#তোমাতেই_নৈঃশব্দ্য_প্রহরে
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্বসংখ্যা_২০
” মোর ধারে কবি না বউ? মুই তো তোর জামাই লাগি। সবচে আপন জন। মোর লগে আবার কিয়ের লুকোচুরি? ক না বউ, কি হইছে? ”
এমন অনুরোধ মাখা স্বর, তার সুগভীর গাঢ়ত্ব আসলেই চমকপ্রদ ছিল উক্তি’র জন্য! উক্তি বিশ্বাস করে উঠতে পারছিল না ওর আপত্তি সত্ত্বেও মানুষটি কিভাবে এত এত ধৈর্য ধরে আছে? ওকে সত্যি বলতে অনুরোধ করছে। আজ এখানে অন্য কেউ হলে কি, সে মানুষটি রাগে গজগজ করে উঠতো না? ওর ওপর তেজ দেখাতো না? অবশ্যই দেখাতো। নিঃসন্দেহে দেখাতো। প্রকাশ পেত পৌরুষালী ক্ষমতার অপব্যবহার। উক্তি এবার সত্যিই দুর্বল হয়ে পড়লো। আর লুকোচুরি করা সম্ভব নয়। কার কাছে অহেতুক লুকোচুরি করছে সে? অর্ধাঙ্গের কাছে? স্বীয় অর্ধেক অঙ্গের কাছে? মেয়েটি আস্তে ধীরে গলনালী সিক্ত করে নিলো। প্রস্তুত করে নিলো নিজেকে। ধীরে ধীরে হাতের ইশারায় বলতে লাগলো,
” আপনি আজ… ”
মুয়ীয জিজ্ঞাসু, কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে। আজ কি?
” বাহির থেকে এসে কেমন অদ্ভুত আচরণ করছিলেন। আমার দিকে একবারের জন্য ফিরেও তাকাননি। কথা বলেননি। আজকের আগে তো কখনো এমনটা হয়নি। আজই প্রথম হলো। তাই জানিনা কেন.. খুব অভিমান হয়েছিল। খারাপ লেগেছিল। অবশ্য খারাপ লাগার কথা নয়। সব দিন তো আর এক নয়। সবসময় কি আর সবাইকে সমানভাবে প্রাধান্য দেয়া যায়? ”
শেষের কথাটিতে মিশে ছিল অফুরন্ত অভিমান। সে কি মুয়ীয হাসান উপলব্ধি করতে পারলো? উক্তির কথা শুনে মানুষটি স্বল্প হেসে ফেলল। ওকে বললো,
” তুই এই লাইগ্গা রাগ করছিলি? মুই আরো ভাবলাম কি না কি হইছে। তুই হাছাই পা’গলিরে! ”
পা’গলী কথাটা শুনে উক্তির কেমন রাগ হলো। স্বল্প অভিমান হলো। সে অভিমানে টলমল করে উঠলো দুচোখ। হ্যাঁ, সে তো এখন পা’গলী। বরের উপর রাগ করেছে না! এখন তো পা’গলি হবেই। অভিমানী উক্তির অভিমান যে উচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে, তা বুঝতে অসুবিধা হলো না জনাবের। মুয়ীয এমনতর গুরুতর মুহূর্তে মোটেও হাসতে ইচ্ছুক নয়। তবুও হালকা হেসে ফেললো সে। ঠোঁটের সীমান্তে চিলিক দিয়ে উঠলো সরু এক রেখা। ফলস্বরূপ উক্তি’র দু’চোখ ছাপিয়ে বারিধারা নামলো। ভারী সে বর্ষণ। থামবার নামমাত্র নেই। বউকে এমন নিঃশব্দে কাঁদতে দেখে মুয়ীয সত্যিই ব্যথিত। পীড়িত। সহ্য হচ্ছিল না আর। উক্তিকে সোহাগী স্পর্শে নিজ বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো সে। চুপটি করে শালিক পাখির ন্যায় মিশে মেয়েটি। অশ্রুধারা তখনো বহমান। মুয়ীয হালকা পরশে দু হাতের তালুতে ভরে নিলো স্ত্রীর মুখশ্রী। উক্তির অক্ষিপুট পিটপিট করে চলেছে। ধীরলয়ে ওর পানে এগিয়ে এলো মুয়ীয। অর্ধাঙ্গিনীর মায়াবী চোখ দু’টোর পাতায় আলতো চুমু ছুঁয়ে দিলো। আবেশে রমণীর চোখ বুজে গেল। বাঁ হাত চেপে বসলো স্বামীর কাঁধে। বৃদ্ধাঙ্গুলের নরম পরশে সহধর্মিণীর গালে বহমান অশ্রুজল মুছে ফেললো মুয়ীয। মিহি আকুলিবিকুল স্বরে বললো,
