রোদরঞ্জন পর্ব-২৮+২৯

0
177

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_২৮
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.

আজ সূর্যের দেখা মিলল না। আকাশ ঢেকে আছে ধোঁয়াটে মেঘে। শীত শীত আবহাওয়া। এই শীতল আবহাওয়ায় খোলা ক্যাফেতে বসে আছে রুহি। রাগে কাঁপছে। অতিরিক্ত রেগে গেলে সে কান্না করে দেয়। এখনও তাই হলো। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তবে মুখে তেজের আগুন। শরৎ তার পাশে বসে বোনকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। রুহির রক্ত বর্ণ চোখ নিবদ্ধ সামনের চেয়ারে নির্বিকারভাবে বসে কফিতে সিপ দেয়া পলকের উপর। তার ধ্যান রুহি কিংবা শরৎএর উপর নেই। সে চোখ ছোট ছোট করে কফির মগকে পর্যবেক্ষণ করছে।

‘তার মানে তুমি…’ হেঁচকি দিতে দিতে বলল রুহি, ‘তুমি ইনানকে পছন্দ করো?’

‘নাহ।’ মাথা তুলে রুহির রাগান্বিত সুশ্রী চেহারায় দৃষ্টিপাত করল পলক, ‘একটু ভুল হয়েছে। আমি ইনানকে ভালোবাসি।’

শরৎএর হাত মুষ্টিবদ্ধ হলো। রুহি এক হাত ভাইয়ের হাতের উপর রেখে ইশারায় থামতে বলল।

‘লজ্জা লাগলো না নিজের হাঁটুর বয়সীর একটা মেয়েকে ভালোবাসতে?’

পলক হাসে, ‘ওর আর আমার বয়সের পার্থক্য সর্বোচ্চ বারো কী তেরো হতে পারে। বর্তমানে এটা নরমাল।’

‘কীভাবে পারলে পলক? তোমার কি আমার কথা একবারও মনে পড়েনি? যদি আমাকে সত্যিকারের ভালোবাসতে তাহলে ব্রেকাপের এক বছরের মাথায় অন্য কারো মায়ায় জড়াতে না তুমি। আমি নিজেও এখনো মুভ অন করতে পারিনি আর তুমি!’

‘মুভ অন করতে পারোনি কিন্তু ডিরেক্টরদের বিছানায় ঠিকই যেতে পেরেছ।’ বাঁকা হেসে বলল পলক।

শরৎ চেয়ার ছেড়ে তেড়ে আসলো, ‘কী বললি তুই!’

রুহি শরৎএর হাত ধরল। গরম চোখে তাকিয়ে পলককে বলল,

‘আমাকে নিয়ে একটা বাজে কথাও বলবে না। এসব আলতু ফালতু খবর তোমাকে দেয় কে?’

পলকও উঠে দাঁড়ায়। রুহির মুখোমুখি হয়ে বলল,

‘পুলিশ কখনো প্রমাণ ছাড়া কথা বলে না। তোমার নোংরামির সব ছবি আমার কাছে আছে। নেহাৎ তোমাকে সত্যিকারের ভালোবেসেছিলাম তাই এক্সপোজ করিনি। তোমার মতো চিটারের মুখে আর যাই হোক ভালোবাসার কথা মানায় না। রিলেশনে থাকা অবস্থাতেই তুমি উপরে উঠার জন্য যে পরিচালকদের বিছানায় গিয়েছ তার প্রমাণও আমার কাছে আছে। তুমি চাইলে দেখাতে পারি। দেখাবো?’

অপমান এবং ভয়ে রুহির মুখটা এইটুকুনি হয়ে গেল। ছোটো ভাইয়ের সামনে এমন অপমানেও বিব্রত হয়ে গেল সে। তাই কথা ঘুরালো তাড়াতাড়ি,

‘যাইহোক, তোমার সাথে আজেবাজে প্যাঁচাল পেড়ে লাভ নেই। তুমি যে সারাদিন ইনান ইনান করো সেই ইনানের যে বিয়ে হয়ে গেছে সেই খবর নিশ্চয়ই তোমার কানে পৌঁছেছে! লজ্জা করে না একটা বিবাহিত মেয়ের পিছনে কুত্তার মতো ঘুরত?’

‘তোমার লজ্জা করল না চার বাচ্চার বুড়ো বাপের বিছানায় পা ছড়াতে?’

রুহি দমে গেল। মুখ লাল হয়ে গেল অপমানে। ভেবেছিল পলককে ইনানের কথা বলে অপমান করবে, তা তো হয়ইনি বরং রুহির সত্যগুলো সামনে এনে তাকেই অপমান করছে!

রুহি একটা কথাও না বলে শরৎএর হাত ধরে বেরিয়ে গেল ক্যাফে থেকে। সে এসেছিল পলকের সাথে প্যাচাপ করার জন্য। জীবনে পলকের মতোই একজন খাঁটি মানুষ পেয়েছিল। কিন্তু হীরাকে কাঁচ ভেবে দূরে সরিয়ে দেওয়াটাই তার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতেই পলককে আবার নিজের জীবনে ফেরাতে চেয়েছিল। কিন্তু পলক যে অজানা কিছু সত্যি জেনে যাবে সেটা ভাবতেও পারেনি রুহি। আর এই সত্যের পর নিশ্চয়ই তাকে আর গ্রহণ করবে না?

