তোমার নিমন্ত্রণে পর্ব-১১

0
115

#তোমার_নিমন্ত্রণে (,পর্ব ১১)
নুসরাত জাহান লিজা

দীপ্ত এখনো একটা ঘোরের মধ্যে আছে, বিয়ে করে ফেলেছে এই ব্যাপারটার সাথে ধাতস্থ হতে পারছে না। শ্রেয়সী বসার ঘরে ওর পাশেই বসে আছে। বিষয়টা ভাবতেই গলা বারবার শুকিয়ে যাচ্ছে দীপ্তর। আজ প্রয়োজনের তুলনায় পানিটা বেশি খেয়ে ফেলেছে। ক্যামেরাম্যান এখনো ছবি তুলেই যাচ্ছে। ওই বাড়িতে শ্রেয়সীর পাশে দাঁড়িয়ে নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলতে হয়েছে। ব্যাটা ওকে বলছিল,
“ভাইয়া, মিষ্টি করে হাসুন। ”
আরেকটু ক্লোজ হোন”
“আরেকটু রোমান্টিক এক্সপ্রেশন দিন তো।”

দীপ্তর একবার মনে হয়েছিল কষে একটা ধমক দিতে, এমন ভাব মনে হচ্ছে কোনো মিউজিক ভিডিওর ডিরেক্টর সে। ভেতরে ভেতরে টেনশন ধরে রেখে হাসা যায় নাকি। তার মধ্যে ভারি একটা শেরওয়ানী, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কনভেনশন সেন্টারেও সে প্রচণ্ড ঘামছিল। ওর মনে হচ্ছিল জীবন থেকে নিজেকেই যেন হারিয়ে ফেলছে। ওর জীবনে জ্বলজ্যান্ত একজন মানুষ এসে ভাগ বসাচ্ছে।

তারমধ্যে রয়েছে খাবারের উৎপাত। এত খাবার ওর সামনে রাখা হয়েছিল, মনে হচ্ছিল পুরো এক মাসের খাবার ওকে একবারে গেলাবে। করুণ চোখে সে শিমুল আর আরমান ভাইয়ের দিকে তাকিয়েছিল। শ্রেয়সীর কাজিনগুলো একেকজন ‘মহা বিটলা’। ওরা ছাড়ছিলই না। শুনেছে শ্বশুর বাড়ি গেলেই নাকি এমন খাবারের পীড়ন সহ্য করতে হয়। আজকের মতো সবসময় হলে তো সর্বনাশ। দীপ্ত ঠিক করল খুব কম যাবে সেখানে। নইলে খেয়ে খেয়েই কয়দিন পর থলথলে ভুড়ির মালিক হয়ে যাবে। দীপ্ত খেতে অবশ্যই পছন্দ করে, কিন্তু এটা রীতিমতো অত্যাচার বলে মনে হলো ওর। বদহজম না হলে হয়!

বাসায় এসেও শান্তি নেই, এখন দুজনকে বসিয়ে রাখা হয়েছে এখানে। মোহসীন সাহেবের বড় ভাই মনিরুজ্জামান এসেছেন সস্ত্রীক, তাদের মেয়ে এসেছে জামাই নিয়ে। ছেলে দেখের বাইরে থাকে। ওর ফুপুও এসেছেন। তারা এখন কী কী ঘর-সংসার নিয়ে আলাপ করছে শ্রেয়সীর সাথে। সংসার বিষয়ক উপদেশ দিচ্ছে।

দীপ্ত শ্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে দেখল, মেয়েটার মুখে ক্লান্তির ছাপ। সে আরও ভারি পোশাক আর জুয়েলারি পরে আছে।

এতক্ষণে দীপ্তর মনে হলো শ্রেয়সীও নিশ্চয়ই ক্লান্ত। সে হাতের পানির বোতল বাড়িয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “পানি খাও একটু। ভালো লাগবে।”

