#অপ্রিয়_মাস্টার
পার্ট [১০]
#লেখিকা_ফারহানা_নিঝুম
সূর্যের তেজস্ক্রিয় রশ্মি পর্দা ভেদ করে মুখে উপছে পড়ছে কন্ঠের,নাক মুখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে নেয় সে। উঠতে গিয়েও পারল না, মনে হচ্ছে ভারী কিছু ওর উপর রাখা আছে, পিটপিট চোখে তাকায় সে। মূহুর্তের লজ্জারা এসে ভিড় জমায় তার গালে।
তূর্য বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, শরীরের পুরোটা ভার যেন তার উপর ছেড়ে দিয়েছে। কন্ঠ নড়ে চড়ে উঠলো, তার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে পড়ে তূর্য, হঠাৎ কন্ঠ কে সামনে দেখে কিঞ্চিৎ চমকে উঠে, কিন্তু তা বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না। বিছানা থেকে উঠে বড় বড় পা ফেলে ওয়াশরুমে চলে যায় সে, কন্ঠ বেশ কষ্ট করে বিছানা থেকে উঠে বসতেই টুং টুং শব্দ করে ফোন বেজে উঠলো,স্ক্রিনে জল জল করছে সানের নাম্বার। ঠোঁট কা’ম’ড়ে ধরে কন্ঠ,ওরা যদি কিছু জিজ্ঞেস করে তাহলে কী বলবে? ইস্ কী লজ্জা।বেজে বেজে কেটে যায় কল, আবার ফোন করে সান, কিন্তু কন্ঠ ইচ্ছে করেই ধরলো না উপরন্তু ফোন বন্ধ করে সাইড টেবিলে রেখে দেয়।
” যা ফোন বন্ধ করে দিল?”
সানের চুপসে যাওয়া মুখখানি দেখে সবাই হুঁ হুঁ করে হেসে উঠল,সোহা ধমক দিয়ে বলল।
” এবার চল ক্লাসে যাই।”
সবাই ক্লাসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসে আছে কন্ঠ, ভীষণ ভ’য় হচ্ছে তার। কিছুক্ষণ আগেই তূর্য তাকে ওয়াশরুম পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসেছে, এরপর প্রয়োজনীয় সব কিছু দিয়েছে।কোমড়ে এত ব্যথা নিয়ে শাড়ি পড়া একদম সম্ভব নয়,তাই তূর্য কন্ঠ কে সালোয়ার কামিজ এনে দিয়েছে। সেগুলো পড়ে চুপচাপ বসে আছে সে, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না তূর্য খান তার স্বামী।
দরজায় টোকা পড়তেই সেদিকে খেয়াল করে কন্ঠ।
” ভাবী ভেতরে আসবো?”
হঠাৎ নূরের গলা শুনে একটু নড়ে চড়ে বসল কন্ঠ, নূর তূর্য খানের ফুপাতো বোন, বিয়ে উপলক্ষে দু দিন হলো এসেছে। কন্ঠ আলতো স্বরে বলল।
” এসো।”
নূর অধর টেনে সৌজন্য মূলক হাসি উপহার দেয় কন্ঠ কে,হাতে একটা ডালা নিয়ে কন্ঠের পাশে ফট করে বসে পড়ে।
” ভাবী এই যে শাড়ি তাড়াতাড়ি তৈরি করতে বলেছে মামী, কিছুক্ষণ মেহমান আসবে তোমাকে দেখতে।”
কন্ঠ নূরের দিকে তাকিয়ে আছে নির্নিমেষ, নূর আবারো হেসে বলল।
” চলো ভাবী আমি তোমাকে সাহায্য করছি।”
কন্ঠ ফট করে বলে উঠলো।
” না না আমি পারব।”
নূর কন্ঠের আঁতকে উঠার কারণ আন্দাজ করতে পারল না।
” কেন কী হয়েছে ভাবী?”
