সুখ অমৃত পর্ব-০৭

0
105

#সুখ_অমৃত
#পর্বঃ৭
#লেখিকাঃদিশা_মনি

আবু সুফিয়ান রেগে তাকিয়ে আছে রাশেদের দিকে৷ রাশেদও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। কি জবাব দেবে সে তার মহামান্যকে? যে এত চেষ্টা করেও মানতাশাকে খুঁজে পায়নি। ২৪ ঘন্টা পেরিয়ে যাবার পরও সে খোঁজ দিতে পারেনি। এটা তার কাছে লজ্জার। কিন্তু তারো যে কিছু করার নেই। নিজের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে কিন্তু ফলাফল শুণ্য। রাশেদ সুফিয়ানের সামনে মাথা নত করে রাখে। আক্ষেপের সুরে বলে,
“স্যার,আমি পারিনি আপনার কথা রাখতে। আমি মানতাশার কোন খোঁজ পাইনি। আপনি আমাকে যেই শাস্তি দিতে চান দিন। আমি নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাচ্ছি।”

“রাশেদীন, আমি তোমাকে এইভাবে দেখতে চাই না। যত সময় লাগে লাগুক, কিন্তু ঐ মেয়ের খোঁজ আমার চাই। তুমি ঐ মেয়ের সন্ধান শুধু একবার আমার কাছে এনে দাও। তারপর আমি ওকে দেখে নিচ্ছি..”

“আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব স্যার। ঐ মেয়ের খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত শান্তিতে নিঃশ্বাস নিবো না। ওকে টেনে এনে আপনার পায়ের তলায় আনতে না পারলে আমার শান্তি নেই।”

সুফিয়ান শান্তি পায় রাশেদের কথায়। বলে,
“এই জেদটাই তোমার মাঝে দেখতে চেয়েছিলাম রাশেদ। এর আগেও তুমি আমার অনেক বড় বড় সমস্যার সমাধান করেছ। আশা করি এবারও তার ব্যত্যয় ঘটবে না।”

“জ্বি, স্যার।”

সুফিয়ান প্রসন্ন চিত্তে হাসে।


মানতাশার দিকে মোহিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল জাইন। জাইনের এই দৃষ্টি মানতাশাকে অস্থির করে তুলছিল। উমায়রাও বুঝতে পারছিল ব্যাপারটা। তাই আর দেরি না করে জাইনের সম্মুখে গিয়ে এমন ভাবে দাঁড়ায় যাতে মানতাশা তার দৃষ্টিগোচর না হয়। আচমকা উমায়রা এভাবে সামনে চলে আসায় জাইন ভ্রু কু্ঁচকে তাকায়। উমায়রা মাথা নিচু করে শুধায়,
“বলুন জাইন,আপনার আমাকে কিজন্য দরকার ছিল?”

“ঐ মেয়েটা কে?”

জাইনের এহেন প্রশ্নে কি উত্তর দেবে ভেবে পায়না উমায়রা। পিছন ফিরে মানতাশার দিকে একপলক তাকিয়ে বলে,
“ও হলো মানতাশা। আমার মামাতো বোন।”

জাইন আবারো মুগ্ধ হয়ে তাকায় মানতাশার দিকে। মানতাশার দিক থেকে দৃষ্টি ফেরানোর জন্য উমায়রা বলে,
“কিজন্য ডাকছিলেন বললেন না যে?”

জাইন বিরক্ত হলেও সেটা প্রকাশ না করে শান্তস্বরে বলে,
“আমার প্রিয় ব্লেজারটা খুঁজে পাচ্ছি না। আজ কিছু জরুরি কাজে লন্ডন যাচ্ছি৷ তাই আমার ওটার প্রয়োজন।”

উমায়রা বলে ওঠে,
“আপনি নিজের কক্ষে যান, আমি আপনার প্রিয় ব্লেজার বের করে দিচ্ছি।”

“কেন,আমি এখানে থাকলে কি তোমার কোন অসুবিধা?”