যদি পলকের জীবনে ইনান না আসতো তাহলে রুহি পলকের পা ধরে হলেও নিজের দিকে ঘুরাতো। অতীতের প্রেমের জের ধরে পলকও নিশ্চয়ই মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারত না। ইনানই যত নষ্টের গোড়া। ইনানের কারণে পলককে পেয়েও হারালো সে। চোয়াল শক্ত হয়ে গেল রুহির। শরৎকে ধরে নিজের দিকে ফিরালো।

‘তোর ইনানকে চাই তাই না?’

শরৎ মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়িয়ে বলল,

‘ও এখন ইউজড মাল। ও’কে দিয়ে এখন আর কী বাল করব? সেকেন্ড হ্যান্ড মালকে বিয়ে করে লাভ নেই।’

‘বিয়ের জন্য না।’

শরৎ সরু চোখে বোনের দিকে চাইল। রুহির চোখে অন্য কিছুর ইঙ্গিত। দুই ভাইবোন চোখে চোখেই ষড়যন্ত্রের ছক কষে ফেলল।

.

.

ইনান মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে ফারাদের বাসার সিঁড়ির সামনে। আজ বড় একটা সর্বনাশ হয়ে গেছে তার। কাল রাতে পালিয়ে এসে নিজের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। মেইনরোডে তার ব্যাগগুলো ছিনতাই হয়ে যায়। তিনটা ব্যাগ ছিলো। একটা হ্যান্ডব্যাগ, যেটায় টাকা পয়সা, বাড়ির চাবি ছিল, আরো বাকি দুইটায় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আর বাবার দেয়া গয়না। গয়না আর হ্যান্ডব্যাগ ছিনতাইকারী নিয়ে যায়।‌ ইনান বাঁচাতে পারে কাগজপত্রের ব্যাগটা।

ইনানের এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে কাছের মানুষদের নাম্বার মনে না রাখার ফল। জেহফিল আর বাবার নাম্বার ছাড়া কারো নাম্বারই মুখস্থ নেই।

মাঝরাতেই ইনান কাঁদতে কাঁদতে রওয়ানা দেয় ফারাদের বাড়িতে। হেঁটে হেঁটে সকাল সাড়ে এগারোটায় ফারাদের বাসায় আসে। এর মাঝে দোকান থেকে ধার করে মোবাইল নিয়ে ফোন করেছিল বাবাকে। পাঁচবার কল করার পর ফোন রিসিভ করে ফুফু, তিনি বলেন যে বাবার অবস্থা তেমন আবারও অসুস্থ হয়ে গেছে তাই আইসিউতে রাখা আছে। ইনান নিজের অসহায়ত্বের কথা আর বলল না। ফোন রাখার পর তার মনে হলো কিছু টাকা পাঠিয়ে দেয়ার কথা। আবারও ফোন দিলো, কিন্তু এবার আর তুলল না কেউ ওপাশ থেকে। ইনান বুঝল ফুফুর ব্যস্ততা। তার বাবাকে নিয়েই এখন হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করছেন।

এদিকে দোকানের লোকটাও মোবাইল দেয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছিল। তাই হতাশ হয়ে ইনান হেঁটে হেঁটেই ফারাদের বাসায় আসে।

দুই ঘন্টার পথ লেগেছে পাঁচ ছয় ঘন্টার মতো। ইনানের পা ব্যথায় টনটন করছে। যেন নিচের অংশ অবশ হয়ে গেছে। ফারাদের গেটের সামনে সিঁড়িতে বসে পড়ল। সকাল থেকে কিচ্ছুটি পেটে পড়েনি। সে আবার না খেয়ে থাকতে পারে না। কষ্টেসৃষ্টে উঠে ফারার বাসায় গেলে আবারও হতাশ হতে হয় তাকে। ফারাদের গেইটে তালা মারা। ইনান কান্না করে দেয় অতিরিক্ত হতাশায়। মাথার চুল চেপে ধরে। বিপদ যখন আসে চারিদিক থেকে আসে- কথাটির মানে আজ ভালো করে বুঝে গেল সে।

ইনানের দাঁড়ানোর শক্তিটাও নেই। হাঁটা তো দূরের কথা!

প্ল্যান ছিল, সে আগে বাড়ি যাবে। বাড়িতে তার এক্সট্রা ফোন আছে। বাবাকে কল করে সব খুলে বলবে। বাবা অবশ্যই তাকে কোনো সমাধান দিবে। তারপর পাসপোর্ট নিয়ে বাবার কাছে চলে যাবে। তাহলেই আর জেহফিল তার নাগাল পাবে না। ব্যস, কাহিনী খতম।

কিন্তু ভাবনা থেকে যে বাস্তবতা ভিন্ন হয় সেটা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিল ইনান। তাইতো এখন নিঃস্ব হয়ে অভাগীর মতো পড়ে আছে।

অন্যান্য ফ্রেন্ডদের বাসাতেও যাওয়া যায়, তবে তাদের বাসাতেও হেঁটে যেতে লাগবে দেড় দুই ঘন্টা। ইনানের শক্তি নেই। তাই ফারাদের খোলা উঠানের দোলনায় গেল বিশ্রাম নেয়ার উদ্দেশ্যে।

জীবন বদলেছে ইনানের। জীবনটাকে যত সহজ ভেবেছিল তারচেয়ে দশগুণ কঠিন।

ইনানের হঠাৎ মনে পড়ল জেহফিল তাকে না পেয়ে যদি ফ্রেন্ডদের বাসায় এসে খোঁজ নেয়! ইনান তড়াক করে উঠে গেল। আবার মনে পড়ল সে তো জেহফিলকে বেঁধে এসেছে। এত সহজে কি আর বাঁধন খুলবে নাকি। আবারো নিশ্চিন্তে বসল।‌ আচ্ছা জেহফিল এখন কী করছে? ইনান কি ভুল করেছে জেহফিলকে বেঁধে? যদি সত্যি সত্যি কোনোদিন বাঁধন খুলতে না পারে? সারাজীবন কি এভাবেই আটকা থাকবে? ও চিৎকার করলেও তো দুই তিন কি.মি.র ভেতর কারো দেখা পাওয়া যাবে না, কে শুনবে ওর চিৎকার? এই দুপুরেও নিশ্চয়ই জেহফিল কিছু খেতে পারেনি?

