মরুর বুকে বৃষ্টি ২ পর্ব-০৭

0
221

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-৭
®মেহরুমা নূর

★ঘুম ভেঙে চোখ মেলে তাকাতেই বিশাল একটা চমক পেল নূর৷ চোখের সামনে বাস্কেটের মাঝে ছোট্ট সুন্দর একটা বিড়াল ছানার দেখা পেল। তা দেখে প্রফুল্লচিত্তে ঝট করে উঠে বসল সে। চোখে মুখে খুশিময় চমক। বিড়াল ছানাটা সেদিনের ওই বাসার পেছনেরই তাও চিনতে সময় লাগল না তার। খুশিতে আমোদিত কন্ঠে সে বলল,
“ওমা! তুই! তুই এখানে কি করে এলি! কি সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে!”

“পছন্দ হয়েছে তোমার?”
হঠাৎ আদিত্যর কন্ঠ শুনে পেছনে ঘুরে তাকাল নূর। আদিত্য বসে আছে তার পেছনে। যেন নূরের এই খুশি মুখটা দেখার জন্য অপেক্ষা করছিল সে। কাল রাতে আদিত্যর কাছেই ঘুমিয়েছিল নূর। তাও কোনো কৌশল ছাড়াই। নূর নিজের ইচ্ছেতেই আদিত্যর সাথে কথা বলতে বলতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিল। আর আদিত্য তার বুকে পেয়েছিল আবারও সেই অনাবিল প্রশান্তি। তার এঞ্জেলকে বুকে নিয়ে আরও একটা প্রশান্তিময় রাত পার করেছে। তাইতো সকাল সকাল নূরের মুখে হাসি ফোটাতে এই বিড়াল ছানা ধরে এনেছে সে। যদিও এসবে আদিত্যর ভীষণ এলার্জি। তবে এখন যে তার নিজের কিছুই নেই। নূরের খুশির জন্য সব পারবে সে। আদিত্য মুচকি হেঁসে বলল,
“কি হলো বলো পছন্দ হয়েছে? ”
নূর বিস্ময় ভরা কন্ঠে বলল,
“এটা তুমি এনেছ?”
“হ্যাঁ, তোমার জন্য। খুশি হয়েছ তুমি? ”
নূর প্রশস্ত হাসি উপহার দিলো আদিত্যকে। উৎসাহিত কন্ঠে বলল,
“অনেক খুশি হয়েছি। তুমি একদম রাক্ষস না৷ তুমিতে অনেক ভালো একটা হিরো।”
নূরের খুশির আলোয় উজ্জ্বল হলো যেন আদিত্যের হৃদ ভুবন। আদিত্য হালকা হেঁসে বলল,
“আচ্ছা! তাহলে হিরো তোমাকে গিফট দিলো এখন তুমিও তাকে প্রতিদানে কিছু দাও। রিটার্ন গিফট দিতে হয় বুঝেছ। মানে ফিরতি উপহার দিতে হয়। তাহলে হিরোকেও খুশি হয়ে কিছু দাও।”
নূর ঠোঁট উল্টে মলিন মুখ করে বলল,
“কি দিবো তোমাকে? আমার কাছেতো কিছু নেই। শুধু এই পুতুলটা ছাড়া।”
“সব উপহার দিতে টাকা বা জিনিস লাগে না৷ এসব ছাড়াও তুমি চাইলে অনেক বড় কিছু দিতে পারো।”
নূর চিন্তাগ্রস্ত মুখ করে বলল,
“কি দিতে পারি?”
আদিত্য নূরের মুখের সামনে ঝুঁকে বলল,
“এই তোমার মিষ্টি ঠোঁট দুটোর ছাপ আমার গালে লাগাতে পারো। সেটাও অনেক বড় উপহার হবে।”
“তাই! এটাও উপহার হয় বুঝি!”
“হুম হয়তো। আমার জন্যতো এটাই বেস্ট উপহার।”
“আচ্ছা, এই নাও।”
অতঃপর নূর তার অধর ছোঁয়াল আদিত্যর গালে। আবেশে মোহিত হলো আদিত্য মন মঞ্জিল। জীবন বুঝি এতো সুখের হয়! নূর মানেই তার সুখের সাম্রাজ্য। চুমু দেওয়ার পর নূর বলল,
“এইযে দিয়েছি,এখন খুশি?”
