মরুর বুকে বৃষ্টি ২ পর্ব-৩৮+৩৯

0
373

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-৩৮
®মেহরুমা নূর

★আজ গায়ে হলুদের দিন ধার্য করা হয়েছে। সকাল থেকেই তোড়জোড় চলছে। বাসার লনে পুল সাইডে স্টেজ সাজিয়ে হলুদ ফাংশনের আয়োজন করা হয়েছে। আজ অল্প সংখ্যক কিছু মেহমানও আসবে। নূরের দুই মায়ের পরিবারও আসবে। বিকাল পর্যন্ত সব আয়োজন শেষ করে সবাই এবার রেডি হতে লেগে পড়ল। হলুদের থিম রাখা হয়েছে। মেয়েরা কলাপাতা রঙের শাড়ি আর ছেলেরা কলাপাতা রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা চুড়িদার পাজামা। তবে বর-কনের কালার আলাদা। নূরকে লাল পাড়ের হলুদ শাড়িতে সজ্জিত করা হয়েছে। আর আদিত্য সেজেছে হলুদ পাঞ্জাবিতে। জারবেরা আর গজরা ফুলের গহনাতে সাজানো হয়েছে রূপবতী কনে’কে। নূরকে রেডি করানো শেষে হিয়া আর আহানাও নিজ নিজ রুমে এলো তৈরি হতে। হিয়া রুমে এসে দেখলো বিহান ছেলেকে কোলে নিয়ে খেলছে তার সাথে। ছোট্ট ছেলেকেও সে হলুদের থিম অনুযায়ী কলাপাতা রঙের ছোট্ট পাঞ্জাবি পড়িয়ে দিয়েছে। ছেলে বাবার কোলে ছোট্ট হাত পা নেড়ে নেড়ে খেলছে। যেন সে খুব করে বুঝতে পারছে এই লোকটাই তার বাবা। বাবার কাছে সে খুব খুশি।ছোট্ট নরম হাতে বাবার মুখ হাতিয়ে যাচ্ছে। হিয়া দরজায় হেলান দিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো বাবা ছেলের সেই সুন্দর মুহুর্তটা। বিহান বাবুর খেয়াল হিয়ার চেয়েও বেশি রাখে। প্রথম যেদিন ছেলেকে নিজের কোলে নিয়েছিলো তার চোখে ছিলো খুশির কান্না। যেন জীবনের সেরা উপহারটা পেয়েছে সে। নাম-পরিচয়হীন, পরিবারের ছায়া ছাড়া বেড়ে ওঠা লোকটা যেন নিজের সন্তানের মধ্যে সকল অপূর্ণতার অবসান খুঁজে পেয়েছিল। বুকের সাথে লাগিয়ে নিয়েছিল নিজের সত্তাকে। বাসায় আসার পরও বিহানই বেশির ভাগ সময় বাবুর খেয়াল রাখে। একটু কাঁদলেই অস্থির হয়ে যায় সে।হিয়া কখনো ভাবেনি তার জীবনেও এতটা সুখের দিন আসবে ।বিহান শুধু হিয়াকে নয়, তার মা বাবাকেও আপন করে নিয়েছে। নিজের মা-বাবার মতোই শ্রদ্ধা আর যত্ন করে তাদের। বিহান তার জীবনে সত্যি কোনো বরদান হয়ে এসেছে যেন। বিহানের মতো একটা খাটি,শুদ্ধ একটা মানুষ তার জীবনসঙ্গী হিসেবে এসে হিয়াকে করেছে সৌভাগ্যবতী। হিয়ার ভাবনার মাঝেই বিহানের নজর পড়ে হিয়ার উপর। তাকে দেখে বিহান হাসিমুখে বলল,
“আরে ওইহানে খাঁড়াইয়া আছো ক্যালা? ভিতরে আহো।দেহো বাবুরে কি ছুন্দর লাগতাচে! এক্কেরে পুরাই হিরো। মাশাল্লাহ কি ছুন্দর আমার পোলডা!”
হিয়া মুগ্ধ হেঁসে এগিয়ে এলো ওদের কাছে। মাথা ঝুঁকিয়ে প্রথমে ছেলের কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“হ্যাঁ, অনেক সুন্দর লাগছে!”
এরপর হিয়া চুমু খেলো বিহানের কপালে। চুমু খেয়ে বলল,
“ঠিক তার বাবার মতো। বাবার মতোই হ্যান্ডসাম হয়েছে আমাদের ছেলে। শুধু চেহারা না। আমি চাই বাবুর ব্যাক্তিত্বও যেন তার বাবার মতো হোক। বাবুর জন্য আদর্শ হিসেবে তার বাবার চেয়ে বড়ো আর কে হতে পারে!”
বিহান প্রাপ্তির নজরে তাকালো হিয়ার দিকে। চোখ দুটো চিকচিক করছে। তার নজর বলছে এই মুহুর্তে সে পরিপূর্ণ, সর্বসুখী।

