#রোদরঞ্জন
#পর্ব_৪০
#আশফি_শেহরীন_চিত্রা
[কপি করা নিষিদ্ধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজে এবং অন্য কোনো সাইটেও কপি করা যাবে না।]
.
.
গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন পরিবেশ। শুনশান নীরবতায় ডুবে গেছে সব। ঘন জঙ্গলের বড় বড় গাছের পাতা যেন নেতিয়ে গেছে ঘুমে। থেকে থেকে দূর হতে ভেসে আসছে শেয়ালের ডাক।
চাঁদের রূপালী আলো গাছের পাতার উপর ঝলমল করছে। যতদূর চোখ যায় ততদূর কেবল গাছেদের মেলা। মনে হয় শেষ মাথায় আকাশ এবং গাছ একত্রে মিলে গেছে। কোনো কৃত্রিম আলো নেই। তার দিকেই এক ধ্যানে তাকিয়ে ছিল তাজবীর। একটা নির্দিষ্ট দিনের অপেক্ষা করছিল কত বছর। সেই দিনটা আসতে চলেছে তবে, কাল পরশুর মধ্যে।
বুকভরে শ্বাস নেয় সে, যেন ঠাণ্ডা বাতাস তার ভেতরে ঢুকে সমস্ত দুঃখ, যন্ত্রণা, ক্রোধ এক নিঃশ্বাসে বের করে দিচ্ছে। এত শান্তি এর আগে কখনো পায়নি।
কিন্তু…! চোখ খুলে সামনের বাসাটার দিকে তাকায় সে, যেখানে বারান্দায় এবং ছাদে স্বল্প পাওয়ারের লাইট জ্বলজ্বল করছে। বুকের ভেতরটায় হুট করে মেঘের ছায়া নামে। একটু আগের প্রশান্তিকে দূর করে গুমোট হয়ে উঠে মন। সামনের বারান্দার পর্দা সামান্য উড়ে গেলে একটা ঘুমন্ত মুখ ক্ষণকালের জন্য ঝলক দিয়ে উঠে চাঁদের মিষ্টি আলোয়। তাজবীর বারান্দার রেলিংয়ে হাত রেখে নির্নিমেষ চোখে চেয়ে থাকে সেদিকে। ইনানের চাঁদের মতো সুন্দর মুখখানি শান্ত অভিব্যক্তিতে বারান্দার দিকে মুখ করে ঘুমিয়ে আছে। তাজবীরের মনে হালকা দ্বিধার একটা সুতো ধীরে ধীরে প্যাঁচিয়ে ধরে তার হৃদয়টাকে।
সে যা করছে, এবং করবে, তা ইনানকে কতটা কষ্ট দিবে তা ভেবেই তার মনের আনন্দ মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। প্রিয় মানুষের সত্যটা যখন ইনান জানতে পারবে তখন নিজেকে সামলাতে পারবে? তাজবীর নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করল, সে কি ঠিক করছে কাজটা? তার মনের কুটিল সত্তাটা ভালোটাকে দমিয়ে রেখে হেসে উঠে উত্তর দিলো,
“তুই যা করছিস সবটাই ঠিক। জীবন একটাই, আফসোস রাখবি না কখনো।”
তাজবীর সমর্পণ করল সেই কুটিল সত্তার নিকট। আসলেই তো জীবন একটাই। এত আফসোস রেখে ম’রবে কেন সে?
তাজবীরের ভাবনার জাল ছিন্ন হয় ইনানের বাড়ির সামনে কাউকে দেখে। ভালো করে দেখার জন্য দূরবীণে চোখ রাখল। তারপর কিছু একটা ভেবে গায়ে শার্ট চড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল।
___
ইনানের গাঢ় ঘুম বিঘ্নিত হয় অস্পষ্ট এক আওয়াজে। ঘুমের ঘোরেই উঠে বসে চারিদিকে চোখ বুলায়, মস্তিষ্ক জেগে নেই। বাইরের চাঁদের আলোয় রুম উজ্জ্বল। ইনান হাতড়ে জেহফিলকে খুঁজতে লাগল। পেল না। কিন্তু ইনানের ঘুমন্ত মস্তিষ্ক জেহফিলের অনুপস্থিতি ধরতে পারল না। কোলবালিশকে জেহফিল ভেবে আবারও ঘুমে তলিয়ে গেল।
প্রায় অনেক, অনেক্ষণ পর ইনান হুড়মুড় করে জেগে উঠে। বাইরের ঠকঠক আওয়াজে। ঝিম ধরে বসে বোঝার চেষ্টা করল আসলেই কি কোনো আওয়াজ পেয়েছে কিনা। তার ভাবনার মাঝেই আবারো জোরে আওয়াজ ভেসে আসে। হঠাৎ আওয়াজে কিছুটা চমকে যায় ইনান। এই গভীর রাতে কে এমন ধাক্কাধাক্কি করছে? আওয়াজ অসহ্য পর্যায়ে চলে গেলে ইনান বিরক্ত হয়ে ধুপধাপ পা ফেলে চলে আসে মেইন ডোরে। এমনভাবে ধাক্কাচ্ছে যেন ভেঙে ফেলবে দরজাটা। সেই মুহূর্তে জেহফিলের কথা ইনানের মাথা থেকেই বেরিয়ে গেছে। তার ঘুমের ঘোর ভালোভাবে কাটেনি। মাথাটা দুলছে। লাইট জ্বালিয়ে ডোর হোলে চোখ রাখতেই ঝটকা দিয়ে উঠে তার শরীর।
তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে দেয় সে। হতবাক কণ্ঠে বলে,
‘আপনি এখানে কেন পলক?’
