অপ্রিয় মাস্টার পর্ব-৩৪ এবং শেষ পর্ব

0
260

#অপ্রিয়_মাস্টার
পার্ট [৩৪](অন্তিম পর্ব)
#লেখিকা_ফারহানা_নিঝুম

পিটপিট চোখ করে তাকায় কন্ঠ, ডক্টর বাইরে এসে আপডে’ট জানালো কন্ঠ ঠিক আছে।চাইলে ওর সাথে দেখা করতে পারবেন।
স্বস্তি পেলো তূর্য,ছুটে গেলো কেবিনে। সাদা রঙের চাদর গায়ে দেওয়া,শুয়ে আছে কন্ঠ।
“কন্ঠ!”

নিজের নাম শুনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে কন্ঠ, তূর্য দাঁড়িয়ে আছে।চোখে মুখে ক্লান্তির ছা’প।
“স্যার।”

তূর্য ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলো, চেয়ার টেনে বসে। কন্ঠের হাত দুটো শক্ত করে ধরে।
“ঠিক আছো তুমি?”
“হুম, আপনার একী অবস্থা? প্রফেসর তূর্য খান কে অসুস্থ লাগছে,পাগলাটে ভাব।”

মলিন হাসে তূর্য।
“কী করার? আমার পাগ’লীটা যে হারিয়ে গিয়েছিল,ভয় পেয়েছিলাম।”

কন্ঠ ফিক করে হেসে উঠলো, বাকিরা সবাই দাঁড়িয়ে তাদের এই গভীর ভালোবাসা দেখে চোখে পানি চলে আসে।
হুট করেই কন্ঠ কেঁদে উঠে, কেমন জানি কষ্ট হচ্ছে তার। ব্যস্ত হয়ে উঠে তূর্য।
“কী হয়েছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলো?”
“আমি আর পরীক্ষা দিতে পারব স্যার তাই না!ওরা সবাই এগিয়ে যাবে, আমি পিছনে রয়ে যাব।”

সান,সোহা,তাহিয়া,রিয়া,তারিফ এর মন হুট করেই খারাপ হয়ে যায়। সত্যি তো একজন বন্ধু কে ছেড়ে তারা কী করে পরীক্ষা দেবে? কন্ঠ কে তো অ্যা’লাও করবে না। তূর্য কন্ঠ কে আশ্বাস দেয় সব ঠিক হয়ে যাবে,সে নিজে কথা বলবে প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে।

দু দিন লাগলো কন্ঠের ঠিক হতে, অতঃপর বাড়িতে ফিরলো সে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো বিকালের দিকে তূর্য কন্ঠ কে বললো কোথাও একটা যাবে দু’জনে। কন্ঠ জিজ্ঞেস করলেও কিছু বললো না তূর্য, কন্ঠ যে পোশাকে ছিল সেটাতেই নিয়ে বের হলো তূর্য।

একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় দু’জনে।
“এটা কার বাড়ি স্যার?”
“এখুনি জানতে পারবে।”

তূর্য কন্ঠ কে নিয়ে বাড়ির সামনে গেলো , কলিং বেল বাজানো মাত্র সহিতা এসে দরজা খুলে দেয়।আচমকা কন্ঠ এবং তূর্য কে দেখে রিতিমত চমকে উঠে সহিতা।
“তোমরা?ততূর্য!”

তূর্য সহিতা কে কিছু বলতে দিলো না, সপাটে চ’ড় বসায়। ছি’টকে গিয়ে পড়ে সহিতা, ব্যাথায় কঁ’কিয়ে উঠলো
“তূর্য!”

সহিতা চমকে উঠে,বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে তূর্য, টেনে তুলে সহিতা কে।
“তুই আমার ফ্রেন্ড?তুই তো খারাপ,তোর এত সাহস আমার ওয়াইফ, আমার জান ওর সাথে এমন করেছিস? সাহস হলো কী করে তুই কন্ঠ কে রুমে বন্ধ করে রাখিস?”

সহিতা রিতিমত ভয়ে শিউরে উঠে, কন্ঠ চুপ করে থাকে। হঠাৎ সহিতা তূর্য কে জড়িয়ে ধরে।
“প্লিজ তূর্য আমি তোকে ছাড়া বাঁচব না,তুই এক কাজ কর এই বাচ্চা কন্ঠ কে ছেড়ে আমার কাছে চলে আসো।”

কন্ঠ এতক্ষণ চুপ থাকলেও এখন আর পারলো না।
“কী বললেন আমি বাচ্চা? আমাকে ছেড়ে দিতে?”

