#অবেলায়_এলে_তুমি
#পর্ব:১৫
#লেখনীতে: তামান্না_ইসলাম_কথা
নিহানের কথা মতো রুমে চলে এলেও আমি নিজেকে শান্ত করতে পারছিলাম না। এইদিকে নিহানকে বলা হয়নি ঐশী লাপাত্তা আবার শাশুড়ি আম্মা নিজের রুম লক করে দিয়েছে। সব কিছু কেমন জানি গোলমেলে ঠেকছে। শাশুড়ি এবং ঐশীর নামক ঝামেলাকে এক পাশে রেখে নিজেকে স্থির করলাম অরিত্রির ছবি খুঁজে বের করার জন্য। কিন্তু কোথায় থেকে শুরু করবো আর কিভাবে শুরু করবো কিছুই মাথায় আসছে না। নিহানের রুমে থাকতে পারে ভেবে এখানে থেকেই শুরু করার চিন্তা করলাম। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে না, “যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই। পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রত্ন।” কথাটা মাথায় রেখে আমিও নিজের মতো করে খুঁজতে শুরু করলাম। আলমারি, ড্রয়ার সব কিছু খুঁজে হয়রান হয়ে গেলাম কিন্তু রুমে কিছুই নেই। পরক্ষনেই আমার মনে হলো, আমি সব কিছু দেখলেও বেড সাইড ড্রয়ার চেক করা হয়নি সেটাই লক করা বলে। ড্রয়ারের চাবি খুঁজতে আবারো আলমারির খুলে খুঁজতে শুরু করলাম।
” কি খুঁজে চলেছ তুমি তরী? যার জন্য তুমি আমার উপস্থিতি টের পেলে না?”
খোঁজাখুঁজির এক জায়গায় গিয়ে কারো কন্ঠের স্বর শুনে চমকে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি নিহান দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। নিহানকে এইসময় এখানে দেখে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হলো। ভেবেছিলাম হয়তো আম্মার সাথে কথা বলে সেখান থেকেই চলে যাবে কিন্তু নিহান যে আবার ফিরে আসবে বুঝতে পারিনি।
” মানে আসলে! আসলে! মামা যে একটা মায়ের বক্স দিয়েছিল না সেটাই খুঁজে চলেছি। মায়ের কথা মনে পড়ছিলো খুব।”
কথাটা বলেই আলমারি আবারো আগের মতো লক করে দিলাম। নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে নিহানের দিকে হাসিমুখে দাঁড়ালাম।
” আম্মার কাছে একটু পরে যেও। আম্মার একটু একা থাকতে চাচ্ছে। নিরাত্রির আর আম্মার খেয়াল রেখো ওকে!’
“তরী!”
“হুম!”
কথাটা বলেই নিহান রুম থেকে বের হতে যেও আবার পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ডেকে উঠলো। আমিও জবুথবু হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম আর নিহান আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো।
” যখন মিথ্যেকে ভালো করে নিজের আয়ত্তে আনতে পারবে তখন মিথ্যে কথা বলিও কেমন?”