পলকের চুল এলোমেলো। হাঁপাচ্ছে সে দরজা ধরে। চোখ টকটকে লাল। আগের থেকে বেশ কিছুটা শুকালেও মলিন চেহারাটাও নজরে পড়ার মতো। পলক বড় বড় শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল,
‘জেহফিল..জেহফিল কোথায়?’
‘মানে?’
ইনানের সামান্য কথাটাও যেন পলকের মাথায় আগুন ধরিয়ে দিলো। সে ফোঁস ফোঁস করতে করতে ভেতরে ঢুকে বলল,
‘জেহফিলকে ডেকে আনো। ওর সাথে বোঝাপড়া আছে। এবার আর ছাড়বো না।’ পলকের ঠোঁটে ভয়ানক হাসির দেখা মিলল।
ইনানের মুখ থেকে রক্ত সরে গেল। ঘুম উবে গেছে তার। মনে পড়ে গেল জেহফিল কী নিষ্ঠুরভাবে পলককে মে’রেছিল। তারপর আর পলকের দেখা মিলেনি কয়েক মাস। ইনান ভেবেছিল পলক হয়তো ক্ষমা করে দিয়েছে বা ঝামেলা বাড়াতে চায়নি। কিন্তু হঠাৎ এত মাস পর ওর উদয় হয়ে জেহফিলের খোঁজ করাটা মেনে নিতে পারছে না সে। তবে কি পলকের সাথে হওয়া অন্যায়ের শাস্তি দিতে এসেছে সে। পলক পুলিশ, সে কোনো না কোনোভাবে জেহফিলকে হাজতে নেয়ার জন্য আসেনি তো?
পলক পাগলা ঘোড়ার ন্যায় ইনানের অনুমতি ছাড়া ইনানের রুমে ঢুকে জেহফিলকে খুঁজতে লাগল। উল্টেপাল্টে খাটের নিচে, বাথরুমে, ক্যাবিনেটে, বারান্দায় খোঁজাখুঁজি আরম্ভ করল সে। না পেয়ে আর্ট রুমসহ আরো যতগুলো রুম আছে সবগুলোয় তন্নতন্ন করে খুঁজলো। আর পাগলের মতো বলতে লাগল,
‘আমার সব কেড়ে নিয়েছিস তুই। তোকে আমি ছাড়বো না..তোকে আমি ছাড়বো না।’
ইনান পিছু পিছু আসতে লাগলো পলকের। আর বারবার তাকে থামানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। প্রত্যেক রুমে জেহফিলকে খুঁজে না পাওয়া তাকে ভাবিয়ে তুলল। জেহফিলের ক্রাচটাও টেবিলের কাছে, মনে হয় না পলক তা খেয়াল করেছে। ইনান মনেপ্রাণে চাইছে জেহফিল যেখানেই থাকুক যেন কোনোভাবে বেরিয়ে না আসে। সে জেহফিলকে হারাতে চায় না, কোনোভাবেই না। যদি পলক কোনোভাবে জেহফিলের খোঁজ পেয়ে যায়, জানে না সে পলককে কী করবে। জেহফিলকে বাঁচানোর জন্য যা করার সবটা করবে। দরকার পড়লে সেদিনের জেহফিলের মতো করে ধরে রেখে মে’রে স্মৃতি ভুলিয়ে দিবে। কিন্তু পলকের মতো শক্তিশালী একটা ছেলেকে ইনানের মতো পুটি মাছ কীভাবে ধরবে? এই চিন্তায় ইনান পলককে ধরার চিন্তা বাদ দিলো।
পলক এতটাই উত্তেজিত ছিল যে তার হতবুদ্ধি লোপ পেয়েছে, সে কিচেনের ক্যাবিনেট পর্যন্তও খুলে খুলে দেখছিল যেন জেহফিল তার বিশালাকার চওড়া দেহ নিয়ে ছোট্ট ক্যাবিনেটে লুকিয়ে থাকবে।
সে নিচের গোডাউনও পর্যন্ত পাগলের মতো খুঁজে এসেছে। উপরে এসে একটা রুম তিন চারবার করে চেক করেও জেহফিলের টিকিটারও দেখা মিললো না।
শেষমেষ হতাশ হয়ে পলক থামল। তার কপাল বেয়ে টুপটুপ করে ঘাম ঝরছে। পরনের শার্ট ভিজে গেছে।
‘অ্যাটলিস্ট বলবেন তো জেহফিলকে কেন খুঁজছেন?’
পলক ক্রুর চোখে ইনানের দিকে তাকায়। আজ সে দেশে এসেছে। এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতেই তার মোবাইলে টুং করে একটা মেসেজ আসে। বিরক্ত হয়ে মোবাইল অফ করতে নিলে দেখে একটা ছবিও আসে। শরৎএর বোন রুহি তার এক্স গার্লফ্রেন্ড ছিল, এখন আবার পলককে পাওয়ার জন্য পিছু পিছু ঘুরছে। আর সে কারণে নাম্বার যোগাড় করে তাকে বিরক্ত করা শুরু করেছে। প্রতিদিন খালি মেসেজ করবে কোনো না কোনো অযুহাতে। পলক পাত্তা দেয় না। যে মন থেকে উঠে গেছে তাকে সহজেই আগের মতো মনে জায়গা দেয়া যায় না। পলক সবসময় রুহির মেসেজ ইগনোর করে। কিন্তু পরপর কয়েকটা ছবি পাঠালো রুহি, ধমক দেয়ার জন্য পলক মেসেজে যেতেই তার রুহ কেঁপে উঠল ছবিটা দেখে। একটা দেহের কয়েকটা অংশ কাটা অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, মাটি লেগে আছে, যেন কেউ মাটির নিচ থেকে তুলে এনেছে। শরীর থেকে গলা আলাদা করা, চোখ মুখ কোনটা কোথায় বোঝা যায় না। দেখেই পলকের গা গুলিয়ে উঠলো।
রুহি সাথে সাথেই কল দিলো। পলক ধরতেই রুহির কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘শরৎ…আমার ভাই শরৎ…’
পলক চমকায় অনেক। এই কাটা বডিটা শরৎএর হতে পারে সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। লম্বা দম ছেড়ে বলল,
‘রুহি, কাম ডাউন। কী হয়েছে আমাকে বলো!’
