দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-২৩+২৪

0
170

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ২৩

আবির বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে, স্থির হলো। এত উত্তেজনায় সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ঠাণ্ডা মাথায় সুপ্তির সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে, অন্যহাতে আরেকটা মোবাইল পকেট থেকে টেনে বের করল, তারপর দ্রুত থানায় ফোন দিল। আবিরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু পুলিশ মাহবুবকে। ভাগ্য সহায় ছিল। মাহবুব নাইট ডিউটিতে ছিল। আবির,
শৌভিকের নাম্বারটা দিয়ে, লোকেশন ট্র্যাক করতে বলল! যতদ্রুত সম্ভব।
সুপ্তিকে ভরসা দিয়ে বলল,
-‘তুমি চিন্তা করো না সোনা। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসছি!
শৌভিক অবশেষে সুপ্তির হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিতে সক্ষম হলো। ফোনটা কেটে দিল না। বিকট শব্দে হা..হা..করে হাসল। শৌভিকের হাসির শব্দ শুনে, আবিরের রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে শরীর জ্বলে গেল। সাইকোটা এখন যদি হাতের নাগালে থাকতো! নির্ঘাত খুন করে ফেলতো আবির। শৌভিক একহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরল, অন্যহাত দিয়ে কানে ফোন চেপে ধরল। আবিরের মনে সন্দেহের বীজ শক্তপোক্ত ভাবে ঢুকানোর জন্য, মিথ্যে করে, দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘হেই ব্রো! দুটো দিন…মানে ২৪ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে, তোমার আদরের বউ, আমার আদরগুলো গভীর ভাবে উপভোগ করেছে। একদম খাসা মাল.. বুঝলে? শেষের কথাটা বলতে বলতে চোখদুটো আবেশে বুঁজে ফেলল শৌভিক। আবিরের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। তবে দমে গেল না। চিৎকার করে বলল,
-‘সুপ্তির সম্পর্কে আর একটা আজেবাজে কথা বললে, তোকে আমি জ্যান্ত পুঁতে ফেলব রে কুত্তার বাচ্চা।
শৌভিকের হাসি চওড়া হলো। শুকনো ঠোঁটদুটো ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
-‘হেই ব্রো! তুমি এত রেগে যাচ্ছো কেন? দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ে ২৪ ঘণ্টা একঘরে আছি। অথচ আমাদের ভেতরে কিছুই হবে না। এটা কখনো সম্ভব? আচ্ছা তুমিই বলোতো? বিয়ের ঠিক কতদিন পরে, সুপ্তিকে গভীর ভাবে স্পর্শ করেছিলে? ওর মতো মিষ্টি একটা মেয়ের কাছ থেকে নিজের কামুক পুরুষকে ঠিক কতক্ষণ সামলে রাখতে পেরেছিলে তুমি?
শৌভিক ফোনে কথা বলছিল, দেয়ালে টংটং করে বাজতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে! ঘড়িতে জানান দিচ্ছে ; ভোর পাঁচটা বাজে। হঠাৎ সুপ্তির দিকে চোখ পড়তেই ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে, থমকে গেল শৌভিক। অনুভূতি শূণ্যে হয়ে, কানে ফোনটা চেপে ধরেই ব্যাকুল হয়ে, চিৎকার করে বলল,
-‘এই সুপ্তি? ফুলদানিটা হাত থেকে ফেলে দাও..প্লিজ? মাথায় লেগে যাবে কিন্তু? আমার কথা শুনো সুপ্তি? এত ভারি ফুলদানি তোমার মাথায় লেগে গেলে, তোমাকে বাঁচানো যাবে না। এই তুমি ঠিক কী চাইছো বলোতো? দুটোদিন তোমাকে আমার কাছে আটকে রেখেছি। অথচ তোমার শরীরে একটা ফুলের টোকা পর্যন্ত দেইনি। বিয়ে না করে হয়তো তোমাকে ছুঁবোও না। আমি সারা দুনিয়ার কাছে খারাপ হতে পারি সুপ্তি! শুধুমাত্র তোমার ব্যাপারে আমার খারাপ কোন ইন্টেনশন নেই।
সুপ্তি কাঁদতে কাঁদতে ফুলদানিটা নিজের মাথা বরাবর তাঁক করে ধরল। হেঁচকি তুলে বলল,
-‘একটু আগে কী বললি তুই? আমাকে সত্যিই ভোগ করেছিস?
শৌভিক আঁতকে উঠল। অস্থির হয়ে বলল,
-‘না..না..সোনা। গড প্রমিস। বিশ্বাস করো আমার কথা? তুমি দুটোদিন অজ্ঞান ছিলে সুপ্তি। তোমার জ্ঞান ফিরে না দেখে, টেনশনেই তো আমার মাথা কাজ করছিল না। পাগল.. পাগল লাগছিল। তাছাড়া তোমার সাথে সারাক্ষণ একজন মেয়ে নার্স ছিল।
-‘তাহলে আবিরকে মিথ্যে কথা বললি কেন?
-‘আমি তো শুধু ব্রো’র মনে সন্দেহের…
এতটুকু বলেই থেমে গেল শৌভিক। “ওহ..শীট..” দুচোখ শক্ত করে বুঁজে ফেলল শৌভিক। বড্ড ভুল হয়ে গেছে। আবির যে এখনো লাইনে আছে, অতিরিক্ত ভয়ে শৌভিকের মাথাতেই ছিল না। চট করে ফোনটা কেটে দিল শৌভিক। ফোনের ওপাশে আবির স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ওই সাইকোটা এখনো যে সুপ্তির কোন ক্ষতি করেনি। ভাবতেই মনটা আনন্দে ভরে উঠল। চোখ-মুখ মুছে, টাকা আর গাড়ির চাবিটা নিয়ে, হন্তদন্ত পায়ে, ছুটে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল আবির।

