#সাজিয়েছি_এক_ফালি_সুখ
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#সূচনা_পর্ব
“বড় সন্তান যদি সম্পত্তিতে নিজের ভাগ বুঝে নিতে চায় তবে বিয়ে করতে হবে অন্যথায় বড় সন্তানের সম্পত্তির অংশ সমানভাবে মেজো ও ছোটো সন্তান পাবে” — বাবার উইলে এমন এক অদ্ভুত শর্তের কথা শুনে অবাক হলো জারা। সঙ্গে সঙ্গে সে বলে বসলো..
‘ হোয়াট নন’সে’ন্স? এটা আবার কোন ধরনের শর্ত বাবা?’
‘ এতো অবাক হওয়ার কি আছে? সহজ একটা ব্যাপারই তো। মাথা গরম করো না ‘
‘ সহজ ব্যাপার? বাবা, তুমি আর কারো বিষয়ে কোনো শর্ত যোগ করলে না। শুধু আমার ক্ষেত্রেই তোমার মনে হলো শর্ত দেওয়া উচিত? তাও আবার এমন উদ্ভট শর্ত?’
‘ আমি কারো মতামত শোনার জন্যে আজকে আমার উইল পড়ে শোনাইনি, কে কতটুকু ভাগ পাবে সেটা জানানোর জন্যে পড়িয়েছি। আর এখানে যা লিখা আছে সেটাই হবে ‘
বাবার কথা শুনে রাগে ফুসছে জারা, পাশের সোফায় বসে আছে ওর সৎ মা ও সৎ দুই ভাইবোন। তারাও জারার দিকে তাকিয়ে আছে। সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো জারা, তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো…
‘ বাবা, আমার মনে হয় এতো নাটকের কোনো প্রয়োজন ছিলো না। সবটা তুমি তোমার আদরের ছোট ছেলে আর মেয়ের নামে দিয়ে দিলেই পারতে ‘
‘ কেনো সব ওদের দেবো? সবাই নিজেদের প্রাপ্যটা পাবে। আর তুমি এতো মেজাজ গরম কেনো করছো? সামনের মাসে বয়স তোমার ত্রিশ হবে ভুলে গেছো? এখন বিয়ে করবে না তো কবে…’
‘ বাবা প্লিজ, তুমি অন্তত আমাকে বিয়ে নিয়ে জ্ঞান দিও না। সংসার নামক বেড়াজালে আটকে আমি অন্তত আমার মায়ের মত কষ্ট পেতে চাইনা। এন্ড বাই দ্যা ওয়ে, আমি জানিনা তোমাকে এমন বুদ্ধি কে দিয়েছে তবে এখানে উপস্থিত সবাই জেনে রেখো। যা আমার ভাগ, সেটা আমি কাউকে দেবো না। কাউকেই না, মাইন্ড ইট ‘
বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো জারা, রায়ান ও জাফাও উঠে চলে গেলো। উকিল সাহেবও কিছু সময় পর বিদায় নিলেন। সবাই যাওয়ার পর হাসনা বেগম আনোয়ার সাহেবকে বললেন…
‘ এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো না? মানে এইভাবে ওকে উস্কে দেওয়ার মানে কি? মেয়েটা এমনিতেই আমাদের কাউকে সেভাবে পছন্দ করেনা, তার ওপর তুমি…’
‘ কিছু বাড়াবাড়ি হয়নি, মেয়েটার মন মানসিকতা কোন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে দেখেছো? ত্রিশ বছর হয়ে গেলো তাও সংসার করার ইচ্ছা নেই? ওকে চাপ না দিলে বিয়ে করানো যাবে না ‘
‘ তাই বলে এভাবে? যদি হিতের বিপরীত কিছু..’
