যে প্রেম হঠাৎ আসে পর্ব-০৫

0
116

#যে_প্রেম_হঠাৎ_আসে❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম.
– পর্ব:০৫

দুপুরের ভ্যাপ্সা গরমে নিজের বিছানায় বসে আছে ইহান। গাঁ চুইয়ে মৃদু ঘামের ছড়াছড়ি। হাতে গিটার। মাথার ওপর সিলিং ফ্যানটা ভনভন শব্দ করে ঘোরে। ইহানের হৃদয় জুড়ে বিষণ্ণ ভাব। অন্তর জুড়ে অনুজাকে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু আজ কোথাও গিয়ে বড্ড ক্লান্ত লাগে তার। ইহান কি হাপিয়ে উঠেছে খুব?– অবশ্যই ওঠে নি। তবুও আজ বড় খারাপ লাগছে ইহানের। বহুদিন পর তার মনে হচ্ছে। ইহানের রাত্রীপ্রিয়া ইহানের হবেনা। ইহান বিষণ্ণ মনে গিটার চালায়। ঝনঝন করে শব্দ হয় কয়েকবার। এরপরই নিদারুণ কণ্ঠে যন্ত্রণার ভীড় নিয়ে ইহান গেয়ে ওঠে। একটা গানের মাঝখানের লাইন–
❝আমার আকাশে আজ বরিষরন,
কালো মেঘে ঢাকা এ মন।
ফিরে-তো পাবোনা তোমাকে কভু আর,
হবে না তুমি-তো আমার।
খুলে মনো দ্বার ভাঙ্গা মন আমার,
খোঁজে তোমাকে বারেবার।❞

তীব্র গরমে জ্বালা ধরানো হৃদয় নিয়ে গান গাইছে ইহান। গিটারের তীব্র শব্দে চারপাশ হচ্ছে বিষাক্ত। মৃদু বাতাস আসে জানালার কার্ণিশ ছুঁয়ে। ওপাশের রমণী সেই গান শোনে। তবুও পাষাণ হৃদয় গলে না। রমণী ফিরে তাকায় না। সে থাকে নির্জীব। চুপচাপ। শান্ত। অথচ সে বুঝচ্ছে ইহান তাকে ইঙ্গিত করেই গান গাইছে। এক পর্যায়ে রমণী বিরক্ত হয়ে তার কক্ষ ত্যাগ করে। ইহান দেখে না। আপন মনে গান করে।’

হঠাৎ কপাটে কারো হাতের ধ্বনি শোনা যায়। সে খটখট শব্দ করে ইহানের দরজায়। শান্ত স্বরে আওড়ায়, “শালা সাহেব, আমি কি ভিতরে আসব?”

তড়িৎ গিটারের শব্দ, কণ্ঠনালি থেমে যায়। ইহানের আঙুল কাটে গিটারের তারে। ইহানের দুলাভাই ভিতরে ঢুকে। দেখতে পায় হাতের রক্তক্ষরণ। দ্রুত পা ফেলে ছুটে আসে। আতঙ্কিত স্বরে বলে, “তুমি ঠিক আছো তো ইহান?”

ইহান দ্বিধাহীন গিটারটা বিছানার উপর রাখে। হাত বেয়ে রক্ত পড়ে। তবুও ইহান চুপচাপ। নির্বিকার। ভাবখানা এমন যেন কিছুই হয়নি। ইহান তার রক্তমাখা হাত মুঠো করে চেপে ধরে। রায়ান বিছানায় বসে। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “কথা বলছ না কেন ইহান?”

ইহান তাকায়। নীরব স্বরে শুধায়,
“কিছু হয় নি দুলাভাই। আচমকা কোথা থেকে উদয় হলে?”

রায়ান অবাক হয়। বিস্মিত স্বরে বলে,
“তোমার হাত থেকে রক্ত পড়ছে ইহান?”
“ওসব কিছু না। আপাও এসেছে নাকি?”

রায়ান মাথা নাড়ায়। যার অর্থ এসেছে। ইহান বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। ড্রয়ার খুলে একটা রুমাল বের করল। তারপর হাত বাঁধতে বাঁধতে বলল,
“তা হঠাৎ এখানে?”
“তোমায় দেখতে আসলাম।”
“আমার কিছু হয়েছিল নাকি।”
“জ্বর-টর বাঁধিয়ে বিচ্ছিরি কান্ড বাঁধিয়েছিলে শুনলাম।”
“হুর। ওমন কিছু না। অল্পস্বল্প জ্বর ছিল।”
“ও! অল্প জ্বরেও হুস ছিল না তোমার।”

