#রোদরঞ্জন
#পর্ব_৩০
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.
ইনান দ্রুত ছিল। তার অবচেতন মন তাকে বিপদের সংকেত দিলো ঠিক, তবে দেরি হয়ে গেল। ইনান মুখটা উঠিয়ে নিতেই পলকের ঠোঁট ইনানের ঠোঁটের নিচে অর্থাৎ চিবুকে লাগে। অধরের নিচে। মিনি সেকেন্ড দেরি হলে অধরেই লেগে যেত।
ইনান তড়াক করে সরে পড়ে পলকের উপর থেকে। পলক ধীর পায়ে উঠতে নেয়। সে জানে সে ভুল করেছে, কিন্তু অনুতপ্ত নয় সে। তার মন কু গাইছিল, মনে হয়েছিল যেই আশা ছিল ইনানকে পাওয়ার সেই আশাটা কোনোভাবে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে, ইনানকে পাওয়া হবে না, কোনোদিন না… সেই ভয় থেকেই পলক খুব বড় দুঃসাহস করে ফেলেছে।
ইনানের রাগ তড়তড়িয়ে বেড়ে গেল। যাকে সে ভরসার স্থল ভেবেছিল এখন সে-ই তার দিকে কামনার্ত চোখে তাকাচ্ছে। পলকের থেকে সে এটা ইহজন্মেও আশা করেনি। স্তম্ভিত নয়নে পলকের দিকে চেয়েছিল সে, বুকে মণখানেকের মতো পাথরের চাপ। কাকে ভরসা করবে? যাকে ভরসা করতে চায় সে-ই তার কোনো কোনো ক্ষতি করতে চায়। কান্নায় এবং শোকে কণ্ঠরোধ হয়ে আসে ইনানের। পলককে কথা শোনানোর জন্য মুখ খুলতে গিয়ে অনুভব করে গলা ভারী, ব্যথা করছে অতিরিক্ত কান্নার ফলে। তবে তার রেগে উঠা মন ঠিকই পলককে তিরস্কার করল,
”আমাকে তাহলে শুধু শুধু বাঁচিয়েছিলেন কেন? শিকারের মুখ থেকে খাবার ছিনিয়ে এনেছেন নিজে গলাধঃকরণের জন্য? আপনি এতটা নীচ! শরৎ আর আপনার মধ্যে পার্থক্যটা বাকি থাকলো কোথায়?”
ইনান মুখে বলতে না পারলেও তার হাত নিশপিশ করে উঠল। ডান হাত উঠালো পলককে চড় দেয়ার জন্য। ঠিক সেই মুহূর্তে ইনানের পাশ কেটে গেল ঠাণ্ডা বাতাস। চোখের পলকের চেয়েও দ্রুত ছিল সেই বাতাস। ইনান পলক ফেলতেই পলককে দেখতে পেল না। দেখল বিশালদেহী কারো পিঠ পলককে আড়াল করে রেখেছে। আরেকবার চোখের ফেলতেই মুষ্টাঘাতের আওয়াজ আসলো।
ইনান হতভম্ব চোখে চাঁদের আলোয় দেখল জেহফিলকে! ইনানের চোখ কপালে উঠে গেল অনাকাঙ্ক্ষিত মুহুর্তে জেহফিলকে দেখে। জেহফিল পলককে মাটিতে ফেলে তার উপর উঠে পলকের মুখে একের পর এক ঘুষি মেরেই চলেছে। ইনানের হতচকিত ভাব কেটে গেল দাঁত ভাঙার আওয়াজে। শরীর কেঁপে উঠল তার অজানা আশঙ্কায়….
ইনান জেহফিলের কাছে এগিয়ে গেল তাকে থামাতে। পলক পুলিশ মানুষ, তাকে দুয়েকবার মা’রলে ঠিকাছে, কিন্তু যদি ও’কে মে’রে ফেলে তাহলে কেস খাবে জেহফিল। জেহফিল যেভাবে আঘাত করছে তাতে মনে হচ্ছে দুই মিনিটের মাথায় পলক পটল তুলবে।
জেহফিলকে থামাতে পারল না ইনান। জেহফিলের চোখমুখ ভয়ঙ্কর ক্রোধান্বিত, ঘাড়ের রগ ফুলে উঠেছে, অপ্রকৃতিস্থের ন্যায় লাগছে তাকে। তার চোখের ভাষা ইনান বুঝতে না পারলেও তার মন বলছে মৃ’ত্যু খেলা করছে জেহফিলের চোখে। এলোমেলো চুলে জেহফিলকে আরো ভয়ানক লাগছে। সাইকোর মতো। যেমনটা সে মুভিতে সিরিয়াল কি’লারদের দেখেছে।
পলকের মুখ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সে নিজেকে রক্ষার সুযোগ পেল না। তার আগেই অতর্কিত হামলার শিকার হতে হয় তাকে। কয়েক ঘা পরে পলক চোখে তারা দেখতে পায় যেন। চোখ বুজে আসে তার।
ইনান জেহফিলের হাত ধরে থামানোর চেষ্টা করল। জেহফিল এমনভাবে ইনানের দিকে চাইল যে ইনান ছিটকে দূরে সরে গেল। জেহফিল চোখ দিয়েই যেন ইনানকে ভস্ম করে দিবে।
জেহফিলের হাত ভরে গেছে পলকের মুখের র’ক্ত দিয়ে। আরো দুটো ঘুষি মেরে পলকের থেকে উঠে ইনানের দিকে এগিয়ে যায়। ইনান বারংবার ঢোক গিলছে। চাঁদের আলোয় সাদা শার্ট পরুয়া, উস্কখুস্ক চুল, ধূসর চোখে অদমনিত ক্রোধ ও রক্তে রঞ্জিত জেহফিলকে হিংস্র দানবের ন্যায় লাগছিল। ইনান পিছু হটল, পড়ে থাকা লতার সাথে পা বেঁধে মাটিতে পড়ে গেল। জেহফিল ঘাড় কাত করে ইনানের দিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসতে লাগল। ইনানের পিঠ গাছে ঠেকে যায়। জেহফিল ইনানের দিকে এক পলক তাকিয়ে আচমকা তার চুল চেপে টেনে উঠায়। মুখের সামনে নিয়ে আসে।
ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে ইনান। জেহফিলের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই জেহফিল আরো শক্ত করে ধরল। ইনান জেহফিলের হাত হালকাভাবে ধরল যাতে জেহফিল মনে না করে যে সে ছাড়ানোর জন্য হাত ধরেছে। জেহফিল তার রক্ত লাগা হাতে ইনানের ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়ায়, গাল চেপে ধরে রূঢ়ভাবে। ইনান চেষ্টা করছে চেহারা স্বাভাবিক রাখার, কিন্তু ব্যথা সইতে না পেরে তার চোখমুখ কুঁচকে গেল।
জেহফিল গম্ভীর গলায় শুধু ডাকল, ‘বাটারফ্লাই!’
