ওগো বিদেশিনী পর্ব-১৬+১৭

0
127

#ওগো_বিদেশিনী
#পর্ব_১৬
#সারিকা_হোসাইন

********
অলস বর্ষণমুখর একটি দিন।অবিরাম ঝরঝর ধারায় ঝরে যাচ্ছে বারী ধারা।এই বর্ষণে ঘটেছে সকলের কার্যক্ষেত্রের সামান্য বিরতি।
দিনটিকে কাটানোর জন্য একেকজন একেক পন্থা অবলম্বন করে চলছে।

বিভিন্ন ধরনের ব্যাস্ততার কারনে মাহাদ অনেক দিন ছবি আঁকেনি।
শুয়ে বসে সময় কাটানোর চাইতে মাহাদের কাছে মনে হলো
―ক্যামেলিয়ার একটি আবেদন ময়ী বৃস্টি ভেজা রূপে ছবি আঁকলে মন্দ হয় না।
যেই ভাবা সেই কাজ।

চট করে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ালো মাহাদ।
এরপর ছবি আঁকার সমস্ত উপকরণ সাজাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো সে।
ইজেল এর উপর বোর্ড রেখে তাতে মোটা কাগজ ক্লিপ দিয়ে ভালো মতো আটকে নিলো।
বিভিন্ন রঙ একটির সাথে আরেকটি মিশিয়ে তৈরি করে নিলো পছন্দ সই প্রয়োজনীয় কালার।
চিকন,মোটা,মাঝারি সমস্ত শেপের তুলি পরিষ্কার করে ধুয়ে নিলো।
এরপর খুব নিখুঁত ভাবে পেন্সিলের স্কেচ আঁকতে শুরু করলো।

দীর্ঘ বছর ধরে ক্যামেলিয়ার ছবি আঁকতে আঁকতে মাহাদ এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যে,ক্যামেলিয়ার যে কোনো ধরনের স্কেচ আঁকতে তার আধ ঘন্টার মতো সময় ব্যয় হয়।
চৌদ্দ বছর ধরে মাহাদ নিখুঁত ভাবে ক্যামেলিয়ার ছবি একে যাচ্ছে।
ক্যামেলিয়ার মুখশ্রীর কোথায় কি আছে সব খুঁটিনাটি মাহাদের মুখস্থ।

——–
সুজানা,ক্যামেলিয়া আর কোহিনুর সময় কাটানোর বহু কসরতের পর লুডুকেই মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে।
ক্যামেলিয়ার কাছে খেলাটি একদম নতুন।
কোহিনুর এই খেলায় খুব পটু।তাই সে খেলার সকল নিয়ম কানুন ক্যামেলিয়া কে শিখিয়ে দিলো।
তিনজনেই উচ্ছসিত হয়ে খেলা শুরু করার পরিপারেশ নিলো।

মুহূর্তেই সেখানে কুহুর আবির্ভাব হলো।
কুহুকে দেখেই সুজানার রাগ সপ্তমে উঠলো।

“মেয়েটি সাংঘাতিক ধূর্ত আর বেয়াদবের হাড্ডি।
ক্যামেলিয়ার হাঁটুর জখম সুজানা দেখেছে।
মাহাদের নির্দেশে মিতালি বা মাহতাব কাউকেই কোনো কিছু জানায় নি সে।
মাহাদ সুজানা কে আশস্ত করেছে যে ,সে কুহুকে একদম নাস্তানাবুদ করে ছেড়ে দেবে।
বাড়ির বড়রা জানলে মাহাদ সেরকম কিছুই স্টেপ নিতে পারবে না।
সেই ভরসায় সুজানা মুখে তালা ঝুলিয়ে রেখেছে।

বহু কষ্টে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সুজানার বিছানায় এসে বসলো কুহু।
তার পা মচকে পা ফুলে গিয়েছে অনেক টুকু।আর কফি অত্যন্ত গরম থাকায় গালের পাশের সামান্য অংশ,আর গলার নীচে অনেক টাই ঝলসে গিয়েছে।

কুহুকে দেখেই সুজানা ব্যাতিব্যস্ত ভাব দেখিয়ে বলে উঠলো

“এতো কষ্ট করে এখানে আসার কি দরকার ছিলো আপু?

“কেনো এসে কি তোদের ডিস্টার্ব করলাম?

“আমার কথায় কি তোমার সেরকম মনে হচ্ছে?

