#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-৮
®মেহরুমা নূর
★দেখতে দেখতে প্রায় মাস পেরুতে চলল আদিত্য-নূরের বিবাহিত সময়কালের। নূরের আবহে আদিত্যর ভুবন রংধনুর সাত রঙের চেয়েও রঙিন। তার আঁধারে ঘেরা একাকিত্ব জীবনে যেন নূরময় আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে। প্রশান্তিময় আবেশে ভরে উঠেছে আনাচকানাচ। আগে এই বাড়িটা শুধু একটা কংক্রিটের ইমারত বৈ আর কিছুই ছিলো না। তবে এখন এটা সুখের বারিধারা হয়েছে। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে যখন আদিত্য বাসায় ফিরে নূরের হাসিমাখা নিস্পাপ মুখখানা দেখে তখন আকাশ ভেঙে যেন তার উপর প্রশান্তির শীতল বর্ষণ হয়। জীবন বুঝি এতদিনে জীবিত মনে হচ্ছে তার। অন্যদিকে নূরও এইকয়দিনে আদিত্যর সাথে পুরোপুরি মিশে গেছে। আদিত্য এখন সবচেয়ে পছন্দের ব্যাক্তিতে সামিল হয়ে গেছে। হবেই না বা কেন! আদিত্যের অসামান্য যত্ন আর ভালোবাসায় নূর কিভাবেই বা তাকে পছন্দ না করে থাকতে পারে। এখনতো আদিত্যকে ছাড়া ভালোই লাগে না। সে যতক্ষণ অফিসে থাকে ততক্ষণ নূরের সময় কাটে না। যদিও আদিত্য প্রতি ত্রিশ মিনিট পরপরই ফোনে কথা বলে নূরের সাথে। নূরের জন্য আলাদা ফোন কিনে দিয়েছে সে। কিভাবে ফোন করতে হয় সেটাও শিখিয়ে দিয়েছে। আর নূরও সেটা পেয়ে একটু পরপরই আদিত্যকে ফোন করে। আদিত্য হাজার ব্যস্ত হলেও নূরের ফোন কখনোই মিস করেনা সে। নূর ফোন করে দুনিয়ার হাবিজাবি প্যাঁচাল পারবে আর আদিত্য হবে তার একমাত্র অনুগত শ্রোতা। এভাবেই কাটছে তাদের খুশিময় প্রহরগুলো।
অফিস থেকে মাত্র ফিরেছে আদিত্য। গাড়ি পার্ক করে দ্রুত বাসার দরজার দিকে এগুলো সে। আজকাল যত দ্রুত সম্ভব সে বাসায় চলে আসে। প্রাণভোরটাকে বেশিক্ষণ না দেখে যে মন ব্যাকুল হয় তার। তাইতো যত জলদি পারে কাজ শেষ করে চলে আসে সে। আর আসার সময় রোজ নূরের জন্য কিছু না কিছু গিফট নিয়ে আসে। সেটা পেয়ে নূরের মুখে খুশি ভাসে সেটাই আদিত্যর সর্বোচ্চ উপার্জন। সাথে বোনাস হিসেবে নূরের কাছ থেকে রিটার্ন গিফটও পেয়ে যায় সে। নূর এখন সেটা নিজে থেকেই দেয়। আজও তাই নূরের জন্য কিছু নিয়ে এসেছে আদিত্য। দরজায় এসে বেল বাজালে একটু পর জমিলা এসে দরজা খুলে দিলো। জমিলাকে দেখে হালকা বিভ্রান্ত চোখে তাকালো আদিত্য। কারণ রোজ এই টাইমে নূর নিজেই দৌড়ে আসে। আদিত্যের গাড়ির হর্ণ শুনলেই সে দৌড়ে আসে দরজার কাছে। কিন্তু আজ তাকে না দেখে একটু কপাল কুঁচকালো আদিত্যের। জমিলাকে জিজ্ঞেস করল,
“নূর কোথায়?”