” চোখ খোল বউ। এই বুকেতে আর যন্ত্রণার পাহাড় বানাইস না। ”
সে কণ্ঠের আকুলতা উক্তি’র বক্ষস্থলে চরম নাড়া দিলো। সক্রিয় হলো মস্তিষ্ক। ঘন শ্বাস প্রশ্বাস। অস্থির কায়। মুদিত চক্ষুপল্লব মেলে আস্তে আস্তে তাকালো মেয়েটি। স্বামী তখন ওর পানেই তাকিয়ে। দু’জনার নয়নে নয়নে কিয়ৎক্ষণ নিঃশব্দ আলাপণ হলো। অতঃপর মুয়ীয উদ্দেশ্যহীন ভাবে বলে চলেছে,
” আইজ অফিসে একখান ঝামেলা হইছিল। ফাইল লইয়া ক্যাচাল হইছে। এক হারাম**র লেইগ্গা অশান্তি হইছে। হেইয়ার লেইগ্গা মনমেজাজ বিক্ষিপ্ত আছিল। কথা কওনের কিংবা পিরিত করার মুড আছিল না। বুঝবার পারি নাই এতেই মোর বউ কাইন্দা কাইট্টা দুনিয়া ভাসাইবো। ”
শেষোক্ত বাক্যে মিশে রসিকতা। চোখেমুখে অর্থপূর্ণ হাসির আভা। উক্তি লজ্জিত। অত্যন্ত লজ্জিত। সে বুঝতে পারেনি। না বুঝেই কেমন বোকার মতো আচরণ করে ফেলেছে। মূল্যবান অশ্রু ঝড়িয়ে বোকামির বহিঃপ্রকাশ করেছে। আসলেই তো মানুষটা সারাবেলা পরিশ্রম শেষে ঘরে ফিরেছিল। স্বাভাবিক ভাবেই ক্লান্ত। মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকতে পারে। পথেঘাটে কিংবা অফিসে অনাহুত ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। সে অতসব না ভেবেই এভাবে ভেঙে পড়লো! লজ্জা কি লজ্জা! এই লজ্জিত মুখ সে দেখাবে কি করে? মানুষটি কি এই নিয়ে হাসিতামাশা করবে না? করতেই পারে। খানিকের ভাবাভাবির সমাপ্তি ঘটিয়ে, উক্তি লজ্জায় রঙিন টুকটুকে মুখে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে বললো,
” স্যরি। আমি বুঝতে পারিনি। এমনটা আর হবে না। ”
মুয়ীয তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ জানালো,
” ক্যান? হইবো না ক্যান? মুই তো চাই আরো হউক। মাঝেমধ্যে এমন একটু আধটু ঠোয়াঠুয়ি লাগুক। হ্যারপর… একছের খালি…?! ”
উক্তি’র একান্ত অসভ্য পুরুষটি ডান চোখ টিপে দিলো। ঠোঁট নাড়িয়ে বললো দু’টো সভ্যহীন বাক্য। পরি কি মরি করে লাজুক উক্তি মুখ লুকানো স্বামীর বুকে। ছিঃ! এই লোকটা এত বেলাজ, বেশরম কেন? কেন গো কেন…? ভাবুক কন্যা ক্ষণিক বাদে চুলের ভাঁজে অনুভব করলো এক অকৃত্রিম আদুরে পরশ। তার স্বামীর পরশ।
•