সুজানার কথাকে অন্য দিকে ডাইভার্ট করে কুহু বলে উঠলো

“বোর হচ্ছিলাম তাই এলাম,আমিও তোদের সাথে লুডু খেলবো।

সুজানার মাথার নিউরন দপদপ করে উঠলো।তবুও মুখে কিছু প্রকাশ না করেই খেলা শুরু করলো।

খেলার এক পর্যায়ে দেখা গেলো কুহু শুধু ক্যামেলিয়ার পাকা গুটি গুলোই বার বার খাচ্ছে।
অনেক খন এই দৃশ্য অবলোকন করার পর
কোহিনুর এক প্রকার ঝাঁঝালো গলাতেই বলে উঠলো

“আফনের উদ্দেশ্য কি আপু?আমাদের কারো গুটি তো আপ্নে খাইতাছেন না।ভাবীর গুটি কিল্লিগা খাইতাছেন বারে বারে?

কুহু ক্রুর হেসে নিজেকে সামলে অপরাধীর ভঙ্গিতে বললো
“আসলে ইন্টেনশনালি খাইনি,সামনে এসে গেছে তাই।

সুজানা ভারিক্কি গলায় বলে উঠলো
“আমাদের গুটি গুলো ও তোমার গুটি পাশ কাটিয়ে গিয়েছে।সেসব তুমি খাওনি আপু।
ক্যামেলিয়া আজ প্রথম এই খেলা খেলতে এসেছে।আমাদের উচিত ওকে উৎসাহ দিয়ে জিতিয়ে খুশি করা।তুমি তো ওকে ভেঙে দিচ্ছ।

কুহু কারো কথাই গায়ে মাখলো না।সে তার শয়তানি তে অনড়।
এক পর্যায়ে সে ক্যামেলিয়ার সব গুলো গুটি খেয়ে ফেললো।

অসহায় ক্যামেলিয়া প্রথম বারের মতো মুখ খুলে নিচু স্বরে বলে উঠলো

“আমি আর খেলবো না সুজানা আপু”
“এই খেলা আমার ভালো লাগছে না।

সাথে সাথেই কুহু হাসতে হাসতে বলে উঠলো
“যারা খেলাধুলায় একদম ভীতু তাদের আমি একদম পছন্দ করি না।
খেলা শেষ না করে কোনো ভাবেই তোমাকে যেতে দেবোনা আমি।

ক্যামেলিয়া জেদ দেখিয়ে বলে উঠলো
“আমি আপনার সাথে খেলবো না”

“তোমার আমার সাথেই খেলতে হবে।
কুহুর রাগী স্বর।

আরো এক ধাপ গলায় জেদ এনে ক্যামেলিয়া বলে উঠলো

“আমি মরে গেলেও খেলবো না।

বলেই লুডু টান মেরে ছিড়ে গুটি গুলো মুঠ পাকিয়ে শক্ত করে ধরে ফুঁসতে থাকলো ক্যামেলিয়া।

সুজানা আর কোহিনুর কোনো ভাবেই কাউকেই থামাতে পারছে না।
ক্যামেলিয়ার অবস্থা বেগতিক দেখে সুজানা কুহুকে থামার জন্য অনুরোধ করতে শুরু করলো

“প্লিজ আপু থেমে যাও, ভাবির সমস্যার কথা তুমি জানো।ভাবি হাইপার হয়ে গেলে আমরা কেউ তাকে আটকাতে পারবো না।”

কিন্তু কুহু সেসব শোনার মেয়েই না।
অগত্যা সুজানা দৌড়ে মাহাদের রুমে চলে আসলো।

*******
মাহাদ তার মনের মাধুরী মিশিয়ে ক্যামেলিয়ার আকর্ষণীয় কমলার কোয়ার মতো পাতলা ঠোঁট দুটোতে গোলাপি রঙ মাখাচ্ছে।
মাহাদের চিত্ত নিমিষেই উৎফুল্ল হয়ে উঠলো।
ক্যামেলিয়ার একটু উষ্ণ সঙ্গ পাবার জন্য মন পাগল পাগল করছে।
কোনো ভাবেই আর পেইন্টিং এ মনোযোগ দিতে পারলো না মাহাদ।
সব কিছু এক সাইড করে মনে মনে বলে উঠলো

“আফিম বড্ড নেশালো।তুমি আফিমের চাইতে ভয়ঙ্কর ক্যামেলিয়া!”