“বউমনিতো রুমেই আছে। দুপুরের পর থেকে আর বের হয়নি। একবার গিয়ে দেখলাম শুয়ে আছে। তাই আর ডিস্টার্ব করিনি।”
আদিত্যের কপালে চিন্তার ভাজ পড়ল। হালকা উদ্বেগী স্বরে সে বলল,
“এখনো শুয়ে আছে! শরীর খারাপ করেনিতো! আচ্ছা আমি দেখছি।”
আদিত্য দ্রুত পায়ে নিজের রুমের দিকে এগুলো। তবে রুমে ঢুকে নূরকে কোথাও দেখতে পেল না।ওয়াশরুমেও নেই। ব্যালকনির দিকে যেতে যেতে আদিত্য নূরের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে বলতে লাগল,
“নূর, মাই এঞ্জেল। কোথায় আমার পরিটা? দেখ তোমার জন্য কি এনেছি! ”
কিন্তু ব্যালকনিতেও নূরকে না দেখে আদিত্যের উদ্বেগের মাত্রা বাড়ল। সে রুমের ভেতর এসে দরজার দিকে যেতে লাগল নূরকে খুঁজতে। হঠাৎ গুনগুন করে হালকা কান্নার সুর কানে এলো আদিত্যের। পা থেমে গেল আদিত্যের। এদিক ওদিক তাকিয়ে সে এই সুরের উৎস খুঁজতে লাগল। তার মনে হলো কাবার্ডের কোনা থেকে আসছে শব্দ। আদিত্য সেদিকে এগিয়ে গেল। কাবার্ডের কোনায় নজর যেতেই আৎকে উঠল সে। শরীরে সমস্ত লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল তার আতঙ্কে। কাবার্ডের কোনায় নূর জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। কাঁদছে আর কাবার্ডের সাথে নিজের মাথা নিজেই ঠোকাচ্ছে। মাথা বারি খেতে খেতে কপাল ফেটে রক্তও বের হয়ে গেছে। তবুও বারি দিয়েই যাচ্ছে সে। নূরের এমন ভয়ানক দৃশ্য দেখে আদিত্যর হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল। যেন জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্য দেখছে। নূরের জন্য আনা গিফটটা ঠাস করে পড়ে গেল হাত থেকে। আতঙ্কিত কন্ঠে আদিত্য উত্তেজিত হয়ে উচ্চস্বরে,”নূরররর…” বলে এক ছুটে গিয়ে বসল নূরের সামনে। দুই হাতে নূরের মাথাটা ধরে কম্পিত,আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
“নূ…নূর, সোনা আমার, কি হয়েছে তোমার! এমন করছ কেন?”
নূরের কানে আদিত্যর কথা পৌঁছাল বলে মনে হলো না। সে আদিত্যর হাত সরিয়ে দিয়ে আবারও একই কাজ করতে লাগল আর দাঁত কিড়মিড়িয়ে কাঁদতে লাগল। আদিত্য আবারও নূরকে সরিয়ে এনে শক্ত করে মাথাটা ধরে করুন সুরে বলল,
“এই কলিজাটা, প্লিজ এমন করিসনা। কি হয়েছে বলনা আমাকে! কেন এমন করছিস?”
আদিত্য জলদি পকেট থেকে রুমাল বের করে নূরের কপালের রক্ত মুছে দিতে দিতে বলল,
“ইশশ! কত র,ক্ত বের হচ্ছে! কি অবস্থা করে ফেলেছে! কি করবো আমি এখন! ”
নূর হঠাৎ আদিত্যকে দুই হাতে সজোরে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো। তারপর আবারও একই কাজ করতে লাগল। নূরের অস্বাভাবিক আচরণে আদিত্যর অন্তর আত্মা কাঁপছে। তার মিষ্টি মাছুম এঞ্জেলটার হঠাৎ কি হয়ে গেল! আদিত্য আবারও নূরকে আটকালো। এবার নূরকে ওখান থেকে সরিয়ে এনে দুই হাতে শক্ত করে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে রাখল। বেদনার্ত কন্ঠে বলল,
“লক্ষী সোনা আমার, আমার কথা শোনো। এমন করোনা। তোমার হিরোকে বলো কি হয়েছে তোমার? এমন কেন করছ?”