কথা গুলো বলে চুপচাপ রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলেন তিনি। আর আমি সেখানেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। আজকের মিথ্যে যেমন ধরে নিতে পেরেছে সে-ই দিনের মিথ্যেও তাহলে ধরে নিয়েছিলো। তাহলে আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না কেনো? সবাই কেমন জানি অদ্ভুত ব্যবহার করে চলেছে। মাথায় হাজার প্রশ্নের উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে কিন্তু কোথাও উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় শেষ হবে এই সব কিছুর।
🍁🍁🍁🍁
রাত দুইটা। ” সুখবিন্দর নিবাস” এর প্রতিটি সদস্য অতল ঘুমিয়ে আছে। সোডিয়ামের আলোয় ঘুমন্ত শহরকেও আলোকিত করে তুলেছে। রৌশানা বেগম আর তরীর কাছে আসেনি। নিরাত্রির হালকা জ্বর করাই তরীও আর সুযোগ পাইনি রৌশানা বেগমের কাছে যাওয়ার। নিরাত্রিকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেও মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। দারোয়ান চেয়ারে বসে ক্যাত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। “সুখবিন্দর নিবাস” এর সামনে একজন কালো হুডি পড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখে মাস্ক পরিহিত একজন মেয়ে। মুখে মাস্ক থাকায় মেয়ের চেহারা ঠিক ভাবে বোঝা যাচ্ছে না শুধু চোখ দুটো ছাড়া। মেয়েটি হাতে থাকা রুমালে ক্লোরোফর্ম মিশিয়ে নিয়ে ঘুমন্ত দারোয়ানের নাকে চেপে ধরে। দারোয়ান অচেতন হয়ে পড়তেই তার পকেট থেকে চাবির গোছা নিয়ে তালা খুলে ভিতরে ঢুকে গেলো।
মেয়েটি বাড়ির ভিতর ঢুকে ড্রয়িংরুমের প্রতিটি জিনিস ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগলো। বাড়ির প্রতিটি কোণায় কোণায় নিজের হাত দিয়ে স্পর্শ করতে লাগল কোনো সমস্যা ছাড়াই। ড্রয়িংরুম থেকে বের হয়ে মেয়েটা একে একে করে নিচের সব জিনিস ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে কিচেন থেকে ছু*ড়ি নিয়ে উপরের দিকে চলে যায়। কোনো দিক না তাকিয়ে মেয়েটি সোজা নিহানের রুমের দিকে চলে যায়। মেয়েটির এমন স্বাভাবিক ভাবে এই বাড়ির প্রতিটি জিনিস এবং রুমে প্রবেশ করতে দেখে মনে হচ্ছে, এই বাড়ির প্রতিটি কোণা তার চেনা।
” তুমি লাক খুব খারাপ তরী নিহানের মতো একজন নরপশুর সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে। যে নিজেকে তো সবার সামনে ভালো, মহান, জেন্টেলম্যান হিসেবে উপস্থিত করে। কিন্তু তুমি যখন নিহানের আসল রূপ দেখবে, পাপের কারসাজি দেখবে, কি ভাবে একটা পরিবারকে নিঃস্ব করে দিতে পারে সেই সব যখন তোমার সামনে আসবে তখন তোমার এই জেন্টেলম্যান স্বামীর প্রতি ভালোবাসা থাকবে তো? আচ্ছা তরী তুমি কি জানো অরিত্রির সাথে নিহানের সব সম্পর্কের কথা? তুমি কি নিহানের আসল পরিচয় জানো? তুমি বড্ড বোকা তরী! বড্ড বেশি বোকা। সুন্দর চেহারার পিছনে যেই কুৎসিত মানুষ লুকিয়ে আছে যেটা তুমি এখনো জানো না তরী। যখন এই বাড়িতে তোমার প্রয়োজন শেষ হয়ে আসবে তখন তোমাকেও মেরে গুম করে দিবে। এই বাড়ির প্রতিটি মানুষের নিজস্ব আলাদা রূপ দেখে আবার ভয় পেয়ে যেও না তরী।”
কথা গুলো বলে মেয়েটি নিরাত্রির পাশে এগিয়ে গেলো। ঘুমান্ত নিরাত্রিকে চুমু খেয়ে সোজা হয়ে একবার রুমের প্রতিটি জিনিস ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে থাকে।
ডিম লাইটের আলোয় রুমে হালকা আলোর ছড়াছড়ি। কিন্তু সেই আলোয় বারবার সেই আলোর মাঝে কিছু একটা পড়েই চোখে একবার আলো তো একবার অন্ধকার হয়ে আসছে, যা ঘুমের সমস্যা সৃষ্টি করছে। পাশাপাশি কিছুর খচখচ করার শব্দ কানে বিঁধছে। কোনো ইচ্ছে করছে না দুচোখ মেলে দেখতে। কিন্তু খচখচ শব্দ যেনো আমার ঘুম কেড়ে নিচ্ছে। ঘুম জড়ানো চোখে কোনো রকম তাকিয়ে থমকে গেলাম। সামনে চেয়ারে বসে কেউ একজন অনবরত আমার কাগজে কিছু একটা লিখে চলেছে যার শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে। এতো রাতে রুমের ভিতর অচেনা একজন মানুষ দেখে আমার কি ভাবে রিয়াক্ট করা উচিত সে-ই কথা জেনো ভুলে গেলাম। কে বা কিভাবে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করেছে তা-ও জেনো মাথায় আসছে না।
” কে! কে ওখানে? আপনি কথা বলছেন না কেনো? এতো রাতে আপনি এই বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলেন কি ভাবে? দারোয়ান চাচা আপনাকে এতো রাতে ভিতরে আসতে দিয়েছে কি করে?”