‘ও..ও.. ইনানের বাসায় গিয়েছিল গতকাল।’
‘কেন?’
‘তুমি..তো জানোই, আমার ভাই ইনানকে পছন্দ করে..’
পলক উড়া খবরে শুনেছিল অবশ্য, কিন্তু গায়ে মাখায়নি। জেহফিল যেই বাঘ, তার মুখ থেকে শিকার ছিনিয়ে আনা শরৎএর মতো সাধারণ মানুষের কর্ম নয়। যেখানে সে নিজেই পারেনি।
‘ও, কালকে ইনানের কাছে গিয়েছিল..জাস্ট..জাস্ট এমনি..ইনানকে দেখতে…কিন্তু তারপর থেকে সারারাত কল দিয়েও তাকে পাইনি আমি। পরে…আজকে সন্ধ্যায়ও যখন খোঁজ পাইনি তখন…তখন ফেসবুকে একটা নিউজে দেখতে পাই দূরের জঙ্গলের রাস্তায়… আমি চলে যাই সেখানে…তারপর ওর পকেটের জিনিসপত্র, হাতের ব্রেসলেট, ট্যাটু দেখে বুঝতে পারি এটা শরৎ। ও..ওকে এত নৃশংসভাবে মারা হয়েছে…’
বলতে বলতেই ডুকরে কেঁদে ওঠে সে, ‘আমার ভাইটা..আমার ছোট্ট ভাইটা…’
পলক সাথে সাথে ফোন কেটে নিউজে ঢুকে। রুহির কথা আসলেই সত্য। ড্রাইভারকে ব্যাগপত্র দিয়ে পাঠিয়ে নিজে গাড়ি করে চলে যায় জেহফিলের বাড়িতে। উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছিল সে। শরৎএর মৃ’ত্যুতে তার একটুও খারাপ লাগেনি। ওর বাজে রেকর্ড সম্পর্কে সে জানে, এমনকি ও ইনানকে পছন্দ করে সেটাও পলক মেনে নিতে পারেনি। যাক, একজন প্রতিযোগিতা আউট হলো। এবার তার জেহফিলকে ধরা সহজ হবে। পথের কাঁটা সরবে। শরৎকে যে জেহফিল মে’রেছে সে সম্পর্কে একশো পার্সেন্ট নিশ্চিত সে। জেহফিলের হিংস্রতার মুখোমুখি হয়েছিল সে, তাই জানে জেহফিল কেমন। কেউ ইনানের দিকে হাত বাড়ালে সে যে কতটা হিংস্র জন্তুতে পরিণত হয় সেটা পলক ছাড়া আর কেই বা ভালো জানবে?
ইনানকে পাওয়ার আশায় সে প্রায় হাল ছেড়েই দিয়েছিল। তাই এরপর আর কখনোই ইনানের খোঁজ নেয়নি সে। কষ্ট হতো অবশ্য। কিন্তু মুভ অন করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু এবার আশার আলো উঁকি দিয়েছে। প্রমাণ হাতে আছে তার। ইফাজ খানকেও এবার চেপে ধরবে। জেহফিলকে শাস্তি না দিয়ে যাবে কোথায় সে?
‘কিছু বলছেন না কেন?’
বাস্তবে ফিরে আসলো পলক। ইনানের ভয় পাওয়া ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে ইনানের কাছে আসলো সে। ইনানের গালে হাত রাখল হঠাৎ। ইনান পলককে ধাক্কা মেরে সরাতে চাইলেও পলক সরল না, বরং ইনানের গাল দুহাতে আঁজলায় নিয়ে, ইনানের কাছাকাছি মুখ এনে বলল,
‘ইনান, আমি জানি তুমি যে জেহফিলের সাথে সুখী নও। ওর মতো জানোয়ারের সাথে কেউ সুখী হতে পারবে না, এটাই স্বাভাবিক। বাট আর না। তুমি অনেক সহ্য করেছো। এবার তোমারও মুক্তি মিলবে। জেহফিল সেবার পার পেয়ে গেলেও এবার আর পাবে না তোমার । তখন তো এভিডেন্স ছিলো না। এবার আছে। ও যাতে জেল থেকে কোনোদিন ছাড়া না পায় সেই ব্যবস্থাও করব আমি।’
ইনান পলকের হাত ঝাড়ি মেরে সরিয়ে দেয়। ইচ্ছে করছে পলকের মুখে থুতু ছুঁড়ে মারতে। সে কিনা জেহফিলের সাথে সুখী না? হাস্যকর!