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মাহাদ।
নিজের রঙচঙ মাখানো হাত ধুয়ে নেয়া প্রয়োজন।

হঠাৎই ধাম করে খুলে গেলো মাহাদের কক্ষের দরজা।
ভীতসন্ত্রস্ত সুজানার দিকে অবাকের দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মাহাদ।

সুজানা আহত স্বরে ডেকে উঠলো
“ভাইয়া”

*******
বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ সুজানার কক্ষে জমা হয়েছে।ক্যামেলিয়ার উগ্র আচরণের কারন কারোরই বোধগম্য হচ্ছে না।
শাহানা আফসোস এর স্বরে বলে উঠলেন
“আহারে চান্দের লাহান পোলাডার জীবনডাই শ্যাষ করলো পাগল মাইয়াডা!

এদিকে ক্যামেলিয়া কে কোনো ভাবেই শান্ত করা যাচ্ছে না।
আগের বার সাইকিয়াট্রিস্ট বলে ছিলেন ক্যামেলিয়া ধীরে ধীরে ওভারকাম এর দিকে আগাচ্ছে।তাহলে হঠাৎই এমন কেনো হলো?
চিন্তায় মাহতাব চৌধুরী এই বৃষ্টি ভেজা ঠান্ডা দিনে ঘেমে নেয়ে একাকার।
মিসেস মিতালি উদ্বিগ্ন হয়ে ক্যামেলিয়াকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করেই যাচ্ছেন।
হঠাৎ বেড সাইড টেবিলের উপর থাকা সিরামিকের ভারী ফুলদানি তুলে নিলো ক্যামেলিয়া।
সেটা উঁচিয়ে বাড়ি দেবার আগেই মাহাদ দৌড়ে এসে পেছন থেকে ঝাপটে ধরলো ক্যামেলিয়া কে।
হাত থেকে ফুলদানিটি টাইলস এর উপর পড়ে ঝনঝন শব্দ তুলে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো।

হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকলো ক্যামেলিয়া।
রাগ সংবরন করতে না পেরে একপর্যায়ে মাহাদের হাতের বাহুতে চোখ বন্ধ করে কা/ম/ড়ে ধরলো সে।

দাঁতে দাঁত পিষে সবটাই সহ্য করে নিলো মাহাদ।
এরপর রক্তচক্ষু নিয়ে কুহুর দিকে তাকিয়ে তেজী কন্ঠে বলে উঠলো―
“ইচ্ছে করেই এই কাজ করেছিস নাহ?

মিসেস মিতালি আর মাহতাব চৌধুরী মাহাদের দিকে উৎসুক দৃষ্টি মেলতেই
ক্যামেলিয়াকে জড়িয়ে ধরে জোর করে নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরলো মাহাদ।

_________
নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ক্যামেলিয়ার পিঠ হাতড়ে শান্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে মাহাদ।
কোনো ভাবেই ক্যামেলিয়া নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না।
মেয়েটি মাহাদের কাঁধে থুতনি রেখে চোখ বুঝে কেঁপে কেঁপে ফুঁপিয়ে উঠছে।

মাহাদ ক্যামেলিয়াকে শান্ত করার জন্য মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বিভিন্ন ধরনের কথা বলে যাচ্ছে।

“শান্ত হয়ে যাও ক্যামেলিয়া”
“মানুষ তোমাকে রাগানোর চেষ্টা করলেও তুমি রাগবে না।রেগে গেলে হেরে যেতে হয়।

“তুমি কি হেরে যেতে চাও?

ক্যামেলিয়া মাথা তুলে ভেজা চোখে মাহাদের দিকে তাকালো।
এরপর অস্ফুট স্বরে আস্তে আস্তে বলে উঠলো

“আমি অনেকক্ষন ধরে নিজেকে শান্ত রেখেছি মাহাদ ভাই।
কুহু আপু বারবার আমাকে অশান্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
আপনি ওকে আমার কাছে আসতে নিষেধ করবেন।
সে সবসময় আমাকে কষ্ট দেয়।”

মাহাদ ক্যামেলিয়ার কপালে চুমু একে বলে উঠলো
“মহারানীর হুকুম শিরোধার্য”

ক্যামেলিয়ার চোখের জল মুছে দিয়ে এলোমেলো বাদামি কোঁকড়া চুলগুলো একটা ইলাস্টিকের সহিত পনিটেইল স্টাইলে বেঁধে দিয়ে মাহাদ বলে উঠলো

“চলো তোমাকে ছবি আঁকা শেখাই।
ছবি আঁকলে মন ভালো থাকে ব্রেন ও শান্ত থাকে।”

“ক্যামেলিয়া কি ছবি আঁকা শিখতে চায়?”