শ্রেয়সী হাত বাড়িয়ে নিল বোতলটা, মিষ্টি করে হাসল কৃতজ্ঞতার হাসি। সে জানে না শ্রেয়সীর হাসিতে কৃতজ্ঞতার পাশাপাশি আরও কিছু ছিল৷ এমন লোক সমাগমের মধ্যেও ওর অসুবিধা সে বুঝতে পেরেছে বলে শ্রেয়সীর মনে কীসের যেন মৃদু কম্পন হলো, সুখের বোধহয়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মোহসীন সাহেব এসে বললেন, “তোমরা তো মেয়েটাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছ এসব বলে।” এরপর তিনি শ্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “মা, তুমি এসব একদম মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও। আমি টিপিক্যাল শ্বশুর নই বুঝলে? আর আমার পুত্রটিও টিপিক্যাল হাজব্যান্ড হবে না। এটা আজ থেকে তোমারও বাড়ি। তোমার নিজের সংসার। তুমি যেভাবে চালাবে সেভাবেই চলবে। আমরা তো আছিই।”

এই মানুষটাকে শ্রেয়সীর ভীষণ ভালো লেগেছে। অদ্ভুত প্রাণখোলা মানুষ। শান্তা ততক্ষণে ছুটে এসে বলল, “আঙ্কেল, আমি শ্রেয়সীকে রুমে নিয়ে যাচ্ছি এখন।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ। সবাই খুব ক্লান্ত এখন। অনেক পরিশ্রম হয়েছে সবার। সকালে আবার আসর বসানো যাবে।”

শ্রেয়সীকে নিয়ে শান্তা এলো দীপ্তর ঘরে। চমৎকার করে সাজানো হয়েছে। অনেকরকম ফুলের সুঘ্রাণ মৌ মৌ করছে ঘরটায়। ফুল সজ্জিত বিছানায় ওকে বসিয়ে দিয়ে শান্তা বলল, “কেমন লাগছে? এভাবে সাজানোর আইডিয়াটা আমার।”

“চমৎকার হয়েছে আপু।” মৃদু হেসে বলল শ্রেয়সী। শিমুলকে ভাইয়া বলে সেজন্য শান্তাকে সে ভাবি বলেছিল প্রথম যেদিন পরিচিত হয়েছিল সেদিন। কিন্তু শান্তা বলেছে,

“আমার বোন নেই। দুটো হাড়ে বজ্জাত বড় ভাই আছে। যারা জ্যামিতি বক্স নিয়ে আমার চলাফেরা মেপেছে। যদিও আমাকে খুব ভালোবাসে। তবুও বোনের খুব শখ ছিল। আপুই বলো, আমার ভালো লাগবে।”

শান্তার আন্তরিকতা ওর ভালো লেগেছে খুব। এখন খানিকটা ইতস্তত করে বলল, “আপু, এই ভারি শাড়িটা চেঞ্জ করি এখন?”

শান্তা হেসে ফেলল, “জানি কষ্ট হচ্ছে। তবে এখনই চেঞ্জ করো না। দীপ্ত আগে দেখুক তার বউকে এই সাজে কতটা মানিয়েছে!”

শ্রেয়সী বলল, “ও তো দেখেছে।”

শান্তা দুষ্টু হেসে বলল, “দুনিয়া সুদ্ধ মানুষের মধ্যে দেখা, আর একান্তে দেখা এক নয় বোকা মেয়ে। পরে চাইলে কখনো এভাবে আবার সাজতেই পারবে। কিন্তু আজকের এই মুহূর্তটা, এই অনুভূতিটা কি আর কোনোদিন ফিরে আসবে? ফিল দ্যা মোমেন্ট। বেস্ট অফ লাক শ্রেয়সী।”

শ্রেয়সীর কান গরম হয়ে গেল লজ্জায়। শান্তা হেসে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

এই কয়দিনে দীপ্তর সাথে ওর দেখা হয়েছে কেনাকাটার সময়, তাছাড়া আরও দুইবার দেখা করেছে। কথা হয়েছে প্রতিদিনই। তাও শান্তার কথায় কেমন লাজুকপাতা বনে গেল শ্রেয়সী।

***
সবাই যারযার নির্ধারিত জায়গায় চলে গেলে দীপ্তকে মোহসীন সাহেব বললেন, একটু আমার ঘরে আয় দীপ্ত কথা আছে।”

দীপ্ত এসেছে বাবার ঘরে। কিছুক্ষণ আগে শোভা কল করেছিল, দীপ্তর মা। তার ছেলের বিয়েতে তাকে জানানো হয়নি বলে কথা শোনালেন, আসতে চাইছিলেন, কিন্তু মোহসীন সাহেব বলেছেন, “আজ নয় প্লিজ। ওর মাথায় বিয়ে অশান্তি ছাড়া কিছু নয়, এই ধারণা আবার আসুক তা চাই না। তুমি নিশ্চয়ই ওর খারাপ চাইবে না?”

