তোমাতেই নৈঃশব্দ্য প্রহরে পর্ব-২৯

0
88

#তোমাতেই_নৈঃশব্দ্য_প্রহরে
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্বসংখ্যা_২৯

জনাব কায়সার হামিদ সদা একটু আবেগী স্বভাবের ব্যক্তি। দিমাগ নয় দিল থেকে পরিচালিত হন উনি। আশেপাশের মানুষদের কথাবার্তা প্রায়শ ওনায় প্রভাবিত করে। তাই তো জন্মদাত্রী মা ও স্ত্রী হারানোর দ্বৈত শোকে যখন ছন্নছাড়া হয়ে ছিলেন, ঠিক সেসময় আশপাশের মানুষজন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে স্বীয় ছোট বোন কোহিনুর। মনে বি°ষক্রিয়া হয়েছিল ওনার। যে বি;ষের ভয়াল প্রতিক্রিয়ায় শেষ হয়ে গেল অবুঝ উক্তির জীবন। পিতা ও পুত্র যুগল সে-ই শুরু থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় কায়সার সাহেবের মনোভাব পরিবর্তিত হতে লাগলো। মেয়ে ওনার কখনো কোনো অভাবে ভোগেনি। চাওয়ার পূর্বেই আবশ্যক সবকিছু পেয়েছে। ছিল শুধু একটাই অভাব। বাবা, ভাইয়ের স্নেহ ভালোবাসার অভাব। যে অভাবে ভুগে সবচেয়ে হতদরিদ্র ছিল উক্তি। উক্তি তখন কিশোরী। কায়সার সাহেবের মনটা পু’ড়তো। মেয়ের সঙ্গে একটুখানি পিতা সুলভ আচরণ করতে ইচ্ছে হতো। আদর করে বুকে আগলে নিতে ইচ্ছে হতো। তবে তা আর হয়নি। দু’জনের মধ্যে ততদিনে গড়ে উঠেছে শক্তপোক্ত এক অদৃশ্য দেয়াল। যে দেয়াল ভাঙ্গার দুঃসাহস কখনো করেননি কায়সার সাহেব। ওনার এই এক জীবনে কৃত কতগুলো ভুলের মধ্যে অন্যতম বড় একটি ভুল এই দেয়াল ভাঙতে না পারা। এভাবেই সময় গড়িয়ে গেল। উনিশ বছরের উক্তি তাকদীরের লেখনী মতে হয়ে গেল মুয়ীয হাসান পত্নী। বোবা উক্তির জীবনে অবশেষে ধরা দিয়েছে সুখপাখি। বাবার রাজকন্যা হয়তো হওয়া হয়নি। তবে আলহামদুলিল্লাহ্। সে হতে পেরেছে স্বামীর হৃদ রাজ্যের মহারানী। এ-ই যে ওর মতো অভাগিনীর জন্য অনেক বড় পাওয়া। আলহামদুলিল্লাহি আ’লা কুল্লি হাল।

মধ্য দুপুর তখন। সূর্যের তেজদীপ্ত কিরণে পুড়ে যাওয়ার উপক্রম জীবকূলের। ঠিক মাথার ওপর অবস্থান করছে সূর্য। ঘামে ভেজা দেহে কাজে নিয়োজিত মানুষগুলো। নির্মাণাধীন সাততলা ভবনের সামনে অবস্থিত খোলা স্থানে রাখা ইট, সিমেন্টের বিশাল স্তূপ। সেথায় কর্মব্যস্ত পুরুষেরা বড় বড় ঝাঁপি বোঝাই করে ইট কেউবা বালু নিয়ে ওপরতলার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হচ্ছে। মাথায় বহন করছে সেই ভারী ভারী বিশেষ ঝাঁপি। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে এক সুঠামদেহী কর্মব্যস্ত ব্যক্তি। রেলিং বিহীন সিঁড়ি। তার ওপর সরু। একজন ওপরে উঠছে। পাশ দিয়েই নামছে আরেকজন। ঝুঁকিপূর্ণ কর্ম বটে। মুয়ীয নামক মানুষটির মাথায় বাঁধা গামছা। তাতে সিমেন্টের বড় এক বস্তা। কর্মঠ দুই হাতে সিমেন্টের ভার বহন করছে সে। পাশ দিয়ে অতিক্রম করে যাওয়া মানুষটিকে যথাসম্ভব জায়গা দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে পড়লো মুয়ীয। লোকটি খালি ঝাঁপি নিয়ে নিচে চলে গেল। এবার ঘর্মাক্ত শরীরে মুয়ীয উঠতে লাগলো ওপরে। বিগত ষোলো দিন ধরে এখানে এই কন্সট্রাকশন সাইটে কাজ করছে মুয়ীয। সকাল থেকে বিকেল এখানে কায়িক পরিশ্রমের কাজ করে থাকে সে। অতঃপর বিকেল থেকে প্রায় মধ্যরাত রিকশা চালিয়ে বেড়ায় শহরের একপ্রান্ত হতে অপর প্রান্ত। অধিক অর্থের প্রয়োজন তাদের। টাকা চাই টাকা। তাই তো নিজে অমানুষিক পরিশ্রম করে চলেছে দিবারাত্রি। ওদিকে স্ত্রী উক্তি টুকটাক সেলাইয়ের কাজ শিখেছে। মাটির কাজ পারে কিছুটা। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সেই কাজ করে চলেছে। তা হতে মিলছে সামান্য কিছু অর্থ। যা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগন্য। এভাবেই স্বামী স্ত্রীর দিনকাল চলছে।