আঁধারিয়া রজনীতে ধীরে ধীরে শান্ত, নীরব হয়ে আসছে গোটা নগরীর কোল। সে শান্ত-নীরব নগরীর এক প্রান্তে অবস্থিত হোটেলটি। নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য বেশ আদর্শ, পরিচিত সে হোটেল। হোটেলের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ হয়তো উচ্চবিত্ত শ্রেণীর জন্য গা ঘিনঘিনে। কেমন রঙচটা দেয়াল। মৃদু শুভ্র আলোর উপস্থিতি। প্লাস্টিকের পানির জগ, স্টিলের গ্লাস, চেয়ার, টেবিল, রান্নার পরিবেশ সবটাই নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের মনের মতো। তাদের জন্য মানানসই। হোটেলের পূর্ব কোণের এক টেবিলে মুখোমুখি বসে মুয়ীয ও বন্ধু চয়ন। মুয়ীযের শ্যামসুন্দর মুখ জুড়ে অকালমেঘোদয়। চয়ন নির্বাক বসে। আস্তে ধীরে পড়ে চলেছে বন্ধুর লুকানো চিন্তন ভাব। বন্ধুর অবস্থা তার অজানা নয়। প্রতি বছর এ সময়, ঠিক এমন মূহুর্তে তাকেও যে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। অকুঞ্চিত চিত্তে সবটা সামাল দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হয়। সেখানে মুয়ীযের দু কাঁধে পর্বতসম বোঝার ভার। তাকে তো আরো গুটিয়ে যেতে হবে। এ-ই স্বাভাবিক।
” দোস্ত! ”
লঘু স্বরে ডেকে উঠলো চয়ন। মুয়ীয সে ডাকে ভাবনার চোরাবালি হতে ছিটকে বেরিয়ে এলো। চোখ তুলে তাকালো চয়নের মুখ পানে।
” কি ভাবলি? ”
” কিচ্ছু বুইঝা উঠতে পারতাছি না রে চয়ন। ম্যালা খরচ। কোনডা থুইয়া কোনডা কোমামু? কোমানোর লাহান কিছুই নাই। বেতন, বোনাস ব্যাবাক মিলাইয়া খরচা হইয়া যাইবো। মাস গেলে হাতে থাকবো এক্কারে কয়ডা হাজার টাহা। অ্যামনে ক্যামনে হইবো? ” মুয়ীয উদ্বিগ্ন।
” কোনো উপায় কি নাই খরচা কমাইন্নার? ”
” নাহ্। ”
চয়ন হতাশ। সেকেন্ডের নীরবতা সমাপ্ত করে মুয়ীয বলে চলেছে আপনমনে,
” মায়ের লেইগ্গা একখান শাড়ি লাগবো। মুন্নির লেইগ্গা আলিয়া কাট জামা। বড় আপার মাইয়াগো লেইগ্গা দুইডা নায়রা ড্রেস। মামার ধারে বায়না করছে ওরা। না দিয়া ক্যামনে পারুম, ক? বড় ভাবীর লেইগ্গা একখান থ্রি পিস নিমু এবার। গতবার দিতে পারি নাই। এই লইয়া অশান্তি হইছিল। হ্যারপর ভাইপো জীবনের লেইগা শার্ট, প্যান্ট কিনতে হইবো। বউডার লেইগা একখান লাল টুকটুকে শাড়ি। শাড়িতে অরে বড় মায়াবতী লাগে রে! ”
শেষোক্ত বাক্যে ঝলমলে উজ্জ্বলতা শোভা পেল মুয়ীযের বদন জুড়ে। তা চক্ষু এড়ালো না বন্ধুর। সে তৃপ্তিময় হাসলো মনে মনে।
” ভাবীর বাড়ির লোকেগো লেইগা? ” চয়ন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
” অর ভাবীর লেইগা ভাবতাছি শাড়ি দিমু। মাগার কি শাড়ি দিমু? অত বড় ঘরের বউ উনি। মোর দেয়া শাড়ি কি মন পছন্দ হইবো?”
” কেন হইবো না? তোর পছন্দ হইলো গিয়া দেশসেরা। মাইনষে পটতে বাধ্য। ”
কেমন মলিন হাসলো জনাব হাসান। সে হাসিতে ছিল ব্যর্থতা আর গ্লানি। দরিদ্রতার সবচেয়ে বড় অভিশাপ!