ইনানের হঠাৎ মায়া লাগল অনেক। জেহফিল কষ্ট পাচ্ছে ওভাবে আটকে থেকে!! পরক্ষণেই মাথায় আসলো জেহফিলের নির্দয় কর্মকাণ্ডের কথা। ইনান মাথা ঝাঁকিয়ে জেহফিলের প্রতি মায়া ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল। জেহফিল যা করেছে ইনান তার এক ভাগও করেনি। জেহফিল একটা নিষ্ঠুর মন্সটার। যার মায়াদয়া বলতে কিছুই নেই। খালি আছে রাগ আর নিজের প্রিয় জিনিসকে বন্দী করে রাখার চেষ্টা। জেহফিল তো ভুলেই গেছে যে ইনানো একজন রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। তার আবেগ অনুভূতির যে দাম আছে তা যেন জেহফিল জানেই না। শুধু জানে কীভাবে নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা ইনানের উপর চেপে দেয়া যায়, ইনানের হাতে পায়ে সুতো বেঁধে কীভাবে নাচানো যায়। ইনানকে শিকল পরিয়ে কীভাবে নিজের চোখের সামনে রাখা যায়!

ইনানের মাঝে মাঝে মনে হয়, মালিক যেমন কুকরকে গলায় চেইন পরিয়ে ঘুরায় ঠিক তেমনই তারা। তবে এখানে পার্থক্য হলো, ইনান মালিক, আর জেহফিল কুকুর। কেননা ইনানের কিছু সীমিত পছন্দগুলো খুশিমনে করে জেহফিল, সব ঘরের মধ্যকার পছন্দগুলো। যেমন, পছন্দের রান্না করে খাওয়ানো, ক্লে দিয়ে কিছু জিনিস বানানো, পছন্দমতো জামা কাপড় কেনা, মেকাপ কিট আরো অনেক কিছুই। কিন্তু জেহফিল কুকুর হয়েও মনিবের গলায় কলার পরিয়ে মনিবকেই হাতের মুঠোয় রেখেছে। সে যেখানে যেতে চাইবে যা করতে চাইবে, সব মনিবকে বাধ্য হয়ে করতে হবে। নাহলে মনিবকে তার ধারাল দাঁত দিয়ে কামড়ে ছিন্নভিন্ন করে দিবে। এইখানে মনিব একজন অসহায়, আর সব ক্ষমতা কুকুরের হাতে।

ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইনান। ভরসা নেই জেহফিলের, যদি কোনোরকমে বাঁধন খুলে চলে আসে। ইনানকে ধরে ফেললে কী করবে জেহফিল? তখন‌ ডিভোর্সের কথা বলায় গোডাউনে আটকে শাস্তি দিয়েছিল, এখন তো আরো বড় কাজ করেছে সে। পালিয়েছে! তাও জেহফিলকে আটকে রেখে। কী শাস্তি দিবে এখন? না না ধুর! ইনান নিজের মাথায় থাপ্পড় মারে। কীসব আবোলতাবোল ভাবনা!! সে শাস্তির কথা ভাবতেই চায় না। জেহফিল তাকে পেলেই না শাস্তি দিবে! যেটা কখনোই হবে না সেটা নিয়ে ভেবে লাভ আছে? ধুর!

বসে থাকতে থাকতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসলো। কিন্তু ফারা আর আসলো না।
ইনানের পেট ক্ষিদেয় চো চো করছে। পেটে পানি ছাড়া আর কিছুই নেই। এবার সে উঠে দাঁড়ায়। এভাবে অপেক্ষা করে লাভ নেই। জেহফিল চলে আসলে বিপদ হবে। হাঁটতে হাঁটতে হাইওয়েতে এসে দাঁড়ায়। উদ্দেশ্য মুগ্ধর বাড়ি যাওয়া। অন্যান্য ফ্রেন্ডদের তুলনায় মুগ্ধর বাসা কাছে।

রাস্তায় দুর্বল পা ফেলে ফেলে হাঁটছে ইনান। ঠিক তখনি তার পাশে কালো রঙের গাড়ি থামল। ইনান থমকে যায়। ভয় পেয়ে যায়। সে দ্রুত হাঁটতে নেয় গাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে। তার আগেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ইনানকে ঝাপটে ধরে। ইনান চাপা চিৎকার দিয়ে উঠল আচমকা জড়িয়ে ধরায়। ভাবল জেহফিল। কিন্তু লোকটির পারফিউমের ঘ্রাণ জেহফিলের না। ইনান লোকটির বুকে হাত রেখে ধাক্কা দেয় সজোরে। পলক!

