যে প্রেম হঠাৎ আসে পর্ব-১২

0
113

#যে_প্রেম_হঠাৎ_আসে❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম.
– পর্ব:১২

গুনতে গুনতে টানা চার মাস পেরিয়ে গেল। ইহানের আর খোঁজ খবর পাওয়া গেল না। এই চারমাস অনুজার জন্য ছিল খুবই বিষাদময় জীবন। একজন মানুষের শূন্যতা ঠিক কতটা জ্বালাপোড়া দিতে পারে তা হারে হারে টের পেয়েছে অনুজা। সে কেঁদেছে। কখনো বেলকনির ঘরে দাড়িয়ে, কখনো বাসস্ট্যান্ডের পিছন ঘুরে, কখনো রাস্তার মোড়ে মুখ লুকিয়ে, কখনো বা আঁধারে ঢাকা ছাঁদের কর্নার ছুঁইয়ে। তবুও ইহান না আসলো। ছেলেটা আচমকাই এইভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিবে অনুজা কল্পনাও করতে পারেনি। এইভাবে ছেড়ে-ছুঁড়ে চলে যাবে বুঝতে পারেনি অনুজা। সেদিনের করা অপমান বোধহয় ইহানকে খুব বেশিই কষ্ট দিয়েছে। অনুজা বুঝতে পেরেছে। অনুজা এইভেবে রোজ কাঁদে, ‘ইহান একবার ফিরে আসুন। আমি আপনার কাছে সেদিনের জন্য ক্ষমা চাইব। মন থেকে চাইব। প্লিজ ইহান ফিরে আসুন।’– কিন্তু ইহান আর আসে না। দিন চলতে থাকে।’

ঋতুতে হেমন্তকাল! একে শীতের পূর্বাভাসও বলা হয়। কারণ এই ঋতুর পরেই বাংলার মাটিতে ঘনিয়ে আসে শীত। শরতের মেঘমালা শেষে হেমন্তের আগমণ বাংলার প্রকৃতির রূপ বদলায়। ফসলের জমিতে ধান পাকার উৎসব শুরু হয়। কৃষকেরা পাকা ধান ঘরের উঠানোর তোড়জোড় চালায়। যেখানে প্রকৃতি তার নানান উৎসবে মগ্ন। সেখানে অনুজার দিন কাটে বিষণ্ণে। আহাচারে।’

সময়টা শেষ বিকেল। গোধূলির আলো ধীরে ধীরে প্রকৃতি ছুইছে। অনুজা আনমনা হাঁটে। আজ শেষের দুটো টিউশনি না করার চিন্তায় আছে অনুজা। তার মনে হচ্ছে টিউশনিগুলো বোধহয় হাতছাড়া হলো। ইদানীং অনুজার মন ঠিক থাকছে না। সে তার স্টুডেন্টদের সাথে অহেতুক চেঁচিয়ে উঠছে। আবার সরিও বলছে। ব্যাপারটা একবার দু’বার ঘটলেও হত কিন্তু তা হচ্ছে না রোজ রোজই হচ্ছে। বিষয়টার জন্য খুবই লজ্জিত অনুজা। দু’দিন আগে এই ব্যাপারটার জন্য এক স্টুডেন্টর মা অনুজাকে কথা শুনিয়েছে। অনুজা নীরবে শুনেছে সব কোনো জবাব দেয়নি। অবশ্য কি জবাব দিবে– যেখানে দোষ তার নিজেরই।’

অনুজা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হঠাৎই আকাশ ছুঁইয়ে প্লেন গেল। শব্দ ছুটছিল তার। ঠিক সেই মুহুর্তেই পিছন থেকে কণ্ঠ শোনা গেল কারো। সে বলল,
“রাত্রীপ্রিয়া দাঁড়ান!”

অনাকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তে অনাকাঙ্ক্ষিত সেই মানুষের কণ্ঠটা বুঝি ভূমিকম্পের ন্যায় কানে বিঁধল অনুজার৷ সে সঙ্গে সঙ্গে পিছন ঘুরল। দেখতে পেল সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, কালো টাই পরিধিত ইহান দাঁড়িয়ে। মুখে তার এক চিলতে হাসি, এলেমেলো চুলগুলো পরিপাটির ন্যায় গুছিয়ে, মুখ ভর্তি চাপদাড়ি। ইহানকে চেনা যাচ্ছে না। অনুজা বরফের ন্যায় দাঁড়িয়ে, নিস্তব্ধ বনে তাকিয়ে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না সত্যিই কি ইহান দাঁড়িয়ে আছে? নাকি অনুজার হ্যালুসিনেশন। ইহান একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। তাকে দেখে নিত্যদিনের সকাল সন্ধ্যে রাত ডিউটি করা চাকরিজীবীদের মতো লাগছে। অনুজার ভিতরে হঠাৎ তোলপাড় শুরু হলো। অন্তরের ভিতর বোধহয় ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে। অনুজা যথাসম্ভব নিজেকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। নিজের বোঝাচ্ছে, ওটা ইহান নয়। তার হ্যালুসিনেশন।’

