#সুখ_অমৃত
#পর্ব_২১
#লেখিকাঃদিশা_মনি
মানতাশা উদাস মনে পুরো বাড়িময় পায়চারি করছে৷ এই বাড়িতে আজকাল তার মন টেকে না। আপনজনদের হারানোর বেদনা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। মনে পড়ে যায় উমায়রা এবং সালমা বেগমের কথা। মানতাশা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। হঠাৎ করেই তার মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয় হাফসা বেগমের সাথে। হাফসা বেগম মানতাশার দিকে তাকিয়ে একটা নির্দয় হাসি দিয়ে বলে,
“শুনলাম, তুমি মা হতে চলেছ। নিজের এবং নিজের সন্তানের যত্ন নিও।”
মানতাশা হাফসা বেগমকে পর্যবেক্ষণ করে। মহিলাকে বেশ আনন্দিত লাগছে। এত ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে এই মহিলা আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে! ব্যাপারটা ভাবতেই মানতাশার রাগ হলো। হাফসা বেগম মানতাশাকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে গেল৷ তারপর আর একটু এগিয়ে গিয়ে পেছন ফিরে কুটিল হেসে মনে মনে বলল,
“তুমি কি ভেবেছিলে? সবকিছু এত তাড়াতাড়ি মিটে যাবে? কিচ্ছু মিটে যায়নি মানতাশা। নতুন বিপদের মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হও।”
মানতাশা নিজের কক্ষে গিয়ে জাদকে চিন্তিত অবস্থায় দেখতে পায়। জাদকে জিজ্ঞেস করে,
“আপনাকে এমন লাগছে কেন?”
জাদ একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“জানি না, হয়তো কোন বিপদ আমাদের দিকে ঘনিয়ে আসছে।”
মানতাশার বুক অজানা আশংকায় কেপে ওঠে। সবেই তো একটা মাত্র বিপদ থেকে তারা মুক্তি পেল। আবার কোন নতুন বিপদের হাতছানি! মানতাশা বলে উঠল,
“কি বিপদ!”
জাদ বলে,
“আমাকে হয়তো গ্রেফতার করা হতে পারে!”
“গ্রেফতার!”
“হু, তুমি তো জানোই আমি এখানে একটা গ্যাং তৈরি করেছিলাম। যদিও আমার উদ্দ্যেশ্য খারাপ ছিল না কিন্তু দুবাইয়ের আইনে এটা একটা অপরাধ। এজন্য আমি বিষয়টা গোপন রেখেছিলাম কিন্তু জানি না কিভাবে তথ্যটা বাইরে গেল। আমাকে গোয়েন্দা কতৃক নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। যেকোন সময় তারা আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ পেয়ে যাবে আর…”
মানতাশা আর শুনতে পারল না। ভয়ে তার পুরো শরীর কাপছে। সে কাপা কাপা স্বরে বলে,
“যদি আপনি ধরা পড়ে যান তাহলে কি শাস্তি হতে পারে?!”
“কমপক্ষে ১০ বছরের কারাদণ্ড থেকে এমনকি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত!”
মানতাশা কাঁদতে শুরু করে দিলো জাদের কথা শুনে। জাদ এগিয়ে এসে মানতাশার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল,
“কেঁদো না, মানতাশা৷ তোমাকে এখন এত ভেঙে পড়লে চলবে না। তোমাকে স্ট্রং থাকতে হবে। আমার কিছু হয়ে গেলে তোমাকেই তো আমাদের অনাগত সন্তানকে একা হাতে সামলাতে হবে।”
মানতাশা কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিল না। সে জাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আপনি আমাকে এই অবস্থায় একা ছেড়ে যাবেন না, জাদ। আমি যে বড্ড একা হয়ে যাব।”
“তুমি একা নও। তোমার পাশে আমার অংশ আমার সন্তান থাকবে। তোমাকে ওর শক্তি হয়ে উঠতে হবে মানতাশা, দূর্বলতা নয়।”
“জাদ!”
★★★
হাফসা বেগম অপেক্ষার প্রহর গুনছে। তার মুখে শোভা পাচ্ছে শয়তানী হাসি। হাফসা বেগম নিজের হাতের নখ কাটতে কাটতে বলছে,
“এতক্ষণে হয়তো পুলিশের কাছে জাদের গ্যাং তৈরি করার প্রমাণ পৌঁছে গেছে। কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। তোমাদের জীবনে আমি সুখকে স্থায়ী হতে দেব না মানতাশা। দুঃখকে পুনরায় আলিঙ্গন করার জন্য প্রস্তুত হও।”
জাদ আজ হঠাৎ কি যেন মনে করে জাইনের কক্ষে এলো। জাইন নিজের ছোট শিশু উসমানকে নিজের কোলের সাথে জড়িয়ে বসেছিল। জাদ তার সম্মুখীন হয়ে আবেগপূর্ণ স্বরে বলল,
“ভাইয়া।”
জাইন জাদের পানে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, বল।”
জাদ একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,
“তোর কাছে একটা অনুরোধ রাখব,কথা দেখে আমার অনুরোধ তুই ফেলবি না।”
“এভাবে বলছিস কেন ভাই? আমি নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করব তোর অনুরোধ রাখার।”
“আমার অবর্তমানে মানতাশার খেয়াল রাখিস, ও যে আমার অনাগত সন্তানের মা হতে চলেছে।”
“তোর অবর্তমানে মানে?!”