‘ইনান!’ ধরা গলায় ইনানের নাম উচ্চারণ করে আবারও জড়িয়ে ধরল পলক।

পলকের কল্পনাতীত কাজে ইনান বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে থাকে। হুটহাট জড়িয়ে ধরার মতো লোক পলক না। পলকের বুকে ইনান পিষে যাচ্ছে। যেন বহুদিন পর প্রিয় মানুষকে দেখতে পেয়েছে পলক। ইনান সরিয়ে দিলো পলককে। এদিক দিয়ে খুশিও হলো সাহায্য করার মতো কাউকে পেয়ে।

‘ইনান, তুমি কোথায় ছিলে এতদিন? বিয়ে হয়ে গেছে অথচ আমাকে জানাওনি পর্যন্ত? তুমি জানো তোমার টেনশনে আমার নাওয়া খাওয়া সব বন্ধ হয়ে গেছে? প্রতিটাদিন হন্নে হয়ে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম আমি..’

পলক একনাগাড়ে আরো অনেক কথা বলে গেল। ইনানের মাথায় ঢুকল না খিদের চোটে। সে পলককে থামিয়ে দিলো।

‘আমাকে আগে মুগ্ধর বাসায় দিয়ে আসুন।’

এই বলে ইনান গাড়িতে উঠে বসল। পলকও এসে বসল ড্রাইভিং সিটে। পলক গাড়ি না চালিয়ে ইনানের দিকে তাকিয়ে রইল। তা দেখে ইনান পলকের সামনে তুড়ি বাজায়,

‘এভাবে কী দেখছেন?’

‘তোমাকে অনেক টেন্সড লাগছে। কোনো সমস্যা হলে বলতে পারো।’

ইনান মাথা নাড়ায়। ক্লান্ত গলায় বলে, ‘কোনো সমস্যা নেই। এবার চলুন প্লিজ।’

পলক মুগ্ধর বাসায় গাড়ি না নিয়ে রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামাতে দেখে ইনান ভ্রু কুঁচকে তাকায়। পলক ইনানের কুঁচকানো ভ্রু দেখে মৃদু হেসে বলল,

‘চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে সকাল থেকে কিছু খাওনি। তুমি তো না খেয়ে থাকতে পারো না।’

এই বলে ইনানের পাশের দরজা খুলে দিলো। ইনান লজ্জা পেল অনেক। তবে লজ্জার চেয়ে খিদে বেশি থাকায় সে আর নাকোচ করল না।

গপাগপ করে খেয়েই চলেছে ইনান। যেন কতদিনের অভুক্ত সে। খাওয়ার মাঝেও মনে পড়ল জেহফিলের কথা। কী করছে তার স্বামী!

পলক তার সামনের চেয়ারে বসে খাওয়ারত ইনানকে দেখে চলেছে। আগে থেকে খুব সুন্দর হয়েছে ইনান।

পেট পুজো শেষে তারা গাড়িতে এসে বসল। পলককে অনেক ধন্যবাদ জানালো সে। পলক বিনিময়ে জানতে চাইল ইনানের চিন্তার কারণ। তার মনে ইনানের হাজব্যান্ড নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। তবে সেগুলোকে সাইডে রেখে আগে ইনানের খবর নেয়াটা জরুরী।

‘প্লিজ, ইনান। আমাকে ফ্রেন্ড মনে করে সব বলতে পারো। আমি সাহায্য করার চেষ্টা করব।’

পলক অনেক রিকুয়েস্ট করল। ইনান শেষমেশ খুলে বলল আসল কাহিনী। জেহফিলের পরিচয়, কিংবা অন্য কোনো তথ্য না বলে সে শুধু স্বামী হিসেবে বলতে লাগল ঘটনা। যে তার স্বামী মানসিকভাবে অসুস্থ, তার লাইফ হেল করে দিয়েছে, সেখান থেকেই পালিয়েছে ইনান। ইনানের মুখে বারবার ‘আমার স্বামী’ শুনতে শুনতে পলকের বুকে ব্যথা শুরু হলো। এত কষ্ট কেন প্রেয়সীর মুখে অন্য কারোর নাম শুনতে পাওয়া?

পলক সিদ্ধান্ত ইনানকে সাহায্য করবে দেশ ছাড়তে। তার সুযোগ এসেছে। ইনান যদি তার স্বামীকে ছেড়ে দেয় তাহলে ইনানকে পেতে আর কষ্ট পোহাতে হবে না পলককে। ভালোবাসার মানুষকে খুব তাড়াতাড়ি নিজের করে পেতে চলেছে।

ইনানকে নিয়ে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ইনানের ফ্রেন্ডদের বাড়িতে থাকাটা রিস্ক হয়ে যাবে। ইনান প্রথমে আপত্তি জানালেও জেহফিলের কাছে বন্দির ভয়ে রাজি হয়ে যায়।

সন্ধ্যা নেমে এসেছে। চারিদিক কুয়াশাতে ঢেকে গেছে। শীতের পূর্বাভাস। পলক উৎফুল্ল চিত্তে গাড়ি চালাচ্ছে আর একটু পরপর আড়চোখে ইনানকে দেখছে। ইনানকে নিজের করে পাওয়ার খুশিতে আত্মহারা সে।

ইনান গাড়িতে হেলান দিয়ে চোখ‌ বন্ধ করে ভবিষ্যতের অনেক কিছুই ভেবে চলছে। কীভাবে কী করবে না করবে।

পলক তার বাড়ি যাওয়ার জন্য আজকে শর্টকাট পথ বেছে নিয়েছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে। ইনানের সাথে মায়ের কথা বলাতে হবে।

কুয়াশায় ঘেরা রাস্তায় নিরবে গাড়ি চালাচ্ছিল পলক। আচানক পেছন থেকে একটা গাড়ি ধাক্কা মারল। পলক ইনানের মাথা বুকে ধরল সবার আগে। গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের সাথে হাতে প্রচণ্ড ব্যথা পেল পলক, কপালেও ব্যথা পেয়েছে। গাড়ি থামায় দ্রুত। ইনানকে ঠিকভাবে বসিয়ে দেখে ইনানের লেগেছে কিনা। ভাগ্যিস ধাক্কাটা তেমন জোরে লাগেনি!