তারপর ইনানকে আচম্বিতে কাঁধে তুলে নেয়। ইনান জেহফিলকে বাঁধা দিলো না। সে জানে জেহফিল তাকে ছাড়বে না।
জেহফিল ইনানকে কাঁধে তুলে পলকের চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিতে থাকে। জঙ্গলে পড়ে থাকা ভাঙা ডাল, লতাপাতায় অচেতন পলকের শার্ট ছিঁড়ে যায়, শরীর কেটে যায়।
বাসায় আসার পর পলককে গোডাউনে ফেলে ইনানকে নিয়ে যায় বাথরুমে। ঝর্ণার নিচে ইনানকে রেখে লুফায় সাবান নিয়ে ইনানের ঠোঁটে ঘষতে লাগে। সাবানের তেঁতো স্বাদ ইনানের মুখের ভেতর চলে যায়। ইনান যতবার কিছু বলার জন্য মুখ খুলে ততবার জেহফিল লুফা দিয়ে জোরে রগড়াতে থাকে ইনানের ঠোঁটে। কিছু বলার সুযোগ পায় না ইনান। শুধু চেয়ে থাকে জেহফিল হিম শীতল চোখে।
প্রায় আধঘন্টা পর ইনান নিস্তার পায় জেহফিল থেকে। ইনানকে টেনে রুমে নিয়ে আসে। ভেজা অবস্থায়ই ইনানকে খাটে ফেলে একহাতে ইনানের দুহাত মাথার উপর, আরেক হাতে তার কোমর চেপে ধরে ঠোঁট দখলে নিয়ে নেয় জেহফিল। যেন কতদিনের অভুক্ত সে, এমনভাবে ইনানের উপর আক্রমণ চালায়। যখন ইনানের দম বন্ধ হয়ে চোখ বড় হয়ে যায় তখন জেহফিল তাকে ছাড়ে, তবে তা এক সেকেন্ডের জন্য। ইনান শ্বাস নিতে না নিতেই জেহফিল আবার ইনানের ওষ্ঠাধর আয়ত্ব করে নেয়। এভাবে বারবার ইনানের দম ফুরিয়ে আসলে জেহফিল এক মুহুর্ত সময় দিয়ে আবার নিজের কাজ চালাতে থাকে। চলতে থাকে ততক্ষণ যতক্ষণ না ইনান দুর্বল হয়ে যায়।
ইনান ক্লান্ত হলে জেহফিল ঠোঁট ছাড়ে। ইনানের ঠোঁট ফুলে লাল হয়ে গেছে। জেহফিল সেদিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল,
‘ইউ হ্যাভ টু মিনিটস।’
এই বলে উঠে চলে যায় সে। ইনান আয়নায় গিয়ে দেখে তার ঠোঁট আর ঠোঁট নেই, যেন সে র’ক্ত মেখেছে। জেহফিল তাকে ওয়ার্ন করে গেছে, তাই ইনান সময় নষ্ট করল না। আগে গিয়ে জামা চেঞ্জ করল। চুল মোছার জন্য তোয়ালে হাতে নিতেই জেহফিল ঠাস করে দরজা খুলে ইনানের হাত ধরে নিয়ে যায়। ইনান চুল মোছার সময়ও পায় না।
জেহফিল ইনানকে নিয়ে গোডাউনে গেল। একটা হলুদ টিমটিমে বাল্ব ঝুলে আছে সিলিয়ে। তার নিচে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে আছে পলক, ইনানকে একটা চেয়ারে বসাল। পলকের পাশে একটা বড় ব্যাগ পড়ে আছে। জেহফিল সাথে করে আনা বোতলটার সবটুকু পানি পলকের মুখে ছুঁড়ে মারল।
কেশে উঠল পলক। তার প্রতিটা কাশের সাথে রক্ত বেরোচ্ছে। চোখ মেলতে পারল না। অস্ফুটে কিছু বলল বিড়বিড় করে।
জেহফিল ব্যাগ থেকে বড় একটা হকিস্টিক বের করল।
ইনানের বুঝতে বাকি রইল না জেহফিল কী করবে। পলকের উপর তার রাগ হলেও সে চায় না তার জন্য কারো জীবন যাক। সে পলককে চড় দিতে পারেনি, তবে জেহফিল যা করেছে তাতে তার শাস্তি হয়ে গেছে। ইনান চায় না পলককে নিয়ে আর কোনো ঝামেলায় জড়াতে। সে চায় পলক তাদের জীবন থেকে চলে যাক, তবে জীবন্ত অবস্থায়। ইনান দৌঁড়ে যায় জেহফিলের কাছে।
মিনতি করে বলে, ‘জেহফিল, উনি ওনার শাস্তি পেয়ে গেছে জেহফিল, আর কিছু করিয়েন না প্লিজ।’
জেহফিল অনুভূতিহীন চোখে চায় ইনানের দিকে। ইনানকে আবারও চেয়ারে বসিয়ে থ্রেট দিলো,
‘চেয়ার থেকে উঠলে ঐ বাস্টার্ডের শাস্তি আরো দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। তোমার একটা ভুল পদক্ষেপ মানে ঐ জানোয়ারের মৃ’ত্যুর দিকে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। অ্যাম আই আন্ডারস্টুড?’
