তোমাতেই নৈঃশব্দ্য প্রহরে পর্ব-১৫

0
104

#তোমাতেই_নৈঃশব্দ্য_প্রহরে
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্বসংখ্যা_১৫

” তুই? এহানে কি করতাছোছ? মোরে একটু একলা থাকতে দে। ”

মুয়ীয বললো। শুনলো উক্তি। তবে করলো না সে আদেশ মান্য।
.

রাতের আঁধারিয়া চাদরে ঢেকে শহরতলী। শীতাংশু’র মোহনীয় রূপের ছটা উপস্থিত অন্তরীক্ষে। বিছানায় কিনারে বসে মুয়ীয। মানসিক বেদনায় উৎপীড়িত অন্তর। উরুর ওপর স্থাপিত দুই কনুই। হাতের দশটে আঙ্গুল মুষ্টিবদ্ধ হয়ে। সে মুষ্টিবদ্ধ দৃঢ়তার ওপর রাখা থুতনি। চোখে বোধশক্তির বাইরে অবস্থিত এক ভাষা। ঘরজুড়ে নীরবতার ভ’য়াল থাবা। উক্তি ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। স্বামী মানুষটির এমন সন্তপ্ত অবস্থা অবলোকন করে পু’ড়ছে তার অন্তঃস্থল। চোখেমুখে বিমর্ষতা। ধীরপায়ে এগিয়ে এলো উক্তি। নিঃশব্দে দাঁড়ালো স্বামীর পাশে। দ্বিধাপূর্ণ দাঁড়িয়ে সে। বুঝে উঠতে পারছে না, মন যা বলছে তা করা ঠিক হবে কিনা। এ পরিস্থিতিতে আদৌও পুরোপুরি মানানসই কিনা। মনের সঙ্গে এক নীরব লড়াই চলমান। মিনিট দুই অতিবাহিত হলো নৈঃশব্দ্য লড়াইয়ে। মুয়ীয তখনো অজ্ঞাত সঙ্গিনীর উপস্থিতি সম্পর্কে। তার মন যে ডুবে অতল উদ্বেজনে। সহসা ধ্যান ভঙ্গ হলো মানুষটির। চমকিত নেত্রে তাকালো বামে! স্ত্রীর অবয়বে। হাসান সাহেবের চোখেমুখে তখন অবাকতার রেশ বিরাজমান! কেননা উক্তি দাঁড়িয়ে পাশেই। একমনে তাকিয়ে ওর পানে। মুয়ীয আস্তে করে দৃষ্টি হটিয়ে নিলো। মিহি স্বরে বললো,

” তুই? এহানে কি করতাছোছ? মোরে একটু একলা থাকতে দে। ”

মুয়ীয চুপটি করে পূর্বের ন্যায় বসে। লহমায় শিরশিরে অনুভূতি ছেয়ে গেল শিরায় উপশিরায়। কপাল ছুঁলো পেলব-নরম পাঁচটে আঙ্গুল। শুধু ছুঁলোই না। আলতো করে বুলিয়ে গেল কপালের এ প্রান্ত হতে ও প্রান্ত। কপালের মধ্যরেখায় যখন আঙ্গুল গুলো আদর মেখে, দুশ্চিন্তার চাপ লাঘব করছিলো না… তখন অন্তরে বর্ণনাতীত প্রশান্তি অনুভূত হচ্ছিল। আরামে, শান্তিতে বুঁজে আসছিল চক্ষু জোড়া। মুখ বলতে চাইছিল, ‘ থাক। এসবের দরকার নেই। ‘ তবে অন্তর আবদার করে বলছিল, এই যত্নের রেশ বহাল থাকুক আমৃত্যু-অনন্তকাল। অন্তরের নীরব আবদার বুঝি মূক উক্তির শ্রবণ পথে পৌঁছালো। তাই তো উক্তি এলো। আরো নিকটে এলো। বসলো ঠিক পাশেই, দেহ ঘেঁষে। মুয়ীয অবুঝ নেত্রে তাকিয়ে। বোধগম্য হচ্ছে না ঠিক কি করতে চাইছে তার নৈঃশব্দ্য উক্তি! আস্তে ধীরে উক্তি স্বামীর মাথাটি দু হাতের তেলোয় নিলো। যতন করে, আদর মেখে স্বামীর মাথা শুইয়ে দিলো নিজের কোলে। নরম, কোমল কোলে ঠাঁই পেয়ে মুয়ীযের সমস্ত মনোযন্ত্রণা যেন পলায়ন করলো। সীমাহীন শান্তি, ভালোলাগা, সুখ আবিষ্ট করে ফেলছিল তাকে। বুঁজে গিয়েছে দু’চোখ। উক্তি বাঁ হাতে একান্ত পুরুষের মাথার চুল টেনে টেনে দিতে লাগলো। ডান হাত কপালে ব্যস্ত, আঙ্গুল চালনার মাধ্যমে স্বস্তি প্রদান করতে। আরামে পুরুষটির মন পুলকিত। আনন্দিত। সুখময় অনুভূতির ছোঁয়া বিরাজমান পুরো ঘরময়। মুয়ীয আস্তে করে ঘুরে শুলো। মুখ গুঁজে দিলো স্ত্রীর পেটে। মোলায়েম সে কোমলাঙ্গে খুঁজে পেল অপরিমেয় সুখের অস্তিত্ব। উক্তি মগ্ন স্বামী সেবায়। তার সর্বোচ্চ সুখ, আরাম, স্বস্তি নিশ্চিত করতে।