আদিত্য প্রাপ্তিময় হেঁসে নূরকে এক হাতে টেনে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আমার এঞ্জেল থাকা মানেই আমার খুশির ভান্ডার। সবসময় এভাবেই থাকিস আমার কাছে। কখনো ছেড়ে যাসনা আমাকে।”
নূর আদিত্যর বুকের মাঝ থেকেই বলে উঠল,
“কিন্তু আমাকেতো এখুনি যেতে হবে।”
আদিত্য ঝট করে নূরের মাথা ধরে সামনে ধরে কপাল কুঁচকে বলল,
“যেতে হবে মানে! কোথায় যেতে হবে? ”
“বাথরুমে যেতে হবে। আমার বাথরুম পেয়েছে তো।”
আদিত্য শব্দ করে হেঁসে উঠল। হাসতে হাসতে নূরের কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
“তুই সত্যিই একটা যাদুর ময়নাপাখি।”

নূর ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে এলো। এতদিনে সব শিখে গেছে। এখন আর বাথরুমে যেতে কাউকে লাগেনা তার। জমিলা নূরের সব জিনিসপত্র আদিত্যর রুমে এনে দিয়ে গেছে সকাল বেলা। যদিও জিনিসপত্র বলতে শুধু নূরের একটা ব্যাগ শুধু। যাতে ওর কিছু কাপড়চোপড় আছে শুধু। নূর ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আসলে আদিত্য খেয়াল করল নূরের জামার এক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। আদিত্য তা দেখে বলল,
“এটাতো ছিঁড়ে গেছে। এটা পড়েছ কেন?”
নূর বলল,
“আরে তাতে কি হয়েছে? আমিতো এরচেয়েও কত ছেঁড়া জামা পড়ে থাকতাম। এতে কিছু হয়না। আর তাছাড়া সব জামাই এমনই প্রায়।”
আদিত্যর এমুহূর্তে নিজের উপর তীব্র পরিমাণ রাগ হচ্ছে। রাগে ইচ্ছে করছে নিজেকে চাবুকাঘাত করতে। সে নিজের বউয়ের প্রতি এতটুকু খেয়াল রাখতে পারেনি! কেমন স্বামী সে! যারজন্য সব কিছু উজার করে দিবে। তারই সামান্য প্রয়োজনের খবর নেই তার! আদিত্য নূরের কাছে এসে নূরের গালে হাত রেখে অপরাধী চোখে তাকিয়ে বলল,
“আম সরি এঞ্জেল। এবারের মতো মাফ করে দাও। আর কখনো এমন ভুল হবে না।”
নূর বুঝতে না পেরে বলল,
“কি ভুল হবে না।”
“কিছু না। ওসব ছাড়ো। আজ আমরা শপিংয়ে যাবো। আমার এঞ্জেলের সব জিনিসপত্র কিনে আনবো।”
নূর খুশি হয়ে বলল,
“সত্যিই!! আমাকে শপিংয়ে নিবেন? কিন্তু আমাকেতো কেউ নেয় না। আমি কত যেতে চাই কিন্তু কেউ নেয় না।”
“আমি নিয়ে যাবো তোমাকে। আমার এঞ্জেল যা চাইবে তাই হবে এখন থেকে। চল এখন নিচে গিয়ে নাস্তা করে নাও। তারপর যাবো আমরা।”
“আচ্ছা।”
আদিত্য নূরের হাত ধরে নিচে নিয়ে এলো। নূর রোজকার মতো নিচে বসতে চাইলো। কিন্তু আদিত্য বসতে দিলোনা। সে বলল,
“এখন থেকে তুমি চেয়ারে বসে খাবে। নিচে বসে খেতে হবে না।”
“কিন্তু আমিতে টেবিলে খেতে পারি না।”
“তাতে কি হয়েছে! খেতে না পারলে আমি খাইয়ে তোমাকে। তবুও নিচে খাবেনা তুমি।”