.

কোনো এক সুবাহ লগ্ন। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে পরিবারের সদস্যরা। তাদের কারো কারোর চোখে অশ্রু। ঠোঁটে ভেজা হাসি। বালক জীবন খুশিতে বাকবাকুম পায়রা হয়ে নাচছে। স্বপ্ন পূরণ হলো তবে। ভঙ্গুর বাড়ি পেল স্থায়ী ছাদ। উন্নতমানের টিনের চাল লাগানো হয়েছে বাড়িতে। সে-ই যে ঝড়ে বাড়ির চাল উড়ে গেল। এরপরের সময়টা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। শুধু টিনের চাল নয়। বাড়ির ভেতরেও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। সবটা ঠিক করার জন্য বেশ টাকার দরকার। কিন্তু ওই মুহূর্তে প্রয়োজনীয় টাকা ছিল না। সেসময় প্রথমবারের মতো সামনাসামনি প্রত্যক্ষভাবে আর্থিক সাহায্য করার অফার দিলেন কায়সার সাহেব। অভদ্রের মতো জেদ বজায় রেখে সে প্রস্তাব নাকোচ করলো মুয়ীয। অতীতের কৃতকর্ম ভোলেনি সে। বউয়ের প্রতি ফোঁটা অশ্রু আজো ঝড় তোলে মনে। এই নির্দয় মানুষটির থেকে সাহায্য নেয়ার প্রশ্নই আসে না। কায়সার সাহেব যথেষ্ট নিরাশ হলেন। একমাত্র মেয়েটার ভবিতব্য কি এ-ই দুর্দশা…? অতঃপর পূর্বের তুলনায় অধিক পরিশ্রম করতে লাগলো মুয়ীয। বাড়িতে আপাতত ছনের ছাউনি দেয়া হলো। অন্তত মাথার ওপর একটা ছাদ তো চাই। সেই ছনের ছাউনি তলেই থাকতে লাগলো ওরা। আস্তে ধীরে বাড়ির ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করতে লাগলো মুয়ীয। মারুফ মাত্র পাঁচ হাজার দিয়ে সহায়তা করতে পেরেছিল। বাকি সব মুয়ীযের কষ্টার্জিত অর্থে। আজ বাড়িতে উন্নতমানের টিনের চাল লাগানো হলো। আনা হলো দুই চুলার নতুন গ্যাস স্টোভ। দিন বদলের হাওয়া বুঝি অবশেষে আরম্ভ হয়েছে। ইনশাআল্লাহ্ একদিন বদলাবে ভাগ্য। পরিবর্তিত হবে জীবনধারা।

তমস্র রাত্রি। গুনগুনিয়ে গাইছে ঝিঁঝিঁ। হালকা হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে দেহমন। পাশাপাশি সোজা হয়ে শুয়ে কপোত কপোতী। মুয়ীয এবং তার উক্তি। দুজনার দৃষ্টি স্থির টিনের নতুন চালে। চোখেমুখে প্রশান্তির ছোঁয়া।

