তোমাতেই নৈঃশব্দ্য প্রহরে পর্ব-৩২

0
97

#তোমাতেই_নৈঃশব্দ্য_প্রহরে
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্বসংখ্যা_৩২

নিশাকর ছড়িয়ে অন্তরীক্ষের বুকে। বাহিরে শীতল হাওয়ার ঝাপটানি। আনন্দিত হৃদয়ে নৃত্যরত বৃক্ষপত্র। সে ঘরে জ্বলছে কৃত্রিম আলোক উৎস। উদ্বেজন চিত্তে ঘরময় পায়চারি করে চলেছে মুয়ীয। একবার করে তাকাচ্ছে আকাঙ্ক্ষিত স্থানে। আবার দৃষ্টি নামিয়ে ফেলছে। ঘরে ফ্যান চলছে ফুল স্পিডে। বাহির হতে ধেয়ে আসছে শীতল হাওয়া। তবুও অনবরত ঘেমে যাচ্ছে মানুষটা। এতটা নার্ভাস লাগছে কেন? কেন এত দুর্বল হয়ে পড়েছে স্নায়ু? মনে হচ্ছে এই বুঝি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়বে মেঝেতে। এত দেরী করছে কেন মেয়েটা? সে কি ওকে উদ্বেগে উদ্বেগে মে রে ই ফেলবে? কিসের এমন নির্দয় শোধ তুলছে আজ? এটা কি শোধ তোলার সময়? এটা তো…। চট করে মস্তিষ্ক সচল হলো। পেছনে স্পষ্ট কারোর উপস্থিতি জানান দিচ্ছে ইন্দ্রিয় শক্তি। এক বুক আশা, অধীরতা, সংকোচ নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো মুয়ীয। ঘরের দরজা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো উক্তি। অবনত মস্তক। কম্পনরত অধরোষ্ঠ। আলতোভাবে দরজা ভেতর থেকে আটকে দিলো মেয়েটা। একটিবারের জন্যও চোখ তুলে তাকালো না স্বামীর পানে। লাল টুকটুকে গৌরবর্ণ মুখখানিতে লজ্জার বিশাল আচ্ছাদন পড়েছে যেন। স্ত্রীর এমন নীরবতা, সাসপেন্সে রীতিমতো অধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। ত্রস্ত পায়ে ছুটে গেল মুয়ীয। চট করে পুরুষালী শক্ত ধাবায় আঁকড়ে ধরলো স্ত্রীর দুই কাঁধ। কেঁপে উঠলো কোমল দেহের অধিকারিণী কন্যা। মুয়ীয গাঢ় চোখে তাকিয়ে। খানিকটা সময় অতিবাহিত হলো নীরবে। অতঃপর নীরবতা ভঙ্গ করে ঈষৎ ফিসফিসানি স্বরে ডেকে উঠলো সে,

” বউ! ”

বরাবরের মতই এই ডাক, এই কণ্ঠ, এই মানুষটির অবিচ্ছেদ্য মায়ায় ব’শীভূত হলো উক্তি। চোখ তুলে তাকালো অবচেতনে। মুয়ীয দূরত্ব কমিয়ে আরো কাছে এলো। নাকে ঠেকলো নাক। দু’জনের চোখেই অব্যক্ত অনুরণন। উষ্ণ শ্বাস প্রশ্বাস ছুঁয়ে যাচ্ছে উভয়কে। নে শা লো স্বরে থেমে থেমে শুধালো মানুষটি,

” ও কি… আইয়া পড়ছে? ”

জানা প্রশ্ন। কাঙ্খিত প্রশ্ন। তবুও জলকণা গড়িয়ে পড়লো মেয়েটির দুই গাল বেয়ে। মুয়ীয অধীর আগ্রহে তাকিয়ে। সে জানতে চায়। উত্তরটি জানতে চায়। জানতে চায় ‘তার’ আগমনী বার্তা। পুনরায় আকুলতার সহিত ডেকে উঠলো সে,

” ও বউ! কিছু তো ক। মোর ধৈর্য্যের আর পরীক্ষা নিস না। ও.. ও কি আইয়া… ”