ইনান ভয়ে ভয়ে মাথা উপর নিচ করল।
জেহফিল মাথা হেলিয়ে দুদিকে ঘাড়ের হাড় ফুটিয়ে বলল,
‘সে ইট।’
‘ব..বুঝেছি।’
‘অ্যান্ড ইয়েস, আরেকটাবার তুমি রিকুয়েস্ট করবে আমাকে থামার জন্য, তাহলে…’ জেহফিল রুঢ় চোখে তাকায় ইনানের দিকে, ‘ইউ নো দ্যাট রাইট?’
ইনান কম্পিত গলায় বলল, ‘হুম।’
‘দ্যাটস সো সুইট অফ ইউ।’ জেহফিল হাসল, কাষ্ঠ হাসি।
জেহফিল পলকের কাছে এসে হকিস্টিক নিয়ে পলকের পেটে জোরে বারি দিলো। পলক পেট চেপে উল্টে গেল প্রায়। ইনান চিৎকার করে উঠে। কিছু বলার সাহস পায় না সে। জেহফিল আরো কয়েকবার পলকের মুখে আর পেটে আঘাত করতে লাগল। রক্তে পলকের চেহারা চেনা যাচ্ছে না, চুল গুলোও র’ক্তে রঞ্জিত। র’ক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে পলকের চুল, মুখ থেকে। র’ক্ত দেখে ইনানের মাথা চক্কর দিয়ে উঠল।
জেহফিল নির্দয়ের মতো মা’রতেই লাগল পলককে, ইনান না পেরে জেহফিলের কাছে উঠে আসলো। জেহফিল তা দেখে হিংস্র চোখে তাকায়,
‘আই ওয়ার্নড ইউ!’
‘আমার কথাটা শুনুন, প্লিজ।’ ইনান জেহফিলের গাল ধরার চেষ্টা করল, জেহফিল ইনানের হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে সেই হাত ইনানের পিঠের কাছে নিয়ে চেপে ধরে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না? দরদ উথলে উঠছে এই জানো’য়ারের জন্য?’
এই বলে পলকের মুখ পিষে ধরে পা দিয়ে।
‘উনি পুলিশ। যদি ওনার কিছু হয় তাহলে আপনি বিপদে পড়বেন জেহফিল।’
জেহফিলের চোখ নরম হয়, ‘তার মানে তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করছিলে?’
ইনান হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। জেহফিল স্মিত হেসে বলে,
‘তুমি আমাকে কেয়ার করো জেনে ভালো লাগলো। বাট আই প্রমিস, আমি এ’কে মা’রব না। শুধু একটু শাস্তি দিবো। প্লিজ সোনা, ট্রাস্ট মি, জাস্ট একটু।’
ইনান কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। জেহফিল নরম সুরে কথা বললেও ইনানের মনে হচ্ছে জেহফিল ভান ধরছে। জেহফিল ইনানকে গোডাউনের বাইরে নিয়ে এসে ইনানকে বাইরে দাঁড় করিয়ে হুট করে দরজা আটকে দেয়।
ইনান বারবার দরজায় কড়াঘাত করলেও জেহফিল খুলল না। সে এসে একটা জানালা খুলে দিলো শুধু। ইনানকে বলল জানালায় দাঁড়াতে।
তারপর মিষ্টি হেসে বলল, ‘সরি সোনা তোমাকে ঢুকতে দিচ্ছি না বলে। তুমি কাছ থেকে দেখলে ভয় পাবে, তাই দূর থেকেই দেখো।’
‘জেহফিল, প্লিজ, ওনাকে ছেড়ে দিন, উনাকে আর শাস্তি দিয়েন না।’
জেহফিলের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। বাটারফ্লাইয়ের চোখে অন্যের জন্য করুণা দেখতে পারবে না সে, তাও আবার একটা ছেলের জন্য যে তার বাটারফ্লাইকে ছুঁয়েছে।
জেহফিল পলকের পাশে বসল। ব্যাগ থেকে ধারালো ছু’রি বের করল সে। এটা তার স্কাল্পচারের, তার খুব প্রিয় একটা ছু’রি। ইনান এদিকে একাধারে চিৎকার করেই যাচ্ছে। জেহফিল তা কানে নিলো না। পলকের হাতের ছু’রি গেঁথে প্যাটার্ন আঁকতে লাগল। পলক গলা কাটা মুরগীর ন্যায় ছটফট করছে, অসহ্য যন্ত্রণায় তার মস্তিষ্ক ফেটে যাচ্ছে।
এই হাতে পলক তার বাটারফ্লাইকে ছুঁয়েছে। পলকের হাত ইনানের কোমর চেপে ধরেছিল। যেটায় একমাত্র জেহফিলের অধিকার সেই জিনিসে হাত দিয়েছে পলক। পলকের দুই হাতে খুব সুন্দর ফুল আঁকলো জেহফিল, পানি নিয়ে জায়গাটা মুছে দিতেই পলকের ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হওয়া শুরু করল। জেহফিল ধ্যানের সহিত দেখল, রক্তগুলো বের হয়ে ফুলটাকে কী সুন্দর কালার করছে, তারপর ধীরে হাত বেয়ে ফুলের চারিদিক লাল রঙা হয়ে উঠছে, অ্যাস্থেটিক একটা দৃশ্য। জেহফিল পানি দিয়ে আবার হাতটা পরিষ্কার করল, আবারও একই প্যাটার্নে রক্ত বের হয়ে ফুলটাকে রঙিন করছে।
এবার সে পলকের শার্ট ছিঁড়ে পলকের বুকে ছু’রি দিয়ে লিখল, ‘BAS’TARD’। এই বুকে তার বাটারফ্লাইয়ের হাত লেগেছে, বাটারফ্লাই এখানে মাথা রেখেছে। জেহফিলের বুকে সূচালো তীরের মতো বিঁধল যখন সে দেখেছিল ইনানকে পলকের বুকে হাত রাখতে। তার মাথায় র’ক্ত চড়ে গেল। ছু’রিটা আরো গভীর করে গাঁথল সে। পলক জ্ঞান হারালো নিমিষেই।
ইনানের কান্নারত মুখের দিকে চাইল সে,
‘তুমি কাঁদছ কেন বাটারফ্লাই? এ’কে শাস্তি দিয়েছি বলে?’