আদিত্য নূরকে চেয়ারে বসিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে লাগল। তা দেখে বাসার সার্ভেন্টরা বিস্ময়ে অজ্ঞান হওয়ার জো। এমন একটা দৃশ্যও কোনোদিন দেখার ছিলো তা জীবনেও কল্পনা করেনি তারা। তবে জমিলা আর বিহান খুশি হলো তা দেখে। আদিত্য ফাইনালি ওর আপনজন পেয়ে গেছে এটাই খুশির কারণ।
__

রাজধানীর বিলাসবহুল এক শপিং মলে এসেছে আদিত্য নূরকে নিয়ে। সাথে আবির আর বিহানও এসেছে। যদিও বিহান আসতে চায়নি। আবির ওকে জোর করেই টেনে এনেছে। এই বলে যে, “আয় তোকে একটু চুড়ি,মালা কিনে দেই।” আদিত্য নূরের হাত ধরে রেখেছে নিজের হাতের মাঝে। নূরতো বিস্ময়ে হতভাগ। শপিং মলের চাকচমক দেখেই চোখে ধাঁধা লেগে গেছে তার। বিস্ময় ভরা নজরে চারপাশে তাকিয়ে দেখছে সে। আদিত্য নূরের হাত ধরে সামনের সিঁড়ি লিফটের দিকে এগিয়ে গেল। সেটা দেখে নূর আরও বিস্ময় আবিষ্কার করল। সিঁড়ি একা একাই চলছে! কি অদ্ভুত ব্যাপার! আদিত্য নূরকে নিয়ে সিঁড়িতে পা দিতে নিলেই নূর ভয় পেয়ে বলল,
“না না আমি এটাতে উঠব না। এটাতে চান্দু মিয়ার নানীর ভূত আছে। দেখেন না একা একাই চলছে! আমাদের গ্রামে চান্দু মিয়ার নানীর ভুত রাতের বেলা একা একাই নৌকা চালাত। সেই ভুত এখানেও চলে আসছে।”
ড্রামাবাজ আবির তখন আতঙ্কিত হওয়ার ভঙ্গিতে বলে উঠল,
“ও মাই খাট! ভুত! আদি তুই আমারে ভুতের মলে নিয়া এলি! এই ছিলো তোর মনে! নাহয় মাঝে মধ্যে ওই একটু আধটু তোর পকেট মাইরা খাইতাম। তাই বলে এভাবে বদলা নিবি তুই! এমনটা করতে পারলি! দুঃখে কলিজায় ডায়রিয়া হয়ে যাচ্ছে আমার।”
বিহান পাশ থেকে বলে উঠল,
“আরে ছমছ্যা কিছের! ভুতনীদের ছাথে ইচ্ছেমত প্রেম পিরিতির আছর বছাবি। তোরে পাইয়া ভুতনী বাছিও খুছি হইয়া যাইবোগা। এমতেও তোর লাইগা ভুতনী গোষ্ঠীই ঠিক আছে। খাপে খাপ মাইনকার বাপ।”
এদের কথায় আদিত্য বিরক্ত হয়ে বলল,
“চুপ করবি তোরা! যেখানে সেখানে শুরু হয়ে যাস।”
তারপর নূরের উদ্দেশ্যে বলল,
“ভয় নেই এঞ্জেল। এখানে কোনো ভুত টুত নেই। এটা একটা মেশিন শুধু। আমি আছি না! আসো আমার সাথে। ভয় পেওনা।”
নূর তাও ভয় পাচ্ছে। আদিত্য এক হাতে নূরকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ভয় নেই, এসো আমার সাথে।”
নূরকে ধরে সিঁড়িতে পা রাখল আদিত্য। নূর ভয়ে আদিত্যকে শক্ত করে করে আছে। আদিত্যর শার্ট খামচে ধরেছে সে। আদিত্য নূরের ভয় কমাতে বলল,
“দেখ কিছু হচ্ছে না। এইযে উঠে যাচ্ছি আমরা।”
নূরের ভয় যেন ধীরে ধীরে কমে এলো। এখন সে এটাতে ভীষণ একটা কৌতুহলী হয়ে উঠল। অবাক হয়ে দেখলো কিভাবে একা একাই উপরে উঠে যাচ্ছে। সিঁড়ির শেষ মাথায় গিয়ে নামতেই আদিত্য বলল,
“দেখেছ কিছুই হয়নি আমাদের। এটা শুধু একটা মেশিন।”
নূর যেন ভীষণ রকম উৎসুক হলো। সে বলল,
“আমরা আবার একটু উঠি এটাতে!”
“এখন! পরে আবার নামার সময় উঠবো তো।”
“আমি এখুনি উঠতে চাই। উঠি না!”