কথাটি সম্পূর্ণ করার সুযোগ মিললো না। উক্তি আস্তে ধীরে পলক ঝাপটালো। একবার নয়। পরপর দু’বার। মেয়েটির অক্ষিকোল বেয়ে পুনরায় বর্ষিত হচ্ছে বারিধারা। এই পরপর দুইবার পলক ঝাপটানো। চোখে অশ্রু অথচ ঠোঁটে লজ্জালু স্রোতধারা। বুঝিয়ে দিলো সবটাই। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝিয়ে দিলো নৈঃশব্দ্য সে ভাষায়। মুয়ীয শব্দহীন হাসলো। তৃপ্তির সে এক প্রসারিত হাসি। এ কি? হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে এলো কি? হ্যাঁ। হ্যাঁ। কেননা এ যে… বাঁধভাঙা আনন্দ অশ্রু। দুই হতে তিনে নবরূপ নিতে চলেছে তাদের ‘ ভালোবাসার সংসার ‘। মুয়ীয মনে মনে লক্ষ সহস্রাধিক বার শুকরিয়া আদায় করলো রবের। সবই তো তাঁরই দান। এই ঘরসংসার, সহধর্মিণী এবং এখন আসতে চলেছে ‘সে’। উক্তি আস্তে করে পেছনে লুকিয়ে রাখা হাতটি সামনে তুলে ধরলো। হাতের মুঠোয় প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিট। মুয়ীয দেখলো। দেখলো সে-ই ক্ষুদ্র অথচ অর্থবহ দু’টো লাল চিহ্নের পাশাপাশি উপস্থিতি। অতঃপর মুয়ীয হাসানের বাহুডোরে পরম সোহাগে বন্দিনী হলো উক্তি। মুয়ীয আগলে নিলো। নিরাপদ বলয়ে সুরক্ষিত করে নিলো তার হৃদয়েশ্বরী’কে। অনাগত সন্তানের মা’কে। আবেগী অশ্রু ঝড়ে পড়তে লাগলো দুজনের গাল বেয়ে চিবুকের নিম্নতলে। অন্তরের গহীনে কে যেন মায়াচ্ছন্ন ঘোরে বলে উঠলো,

‘ হৃদয়েশ্বরী আমার,
হারিয়েছি তোমাতেই নৈঃশব্দ্য বহু প্রহরে
আজ দু হতে তিনে নবরূপ মোদের
না জানি কবে এতখানি বাঁধা পড়লাম অন্তরে অন্তরে ‘

মা হতে চলেছে উক্তি। মুয়ীয হাসানের বংশ প্রদীপ আসতে চলেছে পরিবারে। বাতাসের বেগে এ খুশির খবর ছড়িয়ে পড়লো চারিপাশে। নানা হবার সুসংবাদ শুনে কায়সার সাহেবের সে কি কান্না! আনন্দে বিহ্বল মানুষটি দুই পাক ঘুরে নেচেও নিলেন।

‘ আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে! ‘

পুত্র, পুত্রবধূ তাদের হাত ধরে ঘুরতে ঘুরতে নাচলেন। লাফালেন কিছুটা। নিশাত আশ্চর্যান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলো শ্বশুর আব্বার অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন! একদা এই মানুষটির চক্ষুশূল ছিল উক্তি। ঘৃণার পাত্রী ছিল। খু*নি ছিল তাদের নজরে। আজ সে-ই খু*নির প্রেগন্যান্সি সংবাদে এতটা উৎফুল্ল এই পিতা-পুত্র যুগল! এ যে অকল্পনীয় দৃশ্য! অভাবনীয় আবেগের প্রস্ফুটন। নিশাত হাসলো। আবেগী সে হাসিমাখা কান্না। তার বিশ্বাস ছিল। একদিন পরিবর্তন আসবেই। উক্তি তার যোগ্য সম্মান, স্নেহ, ভালোবাসা পাবে। আজ সেইদিন। হ্যাঁ, আজ সেইদিন। স্রেফ উক্তির দিন। নিশাত আলতো হেসে ভেজা গাল মুছে নিলো। মনে মনে শুকরিয়া আদায় করলো মহান রবের। সন্তানসম্ভবা যে তার স্নেহের উক্তি। মহান আল্লাহ্ মা ও অনাগত সন্তানকে সুস্থ ও সবল রাখুন।
.