নূর যেন কোনো কিছু শোনা,বোঝার অবস্থাতে নেই। সে কেমন অস্বাভাবিক ভাবে দাঁত কিড়মিড় কাঁদছে আর আদিত্যর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়ানোর দুই হাতে ঢেলে সরিয়ে দিতে চাচ্ছে আদিত্যকে। তবে আদিত্য আর ছাড়ার ভুল করবেনা৷ সে জোর খাটিয়ে শক্ত করে ধরে রেখে নূরের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। নূর যখন জোর খাটিয়ে পারলোনা আদিত্যের সাথে তখন সে নিজের শারীরিক যন্ত্রণার তোড়ে আদিত্যর বুকে সজোরে কামড় দিয়ে ধরল। সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সবগুলো দাঁত গেঁথে দিলো আদিত্যের বুকের চামড়ার ভেতর। ব্যাথায় আদিত্যর মুখমণ্ডল লাল হয়ে উঠল। তবুও সে ছাড়লোনা নূরকে। চোখ বুজে দাঁতে দাঁত চেপে সব সয়ে গেল সে। তার এঞ্জেলকে রক্ষা করতে এরচেয়ে হাজার, লাখ গুণ বেশি ব্যাথাও সইতে রাজি সে।কিন্তু এঞ্জেলটাকে এভাবে দেখতে রাজি না সে। ভেতরটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে যেন তার। কতক্ষণ পর হঠাৎ আদিত্য খেয়াল করল নূরের শরীর কেমন ছেড়ে দিয়েছে। ঠাস করে চোখ খুলে তাকালো আদিত্য। দুই হাতে নূরের মাথাটা সামনে আনতেই দেখলো নূরের অচেতন মাথাটা হেলে পড়ল হাতের মাঝে। আদিত্যর পুরো পৃথিবী যেন থমকে গেল মুহূর্তেই। পাথর হলো চোখের নজর। আদিত্য কাঁপা কাঁপা হাতে নূরের গাল আলতো ঝাঁকিয়ে আতঙ্কিত গলায় বলল,
“নূ…নূর, মাই এঞ্জেল। তাকাও প্লিজ। এই এঞ্জেল! কথা বল না! ডোন্ট ডু দিস টু মি, প্লিজ!”
আদিত্য চিল্লিয়ে ডাকল,
“বিহান….”
কিছুক্ষণ পরই বিহান দৌড়ে এলো আদিত্যের রুমে। এসেই ওদের ওভাবে দেখে বলল,
“কি হইচে আদি!”
আদিত্য বিহানের দিকে তাকিয়ে করুন ধরা গলায় বলল,
“বিহান, নূর! আমার নূর। দেখনা আমার এঞ্জেলটার কি হয়ে গেছে! কথা বলছেনা কেন ও?”
বিহান আদিত্যর অবস্থা বুঝতে পেরে বলল,
“আদি চিন্তা করিছ না।আমি অহনি ডাক্তার ডাকতাছি। কিচ্ছু হইবো না ভাবির। একদম চিন্তা করিছ না।
__
ডাক্তার নূরের চেক-আপ করছে। কপালে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। আদিত্য নূরের মাথার পাশেই বসে আছে। কিছু সময়ের ব্যবধানেই কেমন রক্ত,শূণ্য ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তার চেহারা। তার রঙিন ভুবন হঠাৎই বিবর্ণ হয়ে গেছে।তার হাসিখুশি প্রাণবন্ত নূরের এই অচেতন মুখটার চেয়ে বেশি ভয়ংকর বুঝি আদিত্যর জন্য আর কিছুই নেই। তার সহ্যশক্তির বাহিরে এসব। চেক-আপ শেষে আদিত্য জানতে চাইলো কি হয়েছে নূরের। ডাক্তার বলল,
“দেখুন এখনই সিওর কিছু বলতে পারছিনা। আগে উনার সম্পর্কে সবটা জানতে হবে আমাকে।”
আদিত্য তখন ডাক্তারকে নূর মানুষিক ভারসাম্যহীন।নূরের সাথে কতদিন হলো সম্পর্ক তাপ জানাল সব। তা শুনে ডক্টর বলল,
“হুম বুঝলাম, তাহলে বোধহয় উনার প্যানিক অ্যাটাক হয়েছিল। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা হলে অনেক রুগীই এমন করে। আর আমার মতে এটা উনার সাথে আগেও ঘটেছে। তবে উনার এক্সাক্টলি কি ধরনের ডিজিজ আছে। মানে কি কি সমস্যা তার সাথে এগুলো জানতে কিছু পরিক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে।আপাতত আমি ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছি। কিছুক্ষণ পরই জ্ঞান ফিরব। আপনি এক কাজ করুন উনাকে নিয়ে হসপিটালে আসুন। তারপর ভালো করে পরিক্ষা নিরীক্ষা করে বোঝা যাবে সমস্যা কি। আর হ্যাঁ, উনার কোনো মেডিকেল কাগজপত্র থাকলে সেগুলোও নিয়ে এসেন। তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে।”
“জি ডক্টর, আমি কালই নিয়ে আসবো ওকে।”
ডক্টর চলে যেতেই আদিত্য বিহানকে বলল,
“বিহান,নূরের বাড়িতে ফোন করে বল ওকে আগে যে ডাক্তার দেখিয়েছে সেসব রিপোর্ট যেন মেইলে পাঠিয়ে দেয়।”
বিহান ফোন দিলো নূরের বাড়িতে। তাদের সাথে কথা শেষ করে আদিত্যকে বলল,
“আরে ওরাতো নাকি ভাবিরে কোনো ডাক্তারই দেখায় নাইক্কা। তাইলে কাগজপত্র কই থাইকা পাইবো!”