‘ এতো চিন্তার কিছু নেই, জারা নিজের ক্ষতি হবে এমন কিছুই করবে না’
আনোয়ার সাহেব নিজের ঘরে গেলেন, উনি যেতেই হাসনা বেগম কাজের মহিলাকে ডেকে এক কাপ চা করে আনতে বললেন। এরপর আরাম করে বসে চা খেতে খেতে মনে মনে বললেন…
‘ ও মেয়ের যে বিয়ে করবে না সে আমার বেশ জানা আছে, শেষে ওর ভাগও আমার জাফাই পাবে ‘
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মিচকি হাসলেন হাসনা বেগম। উনি আনোয়ার সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী, জারার সৎ মা। উনি যখন এ বাড়িতে আসেন জারার বয়স তখন সাড়ে চার কি পাঁচ হবে। সবার সামনে স্নেহ প্রদর্শন করলেও আড়ালে উনি জারাকে একদমই পছন্দ করেন না। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জারার মনেও ওনার জন্যে ঘৃনা জমতে শুরু করে, একসময় ঘৃনা শুধু নিজের সৎ মা অব্দি সীমাবদ্ধ থাকেনি। নিজের বাবাকেও ঘৃনা করতে শুরু করেছে মেয়েটা। ওদিকে, আজ সকালে আনোয়ার সাহেব হুট করে পরিবারের সবাইকে একসঙ্গে বসিয়ে উকিল ডেকে নিজের উইল পড়িয়ে শোনাতে বলেন। বড় মেয়েকে এভাবে উস্কানোর একটাই উদ্দেশ্য আনোয়ার সাহেবের, জারার বিয়েটা দেওয়া…
_______________________________
গাড়িতে বসে আছে জারা, পাশেই ওর বান্ধবী এলিনা। এলিনাকে সব বলেছে জারা। এই সকালেই মাথাটা যেনো রাগে ফে’টে যাচ্ছে জারার
‘ এতো সহজে আমি সবকিছু ছেড়ে দেবো না, অনেক হয়েছে। সবকিছুর একটা লিমিট আছে। আজকে বাবা সব লিমিট ক্রস করে ফেলেছে ‘
‘ দেখ জারা, তোর রাগের কারণ আমি বুঝতে পারছি কিন্তু এখন কি করার আছে বল। উইলে যেভাবে লিখা আছে সেভাবেই তো সব হবে তাইনা?’
‘ বাবা আমার সঙ্গে কেনো এমন করছে? আমি যে ভালো আছি সেটা কি বাবার ভালো লাগছে না নাকি সে চাইছে আমি সব বাকিদের জন্যে ছেড়ে দেই?’
‘ আচ্ছা, তুই আগে শান্ত হ। তুই কি ভাবছিস এখন। বিয়েটা তো কখনো তুই নিজের লাইফে অপশনই রাখিসনি তাহলে এখন কি করবি?’
‘ কিছু তো একটা করতে হবে। মিসেস. হাসনা প্রতি মুহূর্তে ওৎ পেতে থাকেন কিভাবে আমার থেকে সব কেড়ে নেওয়া যাবে আর আমি নিজেই যদি সব ছেড়ে দেই সেটা ওনার জয় হবে। আমি সেটা হতে দেবো না। কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে ‘
‘ তাহলে কি করবি? বিয়ে করবি? তোর পছন্দের কেউ আছে?’
‘ তুই জানিস আমি কাউকে পছন্দ করিনা, তাও এই কথা কেনো বলছিস?’
‘ তাহলে? আচ্ছা আমার দুইজন আত্মীয় আছে, বিয়ের জন্যে মেয়ে খুঁজছে তারা। তাদের দেখবি? যদি কাউকে পছন্দ হয় তাহলে…’
‘ এখন আর কি করার আছে! নাম্বার দিস আমাকে, মিট করে দেখবো। যদি হয় তাহলে ভালো আর নইলে না ‘
‘ বেশ, আমি দিয়ে দেবো। চল তাহলে কোথাও গিয়ে একটু খাওয়া দাওয়া করি?’
