যে প্রেম হঠাৎ আসে পর্ব-০৯

0
100

#যে_প্রেম_হঠাৎ_আসে❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম.
– পর্ব:০৯
বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা কাটিয়ে অনুজা প্রসঙ্গ পাল্টে প্রশ্ন করল, “আমরা কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব ইহান?”
ইহান কথা বলে না। চুপ করে রয়। অনুজা বিভ্রান্তিতে পরে। নিশ্বাস ফেলে নিরুপায় ভঙ্গিমায় ডাকে, “ইহান।”
ইহান মলিন হাসে। এগিয়ে গিয়ে বলে, “চলুন।”
অনুজার স্বস্থি লাগে। পিছু পিছু হাঁটে ইহানের।’
সে এক বিশাল সুন্দর জায়গা। পাহাড়ি ঝর্ণার ঝমঝম শব্দ শোনা যায়। গাছপালায় ভর্তি সুন্দর বন। বনের পাশে পাহাড়ি বিল বয়ে চলে। বিলের পানি এতটাই স্বচ্ছ যে সুন্দর সুন্দর পাথরগুলোও দেখা যায়। অনুজা অবাক হয়ে পুরো জায়গাটা দেখে। এত সুন্দর জায়গা এর আগে কখনো দেখেনি অনুজা। ইহান অনুজার পানে তাকিয়ে বলে, “আপনার জায়গাটা পছন্দ হয়েছে অনু?”
অনুজার দ্বিধাহীন উত্তর, “খুব।”
ইহান মিষ্টি হাসে। ব্যাগ থেকে বের করে কিছু তাঁবু বানানোর সরঞ্জাম। অনুজা অবাক হয়ে বলে,
“এগুলো দিয়ে কি হবে?”
“ঘর বানিয়ে থাকব।”
তখন সকাল ন’টা। ইহান তাঁবুর ঘর বানাতে ব্যস্ত। আর অনুজা আশপাশ ঘুরে দেখছে। প্রকৃতি ছুঁয়ে সুন্দর বাতাস বইছে। হঠাৎ ইহানের ডাক শোনা যায়। সে বলে,
“অনু, এদিক আসুন– এইটা ধরুন তো।”
অনুজা দেরি করল না। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তাঁবুর কোনা আটকানোর জন্য ধরল। ইহান হাতুড়ি পিটিয়ে তাঁবু টানানো শেষ করল। অনুজা তাকিয়ে। দৃষ্টি একত্রিত হতেই অনুজা দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। ইহান হাসে। ফিসফিস করে বলে,
“খুব দ্রুতই প্রেমে পড়ে গেলেন নাকি অনু?– এখনও তো দিন শেষের ঢের বাকি।”
অনুজা চোখ রাঙায়। ঘোর আপত্তি জানিয়ে বলে,
“আমি মোটেও প্রেমে পড়িনি ইহান।”
ইহান উত্তর দেয় না। উঠে দাঁড়ায়। ব্যাগ থেকে বের করে মাছ ধরার বড়শি। অনুজা আবারও হতভাগ। বিস্মিত কণ্ঠে শুধায়, “এগুলো দিয়ে কি হবে ইহান?”
ইহান কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে বলে,
“আমি মাছ ধরব– আর আপনি রান্না করবেন।”
তাঁবু থেকে বেশ খানিকটা দূরে অবস্থান করছে এক বিশাল নদী। নদীর পানিতে মাছ দেখা যায়। অনুজা ইহান দাঁড়িয়ে একটা গাছের গোঁড়ায়। ইহান গাছের ছোট্ট ডালে শক্ত সুতো দিয়ে বড়শি বাঁধে। আর বড়শির কণায় আটকায় মাছের খাবার। অনুজা তাকিয়ে রয়। একটু উচ্চ আওয়াজে ডাকে, “ই..