কন্ঠ থতমত খেয়ে বলল।
” না তেমন কিছু না, আমি পারব।”
নূর স্ফীত হেসে বলল।
” কিন্তু ভাইয়া তো বলল তোমার সাহায্যের প্রয়োজন, তোমার না কী কোমড়ে ব্যথা?”
চমকে উঠে কন্ঠ,লোকটা সব বলে দিল? ইস্ এখন নূর কী ভাববে?
এটা ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে কন্ঠের গাল, অতঃপর নূর কন্ঠের গালে এক হাত দিয়ে বলল।
” লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই,দেখো সম্পর্কে আমি তোমার ছোট কিন্তু বয়সের দিক দিয়ে বড়, আমি জানি কেন তোমার অস্বস্তি লাগছে, তাই আমি সব বুঝতে পারি। আচ্ছা ঠিক আছে আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।”
নূর বের হয়ে যায়, কন্ঠ লজ্জায় লাল টমেটোর মত হয়ে গেছে, মনে মনে তূর্য কে যা ইচ্ছে বকা দিচ্ছে, এভাবে লজ্জা পেতে হচ্ছে।
গৌধূলীর সন্ধ্যা, পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢলে পড়ছে,পাখিরা কিচিরমিচির শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে নিজেদের বাসায়।ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে কন্ঠ,এই সময় প্রায়ই সে ছাদে যায়।আজও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। হঠাৎ বলিষ্ঠ দুটি হাত কন্ঠ কে আঁ’ক’ড়ে ধরল,শ্বাস নিতে ভুলে গেলো যেন মূহুর্তের মধ্যে। হৃদয় স্পন্দন বেড়ে গিয়েছে, নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়ায় কন্ঠ।কেউ একজন থুতনি ঠেকায় কন্ঠের ঘাড়ে। মানুষটিকে দেখা মাত্র যেন চমকে উঠে কন্ঠ।
” কী করছেন আপনি স্যার?”
তূর্যের কোনো ভাবান্তর নেই, নিশ্চুপ হয়ে জড়িয়ে ধরে আছে কন্ঠ কে। কন্ঠ আগের ন্যায় ভয়ার্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠে।
” কী করছেন?প্লীজ সরুন?”
তূর্য যেন নিজের বলিষ্ঠ হাতের বাঁধন মূহুর্তে দৃঢ় করে নেয়।
” বিয়ে হয়েছে রাইট?ইউ আর মাই লিগ্যাল ওয়াইফ?”
ওয়াইফ শুনে গাল গরম হয়ে উঠে কন্ঠের, ওনাকে একদম অচেনা লাগছে।এই সেই প্রফেসর যে কী না কলেজের সবচেয়ে গম্ভীর মানুষ।আর আজকে তার এমন আচরণ?
তূর্য নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় কন্ঠ কে,তখনো কন্ঠ নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ওনার চোখে চোখ রাখার সাহস হচ্ছে না একদম,তার কারণ একটা সময় উনি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন আর এখন স্বামী। কতশত অনূভুতি জড়িয়ে আছে এক স্বামী শব্দের সাথে। তূর্য শাহাদাত আঙ্গুলের সাহায্যে মুখ খানিকটা উপরে তুলে কন্ঠের,চোখ মুখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে নেয় সে। তূর্য শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে আলতো ভাবে কন্ঠের গালে কপালে ছুঁয়ে দিচ্ছে। কচ্ছপের গতিতে ঠোঁট স্পর্শ করতে যাবে তখন আশেপাশে আজানের ধ্বনি শুনতে পায় কন্ঠ,ফট করে চোখ খুলে তাকালো। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে বলল।