” আলহামদুলিল্লাহ্‌! আল্লাহ্ তাইলে বাড়িডা ঠিক করার তৌফিক দিলো। ”

উক্তি স্বামীর মুখপানে তাকিয়ে ইতিবাচক মাথা নাড়লো। ঠোঁটে মুচকি হাসি। অন্তরে সে-ও শুকরিয়া আদায় করলো রবের।

” জানোস বউ। মুই বড় চিন্তায় ছিলাম। খালি মন কইতো কবে ঠিক হইবো এই বাড়ি। কবে মায়ের মুহে হাসি ফুটবো। মা তো ছনের বাড়ি সইতে পারতাছিল না। গোপনে খালি কান্দে। পোলাগো কিচ্ছু কয়ও না। তয় মুই বুঝি সব। নীরবে দেহি। এক আল্লাহ্’র ধারে মন থে সাহায্য চাইছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ। সফলতা এবার আইছে। মা খুশি তো মুইও খুশি। ”

উক্তি মুচকি হাসলো। হ্যাঁ কথাটা সত্য। বান্দা তার রবের ওপর ধৈর্য ধারণ করে, না অতীতে নিরাশ হয়েছে। না এখন হচ্ছে। ভবিষ্যতেও সম্ভবনা নেই। ধৈর্য্য ধরে সফলতা মিলবেই মিলবে। আজ না হোক কাল। উক্তি আলতো করে স্বামীর গালে হাত রাখলো। মুয়ীয জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। ওর জিজ্ঞাসু মনটিকে হতবিহ্বল করে উক্তি আরেক হাতে দুষ্টুমি করে স্বামীর ছোট ছোট মসৃণ চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো। এতে প্রথমে পেঁচা মুখ বানিয়ে ফেললেও পরবর্তীতে শব্দহীন হেসে উঠলো মুয়ীয। সে হাস্যোজ্জ্বল অভিব্যক্তি আকর্ষিত করলো উক্তিকে! মুগ্ধ চাহনিতে স্বামীর পানে তাকিয়ে রইলো মেয়েটি। চুম্বকের ন্যায় টানছে তাকে। অবাধ্য হয়ে উঠেছে মন। বশীভূত কন্যা ধীরে ধীরে দূরত্ব কমিয়ে কাছে গেল বেশ। মুয়ীয কিছু বলবার জন্য হাসিমুখে ঠোঁট নাড়াতে উদ্যত হয়েছিল। তখুনি উক্তি ঠোঁটের পরশ ছুঁয়ে দিলো স্বামীর গালে। হাসি হাসি মুখখানা আকস্মিক পরিবর্তিত হলো। চমকিত নেত্রে তাকালো মুয়ীয! এটা কি হলো? তার শব্দহীন পাখিটা কিয়ৎক্ষণ পূর্বে স্বেচ্ছায় ছুঁয়ে দিলো! চুমু খেল! এ যে চরম আশ্চর্যজনক কাণ্ড! লজ্জা ও স্বামীর দুষ্টুমি মাখানো চাহনিতে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো উক্তি। আস্তে ধীরে দূরত্ব বাড়িয়ে কেটে পড়তে নিলো। তবে তা আর হলো কোথায়? চট করে পাকড়াও করে নিলো মুয়ীয হাসান। দু হাতের শক্ত বন্ধনে বেঁধে ফেললো ওকে। আবেশে বন্দিনী হলো উক্তি। অতি নিকটে দু’জনে। শ্বাস প্রশ্বাস যেন মিলেমিশে যাচ্ছে তাদের। গরম হাওয়া মুখে লেপ্টে। চোখে চোখ স্থির। মুয়ীযের মুখখানা আরো নিকটে এলো। উক্তি লজ্জায় দৃষ্টি নামালো না। বরং মোহিত নজরে তাকিয়ে রইলো! মুয়ীয এলো কাছে। অর্ধাঙ্গিনীর দু ভ্রুয়ের সন্ধিস্থলে অধরোষ্ঠ ছুঁয়ে রাখলো দীর্ঘ সময় নিয়ে। উক্তির চক্ষু বুঁজে এলো সে গাঢ় প্রমত্ততায়। দু চোখের পাতায় আকাঙ্ক্ষিত পরশ লাভে উক্তি আঁকড়ে ধরলো স্বামীর বাহু। মিশে গেল আরো একটুখানি। গালের কোমলতায়, নাকের নরম ডগায় ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে মুয়ীয ডুব দিলো সম্মোহনী কম্র ওষ্ঠাধরে। উক্তি নিজের সনে পুরোটা আগলে নিলো তার শ্যাম পুরুষ সঙ্গীটিকে। বহুদিন বাদে দু’জনে আজ খুঁজে নিলো আত্মিক-কমনীয় সুখানুভূতি!