রাগ হলো ভীষণ আদিত্যর। কেমন লোক এরা! মেয়েকে আজ পর্যন্ত কোনো ডাক্তার দেখানও জরুরী মনে করেনি! তাও এমন অ্যাটাক জেনেও! তাদের কি বলবো,আমার নিজেরইতো নূরকে ডাক্তার কথা মাথায়ই আসেনি এখনো। হয়তো নূরের মাঝে ও কোনো কমতিই পায়নি তাই৷ নূর যেমন তেমনই সবার থেকে ভালো। তাই হয়তো ডাক্তারের কথা খেয়াল আসেনি ওর মাথায়। তবে এই ভুল আর করবেনা সে। কালই নূরকে নিয়ে যাবে হসপিটালে। তাকে সুস্থ করে তুলবে সে। নূরের সামন্যতম কষ্টও সে রাখবেনা। পুরোপুরি সুস্থ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করবে সে।
__
অন্ধকার রাস্তায় হাঁটছে হিয়া। গার্মেন্টস থেকে বের হতে হতে অনেক দেরি হয়ে গেছে আজ। ওভারটাইম করছিলো সে। টাকার অনেক প্রয়োজন যে তার। নাহলে বাবার হার্টের অপারেশন করাবে কিভাবে! সে ছাড়া আর কেই বা আছে! কিন্তু এই রাস্তাটা মোটেও ভালো না৷ যত মদখোর, গাঁজাখোরদের আড্ডা হয় এই রাস্তার মোড়ে। তাইতো ভয় হচ্ছে হিয়ার। যদিও সে মুখে ওড়না পেঁচিয়ে মুখ ঢেকেই বের হয়। শুধু চোখ দেখা যায়। তবে মানুষ রুপি হায়েনাদের কাছে সুরক্ষা পাওয়ার জন্য এই উপায় খুব একটা কার্যকারী না। এই সমাজে মেয়ে মানুষের স্বাধীন ভাবে চলা যে খুব কঠিন। তা এই দুই বছরে খুব হারে হারে টের পেয়েছে হিয়া। ভয়ে ভয়ে খুব দ্রুত পা ফেলে রাস্তাটা পার হতে চাচ্ছে সে। বাসায় যাওয়ার জন্য যে এই রাস্তা ছাড়া আর কোনো রাস্তাও নেই। তাই এই রাস্তা দিয়েই যেতে হবে। মনে মনে দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে দ্রুত পা ফেলে যেতে লাগল হিয়া। তবে শেষপর্যন্ত শেষ রক্ষা হলোনা বুঝি। যে ভয় পাচ্ছিল সেটাই হলো। চারপাঁচ টা বোখাটে মদখোরের চোখে পড়ে গেল হিয়া৷ রাস্তার পাশে আড্ডা দিচ্ছিল তারা। হিয়ার যাওয়া দেখে এগিয়ে আসতে নেয় ওর দিকে। নানানরকম কুরুচিপূর্ণ কথা বলতে থাকে। হিয়া ভয়ে আৎকে ওঠে। মনে সাহস জুগিয়ে প্রায় দৌড়ের মতো করে হাঁটতে থাকে সে। তবে কাজ হয়না। বদমাইশ গুলো তার পিছু নেয়। তাকে ধরতে উদ্যত হয়৷ নিজেকে বাঁচাতে এবার হিয়া ছুটে পালায়। প্রাণপণে দৌড়ায় নিজেকে রক্ষা করতে এই মানুষ রুপি নরপি,শাচদের হাত থেকে। বদমাইশগুলোও দৌড়ায় হিয়াকে ধরতে। হিয়া জাম হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছে আর মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া চাইছে তাকে যেন এই বিপদ থেকে রক্ষা করে।একবার পেছনে তাকিয়ে বদমাশগুলোকে দেখছে আবার সামনে তাকিয়ে দৌড়াচ্ছে।এভাবে পেছনে তাকিয়ে দৌড়াতে গিয়ে হঠাৎ সামনে থেকে আসা কারো সাথে ধাক্কা খেল সে। মাথা গিয়ে ঠেকল সামনের ব্যাক্তির বুকে আর হাত দুটো পড়ল আগন্তুকের দুই কাঁধে। হাঁপাতে হাঁপাতে ভয়ে জর্জরিত, ঘামে ভেজা মুখ আর লাল চোখ দুটো তুলে তাকালো উপরে। দেখতে পেল এক যুবকের প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি। যা হঠাৎই কেমন বিস্ময় আর একাগ্রতায় পরিবর্তন হয়ে গেল। অপলক দৃষ্টি যেন। হিয়া ডুবতি নদীতে যেন বাঁচার এক টুকরো অবলম্বন আশা করল। হয়তো এই লোকটা তাকে বাঁচাতে পারে এই ভাবনায় মনে একটুখানি আশার উন্মোচন হলো। হিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে করুন মিনুতির সুরে বলল,
