#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ২২)
নুসরাত জাহান লিজা
শ্রেয়সী রুমে এসে শুয়ে পড়ল। এখনো ধাতস্থ হয়ে উঠতে পারছে না যে দীপ্ত ওর সাথে এমন ব্যবহার করেছে। সে ভেবেছিল কিছুটা মন খারাপ করবে, অল্পবিস্তর রেগেও যেতে পারে। কিন্তু সেটা যে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যাবে সে ভাবতে পারেনি।
তবে ওর সবচাইতে বেশি কষ্ট হচ্ছে দীপ্তর একটা কথায়, মাথায় ঘুরেফিরে সেই কথাটাই কানে বাজছে,
“তোমার গহনা দরকার হলে আমাকে বলতে। যার তার কাছ থেকে কেন নিতে হবে?”
অথচ ওর গহনার প্রতি তেমন ফ্যাসিনেশন একেবারে নেই। এতটা ভুল ভাবনা দীপ্ত পুষে ওকে নিয়ে! কথাটা ভীষণ পোড়াচ্ছে শ্রেয়সীকে।
আবার দীপ্তর তার মাকে নিয়ে যে অপূর্ণতা আর আক্ষেপের কথা বলল, তাতে ওর প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতি জন্মেছে।
কষ্ট, রাগ সহানুভূতি সব কেমন একসাথে বইছিল ওর মনে। তবুও ঘুরেফিরে সেই আগের ভাবনাটাই, দীপ্ত ওকে লোভী ভাবল! এটা ভীষণ অসম্মানের। কতক্ষণ যে অতিবাহিত হলো ওর কেবল এপাশ ওপাশ করতে করতে সে জানে না। আজ আর ঘুম আসবে বলে মনে হয় না। অথচ কাল অফিস আছে সক্কাল থেকে।
***
দীপ্ত বারান্দার রেলিঙের সাথে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে বহুক্ষণ ধরে। পৃথিবীতে ওই একজন মানুষকে সে তার সমস্ত অন্তর দিয়ে ঘৃণা করে। মুখটা যেন ওর স্বপ্নেও কখনো হানা দিতে না পারে, তাই চায়৷ তবুও ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মধ্যে সেই মুখচ্ছবি ঠিকই হাজির হয় কখনো কখনো।
ওই সময়টা যদি মেমোরি সেল থেকে মুছে ফেলা যেত চিরতরে তবে হয়তো খানিকটা স্বস্তি মিলত।
স্কুলের সামনে যেখানে অভিভাবক জোন ছিল, সেখানে সবার মায়েরা আসত। সেখানে ওর মাকে নিয়ে, বাবাকে নিয়ে, ওকে নিয়ে চর্চা চলত। তখন সব না বুঝলেও কষ্ট পেত সে। সন্তানকে পরম মমতায় জড়িয়ে রাখার সময় তাদের যতটা কোমল, মাতৃসুলভ বলে মনে হতো, ঠিক এসব চর্চায় তাদেরকেও কী ভীষণ নির্মম বলে যে মনে হতো! দীপ্তর মনে হতো পালিয়ে যায় দূরে কোথাও।
সেই স্কুল বাবা বদলে দিলেন। দুঃস্বপ্ন খানিকটা কমল। তবুও এই সমাজ, একজন ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানের বেড়ে উঠার পথ সুগম করেনি। দীপ্ত আর অফিস, সাথে ঘর সব সামলাতে হিমসিম খাওয়া বাবার স্ট্রাগল সে চোখের সামনে দেখে বেড়ে উঠেছে। বাবা রান্না করতে গিয়ে কতবার হাত পুড়িয়ে রান্না শিখেছেন।
দীপ্ত সেই ছোট্ট বয়সেই বড় হয়ে গিয়েছিল, পারিপার্শ্বিকতা ওকে বড় করে তুলেছিল। সে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে উঠতে নিজেকে অন্যভাবে গড়ে নিয়েছিল। যাতে নিজের মধ্যে হান্ড্রেড পার্সেন্ট পারফেকশন থাকে। সবার মধ্যমণি যে সে-ই হয় যেকোনো আড্ডায় কিন্তু আসরে।
তিনি ডিভোর্সের আট মাসের মাথায় বিয়েও করে নেন। তখনও দীপ্ত বোকার মতো আশা পুষে রেখেছিল মা ফিরবে। একদিন শুনল ওর মায়ের আরেকটা সন্তান হয়েছে। যাকে তিনি ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে নেন। দীপ্ত কেঁদেছিল সেদিন পাগলের মতো। ওই ভালোবাসার কিছুটা তো ওরও প্রাপ্য ছিল। সে কেন পুরোপুরি বঞ্চিত হলো! ওর দোষটা কী ছিল! সেই সন্তান জন্মানোর পর বছর তিনেক তিনি কোনো যোগাযোগ করেননি।
আজ সিমপ্যাথি কেন চাইছেন তিনি! কী চান! শ্রেয়সী…..