ঘরময় ছড়িয়ে চন্দ্রের মৃদু আলোর রোশনাই। জানালায় দাঁড়িয়ে সে পুরুষটি। দহনকর বেদনা লুকিয়ে অন্তঃপুরে। নির্বাক, নিশ্চুপ সে। অনর্থক তাকিয়ে বাইরে। কিছু কি খুঁজে বেড়াচ্ছে? কি খুঁজছে? শৈশব, কৈশোরের সেই স্বর্নালী মূহুর্ত? নাকি সেই গৌরবান্বিত নিজেকে? আজ তো সে ভঙ্গুর। পাপের দুনিয়ায় ঝুলন্ত এক পাপী আ’ত্মা। সংসারের বোঝা। স্ত্রী, সন্তানের গর্ব নয়। বরং আফশোসের সীমানা। এই এক জীবনে কি করলো সে? শুধুই অপচয়, অন্যের অন্তরে কষ্টের আঘাত, টাকা মে-রে দেয়া। আর কি করেছে সে? এই মারুফের গোটা জীবনটাই তো বৃথা। অর্থহীন।

‘ আফসোস লাগে,
যখন পুরনো ভুলগুলো মনে পড়ে,
মনে পড়ে সে গান, ব্যাথা হয় কায়জুড়ে।

আফসোস লাগে,
যখন সে অতীতগুলো খামচে ধরে,
খামচে ধরে প্রিয় স্মৃতি নিথর ধরে। ‘

[ লেখনীতে- জাহিদ হাসান নাদিম ]

মারুফ নিথর চাহনিতে তাকিয়ে। দেহে অবশিষ্ট শুধু প্রাণ বায়ুটাই।

” আকাম করনের সময় হুঁশ থাহে না। অহন রাইত দুপুরে ঢঙ মারাইতাছো? ”

বিছানায় শুয়ে জান্নাত। নির্ঘুম চোখ। স্বামীর উদ্দেশ্যে কটূক্তি মূলক কথাটি বলে উঠলো। মারুফ নীরব। পাশে শায়িত পুত্র জীবনের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে জান্নাত বলে গেল একমনে,

” বাপ হইছো। তয় বাপ হওনের কোনো যোগ্যতা তোমার নাই। সন্তানরে দুইডা ভালোমন্দ খাওয়াইবা। পড়াইবা হেই মুরোদ নাই। ব্যাবাক তো জু°য়া খেইলাই বিকাই দিছো। চাকরিবাকরি নাই। ভিখারির লাহান ছোডো ভাইয়ের ধারে হাত পাতো। হ্যার টাহায় মোগো সংসার চলে। ”

