#অবেলায়_এলে_তুমি🍁
#পর্ব:১৩
#লেখনীতে:তামান্না_ইসলাম_কথা
রাত নয়টা। হসপিটালের করিডোরে বসে বসে নিরবে কান্না করে যাচ্ছি। পাশেই শাশুড়ি আম্মা শান্তা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। পাশেই বিধ্বস্ত অবস্থায় নিহান কপালে হাত ঠেকিয়ে বসে আছে। বেচারা অফিস থেকে ছুটে এসেছে। যখন শুনেছে নিরাত্রি পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে গিয়েছে তখন আদরের মেয়ের এমন কথা শুনে চুপ করে থাকতে পারেনি। আমার ছোট মেয়েটা ব্যাথায় চিৎকার করছিলো যেটা আমার কানে এখনও থেকে থেকে বেজে উঠছে। মেয়েটা আমার যখন কোলে বসে বসে কান্না করছিল তখন আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল। আমার মেয়ে এতো কান্না কখনো করেনি। সবসময় হাসিখুশি থাকে।
” আম্মা আমার মেয়ে ঠিক হয়ে যাবে তো? ওর ছোট ছোট হাত দিয়ে আমাকে ছুঁয়ে দিবে তো? সব কিছু আমার জন্য হয়েছে। আমি যদি নিরাত্রিকে ঐশীর কাছে না দিতাম তাহলে আমার মেয়ের কিছু হতো না।”
” দিদিভাই একদম সুস্থ হয়ে যাবে। তুমি কোনো রকম কান্না করো না। আর নিজেকে দোষারোপ করবে না। এইটা একটা এক্সিডেন্ট। আর আল্লাহ আমাদের জন্য যেটা ঠিক করে রেখেছে সেটা হবেই। তুমি আমি কেউ আটকাতে পারবো না।”
কথা গুলো বলে শাশুড়ি আম্মা পাশ থেকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি এতে আরো আবেগী হয়ে কান্না করতে লাগলাম।
“উঁহু! ঢং দেখে বাঁচি না। সেই দিন তো খুব বড়ো বড়ো কথা বলছিলে ভাবী এখন কি হলো? এই মেয়ে দিলো তো নিহানের মেয়েকে মেরে। আমি বলেছিলাম বলে আমাকে কম কথা শোনাওনি তোমরা মা ছেলে মিলে। এইবার আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেলো না। সৎ মা কী আর আপন মা হয়? সৎ মা সবসময় সৎ মা-ই হয়। একটা কথা আছে তো জানো তো ভাবী! নিজের গাছের ছাল তুলে তুমি যতই অন্য গাছে লাগাও না কেন সেটা লাগবে না। খুলে পড়েই যাবে। এই মেয়ে হচ্ছে তেমনি। কচি মেয়ে, বিয়ে হয়েছে এক মেয়ের বাপের সাথে এখন নিজের সন্তান হলে সে কি সব কিছুর ভাগ সতীনের সন্তানকে দিতে যাবে? সব কিছু নিজে একাই ভোগ করবে। আমার চুল কি এমনি এমনি পাক ধরেছে না কি?”
আমাদের থেকে একটু দূরে বসে থাকা আমার ফুপি শাশুড়ি কথা গুলো বললেন। সন্ধ্যার দিকে উনি এবাড়িতে এসেছেন। আচ্ছা জন্ম দেয়নি তো কি হয়েছে? জন্ম না দিলে কী মা হওয়া যায় না? আর যারা জন্ম দেয় তারাই কি সবাই মা হয়ে উঠতে পারে? কত মা দেখেছি জন্মের পর সন্তানের প্রতি মায়া না করে সন্তানকে রাস্তায়, ডোবায়, অনাথ আশ্রম, ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে যায়। তাহলে তারা কী
কী সত্যিকার অর্থে মা হতে পারে? আবার কত সৎ মা দেখেছি যারা নিজের সন্তানের থেকেও সতীনের সন্তানকে বেশি ভালোবাসে। আর আমি প্রথম দিন থেকেই এই মিষ্টি বাচ্চা মেয়েটার প্রতি আমার মায়া চলে আসে। আমি নিজের সবটা দিয়ে নিরাত্রির মা হয়ে উঠার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমি কখনো নিরাত্রির খারাপ চাই না। সে তো আমার মেয়ে। মা হয়ে নিজের সন্তানের খারাপ চাইবো কি করে?