‘জেহফিল এবং আমি সুখেই আছি। আপনাকে তা নিয়ে ভাবতে হবে না। বরং উনি আমার সাথে না থাকলে আমি পাগল হয়ে যাই। ওনাকে ভালোবাসি আমি। পাগলের মতো।’
‘আমি জানি ইনান, তুমি যে চাপে পড়ে বলছো। জেহফিলের ভয়ে।’
‘আপনি কি বাংলা বুঝেন না? স্পষ্টই বললাম আমি জেহফিলকে ভালোবাসি, আর আপনার কাছে মনে হচ্ছে আমি ভয়ে বলছি?’
‘অবশ্যই। ওর মতো একজন মানুষ কখনো ভালোবাসার যোগ্য হতে পারে না। তুমি কখনো জেনেবুঝে এখজন ক্রিমিনালের সাথে সংসার করবে?’
‘সেদিন আপনাকে রাগের বশে মেরেছিল বলে আপনি জেহফিলকে ক্রিমিনাল বলতে পারেন না।’
‘তাহলে তুমি জানো না মেবি। জেহফিল শুধু আমাকে মা’রেনি, শর..’
‘হ্যালো, মে আই কাম ইন?’
ইনান আর পলক দুজনেই অসময়ে আসা অপ্রত্যাশিত ব্যক্তির দিকে তাকায়। তাজবীর সহাস্যে দাঁড়িয়ে আছে।
‘কে আপনি?’ পলকের প্রশ্ন।
‘ইনানের নেইবার।’
‘এত রাতে কী চাই আপনার?’
‘সেটা আমারও প্রশ্ন। এত রাতে আপনার কী চাই?’
তাজবীরের ত্যাড়া ত্যাড়া জবাবে পলক রেগে যায়, ‘আমার পরিচয় জানা থাকলে আপনি এটা বলার সাহস পেতেন না।’
‘অবশ্যি জানি ইন্সপেক্টর পলক।’
‘তো আর কী, পুলিশের কাজ পুলিশ করছে। আপনার নাক না গলালেও চলবে।’
‘যেহেতু ব্যাপারটা আমার কাছের মানুষকে নিয়ে জড়িত, সেহেতু নাক কেন, পুরো শরীরটাকেই গলাতে হবে।’
তাজবীর এগিয়ে আসে, ‘বাই দ্য ওয়ে। আপনার কিছু কথায় বুঝলাম জেহফিলকে গ্রেফতার করতে এসেছেন। আর কেন এসেছেন সেটা আমি নিউজ দেখেই বুঝতে পেরেছি।’
পলক তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় তাজবীরের দিকে। এই লোকটা শরৎএর কথা বলছে, তার মানে সে জানে এর পেছনে জেহফিলের হাত আছে কারণ সে জেহফিলের নেইবার।
পলক তাজবীরের কাছে এসে বলল,
‘কী জানেন আপনি?’
‘বলব, অবশ্যই বলব। তবে একটা কথা বলুন তো, ইনান আর জেহফিলের যে দুই তিনমাস আগে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল সেটা সম্পর্কে আপনি জানেন?’
পলক বিস্মিত হয়। সে জানতো না। মূলত দেশের কোনো খবরাখবরই সে জানার চেষ্টা করে না।
‘না।’
‘আমার ধারণাই সঠিক। আচ্ছা এবার তাহলে আমি যা জানি তা আপনাকে বলব। তবে এখানে না। চলুন আমার বাসায়।’
পলক যেতে চাইছিল না, জেহফিলকে ধরাই তার মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু এখন এই লোকটার থেকে যদি স্ট্রং কোনো প্রমাণ পায় তাহলে জেহফিলকে হাত করা আরো সহজ হবে। তাই সে আর তাজবীর চলে যায়।
ওর চলে যেতেই ইনান হন্যে হয়ে জেহফিলকে খুঁজতে লাগল। প্রায় কয়েকবার ডাকল। চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার। পরে কী মনে করে ছাদে যায় সে। ছাদেও যখন পেল না তখন পেছন থেকে কারো আওয়াজ আসে।
‘Missed me, butterfly?’
ইনান পেছনে ফিরে দেখে জেহফিল রেলিংএর সাথে হেলান দিয়ে ঘাড় কাত করে তাকিয়ে আছে। ইনান দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে জেহফিলকে। কেঁদে দিলো সে। জেহফিলও জড়িয়ে ধরল তাকে।
‘আপনি কোথায় ছিলেন, এত খুঁজলাম আপনাকে।’ ইনান জেহফিলের পায়ের দিকে তাকায়, ‘ক্রাচ ছাড়া আপনি এখানে কীভাবে এসেছেন?’
‘হাঁটার চেষ্টা করেছিলাম বাটারফ্লাই। যদিও অনেক পেইন হয়েছিল বাট সফল হয়েছি। এক ঘন্টা লেগেছে এখানে আসতে।’
‘আপনি আমাকে একটাবার বলবেন না? এত টেনশনে রাখেন কেন বলুন তো?’
‘সো সরি সোনা।’ ইনানের গালে টুপ করে চুমু খায় জেহফিল, ‘তুমি খুশি হওনি আমার চেষ্টাতে?’