ধিক্কার জানিয়ে জান্নাত বলতে লাগলো,

” ছিঃ! লজ্জা করে না তোমার? বড় ভাই হইয়া ছোডো ভাইয়ের টাহায় চলো। ক্যামন পুরুষ তুমি? তোমার তো হাতে চুড়ি ফিন্দা ঘরে বইয়া থাহা উচিত। ”

ক্ষণিকের নীরবতা। ঘরময় ছড়িয়ে পড়লো সে আফশোসের নারী কণ্ঠ,

” তোমারে বিয়া কইরা মোর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলডা করছি। অহন ব্যাবাক শেষ। কিচ্ছু আর বাকি নাই। শেষ সব।”

মারুফ জানালায় দাঁড়িয়ে। একদা’র কর্মঠ হাতটা শক্ত করে গেঁড়ে বসলো গ্রিলে। ভেতরকার যন্ত্রণার চিত্রপট.. লুকায়িত। সুপ্ত। কারোর নজরের বাইরে।

শুক্রবার আজ। পবিত্র এক দিন। ঘড়ির কাঁটায় সময় তখন বারোটা বেজে বিশ মিনিট। জুমআ’র আযান ইতিমধ্যে মুয়াজ্জিনের সুমধুর কণ্ঠে ঘোষিত হয়েছে। হাসান সাহেব সদ্য গোসল সেরে বের হলেন। গলায় ঝুলছে অর্ধ ভেজা গামছা। সে গামছায় স্বল্প আবৃত ভেজা বুক, পিঠ। বাড়ির সরু গলি অতিক্রম করে ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সে। পথিমধ্যে নজর কাড়লো স্ত্রীর কর্মরত অবয়ব। উক্তি নরম-মোলায়েম এক কাপড় দিয়ে মাঝের ঘরের আসবাবপত্র পরিষ্কার করছিলো। মাথায় কোনোমতে আবৃত শাড়ির আঁচল। স্নিগ্ধময়ীর এ স্নিগ্ধতা মুগ্ধ করলো পুরুষটিকে! তবে এখন হাতে সময় কম‌। তাড়া রয়েছে। তাই তো স্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বললো,

” ঘরে আয় জলদি। ”

ছোট্ট তিনটে শব্দ। ব্যাস এতটুকুই। আর দাঁড়ালো না মুয়ীয। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেল নিজ ঘরের পানে। এদিকে হতবাক অভিব্যক্তি সহকারে দাঁড়িয়ে মিসেস মুয়ীয হাসান!
.

” কি হইলো? অ্যাম্বালে চাইয়া আছোছ ক্যা? ফডাফড কর। হাতে অত সময় নাই। ”