“ফুপিম্মা তুমি কি এখানে এইসব কথা বলতে এসেছ? আমার ছোট্ট মেয়ের করুণ অবস্থা আর তুমি এখানে আমার মা, বউকে কথা শুনাতে এসেছ? আমার মা আর বউয়ের সম্পর্কে তোমাকে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। আর যদি তোমার কোনো অসুবিধা হয়ে থাকে তাহলে তুমি এখানে থেকে যেতে পারো। তোমার মতো সুযোগসন্ধানী মানুষ আমাদের দরকার নেই।”
“তোমাদের কাছে আমি সত্যি কথা বললেই খারাপ হয়ে যায়। তোমাদের ভালো কি আমি চাইতে পারবো না? আর ভুলে যেও না আমার আর নিরাত্রির শরীরের একই পরিবারের রক্ত বয়ে চলেছে।”
নিহানের কথার উত্তরে কথা গুলো বললো নিহানের ফুপি আয়েশা বেগম। একে তো মেয়ের এই অবস্থা তারওপর ফুপির এইসব কথা সহ্য করতে পারলো না নিহান।
“তোমার এমন ভালো চাইতে হবে না। আর তোমার মতো বেইমান, লোভী, সুযোগসন্ধানী মানুষের রক্ত আমার এবং আমার মেয়ের শরীরের আছে এইটা আমার জন্য অভিশাপের থেকে কোনো অংশে কম না। আর তোমার যেই বয়স হয়েছে তাতে আর কিছু দিন পর ওপারে চলে যাবে। এখন এইসব কুটনামী না করে আল্লাহর জিকির করো। পরপারে কাজে দিবে।”
কথা গুলো বলেই নিহান স্থান ত্যাগ করলো। আরেকটু কিছু বললেই এই হসপিটালে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিতো সে। যখন নিহানের বাবা মারা যায় আর রৌশানা বেগম একা একা সমস্ত কিছুর দেখভাল করছিলেন তখন আয়েশা বেগম নিজের আসল রূপ দেখিয়েছেন। নিহান তখন না বুঝলেও ফুপির প্রতি অন্ধ ভালোবাসা ছিলো কিন্তু যখন বুঝতে পেরেছে এবং অরিত্রির সাথে ঘৃণ্য কাজ করার পরিকল্পনা করেছিল তখন থেকেই ফুপির প্রতি নিহানের মনে ঘৃণা সৃষ্টি করে।
🍁🍁🍁🍁
” স্যার আপনি এসেছেন! প্লিজ স্যার আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন। নিহান আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে স্যার। নিহান আমাদের বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ কালেক্ট করেছে। আমাদের প্লিজ স্যার এখান থেকে বের করে নিয়ে চলুন। আমরা বাঁচতে চাই স্যার। আমরা তো স্যার সব কিছু আপনার কথা মতো করেছি। প্লিজ সেভ আস্ স্যার।”
নিজের সামনে বসে থাকা লোকটাকে মিনতির কন্ঠে কথা গুলো বললেন ডঃ. সেন। কিন্তু লোকটি কিছু না বলে চেয়ার টেনে বসলো।
” সেভ করবো ডঃ. সেন। আপনি আমার কাজ করে দিয়েছেন আমি আপনার জন্য এইটুকু করব না? অবশ্যই আমি আপনাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাবো। কিন্তু ডঃ. সেন আপনি কি নিহানকে সব সত্যি বলে দিয়েছেন? কে এই সব কিছুর মাস্টার মাইন্ড?”
“না স্যার আমি নিহানকে কিছু বলিনি। আমাকে নিয়ে চলুন স্যার। নিহান এই কয়েক দিন আমার উপর অনেক অত্যাচার করেছে?”
“বলেছি তো আমি নিয়ে যাব কিন্তু আমাকে জানতে হবে নিহান কিসের ফাইল নিয়ে এসেছিল? আর কতটুকু জানতে পেরেছে আমার সম্পর্কে?”