নানা হওয়ার খুশিতে আত্মহারা কায়সার সাহেব কালক্ষেপণ না করে ছুটলেন বেয়াইন বাড়ি। সাথে পুত্র জাওয়াদ, পুত্রবধূ নিশাত এবং আট কেজি মিষ্টি। হরেক রকমের মজাদার মিষ্টি। সাথে অন্তঃসত্ত্বা মেয়ের জন্য আরো কত কি। মোমেনা বেগম সহ উপস্থিত প্রতিটি মানুষ হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো শুধু! কায়সার সাহেব নিজ হাতে একটি মিষ্টির প্যাকেট মোড়কমুক্ত করলেন। খাইয়ে দিলেন পরিবারের বেশকিছু সদস্যকে। উক্তি ছলছল চোখে তাকিয়ে। ওর ভেতরে চলমান তুফান বোঝার সাধ্য নেই কারোর। শুধুমাত্র ওই একটি মানুষ ব্যতীত। তার স্বামী, জীবনসঙ্গী মুয়ীয। কায়সার সাহেব উচ্ছসিত হৃদয়ে মিষ্টি খাওয়াতে খাওয়াতে এসে হাজির হলেন জামাতার ঠিক সম্মুখে। এসেই কেমন অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। কেননা তাদের মধ্যকার সম্পর্ক, বোঝাপড়া অন্যদের মতো স্বাভাবিক নয় যে। কায়সার সাহেব মিষ্টি বাড়িয়ে রয়েছেন। ভাবুক হয়ে পড়েছেন। ক্ষণিক বাদে উনি ম্লান বদনে মিষ্টি নিয়ে সরেই যাচ্ছিলেন মুয়ীযের সামনে থেকে। তবে এরপর যা হলো তা ছিল অবিশ্বাস্য! অকল্পনীয়! সকলে বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইলো! কায়সার সাহেব হতবিহ্বল! মাত্র যা হলো তা কি সত্যি ছিল? নাকি স্রেফ কল্পনা? মুয়ীয নিজে হাত ধরে ওনার হাতে থাকা মিষ্টি ওনাকেই খাইয়ে দিলো! মুয়ীয নামক প্রবল আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষটি নিজ ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে বললো,

” অভিনন্দন শ্বশুর সাহেব। নানা হইতে যাইতাছেন। আশা করতাছি এই আনন্দে কোনো ফাঁকফোকর নাই। ব্যাবাক হাছা। ”

” এসব কি বলছো বাবা? আমি সত্যিই.. ”

কায়সার সাহেবের কথা সম্পূর্ণ করতে দিলো না মুয়ীয। গম্ভীর স্বরে বললো,

” আইছেন। মোগো লগে খুশির বাটোয়ারা করছেন। খুশি হইছি। তয় এতসব যে আনছেন, হেইয়া গ্রহণ করা মোর পক্ষে সম্ভব না। সুন্দর মনে এইয়া লইয়া যাইবেন হেইলেই খুশি হমু। মিষ্টিগুলা নাহয় মহল্লায় বিলাই দিলেন। ব্যাবাকে খুশি হইয়া দোয়া দিবো। ”

কায়সার সাহেব এমন প্রস্তাবে মনে বড় কষ্ট পেলেন। এতটা খুশিমনে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি মিষ্টি নিয়ে এলেন। সেগুলো কিনা এই মহল্লায় বিতরণ করতে হবে! আর বাকি সব জিনিসপত্র…?

” ওহ হ্যালো! এই যে বোন জামাই সাহেব। এগুলো ফিরিয়ে নিতে হবে কেন? বাবা কতটা আনন্দিত হৃদয়ে এসব এনেছে। এভাবে মুখের ওপর ফিরিয়ে দেয়া অভদ্রতার পরিচয় কিন্তু। ”

মুখ খুললো এবার জাওয়াদ। বাবার ম্লান মুখশ্রী তার কাম্য নয়। মুয়ীয ত্যাছড়া হেসে বললো,

