#সুখ_অমৃত
#পর্ব_২৪
#লেখিকাঃদিশা_মনি
দীর্ঘ ২ বছর পর দুবাইয়ের মাটিতে পা রাখল মানতাশা। তার পরনে সারা শরীর আবৃত করা বোরখা। বলা বাহুল্য, এ অবস্থায় কেউই তাকে দেখে চিনতে পারবে না। মানতাশার পাশে দাঁড়িয়ে একজন শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। দুজনে একসাথে রওনা দেয়। বিলাসবহুল গাড়িতে করে পৌঁছে যায় একটি বিশাল বড় ইমারতের সামনে। গাড়ি থেকে নামতেই কয়েকজন সিকিউরিটি গার্ড তাদের ঘিরে ধরে। দুজনে একসাথে ইমারতের ভেতরে প্রবেশ করে। মানতাশা একটি কক্ষে প্রবেশ করে সেই শ্বেতাঙ্গ পুরুষ আরেক রুমে।
কিছু সময় পর,
দুজনে ডিনার করতে একত্রিত হয়েছে। খাবার টেবিলে বসে খাবার সময় মানতাশার চোখের জল লক্ষ্য করে পুরুষটি বলে,
“কেন কাঁদছ বোন?”
মানতাশা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“কেন আমার সাথে এমন হলো ভাইয়া? আমি তো জাদকে অনেক ভালোবাসতাম ভাইয়া। ও কেন আমার সাথে এমন করল? কেন এভাবে ঠকালো আমায়। কেন আমার থেকে আমার সন্তানকে কেড়ে নিলো? আমি কি অন্যায় করেছিলাম?”
মিস্টার স্মিথ মানতাশার এরকম কান্না শুনে অতীতের পাতায় চোখ বুলান। সেই দিন তিনি একটা জরুরি কাজে দুবাইতে এসেছিলেন। রাতে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। হঠাৎ করে তিনি দুবাইয়ের দরিদ্র এলাকায় পৌঁছে যায়। অনেকেই হয়তো জানেন না,দুবাইয়ের একদিকে যেমন রয়েছে ঝা চকচকে শহর, বড় বড় ইমারত, অপরপ্রান্তে এক দরিদ্র এলাকাও আছে। সেই স্থানে ঘুরতে গিয়েই মিস্টার স্মিথ লক্ষ্য করেন ফুটপাতে বসে আছে এক রমনী। তাই তিনি গাড়ি থামিয়ে উঠে সেই রমনীর কাছে যান। রমনী তাকে গুটিয়ে যায়৷ মিস্টার স্মিথ তাকে প্রশ্ন করেন,
“কে তুমি? কি করছ এখানে?”
এরইমধ্যে তিনি লক্ষ্য করেন সেই রমনীর কোলে একটা ছোট বাচ্চা যার কোন সাড়াশব্দ নেই। রমনীতে কাপা কাপা গলায় বলে,
“আমার..আমার নাম মানতাশা..আমাকে বাঁচান ভাইয়া..ওরা আমায় মেরে ফেলবে..আমার সন্তানকেও মেরে ফেলবে। আমাকে না বাঁচান অসুবিধা নেই কিন্তু আমার সন্তানকে বাঁচান..ও একটা মাসুম বাচ্চা..মাত্র ১ সপ্তাহ বয়স ওর..ইতিমধ্যেই ও অনেক অসুস্থ..দেখেন না কোন রেসপন্স করছে না।”
মিস্টার স্মিথ এই অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যান। তাই তিনি বলেন,
“তুমি আমার সাথে এসো। আমাকে ভরসা করতে পারো। আমারও তোমার মতো একটা বোন ছিল। নিজের ভাইয়ের মতো আমায় ভরসা করতে পারো। এসো।”
মানতাশার কাছে আর কোন উপায় ছিল না। তাই সে মিস্টার স্মিথের গাড়িতে বসে পড়ে। মিস্টার স্মিথ লক্ষ্য করেন মানতাশার কোলে তার সন্তান কোন রেসপন্স করছে না। তাই তিনি বলেন,
“আমার মনে হয় আমাদের আগে হাসপাতালে যাওয়া উচিত..তোমার শিশুর তো চিকিৎসার প্রয়োজন।”
“একটু দূরে কোথাও নিয়ে চলুন। ওরা মনে হয় এখনো আমাকে ফলো করছে। যা তে করে ওরা আমার মেয়েকে আমার থেকে কেড়ে নিতে পারে।”
“কে তোমার মেয়েকে তোমার থেকে কেড়ে নিবে?”