গেস্ট রুমে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে হলুদ ফাংশনের সাজে সজ্জিত করতে ব্যস্ত আহানা। সাজের অধিকাংশ অংশই প্রায় শেষ। তবে পেছনের ফিতা একটু সমস্যা হচ্ছে তার। উল্টো দিকে হাত নিয়ে ঠিক করে মনমতো হচ্ছে না বাঁধা। তার প্রচেষ্টার মাঝে হঠাৎ ব্যাঘাত ঘটালো আবিরের আচমকা আগমনে। সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই আহানাকে এমতো অবস্থায় দেখে আৎকে উঠার ভঙ্গিতে বলে উঠল,
“তওবা তওবা! ইন্না-লিল্লাহ!দিন দুপুরে এইসব কি দেখাচ্ছেন বিয়াইন সাহেবা! মানলাম আমি একটু বেশিই হ্যান্ডসাম। সৌন্দর্যে ভরপুর তাগড়া যুবক। আমি হাঁটলে সৌন্দর্য আমার গা থেকে টুপটুপ করে ঝরে পড়তেই থাকে।আমার সৌন্দর্যের পাওয়ারে বিদ্যুৎ ছাড়াই হাজার পাওয়ারের লাইট জ্বলে ওঠে। আমার রুপের তারিফ করতে গেলে নতুন করে ডাইনোসর জামানা ফিরে আসবে তাও শেষ হবে না। হ্যাঁ মানলাম, এতটাই সুদর্শন যুবক আমি। আর আমাকে পাওয়ার জন্য মেয়েরা অনেক ধরনের কর্মকাণ্ডই করে থাকে। তাই বলে এইভাবে পিঠ,কোমড় দেখিয়ে আকর্ষিত করবেন আমাকে! বেচারা আমার মতো মাছুম, ইনোসেন্ট, অবলা ছেলেটা কি এসব সইতে পারে! এখুনি যদি শরম এটাক করে আমার হার্টের অবসান ঘটিয়ে দিতো তখন!”
যদিও আবিরের এসব ফালতু কথায় আহানা অভ্যস্ত। তবে তার এভাবে হঠাৎ আগমনে অনেকটাই অপ্রস্তুত হয়ে যায় সে। হাত পিঠে রাখা অবস্থায়ই ঝট করে উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়ায় সে। একসাইডে কাঁধের উপর থাকা চুলগুলোও আচমকা ঘুরে দাঁড়ানোয় ঝাপটা খেয়ে উড়ে হাওয়ায়। পিঠ না দেখানোর জন্য এমনটা করলেও আয়নায় ঠিকই আহানার পিঠ দৃশ্যমান হচ্ছে আবিরের সামনে। তা জানলোও না আহানা। সে হকচকানো কন্ঠে বলল,
“আরে আরে আপনি এখানে কি করছেন! আর কোনো মেয়ের রুমে ঢুকতে হলে নক করে ঢুকতে হয় এতটুকু ম্যানার্স নেই আপনার! আমিও কাকে কি বলছি! যে কিনা জীবনে ম্যানার্স নামক ওয়ার্ডটাও শুনেছে কিমা সন্দেহ, তার কাছ থেকে আর কি আশা করা যায়!”
“বাহ! খুব ভালো! একেতো চিকন কোমড় দেখিয়ে ছেলে কাবু করার ধান্ধা হচ্ছে! এখন নাকি সে আবার ম্যানার্স শেখাবে! আরে ভাই প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে ওয়াশরুম খুঁজছিলাম। আমার জানামতেতো এটা আদিদের বাসার গেস্টরুম। এখানে কোনো মেয়ে আছে নাকি পেত্নী আছে তা এই মাছুম ছেলেটা কিভাবে জানবে!জানলে কি আর বেচারা লাজুক ছেলেটা কি ইচ্ছে করে এমন কিছু দেখতো!”কখনো না।”
“লাজুক বলতে আপনি নিজেকে বোঝাতে চাচ্ছেন? ”
“অবশ্যই! এখানে আমিইতো একমাত্র লাজুক ব্যক্তি। আরে লজ্জাতো আমার ভেতর ঠেসে ঠেসে ভরা। লজ্জার ভারে হাঁটাই মুশকিল আমার। আমিতো এতটাই লাজুক যে আয়নায় নিজেকে দেখার আগেও মাথায় ঘোমটা টেনে নেই।”
আহানা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“বাহ! সত্যি, আপনাকে দেখেতো লজ্জা নিজেই নিজেকে বেশরম ভাববে! আপনার মতো মানুষ আছে বলেই লজ্জা এখনো জীবিত আছে। আপনাকে এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে ফেলার জন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত। দয়া করে কি আপনি এখন প্রস্থান করতে পারবেন প্লিজ!”
“আরে বললেই হলো নাকি! আমাকে শরম এটাক দিয়ে এখন যেতে বলছেন বিয়াইন সাহেবা! এখন আমার এটাক ঠিক করবে কে! আপনি এটাক দিয়েছেন আপনিই ঠিক করবেন।”
“মানে! এটাক আবার ঠিক করে কিভাবে? ”
“ডাবল এটাক দিয়ে।”
“কিহ!”