“আচ্ছা বাবা ঠিক আছে চলো।”
আদিত্য নূরকে নিয়ে আবারও সিঁড়িতে উঠল। এবার আর ভয় পেলনা নূর।আদিত্যকেও এবার আর ধরলোনা সে। বরং উল্টো বিস্ময়কর খুশি হচ্ছে সে। এভাবে একবার নেমে আবারও উঠল ওরা। নূর এবার খুশিমনে হাতে তালি বাজিয়ে সিঁড়ির উপর লাফাতে লাগল। উপরে উঠে আবারও জেদ ধরল সিঁড়িতে ওঠার। আদিত্য পড়ে গেল এক বিপাকে। এই মেয়েতো এখানেই সারাদিন কাটিয়ে দিবে। নূর এবার একাই উঠে পড়ল। মহা আনন্দে বারবার উঠছে আর নামছে সে। আদিত্য বেচারা করুন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আবির বিহানের উদ্দেশ্যে বলল,
“যা একখান বালিশ নিয়ে আয়। ভাবির সিঁড়ি বিলাশ করার মাঝে এক ঘুম হয়েই যাবে মনে হচ্ছে।”
নূর এবার উপরে আসলে আদিত্য তাকে ধরে আঁটকে নিয়ে আদুরে সুরে বলল,
“নূর,মাই এঞ্জেল। অনেক মজা করেছ। এখন একটু শপিং করে নেই প্লিজ। দরকার হলে এই সিঁড়ি আমি বাসায় লাগিয়ে দিবো। তুমি সারাদিন চড়ে বেড়িও কেমন! এখন চলো দয়া করে।”
“সত্যিই! ”
“তিন সত্যি। ”
“আচ্ছা চলো তাহলে।”
হাফ ছেড়ে বাঁচল বেচারা আদিত্য।

নূরকে নিয়ে অনেক কেনাকাটা করল আদিত্য। আবির আর বিহানও টুকটাক ঘুরে দেখছে। আবিরতো শপিংয়ের চেয়ে বেশি সুন্দরী মেয়েদের চেকিংএ ব্যাস্ত। শপিংএর শেষে নূরকে নিয়ে সবাই ফুড কর্নারে বসল। হঠাৎ আদিত্যর একটা জরুরি ফোন আসলো। নেটওয়ার্ক না পাওয়ায় আদিত্য একটু উঠে গিয়ে অন্যদিকে গিয়ে কথা বলতে লাগল। নূর জুস খাচ্ছিল। তখনই ওর চোখে আবারও একটা বিস্ময়কর বস্তু পড়ে। এবারের বিস্ময়টা যেন আরও বিশাল। নূর দেখল সামনের ছোট্ট একটা ঘরের মধ্যে মানুষ ঢুকছে। তবে বের হচ্ছে অন্য মানুষ হয়ে। এটা দেখেতো নূর আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেল পুরো। নূর বিষয়টার ব্যাখ্যা জানতে পাশের আবিরকে বলল,
“আচ্ছা ওই ঘরটাতে মানুষ ঢোকার পর অন্য মানুষ হয়ে যাচ্ছে কেমন করে!”
আবির বুঝলো নূর লিফটের কথা বলছে। যেখানে একজন যাচ্ছে তো আরেকজন আসছে। আবির ভাবল একটু মজা করা যাক নূরের সাথে। সে নূরকে বলল,
“আরে এটার কথা জানোনা ভাবি! এটা একটা ভয়ানক জাদুর ঘর। এখানে মানুষ ঢুকলে বের হয় অন্য মানুষ হয়ে।”
নূর বিস্ময়ে শঙ্কিত হয়ে বলল,
“বলো কি!”
হঠাৎ দেখলো আদিত্যও ওই লিফটে ঢুকছে। তাকে লিফটে ঢুকতে দেখে আৎকে উঠল নূর। সে আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
“আরে আরে হিরো ঢুকে গেলোতো ওর মাঝে। হিরোওওও…”
বলতে বলতে নূর দৌড়ে গেল লিফটের সামনে আদিত্যকে বাঁচাতে। কিন্তু ততক্ষণে লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। নূর ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। আবিরদের উদ্দেশ্যে বলল,
“এখন হিরোর কি হবে!”
আবির বলল,
“কি আর হবে! হিরো এখন জিরো হয়ে বের হবে। মানে অন্য কেউ হয়ে বের হবে। দেখো এখুনি বের হবে।”
পরপরই লিফট খুলতেই অন্য একটা লোক বেড়িয়ে এলো। লোকটা বের হতেই নূর তার হাত ধরে ফেলল। চিন্তাগ্রস্ত কন্ঠে বলল,
“হিরো,এটা কি হয়ে গেল! এত কালো হয়ে গেলে কিভাবে তুমি! হিরো থেকে পুরো ডিপজল হয়ে গেছ। এখন কি হবে! কিভাবে ঠিক হবে তুমি! ”
লোকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল পুরো। হতভম্ব কন্ঠে বলল,
“আরে ম্যাডাম কি বলছেন এসব! আমার আবার কি হয়েছে? আর আমাকে কেন ধরে রেখেছেন? ছাড়ুন।”
আবির নূরের কানে কানে বলল,
“চেহারা পাল্টানোর সাথে সাথে আচার-আচরণও পাল্টে যায় ভাবি। দেখোনা আমাদের চিনছেই না৷ ”
নূর গভীর চিন্তাগ্রস্ত কন্ঠে বলল,
“ওও তাই! তাহলে এখন কি করবো? কিভাবে ঠিক করবো হিরোকে?”