পুরোটা বলা হয় না তার আগেই অনুজার মুখ চেপে ধরে ইহান। নিচু গলায় বলে, “হুস শব্দ নয়। মাছ পালিয়ে যাবে।”
অনুজা বিস্ময়কর চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকে ইহানের দিকে। কিছু সময় যায়। ইহানের ব্যাপারটা আন্দাজে আসতেই দ্রুত হাত সরিয়ে ফেলে। অপরাধীর ন্যায় বলে, “দুঃখিত।”
অনুজা কিছু বলে না। দৃষ্টি সরিয়ে মাছের দিকে তাকায়। দূরে মাছ লাফায়। ইহান বড়শি ফেলে নদীতে। কিছু সময় যায় উঠে আসে মাছ। উচ্চতা খুব একটা বড় নয়। অনুজা লাফিয়ে উঠে। ঘটনাটা খুবই সুন্দর। অনুজা এমন দৃশ্য আগে কখনো দেখেনি। ইহান আবার বড়শিতে মাছের খাবার বেঁধে বড় তড়শি নদীতে ফেলে। আরো কিছু সময় পর মাছ উঠে আসে। এমন করে মোট পাঁচখানা মাছ ধরে ইহান। এরপর বলে, “চলুন অনু। আর লাগবে না।”
অনুজাও বিনাবাক্যে হাঁটল। সময়টাকে খুব সুন্দরভাবে অনুভব করছে অনুজা। তার ভালো লাগছে। ভীষণ ভালো লাগছে।’
তাঁবুর নিকট ফিরতেই মাছ কাঁটায় হাত দিল ইহান। কিন্তু তার আগে ব্যাগের ভেতর থাকা কিছু ফল বের করে দিল অনুজাকে। সঙ্গে একটা ছুরি। কেটে খাওয়ার জন্য। অনুজা নিলো। তার খিদে পেয়েছে।’
ইহান মাছ কেটে ধুতে গেল দূরে। অনুজা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ইহান মাছ কাটতে জানে– এ যেন তার ধারণার বাহিরে ছিল। তাও আবার ছুরি দিয়ে। নির্ঘাত ডিসকোভ্যারি দেখে এসেছে। কথাটা ভেবে হেঁসে ফেলে অনুজা। ইহান ফিরে এলো পনের মিনিট পর। হাত থেকে মাছের গন্ধ আসছে মৃদু। ইহান পাত্তা দিল না। ইহান যখন মাছের পাত্র নিচে রাখে। তখন কতগুলো প্লেট ভরা ফল কেটে এগিয়ে দিল অনুজা। ইহান বিস্ময়ের ন্যায় তাকিয়ে। অনুজা বলে, “এতটা অবাক হওয়ার মতো কিছু হয়নি ইহান।”
ইহানের তড়িৎ উত্তর আসে,
“ইহানও অবাক হচ্ছে না।”
“তাহলে অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন কেন?”
“আপনায় কিভাবে বুঝাব অনু?– আপনায় দেখলেই আমার চোখজোড়া অদ্ভুত হয়ে ওঠে।”
“ঢং করা বন্ধ করুন।”
“ছেলে মানুষ ঢং করে নাকি– ঢং হলো মেয়েদের ভূষণ। এতে ছেলেদের মানায় না।”
“আপনি কি আমায় অপমান করছেন?”
“অবশ্যই না।”
অনুজা চোখ রাঙায়। ইহান হাসে। উচ্চশব্দে হাসে। তার হাসিতে গাছ ছুঁয়ে থাকা পাখিরা হাল্কা নড়েচড়ে ওঠে।’
বেলা প্রায় এগারোটার কাটায় ছুঁই ছুঁই। ভোজন হিসেবে আছে। মাছ ভাজা, আর খিচুড়ি। চুলা বানানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ইটপাথর। পোড়ানোর জন্য কিছু গাছের ডালপালা। এগুলো সব ইহান আগে ভাগেই জোগাড় করে নিয়েছিল। ওই যে আসার আগে মাঝখানে একদিন সময় ছিল না– তখনই আগেভাগে এসে কিছু সরঞ্জাম রেখে যায়।’
অনুজা গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে বহমান ওই ঝর্ণার দিকে। তার মনে হচ্ছে একশ্যুট জামা আনলে বেশ হত। ইহানকে দূরে পাঠিয়ে ঝর্ণার পানিতে নাওয়া যেত। কিন্তু আফসোস এমনটা করা যাচ্ছে না। ইহান রান্না করছে– অথচ কথা ছিল অনুজা রাঁধবে। অনুজারও দ্বিধা ছিল না। কিন্তু ইহান দেয়নি। জীবনের আজকের দিনটা ইহান আজীবন মনে রাখবে। একটা মেয়ের জন্য ইহান রান্না করেছিল। কি বিস্ময়কর ব্যাপার না!’