“আরে হ্যাঁ। যেমন সিনেমাতে মাথায় আঘাত পেয়ে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যায়। পরে আবারও তার চেয়ে বেশি আঘাত পেয়ে স্মৃতিশক্তি ফিরেও আসে। আমারও ঠিক তেমনি। প্রথম শরমে এটাক, পরের বার তার চেয়ে বেশি শরম পেয়ে এটাক ঠিক হয়ে যাবে। চলুন ফটাফট আমাকে আবার শরম দিন। এবার একটু বেশি জোরে শরম দিবেন। তাহলে ঠিক হয়ে যাবে।”
“আরে কি যা তা বলছেন! আবার কিভাবে শরম দিবো? আপনি যান না প্লিজ!”
“আরে এমনে কেমনে যাবো! শরম এটাক ঠিক করতে হবে না আমার!এটাক জমিয়ে রেখে আমাকে কি প্যারালাইজড করতে চান! নিন নিন, জলদি আবার শরম এটাক দিন।”
“দেখুন, আবির ভাই অনেক মজা হয়েছে। এবার যান না প্লিজ!”
আবির যাওয়ার বদলে আরও আহানার কাছে এগিয়ে এলো। আহানার ড্রেসিং টেবিলের সাথে একদম লেগে সেটে গেল। আবির এগিয়ে এসে আহানার দুই পাশ দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর হাত রেখে আহানাকে মাঝখানে বন্দী করে ফেলল। থতমত খেয়ে পেছন দিকে একটু হেলে গেল আহানা। আবির ঝুঁকল তার দিকে।চাহুনিতে তার দুষ্টুমি ভরপুর। বাঁকা হাসির রেখা টেনা বলল,
“এটাকতো আমি ঠিক করিয়েই যাবো, আন্নি। এখন তুই নিজে থেকে করলে ভালো। নাহলে আমার ট্রিটমেন্ট আমি নিজেই নিয়ে নিবো।”
আহানার নজর যেন এবার এলোমেলো হলো। আবিরের ওই ঘাতক নজরে বিমূঢ় হচ্ছে সে। আহানার মুখপানে একাগ্র নজর রেখেই আবির তার হাত দুটো ধীরে ধীরে আহানার পিঠের দিকে এগিয়ে নিলো।একসময় হাত পৌঁছালো আহানার পিঠের ফিতায়। যা এখনো আহানার হাতের মাঝেই ধরা আছে। আহানার হাতের মাঝ থেকে ছাড়িয়ে তা নিজের হাতে নিলো আবির। আহানা চকিত নজর রাখল আবিরের চোখে। আহানার চোখের দিকে নজর রেখেই পিঠের ফিতা বেঁধে দিতে লাগল আবির। হৃৎস্পন্দন গতি ভুলল আহানার। পিঠে আবিরের হাতের ছোঁয়ায় মৃদু কম্পন অঙ্গে ঘটলো। ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা হাত দুটো শক্ত মুঠো করে নিজেকে তবুও সবল রাখার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত সে। ফিতা বাঁধার প্রক্রিয়া শেষে আবির আহানার কানের কাছে আরও ঝুঁকল। শক্ত হয়ে গেল আহানা। কানের ঠোঁট প্রায় ছুঁই ছুঁই আবিরের। এভাবেই রেখে আবির বলল,
“এবার আমার পাওনা উসুল করার পালা। সেদিনের স্ট্রবেরি ফ্লেভারের কিসগুলো বাকির খাতায় ফেলে রেখেছিস তুই। আজতো বাকি চুকাতেই হবে তোর। তাও সুদেআসলে সব। কিস বাকি রেখে সুদ জমিয়ে ফেলেছিস। সুদ বেড়ে এখন তিন ডাবল বেড়ে গেছে কিসের পরিমাণ। আজ সব শোধ করবি।”
কথার সাথে আবিরের উষ্ণ নিঃশ্বাস আর অধরের স্পর্শ লাগছে আহানার কানে। গলা শুকিয়ে আসছে আহানার। নিজেকে শক্ত রাখা মুশকিল কাজ হয়ে দাঁড়াচ্ছে যেন তার জন্য। কানের কাছ থেকে মুখ তুলে আহানার মুখের দিকে নজর টিকালো আবির। মাথা হালকা বাঁকিয়ে অগ্রসর হলো সে আহানার অধর পানে। চোখ বুঁজে কাঙ্খিত গন্তব্যের সন্ধান পেতেই নিয়েছিল। ঠিক তখনই হঠাৎ আহানা আবিরের পায়ে নিজের পা দ্বারা ঠাস করে গুতা মেরে দিলো। উসুল প্রক্রিয়ায় জোরেশোরে ব্যাঘাত ঘটলো আবিরের। পায়ে ব্যাথা পেয়ে আর্তনাদ করে পা উঁচু করে লাফাতে লাগলো সে। সেই সুযোগে আহানা আবিরের হাতের মাঝ থেকে ঝট করে বেড়িয়ে ছুটে পালালো। দরজার কাছে এসে হাসতে হাসতে বলল,
“আপনার বাকি কোনোদিনও উসুল হবে না বিয়াই সাহেব।”
বলেই আবার দৌড়ে বেড়িয়ে গেল আহানা। আবির বাঁকা হেঁসে বলল,
“বাকি উসুল করার পদ্ধতি খুব করে জানা আছে আমার আন্নি। দেখি কতদিন বাকি শোধ না করে পালিয়ে বেড়াস। মজ হবে এই চেসিং গেমে।”

