#যে_প্রেম_হঠাৎ_আসে❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম.
– পর্ব:০৭
ভোর ছ’টার কথা শুনে অনুজা বেশ অবাক হলো। তবুও কিছু বলল না। চুপচাপ মেনে নিয়ে জানাল,
“ঠিক আছে।”
ইহান খুশি হলো। মুচকি হেঁসে বলল,
“শুভ রাত্রী, রাত্রীপ্রিয়া!”
অনুজার উত্তরের অপেক্ষা করল না ইহান। চলে গেল। দ্রুত ছুটে গেল ভিতরে। এখনও যে তার গোছগাছ করা বাকি। অনুজা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ইহানের রুমের জানালা দিয়ে ইহানের কার্যকলাপ দেখছে। ইহান এদিক সেদিক ছুটছে আর ব্যাগপত্র গোছাচ্ছে। অনুজা বুঝচ্ছে না। কি এমন?– গোছাচ্ছে ইহান, এই এক সন্ধ্যার জন্য। অনুজা নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ছেলেটা কেন যে– এতটা পাগল তার প্রতি কে জানে? অনুজা ভিতরে ঢুকে পড়ল। রাতের আকাশে থাকা চাঁদটা হঠাৎ মেঘের আড়াল হলো।’
–
লাগাতার এলার্ম বাজছে ইহানের ঘরে। তাও একটা এলার্ম না। গুনে গুনে পাঁচটা এলার্ম বাজছে। যার মধ্যে একটা হলো মোবাইলেনসেট করা এলার্ম আর বাকি চারটা ঘড়ির এলার্ম। ইহানের খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস নেই। যার দরুণ এমন সব ব্যবস্থা। মাথার চারদিকে আচমকাই ঝনঝন করে উঠতেই চমকে উঠল ইহান। হাত দিয়ে এলার্ম ঘড়ি ছুঁড়ে মারল দূরে। এলার্ম ঘড়ির দুটো ছিল ইহানের মাথার কাছে, বাকি দুটি ছিল পায়ের কাছে। আর টেবিলের ওপর ছিল মোবাইল। ইহান লাথি মেরে পায়ের কাছে থাকা দুটো এলার্ম-ঘড়িও ছুঁড়ে মারল মেঝেতে। ঝনঝন করে শব্দ হলো তাতে। এরপরই লাস্টের মোবাইল এলার্মটা বাজতে রইল। সে বলছিল,
“ইহান ওঠো, আজ তোমার জন্য বিশেষ একটা দিন। আজ তুমি আর অনুপাখি একসাথে থাকবে।”
কথাটা দু’বার কানে বাজতেই লাফ মেরে শোয়া থেকে উঠে বসল ইহান। ঘড়িতে তখন পাঁচটা বিশ বাজে। প্রকৃতিতে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে কেবল। ইহান লাফ মেরে বিছানা ছেড়ে নামল। দৌড়ে ছুটে গেল ওয়াশরুমে।’
ঘড়িতে তখন ছ’টা দুই। অনুজা বসে আছে বাসস্ট্যান্ডের কাছেই ফুটপাতের ওপরে। আশপাশ জনশূন্য। খুব একটা মানুষ নেই বললেই চলে। অনুজার পরনে গ্রীন কালার চুড়িদার, খোলা চুলে মাথায় ঘোমটা দেয়া। হাল্কা সাঁজ। ঠোঁটে লালরঙা অল্প লিপস্টিক, কাঁধে ছোট্ট ব্যাগ। অনুজা একবার ভেবেছিল গোসল সেরে আসবে কিন্তু সময়ের অভাবে হলো না। নামাজ পড়ে দ্রুত তৈরি হয়েই চলে এসেছে সে। অথচ দেখ ইহানের খবর নেই। অনুজা নিজের হাতঘড়িটা দেখল। ছ’টা পাঁচ বেজে গেছে। ইহানের আগমণ ঘটে তখন। এলেমেলো চুলে, গায়ে জড়ানো মেরুন কালার শার্ট, ছাইরঙা প্যান্ট। কাঁধে কালো ট্রাভেলিং ব্যাগ। একপ্রকার দৌড়ে ছুটে আসছে ইহান। অনুজা তাকে দেখল। খুব একটা উৎফুল্লতা দেখাল না। ইহান ছুটে এসে শ্বাস ফেলে বলল, “দুঃখিত অনুজা, একটু দেরি হয়ে গেল।”
অনুজা উঠে দাঁড়াল। শান্ত স্বরে বলল,
“কোনো ব্যাপার না। আমরা এখন কোথায় যাব বলুন?”