‘অবশ্যই হয়েছি। আমি অনেক খুশি, আপনি আবার আগের মতো হাঁটতে পারবেন।’
‘মেবি, মেবি নট!’ জেহফিল ইনানের চুল এক আঙ্গুলে নিয়ে প্যাঁচিয়ে খেলতে লাগে।
ইনান এবার ভাবল সবটা বলে দিলো জেহফিলকে। পলকের আসা, তাকে খোঁজা, এমনকি ইনান নাকি জেহফিলকে ভালোবাসে না সেই কথাও, ও নাকি ইনানকে মুক্তি করবে জেহফিলের থেকে। পলক ইনানের গাল ধরেছে সেটাও বলে দিলো। মূলত প্রত্যেকটা ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিলো সে। যেমনটা ছোট বাচ্চারা তাদের প্যারেন্টসদের সব বলে দেয়।
ইনানের মুখে পলকের জন্য এক আকাশ ঘৃণা দেখা দেয়। ঘৃণার চোটে পলককে উদ্দেশ্য করে থুতুও ছুঁড়ে। জেহফিল ইনানের গালে অসংখ্য চুমু খেতে লাগলো হঠাৎ। যেন চুমু দিয়ে দিয়ে পলকের হাতের স্পর্শ মুছে ফেলতে চাইছে।
এক পর্যায়ে জেহফিল ইনানের গালে ঠোঁট হালকা করে চেপে বলে,
‘পলককে তুমি খুব ঘৃণা করো তাই না?’
‘প্রচুর। ব্যাটার সাহস কত!! বলে কিনা আমি নাকি হ্যাপি না আপনার সাথে।’
‘ও’কে শাস্তি দিতে পারলে তোমার ভালো লাগতো?’
‘লাগতো না সেটা বলব না। তবে দুইটা থাপ্পড় দিতে ইচ্ছা করছিল।’
জেহফিল ইনানের হাত দুটো একহাতে চেপে ধরে চুমু খায়,
‘তোমার এই নরম হাত দুটো ঐ পলকের গালে লাগবে সেটা আমি কীভাবে সহ্য করব বাটারফ্লাই? আর তোমাকেই বা কেন কষ্ট করতে হবে? আমি আছি না?’
‘বাদ দিন ঐ বেয়াদবের কথা। অসভ্য একটা। আরেকবার আসুক। গরম পানি ছুঁড়ে মারব মুখে আপনাকে নিয়ে বাজে কথা বললে।’
‘বাটারফ্লাই!’ ইনানের গলায় মুখ রেখে চুমু খেল সে, ‘এক কাজ করি?’
‘কী?’ ইনান চোখ বন্ধ করে জেহফিলের পরশ উপভোগ করতে লাগল।
‘মে’রে ফেলি পলককে?’
‘ইনান ঝট করে চোখ খুলল, ‘কীহ?’
জেহফিল মৃদু হেসে বলল, ‘জাস্ট কিডিং। আমি এই অবস্থায় হাঁটতেই পারছি না, ওকে মা’রব কীভাবে?’
‘যদিও আমি আপনার এই অ্যাগ্রেসিভনেসটাকে ভালোবাসি জেহফিল, কিন্তু কাউকে আমার জন্য একেবারে মে’রে ফেলবেন তা একটু কম ভালোবাসি। আর কখনো মা’রামারি কথা বলবেন না।’
‘আচ্ছা সোনা।’ জেহফিল বাঁকা হেসে ইনানের কাঁধে মাথা রেখে বলল।
.
.
চলবে…
#রোদরঞ্জন
#পর্ব_৪১
#আশফি_শেহরীন_চিত্রা
[কপি করা নিষিদ্ধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজে এবং অন্য কোনো সাইটেও কপি করা যাবে না।]
.
.
‘ইনানের বাবা, ইফাজ খানকে চিনেন নিশ্চয়ই? আপনি তো ওনার আন্ডারেই ছিলেন তাই না?’
তাজবীরের নিচ তলার রুমে দুইটা আরএফএলের চেয়ারে মুখোমুখি বসে আছে পলক আর তাজবীর। আর ছোটো একটা টুলের উপর কফি। পলক ছুঁয়েও দেখল না। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ হলেও পলকের কাছে গরম লাগছে অনেক। সে শার্টের দুইটা বোতাম খুলে রাখলো। তাজবীর কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে আর পলককে ডিটেকটিভদের মতো প্রত্যক্ষ করছে। পলকও তো সুন্দর কম না। তাহলে ইফাজ খান পলককে ছেড়ে জেহফিলের মতো জানোয়ারের কাছে কেন মেয়ে দিলো? যাকগে, সেটা নিয়ে তার মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।
পলক সটান বসে আছে। তার অভিব্যক্তি বোঝা দুষ্কর। ভ্রু কুঞ্চিত করে শক্ত চোয়াল উঁচু করে পায়ের পা তুলে বসে আছে। ব্যাটার ভাব এমন যেন সে না, তাজবীর এখানে অতিথি হয়ে এসেছে, আর সে ঘরের মালিক। সে তাজবীরের কথার জবাব না দিয়ে ফের প্রশ্ন করে,
‘মেইন টপিকে আসুন। শরৎকে কে খুন করেছে সেটা আপনি ভালো ভাবেই জানেন তাই না?’
‘ইয়াপ।’ কফির মগ ঘুরাতে ঘুরাতে বলল।
‘আর সেটা জেহফিল। সেটাও কি জানেন?’
‘অবশ্যই জানি।’
‘পার্ফেক্ট।’ পলকের মুখ উজ্জ্বল হলো। জেহফিলকে কী কঠিন শাস্তি দেয়া যায় ভাবতে লাগে সে। ফাঁ’সি দিবে? নাকি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড?
‘আর কী এভিডেন্স আছে আপনার কাছে? যাতে জেহফিলকে ধরা সহজ হয়ে যায়?’