ভয়ে ভয়ে কথা গুলো বলে সামনে তাকিয়ে রইলাম। আমার কন্ঠ শুনে হাতের লেখা থামিয়ে দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। আগুন্তক যতটা এগিয়ে আসতে লাগলো আমি ভয়ে ততটা কুঁকড়ে যেতে লাগলাম।
“আপনি! আপনি এই ভাবে এগিয়ে আসছেন কেনো? দূরে থাকবেন আমার থেকে। আপনি কাছে আসবেন না! আমি কিন্তু চিৎকার করবো। আপনি আর আসবেন না। আম্….”
চিৎকার করে উঠার আগেই আগুন্তক কিছু একটা দিয়ে মাথায় আঘাত করতেই আমি সেখানেই ঢলে পড়ি।
“স্যরি তরী আমার কোনো ইচ্ছে ছিলো না তোমাকে আঘাত করার। কিন্তু তুমি একটু বেশি বলে দিচ্ছিলে তার জন্য আমাকে এই কাজ করতে হলো।”
কথাটা বলে যে ভাবে এসেছিল তেমন করেই আবারো চলে গেলো। কিন্তু যাওয়ার আগে যদি একটু ভালো করে লক্ষ্য করত তাহলে হয়তো নিজের রাত থেকে পড়া রক্ত টেবিলের উপর খেয়াল হতো।
🍁🍁🍁🍁
সকাল দশটা বেজে ছয় মিনিট। এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে “সুখবিন্দর নিবাস” এর প্রতিটি সদস্য। রৌশানা বেগম হাই ডোজের ঘুমের ঔষধ খাওয়ার ফলে এখনো ঘুমিয়ে আছেন আর তরী গতরাতে মাথায় আঘাতের ফলে এখনো অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। এই দিকে নিরাত্রি ঘুম থেকে উঠে কান্না শুরু করে দিয়েছে অনেক আগে থেকেই। কাজের খালা একবার এসে রৌশানা বেগম আর তরীকে ডেকে গিয়েছেন। কিন্তু কারো কোনো রেসপন্স না পেয়ে নিজের মতো রান্না করে নিয়েছে। অপর দিকে ঐশী নিজেও সকাল সকাল বাড়ি চলে এসেছে। ঐশী এসে নিরাত্রিকে কান্না করতে দেখে আবারও নিজের কাছে নিয়ে নিয়েছে।
” সব সম্পর্ক যেমন সত্যি হয় না তেমনি চোখের দেখাও সবসময় সঠিক হয় না। কিছু সম্পর্ক আড়ালে বেড়ে উঠে আবার কেউ কেউ জন্ম না দিয়েও মা হয়ে উঠে। নিজের সন্তানের খুনিকে নিজের বলে দিতেও পারে। রক্ত কখনো এক হয় না তেমনি বাবার নাম দিলেই বাবা হওয়া যায় না। মাঝে মাঝে চোখের ভুল, মিথ্যা সম্পর্ক এবং মিথ্যার চাদরে সম্পর্ক গড়ে উঠে সত্যিকে লুকাতে।”
#চলবে