জাদ বলে,
“আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আমার দিকে কোন বিপদ ধেয়ে আসছে। তুই শুধু আমার অনুরোধটা রাখিস।”
জাইন কোন অনুভূতি ব্যক্ত করতে পারল না। জাদ জাইনের হাত শক্ত করে ধরে বলল,
“নিজের ছোট ভাইয়ের এই অনুরোধটা রাখিস।”
জাইন কিছু বলতে যাবে তার আগেই তাদের বাড়ির গার্ডস এসে খবর দিল বাইরে পুলিশ এসেছে। জাদ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,
“এরই অপেক্ষায় ছিলাম!”
মানতাশা ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হয়ে পুলিশ ফোর্সকে দেখে অবাক হয়ে যায়। তাদের কাছে বন্দি ছিল জাদের গ্যাং এর কিছু সদস্য। সবাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। মানতাশার চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগল। স্ব বুঝল এখানে কি ঘটতে চলেছে।
জাদ ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হতেই একজন পুলিশ কর্মকর্তা তার হাতে হাতকড়ি পড়িয়ে বলে,”ইউ আর আন্ডার এরেস্ট”
জাদ কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল না। মানতাশা এই দৃশ্য সহ্য করতে পারল না। সামনে এগোনোর চেষ্টা করতেই জাদ ইশারা করে তাকে থামতে বলল কিন্তু মানতাশা থামল না। এগিয়ে গিয়ে পুলিশকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
“আমার স্বামী কোন অপরাধ করে নি, ওনাকে ছেড়ে দিন।”
“অপরাধ করেছে কি করেনি সেটা বিবেচনা করার জন্য আমরা আছি।”
জাইনও এই দৃশ্য দেখে অবাক হয়। বলে ওঠে,
“আপনারা কোন অপরাধে আমার ভাইকে এরেস্ট করছেন?”
“গ্যাং তৈরির অপরাধে!”
“গ্যাং!”
জাইন অবিশ্বাস্য চোখে জাদের দিকে তাকালো। জাদের নিস্তব্ধতাই প্রমাণ দিল সত্যতার।
পুলিশ জাদকে নিয়ে এগিয়ে যেতে নিতেই মানতাশা পথ আগলে দাঁড়ালো।
“আপনারা আমার স্বামীকে ছেড়ে দিন। ওনাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না! প্লিজ ওকে ছেড়ে দিন।”
কিছু মহিলা পুলিশ মানতাশাকে টেনে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলো। মানতাশার চোখে জল টইটুম্বুর। জাইন এসে তাকে ভরসা দিয়ে বলল,
“আমি নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবো নিজের ভাইকে রক্ষা করার!”
কিন্তু মানতাশা বুঝল জাইনের হয়তো বেশি কিছু করার নেই। তার সামনেই জাদকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হলো। মানতাশা জাদের বলা কথাগুলো মনে পড়লো। চোখের জল মুছে নিজেকে শক্ত খোলসে আবৃত করার চেষ্টা করল। আজ থেকে যে তার এক নতুন লড়াই শুরু। যেই লড়াইয়ে তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না।
হাফসা বেগম দূর থেকে সব দৃশ্য দেখে। আজ তার খুশির শেষ নেই। দূর থেকেই সে মানতাশার উদ্দ্যেশ্যে বিড়বিড় করে বলে,
“তোর জাদকে তো তোর থেকে আলাদা করেই দিলাম! এবার তোর পালা। এবার তোকেও এই বাড়ি থেকে দূর করে দেব। তোর জীবন আমি ছাড়খাড় করে দেব। তোর বাচ্চা রাস্তায় রাস্তায় বেওয়ারিশ হিসেবে ঘুরে বেড়াবে। এটাই আমার প্রতিজ্ঞা মানতাশা!”
মানতাশা দূর থেকেই হাফসা বেগমকে দেখতে পায়। তার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারে এসবের পেছনে কোথাও না কোথাও এই মহিলারই হাত আছে। মানতাশা হাফসা বেগমের দিকে শক্ত চাহনি নিক্ষেপ করে। দৃঢ় স্বরে বলে,
“যে বা যারা আমার এবং আমার স্বামীর ক্ষতি করার চেষ্টা করবে তাদের কাউকেই আমি ছেড়ে কথা বলব না। আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি এর শেষ দেখে ছাড়ব। অন্যায়ের জাল যতই বিস্তৃত হোক তার পরিসমাপ্তি নিশ্চয়ই আছে। সকল ষড়যন্ত্রের জাল আমি ছিন্ন করবোই।”
কথাটা বলেই সে স্থান ত্যাগ করে। হাফসা বেগম মানতাশার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বিদ্রুপের সুরে কটাক্ষ করে বলে,
“এবার তোমার কাছে আর কোন উপায় নেই মানতাশা। এবার সবটা হবে আমার ইচ্ছামতো। আমি যেভাবে চাই সেভাবেই তোমাদের জীবন অতিবাহিত হবে। আমার নোংরা খেলা সবে তো শুরু হলো। দেখোই না আমি আর কি কি করি!”
বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। জাইন হাফসাকে এভাবে হাসতে দেখে হতবাক হয়ে চেয়ে রইল।
চলবে….