“প্লিজ বাঁচান আমাকে। ওই বদমাশ গুলো আমার ক্ষতি করতে চায়। প্লিজ দয়া করে সাহায্য করুন আমার।”
হিয়ার কথায় বিহানের ঘোর কাটল। আদিত্যের দেওয়া একটা কাজে এদিকে এসেছিল বিহান। রাস্তায় হঠাৎ মেয়েটির সাথে এভাবে ধাক্কা লাগায় প্রথমে অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় সে। বিহান মেয়েলী ব্যাপারে অনেকটা শায় স্বভাবের। মেয়েদের থেকে সবসময় দশ হাত দূরেই থাকে।তাই এভাবে একটা মেয়ের সাথে হঠাৎ ধাক্কা সে ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তবে মেয়েটা যখন দৃষ্টি তুলে তাকালো তার পানে তখন ওই চোখের অতলে যেন সহসাই ডুবে গেল সে। ভুলে গেল সকল ক্রিয়াকলাপ। ওই ডাগরডোগর আঁখি, ভয়ার্ত চাহুনি, ভেজা চোখের পাপড়িগুলো সব যেন প্রমত্ত সিন্ধু। বিহান হুঁশ হারা হয় সহসা। অজানা কোনো অনুভূতির নাড়া লাগে তার ঘুমন্ত হৃদয়ের দুয়ারে। তবে মেয়েটির কথায় ঘোর কাটে তার। ভ্রু,কপাল কুঁচকে ঘাড় বাঁকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটির পেছনে ছুটে আসা লোকগুলোর দিকে তাকায় সে। বুঝতে পারে ঘটনার সারমর্ম। বদমাশগুলো ততক্ষণে হিয়ার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে গেছে। একজন বিহানের উদ্দেশ্যে বলল,
“ওই ছ্যামড়া, বাঁচতে চাইলে মেয়েটাকে রেখে যা ফুট এখান থেকে। নাহলে ফালতু হাত পা ভাঙা যাবে।”
বিহান যেন চরম একটা মজাদার কৌতুক শুনল এইমাত্র। হাসতে মন চাইল খুব করে। তবে আপাতত নিজের হাসি দমিয়ে রেখে মুখে অসহায় একটা ভাব আনল। নরম গলায় বলল,
“না না ভাইয়েরা, আমারে মাইরেন না।আর উনার লগেও কিছু কইরেন না।দেহেন ভাইয়েরা এইটা করন ঠিক না৷ এইটা ভালা কাজ না। বেচারিরে যাইতে দেন।”
বলতে বলতে হিয়াকে পাশ কাটিয়ে ছেলেগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল বিহান। বিহানের কথায় ছেলেগুলো হো হো করে হাসতে লাগলো। বিহান তখন হিয়ার অগোচরে প্যান্টের দুই পাশে গুঁজে রাখা পিস্তলের কিছু অংশ বের করে দেখাল ছেলেগুলোকে। হাসি মুহুর্তেই থেমে গেল তাদের। ভয় ছেয়ে গেল সবার চোখে। বিহান চোখের ইশারায় বলল যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে। ছেলেগুলোও নিজেদের জানের ভয়ে পালালো ওখান থেকে। হিয়া কিছুটা অবাক হলেও আপাতত তার মান রক্ষা পেয়েছে এটাতেই জানে পানি এলো তার। হিয়া বিহানের সামনে গিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলল,