ইহান চমৎকার হাঁসে। কিঞ্চিৎ স্বরে বলে,
“আজ আসার সময় হলো তাহলে।”
“আর বলো না ইহান। কাজের চাপে দারুণ ব্যস্ত।”
“বুঝেছি।”

রায়ান বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। সোজা চলে যায় ইহানের বেলকনিঘরে। ওপাশের বিল্ডিংয়ে অনুজা কেবল বেলকনিতে পা রাখে তখন। শুঁকনো কাপড় নিয়ে পুনরায় ঢুকে দ্রুত। ইহানের নজরে আসে তাকে। রায়ান বলে,
“আজও ভালোবাসো ইহান?”
“আমি তো ভুলিনি দুলাভাই।”
“মেয়েটা আজও ফেরাচ্ছে তোমায়?”
“মেয়েদের কাজই তো ফেরানো।”
“একবছর। অনেকটা সময়– তুমি ফিরে কেন আসছ না?”
“ফিরে আসব বলে তো ভালোবাসিনি।”
“মেয়েটার কেন যে মায়া হয় না?”
“মায়া হয় দুলাভাই। কিন্তু প্রকাশ করতে চায় না।”
“তুমি ঠিক জানো?”
“কি জানি?– নিজেকে বুঝ দিলাম।”

রায়ান আর কিছু বলে না। সরল চোখে তাকায় ইহানের দিকে। ইহানের চোখ তখনও আবদ্ধ ওই বদ্ধ কপাটের বেলকনির দিকে। রায়ান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মৃদু স্বরে বলে,
“শালা সাহেব, শশুড় আব্বা চাইছেন তুমি চাকরি-বাকরি কিছু করো।”

ইহান কথা বলে না। চুপ করে রয়। রায়ানও দ্বিতীয়বার বলার আগ্রহ দেখায় না। রায়ান বেলকনিঘর থেকে বেরিয়ে আসে। রায়ান ইহানের দুলাভাই। ইহানের বড় বোন আনিসার স্বামী। ইহানরা দুইভাই বোন। ইহান আর ইহানের বড় বোন। আজ থেকে ঠিক পাঁচ’বছর আগে ইহানের বড়বোনের বিয়ে হয়। তাদের একটা দু’বছরের পুত্র সন্তানও আছে। ইহানের পরিবারে একমাত্র রায়ানই জানে ইহান কতটা পছন্দ করে অনুজাকে। অথচ অনুজা মেয়েটা ইহানকে বুঝতে নারাজ।’


রাতের আঁধারে ডুবে আছে চারপাশ। মাথার উপর মস্ত আকাশে একখানা চাঁদ দেখা যায়। ঘড়িতে ন’টার কাঁটায় ছুঁই ছুঁই। অনুজা আপন মনে হাঁটছে রাস্তা ধরে। আজ শেষের টিনশনটা পড়াতে পড়াতে তার একটু দেরি হয়েছে। রোজ সাড়ে আটটার মধ্যে বাড়ি থাকলেও আজ ন’টা বাজে। তাও অনুজা রাস্তায় হাঁটে। খুবই আস্তে আস্তে হাঁটছে অনুজা। যেন শরীরে শক্তি নেই। দুপুরের ইহানের তীব্র করুণ কণ্ঠের গান শোনার পর থেকেই কেমন একটা হয়ে গেছে অনুজা। অদৃশ্য এক কারণে তার প্রচন্ড খারাপ লাগছে। আধোতেও খারাপ লাগার কারণ নেই। তবুও অনুজার খারাপ লাগছে। আচমকা আকাশে মেঘ ডাকে। অনুজা কেঁপে ওঠে। এখনও যে বাড়ি ফিরতে অনেকটা পথ বাকি। একটু হাঁটতেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিফোটা গায় লাগে অনুজার। অনুজা টের পায়। তবুও সে নির্জীব মনে হাঁটে। হঠাৎই একটা দোকানের কিছু বখাটে ছেলেদের কণ্ঠ শোনা যায়। তারা বলে, “সুন্দরী দেখি একা একা হাঁটে। আমরাও সঙ্গে আসব নি।”

অনুজা বিন্দুমাত্র তাদের কথা শোনার বা কানে নেয়ার আগ্রহ দেখায় না। সে চুপচাপ হাঁটে। মনে মনে ভাবে, “রাস্তাঘাটে হাঁটলে এমন ঘেউ ঘেউ করা কুকুর থাকবেই। তাই বলে তাদের পাত্তা দিতে হবে নাকি।”

অনুজা পাত্তা দিল না। নিঃশব্দে হেঁটে গেল। একটু এগোতেই বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা গায়ে লাগে তার। অনুজা চমকে উঠে। মনে পড়ে, আজ সে ছাতা আনেনি। আচমকাই মাথায় ওপর ছাতাজনিত ছায়া দেখা যায়। অনুজা খানিকটা ঘাবড়ে যায়। পাশ ফিরে তাকানোর আগেই ইহান বলে,
“ভয় নেই, আমি এসেছি।”