তে’ড়ে আসে সহিতার দিকে,সহিতা রাগান্বিত হয়ে বলে।
“হ্যা তো! তুমি দূরেই থাকো।”

সহিতা কন্ঠ কে থামিয়ে তূর্যের‌ গালে হাত রাখে।
“প্লিজ বেইব তুমি আমার কাছে চলে এসো। সত্যি আমার তোমার বিয়ে নিয়ে কোনো প্রবলেম নেই।”

কন্ঠ চুপ থাকল না, সপা’টে থা’প্প’ড় বসায় সহিতার গালে।
“অস’ভ্য মেয়ে,এত সাহস আমার জামাইয়ের দিকে হাত বাড়ান। আজকে আপনার একদিন কী আমার একদিন।”

কন্ঠ ফট করে গলায় জড়ানো উড়না কোমড়ে বেঁধে নেয়। আশেপাশে খুঁজতে লাগলো,চোখ পড়ল সোফার পাশে পড়ে থাকা হক স্ট্রিক দেখতে পায়।সেটা গিয়ে তুলে নেয়, এগিয়ে আসে সহিতার দিকে।

সহিতা ভীত কন্ঠে বলে।
“এই মেয়ে কী করছো এসব? দূরে থাকো, তূর্য প্লিজ কিছু বলো।”

তূর্য অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার র’ণ চন্ডী কন্ঠের দিকে। কন্ঠ ভ্রুকুটি করে তাকালো।
“উনি কী বলবে? আজকে আপনাকে ছেড়ে দেবো নাকি?”

কন্ঠ হক স্ট্রিক দিয়ে দু তিনটে ভা’রী দেয় সহিতা কে,ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো সহিতা।
“পা’গল মেয়ে,হোয়াট ইজ দিস?”

কন্ঠ ঝাঁ’ঝা’লো স্বরে বলল।
“তূর্য খান আমার, স্বামী আমার। আমার সাথে কিছু করলে ততটা পাত্তা পাবেন না আপনি। কিন্তু তূর্য স্যার কে নিয়ে টানাটানি করলে খু’ন করে ফেলবো।”

তূর্য অগোচরে হাসলো।
তূর্য কোনো মতে কন্ঠ কে নিয়ে বাড়ি ফিরলো।রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দেয় তূর্য, কন্ঠ এখনও রাগে ফুঁ’সছে। তূর্য কন্ঠ কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।
“ইশ্ আমার বউ টা এত্ত ভালোবাসে আমায়!আগে জানতাম না তো।”

কন্ঠ মূহুর্তে মোমের মত গলে যায়।
“আমার পছন্দ না আপনাকে নিয়ে টানাটানি, আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি।”
“আই লাভ ইউ টু।”

দেখতে দেখতে পাঁচ বছর কে’টে গিয়েছে, সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত,কেউ বা ক্যারিয়ারের পিছনে ছুটছে। পড়াশোনা শেষ করেছে কন্ঠ,জবের জন্য চেষ্টা করছে। মাঝে মধ্যেই বন্ধুদের সাথে দেখা হয় তার।
সান আর তোহা খুব সুখী,তোহার একটা ছেলে হয়েছে বয়স আড়াই বছর।সান বর্তমানে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরী করে, অন্য দিকে সোহা,তাহিয়া সংসার নিয়ে ব্যস্ত।ওরাও জব করছে ছোট খাট। তারিফ বর্তমানে খুবই আলোচনায় আছে, লাস্ট মুভি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে তারিফের।রিয়ার সাথে এই তো মাসখানেক আগেই বিয়ে হয়েছে, আনিকা আহমেদ এত ভালো মেয়ের জামাই পেয়ে অন্তত খুশি।
নীলা আর সাফিনের মেয়ে চার বছরে পা রাখলো, সবাই মা হয়েছে শুধু কন্ঠ বাদে। প্রচন্ড রকম কান্না পাচ্ছে কন্ঠের। কিন্তু সে তূর্যের থেকেও বড় ঘাড় ত্যা’রা, স্বামী স্ত্রীর পবিত্র মিলনের পর তূর্য কন্ঠ কে যে পিল খেতে দেয় তা মুখেও তুলে না কন্ঠ।
মাস দুয়েক পরেই হঠাৎ একদিন জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে কন্ঠ।রুমে এসে কন্ঠ কে ওমন ভাবে পড়ে থাকতে দেখা চমকে উঠে তূর্য। তাড়াতাড়ি বিছানায় শুইয়ে দেয় তাকে,সাফিন কে বললো তাড়াতাড়ি ডক্টর কে খবর দিতে।
মিস্টার মাহমুদ চৌধুরী তূর্য কে উদ্দেশ্য করে বলেন।
“কংগ্রাচুলেশন মিস্টার তূর্য আপনার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট।”