নূরকে হলুদ ফাংশনের জন্য পুরোপুরি রেডি করা হয়েছে। এখন শুধু মেয়েরা আসলে বাইরে যাওয়ার পালা। হিয়া আর আহানা যাওয়ার আগে বাইরে থেকে দরজা লক করে দিয়ে গেছে যাতে আদিত্য এখানে না আসতে পারে। মনে মনে হাসলো নূর এদের কান্ডে। আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে সে। কেমন পুলকিত হচ্ছে তার হৃদয়,মন। আজ তার হলুদ। আদিত্যর নামের হলুদ লাগবে তার অঙ্গে। ভাবতেই যেন ভালো লাগার ঝড় বইছে মন জুড়ে। শিহরিত হচ্ছে শরীর,মন। হঠাৎ খট করে দরজা খোলার শব্দে পেছনে ফিরে তাকালো নূর। আদিত্যতে প্রবেশ করতে দেখে কিছুটা চকিত হলো সে। আদিত্য রুমে ঢুকেই ফট করে আগে ভেতর থেকে সিটকানি লাগিয়ে দিলো। নূর থতমত কন্ঠে বলল,
“আরে তুমি এখানে এখন! কেউ দেখে ফেললে কি ভাববে!”
আদিত্য নূরের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
“কে কি ভাবলো তাও যদি আমিই ভাবি তাহলে মানুষ কি ভাববে! হলুদ আমার,বিয়ে আমার, বউ আমার অথচ আমি দেখবো সবার পর এই অন্যায়তো মেনে নিবোনা আমি। সবার আগে আমি আমার বউকে দেখবো মন ভরে। তারপর বাকিরা।”
লাজুক হাসলো নূর। বলল,
“দরজাতো লক ছিলো। তুমি এলে কিভাবে? ”
“তুমি ভুলে যাচ্ছো রাণী সাহেবা এটা আমার বাড়ি। আর আমার বাড়িতে আমাকে কোথাও যেতে না দেওয়ার মতো ক্ষমতা কারোর নেই। আমার কাছে সব রুমেরই ডুবলিকেট চাবি থাকে জনাবা। এখন একটু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো।আমাকে দেখতে দাও আমার পরীর মতো বউটাকে।”
লাজে রাঙা হলো নূরের মুখ। আদিত্য অবলোকন করতে ব্যাস্ত তার হৃদহরণিকে। ফর্সা মোলায়েম অঙ্গে হলুদ শাড়ি আর ফুলের গহনা। এ যেন অপ্সরাকেও হার মানানো অপূর্ব রুপ তার। আদিত্যর চোখ বুঝি ঝলসে যাচ্ছে তার বঁধুর সৌন্দর্যের ঝলকে। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে নূরের খুব কাছে এসে দাঁড়াল আদিত্য। দুই হাতে নূরের মুখটা ধরে একটু উপরে তুলে পরম ভালোবাসায় অধর ডুবালো নূরের কপালে। খানিক সময় ওভাবেই রাখল। তারপর কপালে কপাল, নাকে নাক ঠেকিয়ে মায়াময় সুরে বলল,
“মাশাল্লাহ! আমার বঁধুটাকে দেখেতো পরিরাও হিংসায় জ্বলবে! আমার সুন্দরী বঁধু!”
সুখময় অনুভূতির মেলা বসলো নূরের অন্তর্দেশ জুড়ে। কিছুক্ষণ সেভাবে থাকার পর নূর বলল,
“এখন যাও প্লিজ! কেউ চলে আসবে।”
“উহুম,আসল কাজতো এখনো করিইনি। আমার বউয়ের সাথে হলুদ খেলার অধিকার সবার প্রথম আমার। আগে আমরা আলাদা হলুদ খেলবো তারপর বাকিরা।”
“কিন্তু…”
বাকি কথা পূরণ করতে দিলোনা আদিত্য। নূরের ঠোঁটে তর্জনী আঙুল চেপে বলল,
“হুঁশ, কোনো কথা না। যা বললাম তাই হবে।”
পরপরই নূরকে কোলে তুলে নিলো আদিত্য। তাকে নিয়ে এসে রুমের ডিভানের উপর পা তুলে বসালো। আদিত্য বসলো নিচে নূরের পায়ের সামনে।ডিভানের উপর নূরের হাঁটু উঁচু করে ভেঙে বসা পা দুটো আরেকটু সামনে টেনে আনলো। শাড়ি উপর দিকে হাঁটু পর্যন্ত উঠিয়ে রেখে হাঁটুর নিচের পা টুকু উন্মুক্ত করলো আদিত্য। পকেট থেকে একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের প্যাকেট বের করলো সে। তাতে বাটা হলুদ ছিলো। নূরের দিকে তাকিয়ে মায়াবী হাসলো একবার আদিত্য। প্রথমে দুই পায়ে চুমুর পরশ বোলালো সযত্নে। তারপর প্যাকেট থেকে হলুদ পেস্ট হাতের আঙুলে মাখিয়ে নূরের আলতা রাঙা ফর্সা পায়ে মাখিয়ে দিলো। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত টেনে মাখিয়ে দিলো হলুদ পেস্ট। নূর একধ্যানে তাকিয়ে দেখছে তার সুদর্শন পুরুষটাকে। পুরুষটার চোখে কত ভালোবাসা! কত যত্ন করে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে সে! এতটা পাগলের মতো কেন ভালোবাসে লোকটা তাকে! সে’কি সামলাতে পারবে এত ভালোবাসার জোয়ার! নূর কি কখনো তার ভালোবাসার বরাবরি করতে পারবে! এত ভালোবাসায় যে সে হারিয়ে ফেলে নিজেকে! লোভী হয়ে যায় সে। আরও বেশি করে শুধু এই পুরুষটার ভালোবাসা চায় সে। সারাজীবন চায়। পরের জনম বলতে কিছু থেকে থাকলে সেই সব জনমেও শুধু এই পুরুষটাকেই নিজের করে চায় নূর। এসব ভাবতে ভাবতে আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে নূরের চোখে। সুখের অশ্রু জমে চোখে। তবে তা আদিত্যর চোখে পড়ার আগেই মুছে ফেলে। লোকটা যে তার চোখের জল দেখতে পারে না। আদিত্যর হলুদ লাগানো শেষে নূর বলল,
“এবার আমার পালা। আমি দিবো তোমাকে।”
আদিত্য নূরের পাশে বসে বলল,
“এত সহজে না জানেমন। হলুদ লাগাবে কিন্তু হাত লাগাতে পারবেনা৷ যদি পারো তাহলে দাও।”
নূর মুচকি হাসলো। যেন বুঝতে পারল কি করতে হবে তাকে। সে আদিত্যর আনা হলুদ পেস্ট হাতে নিয়ে প্রথমে নিজের গালে একটু লাগালো। তারপর দুই হাতে আদিত্যর গলা জড়িয়ে ধরে নিজের গাল আদিত্যর গালের সাথে ঘষলো। এতে করে তার গালের হলুদটা আদিত্যর গালেও লেগে গেল।এভাবে দুই গালেই লাগিয়ে দিলো হলুদ। তারপর নূর আদিত্যর কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“হ্যাপি হলুদ, হিরো।”
প্রাপ্তির খুশিময় হাসির রেখা আদিত্যর ঠোঁটে। সে নূরের লাল লিপস্টিপ রাঙা ঠোঁটে আলতো করে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে বলল,
“হ্যাপি হলুদ, এঞ্জেল।”