ইহান যখন অনুজার খুব নিকটে দাঁড়িয়ে তখন অনুজার হুস আসে। ইহান বলে,
“কেমন আছেন অনু?”

অনুজা থতমত খেয়ে কোনোরকম উত্তর দেয়,
“ভালো। আপনি?”
“আমিও ভালো।”

মৃদু হাসে অনুজা। ইহান আশপাশ দেখে বলে,
“চলুন ওদিকটায় বসি।”

অনুজার বলতে ইচ্ছে করছিল,’বসব কেন?’– কিন্তু বলা গেল না। বিনা বাক্যে হাঁটা ধরল ইহানের পিছু পিছু। অনুজারা এপার ছেড়ে ওপাশ আসলো। ফাঁকা একটা বন্ধ টংয়ের দোকান। টংয়ের পাশে ছোট্ট বেঞ্চ শুইয়ে। ইহান বলল,
“চলুন এখানে বসি।”

অনুজা বসল। ইহান বসল খানিকটা দূরত্ব নিয়ে। অনুজা চুপচাপ। তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না তার পাশে ইহানই বসে। ইহানই বলল আগে,
“তারপর আমিহীন খুব ভালোই আছেন মনে হয়।”

অনুজার ভিতর বলছিল ‘ভালো নেই।’ অথচ মুখে বলল,
“আপনিহীন আমার খারাপ থাকার কথা ছিল নাকি।”
“না– তা থাকবে কেন!”
“তবে?”
“তবে কিছুই না।”
“এতদিন কোথায় ছিলেন?”
“ছিলাম কোথাও একটা– আপনায় বলতে চাচ্ছি না।”
“আচ্ছা। বলতে হবে না।”

নেমে আসলো বেশক্ষণের নীরবতা। কেউ কোনো কথা বলছে না। সাঁ সাঁ শব্দ করে কিছুক্ষণ পর পর যানবাহন ছুটছে, প্রকৃতি ছুঁইয়ে বাতাস বইছে, তবুও কথা বলা যাচ্ছে না। ইহানের অবস্থা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু অনুজা অস্থিরতায় চারপাশ কেমন যেন ঠেকছে। মনে হচ্ছে এখনই কেঁদে ফেলবে। অনুজা আচমকাই উঠে দাঁড়াল। থরথর করে বলল,
“আমাকে যেতে হবে?”
“আপনাকে থাকতে বলার অধিকার তো আমার নেই।”
“ভালো থাকুন।”
“দুঃখ দিয়ে ভালো থাকতে বলবেন না অনু।”
“আমি সেদিনের জন্য খুব দুঃখিত ইহান। আমার সেদিন ওইভাবে বলা ঠিক হয়নি। আমার আপনাকে ওইভাবে অসম্মান করাও ঠিক হয়নি। আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। আসলে আচমকাই ওসব বলে ফেলি। আমি খুবই দুঃখিত। আমায় দয়া করে মাফ করে দিবেন।”

ইহানের তড়িৎ উত্তর,
“দিব না।”

অনুজা অবাক বনে তাকিয়ে। ইহান এবার বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। অনুজার চোখে চোখ রেখে বলল, “আমি আপনায় বিয়ে করতে চাই অনু?”

অনুজা তব্দা খেয়ে তাকিয়ে থাকে। বিস্মিত কণ্ঠে বলে,
“মানে?”
“আমি আপনায় বিয়ে করব।”

এই বলে দ্রুত তার অফিসের আইডি কার্ড বের করল ইহান। অনুজাকে দেখিয়ে বলল, “এটা আমার অফিসের আইডি কার্ড অনু। এখন নিশ্চয়ই আপনার বা আপনার বাবার আমাকে মেনে নিতে কোনো সমস্যা হবে না। আমি এখন চাকরি করি অনু। আমার দূরসম্পর্কের এক মামা আছেন ওনার রাজশাহীতে নিজস্ব অফিস আছে। আমার বাবা চেয়েছিলেন আমি যেন ওই অফিসে কাজ করি। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল না। আমি কখনোই চাইনি অন্যের অধিনে কাজ করতে। কিন্তু আপনার জন্য আমি আমার সেই চাওয়াটা কুরবানী করেছি। আমি এখন চাকরি করি। মাস গেলে মোটা অংকের বেতনও আসে। এবার নিশ্চয়ই আপনার অসুবিধা হবে না। আমি আপনার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাব। এবার আমায় ভালোবাসবেন তো অনু?”