তবুও তিনি বেশ হম্বিতম্বি করলেন, মোহসীন সাহেব আজ শান্ত থাকলেন। জানেন উনি প্রতিক্রিয়া দেখালে শোভা নিজের জেদ চরিতার্থ করার জন্য এখানে এসে উপস্থিত হতে পারেন দীপ্তকে দেখতে। তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

“দীপ্ত, তুই আমাকে সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলি না আমি সংসার করতে পারলাম না কেন?”

“বাবা, আমি ওভাবে…”

ওকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, “স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মিউচুয়াল রেসপেক্টের পাশাপাশি প্রয়োজন হয় বোঝাপড়া। তার জন্য সবচাইতে বেশি জরুরি বন্ধুত্ব হওয়াটা। তোর মায়ের সাথে আমার কখনো বোঝাপড়াই তৈরি হয়নি। ও আমাকে বোঝেনি, আমিও ওকে বুঝতে পারিনি। সেজন্যই হয়তো…..

খানিকটা থেমে তিনি বললেন, “শ্রেয়সীকে তোর বন্ধু হিসেবে ভালো লাগে বলেছিস৷ মেয়েটা ভালো তাও বলেছিস। অন্য অনেক কিছুর সাথে সাথে বিয়েটা একটা প্রতিশ্রুতিও। সেটা নষ্ট করিস না। আজ আমি খুব খুশি।”

এবার দীপ্তর দিকে এগিয়ে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি বললেন, “তোরা সুখী হ। পৃথিবীর সমস্ত সুখ এই ঘরে আলো হয়ে আসুক।”

মনে মনে বললেন, “আমি যা পারিনি, আমার ছেলেটাকে তা তুমি দিও আল্লাহ।”

***
বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে শিমুলের সাথে দেখা হলো, “অল সেট। ঘরে যা।”

দীপ্ত বন্ধুর দিকে খানিকটা বিরক্তি নিয়ে তাকাতেই সে বলল, “দীপ্ত, একটা নতুন জীবনের শুরু এটা। মেয়েটা বড্ড ভালো। আজ রাত নিয়ে ওর মনে নিশ্চয়ই কিছু স্বপ্ন আছে। সেই অনুভূতিকে অসম্মান করিস না।”

দীপ্ত উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু শিমুল আর সুযোগ দিল না, “শান্তা অপেক্ষা করছে। অনেক রাত হয়ে গেছে। এবার বাসায় ফিরতেই হবে।”

“সকালের নাস্তা এখানে করবি কিন্তু। শান্তাকে নিয়ে আসবি।”

***
দীপ্ত দুরুদুরু বুকে ভেতরে ঢুকল। শ্রেয়সীর হাতে মোবাইল। ওর আসার শব্দে মুঠোফোন থেকে চোখ সরিয়ে তাকালো।

দীপ্ত হাসার চেষ্টা করে বলল, “সারাদিন যা ধকল গেল, হাঁপিয়ে গেছি একেবারে। তুমিও নিশ্চয়ই..”

শ্রেয়সী হেসে বলল, “ক্লান্তি তো আছেই। তবুও খুব একটা গায়ে লাগছে না সেটা। কিছু কিছু আনন্দের কাছে অনেককিছুই ম্লান হয়ে যায়।”

দীপ্ত খানিকটা থমকে গেল, শ্রেয়সীর কথায় সচকিত হলো, “তোমার বারান্দা আর এই ঘরটা ঘুরে দেখলাম। সবসময়ই এমন পরিপাটি রাখো, নাকি বিয়ের জন্য?”