“আরে ওইযে দেখ সামনে একটা দোকান৷ ওখানে পুরান মালের বদলে নতুন মাল দেয়। ওখানে গিয়ে বলো এটাকে নিয়ে তোমার ব্রান্ড নিউ নতুন হিরোকে দিতে।”
“তাই! আচ্ছা নিয়ে যাচ্ছি তাহলে।”
বলেই নূর লোকটাকে ওই দোকানের দিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। লোকটা যেন পুরো হতবিহ্বল এদের কাজকর্মে। সে নূরের কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বিভ্রান্ত মুখে বলল,
“আরে হচ্ছেটা কি এসব! কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে। ছাড়ুন বলছি।”
নূর এই পর্যায়ে আবির আর বিহানকে বলল,
“আরে তোমরা দাঁড়িয়ে আছ কেন? হিরোকে শক্ত করে ধরো। ছুটে যাবেতো।”
আবির লোকটাকে ধরে রাখল যাতে ছুটতে না পারে। বিহান আবিরের উদ্দেশ্যে বলল,
“কি করছিস এসব!”
“আরে চিল কর না। একটু মজা করতে দে। তুই ধর ভালো করে।”
আবির আর বিহান মিলে লোকটাকে দুইপাশ থেকে শক্ত করে ধরল। বেচারা লোকটা এবার ভয়ই পেয়ে গেল। আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
“কি করছেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? দেখুন ছেড়ে দিন আমাকে প্লিজ। আমার গার্লফ্রেন্ড আমার জন্য ওয়েট করছে। প্লিজ ছাড়ুন।”
আবির লোকটাকে বেধরম একটা ধমক দিয়ে বলল,
“চুপ, একদম চুপ। আর একটা কথাও বললে একদম এই দোতালা থেকে ছুঁড়ে মারবো। প্রথমত আমি এখনো বেঁচে থাকতে তোর কিভাবে গার্লফ্রেন্ড হতে পারে! এখনতো তোর পোস্ট মোর্টাম করেই ছাড়ব।”
ওরা ধরাধরি করে লোকটাকে সেই দোকানে নিয়ে এলো। দোকানের সেলসম্যানের উদ্দেশ্যে নূর বলল,
“আমাকে এই পূরাণ মালটার বদলে নতুন হিরো দিন।”
সেলসম্যান বেচারা তব্দা খেয়ে গেল। সে বুঝতেই পারলোনা নূর কি বলছে। সেলসম্যান বলল,
“ম্যাম কি বলছেন এসব! হিরো দিবো মানে! এখানে পুরান ডিফেক্টিভ মালের বদলে নতুন মাল দেওয়া হয়।”
নূর ডিফেক্টিভ ওয়ার্ডটার অর্থ বুঝতে না পেরে আবিরকে জিজ্ঞেস করলো ডিফেক্টিভ মানে কি? আবির বলল,
“ভাবি ডিফেক্টিভ মানে নষ্ট বা ভেঙেচুরে গেছে এমন।”
“ওওও তারমানে এই বদলানো হিরোটাকেও আমাদের ভাঙতে হবে। তাহলে উনি নতুন হিরো দিবে৷ উনাকে তাহলে ভাঙো একটু।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। এক কাজ করি ওর হাতটা ভেঙে ফেলি।”
নূর বলল,
“আরে না না হাত ভাঙলে সুচু করবে কি দিয়ে!”
“হ্যাঁ তাও ঠিক।”
“তাহলে ওর পা ভাঙি।”
“পা ভাঙলে কুতকুত কিভাবে খেলবে!”
“তাহলে কি ভাঙবো ভাবি? ”
“এক কাজ করি। টস করি আমরা। যেটা উঠবে সেটা ভাঙবো।”
“বাহ! ভাবি বাহ! এত বুদ্ধি নিয়ে ঘুমান কিভাবে! ”
এদের এসব কথাবার্তায় বেচারা লোকটার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার জো। বেচার এবার কাঁদো কাঁদো করুন সুরে বলল,
“কি বলছেন এসব আপনারা! আমাকে কি প্লাস্টিকের বদনা পেয়েছেন! হাত ভাঙবেন, পা ভাঙবেন! দেখুন দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ।”
নূর এবার ধমকের সুরে বলল,
“এই একদম চুপ, দেখছ না লটারি করছি! একদম ডিস্টার্ব করবে না।”
লোকটা এবার কেঁদেই ফেলল এদের অত্যাচারে। তখনই হঠাৎ একটা মেয়ে এসে বলল,
“সোহেল! তুমি এখানে! আমি তোমার জন্য সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি আর তুমি এখানে অন্য মেয়ের সাথে ঘুরছ!”
