সুখ অমৃত পর্ব-০৪

0
119

#সুখ_অমৃত
#পর্বঃ৪
#লেখিকাঃদিশা_মনি

মানতাশাকে বধূবেশে সাজানোর জন্য পার্লার থেকে লোক এসেছে। গতকাল বিয়ার করবে না বলে হম্বিতম্বি করলেও আজ সে এনিয়ে কোন প্রতিবাদ করে নি। সকাল থেকে বেশ স্বাভাবিক আছে। মঞ্জুয়ারা বেগম ভেবেছিলেন মানতাশা আজ পালিয়ে যাবার চেষ্টা করবে কিংবা এই বিয়েতে অন্য কোন ভাবে হলেও বিঘ্ন সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মানতাশা প্রতিক্রিয়াহীন। এটাতে অবশ্য তিনি বেশ স্বস্তিতে আছেন।

পার্লারের লোকদের মানতাশার রুমে পৌঁছে দিয়ে তিনি মানতাশার উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“তুই যে চুপ আছিস এবং স্বাভাবিক ভাবে এই বিয়েটা মেনে নিয়েছিস এটা দেখে আমার ভালো লাগল। এখন ভালো মেয়ের মতো চুপচাপ এই বিয়েটা করে নে, তারপর দেখবি তোর সব বদনাম ঘুছে যাবে। আমার কথা মিলিয়ে নিস, এই বিয়ের পর তোকে একদম পস্তাতে হবে না।”

মানতাশা কোন জবাব দেয় না। সে মনে মনে বলে,
“আসল খেলা তো আজ বিয়ের আসরে হবে। সেটা দেখার জন্য তৈরি থাকুন মিস্টার আবু সুফিয়ান।”

মঞ্জুয়ারা বেগম মানতাশার রুম থেকে বেরোনোর পরই তার কাছে সুফিয়ানের কল আসে। তিনি ফোনটা রিসিভ করতেই সুফিয়ান বলে,
“ওদিকের কি অবস্থা? মানতাশা কি আবার কোন নতুন ঝামেলা করছে?”

মঞ্জুয়ারা বেগম হাসি মুখে বলেন,
“আরে, কি যে বলেন। মানতাশা আর কোন ঝামেলা করে নি, ও স্বাভাবিক ভাবেই সব মেনে নিয়েছে। আমার মনে হয় ওর সুবুদ্ধি হয়েছে।”

মঞ্জুয়ারা বেগমের কথায় খুব একটা ভরসা পায়না আবু সুফিয়ান। কারণ সে কাল মানতাশার চোখে যেই জেদ দেখেছে সেই মেয়ে যে এত সহজে বিয়েতে রাজি হবে না, সেটা স্পষ্টতই বোঝা যায়। সুফিয়ান স্পষ্ট বুঝতে পারে এর মধ্যে কোন ঘাপলা আছে। তাই সে মঞ্জুয়ারা বেগমের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“মানতাশার উপর নজর রাখবেন ভালো করে। আমার মনে হচ্ছে ও তলে তলে কোন পরিকল্পনা করছে।”

“আমার সেটা মনে হচ্ছে না।”

“আপনাকে যা বলছি তাই করুন, অনেক কষ্টে আমি এমন পরিস্থিতির তৈরি করেছি যাতে মানতাশা আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়৷ এখন আমি চাই না, কোনভাবে তীরে এসে তরী ডুবুক।”

মঞ্জুয়ারা বেগমের বেশ খটকা লাগে। তাই তিনি জিজ্ঞেস করেন,
“অনেক কষ্টে মানে? তাহলে কি কাল আপনিই মানতাশাকে ফাসিয়েছিলেন?”