মনে পড়ল শ্রেয়সীর কথা। ঘণ্টা দুয়েক অতিবাহিত হয়ে গেছে ততক্ষণে। দীপ্তর উত্তপ্ত মস্তিষ্ক খানিকটা স্থির হয়েছে। শ্রেয়সীর সাথে নিজের আচরণ মনে পড়ল। ওর তো কোনো দোষ নেই। বৃথাই ওর উপরে রাগ ঝেড়ে ফেলেছে। ওকে নিশ্চয়ই ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করেছে বলেই বাধ্য হয়ে নিয়েছে, তার ইমোশনকে আঘাত করতে চায়নি হয়তো।
তাছাড়া শ্রেয়সীকে সে একয়দিনে যেটুকু চিনেছে, তাতে এটুকু বুঝতে পেরেছে, তার আত্মসম্মানবোধ অত্যন্ত প্রখর। নাহ্! ভুল হয়ে গেছে ওর। ক্ষমা চাইতে হবে।
রুমে এসে আলো জ্বালালো না, নিঃশব্দে এসেছে বলে শ্রেয়সীর ছটফট সে খেয়াল করেছে। ঘুমোয়নি এখনো। কীভাবে ক্ষমা চাইবে তাই সে ভাবছিল। কিন্তু ডাকার মতো সাহস আপাতত সঞ্চয় করতে পারল না। সে পাশে শুয়ে শ্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরল।
শ্রেয়সী বলল, “কাল অফিস আছে৷ আমি ঘুমাব। গায়ে হাত দিও না। ভাল্লাগছে না।”
দীপ্ত কাতর গলায় বলল, “আমার হৃদয়ে দগদগে ক্ষত আছে। তুমি তাতে একটু প্রলেপ দিয়ে দাও প্লিজ। আমি একটু শান্তিতে ঘুমাতে চাই আজ।”
শ্রেয়সীর রাগ পড়েনি, তবে এমন করে বলল দীপ্ত যে এড়াতে পারল না। সে দীপ্তর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করল আলতো করে।
“বাবা আমার সবচাইতে কাছের বন্ধু। তবুও সমস্ত কথা তার সাথে শেয়ার করা যায় না। তুমি আমার তেমন বন্ধু হবে শ্রেয়সী যাকে হৃদপিণ্ড খুলে সবকটা প্রকোষ্ঠে কী জমে আছে তার সমস্তটা খুলে দেখানো যায়?”
……….
(ক্রমশ)
#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ২৩)
নুসরাত জাহান লিজা
শ্রেয়সী তখনও একটা হাতে দীপ্তর পিঠে মাথায় হাতের স্পর্শে ওকে শান্ত করতে চাইছে। দীপ্ত ফুঁপিয়ে উঠছে নিঃশব্দ কান্নায়। শ্রেয়সীও নিশ্চুপ। নৈঃশব্দ্য জায়গা করে নিয়েছে ঘর জুড়ে। দীপ্তর ভীষণ ভালো লাগছে আলতো স্পর্শটুকু। যে স্পর্শে বন্ধুতা আছে, মায়া আছে, ভালোবাসা আছে, ভরসাও আছে।
ধীরে ধীরে ধাতস্থ হয়ে এলো দীপ্ত। সেই প্রথম নৈশব্দ ভাঙল, “হবে আমার তেমন বন্ধু?”