“কি বলে ধন্যবাদ দেবো জানা নেই। আপনি আজ প্রাণে বাঁচালেন।”
বিহান বলল,
“আরে না না আমি কি করলাম।আসলে উনারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে তো তাই নিজে থেকেই চলে গেছে।”
“সে যাই হোক, হয়েছেতো আপনার কারণেই। আমার জন্যতো আপনিই আজকে আমার রক্ষাকারী। আপনার এই উপকার আমি কখনো ভুলবনা।”
বিহান অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“কখনো ভোলার দরকারও নেই। এই উছিলায় নাহয় আমাকেও মনে করবেন।”
তারপর বলল,
“আইচ্ছা চলুন আপনাকে আপনার বাছা পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছি। এদের কোনো ভরসা নাইক্কা।”
“জি।”
দুজন পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। বিহানের খুব ইচ্ছে করছে আবারও মেয়েটির চোখ দুটোকে দেখতে। কিন্তু এভাবে সরাসরি তাকানোটাও শোভনীয় না। হাঁটতে হাঁটতে বিহান বলল,
“আমার নাম বিহান।”
মেয়েটিও আস্তে করে বলল,
“আমার নাম হিয়া। ****গার্মেন্টসে চাকুরী করি।”
মেয়েটির কন্ঠও সুন্দর। কেমন নতুন এক আবহ কাজ করছে বিহানের মাঝে। যা আগে কখনো হয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা হিয়ার বাড়ির সামনে চলে। হিয়া বলল,
“আমার বাসা চলে এসেছি। আবারও অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আসি এখন।”
বিহানের খুব বলতে ইচ্ছে হলো আবার কি কখনো দেখা করতে পারবো? তবে তা আর বলা হলোনা। হিয়া চলে গেল বাসার ভেতর। বিহান তাকিয়ে রইলো সে পানে। এ কোন মায়ার টানে জড়াল সে। এসব তো তারজন্য না। তবে কেন এ মোহ এলো তার জীবনে।!
চলবে…
(দেখছেন আজ গ্যাপ দিলাম না। তাও কেও ভালোবাসে না। একটু ভালো ভালো কমেন্টও করে না। 🤧)
আরও পড়ুন,
“কোমড় দেখিয়ে ইমপ্রেস করতে চাস আমাকে! ওয়েল, চেষ্টাটা ভালোই ছিলো। আই লাইক ইউর এপ্রোচ। এটা নতুন কিছু না। আমাকে দেখে মেয়েরা তাদের আকর্ষণীয় পার্ট দেখিয়ে আমাকে দূর্বল করার প্রচেষ্টা সর্বক্ষণই করে থাকে। এতে দোষের কিছু নেই। তুইও তাই করতে চাইছিস। বাট বুকে বিশাল একটা পাথর চেপে অতি দুঃখের সহিত বলতে হচ্ছে যে, তোর এই প্রচেষ্টা একেবারেই বিফল গেছে। ইট ডাজেন্ট ওয়ার্ক অন মি। আরে দেখানোর জন্য আগে ঠিকঠাক একটা কোমড়তো বানাতি! কোথায় আমার গার্লফ্রেন্ডদের হট হট মাখনের মতো স্লিম কোমড়।আর কোথায় তোর ঠান্ডা বাসি কোমড়। উল্টো তোর এমন অরুচিকর কোমড় দেখে বমি এসে যাচ্ছে আমার।”