” বান্ধবী শিমু আপার লেইগাও কিছু দিমু ভাবছি। ম্যালা ভালা মাইয়াডা। তোর ভাবীর বহুত কাছের। ”
” খুব ভালো। তয় বেয়াই আর তালই মশাই? ”
ধীরস্থির শুধালো চয়ন। পরক্ষণেই বন্ধুর হাবভাব, মুখভঙ্গি লক্ষ্য করে একদম খোলস বন্দী হয়ে গুটিয়ে গেল। এই রে গেল! গেল! ওই দুটোর নাম নেয়ার খুব কি দরকার ছিল? এবার যে তার ওপর দিয়ে আইলা-সুনামী যাবে।
” বো-ম দিমু বো-ম। বো-ম দিয়া সোজা উড়াই দিমু ওই দুই হালা* পো হা* রে। মোর কষ্টের টাহায় কেনা জিনিস অরা নিতো তো না-ই। নিলেও কিনা ত্যানা বানাই হালাইবো। মোর টাহায় কি চক মা’রে যে অগো লেইগা ত্যানার ব্যবস্থা কইরা দিমু?! ”
ভ্যাবাচ্যাকা খেলো চয়ন। তৎক্ষণাৎ হড়বড় করে বলে উঠলো,
” ঠিক আছে। ঠিক আছে। বো ম কিংবা ত্যানা কিছুই দেওন লাগতো না দোস্ত। তুই শান্ত হ। ফুঁ ফুঁ ফুঁ…! ”
মুয়ীযের দিকে অনেকাংশে ঝুঁকে গিয়েছে চয়ন। জোরে জোরে ফুঁ দিয়ে ওকে শান্ত করতে চাইছে। মুয়ীয এতে আরো তেঁতে উঠলো। হাত ঝেড়ে বললো,
” সর তো এইহান থে। অসহ্য লাগতাছে। ”
” আচ্ছা আচ্ছা। সরতাছি। ফুঁউউউউ! ”
শেষবারের মতো ফুঁ দিয়ে দ্রুত সরে গেল চয়ন। মুয়ীযের দু হাতের আঙ্গুলি একত্রে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে, মোচার মতো বদ্ধ টেবিলের ওপর। কিছুটা সময় নীরবতা গ্রাস করে নিলো। ম্লান কণ্ঠে নিরাশা প্রকাশ করলো মুয়ীয,
” ইচ্ছা সত্ত্বেও সবাইরে দিতে পারতাছি কই, ক? বড় আপা, ভাইরে কিছুই দিতে পারতাছি না। মায়ের একজোড়া স্যান্ডেল দরকার। হেইয়া দিতে পারতাছি না। জীবন মাস কয়েক আগে একখান খেলনা পি•স্তল চাইছে। অহনো দিতে পারি নাই।…. সামনে বউয়ের ভর্তি পরীক্ষা আছে। অনলাইনে কোচিং করে। হেহানেও টাহা দরকার। চাইরদিকে খালি টাহা আর টাহা। ”
করুণ শ্বাস ফেলে,
” মোগো আত্মসম্মানবোধ ওয়ালা গরীবগো জীবনডা সহজ না রে বন্ধু। চাইলেও কারো ধারে ভিক্ষার লেইগা হাত পাততে জানি না। কর্জ করতে পারি না। এক আল্লাহ্ ই মোগো হগল ভরসা। ইয়া রাব্বুল আলামিন! সহায় হন। ”
চয়নের মনেও তখন যেন একই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে,
‘ আমগো গরীবগো সহায় হন আল্লাহ্! ‘
•