মাহাদের বাচ্চাদের মতো করে বলা কথায় ফিক করে হেসে দিলো ক্যামেলিয়া।

ছবি আঁকার ইজেল এর সামনে পাতা চেয়ার এ বসে ক্যামেলিয়াকে কোলে টেনে বসালো মাহাদ।

রংতুলিতে রঙ লাগিয়ে ক্যামেলিয়ার হাত দিয়ে ধরিয়ে মাহাদ চেপে ধরলো ক্যামেলিয়ার রংতুলি সমেত হাতের মুঠি।

এরপর দুজনে মিলে ধীরে ধীরে রাঙাতে লাগলো ক্যামেলিয়ার সাদা কালো পেন্সিলে আঁকা স্কেচ।

ছবি আঁকতে আঁকতে মাহাদ ক্যামেলিয়ার নেশায় বুদ হলো।
ক্যামেলিয়ার ধবধবে সাদা গলার ভাঁজে মুখ ডুবিয়ে গভীর শ্বাস নিলো।
অতর্কিত শিহরনে কেঁপে উঠলো ক্যামেলিয়া।
হাত আলগা হয়ে পড়ে গেলো রংতুলি।
মাহাদের সেসবে কোনো খেয়াল নেই।
ক্যামেলিয়াকে রংযুক্ত পেইন্টিং বোর্ডের সাথে ঠেসে ধরে দখল করে নিলো ঠোঁট জোড়া।
উন্মাদ মাহাদকে আরও উন্মাদ করতে সায় জানালো ক্যামেলিয়া।
হাতের ঝটকায় পড়ে গেলো রঙের পেলেট।
রংযুক্ত হাতের অবাধ্য বিচরণে রঙে রঙিন হলো মানব মানবীর সারা শরীর।
ক্যামেলিয়ার মাঝে বিলীন হবার প্রবল আকুতি জানালো মাহাদ।
সাদরে মাহাদের উন্মত্ততা গ্রহণ করলো ক্যামেলিয়া।

মুহূর্তেই চিত্রকর্ম ভুলে দুজন দুজনকে ভালোবাসার রঙে রাঙাতে ব্যাস্ত হয়ে গেলো।
মেঝেতে অনাদরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রইলো একটু আগের সযত্নে রাখা রংতুলি ,স্কেচ আর রঙ।

_______
নিজেদের বরাদ্দকৃত রুমে এসে দাঁত কিড়মিড় করে যাচ্ছেন শাহানা।
মেয়েটা যে তার বাপের মতো বেক্কল হয়েছে এটা তার কাজকর্মে প্রমাণিত।
শাহানা মেয়ের চুলের মুঠি ধরে গাল চেপে কর্কশ সুরে বলে উঠলেন

―তোর বাপের জন্য জীবনেও কোনো ভালা কামে সফল হইতে পারিনাই।
“ব্যাডায় মইরা গেছে কিন্তু তোরে ফালায় গেছে।

“তোর জন্যও কোনো কামে সফল হইতে পারুম না।

তোরে পই পই কইরা কইলাম বৈদেশীর ধারে কাছে মাহাদ বাড়িতে থাকতে ঘেঁষবি না।
তার পরেও কেন গেলি?

“কিছু কিছু মানুষের চেহারা আছে এমন দেখলেই কষ্ট দিতে ইচ্ছে করে।থাপড়াতে মন চায়।
মেয়েটিকেও আমার তেমনই লাগে।এজন্য আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি মা।

“তাইলে মাহাদ এহন ঘাড় ধইরা তোরে আর আমারে বাইর কইরা দেইক।তার পরে ভালোমতো মাহাদের বউ হইস।

“তোমার কি মনে হয় এতো সুন্দরী বউ রেখে তোমার ভাতিজা আমাকে বিয়ে করবে?

“হেই ব্যাবস্থা তো আমি করতে চাইছি।কিন্তু তুই তো হেই সুযোগ আমারে দিতাছস না।

“তোমার প্ল্যান কি বলতো মা!