তাজবীর তেরছা হাসে, দুই হাঁটুতে কনুই রেখে সামনে ঝুঁকে আসে। নিচু স্বরে বলে, ‘ভিডিও আছে।’
পলক প্রসন্ন হাসলো। এ তো মেঘ না চাইতেই জল। তার ভেতরটা উত্তেজনায় ছটফট করছে। এত ভয়ানক ভাবে হ’ত্যা করার ভিডিও দেখলে আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড না, বরং মৃ’ত্যু দিবে। আর সেটাই তো পলক চায়। অবশেষে.. অবশেষে ইনান তার হবে। ভেতরে ভেতরে এক্সাইটেড হলেও মুখে প্রকাশ করল না সে। ভাবভঙ্গি ফর্মাল রেখে বলল,
‘আশা করছি আপনি আমাদের হেল্প করবেন ভিডিওটা দিয়ে। ইউ নো, এই ধরনের মানুষ কতটা ডেঞ্জারাস। নেক্সট টার্গেট কে হয়, আবার কাকে মা’রে, এরা একটা আতঙ্ক ক্রিয়েট করেছে।’
‘অবশ্যই হেল্প করবো মি. পলক।’ দাঁত বের করে চমৎকার হাসলো তাজবীর, তার গালের টোল ভারী সুন্দর। ‘আপনাকে একজন ডিসেন্ট পুলিশ অফিসার মনে হয় আমার কাছে। তাই আপনাকে আরো একটারও ভিডিও দিবো।’
কমপ্লিমেন্ট কানে নিলো না পলক। বহুবছরের প্র্যাকটিস করা লোক দেখানো হাসি হাসলো।
‘জেহফিল আমাকেও মা’রতে এসেছিল। সেই ভিডিও আমি রেখেছি। অবশ্য লুকিয়ে লুকিয়ে জান হাতে নিয়ে করতে হয়েছে।’
আর কী লাগে পলকের? অনেক প্রমাণ আছে। শরৎকে মা’রার ভিডিওটাই তো মেইন। আরেকজন ভিক্টিম পাওয়া গেল তবে।
‘ভিডিওগুলো দিন।’
পলকের তাড়া বুঝল তাজবীর। কিন্তু এত সহজে তো দিবে না। তার উদ্দেশ্য তো আগে হাসিল করতে হবে। পলক লোকটা জেহফিলকে ধরার জন্য পাগল হয়ে আছে। নিশ্চয়ই এই শালাও ইনানের উপর নজর দিয়েছে। ইনানের জন্য তার চোখে ভালোবাসার ঝিলিক তাজবীরের নজর এড়ায়নি তখন। শিট পলক। শরৎএর মতো যেন তোমার অবস্থা না হয়!
‘দিবো। তার আগে আরো একটা ভিডিও দিবো আপনাকে।’ তাজবীর চাইলেই এখন সবগুলো ভিডিও দেখিয়ে সবকিছুর ইতি ঘটাতে পারে। কিন্তু তার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি এসেছে। কোনো কারণ ছাড়াই তাকে যেমন দৌড়ানি খেতে হয়েছিল, তেমন পলককেও একটু নাকানিচুবানি না খাওয়ালে তার ভালো লাগবে না। একটু স্বাদ নিক না। সমান সমান হয়ে গেল। দুজনে তখন গলা জড়াজড়ি করে দুঃখের গান গাইবে।
‘কীসের?’ উৎকণ্ঠা নিয়ে জানতে চায় পলক।
‘ইফাজ খানকে তো চিনেন?’ তাজবীর থামে।
‘এটা বলার কী আছে? তারপর বলুন।’
তাজবীর কিছু না বলে মোবাইলে একটা ভিডিও অন করে পলকের চোখের সামনে ধরল। পলক স্তব্ধ বনে যায় ভিডিওটা দেখে। ভেতরকার সব উত্তেজনা বাষ্পের মতো মিলে যায়। চোখ অনুভূতিশূন্য। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার। আদৌ কি ইফাজ এই হ’ত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত? সে যা দেখছে তা তার ভ্রম নয়তো?