ইনানের কান্না থামছে না। পলক তার প্রাপ্য শাস্তি জঙ্গলেই পেয়ে গেছে। জেহফিল এখন যা করছে তা পলকের প্রাপ্য নয়। এটা নৃশংসতা। ইনান ভাঙা জানালাটা জোরে জোরে ধাক্কাতে থাকে। কোনোমতে একটা কাঠ ভাঙতে পারলেই হলো।
জেহফিল ছু’রিটা ফেলে দেয়। এবার ব্যাগ থেকে বের করে বড় একটা সুই আর সুতা। ইনান তা দেখে আঁতকে উঠে। বুক ধুকপুক করে উঠে। আরো জোরে ভাঙা জানালা ধাক্কাতে থাকে।
জেহফিল সুইয়ে সুতা ঢুকিয়ে ইনানের দিকে চায়। হিসহিসিয়ে বলল,
‘এবার তোমার ঠোঁট স্পর্শ করার শাস্তিটাই খালি বাকি।’
ইনান দ্রুত বলে উঠল, ‘উনি আমার ঠোঁটে স্পর্শ করেনি জেহফিল, বিশ্বাস করুন..’
জেহফিলের চোখমুখ অন্যরকম হয়ে গেল, ‘তুমি ওর জন্য কেন এত উতলা হচ্ছো বাটারফ্লাই? তার মানে কি তুমি ও’কে বাঁচানোর জন্য আমার কেয়ার করার অভিনয় করেছো? তুমি আসলে আমার জন্য চিন্তা করোনি? অভিনয় করেছ যাতে আমি ও’কে শাস্তি না দেই?’
ইনান জোরে জোরে মাথা নাড়ায়। জেহফিল বলল,
‘তাহলে কেন ও’কে শাস্তি দিলে তোমার কষ্ট হয়? আমার কষ্টটা তোমার চোখে পড়েনি যখন দেখেছি তোমাকে এই অসভ্যটা কিস করেছিল?’
‘উনি আমাকে কিস করেনি, জেহফিল।’ ইনান কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
‘ইউ আর লায়িং।’ জেহফিল এই বলে পলকের ঠোঁট দুটো একত্রে চেপে ধরে। এই জঘন্য ঠোঁট আজকে সে সেলাই করবে। কাপড় বুননের মতো করে।
পলকের ঠোঁটে সুই ঢুকানো মাত্রই ইনান জানালা ভেঙে চলে এসে জেহফিলের হাত থেকে সুই সুতা টেনে দূরে ফেলে দিলো। জেহফিলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সে,
‘আমি মিথ্যে বলছি না জেহফিল, যখন ওনার ইনটেনশন বুঝেছি তখনই আমি নিজেকে সরাতে চেয়েছি, যার কারণে উনি আমাকে কিস করতে পারেনি।’
ইনান জেহফিলের মুখ হাতের আঁজলায় নিলো, কোমল গলায় বলল, ‘জেহফিল, আপনি আপনার বাটারফ্লাইকে বিশ্বাস করুন। আমার জীবনের একমাত্র পুরুষ আপনি, আপনাকে ছাড়া কখনো কাউকেই আমি এলাউ করিনি। উনি যখন ঐ কাজটা করতে নিয়েছিল তখন আমার নিজেরই খুব রাগ উঠেছিল। আমার স্বামী ছাড়া আমাকে কেউ স্পর্শ করবে এটা ভাবতেই আমার গা ঘিনঘিন করছিল, তাই ওনাকে সেই সুযোগ দেইনি আমি।’
জেহফিল তার গালে থাকা ইনানের হাত ধরে, ‘তুমি সত্যিই বলছো তো বাটারফ্লাই?’
ইনান মাথা উপর নিচ করে।
‘আচ্ছা, তাহলে ও’র ঠোঁট একটুখানি কা’টি, যেহেতু তোমার চিবুক ছুঁয়েছে?’ খুব নিষ্পাপ গলায় আবদার করল জেহফিল।
‘তাহলে আপনি আমার চিবুকটাও কেটে ফেলেন যেহেতু ওনার ঠোঁটের স্পর্শ লেগেছে।’
জেহফিল ইনানকে ছু’রি দিয়ে আঘাত করবে ভাবতেই জেহফিলের বুকের ভেতরটা কামড়ে ধরে। সে কখনো তার বাটারফ্লাইকে রক্তাক্ত করতে পারবে না।
ইনান জেহফিলকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পলককে শাস্তি দেয়া থেকে বাঁচালো। জেহফিল পলককে বস্তায় পেঁচিয়ে মুখের দিকটা খুলে দিলো শ্বাস নেয়ার জন্য।
‘টেনশন করো না বেবি, এই বে’জন্মা আগামী ছয় মাসে নড়াচড়া তো দূর, মুখ খুলতেই পারবে না।’
ইনানের মনে হলো না ছয় মাসে পলক স্বাভাবিক হবে, যেভাবে জেহফিল পলকের গলায় মুখে আঘাত করেছে আগামী এক বছরে সে ঠিক হবে কিনা সন্দেহ। সে মনে মনে জেহফিলের নিষ্ঠুর আঘাতের কারণে পলকের কাছে সরি বলে নিলো। তাই বলে এই না যে পলককে সে ক্ষমা করেছে।
ইনান ইতিউতি করছিল আজকের মধ্যেই যাতে পলককে হসপিটালের সামনে রেখে আসে। কিন্তু জেহফিল মানবে না। তার নাকি আরো একটা কাজ বাকি।
‘কী কাজ?’
জেহফিল হঠাৎ বলে উঠল,
‘তুমি আজ অনেক বড় দুঃসাহস দেখিয়েছ। আমাকে খাটের সাথে বেঁধে আমার থেকে পালানোর দুঃসাহস। তুমি ভেবেছ এতকিছুর পরও আমি ভুলে যাবো? ঘুম থেকে উঠার পর তোমাকে না পেয়ে নিজেকে কতটা পাগল পাগল লাগছিল জানো? তুমি আমার কাছে নেই ভেবেই তো আমার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল, কষ্টও হয়েছিল। তারপর আরো একটা সাহস দেখিয়েছ একটা ছেলের সাথে একই গাড়িতে বসার। আবারও সাহস দেখিয়েছ আমাকে তালাবদ্ধ করে ঐ ছেলেটাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার। তুমি সাহসের কতগুলো ধাপ অতিক্রম করেছ আজ একদিনে! আ’ম সারপ্রাইজড। তোমার বুকের পাটা আছে বলতে হয়। থাকার কথা অবশ্য, তুমি জেহফিল এহসানের ওয়াইফ, দুঃসাহস তো তোমার থাকাই লাগবে। তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রটা ভুল ছিল।’
ইনানের মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিল যে আজকের দুঃসাহসটা দেখিয়েছে সে!! জেহফিলের হিংস্র রূপ দেখে ঢোক গিলল সে, কী করে ভুলে গেছে যে জেহফিল তাকে এত সহজে ছেড়ে দিবে?