“মাহাদ তো সবসময় বৈদেশীরে পাহারা দিয়া রাখতে পারবো না।মাইয়ার বহুত সমস্যা আছে।মাইয়া ডরায় বেশি।ডর দেহাইয়া তারে সিস্টেম করতে অইবো।
তুই খালি বাম হাত ঢুকানো বন্ধ কর।
বাকি সব কাম আমি করমু।
মাহাদ আজকের ঘটনায় তোরে কিছু কৈলে সাথে সাথে মাফ চাইয়া লইবি।

“মাহাদ ভাই মেয়েটিকে অনেক বছর ধরে ভালোবাসে মা।আমাকে কোনো ভাবেই সে গ্রহণ করবে না।

“কোনোমতে একবার ঘাড়ে গছায় দিতে পারলে গ্রহণ না কইরা যাইবো কই?

বলেই শ্লেষত্বক হাসি হাসলেন শাহানা বেগম।
বাপ মায়ের বড় সন্তান হওয়াতে নিজের জীবন জলাঞ্জলি দিয়ে ভাই বোনের হাল ধরেছেন তিনি।
বাবা মা বয়স হবার আগেই এক ঘাটের মরার সাথে তার বিয়ে দিয়ে জীবন শেষ করে দিয়েছে।
ভাই বোনেরা তার সেই প্রতিদান না দিয়ে শহরে বেশ সাচ্ছন্দে জীবন কাটাচ্ছে।
নিজের সকল চাহিদা তিনি এবার পূরণ করে তবেই গ্রামে ফিরবেন।
মেয়ের একটা গতি তিনি এবার করেই ছাড়বেন।

“বৈদেশিরে হারাইয়া যহন মাহাদ ভাইঙ্গা পড়বো তহন সুযোগ বুইঝা তোরে বউ বানানোর আবদার করমু মাহতাব এর কাছে।”

“বড় বইনের আবদার কেমনে ফিরাইবো মাহতাব?”

#চলবে

#ওগো_বিদেশিনী
#পর্ব_১৭
#সারিকা_হোসাইন

_______

সকাল থেকেই মেঘ ভেঙে রোদ উঠেছে।যেরকম রোদের তেজ সেই রকম ভ্যাপসা গরম।এসি রুম থেকে বাইরে বেরুলেই শরীরে খপ করে আগুন ধরে যাচ্ছে এরকম এক অবস্থা।এই বেধড়ক গরমে অযথাই মানুষের মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে।

মাহতাব চৌধুরীর বিশাল বড় ড্রয়িং রুমে রক্ত চক্ষু নিয়ে ঠোঁট কামড়ে মেঝের দিকে দৃষ্টি তাক করে বসে আছে মাহাদ।
সুজানা,আর টুসি এক পাশের সোফা ঘেষে বসে পড়লো নীরবে।
মিসেস মিতালি আর মাহতাব চৌধুরী চিন্তিত বদনে মাহাদের পাশের ডিভানে বসে পড়লো।
রিজভীকে দিয়ে ক্যামেলিয়া কে সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে পাঠানো হয়েছে।
গত কালকের ঘটনার পর থেকে কুহুকে দেখলেই মেজাজের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে ক্যামেলিয়া।
কুহুকে কিছু করতে না পেরে নিজেকে নিজেই আঘাত করতে যাচ্ছে সাথে বিভিন্ন জিনিস ভাঙচুর করেছে।
ক্যামেলিয়া কে মাহাদ কোনোভাবেই আজকে আর শান্ত করতে পারেনি।

ক্যামেলিয়ার সামনে মাহাদ গলার স্বর উঁচু করতে চায়না।
মাহাদ কতোটা ভয়ঙ্কর হতে পারে এটা সে ক্যামেলিয়া কে দেখাতে চায়না।

এদিকে কুহুটাও বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।তাকে একটা শাস্তি দেয়া প্রয়োজন।
এজন্য রিজভীকে কল করে ডেকে এনেছে মাহাদ।
ক্যামেলিয়া কে কোনোরকম বুঝিয়ে মাহাদ সাইকিয়াট্রিস্ট এর কনসাল্টিং এর জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে।
এবার কুহুর বিষয়টা খতিয়ে দেখার পালা।

হঠাৎই মাহাদ গলার সর্বোচ্চ আওয়াজ দিয়ে হুংকার দিয়ে ডেকে উঠলো

“কোহিনুর”!