ভিডিওতে দেখা যায় ইফাজ খান কাকভেজা হয়ে জঙ্গলে মাটি খুঁড়ে সেখানে একটা বস্তা গেঁড়ে দিচ্ছে। বস্তায় এবং ইফাজের জামায় রক্ত মাখানো। বস্তার মুখ ভালোভাবে আটকানো না থাকায় হঠাৎ একটা চকচকে জিনিস নিচে পড়ল। জুম করলে দেখা গেল, একটা হাতের কাটা অংশে ঘড়ির গ্লাস চকচক করছে। পলক চিনে ফেলল চট করে, আজ রুহি শরৎএর যেই ছবিগুলো তাকে পাঠিয়েছিল সেখানেও সেইম কাটা হাতের ঘড়িটা দেখতে পেয়েছে।
তাজবীর মোবাইল সরিয়ে নিলো। পা দিয়ে ফ্লোরে ঠুকঠুক আওয়াজ করছে সে, মুখ গোল করে শ্বাস ফেলে বাইরে তাকায়। আরেকটু পর ভোর হয়ে যাবে। তাজবীর সেদিন বারান্দায় ইনানের খোঁজে গেলে দেখতে পায় বাসার সামনে ইনানের বাবার গাড়ি। ইনানের বাবা গাড়ির ডিকিতে কিছু একটা ঢুকানোর জন্য হুড়োহুড়ি করছেন। কাছ থেকে পর্যবেক্ষণের জন্য তাজবীর বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়ে। গাছের আড়ালে থেকে লক্ষ্য করে সবটা। ইফাজের গায়ে রক্ত দেখতে পায়, আর বস্তাতেও রক্তাক্ত কিছু একটা। তার মন কু গাইছে, কোনো খারাপ কিছু হতে চলেছে…আঁচ করতে পারছে সে।
ইফাজ গাড়ি নিয়ে চলে গেলে সেও পিছু নেয় নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে। যখন দেখল দূরের এক জঙ্গলে গাড়ি থেমেছে সে গাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে রাস্তার বাঁকে রেখে আসে যেন চোখে না পড়ে। তারপর দ্রুত দৌড়ে দৌড়ে আসে সে জায়গায়। অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় এবং বৃষ্টি থাকায় সমস্যা হয়নি। দেখল ইফাজ মাটি খুঁড়ছে। মোবাইলের ক্যামেরা অন রাখল। মাটিতে সেই বস্তা কবর দিয়ে চোরদের মতো পালায় ইফাজ। ক্যামেরা অফ করে তাজবীর মাটি খুঁড়ে বস্তা বের করে। কেননা সে দেখেছে একটা কাটা হাতকে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে। বস্তা বের করার পর যা দেখল তাতে সঙ্গে সঙ্গেই ভেতর থেকে সব উগড়ে দিলো তাজবীর। শরৎএর চেহারায় কয়েকটা কো’প পড়লেও বুঝা যাচ্ছিল। তাজবীর বেশিক্ষণ থাকতে চাইল না। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। বস্তাটা টেনে রাস্তার ধারে রেখে গাড়ি নিয়ে চলে আসলো। ইফাজ খানকে ছাড়বে না সে। শাস্তি দিতে না পারোক, অন্তত অনুশোচনায় ভুগাতে তো পারবে! সারাজীবন অনুশোচনা করে ধুঁকে ধুঁকে মরা-ই বড় শাস্তি।
‘কান্ট বিলিভ দিস..’
পলক থেমে থেমে বলল। তাজবীরের ভাবনার সুতো কাটে। সে পলকের দিকে নজর বুলায়। দেখে মনে হচ্ছে পলকের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। পলকের যেন হাত তুলতেও কষ্ট হচ্ছে। কাঁপা কাঁপা হাতে পানির গ্লাস নিয়ে কাষ্ঠ গলাকে ভিজিয়ে শান্তি দেয়। অস্বাভাবিক লাগছে তাকে।
তাজবীর জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। উঠে গিয়ে পলকের কাঁধে হাত রাখে। পলক ধাতস্থ হলে মোবাইল বের করে ইফাজের নাম্বারে ডায়াল করে। তাজবীর তা দেখে মোবাইল নিয়ে কেটে দেয় কল।
‘এখন না। সকাল হোক।’
পলক দুই হাতে মাথা চেপে ধরে নুইয়ে রাখে। যাকে আইডল ভাবত…যাকে এত শ্রদ্ধা করত…যাকে বাবার স্থান দিলো…দেবদূতের চোখে দেখত..সেই লোকটা পুলিশ হয়েও এত বড় একটা অপরাধ কীভাবে করতে পারল!! জেহফিল যতই শরৎকে মা’রুক, সাহায্য করেছেন তো ইফাজ। প্রত্যক্ষভাবে না হোক পরক্ষভাবে তো সাহায্য করেছে! শুধুমাত্র নিজের মেয়ের কথা ভেবে জেহফিলের মতো নিকৃষ্ট একজন খু’নিকে ছেড়ে দিলো!
পলকের কাঁধে রাখা হাত শক্ত করে চেপে সান্ত্বনা দেয় তাজবীর। পলক মলিন চোখে তাকায়, কিছু সময়ের ব্যবধানেই তার চেহারার বয়স যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।
‘মি. পলক। লিসেন। আগে জেহফিলকে ধরুন। মেইন কালপ্রিট ও। ও কিন্তু খুব চালাক। এত সহজে ধরতে পারবেন বলে মনে হয় না। হাতের কাছে থাকলেও এত সহজে ধরা দেবে না সে। এক কাজ করা যায়।’
তাজবীর ঠোঁট চেপে ভাবল, ‘ইফাজ খান আর জেহফিলকে একসাথেই ধরে ফেলুন।’
পলকের চোখ প্রশ্ন দেখে তাজবীর নিজেই বলে, ‘ইজি ওয়ে। জেহফিলকে ধরতে পারলে ইফাজ খান পালাবে না। উল্টো দেখবেন নিজেই হার স্বীকার করবে। বেটার হয় প্ল্যান করে ওদের দুজনকেই একসাথে ধরুন। অবশ্য আমার কাছে একটা প্ল্যান আছে, তবে সেটাতে আপনার লাইফেরও রিস্ক আছে।’
‘ডোন্ট কেয়ার, বলুন।’
তাজবীর হাসে, ‘ম’রতে রাজি আছেন মনে হচ্ছে।’
তাজবীরের উপহাস বিরক্তির উদ্রেক ঘটায় পলকের মনে।
‘ক্যান ইউ প্লিজ…’
‘সরি। যাইহোক, আমি আপনাকে হেল্প করতে পারি। তবে তার আগে একটা কাজ করতে হবে আপনাকে। ওহ, আরেকটা কথা বলতে তো ভুলেই গেছি। কয়েকমাস আগে যে ওদের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল আপনি জানেন?’
ভ্রু কুঁচকায় পলক, ‘ইনানের?’