কথা গুলো বলেই লোকটা ডঃ. সেন এর দিকে কিছুটা ঝুঁকে বসলো। চোখে মুখে হাজার কৌতুহল। কিন্তু ডঃ. সেন কিছু না বলে শুধু নিজেকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যেতে বললো। ডঃ. সেন এর কথায় লোকটা বড্ড বিরক্তবোধ করলে চেয়ারের সাথে ডঃ. সেন এর মাথায় বারি দিলেন।
“আমার এক কথা বারবার বলা পছন্দ না। আমি যখন বলেছি নিয়ে যাবো তখন তোর বোঝা উচিত ছিল আমি নিয়ে যাবো। কিন্তু তুই আমার মাথার পোকা নাড়িয়ে দিলি এক কথা বলে। নিহান যদি তোকে নাও মারে আমি নিজেই তোকে মেরে দিবো। আমি আমার পথের কাঁটা কাউকে রাখবো না।”
কথা গুলো বলে আবারও টেবিলের সাথে সজোরে মাথায় আঘাত করলেই ড. সেন সেখানেই ঢলে পড়ে যায়। ডঃ. সেন এর পড়ে যাওয়ার পরেও লোকটা শান্তি পাচ্ছিল না তাই আবারো কত গুলো লাথি দিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।
🍁🍁🍁🍁
রাত সাড়ে বারোটা। হসপিটালে বর্তমান আমি, আম্মা, নিহান আছি। ফুপি শাশুড়ি তখনই চলে গিয়েছে। বেশি অপমান সহ্য করতে না পেরে বিদায় হয়েছে। নিরাত্রিকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে একটু আগে। মাথায় বেশি আঘাত পাওয়ার ফলে মাথায় থেকে রক্ত বের হয়। যার দরুন রক্ত দিতে হয়েছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, নিহানের সাথে নিরাত্রির রক্তের গ্রুপ মিলেনি। হসপিটাল থেকেই রক্তের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু এইটা এখন কেউ ঘাটে নি। সর্ব প্রথম নিরাত্রিকে সুস্থ দেখা বেশি প্রয়োজন। নিরাত্রি আমাদের জান। নিরাত্রিকে কেবিনে শিফ্ট করার পর পর নিহান কোথায় একটা গিয়েছে এখনো আসেনি। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে মেয়েটার ছোট মুখখানি শুকিয়ে আরো ছোট হয়ে গিয়েছে। দেখে আরো মায়া হচ্ছে।
” তরী, আম্মা তোমরা খাবার গুলো খেয়ে নাও। এখনো তো কিছু খাওনি।”
হাতে থাকা খাবারের প্যাকেট রাখতে রাখতে কথা গুলো বললো নিহান। আমি একবার নিহানের দিকে তাকিয়ে আবারো নিরাত্রির মুখে হাত বুলিয়ে দিলাম। নিরাত্রির ব্যাপারে কিছু শুনলেই নিহানের অবস্থা করুণ হয়ে পড়ে। কিন্তু এখন নিহান শান্ত হয়ে আছে। যেমন করে ঝড় আসার আগে পরিবেশ শান্ত এবং গুমোট হয়ে থাকে নিহান তেমন শান্ত হয়ে আছে।
” নিহান তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে। এখান থেকে বাহিরে চল। নিরাত্রি ঘুমাচ্ছে, কথার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যাবে।”
কথা গুলো বলে শাশুড়ি আম্মা আগেই কেবিনের বাইরে চলে গেলো আর নিহান নিরাত্রির পাশে এসে কপালে চুমু খেয়ে আমার গালে হাত রেখে চলে গেলো। আর আমি মা ছেলের এমন কাজে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কি এমন কথা বলবে যেটা আমার সামনে বলা যেতো না।
” নিহান তুই কি একবার ভেবে দেখেছি তোর সাথে নিরাত্রির রক্ত কেনো মিললো না? তুই তো নিরাত্রির জন্মদাতা পিতা তাহলে তোর রক্ত কেনো মিললো না? আর ঐশী মেয়েটা কেমন জানি অদ্ভুত মেয়ে। যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা শুনে। মেয়েটাকে দেখে ছোট এবং পোশাকআশাক দেখে মনে হয় গরীব। কিন্তু মেয়েটার কথার ধরনে তেমন ভাবে প্রকাশ করে না।”
“মা আমার এখন এইসব ভাবার সময় বা ইচ্ছে কোনটাই নেই। আমি শুধু আমার মেয়েকে সুস্থ, প্রাণ তাজা দেখতে চাই। মা নিরাত্রি আমার আর অরিত্রির শেষ স্মৃতি। রক্ত চাই মিলোক বা না মিলোক নিরাত্রি আমার মেয়ে। আমার আর অরিত্রির মেয়ে।”
মায়ের উদ্দেশ্যে কথা গুলো বলে নিহান হসপিটালের বাইরে চলে গেলো। মায়ের বলা কথা গুলো ফেলে দেওয়ার মতো না। তবে এখন সে নিরাত্রিকে সুস্থ চায়।
#চলবে