‘ না রে, এখন সময় হবেনা। দরকারি একটা কাজে যেতে হবে আমাকে। এমনিতেই সকালে বাবার ওই কাহিনীর জন্যে দেরি হয়ে গেছে
‘ ফাইন! পরে দেখা হবে তাহলে ‘
ওর বান্ধবী গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো, জারা আর দেরি না করে গাড়ি ঘুরিয়ে নিজ গন্তব্যের দিকে ছুটলো। জারা পেশায় একজন ফ্যাশন ডিজাইনার, ছয় বছর আগে এক ফ্যাশন হাউজের দেওয়া সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। খ্যাতিও পেয়েছে। বছর দুই আগে নিজের একটা ছোটো ফ্যাশন হাউজ খুলেছে, তেমন লাভ না হলেও সময় সাপেক্ষে মোটামুটি একটা সফলতা পেয়েছে বলা যায়। আপাতত তাতেই খুশি জারা। আধা ঘণ্টার মধ্যেই নিজের গন্তব্যে পৌঁছে গেলো জারা, গাড়ি পার্ক করেই জলদি গিয়ে লিফটে উঠলো। পাঁচ তলায় থেমেই দু মিনিট হেঁটেই বসের অফিস। দরজায় নক করে কারো সাড়া না পেয়ে নিজেই ভেতরে ঢুকে গেলো জারা, তখনই….
‘ ইউ আর টুয়েন্টি মিনিটস লেট!’
ঘুরে তাকালো জারা, ততক্ষণে পুরুষটি কক্ষে প্রবেশ করেছেন। শহরের সবচেয়ে নামকরা জুয়েলারি ডিজাইনার আবরার নওয়াজ খান, তার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছে জারা। জারার বিজনেস পার্টনার ও ওর ফ্যাশন হাউজের ইনভেস্টর আবরার।
‘ ব্যক্তিগত কিছু কারণে দেরি হয়ে গেছে, দুঃখিত ‘
‘ সকালবেলা ব্যক্তিগত কারণে দেরি সাধারণত বিবাহিতদের হয়, আপনি তো বিবাহিতা নন ‘
‘ অবিবাহিতদের কি দেরি হওয়ার মতো ব্যক্তিগত কারণ থাকতে পারে না?’
‘ থাকতেই পারে। তবে তা অবশ্যই বিবাহিতদের তুলনায় কম হবে, আই গেস ‘
‘ মানে?’
‘ না মানে আমার আপুকে বলতে শুনেছি রোজ সকালেই নাকি আমার দুলাভাইয়ের সঙ্গে একটা না একটা ঝামেলা হয়ে ঝগড়া বেঁধে যায়। তার জন্যে বাচ্চাদের স্কুল ও ভাইয়ার অফিস উভয়েই দেরি হয় ‘
যদিও আবরার কথাগুলো মজার ছলে বলেছে কিন্তু জারার এই মুহূর্তে এগুলো ভালো লাগছে না তাই ও সরাসরি প্রশ্ন করলো…
‘ দেরি হওয়ার জন্যে আই অ্যাম সরি, আমার মনে হয় আর সময় নষ্ট না করে আমাদের কাজের কথা বলা উচিত। আপনি সকালে আমাকে আর্জেন্টলি আসার জন্যে মেসেজ কেনো করেছিলেন জানতে পারি?’
‘ ইয়াহ সিওর, বসুন ‘
চেয়ার টেনে বসলো দুজনেই, আবরার জারাকে জিজ্ঞাসা করলো..
‘ চা না কফি খাবেন?’
‘ একটাও না ‘
‘ তাহলে অন্যকিছু?’
‘ নো, থ্যাংকস! আমি এখান থেকে বেরিয়ে খেয়ে নেবো’
‘ ওকে! সামনের মাসে আমাদের নতুন একটা জুয়েলারি লঞ্চ করা হবে তার জন্য আমরা একটা র্যাম্প শোয়ের আয়োজন করবো। আমি চাইছি আমাদের মডেলরা আমাদের জুয়েলারির সঙ্গে আপনার ডিজাইন করা ড্রেস পড়ুক ‘
‘ আপনি আমার ড্রেস আর আপনার জুয়েলারি দুটোর একসঙ্গে প্রমোশন করতে চাইছেন?’
‘ ইয়াহ! আমার মনে হলো এতে আমাদের উভয়েরই লাভ হবে। জুয়েলারি লঞ্চে অনেকেই আসবে। হতে পারে এতে আপনারও লাভ হয়ে গেলো ‘
‘ কিন্তু, আমাকে এরকম একটা সুযোগ কেনো দিচ্ছেন?’
‘ আমি আপনার ইনভেস্টর, আমি অবশ্যই চাইবো আপনার লাভ হোক। আপনার লাভ মানেই আমার লাভ, রাইট?’