পলক রেগেমেগে গাড়ি থেকে বের হয়। এই রাস্তায় গাড়ির চলাচল নিতান্তই কম। ধাক্কা মারা গাড়িটার হেডলাইট জ্বললেও ভেতরের আলো নেভানো। হেডলাইটের তীব্র আলো চোখে বিঁধলে পলক হাত চোখের উপর নিয়ে কালো কাঁচের জানালায় হাত দিয়ে নক করে। জোরে জোরে লোকটির উদ্দেশ্যে কথা শুনিয়ে দরজা খোলার আদেশ দেয়।

ইনান মাথা ধরে গাড়ি থেকে বের হয়। পলক যদি গাড়িটা না থামাতো তাহলে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যেত। হেডলাইটের সাদা আলো চোখে পড়তেই চোখ বুজে নেয় ইনান।

‘পলক!’

পলক পেছন ফিরে ইনানকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে।

‘তুমি নামতে গিয়েছ কেন? মাথায় কি ব্যথা পেয়েছ? বেশি ব্যথা…’

কিছু একটার আওয়াজ পেয়ে ইনান পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকায়। হুট করে পলক তাকে জড়িয়ে ধরল।

‘আরে, কী করছেন?’

ইনান টের পেল পলক জড়িয়ে ধরেনি বরং তার উপর পড়ে গেছে। পলকের মাথা ইনানের কাঁধের উপর, আর হাত দুটো ঝুলে আছে। হঠাৎ পড়ে গেল কেন? মাথায় আঘাত পাওয়ার কারণে কি পড়ে গেছে?

ইনান পলকের মাথা ধরে দাঁড় করানোর চেষ্টা করতেই পলকের মাথায় ভেজা কিছুর উপস্থিতি টের পেল। হাত সামনে আনতেই দেখতে পেল র’ক্ত। আঁতকে উঠল ইনান। ঝট করে মাথায় আসলো সেই নৃশংস মানুষটির কথা।

আলোর কারণে চোখ মেলতে পারছিল না ইনান। তার উপর কুয়াশা। সেই মুহুর্তেই কুয়াশা ভেদ করে আলোর মাঝে এক লম্বা মানুষের অবয়ব দেখতে পেল। ইনানের চিনতে সেকেন্ড লাগলো না। চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। মৃগী রোগীর মতো কাঁপতে লাগল তার শরীর। নিঃশ্বাসের গতি দ্রুত হলো। শিড়দাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল।

অবয়বটি সামনে আসলো ধীর পায়ে। সামনে আসতেই তার চেহারা স্পষ্টভাবে দেখতে পেল ইনান। ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল তার, কাঁপা কাঁপা গলায় আস্তে আস্তে বলল,

‘জ…জ..জে..জেহফি…’ ইনানের গলা এত কাঁপছিল যে নামটা ঠিকভাবে শেষ করতে পারল না।

জেহফিলের ঠোঁট দুটো প্রসারিত হয়ে সুন্দর হাসিতে রূপ নিলো। হাতের কাঠের ভারী স্টিকটা কাঁধে নিয়ে কপালের এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে পেছনে নিলো। নিচের ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা বিড়বিড় করে ইনানের মুখের কাছে ঝুঁকল, খুব কাছে। ফু দিয়ে ইনানের সামনের ছোট ছোট চুলগুলো সরিয়ে চমৎকার হেসে হাস্কি ভয়েসে বলল,

‘হ্যালো বেবিগার্ল! লং টাইম নো সী!’

.
.
চলবে…

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_২৯
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.

‘পলক! পলক, এই পলক!’

কারো ফিসফিসানির আওয়াজে পলকের জ্ঞান ফিরে। তার মাথা ভার। ঝাপসা চোখ আধো আলোতে মেলে তাকানোর চেষ্টা করতেই বন্ধ করে ফেলল প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব হতেই। মাথার পেছনে শিরশির করছে ব্যথায়। আবারও শোনা যায় কারো উদ্বিগ্ন মিহি কণ্ঠের ফিসফানি,

‘এই পলক, উঠুন না। পলক!’

পলক ঘোলাটে চোখ মেলে। ঝাপসা চোখে দেখে তার ভালোবাসার মানুষটি তার খুব কাছে ঝুঁকে আছে। ইনান!‌ কথা বলার চেষ্টা করতেই গলায় কণ্ঠস্বর আটকিয়ে আসে।

‘ই..!

ইনান স্বস্তি পেল পলককে চোখ খুলতে দেখায়। সে দ্রুত পলকের হাত ধরে উঠে বসানোর চেষ্টা করে। ইনানের উপর ভর দিয়ে পলক উঠে ইনানের কাঁধের উপর ভির দেয়। আশপাশে নজর দেয়, একটা গোডাউন টাইপ জায়গায় তারা আছে। ইনানের দিকে তাকায় প্রশ্নবোধক চাহনিতে। দেখে ইনান কাঁদছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ঘামে লেপ্টে আছে কপালে। চোখমুখ শুকনো। অশ্রুর দাগ বসে গেছে গালে। কতক্ষণ ধরে কাঁদছে মেয়েটা?