যেহেতু শৌভিকের মোবাইল চালু ছিল, মাহবুবের টিমের লোকদের সুপ্তির লোকেশন পেতে খুব বেশি সময় লাগল না। সুপ্তির একটা ছবি ও সুপ্তির বর্তমান ঠিকানা, সেই উপজেলার থানার পুলিশকে দ্রুত সেন্ট করে দিয়ে, যতদ্রুত সম্ভব সুপ্তিকে উদ্ধার করতে বলল। তারপর বিস্তারিত মেইল করে দিল।

২০ মিনিটের ও কম সময়ে পুলিশবাহিনী বাংলোতে পৌঁছে গেল। ম্যাপ অনুযায়ী দোতলায় উঠে, প্রতিটা ঘরে খুঁজতে লাগল। অবশেষে একটা ঘরে, শৌভিক- সুপ্তিকে একসাথে পাওয়া গেল।
শৌভিক পুলিশ দেখে, চমকে উঠল। চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘আপনারা কার অনুমতি নিয়ে এখানে এসেছেন?
পুলিশ, শৌভিকের শার্টের কলার চেপে ধরল। বলল,
-‘আগে থানায় চল? পরে বুঝাচ্ছি। কার অনুমতি নিয়ে এসেছি।
শৌভিক চিৎকার করে বলল,
-‘থানায় যাব মানে কী? এই মেয়েটা আমার বিয়ে করা, মানসিক ভারসাম্যহীন বউ। এই দেখুন? আবোলতাবোল বকতে বকতে আমার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে? কোন সুস্থ মানুষ তার স্বামীর মাথা ফাটিয়ে রক্ত বের করে দেয়?
শৌভিক একটুও ভয় না পেয়ে, এত সুন্দর করে গুছিয়ে মিথ্যা কথাগুলো একনাগাড়ে বলল! সুপ্তি অতিরিক্ত রাগে, দুঃখে, ভয়ে, আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে লাগল। চোখদুটো দিয়ে অঝরে নোনাজল গড়িয়ে পরছে। সুপ্তি ঘরের এক কোণে, হাঁটুতে মুখ গুঁজে, গুটিশুটি মেরে বসে আছে। পুলিশ, সুপ্তির মুখোমুখি হাঁটু মুড়ে বসল। শৌভিককে দেখিয়ে বলল,
-‘এই লোকটা আপনার কী হয়?
সুপ্তি মায়া মায়া কান্নারত মুখ তুলে তাকাল। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
-‘আমার কিছুই হয় না। সম্পর্কে ওই অমানুষটা আমার ছোটবোনের হাজবেন্ড।
শৌভিক ক্ষেপে গেল। মৃদু ধমকে বলল,
-‘ আশ্চর্য.. তুমি মিথ্যা কথা বলছো কেন সুপ্তি?
সুপ্তির ইচ্ছে করছে, শৌভিককে ইচ্ছেমতো থাপ্পড় মারতে! নোংরামির সীমা অনেক আগেই অতিক্রম করে ফেলেছে৷ এত মিথ্যা কথা অকপটে কীভাবে বলতে পারে এই অমানুষটা? ওর কী একটুও ভয় করে না? সুপ্তির তো শুনেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে, গা গুলাচ্ছে।
দুজন কনস্টেবল শৌভিককে ধরে ফেলল। বলল,
-‘আগে থানায় চল? পরে সত্যি- মিথ্যা যাচাই করা যাবে। শৌভিককে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে শার্টের কলার চেপে ধরে হিড়হিড়িয়ে টানতে টানতে নিয়ে গেল।
একজন মহিলা পুলিশ এগিয়ে এলো। সুপ্তিকে বলল,
-‘আপনিও আমাদের সাথে চলুন? যতক্ষণ না আপনার বাড়ির লোক নিতে আসছে! ততক্ষণ পুলিশ হেফাজতে থাকবেন। সুপ্তি চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়াল। শৌভিক যেতে যেতে সুপ্তির দিকে আগুন চোখে তাকাল। চোখ রাঙিয়ে, গাঢ় কণ্ঠে চিৎকার করে বলল,
-‘কাজটা তুমি একটুও ভাল করলে না সুপ্তি? একদিন আগে হোক আর পরে, আমি তো জেল থেকে বের হবোই। সেদিন হয় একসাথে দুজন বাঁচব। নাহয় এক সাথেই মরব। আমি একাকী কষ্টে থেকে, তোমাকে ব্রোর সাথে সুখে থাকতে দেব, ভাবলে কীভাবে?
শৌভিকের থ্রেড শুনে, অতিরিক্ত ভয়ে অন্তঃআত্মা কেঁপে কেঁপে উঠল সুপ্তির। সাইকোটা যে আবিরের সাথে সুপ্তিকে সুখে থাকতে দেবে না। বেশ বোঝা হয়ে গেছে।

