিত চোখে ভর করল হিংসা। তার বাটারফ্লাইয়ের লুকায়িত সৌন্দর্যে ঢাকা অঙ্গগুলোয় অধিকার তার। চাঁদের কেন থাকবে… এত কেন সাহস চাঁদের? চাঁদের সাহস কত তার বাটারফ্লাইয়ের দিকে নজর দেওয়ার?

জেহফিল চোখে হিংসার আগুন জ্বালিয়ে চাঁদের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। তার ক্ষমতা থাকলে এক্ষুনি গিয়ে চাঁদকে ধ্বংস করে দিতো তার বাটারফ্লাইকে আবেদনের সাথে দেখার কারণে।

জেহফিল গিয়ে পর্দা টেনে দিলো ভালোভাবে। যাতে এক টুকরো আলোও ইনানকে না ছুঁতে পারে। এগিয়ে আসলো বাটারফ্লাইয়ের কাছে।

‘আমার বাটারফ্লাই…’ ঘোর লাগা কণ্ঠ তার। ইনানের হাত নিয়ে রাখল জেহফিলের বুকের উপর, ‘তুমি শুধু আমার তাই না? বলো না.. কী হলো সোনা…বলো যে তুমি শুধু আমার…এই জেহফিলের।’

অচেতন ইনানের কানে জেহফিলের বলা বাক্য পৌঁছায় না। জেহফিল ইনানকে নিজের বিশালাকৃতির দেহের মাঝে লুকিয়ে ফেলল। ইনানের চুলে মুখ ডুবিয়ে রাখল প্রায় অনেকক্ষণ। ইনানের ঘ্রাণ নেয়া শেষে তাকে বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। মোহাবিষ্ট চাহনি তার ইনানের মনকাড়া মুখশ্রীতে নিবদ্ধ…

.

.

মাঝরাতে ইনানের ঘুম ভেঙে যায় অক্সিজেনের অভাবে। চোখ খুলে দেখতে পায় জেহফিলের বুকের মাঝে আবদ্ধ সে। শ্বাস নেয়ার উদ্দেশ্যে নড়ে উঠে সে। তাতেই জেহফিলের ঘুম ভেঙে যায়।

‘উমম…বাটারফ্লাই, নড়ছো কেন?’

জেহফিলের ঘুম জড়ানো কণ্ঠে এতটা আবেদন মিশে ছিল যে ইনান তক্ষুনি জেহফিলের কণ্ঠের প্রেমে পড়ে যাচ্ছিল। সামলায় সে নিজেকে। তার পাশে যে শুয়ে আছে সে একজন মনস্টার ছাড়া কিছুই না। যার হৃদয় নেই। অমানুষ একটা।

ইনান সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিলো জেহফিলকে। ধাক্কার চোটে প্রায় পড়ে যেতে নেয়। পুরোপুরি ঘুম ছুটে যায় তার। অস্থির চিত্তে ডেকে উঠে ইনানকে,

‘বেবি, তোমার কিছু হয়েছে? ব্যথা পেয়েছ কোথাও? দুঃস্বপ্ন দেখেছ…’

নিজে যে পড়ে যাচ্ছে সে খেয়াল নেই এসেছে ইনানের খোঁজ নিতে। ইনান চাদর জড়িয়ে উঠে বসল। নিজের বিবস্ত্র অবস্থা দেখে বক্র চোখে জেহফিলের দিকে তাকায়। জেহফিল বুঝতে পারে ইনানের কথার মানে,

‘ডোন্ট অরি। জাস্ট ভেজা জামা কাপড় খুলেছি, নাথিং এলস।’

ইনান চাদর জড়িয়ে উঠতে নিলে জেহফিল তার হাত চেপে ধরে,

‘চাদর জড়িয়েছো কেন?’

ইনান হতবুদ্ধি হয়ে তাকায়, ‘সরি?’

জেহফিল খাটে বসে ইনানের কোমর জড়িয়ে ধরে। তার চাদর সরাতে সরাতে বলল,

‘আ’ম ইওর হাজব্যান্ড। আমাদের ইন্টিমেট হয়েছে অনেক, অনেকবার। তাই আমার সামনে নিজেকে হাইড করার কোনো কারণ দেখছি না বাটারফ্লাই। তুমি আমার সামনে এর আগেও নেকেড ছিলে যখন তোমার নেকেড আর্ট করছিলাম। চাদর গায়ে হাঁটার দরকার নেই। এর মানে তুমি নিজেকে আড়াল করতে চাচ্ছ আমার থেকে। আমাদের কি আড়াল হওয়ার মতো সম্পর্ক?’