” সমন্ধি সাহেব! মোর বউ পোয়াতি। হ্যার এই সময়ে কি দরকার না দরকার হেইয়া কেনার মতো অল্পস্বল্প সামর্থ্য মোরে দিছে আল্লাহ্। এক্কারে ফকিন্নি নাই আর। আর এতডা ছোডোলোক-ও না যে বউয়ের বাপের বাড়ি থে হাত পাততে হইবো। এইয়া সেইডা দুই হাত ভইরা নিতে হইবো। গরীব হইতে পারি মুই। তয় ভিখারি নই। ”

মুয়ীযের শেষের কথাগুলোতে উপস্থিত ছিল স্পষ্ট গাম্ভীর্যতা। সে গাম্ভীর্যতায় উপস্থিত কিছু লো’ভী মন দমে যেতে বাধ্য হলো। চুপ হয়ে গেল জাওয়াদ। সে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। তবে হাতের ইশারায় থামতে বললেন কায়সার সাহেব। যার জন্য জাওয়াদ অনিচ্ছুক মনে চুপ করে গেল। মোমেনা বেগম আন্তরিক কণ্ঠে বেয়াইকে বললেন,

” বেয়াই সাব। ক্ষমা করবেন মোগো। এইয়া নেয়া… সম্ভব না। দয়া কইরা কিছু মনে কইরেন না। ”

কায়সার সাহেব করুণ হেসে বললেন,

” ইটস্ ওকে আপা। চাপ নেবেন না। আমরা এগুলো ফিরিয়ে নিয়ে যাবো। ”

মুয়ীয স্ত্রীর দিকে একপলক তাকিয়ে মোবাইল হাতে অলস ভঙ্গিতে সেথা হতে প্রস্থান করলো। কায়সার সাহেব বিদায় বেলায় মেয়ের সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। উক্তি নত করে নিলো অশ্রুসজল চোখ দু’টো। মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিলেন উনি। মমতা ভরা কণ্ঠে বললেন,

” নিজের ও বাবুর খেয়াল রাখিস মা। আল্লাহ্’র রহমতে ভালো থাকিস। আসছি তাহলে। আল্লাহ্ হাফিজ। ”

উক্তি কিছু বলতে চাইলো যেন। হাত দুখানা স্বল্প কেঁপেও উঠলো। তবে বলা হলো না কিছুই। অভিমানী মনটা একরাশ অভিযোগ নিয়ে চুপটি করে রইলো। কান্নায় অবরুদ্ধ কণ্ঠস্বর। সকলের থেকে বিদায় নিয়ে সেথা হতে বেরিয়ে গেলেন কায়সার সাহেব, জাওয়াদ এবং নিশাত। উক্তি ঝাপসা দৃষ্টিতে তাদের গমন পথে তাকিয়ে। বাবা কি খুব বেশিই কষ্ট পেল? যাওয়ার সময় পিছু ঘুরে তাকালো না যে। সে কি পূর্বের মতো আবারো ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেবে! ওকে দূর ছাই করবে? খারাপ মেয়ে ভাববে? অপয়া, অলক্ষ্মী! অকস্মাৎ উক্তির ঠোঁট অদৃশ্যের মতো হালকা হেসে উঠলো। কেননা ওই তো… ওই তো পিছু ঘুরে তাকিয়েছে বাবা। হাত নেড়ে হাসিমুখে ওকে বিদায় জানাচ্ছে। সাবধানে ভেতরে যেতে বলছে। নাহ্। বাবা আর পরিবর্তিত হবেন না। এটাই বাবার ভালোবাসা। ওর আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন। পৃথিবীর সমস্ত সুখ যেন একত্রে এসে ধরা দিয়েছে উক্তি’র দুয়ারে। এতটা সুখে বুজে আসছে চক্ষুদ্বয়। পুলকিত তনু মন।

সময়ের চাকা ঘূর্ণায়মান। চলতে চলতে পেরিয়েছে কতগুলো দিন, মাস। করিডোরের দেয়াল ঘেঁষে স্টেইনলেস স্টিলের চেয়ারে বসে মানুষটি। উত্তেজনা, ভয়, আশঙ্কার সংমিশ্রনে কম্পিত অন্তঃস্থল। দুই হাতের বদ্ধ মুষ্টিতে ঠেকানো থুতনি। টলমলে অবনত আঁখি যুগল। পাশে বসে বন্ধু চয়ন। ভরসার হাতটি রাখলো ওর হাতে। বোঝালো ধৈর্য ধর বন্ধু। ভয় না পেয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ মহান রবকে স্মরণ কর। মুয়ীয ধীরে ধীরে বন্ধুর দিকে তাকালো। চয়ন চোখের ভাষায় আশ্বাস দিলে সেথা হতে দৃষ্টি সরিয়ে তাকালো অপারেশন থিয়েটারের বদ্ধ দরজায়। কিছু না বলে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো মুয়ীয। এলোমেলো পায়ে হাঁটা আরম্ভ করলো হাসপাতালের নামাজ ঘরের দিকে। উদ্দেশ্য দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে স্রষ্টার কাছে আকুল আবেদন জানানো। সাহায্য ভিক্ষা করা।