অনুজা পিছিয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। তার মানে ইহান একটুও বদলায়নি। উল্টো নিজেকে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত করে ফিরে এসেছে। ইহান আবার বলে,
“কি হলো অনু– আপনি কথা বলছেন না কেন?”

অনুজা শক্ত কণ্ঠে জানায়,
“আমি এই বিয়ে করতে পারব না ইহান।”
“বিয়ে করতে পারবেন না মানে?”
“পারব না মানে পারব না।”

এবার ইহানের রাগ উঠল। সে কপট রাগ নিয়ে অনুজার দুইবাহু চেপে ধরল। ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলল,
“আপনার সমস্যা কোথায় অনু? আজ আপনায় বলতেই হবে। আপনি বলেছিলেন আমি বেকার আপনার বাবা আমায় পছন্দ করেন না। কিন্তু এবার তো করবেন আমি এখন আর কোনো বাজে আড্ডায় নেই। গত চারমাস যাবৎ আমি আমার বন্ধুবান্ধবদের কারো সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ রাখিনি। দিনরাত শুধু খেটেছি। আপনি এত নিষ্ঠুর কেন হচ্ছেন– আমায় জবাব দিন।”
“আমি আপনায় ভালোবাসি না- এটাই জবাব।”
“মিথ্যে বলবেন না অনু। আপনি কি ভেবেছেন? আমি এতদিন নিখোঁজ ছিলাম বলে আপনার কোনো খোঁজখবর রাখিনি। রোজরাতে আমার বেলকনির দিকে তাকিয়ে কেন কাঁদতেন? উত্তর দিন। আজ আপনায় উত্তর দিতেই হবে। অনুজা কথা বলুন? আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি আপনি কি ঠের পাচ্ছেন না। জবাব দিন কেন এমন করছেন?”

ইহানের একেক প্রশ্নে অনুজা দূর্বল হয়ে পড়ছে। নিজেকে সামলানো যাচ্ছে না। অনুজা আচমকাই কেঁদে উঠল। ইহান বিস্মিত নজরে তাকিয়ে। নিজেকে দিশেহারা লাগছে। ইহান নিজের রাগটা কন্ট্রোলে এনে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি কাঁদছেন কেন অনু?”

অসহায় ন্যায় ইহানের দিকে তাকাল অনুজা। অশ্রুভেজা কণ্ঠে থরথর করে বলল, “আমাকে বিয়ে করলে আপনি কোনোদিন বাবা হতে পারবেন না ইহান।”

মুহুর্তের মধ্যে পুরো প্রকৃতি থমকে গেল। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল ইহান। হাতের বাঁধন গেল ছুটে। অনুজা বলল, “দু’বছর আগে আমার একটা এক্সিডেন্ট হয়। সেই এক্সিডেন্টে আমি আমার মা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। ডাক্তার বলেছেন আমি কখনোই মা হতে পারব না। আমি চাই না ইহান আমাকে বিয়ে করে আপনি অসুখী হন। বাবা ডাক থেকে বঞ্চিত থাকুন। আমি আপনায় ভালোবাসি ইহান। তবুও আমি আপনায় চাই না। আমার পিছু ছেড়ে দিন। নতুন করে নিজের জীবন শুরু করুন। আমি অসম্পূর্ণ নারী ইহান, আমায় ভালোবেসে আপনি ভালো থাকবেন না।”

কথাগুলো বলেই দৌড়ে ছুট্টে চলে আসলো অনুজা। আর ইহান ঠায় দাঁড়িয়ে। পুরো বিষয়টা বুঝি তার মাথার ওপর দিয়ে গেল। এখনও কানে বাজছে অনুজার বলে যাওয়া শেষ কথা,
“আমি অসম্পূর্ণ নারী ইহান, আমায় ভালোবেসে আপনি ভালো থাকবেন না।”

#চলবে….