ইহান কিছুক্ষণ পর পর অনুজাকে দেখে। তার শুধু একটাই আফসোস লাগে, “অনুজা কেন তাকে বোঝে না?– যেমনভাবে ইহান অনুজাকে বোঝে, তেমনভাবে অনুজা কেন ইহানকে বোঝে না।”
ইহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনযোগ দেয় রান্নাবান্নায়।”
ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে বারোটার ছুঁই ছুঁই। ইহানের রান্নাবান্না শেষ। অনুজা চুপচাপ তখনও বসে। মাঝে একবার উঠে এসে দাঁড়িয়ে ছিল ইহানের কাছে। কিন্তু ইহান দাঁড়াতে দেয়নি। ইহানের ধারণা অনুজা তার রান্নার সময় দাঁড়িয়ে থাকলে– সে কিছু রান্না করতে পারবে না। ইহান খাবারের পাত্র তাঁবুর ভিতর নিয়ে রাখে। অনেক খুঁচিয়ে ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করে। এরপরই এগিয়ে যায় অনুজার দিকে।
অনুজা নিরিবিলি ঝর্ণার স্রোতের দিকে তাকিয়ে রয়। হিমশীতল বাতাস বয়। চারপাশে বড়বড় গাছ থাকায় রোদ্দুরের ছোঁয়া নেই তেমন। চারপাশ ছায়াময়। পাতায় ভর্তি সোনালি উঠান। বেশ সুন্দর। অনুজার মনে হয়, জীবনের সব ক্লান্তি তার দূর হয়ে গেছে। এখানে তার নিজস্ব একটা ছোট্ট বাড়ি থাকলে বেশ হত। রোজ বিকেলে কফি খেতে খেতে বই পড়া যেত। বৃষ্টি নামলে বারান্ধায় চাদর মুড়ি দিয়ে চা খেতে খেতে বৃষ্টি ফোঁটা অনুভব করা যেত। দারুণ ব্যাপার। ভাবতেই ভালো লাগছে অনুজার।’
“কেউ একজন বলেছেন– একা একা ভাবতে নেই। সঙ্গে কেউ থাকলে তাকে শুনিয়ে ভাবতে হয়।”
অনুজা চমকে ওঠে। পাশ ফিরে ইহানকে দেখে বলে,
“সেই কেউটা কে শুনি?”
ইহান বেশ আয়েশ করে বসে। হাতের জিনিস আড়াল করে। ভাব নিয়ে বলে,
“কে আবার! –আমি।”
অনুজা হেসে ফেলে। খুবই মধুময় দেখায় সেই হাসি। ইহান আপনমনে আওড়ায়,
“হাসেন আপনি। অথচ ব্যাথা লাগে আমার। অদ্ভুত না!”
অনুজা অস্পষ্ট কিছু শব্দ শুনে শুধায়,
“কিছু বললেন?”
“আপনায় বলে কি লাভ?– আপনি তো আর আমায় বুঝেন না।”
“পৃথিবীতে আমি কি একা মেয়েমানুষ বলুন?– আরো অনেক মেয়ে আছে। আমার কাছে মনে হয় না আমার মধ্যে এমন কোনো বিশেষ গুণ আছে যার জন্য একটা ছেলে আমার প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে।”
“অথচ আমি আকৃষ্টে জর্জরিত।”
“আপনার চোখ নেই?”
“তাহলে আমি আপনায় দেখি কিভাবে?”
নিরাশ অনুজা। কথার অর্থটার ওমন ছিল না। অনুজা বলে,
“আপনার চয়েস ভালো না।”
“আমার মুগ্ধতা কাটাতে নিজেকে নিচে নামাবেন না। বিষয়টা ভালো লাগবে না।”
অনুজা থেমে গেল। মন খারাপের দৌলতে বলল,
“আপনি কেন বুঝেন না?”
“আপনি কেন মানছেন না?”
“কি মানবো?”
“আপনি আমায় ভালোবাসেন।”
“আমি আপনায় ভালোবাসি না ইহান। আর কখনো বাসব না।”
“ঠিক আছে– বাসতে হবে না। আমি বাসব। আপনি শুধু রাজি হয়ে যান।”
“এই প্রসঙ্গ পাল্টান।”
“ঠিক আছে। পাল্টে দিলাম।”
“রান্না শেষ?”
“হুম।”
নেমে আসলো অনেকক্ষণের নীরবতা। প্রকৃতির গাঁ ছুঁইয়ে নামল গাছের সবুজ পাতা। ইহান অনুজা বসে। চুপচাপ বসে। প্রকৃতিরাও বুঝি টের পায় কিছু। একজন বুঝায় নিজের অনুভূতি অথচ উল্টোজন তা বুঝতে নারাজ। এত কিসের বাঁধা তার? কিসের আপত্তি! কিছু মানুষ ভালোবাসা পায় না– আর এ, পেয়েও কেন নিচ্ছে না? কেন!’
#চলবে….