চলবে……

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি (S-2)
পর্ব-৩৯
®মেহরুমা নূর

★গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়ে গেছে। আদিত্য আর নূরকে পাশাপাশি স্টেজে বসানো হয়েছে। হলুদ লাগাচ্ছে একে একে সবাই। নূরের দুই মায়ের পরিবারও এসেছে। তারাও হলুদ লাগিয়েছে। এরইমাঝে আবির তার ড্রামা করবেনা তাকি হয়! সে তার ছেলে পক্ষের অপ্রয়োজনীয় দাম্ভিকতা দেখাতে ব্যস্ত। মেয়ে পক্ষের সবকিছুতেই অসন্তুষ্ট সে। নাক কুঁচকে বলছে,”এটা কেমন সস্তা আয়োজন! ছেলের লেভেলের সাথে একদমই যায় না। এতো খারাপ আয়োজন দেখেতো বমি এসে যাচ্ছে আমার! এখানে এক মুহূর্তও দাঁড়ালে আমার দুই লিটার ইজ্জত কমে যাবে।”
তার নিন্দা বাণীর জবাব দিতে আহানা এগিয়ে এলো তার সামনে। বুকে হাত ভাজ করে গম্ভীর ভাব করে বলল,
“এইযে মিঃ বিয়াই সাহেব, হুদাই পোয়াতি গরুর মতো হাম্বাচ্ছেন কেন? কি সমস্যা আমাদের আয়োজনে?”
আবির প্রচন্ড রকম ভড়কে ওঠার ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলল,
“কিহ! আমি গরু! এত্তো বড় ইনসাল্ট! আবির দ্য গ্রেট-এর এত্তো বড় ইনসাল্ট আজ পর্যন্ত কেউ করেনি! এমন একশো কিলোমিটার সমান ইনসাল্টের পরতো আর এক মুহূর্তও এখানে থাকা আমার সম্মানের খিলাফ। আমার সম্মান আহত। তাকে এই মুহুর্তে হসপিটালে নিতে হবে চিকিৎসার জন্য।”
“সে আপনি হসপিটালে যান আর চিড়িয়াখানায় বা,ন্দর সাজতে যান সেটা নিতান্তই আপনার ব্যাক্তিগত চয়েস। আমাদের তাতে কোনো হস্তক্ষেপ নাই। কিন্তু যাওয়ার আগে বলে যাবেন আমাদের আয়োজনে কমতিটা ঠিক কোথায় কোথায় পেলেন?”
“কোথায় কোথায় নেই তাই বলুন! কমতি হতে হতে শুন্য হয়ে গেছে। পুরো কমতির গোডাউন। বলতে বলতে হলুদ ফাংশন শেষ হয়ে বিয়ে, বাসর,বাচ্চা, নাতিপুতি,তার নাতিপুতি হয়ে যাবে তাও কমতির গুণতি শেষ হবে না।”
“তাও এই মহাসাগর থেকে যদি কিছু দ্বিপের নাম উল্লেখ করতেন তাহলে ধন্য হতাম।”
“ঠিক আছে শুনুন তাহলে। এই যেমন ধরেণ আপনারা ওয়েলকাম জানানোর কোনো আয়োজনই করেননি। এটা সবচেয়ে বড়ো কমতি। আপনারাতো প্রটোকলের প্রথম ধাপেই ডাইনোসরের ডিমের মতো বিশাল বিশাল দুটো আন্ডা পাইয়া ফেল মারছেন। আরে ছেলে পক্ষের জন্য ধামাকেদার একটা স্বাগত সমারোহ করাটাতো মেয়ে পক্ষের অতিব অনিবার্য কাজ। মিল্ক ছাড়া যেমন মিল্কশেক হয়না। তেমনি স্বাগত সমারোহ ছাড়া কখনো কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান হয় শুনেছেন! আরে আমাদের রাজপুত্রের মতো ছেলেটার রাজকীয় স্বাগত সমারোহ নাহলে তার হাইট কমে যাবে না! আচ্ছা তাও নাহয় অনেক কষ্টে বুকে ক্যাটরিনা কাইফ চাপা দিয়ে বরের ইনসাল্ট টা মেনে নিলাম। কিন্তু বরের এই মহাকাশ সমান হ্যান্ডসাম বন্ধুটার ইনসাল্ট কিভাবে মেনে আমরা! আরে এমন দুর্ধর্ষ, পৃথিবী কাঁপানো সৌন্দর্যের ভরপুর বন্ধুর কোনো স্বাগত করার ব্যবস্থাই রাখেননি! এতবড় গোস্তাখি কি মেনে নেওয়া যায়! আরে আর কিছু নাহোক অন্তত শ’খানেক সুশ্রী রমনীদের হাতে একটু ফুলই বর্ষণ করিয়ে দিতেন। সাথে সেই রমণীদের চুমুর বর্ষণও দিলে মন্দ হতোনা। ব্যাস এতটুকুই যথেষ্ট ছিলো। আমার আবার বেশি অহংকার নেই। অল্পতেই মানিয়ে নেয় নিজেকে।”
“সত্যিই কতো মহান আপনি! আপনার মহানতা স্বচক্ষে দেখতে পেরে জন্ম সার্থক আমার। আমি অতি দুঃখিত বিয়াই সাহেব। আপনি একটু বসেন৷ আমরা এক্ষুণি আপনার মতো মহান ব্যক্তির স্বাগত করার ব্যবস্থা করছি।”
“ঠিক আছে, ঠিক আছে এতো করে যখন বলছেন তাই মানা করি কিভাবে! আমার আবার কোমল হৃদয়। একটুতেই গলে যায়।”
“সত্যি কত কোমলপ্রাণ আপনি! আমি এক্ষুনি আপনার জন্য ওয়ার্ল্ড বেস্ট স্বাগত সমারোহ-এর আয়োজন করছি। আপনি বসুন ততক্ষণে আসছি পাঁচ মিনিট পর।”
“আচ্ছা।”
আবির চেয়ারে বসলো আয়েশি ভঙ্গিতে পায়ের উপর পা তুলে। আহানা গেল স্বাগত সমারোহের ব্যবস্থা করতে। পাঁচ মিনিট বললেও প্রায় দশমিনিট পর ফিরলো সে। মুখে বিস্তর একটা প্লাস্টিক হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়াল আবিরের সামনে। অমায়িক সুরে বলল,
“তো বিয়াই সাহেব তৈরিতো! আপনার স্বাগত সমারোহ একদম রেডি।আই হোপ আপনি অবশ্যই সেটিসফাই হবেন।”
আবির উৎসাহিত কন্ঠে বলল,
“আমিতো এভার রেডি।”
“তাহলে নিন। গার্লস, লেটস গো ফর ইট!”