‘কী…কী করবেন আপনি?’ ইনানের কণ্ঠ কেঁপে উঠল।
ব্যাগ থেকে ডার্ক রেড শেডের একটা লম্বা ফিতা বের করল। হাতে পেঁচাতে পেঁচাতে ইনানের নিকট এগিয়ে আসতে আসতে বাঁকা হেসে বলল,
‘ইওর পানিশমেন্ট ইজ গনা বি হার্ড, লিটল কিটেন!’
.
.
চলবে…
#রোদরঞ্জন
#পর্ব_৩১
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.
আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। এই শীতেও বৃষ্টি নামাটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। অসময়ে বৃষ্টি। জেহফিল আকাশের দিকে চাইলো। আজকের রাতটা লম্বা হতে চলেছে। হালকা হাসির রেখায় ঠোঁট প্রসারিত হলো তার। মনে মনে কিছু একটা চিন্তা করছে। আর সেই চিন্তাটা আঁচ করতে পারছে ইনান। জানে না জেহফিল তাকে কী শাস্তি দিবে। তবে যেহেতু জেহফিল তখন বলেছিল সে ইনানকে রক্তা’ক্ত করতে পারে না তার মানে জেহফিল কঠিন কোনো শাস্তি দিবে না যাতে ইনানের কষ্ট হয়। তাহলে কী দিতে পারে?
ইনান আড়চোখে জেহফিলের হাতের দিকে তাকাল। বলিষ্ঠ হাতে জেহফিল ডার্ক রেডের লম্বা দড়িটা প্যাঁচাচ্ছে। তার শ্যামলা হাতের নীল শিরাগুলো ফুলে কী সুন্দর আঁকাবাঁকা প্যাটার্নে রূপ নিয়েছে। দেখতে এত মারাত্মক লাগছে যে ইনান যদি স্বাভাবিক অবস্থায় থাকতো তাহলে জেহফিলের হাত ধরে চুমু দিতে দিতে অস্থির করে দিতো।
ইনানের মাথায় একটা বাজে চিন্তা আসলো জেহফিলের হাতের ফিতা দেখে। জেহফিল কি তাকে বাঁধবে? মা’রবে না তো অবশ্যই! তাহলে কী বেঁধে জোর করে কিছু করবে? ইনান গভীর চিন্তায় পড়ল। জেহফিল কখনোই জোর করে স্বামীত্ব ফলায়নি। ফলানোর দরকার পড়েনি। ইনান যতই ঘৃণা করুক জেহফিলকে, সে একটা ব্যাপার অস্বীকার করতে পারবে না যে জেহফিল তাকে যতবারই ঘনিষ্ঠ স্পর্শ করে ততবার ইনান সাড়া না দিয়ে থাকতে পারে না। ইনান মাঝে মাঝে ঘৃণার কারণে জেহফিলের কাছে আসতে চায় না, কিন্তু শরীর? জৈবিক চাহিদা তো সবার থাকে, ভালোবেসে নিবিড়ভাবে হাত ছোঁয়ালে নিজেকে সংযত রাখতে পারে ক’জন? ইনানও পারেনি। সে তো একটা রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। জৈবিক চাহিদা তারও আছে। জেহফিল যখন ইনানকে ভালোবেসে ছোঁয়, ইনান না চাওয়া সত্বেও জেহফিলের ডাকে ছুটে যায়। নিজেকে কোনোভাবেই সামলাতে পারে না। সব দোষ জেহফিলের। কেন এত কামুকের সাথে তাকে ডাকতে হবে? জেহফিল কেন এত আবেদনময়?
‘ইউ ক্যান টাচ মি ইফ ইউ ওয়ান্ট বাটারফ্লাই। আ’ম অল ইওরস।’
ইনান শিহরিত হয় তার পেছন থেকে আসা প্রগাঢ় কণ্ঠ শুনে। এইসব কথা বলেই তো জেহফিল তাকে দুর্বল করে দেয়, যার কারণে ইনান সাময়িক সময়ের জন্য ভুলে যায় জেহফিলের নৃশংসতা।
ইনান জেহফিলের থেকে দূরে সরে যায়। জেহফিল আটকায় না। বরং তার ঠোঁটের কোণে তীর্যক হাসির ঝিলিক দেখা দেয়,
‘সো, শ্যাল উই স্টার্ট?’
জেহফিল চেয়ারে বসে। দুই পা ফাঁক করে হেলান দিয়ে খুব আরামে বসল। ঘাড় পেছনে নিয়ে কাত করে ঘাড়ের হাড় ফুটাল। হাত দিয়ে ঘাড়ের পেছনে নিয়ে ইনানের দিকে তাকায়।
‘ফার্স্ট আমাকে বলো, আমার থেকে যে পনেরো ঘন্টা ত্রিশ মিনিট দূরে ছিলে, কেমন দেখলে দুনিয়া?’
ইনান মিইয়ে গেল। জঘন্য দুনিয়ার সাথে পরিচিত হলো একদিনে। বন্ধু, বন্ধুর বোন এবং আস্থা করা মানুষগুলোর বিশ্বাসঘাতকতা। জেহফিল ঠিক বলেছিল, সে নিরাপদ না বাইরের দুনিয়ায়। অসহায় পেলে কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে তা ঢের বুঝল সে।
‘কী ভাবছ? আই টোল্ড ইউ বাটারফ্লাই। বাইরের দুনিয়াটা ভালো না।’
ইনান দু’পাশে মাথা ঝাঁকায়, ‘আপনিই বা কম কিসে?’