সুপ্তি একটা কাঠের চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে ছিল। সেই ভোরে থানায় এসেছে ওরা। বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। এখনো আবির এসে পৌঁছায়নি। দুবার ফোনে কথা হয়েছে। বলেছে,
-‘আর একটু ধৈর্য ধরে বসে থাকো। আমি আসছি! পথ তো ফুরায় না।

-‘সুপ্তিইইই…?
আহ্… সেই চিরচেনা ‘কণ্ঠস্বর’ একদম বুকে এসে লাগল। সুপ্তি মাথা তুলে তাকাল। আবিরকে সশরীরে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থেকে, চোখের কোণে জল জমলো। মনে হলো: কতযুগ পর মানুষটাকে দেখল মেয়েটা! আবিরও নিঃশব্দে কাঁদছে। চোখের জল আটকাতে আলতো করে চোখদুটো বন্ধ করে ফেলল আবির। তারপর ছলছল চোখে, সুপ্তির দিকে তাকিয়ে, দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে, আস্তে করে সুপ্তির দিকে দুইহাত বাড়িয়ে দিল। সুপ্তির চোখে জল, মুখে হাসি ফুটে উঠল। দৌঁড়ে গিয়ে, আবিরের বুকে ঝাঁপিয়ে পরল। আবির ব্যালেন্স রাখতে পারল না। সুপ্তিকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেই কয়েক পা পিছিয়ে গেল। সুপ্তির মাথায়, কপালে, চোখে, মুখে, গালে, পাগলের মতো অজস্র চুমু এঁকে দিয়ে, অস্ফুট স্বরে বলল,
-‘তুমি ঠিক আছো তো সোনা?
সুপ্তি ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকালো। থেমে থেমে বলল,
-‘আমি একটুও ঠিক নেই আবির৷ একটুও না। তুমি পাশে না থাকলে, আমি বড্ড এলোমেলো হয়ে যাই। আমার সবকিছু অর্থহীন মনে হয়। কবে, কখন, কীভাবে তোমাকে আমি এতটা ভালোবেসে ফেললাম, বলো তো?
উত্তরে কিছুই বলল না আবির। শুধু আরও একটু গভীর ভাবে সুপ্তির মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরল। দুটো দিন কী অশান্তিতেই না ছিল মানুষটা। এখন সুপ্তিকে এত কাছে পেয়ে, সুপ্তির কোমল স্পর্শ গায়ে মেখে, মনের ভেতর কী যে শান্তি লাগছে! বুকের ভেতর অনাবিল সুখ সুখ অনুভূতি! আবির বলল,
-‘তোমাকে হারিয়ে, আমি প্রচণ্ড ভেঙ্গে পড়েছিলাম সুপ্তি। শুধু মনে হতো; আমি কী মানুষ চিনতে ভুল করলাম? না…না…সুপ্তি। আমি আমার মনের মানুষ চিনতে একদম ভুল করিনি। ভুলটা ছিল, আমার চোখের আর বুঝার!
সুপ্তি মুখ তুলে তাকাল। আবিরের চোখে চোখ রেখে, বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,
-‘তুমি আমায় বিশ্বাস করো তো আবির?
আবির আত্মবিশ্বাসী ও দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘নিজের থেকেও বেশি। সমস্ত পৃথিবী উল্টে গেলেও আমি তোমাকে কখনো অবিশ্বাস করব না সুপ্তি। কখনোই না। আমাদের বিচ্ছেদের গল্পটা বোধহয় ক্ষণস্থায়ী ভাবে লেখা হয়েছিল! চিরস্থায়ী হলে, আমরা কেউ কাউকে ছাড়া বোধহয় বাঁচতাম না।