অনুজা যেন স্বস্তির শ্বাস ফেলে। তবুও প্রকাশ করে না। একরাশ ক্ষোভ নিয়ে বলে,
“কেন এসেছেন?”
“তোমার সাথে হাঁটব বলে।”
“আমি কিন্তু পিছু নিতে বারণ করেছিলাম?”
“আপনি কেন বুঝেন না?– এই ইহান অনুজার এসব বারণ শুনবে না।”

অনুজা চুপ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে বৃষ্টির গতিবেগ বাড়ে। ইহানের এক কাঁধ ভিজে। অনুজা দেখতে পায়। মৃদুস্বরে আওড়ায়,
“আপনি ভিজে যাচ্ছেন ইহান?”
“সমস্যা নেই।”
“আপনার আবার জ্বর আসবে?”
“তাতে কি?– আসে যায়।”
“আপনি এমন কেন ইহান?– সহজে কিছু বুঝতে চান না।”
“আপনি আমার প্রতি একটু সহজ হয়ে দেখুন। আমি সবটা বুঝে যাব।”
“জোর করলেই কি ভালোবাসা পাওয়া যায়?”
“আমি জোর কোথায় করি?”
“পিছুটাও তো ছাড়ছেন না?”
“আমি কি আপনায় খুব বিরক্ত করি?”
“আপনি বুঝতে পারেন না?”

ইহানের চোখ-মুখ ছোট হয়। মনখারাপেরা বাসা বাঁধে আবার। সে করুণ কণ্ঠে আওড়ায়,
“আমায় কি সত্যিই ভালোবাসা যায় না অনু?”

অনুজা তক্ষৎণাৎ উত্তর দিতে পারে না। একটু সময় নিয়ে বলে,
“আপনাকে আমার ভালো লাগে না।”
“আমাকে গোটা একটা দিন দিয়ে দেখুন। ভালো না লাগলে আর পিছু নিব না।”

অনুজা বিস্মিত হয়। ভড়কায়। অবাক লাগে। মনে প্রশ্ন জাগে, “ইহান কি সত্যি বলছে?”

ইহান বলে,
“দিবেন কি একটা দিন?”

অনুজা ইহানের দিকে তাকায়। ইহান সাথে সাথে নিজের সরিয়ে নেয়। অনুজা বলে,
“আপনাকে বিশ্বাস করা যাবে ইহান?”
“একান্তে কাটিয়েই দেখুন না। আমি মানুষটা সত্যিই খারাপ না।”
“যদি ঠকে যাই।”
“এই কথার বদলে আমায় গালে থাপ্পড় মারলে বেশি খুশি হতাম অনুজা।”

অনুজা থমকে যায়। মুখ ফসকে ভুল কথা বলে দিল কি!– পুরো রাস্তায় আর কথা হলো না। বৃষ্টির ধাঁঝ মৃদু কমে আসে। ইহান হঠাৎই অনুজার হাতে ছাতা ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসে। অনুজা অবাক হয়ে যায়। দাড়িয়ে পড়ে। ইহান বলে, “এখান থেকে আপনি একা যান অনু?”

অনুজা যায় না। ইহান বলে,
“যাচ্ছেন না কেন?”
“আপনাকে সত্যি একটা দিন দিলে আমার পিছু ছাড়বেন ইহান?”

ইহান বেশি না ভেবেই বলে, “হুম।”
অনুজা মুচকি হাসে। বলে, “গোটা একটা দিন দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে বারো ঘন্টা নিতে চাইলে বলতে পারেন।”

ইহান অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। অনুজা কি সত্যি বলছে? ইহান বলে,
“কি বললেন?”
“পরশুদিনটা আপনায় দিলাম ইহান। তবে মনে রাখবেন দিন শেষে আমার আপনাকে ভালো না লাগলে, আপনি আমার পিছু ছেড়ে দিবেন।”

ইহানের বোধহয় এতক্ষণে বোধগম্য হয়। অনুজা হঠাৎ কেন!– তার সাথে সময় কাটাতে রাজি হলো। ইহান বেশি ভাবল না। সে খুশি হলো। মিষ্টি হেঁসে শুধাল, “ঠিক আছে।”

অনুজা চলে যায়। ছাতার মাথায় টপটপ করে বৃষ্টিফোটা পড়ে। ইহানের শরীর ভিজে যায়। সে আকাশপথে তাকায়। বড়ই আফসোস নিয়ে বলে,
“মানুষ যাকে চায়, তাকে পায় না কেন?”

#চলবে…
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

TanjiL_Mim♥️.