মিঠে রোদ্দুর ছোঁয়া এক সকাল। আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে নিশাত। পড়নে শাড়ি তার। হিজাব বেঁধে নিচ্ছে মাথায়। পেছনে দাঁড়িয়ে জাওয়াদ। শার্টের হাতা গুটিয়ে চলেছে। মাঝেমধ্যে আড়চোখে তাকাচ্ছে স্ত্রীর দিকে। মুখভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে কিছু বলতে ইচ্ছুক সে। তবে কোনো কারণবশত বলতে পারছে না। কি এমন বলতে চাইছে সে, যা কিনা অবরুদ্ধ হয়ে আসছে ঠোঁটের মাঝে!

” কি বলতে চাও? বলে ফেলো। ”

চট করে স্ত্রীর প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়ায় থতমত খেল জাওয়াদ। আমতা আমতা করে বললো,

” ও.. ও কিছু না। ”

” ওকে। ”

” ওকে! ”

যথেষ্ট অবাক এবং হতাশ দুইই হলো জাওয়াদ। নিশাত এত সহজে হাল ছেড়ে দিলো! আরেকবার জানতে চাইলো না কেন? এইবার জিজ্ঞেস করলে সে তো বলেই দিতো। আর লুকাতো নাকি? কিন্তু আফশোস। নিশাত দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধই করলো না। মেয়েটা আজকাল কেমন বদলে গেছে। ওর সঙ্গে শীতল আচরণ করে। দু’জনের মধ্যকার মানসিক বন্ধন বোধহয় বেশ নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। এক অদৃশ্য দেয়াল গড়ে উঠেছে মধ্যিখানে। নিশাত সম্ভবত ওকে আর ভালোই বাসে না। বাসবে কেন? সে কি ভালো ছেলে? সে তো আস্ত এক পাপী। পঁচা ছেলে। পঁচা ছেলেদের গালাগাল করতে হয়। ভালোবাসতে নয়। মনে মনে আকাশ পাতাল ভেবে জাওয়াদের মুখখানা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেল। দেখে মায়া হবে যে কারোর। নিশাত রেডি হয়ে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলো। সব ঠিকঠাক। স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা হবে সে। জাওয়াদ যাবে অফিস। নিশাত স্বামীকে একপ্রকার উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল। সহসা জাওয়াদ বলে উঠলো,

” আজ তো ৮ তারিখ। ”

নিশাতের চলন্ত পদযুগল থেমে গেল। পিছু ঘুরে স্বামীর দিকে তাকালো সে। বললো,

” হ্যাঁ। তো? ”

” তো? ” আমতা আমতা করে, ” আজকের দিনটা ভুলে গেছো? ”

” আমার মনে হয় না আজকের দিনটা খুব বিশেষ কোনো দিন। অন্য দিনের মতোই স্বাভাবিক। না কারো জন্মদিন না কারোর মৃ-ত্যুদিন। ” নির্লিপ্ত নিশাতের কণ্ঠস্বর।

” অ্যাই! কিসব বলছো তুমি? আমি কি জন্ম, মৃ ত্যু এমন টাইপ কিছু বলেছি? ”

” না বলোনি। তবে আমিই আগে বলে রাখলাম। সে যাই হোক। আমার দেরি হচ্ছে। আসছি আমি। আসসালামু আ’লাইকুম। ”

জাওয়াদ কিছু বলবার পূর্বেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নিশাত। হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে জাওয়াদ। নিশাত ওকে এক চিমটি পরিমাণ পাত্তাও দিলো না! এভাবে এড়িয়ে গেল! আজ নিজ দোষে নিজের এই করুণ অবস্থা তার। ঘরে রীতিমতো অস্পৃশ্য সে। যাকে দেখা যায় না, শোনা যায় না, ছোঁয়াও যায় না।
.