” আজান দিচ্ছে, নামাজ পড়তে হবে।”
কথাটা বলে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার মত করে চলে গেল কন্ঠ, কিছু বলার সুযোগ দিল না তূর্য কে। তূর্য কপাল চুলকে এক তাকিয়ে থাকে কন্ঠের যাওয়ার পথে।
ফোন হাতে নিতেই দেখলো তনয়া আহমেদ ফোন করেছে কন্ঠ কে,স্ফীত হাসলো সে। না আজ আর কল করবে না,কাল গিয়ে একে বারে অবাক করে দেবে সবাই কে।
ফোন রেখে মাত্র ওয়াশরুমে যাবে তখনী নূর এসে জানান দিল শাহিনা খান ওকে ডাকছে।আর সাথে এটাও বলল যাতে মাথায় ভালো করে আঁচল দিয়ে তার পর যেনো যায়।
কন্ঠ ফুস করে শ্বাস নিয়ে শাড়িল আঁচল মাথায় দিয়ে ড্রয়িং রুমে যায়, সোফায় বসে আছেন শাহিনা খান, ওনার পাশেই বসেছে শাহিন খান এবং ঐশী রহমান।
ঐশী বারংবার আড় চোখে তাকাচ্ছে কন্ঠের দিকে। কন্ঠের পাশে দাঁড়িয়ে আছে নূর, মুখে তার স্বভাব সুলভ হাসি ঝুলে আছে।
অহনা খান চায়ের ট্রে তুলে দিলেন শাহা খানের হাতে।উনি ট্রে এনে সেন্টার টেবিলের উপর রেখে সাইটে গিয়ে দাঁড়ায়।
শাহিনা খান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল।
” দেখো বড় নাত বউ বাপের বাড়ি যাইতেছো ঠিক আছে কিন্তু বেশী থাকতে পারবা না কইয়া দিলাম।কাল যাইবা,বিকালেই যেন বাড়িতে দেখতে পাই।”
মূহুর্তে মুখ চুপসে গেল কন্ঠের, মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য যাবে?অহনা খান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে শাহিনা খান কে বললেন।
” আম্মা এটা কী বলেন?মেয়েটা দু দিন পর যাচ্ছে নিজের বাড়ি একটা দিন থাকবে না?”
শাহিনা খান অহনা খান কে ধমক সহকারে বলে উঠেন।
“দেখো বড় বউ তুমি এসব কইয়া কইয়া ওদের পা বাড়াতে সাহায্য কইরো না বললাম? ঠিক আছে একটা দিন থাকতে পারবো কিন্তু সকালেই যেন বাড়িতে দেখার পাই?”
কন্ঠ এদিক সেদিক মাথা নাড়ল,শাহিনা খান লাঠির সাহায্যে উঠে দাঁড়াল। শাহিন খান মায়ের হাত ধরে ওনাকে ঘরে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।
______
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে নীলা, সকালের এই পরিবেশ ভীষণ ভালো লাগে তার। বলিষ্ঠ দুটো হাত নীলার কো”ম’ড় চেপে ধরে,আবেশে চোখ বুজে নেয় নীলা।সাফিন নীলার ঘাড়ে মুখ গুজে বলল।
” আই লাভ ইউ।”
নীলা নৈঃশব্দ্য হেসে জবাব দেয়।
” আই লাভ ইউ ইনফিনিটি। এবার গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে অফিস যেতে হবে তো?”
সাফিন মাথা চুলকে বলে।
“যেতেই হবে?”
নীলা চোখ পাকিয়ে বলল।
” এখানে কেন পাঠানো হয়েছে? এভাবে বললে কিন্তু আমি ফোন করে বাড়িতে সব বলব।”
সাফিন ঠোঁট কা’ম’ড়ে ধরে,ওর চাওনি অন্য কিছু ইশারা করছে,নীলা দু কদম পিছিয়ে যায়।সাফিন হেসে বলে।
” এখনও লজ্জা পাও?”