আজকের মিষ্টি সকালটা অন্য দিনের চেয়ে ভিন্ন। অন্যরকম সুন্দর। বাতাসে ভেসে পবিত্রতা। আতরের গন্ধ ছেয়ে ঘরে ঘরে। শুভ্রতা ছড়িয়ে পথে প্রান্তরে। জামায়াতের সময় হয়ে এসেছে। নিজ ঘরে ছোট আরশির সম্মুখে দাঁড়িয়ে মুয়ীয। উক্তি তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে। কপালে পড়ে ছোট ছোট চুলগুলো। কোমরে গুঁজে শাড়ির আঁচল। হালকা ঘাম মুখমণ্ডলে। একদম বাংলার সে-ই অকৃত্রিম গৃহিণী রূপ! স্বামীর পরিহিত শুভ্র রঙা পাঞ্জাবির বুকের বোতামগুলো আটকে দিচ্ছে উক্তি। মুয়ীয সন্তুষ্ট চিত্তে সহধর্মিণীর পানে তাকিয়ে। বোতাম লাগানো শেষে উক্তি আতর মেখে দিলো স্বামীর দেহে। হালকা ভেজা চুলগুলো আঁচড়ে দিলো। পড়িয়ে দিলো শুভ্রময় টুপি। সাহেব একদম প্রস্তুত ঈদুল ফিতরের জামায়াতের জন্য। উক্তি মুচকি হেসে স্বামী হতে কয়েক কদম দূরে সরে গেল। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। হৃদস্পন্দনের সুমধুর ধ্বনি তখন অশ্ব গতিতে সুরের সৃষ্টি করছে। বিমোহিত নয়নে তাকিয়ে রইলো মেয়েটা! শ্যামসুশ্রী পুরুষটির ভালোবাসায় আরো একবার ফেঁসে গেল। হলো চিরবন্দিনী। মুয়ীয মুচকি হেসে নিকটে এলো। আলিঙ্গনাবদ্ধ করলো পুতুল বউটিকে। ললাটে সময় নিয়ে এঁকে দিলো হালাল স্পর্শ। কানে ঠেকালো ঠোঁট। ফিসফিসিয়ে আস্তে ধীরে আওড়ালো,
” ঈদ মোবারক বউ। আল্লাহ্’র রহমতে সুন্দর ও পূণ্যময় হোক তোর হারাডা জীবন। ”
কানের নরম অংশে ঠোঁটের ক্ষুদ্র পরশ বুলিয়ে ঈদগাহ এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো মুয়ীয হাসান। সলজ্জ নেত্রে সে পথে তাকিয়ে উক্তি। উপহার দেয়া পাঞ্জাবিতে মাশাআল্লাহ্ অত্যন্ত সুদর্শন লাগছে তার মানুষটিকে! কারো নজর না লেগে যায়।
.
পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ঘরের সদস্য ও শ্বশুরবাড়ির জন্য সামর্থ্যের মধ্যে কেনাকাটা সম্পন্ন করেছে মুয়ীয। তবে সকল কিছুর ভীড়ে নিজের জন্য কিছুই কেনা হয়ে ওঠেনি। পুরুষ মানুষ এমনই হয়। সকলের তরে ঝড়ে তাদের অক্লান্ত ঘাম। তবে নিজের জন্যে শুধুই শূন্যতা আর ব্যর্থতা। নিজের জন্য সামান্য একটি শার্ট কিংবা পাঞ্জাবি কেনার মতো ফুরসৎ মেলে না তাদের। তাদের সকল ভাবনা ঘিরে শুধুই আপনজন। মুয়ীয এমনই এক পুরুষ। সকলের জন্য কিনেছে সে। নিজের জন্য কিছুই নেয়া হয়নি। বন্ধু চয়ন এজন্য ডাক নিয়েছিল।
‘ দোস্ত! সবার জন্য কিনলি। নিজের জন্য তো কিছুই তো নিলি না। ‘
মুয়ীয অমলিন হেসে বলেছিল,
‘ মোর আবার কি লাগবো? গত বছরে ঈদের সময় একখান জিন্স কিনছিলাম না? ওইয়াই পড়মু এইবার। আর লগে বিয়ার সময় কেনা একখান শার্ট। ব্যাস। মুয়ীয হাসান এক্কারে রেডি। ‘
চয়ন আর কিছু বলতে পারেনি। কিইবা বলবে সে? এ শুধু মুয়ীয নয় বরং প্রত্যেক নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ চিত্র। সে নিজেও তো এমন দৃশ্যের এক সাধারণ জীবন্ত চরিত্র। নীরবে দীর্ঘশ্বাস গোপন করে নিয়েছিল চয়ন।