নূর তখন মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলল,
“আরে ও সোহেল না। আমার হিরো। আমার বিয়ে খেলার বর। এখন একটু বদলে গেছেতো তাই পাল্টাতে এসেছি আমরা।”
মেয়েটি তেতে উঠে বলল,
“কিহ! তুমি বিয়েও করে ফেলেছ! ইউ চিটার! আজকের পর আর নিজের কুশ্রী চেহারা আমাকে দেখাবেনা।”
বলেই মেয়েটি রাগে হনহন করে বেড়িয়ে গেল। লোকটা তখন আরও জোরে জোরে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“এত টাকা খরচ করে একটা গার্লফ্রেন্ড পটাইছিলাম। তাও চলে গেল।”
এসব নাটকের মাঝেই আদিত্য সেখানে এসে উপস্থিত হলো। এসব দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি হচ্ছে এসব এখানে! তোরা এখানে কি করছিস?”
আদিত্যকে দেখে নূর খুশি হয়ে তার কাছে দৌড়ে গিয়ে বলল,
“আরে হিরো তুমিতো দেখছি ঠিকই আছ।”
“ঠিক আছি মানে! আমার আবার কি হবে?”
অবস্থা বেগতিক হবে বুঝতে পেরে আবির চিপাগলি খুঁজে পালানোর চেষ্টা করল। আদিত্য তা দেখেই বলে উঠল,
“এই দাঁড়া। এসব কান্ড তোরই তাইনা!”
আবির তৎক্ষনাৎ দুনিয়ার সবচেয়ে ইনোসেন্ট মুখটা বানিয়ে ফেলল। যেন এইমাত্র ভূমিষ্ট হলো পৃথিবীতে। ফিচেল হেঁসে বলল,
“কে আমি! আমি এসব করতে পারি নাকি! আমার তিন পুরুষও এমন কাজ করতে পারে না। তুইও না, ভোলাভালা পাইয়া সবসময় খালি আমারে বকোস। যা খেলমুই না আর।”
বলেই আবির নেকা ভঙ্গি করে অন্য দিকে চলে গেল। আদিত্য স্মিথ হেঁসে বলল,
“ড্রামাবাজ।”
নূর খুশিমনে আদিত্যকে বলল,
“ভালো হয়েছে তুমি এসেছ। তুমি আর যেওনা ওই যাদুর ঘরে।”
আদিত্য মুচকি হেঁসে বলল,
“আমি আমার এঞ্জেলকে ছেড়ে কোথাও যাবোনা।”
আদিত্য নূরের হাত ধরে বেড়িয়ে এলো দোকান থেকে। শপিং শেষে ফিরতে নিলেই হঠাৎ নূর কাউকে দেখে উৎসুক কন্ঠে ডেকে উঠল,
“আরে ঝুমু!”
নূরের ডাকে আদিত্যও কৌতুহলী হয়ে তাকালো নূরের তাকানো বরাবর। দেখল সামনে একটা সেলসগার্লকে ডাকছে ও।আদিত্য প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল,
“তুমি চিনো ওকে?”
নূর বলল,
“আরে ও ঝুমু, আমার বোন।”
নূর দৌড়ে এগিয়ে গেল মেয়েটার দিকে। আদিত্যও গেল ওর সাথে। নূর মেয়েটির কাছে এসে বলল,
“আরে ঝুমু, তুই এখানে!”
নূরের ডাকে মেয়েটি এবার ফিরে তাকালো। নূরকে দেখে তারও চোখে মুখে বিস্ময়। সে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলল,
“পাগলী! তুই এখানে কি করছিস!”