আবু সুফিয়ান এবার বেশ রাগী স্বরে ধমক দিয়ে বলে,
“আপনাকে তো এত কিছু জানতে হবে না। মানতাশার সাথে আমার বিয়ে হলে আপনি প্রতিশ্রুতি মোতাবেক এক কোটি টাকা পাবেন। সেটা নিয়েই খুশি থাকুন।”

বলেই সুফিয়ান ফোন কে’টে দেয়। অতঃপর রুমের বাইরে আসে। সেখানে তার খাশ লোক আব্দুল করিম দাঁড়িয়ে। আব্দুল করিম সুফিয়ানকে দেখেই সালাম দেয়। সুফিয়ান সালামের উত্তর দিয়ে বাঁকা হেসে একটা চেক বাড়িয়ে দেয় আব্দুল করিমের দিকে। আব্দুল করিম চেকটা হাতে নিয়ে সেখানে চুমু খেয়ে বলে,
“ধন্যবাদ, জনাব।”

“তোমার উপর আমি ভীষণ খুশি আব্দুল করিম। তুমি যেভাবে মেয়েটাকে ফাসিয়েছ তা বলার বাহিরে।”

আব্দুল করিম মৃদু হাসে। সুফিয়ান একটু কড়া গলায় বলে,
“মেয়েটার সাথে কিছু করো নি তো?”

আব্দুল করিম জিভে দাঁত কেটে বলে,
“ছি, জনাব। উনি আপনার হবু স্ত্রী হবে। ওনার সাথে আমি কিভাবে কি করতে পারি? আপনার কথামতো আমি শুধু ঐ মেয়েকে অজ্ঞান করে রুমে শুইয়ে দিয়েছিলাম। আর একটা মেয়েকে সাথে করে নিয়ে গেছিলাম। সেই মেয়েই ওর জামা-কাপড় খুলে নগ্ন করে বিছানায় শুইয়ে দেয়। তারপর আমি ফোন করে এলাকার সবাইকে বলি যে আপনাদের পাশের বাড়িতে নষ্টামি চলছে। বাকিটা তো জানেনই।”

সুফিয়ান উচ্চস্বরে হেসে ওঠে।

“কাজটা তুমি দারুণ করেছ।”


আজ সময় যেন একটু জলদিই পেরিয়ে যাচ্ছে। মানতাশা বারবার ঘড়িতে সময় দেখছে। সন্ধ্যা ৭ টা বাজে। ৭ঃ৩০ নাগাদ সুফিয়ান চলে আসবে। তার পূর্বেই মানতাশাকে যা করার করতে হবে। মানতাশা আবারো নিজের ফোন বের করে। কাঙ্খিত নম্বরটি ডায়েল করে সেখানে ফোন করে। কিছুক্ষণ রিং হবার পর ফোনটা রিসিভ হয়। মানতাশা অসহায় কন্ঠে বলে ওঠে,
“রেখা, কোথায় তুই? আমি আর কতক্ষণ এভাবে অপেক্ষা করব?”

রেখা বলে,
“আমি একটা কাজে আটকা পড়ে গেছি। তাই আমার ভাইয়াকে পাঠিয়েছি তোকে আনার জন্য। তুই আমার ভাইয়ার সাথে চলে আয় প্লিজ। ভাইয়া একটু পড়েই পৌঁছে যাবে।”

“তোর ভাইয়া মানে রাসেল ভাই? কত দূরে উনি?”

“ভাইয়া তো বলল, উনি প্রায় পৌঁছেই গেছেন। তুই একটু অপেক্ষা কর।”

“আচ্ছা।”

বলেই মানতাশা ফোন রেখে দেয়। রেখা মানতাশার একজন বিশ্বস্ত বন্ধু। এই বিপদের দিনে তাই তাকেই স্মরণ করেছে মানতাশা। রেখার সাথে কথা বলার পর আবারো নিজের ব্যাগে সবকিছু ভালো ভাবে চেক করে নেয় মানতাশা। হ্যাঁ, পাসপোর্ট, ভিসা সবকিছু ঠিকই আছে।