শ্রেয়সীর অভিমান হলো, এখনো ওকে বুঝতে পারল না! আলতো স্বরে বলল, “উত্তর পাওনি বুঝি? সব কথা মুক্তি বলে প্রকাশ করতে হবে?”
দীপ্ত শ্রেয়সীর দিকে আরও ঘেঁষে এসে বলল, “আমি ভয় পাই যে।”
“কীসের ভয়?”
“হারাবার।”
“কেন?”
দীপ্ত উত্তর দিতে পারল না। হৃদয় খুলে দিতে চাইলেও পুরোটা কি সে খুলতে পারবে! বিয়ের ব্যাপারে শুরুতে যে হঠকারিতার আশ্রয় নিয়েছিল, সেই কপটতা কি শ্রেয়সী ক্ষমা করতে পারবে!
“কেন, বললে না?”
“জানি না। তবে তোমার সাথে এই একটা মাস থাকতে থাকতে এটুকু বলতে পারি, তুমি আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছ। তোমার সাথে একসাথে মুড়ি আর চা খেতে খেতে খেলা দেখা, মুভি দেখা, রান্না ঘরের খুঁনসুটি, তোমার আমাকে বুঝতে পারা সবকিছু কেমন যেন আমার ভীষণ আপন হয়ে গেছে। অপরিহার্য হয়ে গেছে তোমার সঙ্গ। প্রয়োজন এডজাস্ট করে নেয়া যায়, কিন্তু অপরিহার্য কিছুর এডজাস্টমেন্ট হয় না। তুমি কখনো আমাকে ছেড়ে গেলে আমার শ্বাস আটকে যাবে!”
শ্রেয়সী দীপ্তকে সরিয়ে উঠে বসল। তারপর ওকেও বসালো। শ্রেয়সী রেগে শুয়েছিল বলে জানালার পর্দা সরানো হয়নি। সেদিক থেকে আবছা চাঁদের আলো আসছে। তাতে দীপ্তকে দেখল সে। তারপর ওকে জড়িয়ে ধরল। এরপর বলল,
“তোমার কেন মনে হলো আমি চলে যাব? চলে যাবার জন্য আমি তোমার হাত ধরিনি। ভালোবেসে ধরেছি। ভালোবাসা এত ঠুনকো নয়।”
“তুমি রেগে নেই আর?”
শ্রেয়সী সরে এলো। কিছুক্ষণ আগের কথাগুলো মনে পড়ল। সাথে সাথে উত্তর দিল না। ওদিকে দীপ্ত কেমন অস্থির হয়ে উঠছে।
“রেগে আছি এখনো এটা সত্যি। তুমি আমাকে যা বলেছ তা ভীষণ অসম্মানজনক আমার জন্য। আমি সব সহ্য করে নিতে পারব, কিন্তু অসম্মান আর কপটতা আমি নিতে পারি না। দ্বিতীয়টা তোমার মধ্যে পাইনি। সম্পর্কে রেসপেক্ট জিনিসটা ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট। আরেকটা হলো বিশ্বাস। এই দুটো জায়গায় আঘাত করো না। আমি কোত্থাও যাব না।”
এটুকু বলে দীপ্তর হাত নিজের হাতে জড়িয়ে শ্রেয়সী বলল, “কথা দিলাম।”
দীপ্ত ঘোরগ্রস্ত চোখে শ্রেয়সীকে দেখল কিছুক্ষণ। অপরাধবোধে পুড়ে সে বলল, “স্যরি।”
“স্যরি বলতে হয় এমন কিছু কোরো না প্লিজ। আমার কষ্ট হয়। আমি তোমাকে ভরসা করে তোমার সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছি, তোমার শোক, সুখ সবকিছুর সাথেই। শেষ নিঃশ্বাস অব্দি থাকতে চাই।”