‘দুজনেরই। কার অ্যাক্সিডেন্ট। আর তাতে ইনান গুরুতর আহত না হলেও জেহফিলের এক পা ভেঙে যায় মেবি। হাঁটতে চলতে কষ্ট হয়। দেখি আমি এখান থেকে।’
‘সত্যিই ভাঙলে ও খু’ন করতে পারতো না।’
‘হয়তো, হয়তো না। নাটক করছে কিনা সেটা আমিও নিশ্চিত না। আমাকে মা’রতে আসার টাইমে তো দেখলাম খুঁড়িয়ে আসছে।’
‘নাটক করছে, একশ পার্সেন্ট শিওর থাকেন।’
.
সকালের নরম রোদ লুটোপুটি খায় তাজবীরের মেঝেতে। পলক বিদায়ের জন্য উঠে পড়ে। পলকের সাথে হ্যান্ডশেক করে হঠাৎ তাজবীর বলে,
‘সাবধানে থাকিয়েন। আবার প্ল্যানের আগেই আপনি কেল্লাফতে হয়ে যাবেন না যেন।’
‘ল্যাংড়া জেহফিল মা’রবে নাকি আমাকে?’
‘হু নোউজ, মা’রতেও পারে। সাইকোদের ঠিক আছে নাকি? টেক কেয়ার।’
________
ইনান মুড অফ করে বসে আছে। জেহফিল আয়নায় ইনানের বিষন্ন সুশ্রী চেহারা দেখে যাচ্ছে একধ্যানে। তার বাটারফ্লাই হাসিখুশি থাকলেও যতটা সুন্দর লাগে, অভিমান করলে তারচেয়েও বেশি সুন্দর লাগে। এত মারাত্মক নজরকাড়া কেন তার ওয়াইফ! তার ওয়াইফ! জেহফিলের ওয়াইফ! কথাটা ঝনঝন করে উঠল বুকের মাঝে। তারই তো! আর একমাত্র, ব্যক্তিগত, নিজের ওয়াইফ! তার এত প্রীটি বাটারফ্লাইএর দিকে অন্য ছেলের নজর সে সহ্য করবে কীভাবে? ধপ করে জ্বলে উঠল সে। চোখে হঠাৎ অগ্নিশিখা ঝিলিক দিচ্ছে। পলক…জানোয়ারটা তার বাটারফ্লাইয়ের গালে হাত রেখেছে! কাছে এসেছে, খুব কাছে! তাও তার নিজের বাড়িতে দাঁড়িয়ে! বুকের পাটা কতটুকু তা দেখার ইচ্ছা জাগল প্রচণ্ড। তার জন্য আগে তো বুক কা’টতে হবে। বুক থেকে বুকের পাটা আলাদা করতে হবে। কী দিয়ে আলাদা করবে সে? চোখ গেল স্কাল্পচার বানানোর চিকন ধারালো ছুরির দিকে।
জেহফিল নাকি আজকে রান্না করবে। সেটা নিয়ে ঝগড়া করছে তারা। ইনানই ঝগড়া করছে মূলত। জেহফিল অপলক ইনানকে দেখে চলেছে। ইনান মুখ গোমড়া করে বলল,
‘এই আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন?’
‘সে তো তোমাকে দেখার পড়েই হয়েছি।’ চোখ টিপে দুষ্টু হেসে বলল জেহফিল।
‘নাটক কম করবেন। এমনিতেই হাঁটতে চলতে পারেন না, তা রান্না কীভাবে করবেন?’
‘রান্না করতে পা লাগে?’
‘না লাগুক। চেয়ারে বসে রান্না করবেন আমি জানি। কিন্তু কোনো টাইপের হেল্প নিবেন না এটা কেমন কথা? অ্যাটলিস্ট, আমি কেটেকুটে দেই, মাংস কাটি, সবজি কেটে দেই, সব এগিয়ে দেই, আপনি রান্না করেন। তাও করবেন না। সমস্যাটা কী আপনার?’
‘সমস্যা হচ্ছে এতদিন আমার বউ আমাকে কষ্ট করে রান্না করে খাওয়াচ্ছে তা আমার সহ্য হচ্ছে না। বউএর কষ্ট দেখতে পারছি না।’
‘আপনি কী…’
‘আর কোনো কথা না। যদি তুমি জোর করো তাহলে আমি কিচ্ছু খাবো না, ঔষধও না। অ্যান্ড আই মিন ইট। বোঝা গেছে?’
ইনান রাগত স্বরে আরো কথা বলতো, জেহফিলের চোখ গরম করা দেখে কিছু বলল না। দুইজন রেগে গেলে সমস্যা।
___
রাতের রান্নার জোগাড় সন্ধ্যাতেই করে ফেলতে চাইছে জেহফিল। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়াটা খারাপ না। খিচুড়ি করা যায়। বৃষ্টিময় আবহাওয়ায় ইনানের মোস্ট ফেভারিট খাবার খিচুড়ি। সাথে আমের আচার। আজ ইনানের পছন্দমতো সব রান্না করবে সে। তার ডিনারকে ভালোমতো ডিনার না করালে তো তুষ্ট হবে না।
কিচেনের জানালা দিয়ে বৃষ্টির পানি আসলে জেহফিল আটকানোর জন্য এগিয়ে যায়। তখন দেখল একটা গাড়ি তাদের বাড়ির নিচে থেমেছে। আর গাড়ি থেকে নেমে আসছে অপ্রত্যাশিত অতিথি..পলক। তা দেখে বাঁকা হাসলো জেহফিল। হাতের ছু’রিটা চেপে ধরল কিচেন ক্যাবিনেটের উপর। বিড়বিড় করে বলল,
‘looks like we’re going to have a guest today. A very very important guest…’
.
.
চলবে…