কন্ঠ প্রেগন্যান্ট কথাটা শুনে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকালো তূর্য কন্ঠের দিকে।বাকিরা আনন্দে আ’ত্মহা’রা হয়ে উঠেছে, নতুন এক সদস্য বাসায় আসবে ভাবতেই সবাই উৎফুল্ল হয়ে উঠছে।
সবাই নিচে যাওয়ার পর কন্ঠ উঠে তূর্যের কাছে গেলো, তূর্য বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। মুখশ্রী জুড়ে গম্ভীরতা।
“আপনি কী খুশি নন স্যার? সত্যি আপনি বাবা হতে চান না?”

তূর্য ঘাড় ফিরিয়ে কন্ঠের দিকে তাকায়,চোখ দুটো তার ঝাপসা হয়ে আছে। কন্ঠ দেখলো তূর্য কাঁদছে,অবাক হয় সে। বিবাহিত জীবনে এই প্রথম তূর্য কে কাঁদতে দেখেছে কন্ঠ। তূর্য আদুরে হাতে কন্ঠ কে জড়িয়ে ধরে।

“কে বললো খুশি নই আমি? আমি বাবা হবো পাগলী!খুশি হবো না?”

কন্ঠ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
“তাহলে কেন আপনি আমাকে পিল খওয়াতেন?”

তূর্য স্ফীত হাসলো।
“তুমি কী খেতে?আদেও কখনও খেয়েছো?”

কন্ঠ দৃষ্টি নত করে নেয়। তূর্য কন্ঠের থুতনি ধরে মুখটা খানিকটা উঁচু করে ধরে।
“তুমি যে পিল গুলো এই যে ফুল গাছের টবের নিচে রেখে দিতে তা আমি অনেক আগেই দেখেছি।হতে চাও মা! বানিয়ে দিলাম।”

কন্ঠের‌ ওষ্ঠাধর তীর তীর করে কাঁপছে,গাল দুটো র’ক্ত লাল হয়ে উঠে। লজ্জা পাচ্ছে সে, তূর্য আবারও জড়িয়ে ধরে কন্ঠ কে।
“এত খুশি দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।”

কন্ঠ মিনমিনে গলায় বলল।
“আপনাকেও ধন্যবাদ আমাকে এত্ত ভালোবাসার জন্য।”
_________________

গৌধূলীর সন্ধ্যায় বাগানে দাঁড়িয়ে আছে তুফায়েল হয়তো কারো অপেক্ষায় আছে। হঠাৎ পিছন থেকে এক পিচ্চি মেয়ে এসে ডাকে।

“পাপাই পাপাই মাম্মা খালি বকে।”

অর্ষার আদুরে গলায় বলা কথা গুলো শুনে মুচকি হাসে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা অরিন।তুফায়েল চোখ রাঙিয়ে বললো।
“এত্ত সাহস আমার মাম্মা কে বকে! তোমার মাম্মা কে বের করে দেবো ঠিক আছে?”

অর্ষা রেগে যায়।
“নো,মাম্মা বকবে বলে তুমি তাকে বের করে দিবে?না তাহলে কাকে মাম্মা বলব?”মাম্মা।”

অর্ষা দৌড়ে অরিনের কাছে যায়,তুফায়েল শব্দ করে হেসে উঠলো।
ছোট্ট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। কন্ঠ প্রেগন্যান্ট সবাই জানার পর আনন্দ করে।
সান,তোহা,তাহিয়া,সোহা, কন্ঠ, তূর্য,তুফায়েল,অরিন। সবাই উপস্থিত আছে,কাপল রা নিজেদের মধ্যে একটু সময় কাটাতে চায়। কিন্তু এসব কিছুর মধ্যে রিয়া আর তারিফ এখনো পৌঁছায়নি।
কন্ঠ গাল ফুলিয়ে বলে।
“দেখলি সুপার স্টার আসলো না,আসবেই বা কেন?”