পেরিয়ে গেল আরো কিছু সময়। অপারেশন থিয়েটারের বাইরে পিনপতন নীরবতা। দমবন্ধ অবস্থায় যেন দাঁড়িয়ে উপস্থিত মানুষগুলো। সকলেই অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে। অবশেষে। অবশেষে সকলের অপেক্ষার অবসান ঘটলো একই সঙ্গে। এক শিশু কণ্ঠে চেঁচিয়ে কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো শ্রবণ পথে। সে কান্নায় প্রফুল্লিত হলো সকলে। হেসে উঠলো তারা। কান্নাভেজা হাসি কারোর কারোর ঠোঁটে উদিত হলো। মুয়ীয ত্রস্ত পায়ে ছুটে গেল অপারেশন থিয়েটারের বন্ধ দরজার দিকে। অপেক্ষা আর অপেক্ষা। মনেতে সয় না যে এই অপেক্ষা। অতঃপর বদ্ধ দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। হাসিমুখে জানালেন সুসংবাদ। ধন্য হলো মানুষগুলোর কান।

” কনগ্রাচুলেশন মিস্টার হাসান। পুত্র সন্তানের বাবা হয়েছেন আপনি। ”

মুয়ীয আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লো। দু হাতের তালুতে লুকিয়ে ফেললো নাকমুখ। অশ্রু ফোঁটা ঝড়ে পড়লো নীরবে নিভৃতে।

‘ আলহামদুলিল্লাহ্ আলহামদুলিল্লাহ্। ‘

বিড়বিড় করে চোখের পানি মুছে ফেললো মানুষটি‌। সোজা হয়ে দাঁড়ালো। উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

” মোর বউ? ও ভালো আছে তো? কোনো অসুবিধা? ”

” ডোন্ট ওয়্যারি। মা ও সন্তান উভয়ে ভালো আছে। কিছুক্ষণ পর তাদের কেবিনে শিফট করা হবে। ”

মোমেনা বেগম কান্নাজড়িত হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন,

” ডাক্তার সাব! মোর নাতি কই? হ্যারে দেখুম কখন? এই দুই হাতে কোলে নিমু না? ”

ডাক্তার হেসে বললেন,

” খালাম্মা একটুখানি ধৈর্য ধরতে হবে। বেবির কিছু এসেনশিয়াল চেকআপ শেষেই আপনাদের কোলে দেয়া হবে। ততক্ষণে না হয় মিষ্টি আনুন। মিষ্টি মুখ করেন সবাই। নাতি চলে এসেছে যে। ”

মোমেনা বেগম হাসিমুখে মাথা নাড়লেন। কায়সার সাহেব তৎক্ষণাৎ ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে ছেলেকে ডেকে উঠলেন,

” কই রে জাওয়াদ? যা বাবা। এখুনি গিয়ে মিষ্টি নিয়ে আয়। পুরো হসপিটালের সবাইকে মিষ্টিমুখ করাবো আমি। নানা হয়েছি যে। নানা। আলহামদুলিল্লাহ্! ”

একযোগে হেসে উঠলো সবাই। আলহামদুলিল্লাহি আ’লা কুল্লি হাল।

.