দুজন একে-অপরকে দেখে, ঘোরের মাঝে চলে গিয়েছিল। এটা থানা। আবিরের খেয়াল হতেই সুপ্তিকে আস্তে করে ছেড়ে দিল। তারপর সুপ্তির একহাত শক্ত করে চেপে ধরল। যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে। আবির, শৌভিকের সাথে দেখা করতে চাইলো! একজন কনস্টেবল আবিরকে নিয়ে গেল। শৌভিকও অন্য একটা রুমে, পুলিশ হেফাজতে বসে ছিল। সঠিক প্রমাণের অভাবে এখনো জেলে ভরা হয়নি। আবিরকে দেখে তড়াক করে দাঁড়াল শৌভিক। আবির, শৌভিককের সামনে দাঁড়িয়ে সুপ্তির কাঁধ জড়িয়ে ধরল। এই স্পর্শটুকু সহ্য হলো না শৌভিকের। বুকের ভেতর জ্বলেপুড়ে গেল। আবিরের স্পর্শ গায়ে মেখেও কী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। চোখে-মুখে ভয়ের কোন ছাপ নেই। উল্টো আবিরের পুরুষালি স্পর্শটুকু পেয়ে যেন খুব স্বস্তি পাচ্ছে। তাহলে শৌভিক ছুঁতে গেলেই ওমন করে মরার ভয় দেখাতো কেন সুপ্তি? কেনই বা আঁতকে উঠতো? আর কেনই বা সবসময় চোখে, মুখে ভয় লেপ্টে থাকতো? শৌভিক কী দেখতে এতই অসুন্দর? না তো। আবিরের থেকেও বেশি সুন্দর ও মেধাবী। তারপরও কেন সুপ্তি শৌভিককে সহ্য করতে পারে না? একটু ভালোবাসলে, একটু ছুঁয়ে দিলে কী এমন ক্ষতি হতো?
আবির, সুপ্তিকে ছেড়ে, আচমকা শৌভিকের শার্টের কলার একহাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল৷ তারপর আরেক হাত দিয়ে এলোপাতাড়ি শৌভিকের গালে, মাথায় থাপড়াতে লাগল। শৌভিক টু শব্দটিও করল না। বাঁক হারা হয়ে, সুপ্তির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে, মাইরগুলো হজম করে নিল। আবির ক্লান্ত হয়ে শৌভিককে ছেড়ে দিল। শৌভিকের মাথার রক্ত শুকিয়ে গেছে। মাথায় গেঁথে থাকা কাচগুলো খুলে দিয়ে, মাথা ব্যান্ডেস করে দেওয়া হয়েছে। আবিরের চোখে-মুখে একরাশ ঘৃণা। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-‘তোকে আমার ভাই বলতেও ঘৃণা লাগছে শৌভিক। ছিঃ…তুই এত জঘন্য একটা কাজ কীভাবে করতে পারলি? তোকে আমি এমনি এমনি ছাড়ব না। সুপ্তিকে দিয়ে, নারী নির্যাতনের, অপহরণের, আর মানহানীর কেইস দেওয়াবো। দেখব তোকে কে ছাড়ায়? সরকারি চাকরির দাপটে এত ঘৃণ্য একটা অপরাধ করেছিস না তুই? শুধু জেল হোক। তোর স্বাদের চাকরিটাও চলে যাবে। তুই আমার কলিজায় হাত দিয়েছিস শৌভিক। আমি তোকে যে কী করবে রে… তুই ভাবতেও পারছিস না। সুপ্তির হাতের লেখা নকল করে একটা চিঠি লিখবি আর কাউকে দিয়ে, সুপ্তির জামা-কাপড় চুরি করে নিয়ে গেলেই আমি বোকার মতো সুপ্তিকে ভুল বুঝে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব! ভাবলি কীভাবে? সুপ্তি যদি সত্যি সত্যিই চলেও যেতো৷ তবুও সুপ্তিকে আমার সামনা-সামনি যে ভাবেই হোক, দাঁড় করাতাম আমি। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে, মুখ থেকে সত্যিটা শুনে তবেই ছাড়তাম। এত ভালোবাসা, এত মায়া, এত আদর, এত সুখ কখনো মিথ্যা হতে পারে না। আর একটা কথা! সুপ্তির জামা-কাপড়ের ব্যাগটা তুই কার কাছ থেকে পেয়েছিস? তোর বাবার দিব্যি! সত্যি করে বলবি?
শৌভিক এক সেকেন্ডও সময় নিল না। বলল,
-‘সুপ্তির মা নিজে দিয়েছে। বলেই বাঁকা চোখে সুপ্তির দিকে তাকিয়ে, নিঃশব্দ হাসল শৌভিক।
সুপ্তি চমকে উঠল। মা..মা.. দিয়েছে? কিন্তু কেন? আবিরও বেশ অবাক হয়েছে। সুপ্তিকে ভরসা দিয়ে বলল,
-‘মন খারাপ করো না সুপ্তি। তবে ওনি যদি সত্যিই এই কাজটা করে থাকে। ওনাকে এর জবাব দিতেই হবে।