“এই যে এসে গেছি?”

সবাই ঘাড় ফিরিয়ে দেখে তারিফ আর রিয়া হেঁটে আসছে, দু’জন কে বেশ ভালো লাগছে। কিন্তু কন্ঠ তবুও গাল ফুলিয়ে আছে।তারিফ এসে বলল।
“আ’ম স্যরি গাইস, সত্যি বলছি কন্ঠ রাস্তায় এত জ্যাম ছিল বলার মতো না।”

কন্ঠ নাক মুখ কুঁচকে নেয়।
“থামেন থামেন স্টার সাহেব,আমরা বুঝি না ভাবছেন?”

তারিফ কন্ঠের মাথায় চা’টি মে’রে বললো।
“পাগল নাকি তুই?কী সাহেব সাহেব বলছিস! গলায় আয়।”

তারিফ কন্ঠ কে জড়িয়ে ধরে, এরপর রিয়াও কন্ঠ কে জড়িয়ে ধরে। অনেক দিন পর সবাই এক সাথে আছে,একে অপরের সাথে সময় কা’টাচ্ছে। খুব পূর্ণ পূর্ণ লাগছে কন্ঠের,এত ভালোবাসে এবং কেয়ারিং হাসব্যান্ড,বাবা মায়ের মতো শশুর শাশুড়ি।এত ভালোবাসার বন্ধু গুলো, যারা সবসময় পাশে ছিল।
সবাই মিলে কেক কা’টে, জম্পেশ খাওয়া দাওয়া হয়। অতঃপর আকাশের নিচে প্রতিটি ভালোবাসার মানুষ গুলো বসে।
অরিন তুফায়েলের ঘাড়ে মাথা রাখলো, অর্ষা ইতিমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে।রিয়া আর তারিফ হাতে হাত রেখে শক্ত করে কাছাকাছি বসে।তোহা আর সান এক সাথে আছে,তোহার কোলে মাথা রাখলো সান।চুলে হাত বুলিয়ে দেয় তোহা।সোহা আর তাহিয়া নিজেদের স্বামীর সাথে হেসে কথা বলে, ওদের ছেলে মেয়ে খেলা করছে।নীলা আর সাফিন তাদের মেয়ে কে নিয়ে দুষ্টুমি করছে।
কন্ঠ তূর্য কে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।
“আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি #অপ্রিয়_মাস্টার সাহেব।”

তূর্য মুচকি হাসে। কন্ঠ ভ্রুকুটি করে তাকালো।
“আপনি রাগলেন না কেন?”

তূর্য মাথা দুলিয়ে বলল।
“রাগব কেন?এই যে তুমি অপ্রিয় বললে এটাতে আমি প্রিয় খুঁজে নিয়েছি।”

কন্ঠ ফিক করে হেসে উঠলো।
“আপনি এত্ত ভালো কেন?”
“কারণ আমার বউ টা একটু বেশি ভালো।”

তূর্য থামলো, কন্ঠের কপালে গাঢ় চুম্বন এঁকে দেয়।
“আমি ভালোবাসি ইনফিনিটি পাগলী।”

কন্ঠ আশপাশটা দেখলো, সবাই নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত আছে।এই ফাঁকে কন্ঠ তূর্যের অধর আঁ’কড়ে ধরে, তূর্য কন্ঠের চুলে হাত ঢুকিয়ে দেয়, আ’শ্লে’ষে শুষে নেয় অমৃত সুধা।একে অপরের মাঝে ডুবে যায়।

ভালোবাসা চার অক্ষরের এই শব্দটিতে রয়েছে হাজারো অনুভূতি,হাজারো কষ্ট, দুঃখ বেদনা। সেগুলো সয়ে যেতে পারলেই তুমি পূর্ণ। ভালোবাসা মা বাবা, প্রেমিক প্রেমিকা, বন্ধুবান্ধব। সবার ক্ষেত্রেই রয়েছে।কিছু সম্পর্ক গাঢ় হয়, কিছু সম্পর্ক ভেঙে যায়।
সমাপ্ত