উক্তি আলতো করে পলক ঝাপটালো। একবার তাকালো হাতে থাকা গামছার দিকে। আরেকবার তাকালো স্বামীর অর্ধ ভেজা অবয়বে। শুকনো ঢোক গিলে নিলো মেয়েটি। মানুষটির এই সদ্য স্নান রূপ। শ্যাম গড়নে ফোঁটা ফোঁটা জলের অস্তিত্ব। নে’শা জাগানো প্রখর চাহনি। ওর ভেতরে সামুদ্রি ঝড়ের সৃষ্টি করছিল। কেঁপে কেঁপে উঠছিল হাতের আঙ্গুলগুলো। গামছা যেন হাত ফসকে বেড়োতে উদগ্রীব। কোনোরূপ গলা ভিজিয়ে উক্তি এলো। আরো সন্নিকটে এলো। মুয়ীয হাসান সুপ্ত প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে। ঠোঁটের কোলে অতি ক্ষুদ্র খুশির ঝিলিক। উক্তি অবনত মস্তকে হাত বাড়িয়ে দিলো। হাতের ওপর গামছার আবরণ। তবুও যখন স্বামীর স্বল্প ভেজা বুকে হাতের ছোঁয়া লাগলো, বিদ্যুৎ তরঙ্গ প্রবাহিত হলো ধমনীর কিনারে কিনারে। ক্ষণিকের জন্য বুঁজে এলো চোখ। হালকা নিশ্বাস ফেলে, চোখ খুলে তাকালো মেয়েটি। কম্পিত, অস্থির বক্ষস্থল। আস্তে ধীরে মুছে দিচ্ছে নিজ মানুষটির বুকে, গলায়, বাহুদ্বয়ে, পেটে, পিঠে ও ঘাড়ে অবস্থিত দুষ্টু, সৌভাগ্যবান জলকণাকে। সৌভাগ্যবান কেন? কি অবলীলায় তার মানুষটির দেহে লেপ্টে ওরা। সে যে তা করতে অপারগ। একাকী সলজ্জ হেসে উঠলো উক্তি। সহসা সে হাসিমুখ বি*স্ফোরক অভিব্যক্তিতে রূপান্তরিত হলো। কেননা শাড়ির অতলে কোমরের দৃশ্যমান ত্বকে কিলবিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটি হাত। পুরুষালী মৃদুমন্দ ভেজা, ঠাণ্ডা সে হাত। কোমরের সীমান্ত ছাড়িয়ে সাহসী হাতটি ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হচ্ছে নাভিকুণ্ড বরাবর। লাজে আড়ষ্ট কন্যা সরে যেতে উদ্যত হলো। মৃদু গুঙ্গিয়ে নিজেকে ছাড়াতে ব্যর্থ হলো। বরং আরো বাঁধা পড়লো সে-ই অভেদ্য বেষ্টনীতে। মানুষটির দু হাত গাঢ় রূপে চেপে বসেছে স্ত্রীর কোমরে। টেনে নিয়েছে অতি সন্নিকটে। একদম হৃদয়ের কাছে। দু জোড়া নয়ন স্থির একে অপরেতে। নিষ্পলক তাকিয়ে তারা। রমণীর চক্ষু পাতা বন্ধ হলো খানিক বাদে। দু চোখের বদ্ধ পাতায় একে একে অধর ছুঁয়ে দিলো মুয়ীয। গালে ছুঁলো। ছুঁলো নাকের নরম ডগায়। ঠোঁট জোড়া তখন অতি সন্নিকটে। তপ্ত শ্বাস প্রশ্বাস দু’জনার অন্তরে তীব্র আঙ্ক্ষাকার অগ্নি সংযোগ করছিল। প্রিয়তমার ঠোঁটের কোমলতায় হালকা নিশ্বাস ছাড়ল মানুষটি। কম্পিত স্ত্রীর হৃদয় আরো অস্থির, কম্পমান করে তুলতে মোহাচ্ছন্ন স্বরে থেমে থেমে বললো,

” নামাজে যামু। অহনকার মতো এইয়াই রইলো। বাকিডা নয়… ”

উক্তির শ্বাস প্রশ্বাস অনিয়ন্ত্রিত। অস্থির। ঠোঁটের কোণে ছোট্ট আদর ছুঁয়ে বললো মানুষটি ফিসফিসিয়ে,

” মধ্য রাইতে! ”

শুভ্র রঙা দেয়ালে গঠিত সে মসজিদ। স্থানীয় এ মসজিদটি অন্য সকল মসজিদের ন্যায় সাধারণ দেখতে। লোক লোকারণ্যে আজ ভীড় জমেছে এ মসজিদে। কেননা আজ শুক্রবার। জুমআ’র দিন। জুমার নামাজ আদায় করতে উপস্থিত হয়েছে এই মানুষগুলো।

জুমার নামাজ অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। পবিত্র আল-কোরআনে ‘জুমা’ (জমায়েত) নামে একটি স্বতন্ত্র সুরা আছে। সেটি ৬২ নম্বর সুরা। তাতে জুমার নামাজের গুরুত্ব বর্ণনা করে আল্লাহ্ বলছেন, ‘হে বিশ্বাসীরা! জুমার দিন যখন নামাজের জন্য ডাকা হয়, তখন তোমরা আল্লাহ্কে মনে রেখে তাড়াতাড়ি করবে ও কেনাবেচা বন্ধ রাখবে। এ-ই তোমাদের জন্য ভালো; যদি তোমরা বোঝো।’ (সুরা জুমা, আয়াত: ৯)