আবির সুপ্তিকে নিয়ে চলে যেতেই, শৌভিক শান্ত হয়ে, থম মেরে বসে পরল। সেই যে সুস্থ স্বাভাবিক একটা ছেলে বসল। আর নিজের ইচ্ছেতে উঠলো না। কারো সাথে কথাও বলল না। সুপ্তিকে হারিয়ে এবার না সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে যায় ছেলেটা। ভালো না বাসুক। দয়া দেখিয়েও সুপ্তি যদি শৌভিকের কাছে থেকে যেতো। শৌভিকের জীবনটা আজ অন্যরকম সুন্দর হতে পারতো!

গাড়িতে উঠেই সুপ্তিকে নিজের কাছে টেনে নিল আবির। সুপ্তি নিচু কণ্ঠে বলল,
-‘ছাড়ো..? আমি স্নান করব। তারপর…
আবির সেকথা শুনলে তো! দুটো দিন সুপ্তি বিহীন ছিল। অথচ দুই যুগ মনে হয়েছে। এত ধৈর্য নেই আবিরের। সুপ্তির অধরে অধর রাখতেই ছটফটিয়ে উঠল সুপ্তি। আবির, সুপ্তির কোমরটা আর একটু শক্ত করে চেপে ধরতেই ধীরে ধীরে সুপ্তির ছটফটানি কমে এলো। আবিরের তীব্র ভালোবাসার কাছে সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, ভয়, হতাশা, ধুয়ে-মুছে বিলীন হয়ে গেল।

(চলবে)

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ২৪

রাত নেমে গেছে অনেক আগেই। রাতের নিকষ কালো আকাশ জুড়ে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে। আবির একমনে গাড়ি চালাচ্ছে।
বিধ্বস্ত, ক্লান্ত সুপ্তি, আবিরের কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। এতরাতে আবিরের আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করল না। তাছাড়া এখন সুপ্তিকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেই হাজারটা কথা উঠবে। সুপ্তিকে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামীর মতো, হাজার রকমের প্রশ্ন করা হবে। মেয়েটা এমনিতেই অনেক আপসেট হয়ে আছে। হয়তো ভয়ও পেয়েছে খুব। আগে সুপ্তিকে সহজ করা প্রয়োজন। তারপর নাহয় আস্তে-ধীরে বাড়ি ফেরা যাবে। আবির, সুপ্তিকে নিয়ে একটা বিলাসবহুল হোটেলে উঠল। হোটেল প্লেসে গাড়ি পার্কিং করে, আবির সুপ্তির মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে, নিচু কণ্ঠে, বারকয়েক ডাকল। সুপ্তি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল। মাথাটা ভার হয়ে আছে। মনটাও খুব বিক্ষিপ্ত। হাই তুলে বলল,
-‘এসে গেছি আমরা?
-‘হ্যাঁ।
সুপ্তি গাড়ি থেকে নেমে, চারপাশে এক নজর চোখ বুলিয়ে নিল। অবাক হয়ে বলল,
-‘এটা তো বাড়ি না।
আবির, গাড়ি থেকে নেমে এসে, একহাতে সুপ্তির কাঁধ জড়িয়ে ধরল। বলল,
-‘ তোমার এখন রেস্টের প্রয়োজন। দুটোদিন এখানে রিলাক্সে থাকব আমরা। তারপর বাড়ি ফিরব।
সুপ্তি নিচু কণ্ঠে বলল,
-‘মা কী ভাববে?
-‘মাকে আমি বুঝিয়ে বলব।
সুপ্তি একগুঁয়ের মতো জেদ করে বলল,
-‘না আমি এখানে থাকব না। বাড়ি যাব।
আবির, সুপ্তির গালে একহাত রেখে বলল,
-‘বাড়ি তো যাবেই। তবে দুটো দিন পরে প্লিজ।
সুপ্তি মায়া মায়া চোখ তুলে তাকাল। বলল,
-‘আমার এখানে থাকতে একটুও মন মানছে না। তুমি আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো প্লিজ? আমি মায়ের কাছে যাব।
আবির বুকচিরে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ধীর কণ্ঠে বলল,
-‘বেশ চলো তবে।