দীপ্ত বলতে চাইল, “তোমার ভরসা কখনো টলতে দেব না।” কিন্তু বলতে পারল কই! সে তো এখনো কপটতারই আশ্রয় নিল! ভরসা তো সে শুরুতেই ভেঙে রেখেছে। ওই সময়টা যদি মুছে ফেলা যেত! কী ছেলেমানুষি যে তখন মাথায় চেপেছিল। অথচ সে নিজেকে বলে সে নাকি অনেক পরিণত, ‘পারফেক্ট’। ভুল চিনেছিল নিজেকে।
সে এত কথা বলল, অথচ ‘ভালোবাসি’’ বলতে পারল না। মনে পড়ল ওর বাবা, মা পরস্পরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। ভালোবাসা ঠুনকো না হলেও অতটা মজবুত কী! তবুও সে আজ শ্রেয়সীকে হারাবার ভয় পেয়েছে। এটা তো ভালোবাসাই, সে তো ভালোবাসে, এটা উপলব্ধি করে, কিন্তু মুখে বলতে পারে কই! বললেই যদি ফিঁকে হয়ে যায় ভালোবাসার প্রগাঢ় রঙটা! বে-রঙিন ভালোবাসা বড্ড যাতনার। সে-ই যাতনা ওর সহ্যাতীত।
“আমি বাইরে যতটা গোছানো, ভেতরে ভেতরে ততটাই ভাঙাচোরা। তুমি আমাকে গড়ে পিটে নিও শ্রেয়সী। মানুষ তো যদি কখনো ভুল করি, আমাকে শুধরে দিও এভাবেই পাশে থেকে। আমি নতুন করে আর কোনো ভুল করব না।”
এই কথার নিগূঢ় তাৎপর্য শ্রেয়সী বুঝল না, সে আজকের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই কথা ধরে নিল।
শ্রেয়সী দীপ্তর চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, “এবার একটু হাসো তো দেখি। এরকম দেবদাস দেবদাস লুকে তোমাকে মানাচ্ছে না। দেখতে পঁচা লাগছে। এমন দেখালে তোমার সিক্রেট এডমায়ারার হু হু করে কমে যাবে।”
গোমট পরিবেশ হালকা করার জন্য কথাটা বলল শ্রেয়সী, দীপ্ত বলল, “তুমি তো এটাই চাও।”
“আমি তো কত কিছুই চাই। সব তুমি বোঝো?”
দীপ্ত এবার স্মিত হাসল, “কী চাও শুনি?”
“তুমি দেবে কি-না সেটা বলো।”
“সামর্থ্যের মধ্যে হলে অবশ্যই দেব।”
শ্রেয়সী খিলখিল করে হেসে উঠল, সে-ই হাসি ছন্দ তুলল দীপ্তর কানে। সপ্তসুর যেন মিশে আছে সেই ছন্দে। হাসিতে যে এমন সুর আর ছন্দ থাকে তা দীপ্ত জানত না।
“ভয় পেয়ে গেলে? ভয় নেই, আকাশের চাঁদ চাইব না। তোমার সামর্থ্যের মধ্যেই চাইব।”
“এ্যাহ! আমি ভয় পাই নাকি! বলেই দেখো!”
“তোমার মুখে সবসময় হাসি দেখতে চাই। তোমার ছেলেবেলা তো আর ফিরে আসবে না। কিন্তু সামনে যে জীবনটা পড়ে আছে, সেখানে পুরনো দুঃসহ স্মৃতিকে স্থান দিও না। তোমাকে খুশি দেখলে বাবা ভীষণ আনন্দিত হন।”
খানিকটা থেমে দুষ্টু হেসে শ্রেয়সী আরও একটা শব্দ যোগ করল, “আমিও।”
দীপ্তর হাসি বিস্তৃত হলো, শ্রাবণের প্রকৃতির মতো এই আচমকা জমে উঠা ছোঁপ ছোঁপ কালো মেঘ সরে গিয়ে ওদের আকাশে কাশফুলের সাদায় আকাশে সাদা মেঘেরা হুটোপুটি খেতে শুরু করল। দীপ্ত উঠে গিয়ে জানালার পর্দা ঠিক করে দিল।
এই ঘর মান অভিমান সরিয়ে আরেকটা ভালোবাসা সিক্ত রাতের স্বাক্ষী হলো।
……….
(ক্রমশ)