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন,

‘যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করে প্রথম মসজিদে হাজির হয়, সে যেন একটি উট কো*রবানি করল;
দ্বিতীয় যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে, সে যেন একটি গরু কো*রবানি করল;
তৃতীয় যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করল এবং সে যেন একটি ছাগল কো*রবানি করল।
অতঃপর চতুর্থ যে ব্যক্তি মসজিদে গেল, সে যেন একটি মুরগি সদকা করল।
আর পঞ্চম যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করল, সে যেন একটি ডিম সদকা করল।
এরপর ইমাম যখন বেরিয়ে এসে মিম্বরে বসে গেলেন খুতবার জন্য, তখন ফেরেশতারা লেখা বন্ধ করে খুতবা শুনতে বসে যায়।’ (বুখারি: ৮৮১)

রাসুল (সা.) ইরশাদ করেনঃ
– ‘ যে দিনগুলোতে সূর্য উদিত হয়, ওই দিনগুলোর মধ্যে জুমার দিন হচ্ছে সর্বোত্তম। ওই দিন হজরত আদমকে (আ.) সৃষ্টি করা হয়েছে। ওই দিন তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয় এবং ওই দিনই তাকে জান্নাত থেকে বের করে দেওয়া হয়। এছাড়াও ওই দিনই কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। ‘ (মুসলিম শরিফ, হাদিস নম্বর ৮৫৪)

মহানবী (সা.) ইরশাদ করেনঃ
– ‘ জুমার দিন দোয়া কবুল হওয়ার একটি সময় রয়েছে। কোনো মুসলিম যদি সেই সময়টা পায় এবং তখন যদি সে নামাজে থাকে, তাহলে তার যেকোনো কল্যাণ কামনা আল্লাহ্ পূরণ করেন।’ ( বুখারি, হাদিস নম্বর ৬৪০০)

রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেনঃ
– ‘ তোমরা জুমার দিনে আমার ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করো। কেননা তোমাদের পাঠকৃত দরুদ আমার সামনে পেশ করা হয়। ‘ (আবু দাউদ, হাদিস নম্বর ১০৪৭)।

জুমার দিন বহু ফজিলত সম্পন্ন এক দিন। এ দিনের রয়েছে বহু ফজিলত। অসংখ্য সাওয়াব অর্জন করার সুবর্ণ মূহুর্ত।

জুমআ’র সালাত আদায় করে মসজিদ প্রাঙ্গন হতে বেরিয়ে আসছে মুসল্লিরা। বেরিয়ে আসছে শুভ্র পাঞ্জাবি, পাজামা ও মাথায় টুপি পরিহিত সে শ্যাম পুরুষ। জনাব মুয়ীয হাসান। সাথে বন্ধু চয়ন, বড় ভাই মারুফ। মারুফ সারা বছর নিয়মিত নামাজ আদায় না করলেও শুক্রবার এবং ঈদের নামাজ কখনো বাদ দেয় না। ঠিক আদায় করে। এ গুণটি অন্তত রয়েছে। ভাই এবং বন্ধুর মধ্য বরাবর মুয়ীয দাঁড়িয়ে। পাঞ্জাবি পড়ুয়া তিন মানব হেঁটে চলেছে এবং নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। বলছে মুয়ীয এবং চয়ন। নিশ্চুপ মারুফ।
.

জুমার নামাজ শেষে আপন নীড়ে ফিরলো ঘরের দুই ছেলে। মাথার টুপি খুলে হাতে নিলো মুয়ীয। মাঝের ঘরটিতে প্রবেশ করে লক্ষ্য করলো খাবারের আয়োজন চলছে। উক্তি এবং জান্নাত সকলের জন্য খাবার পরিবেশন করছে। স্ত্রীকে দেখে মুচকি হাসলো মুয়ীয। সকলের অলক্ষ্যে রইলো সে হাসি। মোমেনা বেগম দুই ছেলেকে দেখে হেসে উঠলেন,

” আইছোছ তোরা? আয় আয়। খাইতে আয়। ”

” হু। ”

মোমেনা বেগম মাদুরে বসলেন। মুয়ীয বসলো ওনার ডান পাশে। মারুফ বাম পাশে। সে-ই ছেলেবেলার মতো। মুয়ীয প্লেটে হাত ধুতে ধুতে শুধালো,