মাহাদের গলার আওয়াজে কেঁপে উঠলো উপস্থিত সকল সদস্য।
দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে মাহাদের সেই গর্জন ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করলো চারপাশে।

কাঁপতে কাঁপতে ভীতসন্ত্রস্ত কোহিনুর মাহাদের সামনে এসে বলে উঠলো

“জ,জ,জে ভাইজান”

“ফুপু আর তার মেয়েকে আমার সামনে আসতে বল”

কোহিনুর বাধ্য দাসীর ন্যায় কাঁপতে কাঁপতে দুতলায় শাহানার বরাদ্দকৃত রুমে এসে দরজায় নক করলো।

অসময়ে কারো ডাকাডাকি শাহানার পছন্দ হলো না।

ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট বাকিয়ে দরজা খুলে কোহিনুর দেখে বাজখাই গলায় বলে উঠলো

“এই ছেমরি কি চাস?

কোহিনুর তার ভয়ে শুকিয়ে আসা গলায় ঘস ঘস করে বলে উঠলো

“মাহাদ ভাইজান আপ্নেগরে ডাকতাছে”

বলেই এলোমেলো পায়ে প্রস্থান নিলো।

মাহাদ রেগে গেলে কি কি করতে পারে এটা কোহিনুর আগেও দেখেছে।
ক্যামেলিয়ার বিষয়ে মাহাদ খুব সেনসেটিভ।
বাড়িতে আজ কি যে দুর্ঘটনা ঘটবে আর মাহাদের গর্জনে পুরো বিল্ডিং কাঁপবে সেটা ভেবেই গলা শুকিয়ে উঠছে কোহিনুরের।

মিনিট দশেক পর কুহুকে নিয়ে নীচে নেমে এলো শাহানা বেগম।

“আমারে ডাকছো কেন বাজান?

শাহানার মিষ্টি কথায় শরীর জ্বলে গেলো মাহাদের।

মেঝে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আগুন লাল চোখে হিংস্র চাহনি নিক্ষেপ করলো শাহানা আর কুহুর পানে ।

“দূতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে ড্রয়িং রুমে আসতে কয় মিনিট লাগে ফুপু?

মাহাদের রক্ত হিম করা বীভৎস চাহনি দেখে ভয়ে কলিজা শুকিয়ে এলো কুহুর।
টাল সামলাতে না পেরে শাহানার শাড়ির আচল খামচে ধরে শাহানার পিছে লুকিয়ে পড়লো কুহু।

দাঁতে দাঁত চেপে মাহাদ রুক্ষ স্বরে বলে উঠলো

“তোমার মেয়ে এতো বড় সাহস কার থেকে পেয়েছে ফুপু?

“না বুইঝা কইরা ফালাইছে বাবা।বৈদেশীর এমন রোগের কতা ও জানে না।”

“বাড়ির সব গুলো মানুষ জানে আর তোমার মেয়ে জানেনা এটা আমাকে বিলিভ করতে হবে?”

“ভুল কইরা ফালাইছে ছোট মানুষ হিসেবে মাফ কইরা দে মাহাদ”!

কুহুকে উদ্দেশ্য করে মাহাদ তেজী কন্ঠে বলে উঠলো

“বয়স কতো তোর?”

কুহু জড়ানো কন্ঠে মিন মিন করে বলে উঠলো

“প,প-প-পঁচিশ ভাইয়া।

“আমার বউয়ের বয়স আঠারো”
শান্ত কন্ঠ মাহাদের।

“এবার বল কে ছোট তুই না ক্যামেলিয়া?”

কুহু নিশচুপ।

মাহাদ দ্বিতীয় বার একই প্রশ্ন করে গর্জে উঠলো।

ভয়ে কুহু সহ শাহানাও কেঁপে উঠলো।

মাহতাব চৌধুরী এতোক্ষন চুপ করে থাকলেও এখন মুখ খুললেন।
শাহানাকে উদ্দেশ্য করে মাধুর্যহীন কন্ঠে বলে উঠলেন―

“বড় আপা তোমরা মাহাদের বিয়েতে এসেছো আমি খুব খুশি হয়েছি। বিয়ের অনুষ্ঠান যেহেতু শেষ হয়ে গিয়েছে এবার তোমরা চলে যাও।
তুমি আমাদের বাকি ভাই বোনদের জন্য অনেক করেছো।
তোমার সারা জীবনের দায়িত্ব আমি নিয়ে নিলাম।
ঠিক সময়ে তোমাদের সংসার চালানোর সকল খরচ পেয়ে যাবে।

