অবেলায় এলে তুমি পর্ব-০২

0
222

#অবেলায়_এলে_তুমি🍁
#পর্ব:২
#লেখনীতে: তামান্না_ইসলাম_কথা

আশেপাশে না তাকিয়ে নিজের মতো করে শাশুড়ি আম্মার কাছে বিচার দিয়ে যাচ্ছিলাম কিন্তু পিছনে যে আমরা দুইজন ছাড়াও তৃতীয় ব্যক্তি উপস্থিত আছে সেটা খেয়াল ছিলো না। কিন্তু পিছনে ফিরতেই লোকটা দেখে রাগ বেড়ে গেলো আবারো। একে তো গতকাল সারারাত বাহিরে ছিলো এখন এসে আবার আমাকে অন্ধ বলেছে। নিজের রাগটা কোনো রকমে চেপে রেখে দিলাম।

“আম্মা আমি নিরাত্রির কাছে যাচ্ছি। আপনি আপনার ছেলেকে কি করবেন করুন।”

শাশুড়িকে কথা গুলো বলে আমি নিরাত্রির কাছে চলে আসি। মেয়েটা সেই কখন ঘুমিয়েছে।

” আম্মা এই মেয়ে যেই উড়নচণ্ডী তাতে আমার ছোট্ট পরীকে কি দেখে রাখতে পারবে আম্মা?”

তরী যেতেই নিহান মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে কথা গুলো বললো।

“খুব ভালো করেই পারবে। আমি গতকাল রাতে দেখেছি মেয়েটা কত মায়া নিয়ে আমার দিদি ভাইকে দেখছিলো। সারারাত নিজের কাছে রেখেছে। যে ভাবে আগলে রেখেছে দেখলে কেউ বলবে না যে,,,”

মায়ের কথা শুনে একটু চিন্তা মুক্ত হলেন নিহান। তবুও কোথাও গিয়ে যেনো মনকে শান্ত করতে পারছে না সে।

“নিহান!”

মায়ের সাথে কথা বলে নিজ রুমের দিকে যাচ্ছিল নিহান। হঠাৎ করে আবার মায়ের ডাকে পিছনে ফিরে তাকায়।

” তুমি বিয়ে করতে চাওনি কিন্তু আমার আর নিরাত্রির কথা ভেবেই তুমি বিয়ে করতে রাজি হয়েছো। তোমার জন্য অরিত্রিকে ভুলে যাওয়া হয়তো কষ্ট হবে কিন্তু অসম্ভব না। তরী এখনো ছোট। যেই বয়সে ঘুরে ফিরে চলার কথা সেই বয়সে সংসার সামলিয়েছে। ভুল করবে, রাগ করবে, ঝগড়া করবে, অভিমান করবে আর তোমাকে তরীকে সব কিছু বুঝিয়ে দিতে হবে। সে তোমার বিবাহিত স্ত্রী এইটা ভুলে যেও না। শুধু তোমার মেয়ের জন্য তাকে এই বাড়ির বউ করে আনা হয়নি বরং এই সংসারের হাল ধরার জন্য, প্রতিটি মানুষের জন্য তাকে নিয়ে আসা হয়েছে। তুমি নতুন জীবনে প্রবেশ করেছো নতুন একজন মানুষ এসেছে। তরী শুধু তোমার দায়িত্ব না তরী তোমার স্ত্রী। তুমি যেমন করে অরিত্রিকে মর্যাদা দিতে আশাকরি তুমি তরীকেও তার যোগ্য মর্যাদা দিবে। পুরানো অতীত মনে রেখে আশাকরি বর্তমান এবং ভবিষ্যত তুমি নষ্ট করবে না। আর হ্যাঁ গতকাল রাতে তুমি যেটা করেছো সেটা কতটা সঠিক কাজ তুমি নিজেই ভালো করে জানো। বাসার রাত প্রত্যেকটা মেয়ের জীবনের বিশেষ দিন থাকে কিন্তু তুমি ছিলে না। যাই হোক সামনে এমন আর করবে না আশাকরি। আর হ্যাঁ শুনো! বিকেলে তরীকে তৈরি হয়ে থাকতে বলবে।”

“কেনো?”

এতো সময় মায়ের কথা গুলো নিরবে শুনে যাচ্ছিল নিহান। শেষ কথাটা শুনে ব্রু জোগলের মাঝে কিংচিত ভাঁজ পাড়লো।

“তৈরি হয়ে থাকবে মানে?”