ইহানের সাথে সাথে উত্তর,
“উই দূরে মোতালেব নানার টং দোকানে।’
ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে ছ’টা ছাড়িয়ে। সেই বাসস্ট্যান্ড থেকে হেঁটে হেঁটে প্রায় পঁচিশ মিনিটের রাস্তা পেরিয়ে টং দোকানে চা খেতে এসেছে ইহান আর অনুজা। অনুজা বেশ বিরক্ত। এভাবে কেউ এতদূর হেঁটে হেঁটে আসে। আর পুরো রাস্তায় ইহানের বকবকানি তো আছেই। অনুজা বেশ টের পাচ্ছে আজকের দিনটা তার বড়ই বিশ্রী যাবে। রাস্তাটা তিনমাথার মোড়। তার মাঝ বরাবর দিয়ে টংয়ের দোকান। দোকানের দুপাশে মস্তবড় দু’খানা গাছ। গাছ ছুঁইয়ে সকালের ফুড়ফুড়ে বাতাস বইছে। বাতাসের সংস্পর্শে আসতেই বিরক্তভাবটা খানিক হলেও কমলো অনুজার। ইহান তার কাঁধের ব্যাগটা সামনের বেঞ্চিতে রাখল। এরপর অনুজাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “বসুন অনু।”
অনুজা বসল। ইহান এগিয়ে গেল দোকানদারের কাজে। একজন বুড়ো মতো লোক। গায়ে সাদা সেন্টু গেঞ্জি, আর সাদা লুঙি। মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি, মাথায় নামাজের চুপি। ইহান তার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, “নানাভাই দু’কাপ কড়া করে রঙ চা দিও। সঙ্গে পাউরুটি।”
মোতালেব নানাভাই মৃদু হাসলেন। বললেন,
“তুমি বহো আমি এহনি দিতাছি।”
ইহান বসল। অনুজার থেকে খানিক দূরত্ব নিয়ে বসল। অনুজা আশপাশ দেখে। শহরের দক্ষিণ দিকে এমন সুন্দর গ্রামীণ জায়গা আছে এ তো জানতোই না অনুজা। গাছের ডালে বসা সকালের সুমধুর কণ্ঠে ভাসা পাখির কলরব শোনা যায়। অনুজা চোখ বন্ধ করে ফেলে নিমিষেই। জীবনের সব ক্লান্তিকর মুহূর্ত আচমকাই কোথায় যেন হারিয়ে যায়। বাতাসের মৃদু ধাক্কায় অনুজার মাথার ঘোমটা দোলে। শরীর নাড়িয়ে দেয় সঙ্গে সঙ্গে। অনুজার ভালো লাগছে। বেশ ভালো লাগছে। ইহান দূর থেকে তাকে দেখে। হেঁসে ফেলে আপনাআপনি। মনে মনে বলে, “আপনি এত স্নিগ্ধনীয় কেন অনু?”
মিনিট দশ যেতেই চায়ের দেখা পাওয়া যায়। ইহান অনুজার হাতে এককাপ চা আর ছোট্ট গোল পাউরুটি ধরিয়ে দিয়ে বলে, “ এগুলো খান। ভালো লাগবে অনু।”
অনুজা দ্বিধাহীন নিলো। আজ সে ইহানের কথা শুনবে কোনোকিছুতেই কোনো অভিযোগ জানাবে না। যেহেতু আজকের দিনটা ইহানকে দিয়েছে তাই এমন সিদ্ধান্ত। অনুজা চায়ের কাপে রুটি ভিজিয়ে খেতে শুরু করল। রুটি অনেক নরম। বেশ লাগল খেতে। অনুজা একটুখানি মুখে পুড়তেই বলে উঠল,
“দারুণ।”
বিনিময়ে ইহান একটু হাসল। চায়ে চুমুক দিল এর পরপরই। টংয়ের দোকানে চায়ের আসর শেষ করতে করতে প্রায় বিশ মিনিট কাটল ইহান অনুজার। ঘড়িতে সাতটা বেজে গেছে। ইহান চায়ের বিল মিটিয়ে বলল,
“চা’টা দারুণ ছিল নানাভাই।”
উত্তরে মৃদু হেসে এতটুকু বলেন দোকানী, “আবার আইসো নাতি।”
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় ইহান। যার অর্থ,’আচ্ছা।’
পাশাপাশি উদ্দেশ্যহীন হাঁটছে অনুজা। কোথায় যাচ্ছে! জানে না। দু’পাশে সারি-সারি গাছপালা। মাঝখানে পিচঢালা রাস্তা। আশপাশ মানুষহীন। খারাপ লাগছে না। ইহান হাঁটতে হাঁটতে জানাল,
“চায়ের আয়োজন আপনার পছন্দ হয়েছিল অনু?”
অনুজা নীরবে শুধায়, “হুম।”
ইহান খুশি হয়। অনুজা বলে,
“আমরা কোথায় যাব?”