“ওর বাবার লোকেরা!”
“কি?”
“ঠিক শুনেছেন আপনি। আমার স্বামীর আদেশেই এসব হচ্ছে। আমার স্বামী চান আমার থেকে আমার সন্তানকে কেড়ে নিতে..”
মানতাশা নিজের কথা শেষ করতে পারে না তার আগেই সামনে থেকে কয়েকটা গাড়ি তাদেরকে আটকে দেয়। মিস্টার স্মিথ গাড়ি থামাতে বাধ্য হন। মানতাশা নিজের মেয়েকে জোরে আকড়ে ধরে। মিস্টার স্মিথ বলেন,
“তুমি ভয় পেওনা, বোন। আমি আছি তোমার পাশে। তোমার বা তোমার সন্তানের কোন ক্ষতি হতে দিব না।”
মিস্টার স্মিথ গাড়ি থেকে বলেন,
“কে আপনারা আর এভাবে আমাদের গাড়ি আটকে রেখেছেন কেন?”
“আমাদের পথ থেকে সরে দাঁড়ান।আপনার সাথে আমাদের কোন শত্রুতা নেই। আমাদের বসের অর্ডার পালন করতে হবে। উনি আমাদের বলেছেন এই বাচ্চাটাকে যে করেই হোক তুলে নিয়ে যেতে।”
“কে আপনাদের বস?”
“মোহাম্মদ জাদ।”
“আমি কিছুতেই আপনাদের কোন অন্যায় করতে দেব না। এক মায়ের বুক থেকে তার সন্তানকে কেড়ে নিতে দিব না।”
“তাহলে মর..”
এই বলেই তারা মিস্টার স্মিথকে মারতে শুরু করে। অবস্থা বেগতিক দেখে মানতাশা গাড়ি থেকে নামে এবং বলে,
“দয়া করে ওনাকে আর মারবেন না। উনি মরে যাবেন।”
এরইমধ্যে কয়েকজন এগিয়ে এসে মানতাশার কোল থেকে তার মেয়েকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। এরইমধ্যে মানতাশার মেয়ে রেসপন্স করে। সে হাত নাড়ায়। এটা দেখে মানতাশা একটু স্বস্তি পায়। কিন্তু মুহুর্তের মাঝেই একজন লোক তার থেকে বাচ্চাটিকে কেড়ে নেয়। মানতাশা লোকটির পায়ের কাছে বসে বলে,
“দয়া করে আমার বাচ্চাটিকে নিয়ে যাবেন না..ও যে এখনো ছোট। মাকে ছাড়া কিভাবে বাঁচবে? আপনাদের বসকে গিয়ে আপনারা বলুন যে ও একটু বড় হলে একটু স্টেবল হলে আমি নিজে ওকে গিয়ে আপনাদের বসের কাছে দিয়ে আসব। ও তো বাবা হয়,ওর অধিকার আমি হরণ করব না। কিন্তু দয়া করে এভাবে আমার মেয়েকে আমার থেকে কেড়ে নেবেন না।”
লোকটা লাথি মেরে মানতাশাকে সরিয়ে দিয়ে বলে,
“আমাদের কিছু করার নেই। আমাদের বসের আদেশ মানতেই হবে।”
বলেই তারা মানতাশার চোখের সামনে একটি গাড়িতে করে তার সন্তানকে নিয়ে যায়। মানতাশা ভীষণ ভাবে কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। মিস্টার স্মিথ মানতাশাকে নিকটস্থ একটি হাসপাতালে ভর্তি করায়। মানতাশার জ্ঞান ফেরার পর সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সারাক্ষণ আমার মেয়ে, আমার মেয়ে বলে কান্না করতে থাকে। মিস্টার স্মিথ এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য মানতাশাকে আমেরিকার লস এঞ্জেলস এ নিয়ে আসে। তারপর সেখানে ১ বছর চিকিৎসার পর মানতাশা সুস্থ হয়ে ওঠে। তার থেকেই তার চোখে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন।