ওরা বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে গেল। তখনো আকাশ কাঁপিয়ে ঝুমবৃষ্টি নামছে। তৃণারানী জেগেই ছিল। আবিরের সাথে সুপ্তিকে দেখে এগিয়ে এলো।
এই প্রথমবার তৃণারানী সুপ্তিকে দেখে, একটুও খুশি হতে পারল না। ঘরের বউ পরপুরুষের সাথে দুই রাত কাটিয়ে এসেছে! কথাটা মনে পড়তেই গা গুলিয়ে উঠল। আবির তখনো সুপ্তির কাঁধ জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তৃণারানী চোখে, মুখে কাঠিন্য ফুঁটিয়ে বলল,
-‘ওকে কোথায় পেলি?
আবির, মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘সুপ্তি কিডন্যাপ হয়েছিল মা।
তৃণারানীর চোখে-মুখে অবিশ্বাস। আবিরকে অপকটে সুপ্তির ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলতে দেখে, তৃণারানীর মনটাই খারাপ হয়ে গেল। একটা মেয়ে কিডন্যাপ হলে, কেন জামাকাপড় সহ চিঠি লিখে কিডন্যাপ হবে? আবির- সুপ্তির প্রেমে মজনু হয়ে, চোখে ঠুলি পরতে পারে। কিন্তু তৃণারানীর বেশ জানা আছে! দুটো রাত তো আর সুপ্তিকে একাকী পেয়ে, বসিয়ে রাখেনি শৌভিকটা। নিশ্চয়ই উল্টাপাল্টা কিছু করেছে। পালিয়েই যখন যাবে! আবার কেন আবিরের হাত ধরে এই বাড়িতে ফিরে এলো সুপ্তি?
আবির হাসল। হাসিটা মলিণ। সুপ্তিকে ছেড়ে দিয়ে, মায়ের মুখোমুখি দাঁড়াল। তারপর এঁকে এঁকে তৃণারানীকে সব সত্যি কথা বলল। তৃণারানী দুইহাত দিয়ে কান চেপে ধরে, আবিরকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিল। চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘আর কত মিথ্যা গল্প বানিয়ে বানিয়ে বলবি? চুপ কর আবির? তোর মুখ থেকে আমি আর একটাও মিথ্যা কথা শুনব না।
-‘মা…?
-‘এতকিছুর পরও কেন এই মেয়েটাকে ঘরে তুলেছিস তুই? আবারও সুযোগ পেলে এই মেয়েটা তোকে ফেলে ঠিকই চলে যাবে!
আজ নিজের মাকে বড্ড বেশি অচেনা ঠেকলো আবিরের! এই কী তার সেই আদর্শ মা? না বোধহয়। চেনা মায়ের অচেনা রূপ দেখে, আবির মনে মনে খুব ভেঙে পড়ল। শুধু মুখে বলল,
-‘শাশুড়ীরা কখনো মা হয় না। তাই না মা?
-‘আমি মা হতেই চেয়েছিলাম আবির। কিন্তু তোর বউ আমার মেয়ে হতে চায়নি। তাই তো এত ঘৃণ্য একটা কাজ করতে পারল। ছিঃ…
আবির অধৈর্য হয়ে, চিৎকার করে বলল,
-‘সুপ্তি কিছু করেনি মা? তুমি কেন আমার মুখের কথা বিশ্বাস করছো না? ওকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল! বুঝতে পারছো তুমি?
ছেলের ভয়ংকর রেগে যাওয়া রূপ দেখে, তৃণারানীর অন্তরঃআত্মা কেঁপে কেঁপে উঠল। কখনো তো মায়ের সাথে জোর গলায় কথা বলেনি আবির? তাহলে আজ কেন এমন করল?
শাশুড়ীমায়ের চোখে স্পষ্ট অবিশ্বাস দেখে, সুপ্তি ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গেল। এই মানুষটাকে মন থেকে সম্মান করে সুপ্তি। মনে মনে মায়ের আসনে বসিয়েও ফেলেছিল। অথচ আজ কত সহজেই সুপ্তির চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। এক গাছের বাঁকড় কখনো অন্য গাছে লাগে না। আর স্বার্থের পৃথিবীতে পর কখনো আপন হয় না।
এই ব্যাপারে আর মায়ের সাথে আর কথা বলতে ইচ্ছে করল না আবিরের। সুপ্তির হাত মুঠো করে ধরে, মায়ের সামনে দিয়ে ঘরে নিয়ে গেল।
তৃণারানী ধীরে ধীরে সোফায় বসে পরল। বিড়বিড় করে বলল,
-‘এত পাপ ঈশ্বর সইবে তো?