মিসেস মিতালি কষ্ট জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলেন

“আমার ছেলেটার সকল কথাই আপনারা জানেন।মেয়েটার জন্য মাহাদ জীবন পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত।মাহাদ বহু চেষ্টায় মেয়েটিকে অনেকটাই স্বাভাবিক জীবনে আনতে সক্ষম হচ্ছিলো।
ক্যামেলিয়া আবার অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

কুহুকে দেখে সে বারবার নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে।

মনে কষ্ট না নিয়ে আপনারা চলে যান আপা।
আমাদের ছেলে আর বউকে নিয়ে একটু শান্তিতে থাকতে দিন।
মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে আমার ছেলেটা মরে যাবে।

হঠাৎই কুহু হাটু মুড়ে মেঝেতে বসে সকলের উদ্দেশ্য বলে উঠলো

“ক্যামেলিয়ার এতো খারাপ অবস্থার কথা আমি জানতাম না।
আমি ওর সামনে আর কখনো যাবোনা।
আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন।

নিমিষের ব্যাবধানেই শাহানা মেঝেতে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো।
কোনো অসুখ বিহীন এভাবে জ্ঞান হারানোর বিষয় কারোর ই বোধগম্য হলো না।

********
ক্যামেলিয়া কে সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছ থেকে কনসাল্টিং আর সাইকো থেরাপি শেষ করে অনেক আগেই বাসায় নিয়ে এসেছে রিজভী।

রিজভী প্রথমে ক্যামেলিয়া কে অফার করেছিলো যে,
সে রিজভীদের বাড়িতে যাবে কিনা?

কিন্তু ক্যামেলিয়া এক বাক্যে নিষেধ করেছে।
মাহাদ আর দুদিন বাড়িতে থাকবে।ক্যামেলিয়া কিছুতেই মাহাদ কে ছেড়ে নাবিল হাসানের বাড়িতে যাবে না।
অগত্যা রিজভী মাহাদদের বাড়িতে নিয়ে এসেছে ক্যামেলিয়া কে।

ক্যামেলিয়া কে রুমে নিয়ে গিয়েই দরজা আটকে দিয়েছে মাহাদ।

হঠাৎই শাহানা বেগম বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছেন না।আর কুহুর পা তো অস্বাভাবিক ফুলে রয়েছে।
যার জন্য ওদের রুমে কেউ আর যায় নি।

এতো অপমানের পর ও যদি না যেতে চায় তাহলে বাড়ির কোনো সদস্যই ক্যামেলিয়ার আশেপাশে কুহুর ছায়াও এলাউ করবে না।

ড্রয়িং রুমে বসে আছে রিজভী।
মিসেস মিতালি তাকে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য অনুরোধ করে যাচ্ছেন।
কিন্তু কোনো এক গুরুতর কাজের বাহানায় রিজভী খেতে চাচ্ছে না।

হঠাৎই সুজানা ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হলো।
মেয়েটা অনেকটাই মলিন হয়ে গিয়েছে একদিনে।
সেদিনের কল কাটার পর রিজভী আর তাকে কল করেনি।
সুজানাও আর কল দেয়নি।
হঠাৎই রিজভী ডেকে উঠে
“সুজানা”!

সুজানা শুনেও না শোনার ভান করে চলে যেতে নিলেই খপ করে রিজভী সুজানার হাত ধরে ফেলে।

কটমট করে রিজভী বলে উঠে

“ডাকি যে,কানে শুনতে পাস না?

“হাত ছেড়ে দাও রিজভী ভাই”

“যদি না ছাড়ি তবে কি করবি?

“আমার হাত ধরে অযথা সময় অপচয় কেনো করছো?

“আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই।
সেদিন রাতে কেনো মরতে চাচ্ছিলি এবার বল।

“সেদিন রাতেই আমি মরে গেছি রিজভী ভাই।আর কোনো কথা নেই তোমার সাথে”

“খুব ভাব বেড়েছে দেখছি”

“ভাব কিছুই না।তোমার মতো মহা মূল্যবান মানুষকে কি আমার মতো মূল্যহীন মানুষ ভাব দেখাতে পারে?