চাঁদ রাত আজ। একমাস ব্যাপী পবিত্র মাহে রমজানের শেষে এলো খুশীর ঈদ। অদূরে ঘরে ঘরে ধ্বনিত হচ্ছে কাজী নজরুল ইসলামের সে-ই কালজয়ী…
‘ ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।
তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। ‘
মেহেদীর রঙে রঙে রঙিন হচ্ছে ললনাদের হাতের এপিঠ, ওপিঠ। ঈদের চাঁদ দেখতে ছোটাছুটি করে চলেছে শিশুদের দলবল। মারুফ পুত্র জীবন তাদেরই একজন। অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে সেও ছোটাছুটি করছে। ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে কয়েকজন।
ইসলাম যে তার অনুসারীদের ধর্ম-কর্ম পালনের পাশাপাশি আনন্দ উদ্যাপনেরও সুযোগ দিয়েছে, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন দুটি তারই এক বড় নিদর্শন। ঈদের দিন বৈধ পন্থায় আনন্দ উদ্যাপনের এই অবকাশ প্রসঙ্গেই আম্মাজান আয়েশা রা. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস বর্ণনা করেছেন-
لَتَعْلَمُ يَهُودُ أَنَّ فِي دِينِنَا فُسْحَةً، إِنِّي أُرْسِلْتُ بِحَنِيفِيَّةٍ سَمْحَةٍ.
ইহুদিরা জানবে, আমাদের ধর্মেও অবকাশ আছে। নিশ্চয়ই আমি প্রেরিত হয়েছি এমন এক শরীয়ত নিয়ে, যা সহজতা ও উদারতার গুণে গুণান্বিত। [ মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৪৮৫৫]
মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর ঈদুল ফিতরের এই দিনটি মূলত আল্লাহ্ দিয়েছেন তার প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদনের জন্য। তিনি যে রমজানের সবক’টি রোজা রাখার এবং তার ইবাদতে পুরো একটি মাস কাটানোর তাওফীক দিয়েছেন সেজন্য শোকর আদায়- এটাই ঈদের তাৎপর্য। এই মাসে রোজা রাখতে পারা এবং আল্লাহ্’র ইবাদতের অসীম-অবারিত সুযোগ পাওয়ার যে আনন্দ মুমিন-হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়- ঈদুল ফিতর হল সেই আনন্দ প্রকাশ করার উৎসব। সে আনন্দের প্রকাশ ঘটে দলে দলে ঈদগাহে হাজির হয়ে মহান রবের কৃতজ্ঞতায় সালাত আদায়ের মধ্য দিয়ে। তার মহিমা ও বড়ত্বের ঘোষণা দিয়ে তাকবীর পাঠের মাধ্যমে এবং এই সিয়ামসাধনা যেন কবুল হয় সেজন্য একে অপরের কাছে দোয়া চাওয়ার মাধ্যমে।