‘পলক, আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে, যত দ্রুত সম্ভব।’ চারিদিক তাকাতে তাকাতে সাবধানের বাণীতে বলল ইনান।

পলক মুখ খুলল কিছু বলার জন্য, তার আগেই ইনান পলকের মুখ চেপে ধরে হাত দিয়ে। নিজের ঠোঁটে তর্জনী রেখে গলা খাদে নামিয়ে বলল,

‘জোরে কথা বলবেন না, উনি শুনে ফেলবে!’

‘তোমার স্বামী?’ ইনানের মতো করে বলল।

ইনান মাথা ঝাঁকায়, ‘উনি অনেক ভয়ানক।’

‘কোথায় সে?’

‘দোতলায়।’

পলক ইনানের কাঁধে হাত রেখে আরেক হাত পকেটে চালান করে। কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি না পেয়ে বলল,

‘আমার মোবাইল কোথায়?’

‘উনি রেখে দিয়েছেন।’ ইনান হেঁচকি তুলে বলল, ‘আমাদের হাতে সময় নেই। উনি যেকোনো সময় চলে আসবে। পালাতে হবে আমাদের পলক।’

এই ঘোর বিপদের মাঝেও পলকের ঠোঁটে হাসির ঝলক দেখা দেয়,

‘এই ফার্স্ট তুমি আমাকে আমার নাম ধরে ডেকেছ ইনান।’

ইনান বিরক্ত হয়, ‘এসব নাটকের সময় নেই। উঠুন আপনি।’

ইনান পলকের হাত ধরে উঠায়। পলক এক হাতে ইনানের কাঁধ ধরে নিজের ভারসাম্য রাখে। ইনান পলককে ধরে ধরে গোডাউনের বাইরে নিয়ে আসে।

‘কোথায় আছি আমরা?’

‘জায়গাটার নাম নেই। জঙ্গলের মাঝেই।’

‘তুমি এখানে থাকো।’

‘হু।’

পলক অবাক হয়। ইনানকে যতদূর চিনে সে খোলামেলা জায়গায় থাকতে পছন্দ করে বেশি। এই নির্জনে একলা পড়ে থাকাটা ওর পছন্দ না। ও থাকতে চায় শত মানুষের ভিড়ে।

‘কোনদিকে যাবো?’

‘রাস্তার দিকে যাওয়া সম্ভব না। উনি ধরে ফেলবে সহজে। জঙ্গলের দিকে যাওয়া যায়।’

‘জঙ্গল ধরে কোনো রাস্তা কি মেইনরোডে উঠেছে?’

‘উঠেছে মেবি। খেয়াল নেই। কিন্তু আমাদের আগে এক জায়গায় লুকিয়ে থাকা দরকার। যাতে উনি খুঁজে না পায়।’

ইনান পলককে সাথে নিয়ে জঙ্গলের পথে হাঁটা ধরল। গোধূলি আলোকে ভরসা করে।

.

তখন জেহফিল ইনানকে আর পলককে টেনেহিঁচড়ে তার গাড়িতে উঠায়। ইনান সাহায্যের জন্য অনেকবার চিৎকার করলেও ফাঁকা রাস্তায় কারো টিকিটার দেখা পেল না। জেহফিলের হাত থেকে ছাড়া পাবার অনেক চেষ্টা করেছে ইনান। জেহফিল ইনানের গলা থেকে ওড়না নিয়ে ইনানের হাত পেছনে নিয়ে বেঁধে গাড়িতে ওঠায়। আর পলকের মাথার চুল খামচে ধরে টেনে গাড়ির ডিকিতে আছড়ে মারে। ইনান যাতে কথা না বলতে পারে তাই মুখে রুমাল গুঁজে দেয় জেহফিল।

তার মুখ অস্বাভাবিক রকমের শান্ত। এটা যে ঝড়ের পূর্বাভাস তা ভালোই বুঝতে পারছে ইনান। সে সয়ে নিতো এই ঝড়, কিন্তু পলক! সে দোষ না করেই যে শাস্তি পাবে! তাও ইনানের জন্য!

রাস্তায় কয়েকবার ইনান জেহফিলের সিটের পেছনে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়েছে, যেভাবে পেরেছে সবভাবেই জেহফিলকে থামাতে চেয়েছে। বাধ্য হয়ে জেহফিল ইনানের পায়ের সাথে পা পেঁচিয়ে ধরে দড়ি দিয়ে বেঁধে দিয়েছে। পা পেঁচানোর ফলে পায়ে ব্যথার কারণে আর কোনো কিছু করার সুযোগ পায়নি ইনান।

বাসায় এসে পলককে সবার আগে গোডাউনে ফেলে ইনানকে নিয়ে উপরে চলে আসে। ইনান কাঁদতে কাঁদতে জেহফিলের কাছে মিনতি করেছিল, জেহফিল শুনেনি। ইনানকে রুমে আটকে রেখে সে চলে যায় অন্য রুমে। ইনান দরজা ধরে অনেকক্ষণ বারি দেয়ার পর তার মাথায় আসে ডুপ্লিকেট চাবিটা আলমারিতে আছে। সেটা নিয়ে খুব সাবধানে দরজা খুলে। জেহফিলের আর্টরুম থেকে আওয়াজ আসায় সেখানে পা টিপে টিপে উঁকি মারে। দেখে জেহফিলের হাতে ফিতা জাতীয় কিছু, আর নিচে কয়েকটা লাঠি আর রড, তার চেহারা রক্তবর্ণ, কপালের রগ ফুলে আছে। ইনান বুঝে যায় জেহফিল যে পলককে শাস্তি দিতে চলেছে‌। জেহফিল যখন কাজে ব্যস্ত সেই সুযোগে ইনান রুমের দরজা আলতো করে আটকে দেয়। ঘরের তালা নিয়ে মেইন দরজাও আটকে চলে যায় গোডাউনে। পলককে নিয়ে পালানোর উদ্দেশ্যে। সে বাঁচুক নয় মরুক, পলককে বাঁচাতে হবে।

.