আদিত্যর ভীষণ রাগ হলো নূরকে এভাবে পাগলী বলে ডাকায়। নূর খুশিমনে বলল,
“আরে আমিতো এখানে হিরোর সাথে এসেছি। এইযে হিরো, আমার বিয়ে খেলার বর।”
নূরের কথায় ঝুমুর হতবাক চোখে তাকালো আদিত্যের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলো। যেন কোনো অবিশ্বাস্য কিছু দেখছে সে। তারপর বলল,
“আপনি কি সত্যিই পাগলীর হাসব্যান্ড।”
আদিত্য চোয়াল শক্ত করে বলল,
“ফাস্ট অফ অল, ওর একটা নাম আছে। সেই নাম ধরেই ডাকবেন।এক্সুলি নামও না, আই থিংক আপনি ওর ছোটবোন। তাই আপু বলে ডাকবেন। একবার বললাম, বারবার বলবো না৷ আর হ্যাঁ, আমি নূরের হাসব্যান্ড সাদমান শাহরিয়ার আদিত্য।”
ঝুমুরের মুখে কেমন কালো ছায়া ছেয়ে গেল।কারণ সে বুঝতে পারলো সেদিন এই লোকটার সাথেই তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। যে এখন ওর বোনের হাসব্যান্ড হয়েছে। ঝুমুর কিছুটা কালো মুখ করেই বলল,
“আম সরি আসলে সেদিন….
ঝুমুরের কথার মাঝেই থামিয়ে দিয়ে বলল,
” দ্যাট ডাজেন্ট ম্যাটার টু মি। ইনফ্যাক্ট দ্যাটস দ্য বেস্ট থিংক হ্যাপেন্ড ইন মাই লাইফ।”
ঝুমুরের মুখটা যেন আরও বেশি কালো হয়ে গেল। নূর বলল,
“এই ঝুমুর চলনা আমাদের সাথে৷ আমাদের অনেক বড়ো বাড়ি। তোকে দেখাবো চল।”
আদিত্য নূরের উদ্দেশ্যে বলল,
“নূর উনি এখানে চাকরি করছেন। এভাবে হঠাৎ করে যেতে পারবেন না। অন্য সময় আসবে।”
আদিত্য বিহানকে ডেকে বলল,
“বিহান,উনাকে আমাদের বাসার ঠিকানাটা দিয়ে দাও। সময় করে আসবে নূরের সাথে দেখা করতে।”
এরপর নূরের হাত ধরে বলল,
“এঞ্জেল চলো, এখন আমাদের যেতে হবে।”
নূর যেতে যেতে ঝুমুরের উদ্দেশ্যে বলল,
“আমাদের বাড়িতে আসিস ঝুমু হ্যাঁ। অনেক মজা হবে।”
ঝুমুর জোরপূর্বক হাসলো শুধু। আদিত্য নূরকে চলে গেল। ঝুমুর চেয়ে রইল তাদের যাওয়ার পানে। দেখল আদিত্য ওদের সেই পাগলীকে কেমন রাজরানীর মতোন মাথায় করে রেখেছে। তাদের পেছনে দুজন বডিগার্ড একগাদা শপিংয়ের ব্যাগ উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। খুশির ঝলক নূরের চোখে মুখে। এটাতো হয়তো তারও হতো। যদি না সে ভুল ডিসিশন নিতো।

চলবে……

(আপনাদের সকলের প্রিয় চরিত্র আবিরকে নিয়ে লেখা ইবুক। নিচে বিস্তারিত।)

“কোমড় দেখিয়ে ইমপ্রেস করতে চাস আমাকে! ওয়েল, চেষ্টাটা ভালোই ছিলো। আই লাইক ইউর এপ্রোচ। এটা নতুন কিছু না। আমাকে দেখে মেয়েরা তাদের আকর্ষণীয় পার্ট দেখিয়ে আমাকে দূর্বল করার প্রচেষ্টা সর্বক্ষণই করে থাকে। এতে দোষের কিছু নেই। তুইও তাই করতে চাইছিস। বাট বুকে বিশাল একটা পাথর চেপে অতি দুঃখের সহিত বলতে হচ্ছে যে, তোর এই প্রচেষ্টা একেবারেই বিফল গেছে। ইট ডাজেন্ট ওয়ার্ক অন মি। আরে দেখানোর জন্য আগে ঠিকঠাক একটা কোমড়তো বানাতি! কোথায় আমার গার্লফ্রেন্ডদের হট হট মাখনের মতো স্লিম কোমড়।আর কোথায় তোর ঠান্ডা বাসি কোমড়। উল্টো তোর এমন অরুচিকর কোমড় দেখে বমি এসে যাচ্ছে আমার।”
