তোমার নিমন্ত্রণে পর্ব-১০

0
125

#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ১০)
নুসরাত জাহান লিজা

বিয়েতে মত দেবার পর থেকেই দীপ্ত ভীষণ অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ওদিকে মোহসীন সাহেবের শরীরটাও দূর্বল। দীপ্ত তার খুব খেয়াল রাখছে। শ্রেয়সীর সাথে ওর আর কথা হয়নি। মনে হয়েছে শ্রেয়সী পর্যন্ত এই কথাগুলো গেলে বাবার কানে আসবে। সে চায় না তার এই শারীরিক কন্ডিশনে তাকে উত্তেজিত করতে।

দীপ্তর মনে হলো কোনো একজনের সাথে অন্তত বিষয়টা শেয়ার করা উচিত। নইলে সে হালকা হতে পারবে না। সে শিমুলকে কল দিতেই বলল, “অফিস শেষ করে আমার বাসায় আয়।”

দীপ্ত এখন বসে আছে শিমুলের ড্রইংরুমে। ওর স্ত্রী শান্তা ওদের চা দিয়ে বাইরে গেছে। কাজিনদের সাথে শপিংয়ে যাবে বলে।

“আঙ্কেল কেমন আছেন এখন?”

“আজ বেশ ভালো। পরশু থেকে যা অবস্থা, আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম।”

শিমুল জানে ওর বন্ধুটি বাবা অন্তঃপ্রাণ। আরও কিছু স্বাভাবিক কথা বলার পরে দীপ্ত ওর সমস্যাটা খুলে বলল।

শিমুল খানিকটা ক্ষোভ নিয়ে বলল, “তোর কাছ থেকে এমন গাধামি এক্সপেক্ট করি নাই।”

দীপ্ত আগে হলে প্রতিবাদে ফুঁসে উঠত, সে নিজের ভুল মানতে পারে না। কিন্তু আজ সে চুপ করে রইল।

“শোন, বিয়ে তো করেই ফেলবি। এখন কিছু জানানোর দরকার নেই মেয়েটাকে।”

দীপ্ত বলল, “বিয়েটাই তো সমস্যা। ওকে আমি বন্ধু ভাবি। এরবেশি কিছু ভাবিনি।”

শিমুল খানিকটা গম্ভীর হয়ে বলল, “শোন দীপ্ত, তোদের এ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হবে। অসংখ্য বিয়ে হচ্ছে যারা বিয়ের আগে কেউ কাউকে চেনেও না। বিয়ের পরে ধীরে ধীরে ওদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং গ্রো করে। একজন আরেকজনকে চেনে, জানে। সম্পর্ক একসময় গভীর হয়, এরকম বহু উদাহরণ আছে। তোদের সম্পর্কটাও তো তেমনই। তুই মেয়েদের থেকে দূরত্ব রেখে চলতি, কেন সেটা আমি জানি। শ্রেয়সীকে যেভাবেই হোক, তোর বন্ধু মনে হয়েছে। দাম্পত্যে পরস্পরের বন্ধু হওয়াটাও কিন্তু খুব জরুরি। এখন তুই কী করেছিস, সেটা ভুলে যা না। একেবারে নতুন করে শুরু কর সম্পর্কটা।”

শিমুলের কথাগুলো দীপ্ত ভাবল কিছুক্ষণ, এরপর ধীর গলায় বলল, “কিন্তু ও আমার ইনটেনশন কখনো জানলে সেটার প্রভাব সম্পর্কে পড়বে। তখন…”

“তুই এটা তোর মন থেকে মুছে ফেল। আর যদি বলতে চাস, যখন তোদের মধ্যে কেমিস্ট্রি তৈরি হবে, তখন একসময় শেয়ার করতে পারিস। তখন ও কিছু মনে করবে না আশা করি। বেস্ট অফ লাক, দোস্ত। ধুমাইয়ে তোর বিয়ে খাব এখন।”

দীপ্ত বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবল আপাতত এটাই থাকুক, সে নাহয় নতুন করে শুরু করবে। তবুও একটা দ্বিধা ওর মধ্যে থেকেই গেল।

***
শ্রেয়সী ভেবেছিল ওর সম্মতি জানার পরে দীপ্ত ওকে কল করবে। কিন্তু এই দুদিনে কোনো কল আসেনি। ওর অভিমান হলো কিছুটা। অন্য সময় তো প্রতিদিন নক করে ওকে, আর এতবড় একটা খুশির দিনে সে নির্বিকার কী করে! নিজে দিতে চেয়েও দিতে পারেনি। আজ বাবার কাছ থেকে শুনল মোহসীন সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ওর অভিমান সরে গিয়ে একটা অপরাধবোধ জন্ম নিল।

মানুষটা বাবার অসুস্থতা নিয়ে কতটা টেনশনে আছে, এরমধ্যে সে কিনা এসব ভেবেছে৷ সে সাথে সাথে দীপ্তর নম্বর ডায়াল করল। দ্বিতীয় বারে রিসিভ করল দীপ্ত।

“দীপ্ত, আঙ্কেল কেমন আছেন এখন?”