ইনান আর পলক জঙ্গলের সাইড ঘেঁষে হাঁটছে। যেখানে পাতা কম। যাতে আওয়াজ না হয়। আর যাতে গভীর জঙ্গলে হারানোর আগেই জঙ্গল থেকে বের হওয়া যায়।

প্রায় বিশ মিনিটের মতো হাঁটল তারা। ইনান এই জঙ্গল ধরে এসেছিল একবার। ফ্রেন্ডদের সাথে। তাই এই সন্ধ্যার লালচে আলোতে পথটা হালকা চিনতে পারছে। আবার চাঁদের আলোতেও পথ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

ইনানের মাথায় অন্য চিন্তা। জেহফিল নিশ্চয়ই এতক্ষণে জেনে গেছে তাদের পালানোর খবর! যে করেই হোক পলককে নিরাপদে কোথাও পৌঁছে দিতে হবে।‌ যাতে জেহফিলের হিংস্রতার শিকার না হতে হয় পলককে।

‘ইনান, আলো দেখা যাচ্ছে।’ হঠাৎ পলক বলে উঠল।

ইনান ভয় পেয়ে গেল। জেহফিল এসে গেছে কি? কিন্তু না, আলোটা দেখা যাচ্ছে কোনো রাস্তায় চলার গাড়ির। ইনানের মনে যেন প্রশান্তির শীতল বাতাস বয়ে গেল।

সে পলককে ধরে রাস্তায় উঠল। কিন্তু রাস্তায় উঠতেই চমকে গেল। এই রাস্তাটা জেহফিলের বাসার সামনের রাস্তা ধরেই এসেছিল। তার মানে তারা শুধু শুধু জঙ্গলের পথ ধরে হেঁটেছে! রাস্তা দিয়ে আসলে আরো আগেই বহুদূর যেতে পারত! ইনান নিজের বোকামির জন্য মনে মনে নিজেকেই গালি দিলো।

এগিয়ে আসছে একটা বাইক। ইনান হাত নাড়িয়ে বাইকটা থামায়। এখন আর সন্ধ্যার লালচে আলো নেই। এখন রাতের শুরু।

বাইক থেকে দুজন নেমে আসে। তাদের মাথায় হেলমেট। ইনান আকুল গলায় বলল,

‘দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন, আমরা অনেক বড় বিপদে পড়েছি।’

বাইকের একজন হঠাৎ দৌড়ে আসলো পলকের কাছে। অস্থির হয়ে পলকের গাল ধরে বলল,

‘কী হয়েছে তোমার পলক? রক্ত কেন গলায়?’

ইনান আর পলক দুজনেই চমকে গেল মেয়েলি কণ্ঠ শুনে। চিনে ফেলল এটা যে রুহি। রুহি মাথার হেলমেট খুলল। শরৎও এগিয়ে আসলো। কৌতুহলী হয়ে বলল,

‘এই অবস্থা কেন আপনাদের? ইনান, কী হয়েছে?’

‘এত কিছু বলার সময় নেই এখন। তুই প্লিজ পলকে নিয়ে এখান থেকে চলে যা। উনি আহত।’

পলক ততক্ষণে ইনানের হাত চেপে ধরেছে,

‘তোমাকে একা ছাড়ছি না ইনান। জেনেবুঝে তোমাকে সিংহের গর্তে ঠেলে দিতে পারি না।’

ইনান পলককে ঠেলতে লাগল রুহিদের সাথে যাওয়ার জন্য।

রুহি আর শরৎ অবাক হয়েই চেয়েছিল। রুহির মনে তখন হিংসার আগুন জ্বলে উঠছে। পলক যেভাবে ইনানকে চেপে ধরেছে যেন বহুদিন পল ফিরে পাওয়া স্ত্রীকে ধরেছে। রুহির বুকে সাড়াশির মতো কিছু একটা বিঁধল যেন। চোখে জমল জল। পলককে সে অন্য মেয়ের সাথে দেখতে পারে না। ইনানের উপর জমে থাকা ক্ষোভ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। শরৎএর হাত ধরে ফিসফিস করে বলল,

‘এদের মধ্যে কী হয়েছে জানার দরকার নেই। আমি পলককে নিয়ে চলে যাচ্ছি, তুই ইনানকে সামলা।’

বোনের কথার আড়ালে থাকা কূটনৈতিক ইঙ্গিত ধরে ফেলল শরৎ। লোভাতুর হয়ে উঠল চোখ দুটো। চাঁদের আলোতে ঝিকমিক করা ইনানের ফ্যাকাশে মুখ, আর কাপড়ের অবিচ্ছিন্ন অবস্থা দেখে জিভে জল চলে এলো তার। এরকম সুযোগ কয়জনে হাতছাড়া করে?