“মানে কী? আমি মোটেও অলস আর অগোছালো নই।”

শ্রেয়সী হেসে ফেলল, “আজও ঝগড়া করবে?”

দীপ্তও হেসে ফেলল নিজের ছেলেমানুষিতে, বলল, “শুনুন ম্যাডাম, আমি প্রতিদিন ঘর গুছিয়ে রাখি।”

শ্রেয়সীর মুখে হাসি লেগেই আছে, সে বলল, “আমি অবশ্য এত গুছিয়ে টুছিয়ে রাখতে পারি না। আবার নোংরা দেখতেও ভালো লাগে না। যেটুকু না করলে না হয় সেটুকু।”

দীপ্ত বলল, “ঘরটা কেমন লাগল?”

“আজ প্রথম এই ঘরে এলাম। তবুও কেমন আপন আপন মনে হচ্ছে, এই ঘর, বারান্দা, আঙ্কেল আর…”

বলে থামল শ্রেয়সী, ওর দুজন বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। আকাশে মস্ত একটা চাঁদ উঠেছে। জোছনার আলোয় ঘরে থাকে ফুলের ঘ্রাণ সব মিলিয়ে কেমন স্বপ্নালু পরিবেশ তৈরি করেছে।

“আর?” প্রশ্ন করল দীপ্ত।

শ্রেয়সী ফিসফিসে গলায় বলল, “আর এই ঘরের অধিবাসীকেও।”

শ্রেয়সীকে দেখল দীপ্ত, মুখে উদ্ভাসিত হাসিতে যেন আনন্দচ্ছটা খেলে যাচ্ছে। দীপ্তর এই ঘরে ঢোকার সময়ও মনে হচ্ছিল শ্রেয়সীকে সবকিছু খুলে বলবে। কিন্তু মেয়েটার এখনকার হাসিটুকু এত মায়াময়, এত প্রশান্তির, যে সেই চোখে-মুখে অন্য অনুভূতি আসুক তা দীপ্ত চাইতে পারল না।

“কত বিয়েই তো হচ্ছে, যেখানে আগে থেকে চেনাজানা পর্যন্ত থাকে না।”

শিমুলের বলা কথাটা মাথায় ঘুরল দীপ্তর। বিয়ে তো হয়েই গেছে, এখন আর সেসব ভেবে লাভ কী! এভাবেই শুরু হোক তবে, সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দিয়েই দেখা যাক৷

দীপ্ত এগিয়ে এসে শ্রেয়সীকে জড়িয়ে নিল আলিঙ্গনে।

“তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে, শ্রেয়সী।”

শ্রেয়সীও দুই হাতে জড়িয়ে ধরল ওকে৷ প্রথম আলিঙ্গন। একসময় দেখল দীপ্ত ওকে কোলে তুলে নিয়েছে। শ্রেয়সী ওর গলা জড়িয়ে ধরল যাতে পড়ে না যায়।

সময়জ্ঞান ভুলেছে শ্রেয়সী, ওর কেবলই মনে হলো ঘরে সাজানো ফুলেল সৌরভের পাশাপাশি ভালোবাসার মিষ্টি সৌরভ ওকে মোহাবিষ্ট করে ফেলেছে। বুক ভরে শ্বাস টেনে সেই ঘ্রাণ হৃৎপিণ্ডে ভরে নিতে চাইল যেন সে। ভালোবাসার প্রবল জোয়ার বইছে প্রকৃতিতে। আজ রাত কেবলই ভালোবাসার রাত, ভালোবাসায় ডুবে যাবার।

সব বদল খারাপ নয়, শ্রেয়সীর কাছে এই নতুন জীবনটা আজকের জোৎস্নালোকের মতোই স্নিগ্ধ, সেই আলোকের স্নিগ্ধতা গায়ে মেখে থাকুক আজীবন।

দীপ্ত এভাবেই ওকে ঘিরে রাখুক খেয়ালে, যত্নে, ভালোবাসায়, বিশ্বাসে। সম্পর্কের শুরুতে এটাই ওর হৃদয়ের একান্ত চাওয়া।
……………..
(ক্রমশ)