“এখন ভালো, আলহামদুলিল্লাহ।”

“তুমি কেমন আছ?” শ্রেয়সী সম্বোধন পাল্টে তুমি বলল। দীপ্ত এমনিতে আপনি বলত, কিন্তু ওর জন্মদিনের পরে এই সম্বোধনে নেমে এসেছে।

“ভালো। তুমি?”

“ভালো। স্যরি।”

দীপ্ত খানিকটা অবাক হয়ে বলল, “স্যরি কেন?”

“আঙ্কেলের অসুস্থতার কথাটা আমি জানতাম না। আজ শুনলাম। তুমি কল করোনি, আমার বোঝা উচিত ছিল কোনো সমস্যায় আছ।”

দীপ্ত ইতস্তত করে বলল, “এটা হতেই পারে। সমস্যা নেই। বাবা ভালো আছে এখন।”

“আমি কি আঙ্কেলের সাথে কথা বলতে পারি?”

দীপ্ত গিয়ে ফোনটা বাবাকে দিল, “মা, কেমন আছ?”

“ভালো। আঙ্কেল, আপনার শরীর এখন কেমন?”

“এখন হান্ড্রেড পার্সেন্ট ফিট আছি আলহামদুলিল্লাহ। তোমাকে ঘরে আনার জন্য আমাকে তো সুস্থ হতেই হবে মা।”

শ্রেয়সী লজ্জা পেল, মোহসীন সাহেব বললেন, “আমি কালই তোমাদের বাড়িতে যাব।”

শ্রেয়সী লাজুক হেসে শুধু বলল, “দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন আঙ্কেল।”

***
ওদের বিয়ের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হলো দুই সপ্তাহ পরে। বিয়েটা ঢাকায় হবে। দীপ্ত বাড়ি যেতে চায় না তিক্ত অভিজ্ঞতা ওকে হানা দিয়ে যায়। মোহসীন সাহেব শ্রেয়সীর বাবা শাফকাত সাহেবকে নিজের সমস্যার কথা জানান খুলে। এসব বিষয় তিনি লুকিয়ে রাখতে চান না। নতুন আত্মীয়তায় তিনি শতভাগ স্বচ্ছ থাকতে চান। শাফকাত সাহেব কিছুটা আগেই জেনেছিলেন অবশ্য। তিনি তাই আপত্তি করলেন না। ঢাকায় তাদের অনেক কাছের আত্মীয়স্বজন থাকে। তাই বাড়ি থেকে যারা আসবে থাকার জন্য তাদের থাকার সমস্যা হবে না। বেশিরভাগই সেদিনই এসে আবার ফিরে যাবে। নিজের একমাত্র মেয়ের বিয়ে তিনি বিশাল আয়োজন করে ঢাকঢোল পিটিয়েই দিতে চান।

কেনাকাটা চলছে পুরোদমে। বিয়ের জন্য এক সপ্তাহের ছুটি মিলেছে শ্রেয়সী, দীপ্ত দুজনেরই। দীপ্তর ইচ্ছে না থাকলেও ওকে শ্রেয়সীর বাবার কথায় আসতে হলো। পাঞ্জাবির মাপ, পায়ের মাপ, আরও কীসব দেখা হলো। ওকে সাইজ জিজ্ঞেস করলেই হতো। কিন্তু তা না করে দৌড়াদৌড়িতে কিঞ্চিৎ বিরক্তই ছিল দীপ্ত। সেদিনই শ্রেয়সীর বিয়ের শাড়ি কেনা হলো। খেয়াল করল মেয়েটা পোশাকের ক্ষেত্রে ওর মতোই খুঁতখুঁতে। টুকটুকে লাল একটা বেনারসি কেনা হলো। আরও কীসব কেনাকাটা চলল। দীপ্তর প্রতিনিধি হিসেবে শিমুল আর শান্তা।