উমায়রা দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে না-বোধক ইশারা করলো। জাইন মানতাশার দিকে তাকিয়ে বলে,
“বাসায় নতুন মেহমান এসেছে, তার সাথে একটু পরিচিত হয়ে নেই।”

উমায়রা ব্যথিত নয়নে মানতাশার দিকে তাকায়। জাইন ধীর পায়ে মানতাশার দিকে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় হ্যান্ডশেক করার জন্য। হেসে বলে,
“আমি মোহাম্মদ বিন জাইন, তোমার দুলাভাই হই সম্পর্কে।”

মানতাশা জাইনকে সালাম জ্ঞাপন করে বলে,
“আরবে হাত মেলানোর সংস্কৃতি আছে জানা ছিল নাতো?”

জাইন কিছুটা অপমানিত বোধ করলেও হেসে বলে,
“আমি তো বিভিন্ন ব্যবসায়িক কাজে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াই। সেখানকার রমনীরা তো হ্যান্ডশেকেই অভ্যস্ত। তাই আরকি..”

“আমরা বাঙালি রমনীরা এতে অভ্যস্ত নই, কারণ আমরা মুসলিম।”

জাইন আর কিছু বলতে পারে না। কিন্তু এটা ঠিকই বুঝতে পারে এই মেয়ে মোটেই যেমন সাধাসিধা দেখতে আসলে তেমন নয়। তবুও বাকা হেসে মনে মনে বলে,
“এমন মেয়েই তো আমার পছন্দ।”


দুপুর বেলায় উমায়রা মানতাশাকে নিয়ে আসে সালমা বেগমের কক্ষে। সালমা বেগম, মোহাম্মদ বিন জাফরের স্ত্রী। সম্পর্কে উমায়রার চাচী এবং শ্বাশুড়ি। মানতাশা অনেক ভয়ে ছিল যে জানি না তিনি কেমন হবেন। তবে তার কক্ষে আসতেই ভয় উবে গিয়ে একরাশ মায়া ভড় করলো। হুইল চেয়ারে বসে কোরান পাঠ করছেন একজন মধ্যবয়সী নারী। উমায়রা কক্ষের বাইরে থেকে তার উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“আম্মাতুন(চাচী), ভিতরে আসব?”

সালমা বেগম কোরান পাঠ থামিয়ে তাদের পানে চায়। সম্মানের সহিত কোরানটা যথাস্থানে রেখে দিয়ে বলেন,
“এসো।”

উমায়রা মানতাশাকে ভেতরে চলার ইশারা করে। দুজন একসাথে ভিতরে প্রবেশ করে। উমায়রা সালমা বেগমের সাথে সালাম বিনিময় করে বলেন,
“আম্মাতুন, ও হলো মানতাশা। আমার মামাতো বোন। আম্মুর কাছে শুনলাম আপনি ওনার সাথে দেখা করতে চাইছেন। তাই ওকে নিয়ে এলাম।”

সালমা মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকায় মানতাশার দিকে। মানতাশা সালাম বিনিময় করে তার সহিত। সালমা বেগম স্নেহভরা কণ্ঠে বলেন,
“তোমায় দেখে অনেক খুশি হলাম। হুসনেয়ারার কাছে তোমার কথা অনেক শুনেছি। আজ সামনাসামনি দেখলাম। আসলেই তুমি অনেক মায়াবী। এখানে কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?”