কেবিনের অভ্যন্তরে লেগেছে খুশির মেলা। শুভ্র রঙা বিছানায় শুয়ে সদ্য মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করা মিসেস উক্তি কায়সার। ওড়নায় মোড়ানো দেহের উর্ধাংশ, মাথা। মেয়েটা ভেজা চোখে তাকিয়ে। মুয়ীয সযতনে নবজাতক শিশুকে শুইয়ে দিলো তার প্রকৃত স্থানে। মায়ের সান্নিধ্যে। বাহুডোরে শায়িত পুত্রকে প্রথমবারের মতো পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখলো উক্তি। লাল টুকটুকে ধবধবে ফর্সা একটা পুতুল যেন ঘুমিয়ে তার পাশে। ছোট আকারের হাত দু’টো প্রায় মুষ্টিবদ্ধ হয়ে রয়েছে। মাথায় ছোট ছোট পাতলা চুল। ঠোঁট দুইটা একদম লাল বর্ণের। যেন লিপস্টিক পড়িয়ে দিয়েছে কেউ। উক্তি কান্নার মাঝে হেসে উঠলো। তোয়ালে মোড়ানো জীবন্ত পুতুলটিকে আলতো করে বুকে জড়িয়ে নিলো। মায়ের ওম পেয়ে দেহের সঙ্গে আরো মিশে গেল বাচ্চাটা। উক্তি প্রথমবারের মতো ছুঁলো নিজ অস্তিত্বকে। বাচ্চার কপালে চুমু এঁকে দিলো বড় আদর করে। ছেলেকে প্রথমবার স্নেহের পরশ দিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লো উক্তি। এ লক্ষ্য করে মোমেনা বেগম, ময়না, নিশাত-ও আবেগী হয়ে পড়েছে। জীবন ঠিক সে মুহূর্তে বলে উঠলো,

” বাবু খালি ঘুমায় ক্যান? ওঠবে কহন? ”

সহসা কেবিনে হাসির রোল পড়ে গেল একপ্রকার। মারুফ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

” ও তো ছোট বাচ্চা। হেই লেইগা খালি ঘুমায়। একটু বড় হইলে আর এত ঘুমাইবো না। ”

” তাইলে কি করবে? ” অবুঝ প্রশ্ন জীবনের।

ময়না হেসে বললো,

” তোমার লগে দৌড়ঝাঁপ খ্যালবে। ”

জবাবে সন্তুষ্ট হলো জীবন। বেশ ভালোই তো। তার একটা নতুন সঙ্গী এসেছে। কবে যে বড় হবে বাবুটা আর খেলবে? ইশ্। জীবন বিড়বিড় করে বলে ফেললো,

” তাড়াতাড়ি বড় হও বাবু। ”

কিছুটা সময় কেবিনে কাটিয়ে হাসিঠাট্টার অন্ত ঘটিয়ে দুই পরিবারের সদস্যরা সেখান থেকে প্রস্থান করলো। পুরো কেবিনে এখন শুধুমাত্র তিনটে জীব। মুয়ীয, উক্তি এবং তাদের ঘুমন্ত অংশ। মুয়ীয ও উক্তি একে অপরের দিকে তাকিয়ে। গভীর সে দৃষ্টি বিনিময়। ধীরপায়ে মুয়ীয বেডের কাছে এলো। উক্তি তাকিয়ে বেদনাবিধুর হাসলো। প্রসবের ধকল এখনো পোড়াচ্ছে যে শরীর। মুয়ীয স্ত্রীর পানে ঝুঁকে গেল। ধুকপুক করে চলেছে হৃৎপিণ্ড। আবেশে পিটপিট করছে উক্তির চোখ দু’টো। মুয়ীয আলতো চুম্বন ছুঁয়ে দিলো সন্তানের মাথায়। উক্তি হৃদয়কাড়া হাসি উপহার দিলো। মুয়ীয-ও মুচকি হেসে স্ত্রীর কপালে অধর ছুঁয়ে রাখলো অনেকটা সময় ধরে। সেভাবেই ফিসফিসিয়ে বললো,

” জাঝাকিল্লাহু খইরন মাই লাভ। ”

উক্তি’র অক্ষিকোল ঘেঁষে অশ্রু গড়িয়ে পড়লে আদরে সোহাগে তা শুষে নিতে লাগলো মুয়ীয। এই লগ্ন, এই নীরবতা, এই প্রণয়াকাঙ্ক্ষা শুধুই তাদের…! নীরবতা বিচ্ছিন্ন করে শোনা গেল যেন এক পুরুষালী লহু কন্ঠস্বর,

” আমাগো মেহরাব। ”

•••

চলবে।