মেয়েদের শপিং করার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা সে পূর্বে বন্ধুদের মুখে শুনেছে, আজ নিজের অভিজ্ঞতা হলো। শ্রেয়সী যদি বিয়ের পরে ওকে নিয়ে শপিংমলে আসার বায়না করে তাহলে সর্বনাশ। শঙ্কিত হলো দীপ্ত।

লিস্ট ধরে ধরে কেনাকাটা হলো। শ্রেয়সীর সাথে ওর দুই কাজিন আর সোমা এসেছে।

শান্তা বললো, “আপাতত এই। পরে মনে পড়লে আবার আসা যাবে।”

সবাই মিলে রেস্টুরেন্টে খেয়ে বাসায় ফিরল।

***
বিয়ের দিন যত ঘনিয়ে আসছে তত দীপ্তর অস্থিরতা বাড়ছে৷ বাবা অবশ্য খুব খুশি আছেন৷ এটা দেখে ওর ভালো লাগছে। তার জন্যই তো সব দিনশেষে।

ওদিকে শ্রেয়সীর দিনগুলো যাচ্ছে ঘোরের মধ্যে। নতুন জীবন, নতুন স্বপ্ন। মা খুব ব্যস্ত সময় পার করছেন৷ অবশেষে মেয়ে বিয়ে করছে। তার কি ব্যস্ততার শেষ আছে। আত্মীয়স্বজন কে কোথায় থাকবে সব তিনি দেখছেন। শাফকাত সাহেব আর মোহসীন সাহেব শ্রেয়সীর মামাকে নিয়ে বিয়ের ভেন্যু ঠিক করলেন।

শ্রেয়সীর কাজিনরা বায়না জুড়ল গায়ে হলুদের। সেদিন শ্রেয়সীর দুই হাত রেঙে উঠল মেহেদী রঙে। ওর মনেও যেন সে রঙ ছড়িয়ে পড়ল।

অবশেষে বিয়ের ক্ষণ এলো। কাবিন নামায় সই করার আগে ভেতরে সে অচেনা এক উত্তেজনা টের পাচ্ছিল। কেমন একটা ভীতি মিশ্রিত আনন্দ। বাবার চোখের নিঃশব্দ জলটুকু ওর দৃষ্টিগোচর হলো। কেন জানে না, ওরও কান্না পেয়ে গেল ভীষণ। অবশেষে সে সই করতে পারল। কবুল বলার আগে গলায় যেন কথা জড়িয়ে গেল। একটা আচ্ছন্নতার মধ্যেই যেন সব ঘটে গেল। শ্রেয়সীর মনে হলো আজ থেকে ওর জীবন কিছুটা হলেও বদলে গেল।

দীপ্তর অনুভূতি ভিন্ন, খুব একটা উচ্ছ্বাস নেই ওর মধ্যে। খানিকটা যেন মিইয়ে গেছে সে। তবে ইতস্ততা করেনি। বাবার মুখটা মনে করে সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা সে হাসিমুখে সম্পন্ন করেছে। এমনকি শ্রেয়সীর কাজিন আর ফ্রেন্ডরা দুষ্টুমি করে ওর জুতো চুরি করলে ওর বন্ধুদের সাথে সে-ও রসিকতা করেছে। বিদায় বেলায় শ্রেয়সী আর দীপ্তর হাত এক করে দিয়ে শাফকাত সাহেব যখন বললেন,

“আমার মেয়েটা আমার সমস্ত পৃথিবী। ওকে ভালো রেখো।”

দীপ্ত তখন চোখ তুলে একবার শ্রেয়সীকে দেখল। সেদিন কেনা সেই টুকটুকে শাড়িটা যেন শ্রেয়সীতে পূর্ণতা পেয়েছে। কান্নায় চোখের কাজল কিছুটা ছড়িয়ে গেছে, তবুও কেমন মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে মুখটা।

মুহূর্তের ঘোর দীপ্ত কাটিয়ে উঠে বলল,
“দোয়া করবেন, আঙ্কেল।”
শ্রেয়সীর মা কাঁদছেন মেয়েকে বুকে জড়িয়ে।

গাড়িতে দীপ্তর পাশে বসে আছে শ্রেয়সী। ওর হাত তখনো ধরে রেখেছে দীপ্ত, ওর মনে অনেক দ্বিধা, সংকোচ, শঙ্কা সত্ত্বেও।
……….
(ক্রমশ)