জেহফিল ভ্রু কুঁচকায়।
‘বিয়ের আগে স্টক করেছেন, ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করেছেন, এগুলো কোনো ভালো মানুষের কাজ?’
এক ভ্রু উঁচু করল জেহফিল, বাঁকা হেসে বলল,
‘কে বললো আমি ভালো মানুষ? বাই এনি চান্স, তুমি কি আমাকে ভদ্র নায়ক হিসেবে আশা করছিলে? তাহলে জেনে নেও, তোমার জীবনের খলনায়ক আমি। খলনায়কের কাছ থেকে নায়কের অ্যাক্টিং আশা করলে হবে?’
‘তাহলে বাকিরাও খলানায়ক।’ ইনানের পাল্টা উত্তর।
‘উহু, তোমার জীবনে আসা প্রথম খলনায়ক আমি। তাই জায়গাটা আমার জন্য সিলবদ্ধ হয়ে গেছে, মৃ’ত্যুর আগ পর্যন্ত। কীভাবে নিজের অর্জিত জায়গা ছেড়ে অন্যকে জায়গা দেই বলো তো? এত মহান আমি না। তোমার জীবনে ‘ভিলেন’ শব্দটা শুধুমাত্র আমার জন্যই বরাদ্দ। যার কাজ পরে আসা সব নিচুস্তরের ভিলেনদের পরাস্ত করা।’
ইনান হাল ছেড়ে দেয়। জেহফিলের সাথে কথা বলে পারবে না সে।
‘এখন বলো, তোমার কী সিদ্ধান্ত?’
ইনান হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে থাকে, ‘কীসের?’
‘আমার সাথে সংসার করার? করতে চাও নাকি না?’
জেহফিল যে এইধরনের প্রশ্ন করবে তা চিন্তাও করেনি সে। জেহফিল এই ধরনের কথা বলার মানুষ না। ইনান কী বলবে ভেবে পায় না। জেহফিল বলল,
‘তুমি যদি আমার সাথে সংসার করতে চাও তাহলে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে।’
সংসার করতে নিয়ম মানে কোন পাগলে? এটা কি কোনো চাকরি যে নিয়ম মতো করতে হবে? জেহফিল কিসব কথা বলছে?
‘ওয়েল, নিয়ম না সঠিক, এটা আমার অর্ডার।’
জেহফিল তীক্ষ্ণ চোখে চায় ইনানের দিকে। ইনানের হতবাক মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তুমি কি আমার কথা শুনছো?’
ইনান ধীর গতিতে মাথা নাড়ায়।
‘গুড। ওয়ান, তোমার প্রায়োরিটি থাকবে আমাকে ঘিরে। না কোনো জীব, না কোনো জড় বস্তু, কোনোটাকেই আমার থেকে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া যাবে না। টু, আমার কথা মতো সব করবে, জামা কাপড় পরা শুরু থেকে খাবার খাওয়া, ইভেন তোমার আন্ডার গার্মেন্টসও আমার পছন্দে হবে। থ্রি, মোবাইল নিষিদ্ধ। ল্যাপটপ আছে, আমি থাকলেই শুধু ল্যাপটপ ইউজ করতে পারবে, বাট, নট ফর কমিউনিকেশন। ফোর, কোনো ফ্রেন্ডস রাখা যাবে না। ফ্রেন্ড ছাড়াও জীবন পার করে দেয়া যায়, যেমনটা আমি দিয়েছি।’
‘কোনো না কোনো প্রয়োজনে ফ্রেন্ড লাগেই। তবে আমার স্বার্থপর বন্ধুদের কথা বলছি না।’ ইনান ঠেস মারা গলায় বলল।
জেহফিলের গলা চড়ল কিছুটা, ‘আমি থাকতে তুমি একা কিসের? তুমি ফ্রেন্ডদের সাথে যা বলবে তা আমাকে বলতে পারো, আমি যে কারো থেকে ভালো কনভারসেশন করতে পারি। তোমার যা জানতে চাওয়ার আমাকে বলবে। ফ্রেন্ডরা কি স্বামীর থেকে বেশি আপন?’
ইনান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার কথা বলাটাই ভুল হয়েছে। ইনানের উত্তর এবার সহজেই ‘না’-এর কোঠায় ঘুরবে। জেহফিল যা যা শর্ত ওরফে আদেশ দিয়েছে তা কখনো নরমাল মানুষের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব না যদি না সে জেহফিলের মতোই একই চরিত্রের হয়। উত্তরটা ক্লিয়ার। জেহফিলের সাথে সংসার করবে না। যতই ভালোবাসুক, এই ধরনের দমবন্ধ হয়ে বেঁচে থাকা যায় না।
‘ফাইভ, তোমার বাবার সাথে কথা বলবে সপ্তাহে একদিন। তোমার বাবার জ্ঞান দেয়াটা আমার পছন্দ না, তাই সময়টাও কমিয়ে দেয়া হবে প্রয়োজন মতো।’
ইনান চোখ উল্টায়, এবার তো আগেই ক্লিয়ার। না, না, এবং না। সে জেহফিলের সাথে সংসার করবে না। তাও জেহফিলের আরো শর্তগুলো শোনা যাক। পাগলের প্রলাপ শেষবারের মতো শুনুক।
‘সিক্স, কখনো অন্যের জন্য আমার কাছে মাথা নিচু করবে না। তোমাকে আমি সবসময় মাথা উঁচু করে দেখতে চাই। তুমি আমার ওয়াইফ, আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস থাকতে হবে। সেভেন, প্রতি ঘন্টায় হাগ, কিস করবে, নিজ থেকে। এইট, আমার বাধ্য থাকবে। যা বলব তাই মানবে, অহেতুক চেঁচামেচি করবে না। নরম সুরে কথা বলবে। এন্ড লাস্ট বাট নট লিস্ট, ইউ হ্যাভ টু লাভ মি। তোমার চোখে তাকালেই যেন আমার জন্য ভালোবাসা দেখতে পাই। তোমার ভালোবাসা আমাকে ঘায়েল করার অ’স্ত্র। You can dominate me with your love. I’ll always be on my knees then.’