রাগে দুঃখে সারা শরীর রি রি করে উঠলো আহানার। এই বিশ্ব অসংভ্য লোকটা এখানে আছে জানলে সে আসতোই না। চাচাত বোন হিয়ার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে শাড়ি পড়ে বের হয়েছিল সে। যদিও এটা হিয়ার জোরাজুরিতে পড়েছে। নাহলে শাড়ি পড়া তার পছন্দ না। কারণ সে শাড়ি ঠিকমতো সামলাতে পারে না। বারবার শুধু মনে হয় কোন দিক দিয়ে হয়তো তার শাড়ি খুলে যাচ্ছে। আজও তেমনই হচ্ছিল। একদিকে শাড়ি ঠিক করছেতো মনে হচ্ছে অন্য দিক দিয়ে সরে যাচ্ছে। এভাবেই শাড়ির সাথে যুদ্ধ করতে করতে সে হলুদের আয়োজনের কাছে আসতে নেয়। তখনই সামনে পড়ে এই অসহ্যকর লোকটা। যার জন্মই হয়েছে হয়তো একমাত্র আহানাকে জ্বালানোর জন্য। বখাটে ছেলেদের মতো বাইকের উপর পায়ের উপর পা তুলে আয়েসি ভঙ্গিতে শুয়ে থেকে সিগারেটের ধুঁয়া ছাড়ছিলেন জনাব। আহানাকে দেখেই সে ফট করে একলাফে নিচে নেমে দাঁড়ায় আহানার সামনে।পড়নে তার এ্যাশ কালারের টিশার্টের উপর কালো লম্বা ঢিলাঢালা ধরনের জ্যাকেট আর কালো প্যান্ট। তার ড্রেসিং সেন্স সর্বদাই আহানার কাছে উদ্ভট আর উগ্র মনে হয়। কানের নিচ পর্যন্ত লম্বা লম্বা চুল। যা কখনো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে থাকে, আবার কখনো উপর থেকে অর্ধেক চুল ঝুঁটি করে বেঁধে রাখে। হাতের সবগুলো আঙুলে অদ্ভুত ডিজাইনের সব আংটি আর দড়ির মতো একগাদা ব্রেসলেট হাতে ভরা। এটা নাকি তার রকস্টার লুক। এমনটাই বলে সে।আবির আহানার সামনে দাঁড়িয়ে চোখের রাউন্ড শেইপের কালো চশমাটা হাতের দুই আঙুল দিয়ে চোখের উপর থেকে খানিকটা নামিয়ে নাকের ডগায় ঠেকায়। তারপর ঘাড় বাঁকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আহানার নিচ থেকে উপর পর্যন্ত পুরোটা স্ক্যান করতে থাকে। তা দেখে আহানা কিছুটা ভড়কে যায়। সে কিছু বলবে তার আগেই আবির তার মহান উক্তি গুলো বলা আরম্ভ করে দেয়। যা বরাবরের মতোই আহানার রাগে শরীর জ্বলিয়ে দেয়। আহানা আজ পর্যন্ত ভেবে পায়না একটা এতটা অসভ্য আর অসহ্যকর কিভাবে হতে পারে! প্রতিবারই আবির অসভ্যতায় নিজেই নিজের রেকর্ড ভেঙে দেয়। আহানা রাগে কিড়মিড় করে আবিরের কথার প্রতিত্তোরে বলল,”একদম বাজে কথা বলবেন না কিন্তু। আপনাকে কেন কোমড় দেখাতে যাবো আমি! আপনাকে কোমড় দেখাতে যাবে আমার জুতো।”
“তো কাকে দেখাতে কোমড় বের করেছিস! অন্য ছেলেদের! ”
“যাকে খুশি দেখাই আপনার এত মাথা ব্যাথা কেন?”
“আরে কি বলিস! এটাতো আরও ভয়াবহ ব্যাপার। তোর এমন বাসি,পঁচা কোমড় দেখে আমাদের যুবসমাজের ভেতরেতো ভুল ধারণা পয়দা হবে তাইনা! আমি নাহয় শক্ত মনের দেখে তোর এই কোমড় দেখেও সহ্য করে গেলাম। কিন্তু ওই মাছুম যুবসমাজ তোর এই কোমড় দেখে নির্ঘাত হার্ট করে মারা যাবে। যারা বেঁচে থাকবে তারাও ডিপ্রেশনে চলে যাবে। কোমড়ের উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যাবে তাদের। নিজের বউয়ের কোমড়ও দেখতে চাইবে না। ধীরে ধীরে যুবসমাজ শেষ হয়ে যাবে। আর আমার মতো দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে যুবসমাজের এমন ক্ষতি আমি কিছুতেই হতে দিবোনা। কারণ যুবক না থাকলে যুবতীদের কি হবে? যুবকহীনা তারাতো অপূর্ণই রয়ে যাবে।”
চলবে।