সকাল থেকে বরাবরের মতো ব্যস্ত সময় পার করছে উক্তি। ঘরের কাজকর্ম করে চলেছে। রান্না করছে। উক্তির রন্ধন গুণ মাশাআল্লাহ্! শুরু শুরু যা-ও একটু খামতি ছিল এখন অসাধারণ রান্না করে! শাশুড়ি মা, বড় জা খেয়ে তৃপ্ত। তবে মুখ ফুটে স্বীকার করেন না। উক্তি আজ রান্না করেছে বেগুন দিয়ে শিং মাছের তরকারি। লাল শাক ভাজি। আর অল্প করে ডাল। দুপুর, রাত এই খাবে সকলে। শাক ভাজি শাশুড়ি মা করেছেন। তরকারি, ডাল রান্না করেছে উক্তি নিজে। অন্য দিনের মতো ব্যস্ত থাকলেও উক্তি আজ চিন্তিত কিছু এক নিয়ে। মাঝেমধ্যে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। মোমেনা বেগম তা লক্ষ্য করলেন। দুপুরে খাওয়া শেষে উক্তি যখন এঁটো থালাবাসন একত্রিত করছে তখন ডেকে উঠলেন ওকে,

” ছোডো বউ! ”

উক্তি দাঁড়িয়ে পড়লো ত্বরান্বিত। প্রশ্নমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে। অস্ফুট স্বরে বললো,

” উঃ.. ”

” কি হইছে তোমার? অ্যামন প্যাচার লাহান মুখ কইরা আছো ক্যা? ”

উক্তি কেমন অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। আস্তে করে মাথা নেড়ে বোঝালো কিছু হয়নি। মোমেনা বেগম তা বিশ্বাস করে উঠতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন,

” কেউ কিছু কইছে? বড় বউ? ”

উক্তি দ্রুত না বোধক মাথা নাড়লো।

” তাইলে? মুন্নি? ”

” আঃ.. ”

‘না’ বলতে চাইছে উক্তি। মোমেনা বেগমের কপালে ভাঁজ সৃষ্টি হলো এই নেতিবাচক উত্তরে। জান্নাত কিছু বলেনি। মুন্নি বলেনি। তবে হয়েছে টা কি? আর কে কি বলতে পারে? ময়না কিংবা কেয়া, খেয়া তো অসম্ভব। ওরা যথেষ্ট ভালোবাসে ওকে।

” তাইলে কি হইছে? কও মোরে। ”

উক্তি হাতে থাকা এঁটো বাসন মেঝেতে রেখে হাতের ইশারায় বলে উঠলো,

” কিছু হয়নি মা।‌ আমি ঠিক আছি। আপনি চিন্তা করবেন না। সব ঠিক আছে। ”

উক্তি বলতে চাইছে না যেহেতু মোমেনা বেগম আর জোর করলেন না।

” ঠিক আছে। না কও। তয় কিছু হইয়া থাকলে লুকাইয়ো না য্যান। মোরে নাইলে মুয়ীযরে কইয়ো। কইয়ো কিন্তু। ”

কথা সমাপ্ত করে সেথা হতে চলে গেলেন মোমেনা বেগম। উক্তি প্রসন্ন চোখে সে পথে তাকিয়ে। সময় বড় জা*দুকরী কেরামতি দেখাতে জানে। বিয়ের পর প্রথম প্রথম এই শাশুড়ি মায়ের অপছন্দের ছিল সে। মাঝেমধ্যে কটূক্তি শোনাতে ভোলেননি দ্বিতীয় এই মা। হয়তো বেশি কষ্ট পেতে হয়নি তাকে। তবে একটু হলেও সমস্যা ছিল বটে। আজ সময় বদলেছে। বদলেছে মনুষ্য মন। মনোভাব। দৃষ্টিভঙ্গি। শাশুড়ি মায়ের পরোক্ষ স্নেহ এখন পেয়ে থাকে সে। যদিওবা ওনার স্নেহ-ভালোবাসা দৃশ্যমান নয়। নীরবেই নাহয় থাকুক সে স্নেহ-ভালোবাসার অস্তিত্ব। তবুও থাকুক না…!
.