ইনান ম্লান হাসে। ভালোবাসার শর্তগুলো ছাড়া আর একটাও যে গ্রহণযোগ্য নয়।
‘এবার তোমার ডিসিশন…’
‘না।’ জেহফিলের মুখ থেকে কথা কেড়ে নেয় ইনান, ‘আমি আপনার সাথে সংসার করব না।’
জেহফিল দুর্বোধ্য হাসলো, ‘বুকের পাটা আছে বলতে হয়।’
‘আপনি নিজেই ভেবে দেখুন না জেহফিল, আমি যদি এসব শর্ত আপনার উপর আরোপ করি, আপনি চলতে পারবেন? আপনি…’
ইনানের কথা শেষ হওয়ার আগেই
জেহফিল বলে উঠল,
‘অবশ্যই পারব। অল আই ওয়ান্ট ইন মাই লাইফ ইজ লাভ, অনলি লাভ। ভালোবাসার জন্য সব করতে পারি, সব। আমার প্রায়োরিটিতে সবসময় তুমি ছিলে, আছো, এবং থাকবে। তোমাকে সিকিওর ফিল করানোর জন্য আমি দুনিয়ার সবার থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারব, তোমার পায়ের কাছে বসে থাকব যতটাদিন না তুমি আমার সাথে সিকিওর ফিল করো। যদি তোমার মনে হয় কেউ আমাকে তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিবে, তবে তুমি বললে আশেপাশের সব মেয়ের চোখ তুলে ফেলব। আমাকে নিয়ে জ্বেলাসির সুযোগ দিবো না কখনোই। সব পারব আমি, তাহলে তুমি কেন পারবে না?’
‘অসুস্থ আপনি, অসুস্থ আপনার ভালোবাসা।’ ইনান বিড়বিড় করে বলল।
‘আমি জানি আমার ভালোবাসা কতটা পবিত্র।’ জেহফিলের চোখে দ্যুতি দেখা দেয়।
ইনান হতাশ হয়। পাগল কীভাবেই বা বুঝবে যে সে পাগলামি করছে?
‘জেহফিল, আপনি মরীচিকার পেছনে ছুটছেন। আমি আর আপনি দুই মেরুর। আপনি কেন বুঝছেন না?’
‘আর কিছু?’
‘আমার একটা অনুরোধ। আপনি..’ ইনান বুকে সাহস সঞ্চয় করল, সে খুব বড় একটা কথা বলতে যাচ্ছে,
‘আপনি আমাকে ছেড়ে দিন, আমি প্রমিস করছি আমি আমার জীবনে কোনোদিন বিয়ে তো দূর, কোনো ছেলের দিকেও তাকাব না। সারাজীবন সিঙ্গেল থাকব। দরকার পড়লে কোনো মহিলা সংগঠনে চাকরি নিবো যাতে ছেলেদের থেকে দূরে থাকতে পারি। গড প্রমিস আমি ছেলে ফ্রেন্ডও বানাবো না, মেয়েও না। একা থাকব।’
জেহফিল হাসে। একটু নরম হয়ে কথা বলায় তার বাটারফ্লাইয়ের বড্ড সাহস বেড়ে গেছে। কার সামনে দাঁড়িয়ে এই কথা বলছে সে বোধহয় ভুলে গেছে।
হাঁটুতে কনুই রেখে হাত জোড় করে তার উপর চিবুক রেখে বলল,
‘সেই সুযোগটাই তোমাকে দিবো আজ।’
ইনান আশ্চর্যান্বিত হয়। কানে বাজতে থাকে জেহফিলের কথা। জেহফিল কী বলছে সে নিজে জানে?
‘আর এটাই তোমার শাস্তি।’
‘মানে?’
‘মানেটা খুবই সিম্পল। এই যে আমার হাতে ফিতেটা দেখছো না? এটা কিন্তু সফ্ট ফেব্রিক না। খুবই হার্ড। এটা দিয়ে কী করব বলো তো?’
‘এটা দিয়ে আমাকে বেঁধে শাস্তি দিবেন?’
‘বোকা বাটারফ্লাই। তোমাকে কেন বাঁধব? আমি তোমাকে কষ্ট দিতে পারি?’ মিষ্টি করে হাসলো জেহফিল,
‘এটা দিয়ে তুমি আমাকে বাঁধবে। এই যে আমি বসে রইলাম। তুমি সর্বশক্তি দিয়ে আমাকে বাঁধবে এই ফিতে দিয়ে।’
‘তাহলে এটা আমার শাস্তি কীভাবে হলো?’
‘আমাকে বেঁধে তুমি পালাবে।’
ইনান কেশে উঠল। একবার পালিয়ে তার জন্মের শিক্ষা হয়েছে।
‘আপনি কি আমার সাথে মজা নিচ্ছেন?’
‘নোপ। আমি ভেবে দেখেছি, বুঝলে বাটারফ্লাই। তোমাকে তোমার লাইফের ডিসিশন নেয়ার সুযোগ দিবো। তুমি আমার থেকে মুক্তি পাবে, তবে তোমাকে তা অর্জন করতে হবে। কীভাবে অর্জন করবে? আমাকে বেঁধে পালিয়ে।’
ইনানের মাথা ঘুরায়। একদিনে কি জেহফিলের ব্রেইন খুলেছে নাকি, নাহলে ভালো মানুষের মতো চিন্তা করল কীভাবে?
‘আর হ্যাঁ, ঐ লোকের কথা ভেবো না, ও’র ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা আমি করে দিবো। ওর শাস্তি ও পেয়ে গেছে। তাই এ’কে রেখে আমার লাভ নেই।’ গাড়িতে রাখা পলককে ইঙ্গিত করে বলল।
‘হোয়াটএভার, যা বলছিলাম, তুমি আমাকে বাঁধবে, বেঁধে যেখানে চোখ যায় পালাবে।’
‘আপনি তো আমাকে ধরেই ফেলবেন। আজ হোক কিংবা কাল।’
‘নাহ, এই শাস্তির কিছু রুলস আছে। তোমার হাতে কাল সূর্যোদয় অবধি সময় থাকবে। এর সময়ের মধ্যে যদি তুমি আমার চোখের আড়ালে পালিয়ে থাকতে পারো তবে তোমাকে আমি সারাজীবনের জন্য মুক্তি দিয়ে দিবো। আই প্রমিস।’
জেহফিলের চোখে প্রতিজ্ঞা। জেহফিল যে মিথ্যা বলছে না ইনান জানে। কিন্তু সে বুঝতে পারছে না এটা কি আসলেই জেহফিল নাকি! এত পরিবর্তন!