জেহফিল একটু থেমে আবার বলে, ‘তুমি আমার ওয়াইফ। ইউ ক্যান মুভ ফ্রিলি অ্যারাউন্ড মি। হেজিটেট ফিল করার প্রয়োজন নেই। তুমি চাদরটা দেহে এমনিতেই ফেলে রাখলে একটা কথা ছিল, কিন্তু তা না করে এমনভাবে চাদর দিয়ে নিজেকে ঢেকেছ যেন তুমি পরপুরুষের সামনে। এই আচরণ কি গ্রহণযোগ্য?’

ইনান এক কান দিয়ে কথা ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিলো। সে জেহফিলের হাত চাদর থেকে ঝটকা মেরে সরিয়ে নিজের জামাকাপড় খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেল।

‘ইউ আর অ্যাভয়েডিং মি বাটারফ্লাই। কনসিকুয়েন্স ভালো হবে না বলছি।’ জেহফিল ওয়ার্ন করল।

ইনান তাও শুনল না। যতই হোক, বিবস্ত্র অবস্থায় থাকাটা তার জন্য অনেক লজ্জাজনক। সেদিন আবেগের বশে জেহফিলের সামনে ঐ অবস্থায় ছিল। আজ সেই আবেগ জেহফিল নিজেই ধামাচাপা দিয়ে দিয়েছে।

ইনানকে কথা অমান্য করতে দেখে জেহফিল উঠে গিয়ে তার চাদর ধরে টান মারল। খুলে গেল ইনানের শরীরে থাকা চাদর। এমন না যে জেহফিল ইনানকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখতে চাইছে। সে শুধু মাত্র ইনানকে ফ্রি হয়ে চলতে বলেছে। আর সেটা রিজেক্ট করার মানে ইনান তার সাথে ফ্রি না। এই ফ্রি না হওয়ার কথা মাথায় আসতেই জেহফিল বিরক্ত হয়, ইনানকে প্রতিবাদ করার সুযোগ না দিয়ে তাকে খাটের উপর শুইয়ে এক হাত হেডবোর্ডের সাথে বেঁধে দিলো ওড়না দিয়ে। আরেকহাত নিজের হাতের মুঠোয় চেপে ধরে ইনানের কাছে এসে বলল,

‘আমাকে ইগ্নোর করার দুঃসাহস দেখাতে আসবে না সোনা। আজকে লাইট পানিশমেন্ট দিচ্ছি। পরেরবার হার্ড স্টেপে যাব…’

ইনানের পেটে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করল জেহফিল। ইনান হাত নাড়িয়েও খুলতে পারল না, এত শক্ত বাঁধন। ইনানকে টানাটানি করতে দেখে জেহফিল আচমকা ইনানের পেটে কামড় দিলো, যেই কামড়ে ইনানের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করল।

ইনান ঠিক মতো কাঁদতেও পারল না। তার আগেই জেহফিল ইনানের মুক্ত হাত ধরে নিজের চুলে রেখে আদেশ করল,

‘হাত বুলিয়ে দাও লাভ। ছোটোবেলায় তোমার মা যেভাবে ছড়া শুনাতো ঠিক সেভাবে টুইংকেল টুইংকেল ছড়া শুনিয়ে আমাকে ঘুম পাড়াও তো।’

ইনান হাত শক্ত করে রাখল। জেহফিল তা দেখে ইনানের হাত চেপে ধরে নিজের চুলের কাছে নিলো। নিজেই ইনানের হাত ধরে নিজের চুলে বুলাতে লাগল। তার জ্বলন্ত দৃষ্টি ইনানের ভেজা চোখে নিবদ্ধ রেখে বাঁকা হেসে নিজেই ছড়া কাটতে আরম্ভ করল, এই গভীর রাতে জেহফিলের কণ্ঠ এত ভয়ানক লাগল যে ইনানের শিড়দাঁড়া বেয়ে আতঙ্কের শীতল স্রোত বয়ে গেল,

‘টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার,
হাউ আই ওয়ান্ডার হোয়াট ইউ আর…’

.
.
চলবে…