গত বছর মানতাশার ইচ্ছা ছিল উইন্টার হলিডেতে বিদেশে ঘুরতে যাবে। কিন্তু তার বাবা সেই সময় ব্যস্ত থাকায় আর কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠে নি। কিন্তু মানতাশার বাবা তাকে কথা দিয়েছিল সামার হলিডেতে তাকে দুবাইয়ে ঘুরতে নিয়ে যাবে। সেই জন্য পাসপোর্ট ভিসা সব করে রাখাও ছিল। দুবাইয়ে মানতাশার ফুফু সপরিবারে থাকে। মানতাশা গতকাল রাতেই ফুফুর সাথে কথা বলে রেখেছে। বাবার মৃত্যুর পর এখন ফুফুই তার একমাত্র ভরসা। তাই মানতাশা ঠিক করেছে আজকেই সে পালিয়ে নিজের ফুফুর কাছে দুবাইয়ে চলে যাবে। এজন্য নিজের বান্ধবী রেখার সাথে যোগাযোগ করেছে। রেখা তাকে সাহায্য করার আশ্বাস দিয়েছে। বিমানের টিকেটের বন্দোবস্তও সে করে দিয়েছে। এসব ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মানতাশা।

একটু পরেই তার ফোন বেজে ওঠে। রেখার কল। মানতাশা ফোন রিসিভ করতেই রেখা বলে ওঠে,
“ভাইয়া পৌঁছে গেছে। তুই জলদি নিচে নেমে যা।”

মানতাশা ফোন রেখে পরণের শাড়ি খুলে দ্রুত একটা বোরখা পড়ে নেয়। নিজেকে আড়াল করার জন্য। অতঃপর ধীর পায়ে হেটে বাইরে আসার চেষ্টা করে। মাঝপথে হঠাৎ করে কেউ তার হাত ধরে টান দেয়। মানতাশা তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিলেই মঞ্জুয়ারা বেগম তাকে ধরে ফেলে এবং বলে,
“কি ভেবেছিস? এত সহজে আমার চোখকে ফাকি দিয়ে পালিয়ে যাবি?”

মানতাশা মঞ্জুয়ারা বেগমকে দেখে হতাশার শ্বাস ফেলে। তাহলে কি তীরে এসে তরী ডুবল বলে?


আবু সুফিয়ান একদম রাজকীয় বেশে বরের সাজে সেজে উঠেছে। দারুণ কারুকাজ করা সাদা পাঞ্জাবী তার উপর শেরওয়ানীতে দারুণ লাগছে তাকে। আজ যেন তার বয়স অনেকটাই কমে গেছে। কেউ দেখে বলবেই না, তার বয়স ৩৩, এক দেখায় যে কেউ ২৫ বছরের যুবক ভেবে ভুল করবে। আবু সুফিয়ান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,
“আমার জন্য অপেক্ষা করো মানতাশা। আর মাত্র কিছু সময়ের অপেক্ষা, তারপর আমি তোমাকে একদম নিজের করে নেব। তুমি না চাইলেও আমার কাছে তোমাকে ধরা দিতেই হবে।”

বলেই নিজের গায়ে সুগন্ধী মেখে নেয় আবু সুফিয়ান।

তারপর গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করে। তার নিকটাত্মীয় বলতে তেমন কাছের কেউ নেই। সুফিয়ানের সবথেকে কাছের বলতে তার সেক্রেটারি রাশেদ। সেই রাশেদকেই সবদিক তদারকির দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে। বিজনেস করার সুবাদে বেশ ভালোই পরিচিতি তৈরি হয়েছে, সেই পরিচয়কে কাজে লাগিয়েই অনেকের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছে। সেইসব ব্যক্তিদের নিজের বিয়েতে নিমন্ত্রণও করেছে। এখন তাদের আপ্যায়নের ভার পুরো রাশেদের কাঁধে।

রাশেদ এসে উপস্থিত হয় সুফিয়ানের কক্ষের সামনে। সুফিয়ান তাকে দেখে বলে,
“সব কাজ কমপ্লিট?”

“জ্বি, স্যার। আপনার গাড়িও চলে এসেছে। চলুন এখন।”

“হুম, যাচ্ছি।”

বলেই আবু সুফিয়ান একটা হাসি দেয়। এবার তার গন্তব্য মানতাশাদের বাড়ি। সেখানে যাওয়ার পরেই মানতাশাকে একদম নিজের করে নেবে।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