“তোমার ফুপি আসবে তরীকে দেখতে। আর তুমি আর তরী বিকেলে তরীর মামা বাড়ি যাবে।”

ফুপির কথা শুনতেই চোখ মুখ শক্ত করে নিলো নিহান। দেখেই বুঝা যাচ্ছে নিজের ফুপির আসার কথা শুনে বিন্দু মাত্র খুশি হয়নি।

“উনি আসবে কেন? কে বলেছে উনাকে এখানে আসতে? আম্মা তুমি জানো না উনি কেমন? আম্মা আমি উনি আসার আগেই তরী আর নিরাত্রিকে নিয়ে চলে যাবো। উনাকে বলে দিবে আমরা বাসায় নেই।”

কথা গুলো বলেই নিহান নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। নিহান যেতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো রৌশনা বেগম। কে বলবে এক সময় এই ছেলে ফুপির জন্য পাগল ছিলো? কিন্তু যেই দিন নিহান অরিত্রিকে বিয়ে করে নিয়ে এই বাড়ি আসলো সেই দিন থেকেই আর ফুপির নাম শুনতে পারে না। রৌশানা বেগম ফের দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্না ঘরের দিকে গেলেন। এগারোটার দিকে একটা মেয়ে আসে রান্না করার জন্য। ছোট ননদ আসবে। ঠিক সময়ে সব কিছু না শেষ হলেই তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলবে আবার।

🍁🍁🍁🍁

“তরী!”

নিরাত্রিকে খাবার খাওয়াচ্ছিলাম এমন সময় লোকটার কন্ঠ শুনে চমকে উঠলাম। পিছন ফিরে তাকিয়ে মানুষটাকে দেখে থতমত খেয়ে বসলাম। লোকটা আমার থেকে এক হাত দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটাকে পাত্তা না দিয়ে কিছুটা নড়েচড়ে বসে আবারো নিরাত্রির দিকে মন দিলাম।

“বিকেলে রেডি হয়ে থেকো।”

এবার লোকটার কথায় তার দিকে ভালো করে ফিরে তাকালাম। হঠাৎ করে রেডি হতে বলায় কোনো কিছু বোধগম্য হচ্ছে না। তাই বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম।

“তোমার মামা বাসায় যাচ্ছি আমরা। আর হ্যাঁ ফুপি আসবে হয়তো কিছু দিন থাকবে তাই তুমি তার থেকে দূরে থাকবে যত দিন না সে এই বাসা ছেড়ে যাচ্ছে। আর ভুলেও নিরাত্রিকে ফুপি বা অন্য কারো কাছে দিবে না।”

“কিন্তু কেনো? সে তো আপনার ফুপি হয়।”

“আমি যেটা বলেছি তুমি সেটাই করবে।”

বিরক্ত হয়ে প্রশ্নের উত্তর দিয়েই রুম থেকে বের হয়ে গেল লোকটা। সাধারণ একটা প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে যাওয়ার কি হলো বুঝতে পারলাম না। লোকটার কথা বেশি না ভেবে নিরাত্রির দিকে তাকাতেই দেখি মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। একজন আমার উপর বিরক্ত হচ্ছে তো আরেক জন হাসছে।

🍁🍁🍁🍁

একটা কলাপাতা রঙের শাড়ি আর শাশুড়ি আম্মার দেওয়া গহনা পরে বসে আছি ফুপি শাশুড়ির সামনে। শুধু ফুপি শাশুড়ি সামনে না বরং তার ছেলের বউ এবং মেয়ের সামনে বসে আছি পাশের সোফায় বসে আছে শাশুড়ি আর ভদ্রলোক। আর নিরাত্রি ভদ্রলোকের কোলে বসে বসে হাতের আঙ্গুল মুখে দিচ্ছে। আর ফুপি শাশুড়ি খুতিয়ে খুতিয়ে দেখছে আমাকে।

“ভাবী তুমি শেষ পর্যন্ত এমন ছোট বাচ্চা একটা মেয়ে ছেলের বউ করে নিয়ে এলে? এই মেয়ে সংসার কী সেটা আদৌওতে বুঝে? নিজেই তো একটা বাচ্চা আবার সে তোমার নাতনিকে সামলাতে পারবে ঠিক মতো? আবার বললে মা-বাবা নেই। মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছে। অনাথ মেয়ে। তা ভাবী তুমি শেষ পর্যন্ত এমন মেয়ে নিয়ে এলে? আমার মেয়েকে দেখো ! রুপে গুণে সব দিক থেকেই সুন্দর ছিলো। তোমার এই পরিবারকে দেখে রাখতে পারতো আগলে রাখতে পারতো। কিন্তু তোমাকে আর কি বলবো? তোমার তো আবার সবসময় এমন মেয়েই পছন্দ। নিহানের আগের বউ ও তো এমন ছিল। তা মেয়ে তোমার মামা-মামী তোমাকে কিছু দিয়ে পাঠাইনি? না কি এমনি খালি হাতে পাঠিয়ে দিয়েছে বড়লোক পরিবার দেখে?”