উক্তি ঘরের জানালা গলিয়ে শিশুদের অকৃত্রিম আনন্দ উদযাপনের দৃশ্য দেখে মুচকি হেসে ফেললো। হাতে থাকা প্যাকেটে আলতো হাত বুলিয়ে সে চললো নিজ কক্ষের উদ্দেশ্যে। কক্ষে প্রবেশ করে উক্তি’র ঠোঁটের কোণ প্রসারিত হলো। স্বামী মানুষটি ঘরময় হেঁটে চলেছে। কানে ঠেকে মুঠোফোন। কারো সঙ্গে আলাপচারিতায় ব্যস্ত সে। কালো রঙা স্যান্ডো গেঞ্জি এবং লুঙ্গি পড়নে তার। ঘরোয়া নিজস্ব অগোছালো রূপেও অবর্ণনীয় সুদর্শন, সুকুমার লাগছে মানুষটিকে! উক্তি চুপটি করে দাঁড়িয়ে। দেখছে দু নয়ন ভরে! চোখেমুখে সুখের ঝলকানি। অন্তরে সুখকর অনুভূতির সুগভীর জলাধার। লজ্জালু মুখে ভেতরে প্রবেশ করলো মেয়েটি। হাতে থাকা প্যাকেটটি বারবার তার অন্তরে সংকোচ, জড়তার সৃষ্টি করছে। কাঁপছে অন্তঃস্থল। শুকিয়ে আসছে ঠোঁট। আলতো করে ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে নিলো উক্তি। স্বামীর নিকটে এসে পৌঁছালো। মুয়ীয তখন মুঠোফোনে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। স্ত্রীর উপস্থিতি টের পেয়ে বামে ঘুরে তাকালো। চোখের ভাষায় শুধালো কি হয়েছে? দুরুদুরু বুকে আল্লাহ্’র নাম স্মরণ করে হাতে থাকা প্যাকেটটি বাড়িয়ে দিলো উক্তি।
” কি? ”
উক্তি ইশারায় নিতে বললো। কথামতো দ্বিধান্বিত মুয়ীয প্যাকেটটি হাতে নিলো। নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখতে লাগলো। উক্তি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে বললো,
‘ খুলে দেখুন। ‘
” আছেডা কি ভিতরে? ”
বিড়বিড় করে মুয়ীয প্যাকেটটি উন্মুক্ত করলো। কল্পনাতীত চমকের আধিক্যে মুখের বুলি হারিয়ে ফেললো মানুষটি। স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে। এ কি?! সে কি ভুল দেখছে? এই অভাবনীয় মুহুর্তটুকু এতটাই অবাস্তব! একটুও কি সত্য হতে পারে না?!
সেদিন সে প্রহরে স্বামীকে সামান্য নকশা খচিত এক পাঞ্জাবি উপহার দিয়েছিল উক্তি। অর্থ পেল কোথায়? বিবাহ পরবর্তী সময়ে স্বামী মানুষটি বিভিন্ন সময়ে তাকে হাত খরচের জন্য সামান্য কিছু টাকা দিতো। সেসব টাকা ব্যয় না করে জমিয়ে রাখতো মেয়েটি। অদ্যবধি জমানো সকল অর্থ ব্যয় করে দিন দুয়েক পূর্বে এক বাহানা দিয়ে সে বেড়িয়েছিল বাড়ির বাইরে। নিকটবর্তী এক শপিংমলে গিয়েছিল। সেখানকার পোশাক বাজেটের বাইরে। ইচ্ছে সত্ত্বেও দামাদামি করে কিছু কিনতে পারেনি উক্তি। ব্যর্থতায় চোখে জল নেমেছিল। হাজার টাকার পোশাক ক্রয় করা মেয়েটি আজ কয়েকশ টাকা দিয়ে স্বামীর জন্য কিছু কিনতে ব্যর্থ। শেষমেষ শপিংমলের বাহিরে অবস্থিত ফুটপাতের দোকান থেকে সামর্থ্যের মধ্যে একটি পাঞ্জাবি ক্রয় করলো উক্তি। শুভ্র রঙা পাঞ্জাবি। শুভ্রতায় তার সুদর্শন পুরুষটিকে আকাশের ন্যায় স্বচ্ছ, সুন্দর, নির্মল লাগে যে!