বলেই একটা রহস্যময় বাঁকা হাসি দিয়ে আবিরের সামনে থেকে সরে গেল আহানা। এবং সাথে সাথে একঝাঁক মেয়ের দল এসে ঘিরে নিলো আবিরকে। তাদের দেখে আবিরের আত্মা উড়ে তাল গাছের উঁচু ডালে ঝুলে পড়ল। এক লাফে চেয়ারের উপর দুই পা তুলে উঠে বসলো সে। আতঙ্কে চোখের মনি ফটাস করে ফেটে যাওয়ার উপক্রম। কারণ তার সম্মুখে আসা নারীগুলো সেরকম না যেমন আবিরের ধারণায় থাকে। ওকে এই মুহুর্তে ঘিরে আছে একঝাঁক হিজড়ার দল। অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঝটকার জন্য আবির মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা। বেচারার এখন একদল গুন্ডার হাতে আবদ্ধ অসহায় নারী টাইপ ফিলিং হচ্ছে। ওদের মাঝে একজন দুই হাত উঁচু করে তালি বাজাতে বাজাতে আবিরের কাছে এগিয়ে আসতে আসতে তাদের নিজস্ব ভঙ্গিতে বলল,
“আয় হায় হায়! এই ছেলে! তুইতো আসলেই অনেক সুন্দর রে! এক্কারে রসে চুবানো রসগোল্লা একখান! পোলাতো নয় যেন আগুনের গোলা! আজ তোর সাথে মজা হবে অনেক!”
শুকনো ঢোক গিলল আবির। অসহায় মুখে ফিচেল হেঁসে বলল,
“ম…মজা! না না এসবের কি দরকার! আমার মাঝে মজা বলতে কোনো ফিচার নেই। রাধুনি মশলা দিয়ে রান্না করে খেলেও কোনো মজা পাওয়া যাবে না আমার মাঝে। আর সৌন্দর্যেরতো ছিটেফোঁটাও নেই আমার মাঝে। অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে রিসার্চ করেও আমার মাঝে সৌন্দর্যের কোনো জীবানুও খুঁজে পাবেন না। আরে আমিতো এতই কুৎসিত যে আয়নার সামনে গেলে আয়নায়ই ফটাস করে ফেটে যায়। বাড়িতে আমার মুখের উপর তেনা দিয়ে ঢেকে রাখি নাহলে মেহমান আসলে ভয় পেয়ে যায়। আপনারা বোধহয় কোনো ভুল বুঝছেন। আমি বরং এখন আসি হ্যাঁ! ”
বলেই আবির চেয়ার থেকে নেমে কেটে পড়তে চাইলো। কিন্তু তার কৌশল সফল হলোনা। হৃষ্টপুষ্ট গঠনের একজন হিজড়া এসে আবিরের হাত টেনে ধরে বলল,
“আরে কই যাস পোলা!আয় আইজকা তোর সাথে পাশা খেলমু সোনা।”
আবির বেচারা করুন সুরে বলল,
“আরে না না, আমিতো জীবনে লুডুই খেলিনি কখনো। খেলাধুলা আমার একদমই পছন্দ না। আমাকে যেতে দিন না! বাচ্চে কি জান লোগে কেয়া!”
কিন্তু আবিরের আকুতি কানে নিলোনা তারা। আবিরের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে চাইলো। আবির যেতে চাইছে না কোনমতেই। নিজের ইজ্জত যেন আজ সত্যি সত্যিই বিপদের মুখে। আবির যেতে চাচ্ছে না দেখে এবার হিজড়াটি আবিরকে ধরে সোজা কাঁধে তুলে নিলো। বেচারা নিজেকে বাঁচাতে হাত পা ছোড়াছুড়ি করে বলছে,
“ছেড়ে দিন আমাকে। আপনার ঘরে কি বাপ ভাই নেই? দয়া করে ছেড়ে দিন আমাকে! আপনারা আমার দেহ পাবেন মন পাবেন না! ওই বিহাইন্নার বাচ্চা বাচা আমারে।”
বিহান ওর অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে বলল,
“নিজের বাঁশ নিজেই ছামলা। আমি কিচ্ছু করতে পারুম না। আমি কইছিলাম আজাইরা ভাব দেহাইতে! অহন ল ঠেলা!”
আবির নিজেকে আর বাঁচানোর আর পথ পেলোনা। তারা সবাই সাউন্ড বক্সে “পোলাতো নয় একটা আগুনেরই গোলা” গান ছেড়ে, আবিরকে নিয়ে নাচানাচি শুরু করে দিলো। সবাই আবিরকে ঘিরে ধরে এদিক ওদিক টানাটানি করে নাচানাচি করছে। আবির বারবার পালানোর চেষ্টা করেও পারছেনা। তারা ধরে ফেলছে। আবিরকে উঁচু করে ধরে সবাই মিলে তার সাথে খেলনার মতো খেলছে।কেউ কেউতো আবার আবিরের নিতম্বে চিমটি কাটছে। আবিরের নিজেকে গুন্ডাদের কাছে টিজ হওয়ার মতো অসহায়ত্ব ফিল হচ্ছে। বেচারার অবস্থা নাজেহাল। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। প্রায় দশ/পনেরো মিনিট ধরে এভাবেই টানাহেঁচড়া করে বেচারা আবিরের নাড়িভুড়ির কিমা বানিয়ে দিলো তারা। অবশেষে তালি বাজাতে বাজাতে তারা আবার চলে গেল। আবির চুষে খাওয়া আমের পড়ে রইলো নিচে।যেন এইমাত্র তার উপর দিয়ে সিডোর বয়ে গেছে। যুদ্ধে বিধ্বস্ত সৈনিকের মতো হাল তার। তার এই অবস্থা দেখে বাকিদের হাসতে হাসতে গড়াগড়ি। আহানা আবিরের উদ্দেশ্যে বলল,
“কি বিয়াই সাহেব, এবার আপনি সেটিসফাইতো! এবার নিশ্চয় আমাদের আয়োজনে আপনার কোনো কমতি চোখে পড়ছেনা! পড়লে বলবেন। আমরা সেটিকফেশন দিতে অলওয়েজ প্রস্তুত।”
আবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আহানার পানে। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টি রাখে। মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলোও খানিক। তারপর আচমকা ঝট করে এক লাফে উঠে দাঁড়াল সে। চুলে হাতের আঙুল ঢুকিয়ে এলোমেলো চুলগুলো পেছন দিকে সেট করে পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে আহানার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
“নাহ, বিয়াইন সাহেবা। আপনার প্রচেষ্টা যথেষ্ট ছিলো। তবে আমি ব্যক্তিটাই একটু ইউনিকতো। এত সহজে আমাকে ইমপ্রেস করা যায়না। তাও আপনাকে আরেকটা সুযোগ দিচ্ছি। আপনিতো জানেনই আমি কতো মহান! মহানতার সাগর আমার মাথার উপর দিয়েই বয়ে যায়। তাই এবার আমি নিজেই আপনাকে সাহায্য করবো। আর বোঝাবো কিভাবে সেটিসফাই করতে হয়।”
বলতে বলতে আহানার সামনে এগিয়ে এলো আবির। আবিরের ভাবসাব সুবিধার মনে হলোনা আহানার। হালকা ভীতি মনে সে পিছিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু তা হতে দিলোনা আবির। খপ করে তার হাত ধরে এক ঝটকায় নিজের কাছে এনে দাঁড় করালো আবির।আহানা খানিকটা থতমত খেয়ে গেল। আবির চোখে চোখ রেখে বাঁকা হেঁসে বলল,
“কোথায় পালাচ্ছেন মিস বিয়াইন সাহেবা! আপনি না বললেন সেটিসফেকশন দিতে আপনি অলওয়েজ প্রস্তুত! তো না দিয়েই পালাচ্ছেন কেন? বাইদাওয়ে আপনার এই চিকন কোমড়ে ঠুমকা লাগালে এই অধম সেটিসফাই হতে বাধ্য।”
বলেই আবির আহানার হাত ধরে ঘুরিয়ে তাকে স্টেজের সামনের ফাঁকা জায়গায় ছুঁড়ে মারলো একপ্রকার। ডিজের দিকে ইশারা করে দিলো মিউজিক প্লে করার জন্য। মিউজিক বাজতেই আবির আহানার আশেপাশে ঘুরে ঘুরে তাকে টিজ করে করে নাচলো আর গাইলো,
♬ পেহেন কে জোড়া লাল কালার কা
♬ তুনে মাচায়া খুব তেহেলকা
♬ বায় গড তু লাগতি হে জেইসি
♬ সুইমিং পুল মে ফুল কমল কা