নীলা মুখ বাঁ’কিয়ে বলল।
” আপনি কি যাবেন? এমনিতেই রাতে আমাকে ঘুমাতে দেন না এখন আবার দুষ্টুমি।”
সাফিন আবার নীলা কে আলতো হাতে আলিঙ্গন করে বলে।
” আমার বউটা এত্ত মিষ্টি, তাহলে তাকে ছেড়ে কী ভাবে থাকি বলো তো?কাছে না এনে ঘুমানো যায়?”
“উফ্ ছাড়ুন তো, এখন যান।”
সাফিন ওয়াশরুমে চলে যায়,নীলা ওয়াড্রফ থেকে জামা বের করে রাখে।
আধভেজা অবস্থায় ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঝেড়ে নিচ্ছে তূর্য, কন্ঠ রুমে ঢুকেই ওমন একটা দৃশ্য দেখে চমকে উঠে।চোখ দুটো খিঁচিয়ে বন্ধ করে নেয়, তূর্য ঠোঁট কা’ম’ড়ে হাসে। তার এমন হাসির কারণ বোধগম্য হয়না কন্ঠের,গা জ্ব’লে যাচ্ছে ওর।
জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় কন্ঠ, কামিজ আর সাথে প্লাজু পড়ে নেয় কন্ঠ, বেরিয়ে আসতেই আরেক দফা চমকে উঠে। তূর্য বই খাতা নিয়ে বিছানার উপর বসে আছে,মনে হচ্ছে যেন কারো জন্য অপেক্ষা করছে। কন্ঠ কিঞ্চিৎ ভ’য় নিয়ে জিজ্ঞাস করে।
” সস্যার এই বই খাতা গুলো বিছানায় কেন?কী হবে?”
তূর্য সরু দৃষ্টি নিক্ষে’প করে কন্ঠের দিকে, অতঃপর খাতার পে’জ উল্টো বলে।
” পড়া হবে আর কী?বই খাতা নিয়ে মানুষ কী করে?”
কন্ঠ জিহ্বা দিয়ে ঠোঁ’ট ভিজিয়ে বলল।
” কিন্তু কে পড়বে?”
তূর্য খাতা রেখে পুরোপুরি দৃষ্টি দেয় কন্ঠের দিকে।
” এগুলো কার?”
“আমার।”
” তাহলে অবশ্যই তুমি পড়বে।”
“নাআআআ।”
_______
বেলকনিতে একা কী দাঁড়িয়ে আছে তুফায়েল, দুটো বোন চলে গেল,ওরাই তো আগে পুরো বাড়ি মা’তিয়ে রাখতো।
স্ফীত হাসে তুফায়েল,ঘাড়ে কারো হাতের স্পর্শ পায়,পিছন ঘুরে দেখে আনিকা আহমেদ দাঁড়িয়ে আছে।
” বাবা আর কত?”
তুফায়েল দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল।
” যত দিন বেঁচে আছি।”
নিজের কর্মের জন্য নিজেকে দোষ দিতে ইচ্ছে করছে আনিকা আহমেদ, সত্যি আজ ওনার জন্য সব কিছু উল্টো পাল্টা হয়ে গিয়েছে । সত্যি যদি সেদিন ছেলে কে ওভাবে জোর না করলে হয়ত আজ অন্য কিছু হতো। কথা টা ভাবা মাত্র চোখ দুটো ভিজে গেছে অনুভব করল আনিকা আহমেদ।
তুফায়েল আকাশের দিকে এক নজর দেখে বলল।
” কাল তো কন্ঠ আর তূর্য আসবে তাই না? পরের দিন আমার ফ্লাইট মা, মালয়েশিয়া যেতে হবে।”
কিয়ৎক্ষণের জন্য থমকে গেল।
” কী বলছিস এসব?”
” হুম মা, কাল ছিল ফ্লাইট কিন্তু বোন আসবে কী করে রেখে যাবো?তাই পরের দিন টিকিট বুকিং করেছি।”
আর কিছু বলল না আনিকা আহমেদ, নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন, কিন্তু তুফায়েল ঠিক সেই আগের মতই বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রইল।
চলবে………….. ✨।