‘আকাশে সূর্যের দেখা পাওয়ার এক সেকেন্ড পরও যদি তোমাকে খুঁজে পাই, তবুও আমি তোমার নিকট হাত বাড়াব না আর। ছেড়ে দেব তোমাকে। তবে তোমাকে পালিয়ে থাকতে হবে এই সময় অবধি। আর যদি এই টাইমের মধ্যে পেয়ে যাই,’ জেহফিল বাঁকা হাসে, ‘তোমাকে আমার বশ্যতা স্বীকার করতে হবে ফর দ্য রেস্ট অফ ইওর লাইফ।’
‘আপনি আমাকে পেয়ে যাবেন।’ ইনান ঠোঁট চেপে বলল।
‘ডিপেন্ড করে তোমার উপর। তুমি কতটা টাইট করে আমাকে বাঁধো তার উপরই নির্ভর করছে তোমাকে পাওয়া না পাওয়া। বলতে পারো এই শাস্তিতে সব রুলসই তোমার হাতে। তুমি কীভাবে নিজেকে আড়ালে রাখতে পারো সেটা তোমার উপর।’
‘আমি কি কারো সাহায্য নিতে পারব?’
‘শিওর। কিন্তু, আমি যদি তোমাকে পেয়ে যাই এবং সাথে তোমার সাহায্যকারীকে দেখি তাহলে ঐ মুহুর্তেই সেই সাহায্যকারীর চোখজোড়া মার্বেলের মতো মাটিতে গড়াগড়ি করবে এবং হাতজোড়া থাকবে রাস্তার কুকুরের মুখে।’
ইনান শরীরে কম্পন অনুভব করব। কী সহজে জেহফিল একজনের মৃ’ত্যুর কথা বলল!
‘আরো একটা রুলস। আমাকে বাঁধতে পারবে যা ইচ্ছে দিয়ে। শুধু এই ফিতে না, যেটা পাবে সেটা দিয়েই বাঁধবে। তবে এইখানেও একটা কিন্তু আছে।’
ইনান প্রশ্ন চোখে তাকায়।
‘তোমার হাতে থাকবে দশ মিনিট আমাকে বাঁধার জন্য। এরমধ্যে যেভাবে ইচ্ছে আমাকে বাঁধতে পারবে। এরপর যেখানে ইচ্ছে সেখানে চলে যাবে। আমাকে যদি ভালোভাবে না বাঁধতে পারো বাটারফ্লাই, তাহলে যে এই সিংহ তোমাকে ফের তার গুহায় গলায় কামড়ে ধরে নিয়ে আসবে।’ ঘাড় কাত করে বলল জেহফিল। ভয়ানক লাগছে তাকে।
ইনান ভাবলো, দশমিনিট অনেক সময়। এর মাঝে জেহফিলকে টাইট করে বাঁধাটা কঠিন হবে না।
‘নাউ ডিসিশন ইজ ইওরস। তুমি কি পালাবে নাকি আমার অর্ডার মেনে আমার সাথে থাকবে?’
‘একটা প্রশ্ন। এমনিতেও আপনার কাছে থাকলে আপনার অর্ডার মানতে হবে, আবার পালানোর পর ধরে ফেললেও অর্ডার মানতে হবে। এখানে কি কোনো ডিফ্রেন্স নেই?’
‘তোমার কি নিজের উপর বিশ্বাস নেই যে তুমি আমার থেকে পালাতে পারবে না?’
ইনান চুপ করে রইল। আসলেই তো, তার কনফিডেন্স এত লো কেন? যেহেতু পুরো গেইমটা তার হাতে, তাহলে তার ভয় কিসের?
‘একটা সুবিধা আছে। পালানোর পর তোমাকে পেয়ে গেলে অর্ডার চেঞ্জ হবে।’
‘যেমন?’
‘যেমন ধরো, আমি এখন যেই অর্ডারগুলো দিয়েছি তা রিপ্লেস করে আমার দেয়া অন্য যেকোনো অর্ডার মাথা পেতে নিতে হবে।’
ইনান কিছুক্ষণ মৌন থাকল। হিসাব মিলাচ্ছে সে।
‘বলো, কী ডিসিশন তোমার? থাকতে চাও নাকি পালাতে?’
‘পালাবো।’ তাৎক্ষণিক জবাব ইনানের।
ইনান যেহেতু মুক্তির পথ পেয়েছে সেহেতু এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। জেহফিলের কাছে থেকে ঐসব আদেশ মানলে সে দুইদিনে পাগল হয়ে যাবে। আজকে পনেরো ঘন্টার মতো পালিয়ে থেকেছে জেহফিলের কাছ থেকে। আর এখন রাত, বারোটা কী একটা। সূর্য উঠতে ছয় ঘন্টার মতো বাকি। পনেরো ঘন্টায় একটা ওড়না দিয়ে বেঁধে পালিয়ে থাকতে পারলে ছয় ঘন্টা তো টাইট দড়ি দিয়ে বেঁধে পালানো আরো সহজ। ইনান হাসলো। কঠিন হবে না এবারের চ্যালেঞ্জটা। রুলস তার হাতে, খেলাটাও তার হাতে।
জেহফিল চেয়ারে গা ছাড়িয়ে আরাম করে বসলো। দেখল তার বাটারফ্লাইয়ের চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে মুক্তির কথা শুনে। এতটাই কঠিন জেহফিলের ভালোবাসা যে ভালোবাসা থেকে বাঁচতে পালানোকেই একমাত্র মুক্তির পথ ভেবে নেয়? জেহফিল মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গভীর চোখে ইনানকে পা থেকে মাথা অবধি দেখলো সূক্ষ্মভাবে। চোখ বন্ধ করে মাথা হেলিয়ে ডিপ ভয়েসে বলল,
‘ইওর টাইম স্টার্টস নাউ কিটেন।’
.
.
চলবে…