“আপনি যেখানে যেতে চাইবেন।”
“আপনার মনে হয় আমি শহরের আনাচে-কানাচের সব জায়গা চিনে বসে আছি?”
“অবশ্যই বসে নেই।”
“তাহলে,
“তাহলে কিছুই না।”
“আমরা কি হাঁটতেই থাকব?”
“আপনি চাইলে আমি তাও করতে প্রস্তুত।”
অনুজা বিরক্ত নিয়ে তাকাল। চা খাওয়ার পর যতটা ভালো লাগা সৃষ্টি হয়েছিল। ইহানের ত্যাড়ামির কথা শুনে পুরোটাই হাওয়া হয়ে গেল। অনুজা বলল,
“অকারণে মজা করবেন না ইহান?”
“আমার সব কথাই আপনার মজা কেন লাগে বলুন তো?”
“কারণ আপনি মানুষটাই জোকার।”
“আপনার মুখে অপমান শুনতেও দারুণ লাগে।”
অনুজা চুপ হয়ে গেল। ঘড়ির কাটা টিকটিক করে ছোটে। প্রকৃতিতে তখন মৃদু মৃদু রোদের দেখা পাওয়া যায়। শীতল পরিবেশ ধীরে ধীরে উষ্ণ হওয়ার বায়না ধরে। অনুজা ইহান তখনও হাঁটে। হঠাৎ দূর থেকে ভ্যানের দেখা পাওয়া যায়। ইহান মুচকি হাসে। অবশেষে যেন যাহার খোঁজ ছিল তাহা পাওয়া গেল। ইহান বলে, “দাঁড়ান অনুজা!”
অনুজা দাঁড়িয়ে পড়ল। দূরের ভ্যান তখন খুবই নিকটে। ইহান হাত বাড়িয়ে ভ্যান থামালো। অনুজা অবাক হয়ে তাকিয়ে। মাথায় প্রশ্ন জাগল সঙ্গে সঙ্গে,“ইহান কি এটায় করে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে নাকি?”
ইহান এগিয়ে গিয়ে ভ্যান চালককে কি যেন বলল?– কিছু সময় তাদের মধ্যে তর্কাতর্কি হলো। অতঃপর ভ্যানচালক রাজি হলো। ইহান তার কাঁধের ব্যাগ ভ্যানের ওপর রেখে অনুজাকে ডাকতে গেল। বলল,
“আসুন অনু।”
অনুজা আসলো না। উল্টো প্রশ্ন করল,
“আমরা কি এটায় করে যাব ইহান?”
ইহানের তড়িৎ উত্তর,
“জি।”
“আমার ভয় লাগছে?”
“ভয় কিসের?– আমি তো আছি।”
“আমি তবুও ভয় পাব।”
“সাহস নিয়ে এসে তো দেখুন, আপনি ঠকবেন না।”
“অন্যকিছুতে যাওয়া যায় না?”
“আপনার নজরে আশপাশে অন্যকিছু আছে?”
অনুজা আশপাশ দেখল। কিছু নেই। অনুজা ভীতু হলো,
“আমি এগুলোতে কখনও উঠি নি?”
“তাতে কি?– আজ উঠবেন।”
অনুজা উঠল না। দাঁড়িয়ে রইল। ভ্যান চালক তাড়া দিচ্ছেন। ইহান বলল,
“দেরি হচ্ছে অনু?”
“হোক আমি ওসবে যাব না।”
ইহান তার কপাল চুলকায়। কিছুসময় চুপ থেকে জানায়, “সত্যিই যাবেন না?”
অনুজার জেদী উত্তর, “না।”
ইহান মেনে নিলো। ভাব নিয়ে বলল,
“ঠিক আছে। কিন্তু– এরপর আমি রাতটুকু নিতে চাইলেও আপনি বারণ করতে পারবেন না।”
অনুজা চোখ-মুখ রাঙায়। শক্ত কণ্ঠে শুধায়,
“মানে?”
“মানেটা খুব সহজ। আপনি দিনটাকে যতটা দেরি করবেন আমি রাতটাকে ততটা নিকটে নিয়ে আসব।”
অনুজা কথার অর্থ বুঝল। খানিকটা রাগ নিয়ে বলল, “আপনি একটা অভদ্র লোক ইহান।”
ইহান হেঁসে ওঠে। খুবই চমৎকার দেখায় সেই হাসি। ইহান একটু ঝুঁকে অনুজার দিকে। অনুজা থমকে যায়। ইহান অনুজার কানের কাছে ঠোঁটটা নিয়ে শীতল স্বরে আওড়ায়,
“আমাকে অভদ্র বলবেন না অনু, আমি সত্যি সত্যিই অভদ্র হয়ে গেলে আপনি কিন্তু কলঙ্কিত হবেন।”
#চলবে….