♬ চাল দিখা জারা
♬ জো তেরা ডান্স মুভ হে
♬ শুন যারা মাস্ত গ্রুভ হে
♬ মামলা ফুল প্রুফ হে
♬ সোনিয়ে দিল পে গিরি
♬ এক জোর কি বিজলি
♬ লং কা তেরে জাব লাশকারা
♬ ছামকা ছামকা ছামকা

♬ শো মি দা ঠুমকা
♬ দা দা দা দা ঠুমকা
♬ দা দা দা দা ঠুকমা
♬ দা দা দা দা আঃ আঃ
(এই পর্যায়ে আহানাও আবিরের জবাব দেয়।)

হাট!

♬ ৬ ফুট পনে ৩ হাইট হে
♬ লুজ কারেক্টার প্যান্ট টাইট হে
♬ পুত্তার পেইসে ওয়ালে ড্যাড কা
♬ হার দিন ফ্রাইডে নাইট হে
♬ চাল দিখা যারা
♬ জো তেরা ডান্স মুব হে
♬ কাহে কা এটিটিউড হে
♬ সোয়্যাগ হে ঝুট মুট হে

♬ খোত্তেয়া ফিরতি
♬ মেরে লেফট রাইট
♬ শুন তেরে জেইসা
♬ লাখ ফালানা ঢিমকা ঢিমকা ঢিমকা
♬ শো মি দা ঠুমকা
♬ দা দা দা ঠুমকা
♬ দা দা দা দা ঠুমকা
♬ দা দা দা দা আঃ আঃ