সন্ধ্যা সাতটা বেজে পঁচিশ মিনিট। বিছানায় বসে উক্তি। উদ্বেগময় মুখশ্রী। দুই পাশে বসে কেয়া ও খেয়া। জীবন কোল ঘেঁষে বসে। উক্তি’র হাতে স্মার্টফোন। দৃষ্টি নিবদ্ধ তাতে। হাত কাঁপছে। ঘনঘন ঝাপটাচ্ছে চক্ষু পল্লব। ময়না শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ঘরে প্রবেশ করলেন। জিজ্ঞেস করে উঠলেন,

” কিরে উক্তি। কিছু হইলো? ”

আকস্মিক কণ্ঠস্বরে উক্তি ঘাবড়ে গেল। চোখ তুলে তাকালো বড় আপার দিকে। কেয়া বলে উঠলো,

” না মা। হয় নাই। এই লেইগ্গাই তো ছোটো মামী ভয়ে কাঁপতাছে। ”

ময়না শব্দহীন হেসে উঠলেন। বললেন,

” আরে পা’গলি! এত ভয় কিয়ের? যা হইবো ইনশাআল্লাহ্ ভালোই হবো। ”

খেয়া চট করে বলে উঠলো,

” হ্যাঁ হ্যাঁ। ফিকার নট। ”

খেয়ার হিন্দি-ইংলিশ মিশানো বুলি শুনে হেসে উঠলো সবাই। উক্তি কৃত্রিম হাসলো। ময়নার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে পুনরায় আকাঙ্ক্ষিত ওয়েবসাইটে ঢোকার চেষ্টা করলো। ফলাফল একই। সার্ভার ডাউন। ঢোকা যাচ্ছে না। ভয়, আশঙ্কায় উক্তির চোখে পানি চলে এলো। কখন মিলবে ফলাফল? এবার এমনিতেই প্রস্তুতি ভালো ছিল না। পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলী প্রভাব ফেলেছিল স্টাডি লাইফে। না জানি রেজাল্টের কোন করুণ হাল হয়েছে। ইয়া আল্লাহ্! উক্তি প্রায় কেঁদেই ফেলবে। ঠিক সে মুহূর্তে টুং করে নোটিফিকেশনের শব্দ। উক্তি তৎক্ষণাৎ মোবাইলে তাকালো। মেসেঞ্জারে মেসেজ এসেছে। একটি স্ক্রিনশট। পাঠিয়েছে স্বামী মহাশয়। উক্তি দুরুদুরু বুকে সে স্ক্রিনশটে ক্লিক করলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো আকাঙ্ক্ষিত রেজাল্ট।

‘ NU H2 Result: UKTI KAYSAR;Result: P; Marks:………………………………………….. ;Exam Year:….. Powered by Teletalk. ‘

পাশ! সে.. সে ভালো ফলাফল করে পাশ করেছে! ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠলো উক্তি। এতে ভড়কে গেল উপস্থিত সকলে। জীবন চিন্তিত হয়ে পড়লো,

” কাকি। ও কাকি। কি হইছে তোমার? কাইন্দো না। ”

বাচ্চা ছেলেটা ভয় পাচ্ছে। ময়না শুধিয়ে উঠলো,

” অ্যাই উক্তি। কি হইছে রেজাল্ট? ”

উক্তি ভেজা চোখে তাকিয়ে। কোনোরকম সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে বললো,

” আলহামদুলিল্লাহ্ পাশ করেছি বড় আপা। ”

খুশিতে ভরে উঠলো পরিবেশ। কেয়া, খেয়া সমস্বরে উল্লাস করে উঠলো,

” ইয়েএএএএএ। ছোট মামী পাশ করছে! ”

উল্লাস প্রকাশ করে জীবন লাফিয়ে উঠলো বিছানায়। ময়না হাসিমুখে এগিয়ে এলো। উক্তিকে আলতো আলিঙ্গন করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। উক্তি আবেগী হয়ে জড়িয়ে ধরলো তাকে। সে অবস্থায় হাতে থাকা মোবাইলে আরেকটি মেসেজ এলো।

‘ তোমারে নিয়া মুই গর্বিত বউ। ভালোবাসি আমার নিঃশব্দ পাখি! জীবনে বহুত বড় হও। সফল হও হেই দোয়া রইলো। ‘

এমন অপ্রত্যাশিত খুশির লগনে আরেক দফা চমকে চক্ষু ভিজে যাচ্ছে উক্তির। ময়না আপাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সে। তার চোখে খুশির অশ্রু। ঠোঁটের কোণে লজ্জার পরশ।

চলবে।