মানতাশা বলে,
“না, আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না এখানে।”

“কোন অসুবিধা হলে নিঃসংকোচে জানাবে। উমায়রা তুমি তো জানো আমার অবস্থা। যদি আমি ঠিক থাকতাম তাহলে যথেষ্ট চেষ্টা করতাম ওর যত্ন-আত্তি করার। কিন্তু…যাইহোক তোমার আর হুসনেয়ারার উপর আমার ভরসা আছে। তোমরা ওর খেয়াল রেখো। যাতে ওর কোন অসুবিধা না হয়।”

“আপনি কোন চিন্তা করবেন না আম্মাতুন, আমরা ওর যথাযথ খেয়াল রাখব।”

সালমা বেগম যেন নিশ্চিত হলেন। মানতাশারও সালমা বেগমের এমন ব্যবহার ভীষণ ভালো লেগে গেল। বুঝতে বাকি রইল না তার সম্মুখে দাঁড়ানো এই মহিলাটি ভীষণ দয়ালু এবং ভালো মনের।

সালমা বেগমের সাথে দেখা করে কক্ষ থেকে বের হলো দুজন। একটু সামনে অগ্রসর হতেই দুজনে মুখোমুখি হলো এক নারীর। মানতাশা ভ্রু কুচকে তাকালো সেই নারীর দিকে। পরনে লম্বা গাউন। হিজাবও ব্যবহার করেন নি এই নারী। পোশাক, আশাক দেখে ভীষণ শৌখিন মনে হচ্ছে। নারীটি মানতাশার দিকে কিছুক্ষণ কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে উমায়রার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“কে এই মেয়ে?”

“ও মানতাশা,আমার মামাতো বোন।”

নারীটি ভীষণ বিদ্বেষের সহিত বিদ্রুপ করে বলল,
“ভালোই তো, আমার স্বামী আর শ্বশুরের টাকা নষ্ট করার জন্য নতুন একজনকে হাজির করেছ।”

নারীটির এহেন কথায় চুপসে গেল উমায়রা। করুণ চোখে তাকালো মানতাশার দিকে। মানতাশা রাগী চোখে তাকিয়ে উক্ত নারীর দিকে। সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই উমায়রা বলে উঠল,
“উনি হলেন হাফসা বেগম, জাইনের বড় পত্নী।”

মানতাশা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। সে জানত যে আরব পুরুষরা সাধারণত বহুবিবাহ করে থাকে। বাংলাদেশে এর খুব একটা প্রচলন না থাকলেও আরবে অধিকাংশ পুরুষই বহুবিবাহ করে। তাই বলে উমায়রা যে এভাবে কারো দ্বিতীয় পত্নী হবে এটা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। হঠাৎ করে খুব অভিমান হলো নিজের ফুফা আর ফুফুর উপর। তারা কিভাবে এমনটা করতে পারলো? যদিও এটা আরবে খুব স্বাভাবিক কিন্তু মানতাশার মেনে নিতে কষ্ট হলো। এমনিই জাইন নামক পুরুষটির অদ্ভুত দৃষ্টি তার ভালো লাগে নি আর উপর এই সত্য। সে অভিমানে হনহন করে স্থান ত্যাগ করলো। উমায়রা তার পিছু পিছু যেতে নিবে এমন সময় হাফসা তার হাত টেনে ধরে মুখ চেপে ধরে বলল,
“তোমার মামাতো বোনের এত সাহস হয় কিভাবে যে আমাকে এভাবে অপমান করে?”

“আপনি ভুল ভাবছেন। ও আপনাকে অপমা করেনি।”

“ভুল, আমি ভুল…খুব সাহস বেড়েছে তাইনা? এত সাহস কোথায় পাচ্ছ? ঐ মেয়ে আমার অনুমতি বিনা কিভাবে স্থান ত্যাগ করলো এভাবে? ওকে এই মহলের নিয়ম শিখিয়ে দিও। নাহলে বেশিদিন টিকতে পারবে না।”

বলেই হাফসা ধাক্কা দিয়ে উমায়রাকে ফেলে দিলো। একটুও করুণা না করে চলে গেলো ত্রস্ত পায়ে। উমায়রা সেখানেই বসে অশ্রু বিসর্জন দিলো। ক্ষমতাহীন বাবার সন্তান হওয়ায় এটাই বুঝি তার ভবিতব্য। তাই তো মেয়ে নিয়েছে সব অপমান আর লাঞ্চনা।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