ঘরের দরজা আটকে দিয়ে, সুপ্তিকে বুকের মাঝে চেপে ধরল আবির। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-‘মায়ের কথায় কিছু মনে করো সোনা। আসলে মা চোখে যা দেখেছে! তাই সত্যি ভাবছে।
সুপ্তির মুখটা আঁজলায় তুলে ধরে, পরম যত্নে চোখের জল মুছিয়ে দিল আবির। গাঢ় কণ্ঠে আবারও বলল,
-‘সবসময় মনে রেখো! সমস্ত পৃথিবীর মানুষ তোমার বিপক্ষে গেলেও আমি তোমার পক্ষে থাকব সুপ্তি। একমাত্র মৃত্যু ছাড়া আমাদের এই স্বামী-স্ত্রী’র পবিত্র বন্ধন সারাজীবন অটুট থাকবে। সুপ্তি নিজেকে সামলে নিল। আবিরের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে, স্নান করতে চলে গেল। সময় নিয়ে স্নান করে, মাথা মুছতে মুছতে ব্যালকনিতে গিয়ে আবিরের পাশে দাঁড়াল। আবিরের হাতে জলন্ত সিগারেট। সুপ্তি কেশে উঠল। আবির সিগারেটে শেষ টান দিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলল। সুপ্তি সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। আবির বিয়ের পরপরই সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। সুপ্তি হারিয়ে যাওয়ার পর, মানসিক ডিপ্রেশন থেকে ক্ষণিকের জন্য মুক্তি পেতে এত বেশি সিগারেট খেয়েছে আবির। এখন বোধহয় চাইলেও হুট করে ছাড়া সম্ভব না। সুপ্তি টিয়াপাখির শূণ্য খাঁচার দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল। মুখে হাত রেখে অস্ফুট স্বরে বলল,
-‘বিবিসি কোথায়?
-‘তার আপন ঠিকানায়।
-‘মানে?
-‘মুক্ত করে দিয়েছি।
-‘ওমা…কেন?
আবির, সুপ্তিকে হাত বাড়িয়ে নিজের কাছে টেনে নিল। সুপ্তির উন্মুক্ত কোমরে ঠাণ্ডা হাত রেখে শক্ত করে চেপে ধরে, সুপ্তির সদ্য শ্যাম্পু করা ভেজা চুলে নাক ডুবিয়ে দিল। আবেশে চোখ বুঁজে নিঃশ্বাসে টেনে নিল, সেই চিরচেনা মাতাল করা ঘ্রাণ। তারপর সুপ্তিকে ঘুরিয়ে সামনে এনে, দুই কাঁধে হাত রেখে, চোখ চোখ রাখল। গাঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘তোমার হারিয়ে আমি পাগল পাগল হয়ে গিয়েছিলাম সুপ্তি। কী করব..না করব। আমার মাথা সুস্থ ভাবে কাজ করতো না। তাই আমার বহু দিনের পোষা পাখিকে ছেড়ে দিয়েছি। কী হবে আটকে রেখে? আমার ভালোবাসার মানুষটাকেই তো আমি আগলে রাখতে পারিনি।
সুপ্তির চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল জমলো। আস্তে করে মাথাটা আবিরের উন্মুক্ত বুকে গুঁজে দিল। এই বুকে মাথা রাখতে সব দুঃখ-কষ্ট, ভয়, হতাশা ম্যাজিকের মতো দূর হয়ে যায়। খুব শান্তি লাগে। অস্ফুট স্বরে বলল,
-‘ তাই বলে, তোমার প্রিয় পাখিটাকে এই ভাবে ছেড়ে দেবে?
-‘বিবিসিকে এতদিন শুধু শুধু নিজের কাছে আটকে রেখে কষ্ট দিয়েছি সুপ্তি। সব নীড় হারা পাখিরই দিনশেষে আপন নীড়ে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। মুক্ত আকাশে মনের সুখে ডানা মেলে উড়তে ইচ্ছে করে। এতদিন না বুঝে, স্বাধীন পাখিটাকে পরাধীন জীবন দিয়ে বড্ড ভুল করেছি। তুমি আমার জীবন থেকে ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে না গেলে, আমার এই উপলব্ধিটা হয়তো কোনদিনও হতো না।
উত্তরে সুপ্তি কিছু বলল না। আবির বলল,
-‘মায়ের কথায় মন খারাপ করো না সুপ্তি। মা চোখে যা দেখেছে, তাই সত্যি মনে করছে। খুব শীঘ্রই মায়ের ভুল আমি ভেঙে দেব। তুমি দেখো?
-‘না। মন খারাপ করিনি।
আবির বলল,
-‘চলো খেয়ে নিবে?
-‘খিদে নেই।
-‘অল্প কিছু খাবে।
-‘না। আমি এখন নিচে যাব না প্লিজ।
আবির আর কথা বাড়াল না। চলে গেল। সুপ্তি ব্যালকনিতেই দাঁড়িয়ে রইল। এতক্ষণ মুষলধারে ঝুমবৃষ্টি নামলেও এখন একটু কমে এসেছে। তবে টিপটিপ করে একধারে বৃষ্টি পরছে। বৃষ্টির ছোট ছোট কণা সুপ্তিকে বারংবার ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সুপ্তি কখনোবা জলের উষ্ণ স্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠছে।