স্ত্রীর কাছ থেকে অকল্পনীয় উপহার পেয়ে আবেগের আতিশয্যে হার মানতে বাধ্য হলো মুয়ীয। অকস্মাৎ বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নিলো কোমল দেহটিকে। দ্রুত মুখ লুকালো স্ত্রীর ডান কাঁধে। সেথায় নীরবে নিভৃতে ঝড়লো দু ফোঁটা অপ্রত্যাশিত খুশির নোনাজল। সে খুশি অনুভব করতে পারলো উক্তি। বললো না। দিলো না বাধা। শুধু নীরবে নিজের সনে আরো আগলে নিলো। বুঝিয়ে দিলো ‘ আমি আছি তো প্রিয়তম স্বামী! ‘
•
আজ পবিত্র ঈদুল ফিতর। পবিত্রতম এক খুশির উৎসব। ইসলাম ধর্মে ঈদের প্রবর্তন বা সূচনা হয়েছে দ্বিতীয় হিজরী সনের মাঝামাঝি সময়ে।
عن أنس بن مالك: قدِمَ رسولُ اللهِ صلّى اللهُ عليه وسلَّمَ المدينةَ ولهم يومانِ يلعَبونَ فيهما في الجاهليَّةِ، فقال: إنَّ اللهَ قد أَبدَلَكم بهما خَيرًا منهما: يومَ الفِطرِ، ويومَ النَّحرِ
হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় আসেন, তখন দেখেন যে সেখানকার লোকেরা বছরে দুদিন (নাইরোজ ও মিহরজান নামে দুটি দিনে) আনন্দ করে, খেলাধুলায় মগ্ন থাকে। এহেন পরিস্থিতি দেখে দুজাহানের বাদশাহ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ্ তায়ালা তোমাদের এ দুদিনের পরিবর্তে আরও বেশি উত্তম ও কল্যাণকর দুটি দিন দিয়েছেন। ১. ঈদুল আজহা ২. ঈদুল ফিতর। (আবু দাউদ, ১/১৬১. হাদীস নং ১১৩৪ সুনানে নাসায়ী : ১ম খ-, পৃ. ১৭৭)
ঈদগাহ ময়দানে জমায়েত হয়েছে শতাধিক মুসল্লি। মুসলিম ভাইয়েরা। ঈদের সালাত আদায় করে কোলাকুলি করে চলেছে তারা। মুয়ীয, চয়ন, মারুফ আরো কয়েকজন একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করছে। মুখে উচ্চারিত হচ্ছে ‘ ঈদ মোবারক ‘ কলরব।
ঈদের দিন কুশল বিনিময়ের ভাষার মধ্যেই এ বার্তা রয়েছে- تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكُمْ. অর্থাৎ আল্লাহ্ কবুল করুন- রমজান মাসে ও আজকের দিনে করা আমাদের ও তোমাদের সমস্ত নেক আমল।
কুশল বিনিময়ের এই বাক্যটিই ইসলামের ঈদকে অন্যান্য ধর্মের উৎসব থেকে আলাদা করে দেয়। মুসলমানের ঈদ আশা ও ভয়ে মিশ্রিত এক সতর্ক ও সংযত আনন্দ উদ্যাপন। একদিকে খুশি- আলহামদুলিল্লাহ, রোজাগুলো রাখতে পেরেছি। অন্যদিকে শঙ্কা- কবুল হয়েছে তো! রমজান পেয়েও যদি মাগফিরাত নসীব না হয়, তাহলে এর চেয়ে দুর্ভাগ্য তো কিছু নেই…।
মাসব্যাপী ইবাদতের তাওফীক পেয়ে আল্লাহ্’র প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন এবং সেই খুশিতে তার বড়ত্ব বর্ণনা করে তাকবীর পাঠ, এটাই যে ঈদের মর্মকথা- নিম্নোক্ত আয়াতই তার প্রমাণ-
وَلِتُكْمِلُواْ الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ اللهَ عَلٰى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُون.
এবং যাতে তোমরা রোযার সংখ্যা পূরণ করে নাও আর আল্লাহ যে তোমাদের পথ দেখিয়েছেন, সেজন্য আল্লাহর তাকবীর পাঠ কর ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। [সূরা বাকারা ১৮৫]
আল্লাহ্’র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অংশ হিসেবেই এদিন বৈধ সব উপায়ে আনন্দ করতে দেয়া হয়েছে। একজন মুমিন শরীয়তের সীমার ভেতরে থেকে যেভাবে আনন্দ করতে পারে। ভালো খাওয়া, ভালো পরা, আপনজন ও প্রিয়জনদের সাথে দেখা- সাক্ষাৎ ও খোশগল্প, একে অপরকে হাদিয়া দেয়া, আত্মীয়- স্বজনের খোঁজখবর নেয়া ইত্যাদি।
এই আনন্দে যেন সমাজের সব শ্রেণির মানুষ শরীক হতে পারে, সেজন্যই সদাকাতুল ফিতরের বিধান। শুধু নিজে ভালো খাওয়া ও ভালো থাকার যে আনন্দ- অন্যের মুখে হাসি ফোটানোর আনন্দ তার চেয়ে বহুগুণে বেশি। এ কারণেই দান-সদকা ও জাকাত- ফিতরার প্রতি এত উৎসাহিত করেছে শরিয়ত।
চলবে।