‘ দ্যাটস ট্রু! কিন্তু আমি কয়েকমাস আগে ফ্যাশন শো করেছি। এখন আমার তেমন নতুন ডিজাইন করা ড্রেস নেই। পুরোনো ড্রেস দিয়ে হবে নাকি…’
‘ হাতে এখনও অনেকটা সময় আছে, আপনি পারলে কয়েকটা ডিজাইন করে নিন। নতুন হলে ভালো হয়, ইউ নো হোয়াট আই মিন ‘
‘ ইয়াহ, ওকে আমি চেষ্টা করছি। থ্যাংক ইউ আমাকে সুযোগ দেওয়ার জন্যে ‘
‘ ইউ আর ওয়েলকাম ‘
আবরারের সঙ্গে কথা শেষে উঠে দাঁড়ালো জারা, ওর কর্মক্ষেত্র থেকে বারবার ফোন আসছে। ও যাওয়ার সময় আবরার হঠাৎ ডেকে উঠলো..
‘ জারা…’
‘ জ্বি, বলুন!’
‘ আপনি ঠিক আছেন?’
‘ ইয়াহ, কেনো?’
‘ কিছুনা ‘
ভ্রু কুঁচকে নিলো জারা, আবরারের উত্তর শোনার জন্যে এখানে দাড়িয়ে থাকার সময় জারার নেই। তাই ও আর কিছু না বলে বেরিয়ে পড়লো। জারা যাওয়ার পর চেয়ারে আবরার গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো আবরার। মনে মনে ছোটখাটো একটা হিসেব করে কষে বের করলো কতদিন পর আজ জারার সঙ্গে দেখা হলো। বিড়বিড়য়ে হঠাৎ আনমনেই বলে উঠলো…
‘ আড়াই মাস ‘
_________________________________
আজকে কোনো কাজেই মন দিতে পারছে না জারা, মাথার মধ্যে শুধু বাবার ওই উইলের কথা ঘুরঘুর করছে। বাবা যা বলেছে তার নড়চড় হবেনা তা জারা ভালোভাবেই জানে। অন্য কোনো শর্ত হলে দু দণ্ড ভাবতো না ও কিন্তু এই বিয়ের শর্ত মানতে পারছে না কারণ ওর মা বাবার বিচ্ছেদের পর ছোটবেলা থেকেই বিয়ে, সংসার নিয়ে নেগেটিভ চিন্তা ঢুকে গেছে জারার মাথায়। জ্ঞান হওয়ার পর মেয়েটা পণ করেই নেয়, বিয়ে করবে না। তাই তো বয়স প্রায় ত্রিশ ছুলেও জীবনে কাউকে আসতে দেয়নি, বন্ধুবান্ধব – কাজ এসবেই ব্যস্ত থেকেছে কিন্তু আজকের বিষয়টা বেশ ভাবাচ্ছে জারাকে। বারবার ওর মনে হচ্ছে এসব ওর সৎ মায়ের কাজ, সেই হয়তো ওর বাবাকে বুদ্ধি দিয়ে এমন একটা উইল বানাতে বলেছে… এসব ভাবতে ভাবতে আবারো আরেকটা কাগজ দু’ম’ড়ে মু’চ’ড়ে ডাস্টবিনে ফেললো জারা। অনেকক্ষণ ধরে নতুন কিছু ডিজাইন করার চেষ্টা করছে পারছে না। প্রায় সাত – আট পিস কাগজ নষ্ট করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। এসব দেখে ওর সেক্রেটারি জিজ্ঞাসা করলো…
‘ ম্যাডাম, আপনি ঠিক আছেন তো?’
দীর্ঘশ্বাস ফেললো জারা…
‘ না, আজকে ভালো লাগছে না। মনে হয় না কোনো কাজ আজ ঠিকঠাক করতে পারবো ‘
‘ আপনি তাহলে বাড়ি চলে যান, রেস্ট করুন। আজ তেমন কাজ নেই। যা আছে আমি সামলে নেবো ‘
‘ ঠিক আছে ‘
ব্যাগে সব গুছিয়ে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো জারা, আজ রাতে ভালোভাবে একটু ঘুম না হলে কাজ হবেনা। কিন্তু এতো চিন্তা মাথায় নিয়ে কি আদৌ ঘুম আসবে?
চলবে….