আবির কিছুক্ষণ পরেই হাতে খাবারের থালা আর জলের গ্লাস নিয়ে, ব্যালকনির দোলনায় এসে বসল। সুপ্তির হাত টেনে ধরে পাশে বসিয়ে দিল। তারপর নিজেও খেলো, সুপ্তিকেও জোর করে খাইয়ে দিল।
খাওয়ার পর্ব শেষ করে, হাত-মুখ ধুয়ে, দোলনায় আড়াআড়ি ভাবে শুয়ে পরল আবির। সুপ্তিকে বুকে টেনে নিল। সুপ্তিও আবিরের বুকে মাথা রেখে, নিজের শরীরের সমস্ত ভরটুকু আবিরের শরীরে ছেড়ে দিল। দুজনই সারারাত জেগে জেগে বৃষ্টিবিলাস করল। স্বচ্ছ বৃষ্টির জলের সাথে সুপ্তির মন খারাপ ভাবটাও একটু একটু করে ধুয়েমুছে বিলীন হয়ে গেল।

সুর্বনারানী একমনে ভাত খাচ্ছিল। ধীর পায়ে দীপ্তি মায়ের পাশের চেয়ারে এসে, আস্তে করে বসল। মায়ের প্লেটে আরেক চামচ ভাত তুলে দিয়ে বলল,
-‘খাও..মা?
সুর্বনারানী মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
-‘আর দিস না। এত খেতে পারব না।
দীপ্তি গ্লাসে জল ভরে মায়ের সামনে বাড়িয়ে দিল। বলল,
-‘দিদি ফিরে এসেছে মা।
সুর্বনারানী বিষম খেল। গলায় ভাত আটকে কাশতে কাশতে অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। একটু ভয় ভয় করে লাগল। প্রাণপনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে, আমতা আমতা করে বলল,
-‘সে তো ভাল কথা।
মায়ের মাখানো ভাতের দিকে একপলক তাকাল দীপ্তি। ধীর কণ্ঠে বলল,
-‘এই যে ভাতটা খাচ্ছো না মা? এই ভাতের চাউলটাও দিদির বাবার টাকায় কেনা। আমাদের নিত্যদিনের বাজার খরচ, আমার পড়াশোনার খরচ, বাবার ঔষধ, তোমার শখের টুকিটাকি কেনাকাটা, এমনকি আমার বিয়ের খরচটা পর্যন্ত দিদির বাবার টাকায় হয়েছে।
অথচ তুমি দিদির সাথে এতবড় অন্যায়টা কেন করলে মা? সত্যিটা দিদি কখনো জানতে পারলে, এর পরিণাম কী হবে একবারও ভেবে দেখোছো?
সুর্বনারানী উত্তেজিত হয়ে গেল। তোতলাতে তোতলাতে বলল,
-‘কী..কী করেছি আমি?
-‘সেদিন যখন তুমি সবাইকে লুকিয়ে দিদির ব্যাগটা অচেনা এক মহিলার হাতে তুলে দিয়েছিলে, আমি প্রথমে বুঝিনি জানো? ভেবেছি, ব্যাগ হয়তো ছিঁড়ে গেছে। তাই সেলাই করতে দিচ্ছো। অনেক পরে বুঝেছি ওই ব্যাগের আসল রহস্য। শৌভিক খারাপ মা। শুধু খারাপ বললে, ভুল হবে, ও আস্ত একটা নরপিশাচ। জেনেশুনে ওদের সাথে কেন হাত মিলালে তুমি? এতে তোমার কী এমন লাভ হয়েছে? বলোতো আমাকে? যার বাবার টাকায় খাও, ফুটানি করে চলো! তাকে আদর না করতে, একটু স্নেহও তো করতে পারতে মা?
সুর্বনারানী ঝরঝর করে কেঁদে দিল। অস্ফুট স্বরে বলল,
-‘বিশ্বাস কর? আমি সত্যিই জানতাম না। সুপ্তিকে ওই জানোয়ারটা নিয়ে পালিয়ে যাবে। আমি তো অন্য একটা কারণে এই কাজটা করেছি।

(চলবে)