সুজানার কঠিন কথায় হাতের বাঁধন আলগা হলো রিজভীর।
সুজানার হাত ছেড়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো।
কাউকে কিছু না জানিয়ে হনহন করে বাইরে বেরিয়ে এলো।

টুসি দূর থেকে সব কিছু অবলোকন করে মন খারাপ করে সুজানার রুমে চলে গেলো।

মিসেস মিতালি কিছু হালকা নাস্তা নিয়ে সেন্টার টেবিলের উপর রেখে বলে উঠলো

“এই সুজানা রিজভী কোথায় গেলো?

“চলে গেছে আম্মু
বলেই চোখের কোনে জমা জল মুছে গটগট পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো সুজানা।

রিজভীর চলে যাওয়া সুজানার কান্না কিছুঁই বোধগম্য হলো না মিসেস মিতালীর।
দীর্ঘশ্বাস টেনে কোহিনুর কে ডেকে নির্দেশ দিলেন

“টেবিলের খাবার গুলো খেয়ে ফেল”।

বাড়ির কারোর ই মন মেজাজের ঠিক নেই।তাই কোহিনুর কোনো মন্তব্য না করে খাবার গুলো নিজের রুমে নিয়ে চলে গেলো।

________

মাহাদ একটা নারিকেল তেলের বোতল নিয়ে ক্যামেলিয়ার পিছে পিছে ঘুরে চলেছে।

“আপনি তেল নিয়ে কেনো ঘুরছেন আমার পিছে পিছে?
অবাকের স্বরে জিজ্ঞেস করলো ক্যামেলিয়া।

“এটা দিলে তোমার মাথা ঠান্ডা হবে।আজকাল হুটহাট তোমার মেজাজ গরম হচ্ছে বউ।

মাহাদ লোকটাকে এড়িয়ে চলা কোনো ভাবেই সম্ভব না।মাহাদ ক্যামেলিয়ার অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে দিনে দিনে।
মাহাদ কে ছাড়া তার এক সেকেন্ড ও ভালো লাগে না।মাহাদ যখন চলে যাবে ডিউটিতে তখন ক্যামেলিয়া সেই দিন গুলি কিভাবে কাটাবে?সেটা ভেবেই তার মাথা আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

ঘরের মধ্যে খুনসুটি করে চলেছে মাহাদ আর ক্যামেলিয়া।
ক্যামেলিয়া মাহাদকে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে মাহাদ যদি তাকে ধরতে পারে তবেই সে মাথায় তেল মাখবে।
দুজন খাটের দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে দুজন কে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে চলেছে।

একজন করে যাচ্ছে পালানোর চেষ্টা অন্যজন কখন তার শ্রেয়সী কে খপ করে ধরে ফেলবে সেই প্রচেষ্টা।

খাটের দুই পাশে চক্রাকারে এলোমেলো দৌড়ে চলছে মাহাদ আর ক্যামেলিয়া।

মাহাদ হঠাৎই বলে উঠলো
“আমার ঘরে যে ছোট গেছো ইঁদুর টা আছে তা কি তুমি ভুলে গেছো?

“এখনই যদি ওটা তোমার শরীরে উঠে কামড় দেয়?

নিমিষেই মেরুদন্ড বেয়ে ক্যামেলিয়ার শরীরে বয়ে চললো শীতল স্রোত।।
হাত পা অবস হয়ে এলো।
ওমনি মাহাদ গিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরে ফেলল ক্যামেলিয়া কে।
শরীরের সকল ভার ছেড়ে দিয়ে মাহাদকে খামচে ধরলো ক্যামেলিয়া।

শয়তানি বিজয়ী হাসি দিয়ে মাহাদ বলে উঠলো
“এবার কোথায় পালাবে সুন্দরী?”

*******
নিজের বাড়িতে এসে গটগট পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজের কক্ষে এসে সপাটে দ্রিম করে দরজা লাগিয়ে দিল রিজভী।
নাজনীন সুলতানা সবটাই অবলোকন করলেন।
কিন্তু ছেলের মেজাজ চটে আছে সেই ভয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না।

নিজের রুমে এসে দ্রুত কাপড় পাল্টে ওয়াশরুমে চলে গেলো রিজভী।
রাগে তার সারা শরীর ,মাথা জ্বলে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।দ্রুত মাথা ঠান্ডা না হলে তামাম দুনিয়া উল্টে ফেলবে এখন রিজভী।

শাওয়ার ছেড়ে দালানে দুই হাতের ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে রক্তচক্ষু নিয়ে কটমট করে বলে উঠলো

“তোকে আমি মে/রে ফেলবো সুজানা।”

#চলবে