ওদের দুজনের সাথে আরও ছেলেমেয়ে এসে নাচে যোগ দিয়ে ছেলে আর মেয়ে পক্ষের মাঝে একটা ফুল অন ডান্সিং কম্পিটিশন শুরু হয়ে গেল। একপর্যায়ে সবাই উড়াধুড়া নাচা শুরু করে দিলো। বিহানও হিয়ার হাত ধরে নিয়ে এলো ডান্স ফ্লোরে। সবাই নাচগানে মগ্ন। নূর সেসব দেখছে হাসিমুখে আর এনজয় করছে। কিন্তু এসবের মাঝে আদিত্য আছে তার মতলব হাসিলে। সবাই নাচগানে মত্ত, সেই সুইযে আদিত্যর দুষ্টু হাত পেছন দিয়ে নূরের শাড়ির ফাঁকে কোমড়ে চালান হয়ে গেল। আচমকা এহেন কান্ডে হকচকিয়ে কেঁপে উঠল নূর। চোখ বড় বড় করে তাকালো আদিত্যর পানে। কোমড়ে হাতের বিচরণ দ্রুত ঘটছে। নূর করুণ সুরে ফিসফিস করে বলল,
“কি করছ! ছাড়োনা প্লিজ! কেউ দেখে ফেলবে!”
আদিত্য হাততো সরালই না। বরং টুস করে নূরের গালে একটা চুমু এটে দিলো। নূর চোখের আকার আরও বড় করলো। করুন সুর আরও দৃঢ় করে বলল,
“তুমি কি পাগল হয়ে গেলে! কেউ দেখলে কি ভাববে! ছাড়োনা প্লিজ! ”
আদিত্য ছাড়লোনা। কোমড় চেপে নূরকে আরও কাছে আনলো তার। রহস্যময় হেঁসে বলল,
“তাহলে সবার নজরের আড়ালে যাওয়া যাক!”
বলেই এক চোখ টিপ মারলো আদিত্য। নূর প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল,
“মানে?”
জবাব দিলোনা আদিত্য। আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে নূরকে ঝট করে পাঁজা কোলে তুলে নিলো। নূর হড়বড়িয়ে ভীতিগ্রস্ত কন্ঠে বলল,
“আরে আরে কি করছ? নামাও প্লিজ! ”
“হুঁশশ! কোনো কথা না। তুমিই না বলছিলে কেউ দেখে ফেললে সমস্যা। তো সেটারই সলিউশন করছি। এখন চুপচাপ থাকো।”
নূরকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আদিত্য তাকে নিয়ে ধীরে ধীরে স্টেজ থেকে নেমে অন্য দিকে চলে গেল। নাচ-গানে মত্ত পাবলিক আর সেটা খেয়াল করলোনা৷ আদিত্য নূরকে নিয়ে আস্তে আস্তে বাসার পেছন সাইডে এলো। সেদিকে চোখ যেতেই আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেল নূরের চোখ মুখ। তার সামনেই দেখতে পেল সে অপূর্ব এক দৃশ্য। এখানে গোলাকার এক ছোট্ট সুইমিং পুলের মতো বানানো হয়েছে। পানির উপরে হাজারো লাল গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো। পুলের চারিদিকে সুগন্ধি মোমবাতি জ্বলছে। নূর চমকিত চোখে তাকালো আদিত্যর মুখপানে। আদিত্য মুচকি হেঁসে বলল,
“কি ভেবেছিলে আমার এঞ্জেলের হলুদ বুঝি বাকিদের মতো একঘেয়ে হবে! যেমন হলুদ আমি লাগিয়েছি তেমন, হলুদ ধুয়েও আমি দিবো। আমার পরীটার হলুদ ধোঁয়ার ব্যবস্থাও হবে পরীর দেশের মতোই।”
নূর যেন ভাষা হারিয়ে ফেলল এই মুহুর্তে। আদিত্য তারজন্য এসব কখন করলো সে’তো টেরই পেলনা। লোকটা আসলেই যাদুকর। তার যাদুর মোহনীয়তায় দ্রবীভূত হয়ে তার বুকেই ঢলে পড়ে যেন। আদিত্য তার প্রেয়সীকে নিয়ে আস্তে আস্তে ফুলের পাপড়ি ছড়ানো পানিতে পা রাখলো। পানি খুব বেশি না। হাঁটুর কিছুটা উপর পর্যন্ত হয়তো গভীরতা হবে। আদিত্য নূরকে নিয়ে পুলের মাঝে এসে পানির মাঝে পা ভাজ করে বসলো। বসার দরুন পানি তাদের পেট পর্যন্ত এলো প্রায়। নূর এখনো আদিত্যর বাহুডোরে। লাজুক মুখটা লুকিয়ে আছে তার বক্ষমাঝে। আদিত্য নূরের থুতনিতে আঙুল রেখে মুখটা সামনে তুলে ধরলো। লজ্জায় তাকানো দায় নারীর! আদিত্যর নজরে নেশার পারদ। ঘোর লাগা কন্ঠে সে বলল,
“তাকাও এঞ্জেল।”
লাজে ভরা ডাগর ডাগর আঁখি যুগল মেলে তাকালো নূর। আদিত্যর ওই মাদকতা চাহুনিতে নজর পড়তেই সর্বাঙ্গ বুঝি হিম হয়ে এলো নূরের। পাল্লা দিয়ে বাড়লো নিঃশ্বাসের গতি। আদিত্যর তীক্ষ্ণ নজর নূরের কম্পিত অধর পানে। মুখ নামিয়ে আলতো করে অধর ছোঁয়ালো নূরের কোমল অধরে। কম্পনের শিহরণে চোখ বুঁজে নিলো আবারও নূর। কাঁধ চেপে ধরল শক্ত করে। আদিত্য মাথা তুলল। হাতের তালুতে পানি নিয়ে প্রথমে নূরের গালের হলুদ ধুয়ে দিলে সযত্নে, আঙুলের আলতো স্পর্শে। চোখ বুঁজেই রইলো নূর। চাওয়ার সাহস কোথায় তার! নিঃশ্বাস ভারী হচ্ছে ক্রমাগত। মুখের পর নূরের হাতের হলুদ ধুয়ে দিলো। পা দুটো এবার টান করে শাড়ি একটু সরিয়ে আদিত্যর লাগিয়ে দেওয়া হলুদ পরিস্কার করতে লাগলো পা থেকে। নূরের বেসামাল নিঃশ্বাস বুঝি এবার আঁটকেই যাচ্ছে। আদিত্যর কাঁধে মুখ গুঁজল সে। দুই হাতে আদিত্যর দুই কাঁধ খামচে ভারী নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল সে। সেই নিঃশ্বাসের তোড় নেশার মাত্রা বাড়ালো আদিত্যর মাঝে। নূরের ভেজা অঙ্গ আর অঙ্গ থেকে আসা হলুদের সুগন্ধ মাতোয়ারা করে দিচ্ছে তাকে। সিক্ত কোমড়ে আদিত্যর হাতের বিচরণ অনুভব করলো নূর। কম্পনের মাত্রা বাড়ল তার। পরপরই কাঁধে আদিত্যর অধরের স্পর্শ পেল নূর। শিহরণে কাঁধ বেঁকে এলো তার। কোমড় চেপে আরও নিবিড় ভাবে মেশালো নিজের সাথে নূরকে।কাঁধে অধরের তীব্রতা বাড়ল। খানিক বাদে আদিত্য নূরের কাঁধ থেকে মাথা তুলে এক হাতে নূরের মুখটা সামনে ধরলো। চোখ বন্ধ তার। ভারী নিঃশ্বাস আর কম্পিত সর্বাঙ্গ। তিরতির কাঁপছে তার সিক্ত ওষ্ঠদ্বয়। ভেজা ঢোক গিলল আদিত্য। নেশায় পাগল সে। মুখ নামিয়ে মিলিত করল দু’জোড়া ওষ্ঠদ্বয়। মেতে উঠল অধরলীলার খেলায়। কম্পনে দিশেহারা নূরের সর্বাঙ্গ। হাতের মুঠোয় খামচে ধরে আছে আদিত্যর কাঁধের পাঞ্জাবি। আদিত্যর মাদকতা বাড়ছে। যেন কোনো সিন্ধুতে তলিয়ে যেতে নিমগ্ন সে। নূরযে আর পারছেনা। দম আঁটকে আসছে তার। সে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য সরে আসার চেষ্টা করলো। তখন থামলো আদিত্য। অধর যুগল আলাদা করে নূরের কপালে কপাল ঠেকিয়ে হাঁপাতে লাগল দুজনেই। নিজেকে খানিকটা ধাতস্থ করে আদিত্য বলল,
“সরি এঞ্জেল! একটু বেশিই পাগলামো করে ফেলেছি বোধহয়। কি করবো! তোমার এই মোহনীয়তা সব নিয়ন্ত্রণ ভেঙে দিচ্ছে আমার। শুধু আর এই একটা রজনীর দূরত্ব। তারপর তোমাতে বিলীন হবে আমার আমিত্ব।

চলবে….