ফুপি শাশুড়ির সব কথা গুলো সহ্য করতে পারলাম না। এইদিকে নতুন বউ বলে কিছু বলতেও পারছি না। একবার আড়চোখে ভদ্রলোককে দেখলাম। ভদ্রলোকের চোখে মুখে স্পষ্ট রাগের ছাপ দেখা যাচ্ছে। এই ব্যবহারে জন্য হয়তো বলেছিল দূরে থাকতে।

“ফুপি আম্মা আপনি তো আমার স্ত্রীকে প্রথম আমাকে দেখালেন তাই হয়তো তার বিষয়ে সঠিক ভাবে কিছু জানেন না। হ্যাঁ আমি এবং আমার আম্মা দুইজনেই এমন মানুষ পছন্দ করি যাদের মাঝে অহংকার নেই, যাদের মন মানসিকতা নিচু মনের নয়, যাদের বাহ্যিক সৌন্দর্য না বরং মনের দৃষ্টি সুন্দর তাদের আমরা মা ছেলে পছন্দ করি। আর কি জানি বললেন? সংসার সামলাবে কী ভাবে? আমাদের সংসার নিয়ে ভাবতে হবে না আপনাকে। আমার সংসারের জন্য আমার মা, আমার বউ এবং আমি আছি। আপনি বরং নিজের সংসার দেখুন। শুনেছি ছেলের বউয়ের গায়ে না কি হাত তুলেন একটু ভুল হলেই। তা আপনার মা মানে আমার দাদি কি আপনাকে সব কাজ শিখিয়ে পড়িয়ে শশুড় বাড়ি পাঠিয়ে ছিলো? আপনার এই রূপবতী, গুনবতীর মেয়ের নামেও তো অনেক কিছুই শোনা যাচ্ছে আবার ফুপা না কি এই বয়সে এসে আপনাকে ছেড়ে বিদেশ পাড়ি দিতে চাচ্ছে। তা বলছি কি অন্যের সংসারের কথা না ভেবে নিজের সংসারের কথা ভাবুন কাজে দিবে।”

“নিহান একদম বেয়াদবি করবে না। ভুলে যেও না আমি তোমার ফুপি হই। দিনকে দিন ভুলে যাচ্ছ বড়দের সাথে কী ভাবে কথা বলতে হয়?”

এবার যেনো ভদ্রলোক আরো রেগে গেলেন। সে আরো কিছু বলতে যাবে তার আগে শাশুড়ি আম্মা তাকে থামিয়ে দিলেন।

“আপা আমি বা আমার ছেলে কেমন আর আমাদের পছন্দ কেমন সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। বউ দেখতে এসেছেন দেখুন ইচ্ছে হলে কয়েক দিন থেকে যাবেন তবুও আমার ছেলের বউকে নিয়ে বা আমার সংসার নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আর নিহান বরাবর চৈতিকে নিজের বোন বলে ভেবে এসেছে তাই বোনকে বোনের স্থানে থাকতে দিলেই ভালো হয়।”

নিহানের অপমানের পর রৌশানা বেগমের ঠান্ডা গলায় অপমান গুলো যেনো হজম করতে পারলেন না তিনি। রাগে যেনো ফেটে পড়ছেন।

“ভুলে যেও না এইটা আমার ভাইয়ের বাড়ি। এই বাড়িতে আমার সমান অধিকার আছে।”

“আপনাকে আর কিছু বলতে চাইছি না ফুপি আম্মা। আপনি খাবার খেয়ে চলে যাবেন সাবধান মতো। আর আমি ড্রাইভারকে বলব যেনো আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসে। আর তুমি এখনো বসে আছো কেনো? যাবে না তুমি? তাড়াতাড়ি করে আসো।””

প্রথম কথা গুলো ফুপি শাশুড়িকে বলে শেষ কথা গুলো আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেই ভদ্রলোক সদর দরজার দিকে চলে গেলো মেয়েকে নিয়ে।

“ফুপি আম্মা! আপনার মেয়ে কেমন রূপবতী সেটা তো তার হাত পা আর মুখের পার্থক্য দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আর আপনার ভাইপো তো বলেই দিলো আপনার মেয়ের গুনের কথা। কিন্তু আমাকে দেখুন আমি জন্মগত ভাবেই দুধেআলতা গায়ের রং নিয়ে জন্ম নিয়েছি। আপনাকে এবং আপনার এই রূপবতী মেয়েকে একটা টিপস্ দেয় ফ্রিতে। আপনার মেয়েকে শুধু মুখ না বরং হাতে পায়েও ঘষামাজা করতে বলবেন।”

ফুপি শাশুড়িকে কথা গুলো বলে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে আমিও সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। এখানে থাকলে আবার বেফাঁস কিছু বলে দিবো।

🍁🍁🍁🍁

“তোমাকে সব সত্যি বলা হয়নি? সম্পূর্ণ মিথ্যা দিয়ে বিয়ে হয়েছে?”

#চলবে