রাগে দুঃখে সারা শরীর রি রি করে উঠলো আহানার। এই বিশ্ব অসংভ্য লোকটা এখানে আছে জানলে সে আসতোই না। চাচাত বোন হিয়ার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে শাড়ি পড়ে বের হয়েছিল সে। যদিও এটা হিয়ার জোরাজুরিতে পড়েছে। নাহলে শাড়ি পড়া তার পছন্দ না। কারণ সে শাড়ি ঠিকমতো সামলাতে পারে না। বারবার শুধু মনে হয় কোন দিক দিয়ে হয়তো তার শাড়ি খুলে যাচ্ছে। আজও তেমনই হচ্ছিল। একদিকে শাড়ি ঠিক করছেতো মনে হচ্ছে অন্য দিক দিয়ে সরে যাচ্ছে। এভাবেই শাড়ির সাথে যুদ্ধ করতে করতে সে হলুদের আয়োজনের কাছে আসতে নেয়। তখনই সামনে পড়ে এই অসহ্যকর লোকটা। যার জন্মই হয়েছে হয়তো একমাত্র আহানাকে জ্বালানোর জন্য। বখাটে ছেলেদের মতো বাইকের উপর পায়ের উপর পা তুলে আয়েসি ভঙ্গিতে শুয়ে থেকে সিগারেটের ধুঁয়া ছাড়ছিলেন জনাব। আহানাকে দেখেই সে ফট করে একলাফে নিচে নেমে দাঁড়ায় আহানার সামনে।পড়নে তার এ্যাশ কালারের টিশার্টের উপর কালো লম্বা ঢিলাঢালা ধরনের জ্যাকেট আর কালো প্যান্ট। তার ড্রেসিং সেন্স সর্বদাই আহানার কাছে উদ্ভট আর উগ্র মনে হয়। কানের নিচ পর্যন্ত লম্বা লম্বা চুল। যা কখনো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে থাকে, আবার কখনো উপর থেকে অর্ধেক চুল ঝুঁটি করে বেঁধে রাখে। হাতের সবগুলো আঙুলে অদ্ভুত ডিজাইনের সব আংটি আর দড়ির মতো একগাদা ব্রেসলেট হাতে ভরা। এটা নাকি তার রকস্টার লুক। এমনটাই বলে সে।আবির আহানার সামনে দাঁড়িয়ে চোখের রাউন্ড শেইপের কালো চশমাটা হাতের দুই আঙুল দিয়ে চোখের উপর থেকে খানিকটা নামিয়ে নাকের ডগায় ঠেকায়। তারপর ঘাড় বাঁকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আহানার নিচ থেকে উপর পর্যন্ত পুরোটা স্ক্যান করতে থাকে। তা দেখে আহানা কিছুটা ভড়কে যায়। সে কিছু বলবে তার আগেই আবির তার মহান উক্তি গুলো বলা আরম্ভ করে দেয়। যা বরাবরের মতোই আহানার রাগে শরীর জ্বলিয়ে দেয়। আহানা আজ পর্যন্ত ভেবে পায়না একটা এতটা অসভ্য আর অসহ্যকর কিভাবে হতে পারে! প্রতিবারই আবির অসভ্যতায় নিজেই নিজের রেকর্ড ভেঙে দেয়। আহানা রাগে কিড়মিড় করে আবিরের কথার প্রতিত্তোরে বলল,”একদম বাজে কথা বলবেন না কিন্তু। আপনাকে কেন কোমড় দেখাতে যাবো আমি! আপনাকে কোমড় দেখাতে যাবে আমার জুতো।”
“তো কাকে দেখাতে কোমড় বের করেছিস! অন্য ছেলেদের! ”
“যাকে খুশি দেখাই আপনার এত মাথা ব্যাথা কেন?”
“আরে কি বলিস! এটাতো আরও ভয়াবহ ব্যাপার। তোর এমন বাসি,পঁচা কোমড় দেখে আমাদের যুবসমাজের ভেতরেতো ভুল ধারণা পয়দা হবে তাইনা! আমি নাহয় শক্ত মনের দেখে তোর এই কোমড় দেখেও সহ্য করে গেলাম। কিন্তু ওই মাছুম যুবসমাজ তোর এই কোমড় দেখে নির্ঘাত হার্ট করে মারা যাবে। যারা বেঁচে থাকবে তারাও ডিপ্রেশনে চলে যাবে। কোমড়ের উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যাবে তাদের। নিজের বউয়ের কোমড়ও দেখতে চাইবে না। ধীরে ধীরে যুবসমাজ শেষ হয়ে যাবে। আর আমার মতো দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে যুবসমাজের এমন ক্ষতি আমি কিছুতেই হতে দিবোনা। কারণ যুবক না থাকলে যুবতীদের কি হবে? যুবকহীনা তারাতো অপূর্ণই রয়ে যাবে।”

চলবে।