অবেলায় এলে তুমি পর্ব-১০

0
162

#অবেলায়_এলে_তুমি🍁
#পর্ব:১০
#লেখনীতে:তামান্না_ইসলাম_কথা

রুমে প্রবেশ করতেই আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। একটু আগে রুমটা সাদামাটা ভাবেই ছিলো। আমার রুম তেমন একটা করে সাজিয়ে রাখি না। কিন্তু এখন রুম সাজানো না হলেও মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা আছে সমস্ত রুম জুড়ে। এতো অল্প সময়ের মাঝে সমস্ত রুম জুড়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখে গিয়েছে। সমস্ত রুমে চোখ বুলিয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকাতেই আমি সেখানে থমকে গেলাম। ভদ্রলোক আমার দিকে এক দৃষ্টিতে নেশালো ভাবে তাকিয়ে আছে। লোকটার এহেন দৃষ্টিতে লজ্জার মাত্র আরো বেড়ে গেলো।

“মিসেস নিহান আর ইউ রেডি ফর মাই লাভ এন্ড রোমান্স?”

এমনিতেই লজ্জায় মরি মরি অবস্থা তার উপর আবার লোকটির এমন কথায় লজ্জা আরো বাড়িয়ে দিলো। লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে লোকটার গলা আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে মুখ ডুবিয়ে দিলাম।

“ওহে মিসেস আজকে লজ্জা পেয়ে লুকিয়ে থাকতে আমি দিচ্ছি না। আমাকে যে পাগল করে তুলেছেন আপনি। কে বলেছিল শাড়ি পড়ে বৃষ্টি বিলাস করতে?আর সাথে আমাকে কেনো যেতে বললেন? আমাকে এভাবে বেসামাল করে দিয়ে আপনি লজ্জা পাচ্ছেন? এখন আমাকে সামলানোর দায়িত্ব আপনার হাতে মিসেস নিহান। আজ আপনার সব লজ্জা আমার করে নিবো।”

শেষ কথাটা কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিস ফিস করে বললো। লোকটার লাগামহীন কথা আজ বুঝি শেষ হবে না। নিজের গালে নিজেই একটা থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করছে। কেনো যে আমি লোকটাকে বৃষ্টিতে ভিজতে বলতে গেলাম। এখন আমাকে লজ্জায় ডুবিয়ে মারছে। আর লোকটাও ইচ্ছে করে আমাকে লজ্জায় ফেলতেই যেনো বেশি করে কথা গুলো বলছেন তিনি।

🍁🍁🍁🍁

নতুন একটা দিন, নতুন একটা সকাল নতুন সব অনুভূতি। পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো‌। এখনো বাহিরে হালকা অন্ধকার বিদ্যমান। লোকটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে তবে চোখ মেলে তাকালাম না। চোখ দুটো মেলতে বড্ড অনিহা প্রকাশ করছি। বিছানা হাতড়ে কিছু একটা খুঁজতেই উন্মুক্ত শরীরে হাত লাগলো। শরীরে হাত লাগতেই ঘুম চোখ থেকে ছুটে পালালো। লোকটাকে দেখার জন্য পাশ ফিরতেই দেখি উবু হয়ে শুয়ে আছে। লোকটার দিকে পাশ ফিরে শুয়ে প্রথম বারের মতো খুঁতিয়ে খুঁতিয়ে দেখতে লাগলাম। উজ্জল শ্যাম বর্ণের অধিকারী। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি কামিয়ে রেখেছে। কপালের বাম পাশে ছোট একটা কাঁটা দাগও আছে। কোনো কিছু না ভেবেই টুপ করে ঠোঁটে চুমু দিয়ে বসলাম।

“ঘুমের সুযোগ এভাবে নেওয়া হচ্ছে? যখন সজাগ ছিলাম তখন তো পালাই পালাই করছিলেন। আর এখন ঘুমিয়ে আছি বলে সুযোগ নিচ্ছেন মিসেস নিহান। এইটা কিন্তু আমার সাথে অন্যায় করলেন আপনি।”