অতীতের এসমস্ত কথা ভেবে কান্নার গতি বাড়িয়ে দেয় মানতাশা। হুংকার দিয়ে বলে,
“আমি জাদকে ক্ষমা করবো না। আমার থেকে আমার মেয়েকে আলাদা করার শাস্তি ওকে আমি দেবোই। সেজন্য আমি ফিরে এসেছি দুবাইতে। এবার দুবাই দেখবে একজন মায়ের প্রতিশোধ।”
★★
হুসনেয়ারা বেগম বিষন্ন মনে নিজের ঘরে বসে আছেন। হঠাৎ করেই তিনি বুঝতে পারেন কেউ আচমকা এসে তার কোল দখল করে বসে আছে। তিনি উসমানকে দেখতে পান নিজের কোলে। ছেলেটার মুখে বড্ড মায়া। তিনি উসমানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“আহা! আমার উসমান!”
জাইনও সেই সময় তার কক্ষে চলে আসে। জাইনকে দেখেই হুসনেয়ারা বেগমের অপরাধবোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তিনি বলেন,
“আমরা অনেক স্বার্থপর,অনেক পাপী তাইনা? আল্লাহ আমাদের কখনোই ক্ষমা করবেন না। নিজের চোখের সামনে এত অন্যায় ঘটতে দেখেও শুধুমাত্র নিজেদের কথা ভেবে আমাদের মিথ্যা কথা বলতে হচ্ছে।”
জাইন অসহায় কন্ঠে বলে,
“মানতাশা জাদ ওদের সাথে এত অন্যায় দেখেও আমাদের চুপ থাকতে হচ্ছে। হাফসার এই নোংরা চক্রান্তে সামিল হতে হচ্ছে। নাহলে যে ও উসমানের চিকিৎসার সব খরচ দেয়া বন্ধ করবে আর আমার ছেলেটা বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে।”
জাইন মনে করে মানতাশাকে যেদিন হাফসা বেগম বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল এরপরই সে অপরাধবোধে ভুগে হুসনেয়ারা বেগম, তার চাচা এবং উসমানকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে গিয়ে মানতাশার পাশে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু উসমান হঠাৎ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে তাকে হাসপাতালে নেয়া হলে তার একটি বিরল রোগ ধরা পড়ে।যার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। হাফসা তখন সেই টাকা দিতে রাজি হয় কিন্তু বিনিময়ে তাদের সবাইকে নিজের গোলাম বানিয়ে নেয়। তারপর তিনি হুসনেয়ারা বেগমকে বলে মানতাশাকে একটা আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেয়। হুসনেয়ারা বেগম পুরো ৯ মাস নানা কথা বলে জাদের বিরুদ্ধে মানতাশার মন বিষিয়ে দিতে বাধ্য হয়। এরপর তো জাদও এতে যোগ দেয়। সে মানতাশাকে জানায় জাইন তার বাচ্চাকে তার থেকে আলাদা করতে চায়। এরপর তো জাদের গ্যাং এর লোক দিয়ে হাফসা এসব কিছু করায়। আর বর্তমানে এভাবে জাদকে মানতাশার সম্পর্কে ভুল বোঝানো হচ্ছে!
এসব মনে করে জাইন বলে,
“আমাদের পাপের পরিমাণ বাড়ছে। কিছু একটা করা দরকার।”
চলবে….