” কি রানছো আইজ? ”

” আলু দিয়া রুই মাছ, করলা ভাজি আর ডাউল। ” মোমেনা বেগম হাসিমুখে জবাব দিলেন।

মুয়ীয বললো,

” রুই রানলা ক্যা? ফ্রিজে না কাঁচকি মাছ আছিল? হেইয়া রানতা।”

” ক্যান বাপ? রুই মাছ তো তোর পছন্দ। ”

” হ পছন্দ। হেই লেইগ্গা হপ্তায় তিনবার রুই মাছ খাইলে তো অসুবিধা। ম্যালাদিন পর পাইছো দেইখা ব্যাবাক একলগে খাইবা? মুহের স্বাদ সব উইড়া যাইতাছে যে। ”

মোমেনা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে আশ্বস্ত করতে বললেন,

” আইচ্ছা বাপ। অহন এইডা খা। মা কাইল অন্য মাছ রানমু নে। ”

মুয়ীয কিছু না বলে প্লেটে ভাত নিতে উদ্যত হলো। তবে এগিয়ে এলো উক্তি। স্বামীর প্লেটে নিজেই ভাত বেড়ে দিলো। দিলো করলা ভাজি। মুয়ীয একপলক তাকিয়ে, ভাত খাওয়ার পূর্বে দোয়া পড়ে নিলো মনে মনে।

খাওয়া আমাদের প্রতিদিনের রুটিনের অপরিহার্য অংশ। বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন বেশ কয়েক বার আমাদের খাবার খেতে হয়। খাওয়ার সময় আল্লাহ্’কে স্মরণ করা ও তার নেয়ামতের শোকর আদায় করা আমাদের কর্তব্য। আল্লাহ্’র স্মরণে সিক্ত হলে আমাদের খাবার যেমন বরকতময় হতে পারে, পাশাপাশি খাওয়াও ইবাদত হয়ে উঠতে পারে।

রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ একজন মুসলিম তার সব কাজে সওয়াবের অধিকারী হয়, এমনকি খাবারের যে লোকমা সে খায় তাতেও সে সওয়াব পায়। ‘ (মুসনাদে আহমদ: ১৫৩১)

খাবারের অপরিহার্য দোয়া হলো, শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে আল্লাহ্’র নামে খাওয়া শুরু করা। ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ অর্থাৎ ‘পরম করুণাময় দয়াময় আল্লাহর নামে শুরু করছি’ বলতে পারেন অথবা বলতে পারেন ‘বিসমিল্লিাহি ওয়া আলা বারাকাতিল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ্’র নামে এবং আল্লাহ্’র বরকতের ওপর খাওয়া শুরু করছি।’

রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ যে খাবারে বিসমিল্লাহ পড়া হয় না, সে খাবারে শ*য়তানের অংশ থাকে। সেই খাবার মানুষের সঙ্গে শ*য়তানও খায়। ‘ (সহিহ মুসলিম: ৫৩৭৬)

তাই ‘বিসমিল্লাহ’ যেন কোনোভাবেই ছুটে না যায় সেদিকে বিশেষ মনোযোগ থাকা দরকার। খাবারের শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়তে ভুলে গিয়ে খাওয়ার মাঝখানে মনে হলে বলুন,

‘বিসমিল্লাহি আওয়ালাহু ওয়া আখিরাহু’ অর্থাৎ ‘এর শুরু ও শেষ আল্লাহর নামে।’

খাওয়া শেষ হলে পড়ুন,

الحمد لله الذي اطعمنا وسقانا وجعلنا من المسউচ্চারণ: আলহামদুলিল্লাহিল্লাযী আতআমানা ওয়া সাকানা ওয়া জাআলানা মিনাল মুসলিমীন।

অর্থ: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্’র জন্য যিনি আমাদের খাওয়ালেন, পান করালেন এবং মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

” উক্তি! কেমন আছিস? ”

ঘরের দোরগোড়ায় উপস্থিত আগন্তুককে দেখে বিহ্বল উক্তি! হারিয়ে মুখের বুলি। চোখেমুখে আশ্চর্যের ছাপ!

চলবে।