কথাটা বলে চোখ মেলে তাকালো নিহান। ভেবেছিলাম হয়তো ভদ্রলোক ঘুমিয়ে আছে সেই সুযোগে চুমু দিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।। কিন্তু লোকটা যে আমার সাথে বরাবর এমন করে এসেছে আমি সেটা আবারো ভুলে গিয়েছি। লোকটার কথা শুনে কাঁথা মুড়ি দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে নিলাম। লোকটার সামনে আর যাওয়া দায় হয়ে পারবে। কি কথার ছিরি।

” মিসেস নিহান এভাবে আমার সুযোগ নিলেন। আমার মানসম্মান, ইজ্জত সব লুট করে নিয়ে এখন কাঁথা মুড়ি দেওয়া হচ্ছে? আমার ইজ্জত নিয়ে এখন কাঁথা মুড়ি দিলে আমি তো মেনে নিচ্ছি না মিসেস। আমার এখন ভালোবাসা লাগবে যে।”

কথাটা বলে লোকটা মুখের উপর থেকে কাঁথা সরিয়ে দিয়ে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলেন। ধীরে ধীরে ছোঁয়ে গভীর হতে লাগলো। লোকটা আবারো বেসামাল হতে লাগলো।
ভেবেছিলাম হয়তো ভদ্রলোক কখনো অরিত্রি থেকে বের হয়ে আসতে পারবে না। আমার বুঝি স্বামীর ভালবাসা পাওয়া হবে না। অরিত্রির প্রতি রাগ হতো আবার হিংসেও হতো। মেয়েটা মারা গিয়েও দিব্বি একজনের মনে রাজত্ব করে চলেছে। মানুষটাকে তো আমার স্বামী রূপে পেয়েছি কিন্তু ভালোবাসা হয়তো কখনো পাবো না। ভালোবাসা শুধু অরিত্রির জন্য। লোকটা কিন্তু এখন লোকটার প্রতিটি ছোঁয়া যেনো বলে দিচ্ছে আমি ভুল ছিলাম। নিহানের প্রতিটি স্পর্শে আমি যেনো আমার জন্য ভালোবাসা খুঁজে পাচ্ছি। আর নিহান! নিহান নিজেও অরিত্রি থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে। নিহানের মনে নিজের জন্য ভালোবাসা তৈরি করতে পেরেছি। এই লোকটি এখন আমার। একান্ত আমার নিজের। আমার আপন, কাছের মানুষ। যার কাছে আমি আমার সব কিছু উজার করে দিতে পারি।

🍁🍁🍁🍁

সকাল দশটা। খাবারের টেবিলে বসে আছে সবাই। আমি মামী আর নতুন একজন কাজের মেয়ে রাখা হয়েছে তিন জন মিলে সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছি। জেসিকা আর সোহেল ভাইয়া খাচ্ছে কম কথা বলছে বেশি।

” হেই ইউ! আর ব্লাইন্ড? ডু ইউ হ্যাব এনি আইডিয়া হাউ মাচ কস্ট দিস ড্রেস?”

কথাটা বলেই নতুন মেয়েটাকে থাপ্পড় মারলো জেসিকা। জেসিকার এহেন কান্ডে উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। ভুল বশত সামান্য একটু তরকারি পড়ে যাওয়ায় মেয়েটাকে এভাবে থাপ্পড় দিলো?

“এই মেয়ে দেখে কাজ করতে পারিস না? তোর জন্য মেয়েটার এতো দামের জামা নষ্ট হয়ে গেলো। তোর মুরোদ আছে এই জামা’র টাকা জোগাড় করার? এখন মেয়েটার জামা নষ্ট করে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে। ফকিন্নীর ঘরে ফকিন্নী একটা। তোকে তো আরেকটা কষিয়ে থাপ্পড় দেওয়া অসভ্য মেয়ে একটা।”

কথাটা বলেই মামী মেয়েটাকে ধাক্কা দিলো। অল্প বয়সী একটা মেয়ে। কাজে ভুল হতেই পারে তাই বলে এমন ব্যবহার করবে? যেই বয়সে ঘুরে ফিরে চলার কথা সেই বয়সে পেটের তাগিদে মানুষের বাড়িতে কাজ করছে। হায়রে দুনিয়া। এখানে ক্লাস দেখে মানুষকে সম্মান করা হয়। যার দামী গাড়ি, বাড়ি আছে যার গড়নে দামি জামা কাপড় আছে তাদের সম্মান দেওয়া হয়।