রুহি মুখে করুণার ভাব ফুটিয়ে পলকের কাছে এসে বলল,

‘আই থিংক তোমার হেল্প দরকার বেশি। ইউ আর ইনজুরড। শরৎ বরং ইনানকে নিয়ে আসুক। আমি তোমাকে নিয়ে হসপিটালে যাই।’

এই বলে পলককে টেনে আনতে লাগল। কিন্তু পলক যেন পণ করেছে যাবেই না ইনানকে ছাড়া। ইনানের মনে ভয় হতে লাগল কখন না জানি জেহফিল চলে আসে। সে পলককে ঠেলে বাইকে উঠায়।

‘আমিও আসছি শরৎএর সাথে। আপনার সত্যিই চিকিৎসার দরকার আগে।’

জোরাজুরির পর পলক রাজি হয় যেতে। তবে আগে রুহিকে বলল ফোনটা দিতে, সে তার ফোর্সদের কল করবে। কিন্তু রুহি মিথ্যে বলল যে তারা কেউই ফোন নিয়ে বের হয়নি।

পলক বাইকে উঠে রুহির পেছনে বসে। তাদের বাইক ছাড়ার পর পরই শরৎ ইনানকে চেপে ধরে নিজের সঙ্গে।

ইনান হতচকিত হয়ে বলে, ‘কী করছিস, হাত ছাড়।’

শরৎ ছাড়ল না। ইনানের জামায় হাত দিয়ে কুৎসিত হেসে বলল,

‘নাউ আই ক্যান টেক মাই রিভেঞ্জ।’

শরৎএর উদ্দেশ্য বুঝতেই আতঙ্কে নীল হয়ে যায় ইনান। ফ্রেন্ডের থেকে এই ধরনের আশা করেনি সে। ভয় পেয়ে চিৎকার দেয় সে। শরৎ ইনানকে রাস্তার পাশেই জোর করে ধরে জঙ্গলে নিয়ে যেতে চায়। ইনান আর ওর মাঝে একপর্যায়ে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। সেই সময় ইনান খেয়াল করে রাস্তার মাঝে দুর্বল পায়ে দৌঁড়ে আসছে পলক। তার পেছন পেছন ছুটে আসছে রুহি।

পলক এসেই শরৎএর উপর হামলে পড়ে। শরৎকে মাটিতে ফেলে হাত দিয়ে মুষ্টাঘাত করতে করতে বলে,

‘শু’য়োরের বাচ্চা, তোর হাতে আমি ইনানকে ভরসা করে ছেড়ে দিয়েছি ওর সম্ভ্রম লুট করার জন্য?’

একের পর এক আঘাত করতে থাকে শরৎকে। রুহি এসে পলককে সরায়। শরৎও উঠে পলকের সাথে মা’রামারি শুরু করে দেয়।

পলক দুর্বল থাকায় শরৎ সহজেই তাকে পরাস্ত করে। ইনানও রুহির সাথে পেরে উঠে না। রুহি ইনানের হাত মট করে ধরেছে যে ইনান এদিক ওদিক নড়তে পারছে না চোখের পানি ফেলা ছাড়া।

পলক শরৎএর মেইন পয়েন্টে আঘাত করলে শরৎ লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। সেই সুযোগে পলক রুহিকে ধাক্কা মেরে ইনানকে নিয়ে দৌঁড়ে পালায় জঙ্গলের মাঝে। শরৎ আর রুহিও তাদের পিছু ছুটে আসে।

জঙ্গলের মাঝে বেশিদূর এগোতে পারে না তারা। পলক তাই ইনানকে নিয়ে একটা বড় গাছের নিচে গর্তে লুকিয়ে পড়ে। ইনানকে নিজের বুকে শক্ত করে ধরে রাখে।

রুহি আর শরৎ এদিকটায় হাঁপিয়ে এগিয়ে আসে।

‘এদিকেই আছে কোথাও লুকিয়ে।’ রুহি শুধায়।

‘শালাকে আজ ছাড়ছি না, আমার মুখ থেকে খাবার কেড়ে নেয়া?’ শরৎ রাগত গলায় বলল।

রুহি হঠাৎ শরৎএর শার্ট ধরল। তীক্ষ্ণ চোখে চারিদিকে নজর বুলিয়ে ফিসফিস করে বলল,

‘উই শ্যুড গো।’

‘কেন?’

‘কেউ আসছে মনে হচ্ছে।’

শরৎও কান পেতে দূর থেকে আসা পাতার কড়মড়ে আওয়াজ শুনল, ‘কে আসবে এই জঙ্গলে?’

‘কোনো পশু হতে পারে? যেই আসুক আমাদের পালানো উচিৎ।’

রুহি এবার শরৎএর হাত ধরে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসলো‌। আগে নিজেদের প্রাণ বাঁচানো জরুরী। তারা নিজেদের বাইকে করে উঠে পালাল।

এদিকে ইনানকে জড়িয়ে ধরে আছে পলক। ইনানের বুকের ধুকপুকানি পলক স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। সে ইনানের দিকে তাকায়। চাঁদের আলোয় ইনানের ভয়ার্ত চোখ আর কম্পিত ঠোঁট দেখা যাচ্ছে। ইনান একটু পর পর জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে যেটা পলককে বারবার আকর্ষিত করছে। ইনানের শরীরের ঘ্রাণে তার মাতাল হওয়ার জোগাড়। এই প্রথম ইনানের এত কাছে আসা, জড়িয়ে ধরা! ইনানের মোহিত করা ঠোঁট আর ঘ্রাণে পলক ভুলে গেল তারা যে বিপদে আছে, ভুলে গেল তার প্রেয়সী যে বিবাহিত। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। মনের ভেতর কেমন নেশালো এক অনুভূতি তাকে ঝাপটে ধরে আছে।

ইনান যখন কারো আওয়াজ না পেয়ে পলকের উপর থেকে উঠতে যাবে সেই সময় পলক অচিন্তনীয় একটা কাজ করে ফেলল। ইনানের কোমর চেপে তার ঠোঁটে চুমু দিলো সে।

.
.
চলবে…