“মামী তুমি মেয়েটার সাথে এমন ব্যবহার করছো কেনো? ভুল করে একটু তরকারি পড়ে গিয়েছে বলে তুমি এমন ব্যবহার করবে? আর সে তোমার বাড়িতে এমনি এমনি কাজ করতে আসেনি মামী। পেটের তাগিদ অন্যের বাড়িতে ঝিগিরি করতে হচ্ছে। তোমার কি মুরোদ আছে সঠিক সময়ে নিজের স্বামী সন্তানকে রান্না করে খাওয়ানোর? ঠিক ভাবে তো রান্না করতে দেখিনি কখনো। এন্ড ইউ জেসিকা! হু গিভ ইউ দ্যাট রাইট টু স্লাপ হ্যার? স্যে স্যরি!”

প্রথম কথা গুলো মামীকে বলে শেষ কথা গুলো জেসিকাকে বলতেই সে রাগি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো।

” হোয়াই শোল্ড আই আপোলজাইস্? ইউ ডিড নট সি মাই ক্লস্থ রুইন্ড?”

রাগি ভাবে জেসিকা আমাকে কথা গুলো বলতেই আমার উল্টো রাগ উঠে গেলো। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে করে নিলাম। একদিনের জন্য ঝামেলা করতে চাই না। সবাই মিলে আনন্দ করবো।

“আই সেইড স্যে স্যরি।”

“নো!”

জেসিকার এক রুখো জবাবে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। টেবিলের উপর থেকে তরকারির বাটি নিয়ে সেটা সম্পূর্ণ জেসিকার সাদা জামার উপর ঢেলে দিলাম। এবার নিজেকে ঠান্ডা লাগছে।

“ইউ স্টোপিড।”

“ডোন্ড ইউ ডেয়ার জেসিকা। আদারোয়াইজ!”

কথাটা বলে আবারও টেবিলের দিকে ইশারা করতেই রাগে ফুস ফুস করতে করতে সেখান থেকে চলে গেলো। বাকি সবাই খাওয়া বাদ দিয়ে হা করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।

🍁🍁🍁🍁

“কাজ হয়ে গিয়েছে স্যার। আপনি যেভাবে বলেছিলেন তেমন করেই সব কিছু হচ্ছে। আমাকে ঐ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না সব কাজ হয়ে যাবে।”

ফোনে কথাটা বলেই মেয়েটা ফোন লুকিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।
নিজের অজান্তেই নিজের সাথে বিপদ নিয়ে যাচ্ছে তরী। এই বিপদ কার কার উপর প্রভাব ফেলবে সে-ই বিষয়ে ধারণা নেই। হাস্যজ্জল পরিবারের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বাঁকা হাসলো।

“তরী সোনা তুমি জানো না তুমি কতটা বড় ভুল করলে। তুমি জানো তুমি নিজের সাথে করে সবার মৃত্যু নিয়ে যাচ্ছো। তোমাকে পাওয়ার জন্য নিজের বন্ধুকে ও মারতে আমি পিছু হাঁটব না। আর এই নিহানকে তো একদিন আমার হাতে মরতেই হতো। নিহানের জন্য আমি আমার প্রথম ভালোবাসা হারিয়েছি। এখন আবার আমি তোমাকে কোনো ভাবেই হারাতে দিবো না। তুমি শুধু আমার আর এই আমাকেই ভালোবাসবে।”

কথাটা বলেই উচ্চ স্বরে হাসতে লাগলো আয়ান। ভালোবাসার জন্য সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে গিয়েছে সে। নিজের ভাই স্বরূপ বন্ধুকেও মেরে ফেলতে পিছুপা হাঁটবে না। ভালোবাসা মানুষকে যেমন ভালো করে তুলতে পারে আবার সে-ই ভালোবাসা একটা মানুষকে খারাপের পথেও নিয়ে যেতে পারে। ভালোবাসা এমন একটা জিনিস আপনি যে পাত্রে দান করবেন সে-ই পাত্রে ভালো খারাপ দুইটাই ধারণ করবে।

#চলবে